সদর দরজা খুলে দিয়ে সন্তু দেখল
সদর দরজা খুলে দিয়ে সন্তু দেখল, বাইরে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তারই সমবয়েসি। জিন্স আর হলুদ টি-শার্ট পরা। খুব ফরসা রং, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে।
প্রথম দেখেই সন্তুর মনে হল, এ কলকাতার ছেলে নয়। কেন এরকম মনে হয়, তা ব্যাখ্যা করা যায় না। তার মুখের ভাবে কিংবা দাড়াবার ভঙ্গিতে যেন খানিকটা আড়ষ্টতা আছে। কয়েক পলক সোজাসুজি তাকিয়ে থেকে ছেলেটি বুকের কাছে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার। আমার নাম পুড়ু হ্যালডার। আমার বাবার নাম জি সি হ্যালডার। আমি কাকাবাবু ভদ্রলোকের সঙ্গে মিট করটে, না, ভিজিট করটে, না, সাক্ষাৎ করটে এসেছি।
এর কথা বলার ভঙ্গিও শুধু যে আড়ষ্ট তাই নয়, মনে হয় যেন মুখস্থ বলছে।
অবাঙালিরা যখন ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলে, তা একরকম শোনায়। আর সাহেবদের দেশের লোকরা যে ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলে, তা অন্যরকম। বোঝাই যায়, এ-ছেলেটি এসেছে সাহেবদের দেশ থেকে।
সন্তু বলল, ভেতরে আসুন।
ছেলেটি বলল, আপনার নাম জানটে পারি কি?
হ্যাঁ। সুনন্দ রায়চৌধুরী।
গ্ল্যাড টু মিট য়ু। না, না, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভেরি প্লিজ, না, খুব খুশি হয়েছি। কোথায় ঝুটো খুলতে হবে?
কী খুলতে হবে? ঝুটো, ঝুটো!
ছেলেটি আঙুল দিয়ে পায়ের দিকে দেখাতে সন্তু বলল, ও, জুতো? না, খুলতে হবে না।
ছেলেটি বলল, কাডা।
সন্তু বলল, কাডা? মানে, কাদা লেগেছে? তা হলে দরজার পাশে খুলে রাখুন।
ছেলেটি নিচু হয়ে জুতো খোলর পর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট বার করে বলল, দিস ইজ আ গিফট ফর ইউ।
সন্তু বলল, আমার জন্য? থ্যাঙ্ক ইউ। কাকাবাবুর সঙ্গে আপনার কী দরকার, তা আমাকে বলবেন কি? এই সময় উনি একটু ব্যস্ত থাকেন।
ছেলেটি বলল, আমার বাবা কাকাবাবু ভদ্রলোককে একটা মেসেজ, না, না, একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। আমি সেটা নিজের হাটে দিটে চাই।
ঠিক আছে, ওপরে চলুন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ইফ আই রিমেম্বার কারেক্টলি, এ বাড়িটে সন্তু নামে কেউ থাকে?
সন্ত বলল, আমারই ডাকনাম সন্তু।
ছেলেটি সন্তুর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল, আমি পুড়ু। আমার কোনও নিক নেইম নেই। আপনাকে আমি টুমি বলতে পারি?
সন্তু বলল, নিশ্চয়ই। আমিও তুমি বলব। তুমি কোথা থেকে এসেছ?
ছেলেটি বলল, ডাক্কি, ডাক্কি। ডাক্কিনেশোয়ার।
সন্তু বলল, দক্ষিণেশ্বর? এখন সেখান থেকে আসছ? তার আগে কোথায়, ছিলে?
ছেলেটি বলল, কানেটিকাট!
কাকাবাবু যথারীতি বসে আছেন ইজি চেয়ারে। পাজামা আর গেঞ্জি পরা। সামনের একটা টেবিলে অনেক বই আর কাগজপত্র ছড়ানো। আর একটা কফির কাপ। কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন টেলিফোনে।
ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। কাকাবাবু সন্তুর সঙ্গে একটি অচেনা ছেলেকে, দেখে চোখের ইঙ্গিতে চেয়ারে বসতে বললেন, কিন্তু ছেলেটি বসল না।
টেলিফোনে কথা শেষ করার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, এ ছেলেটি কে?
সন্তু কিছু বলার আগেই ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কে?
ছেলেটি বলল, মাই নেইম, সরি। আমার নাম পুড়ু হ্যালডার। কাকাবাবু, আপনি আমার রেসপেক্ট, রেসপেক্ট, আই মিন, রেসপেক্ট…
সন্তুর দিকে মুখ ফিরিয়ে সে কাতরভাবে জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ দা বাংলা ফর রেসপেক্ট?
সন্তু বলল, শ্রদ্ধা, ভক্তি।
ছেলেটি বলল, থ্যাঙ্কস! ইয়েস, কাকাবাবু, আপনি আমার শ্ৰড্ডা আর ভক্টি গ্রহণ করবেন।
কাকাবাবু বললেন, বেশ। তা তুমি কার কাছ থেকে এসেছ?
ছেলেটি বলল, মাই ফাদা… আমার বাবার নাম জি সি হ্যালডার। আপনি নিশ্চিট ভাল থাকসেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যালডার? তার মানে হালদার। জি সি? জি সি?
ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে একটা বড় সাদা খাম বার করে এগিয়ে দিল কাকাবাবুর দিকে।
খামটা সেলোটেপ দিয়ে আঁটা। খোলার বদলে সেটা ছিঁড়ে ফেলতে হল। একটা সাদা কাগজে শুধু গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা :
ওরে শেয়াল,
বনগাঁয়ে কেমন রাজত্ব চালাচ্ছিস?
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সে-দিকে। তারপর চিঠিটা সন্তুকে দেখিয়ে বললেন, কিছু বুঝতে পারছিস?
সন্তু কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু কাকাবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। ছেলেটিকে বললেন, তুমি বোসো।
ছেলেটি বসল না, পাশের টেবিলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইজ দ্যাট ইয়োর কম্পিউটার?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ।
ছেলেটি বলল, মে আই, আমি কি, ইউজ, আই মিন ব্যবহার করটে পারি?
কাকাবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
ছেলেটি প্রায় ছুটে গিয়ে কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। কম্পিউটারটা চালুই ছিল, সে কি-বোর্ডটা টেনে নিয়ে শুরু করে দিল খটাখট।
সন্তুও এখন কম্পিউটার ব্যবহার করতে শিখেছে। সে গিয়ে দাড়াল ছেলেটির পাশে। তখনই আবার বেল বেজে উঠল নীচের সদর দরজার। রঘু এই সময় বাজারে যায়, সন্তুকেই দরজা খুলতে হয়।
এবারে দরজা খুলে দেখল, মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা। তার পেছনে একজন শাড়ি পরা মহিলা, গায়ের রং মেমসাহেবদের মতন ফরসা, তবু বাঙালি বলে বোঝা যায়।
সন্তু ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারল না, কিন্তু মহিলাটিকে একটু একটু চেনা মনে হল।
ভদ্রলোক বললেন, কী রে, তুই সন্তু না? ইস, কত বড় হয়ে গেছিস!
মহিলাটি বললেন, বড় হবে না? বয়েস কি কারুর থেমে থাকে? প্রায় আট বছর পরে এলাম।
ভদ্রলোক বললেন, আট না, ন বছর। কেমন আছিস রে সন্তু? তোর মা বাবা কেমন আছেন? তোর বাবা আমার মাস্টারমশাই ছিলেন, চল আগে তাঁকে প্রণাম করব।
সন্তু বলল, মা-বাবা ভাল আছেন। কদিনের জন্য বেড়াতে গেছেন শান্তিনিকেতনে।
ভদ্রলোক বললেন, ওঁরা বাড়ি নেই? আর তোর কাকা, সে-ও গেছে?
সন্তু বলল, না, কাকাবাবু আছেন। ওপরে চলুন।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, সে কী করছে?
সন্তু বলল, বনগাঁয়ে রাজাগিরি করছেন।
ভদ্রলোক হেসে ফেলে বললেন, বুঝেছিস তা হলে? স্মার্ট বয়!
ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, মানে কী হল? ভদ্রলোক বললেন, ওর কাকার সঙ্গে আমি এক ইস্কুলে এক ক্লাসে পড়েছি। ওর নাম তো রাজা, আমরা ওকে বলতাম বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা! তবে, ও ছিল সব ব্যাপারে আমাদের লিডার। ইস্কুলের বন্ধুরা আমাকে কী বলে ডাকত জানো? গোবর্ধন! গৌ থেকে গোবর, তার থেকে গোবর্ধন!
মহিলা বললেন, বাবা রে বাবা, কীসব অদ্ভুত নাম!
সন্তুর তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল। সে বলল, আপনি তো মিলিকাকিমা?
দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। ভদ্রলোক বললেন, এতক্ষণ চিনতে পারিসনি বুঝি? কাকিমাকে আগে চিনলি কী করে? আমি গৌতমকাকু।
এক-একজনকে এক-একটা বিশেষ কারণে মনে থেকে যায়। মিলিকাকিমা মাঝে-মাঝেই বলেন, বাবা রে বাবা! তখন তার নীচের ঠোঁটটা উলটে যায়,
তাকে আরও সুন্দর দেখায়।
ওঁদের দুজনকে দেখেই কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। গৌতমকাকুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কী রে কেমন আছিস? কবে এলি, আগে থেকে কোনও খবরও দিসনি! মিলি, তুমি তো একই রকম আছ দেখছি।
গৌতমকাকু বললেন, খবর দিইনি, তোকে চমকে দেওয়ার জন্য। ফোনও করিনি। আমাদের ছেলেটা এসেই কম্পিউটারে বসে গেছে? দক্ষিণেশ্বরে মামার বাড়িতে উঠেছি। সে বাড়িতে কম্পিউটার নেই, তাই ছটফট করছিল। এই বয়েসের এরা তো কম্পিউটারের পোকা!
কাকাবাবু বললেন, তোর ছেলেকে চিঠিটা দেখার আগে চিনতে পারিনি। বাবার নাম বলেছে জি সি হ্যালডার। যদি বলত গোবর্ধন…
মিলিকাকিমা বললেন, এই, ওরকম বিচ্ছিরি নামে ডাকবে না।
গৌতমকাকু বললেন, গোবর্ধন বিচ্ছিরি তো নয়। আমার বেশ ভাল লাগে। আমাদের ছেলেটা ঠিকঠাক এসে বাংলায় কথা বলেছে?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ও তো সুন্দর বাংলা কথা বলে।
গৌতমকাকু বললেন, ওদেশের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখতেই চায় না। আমরা অবশ্য সবসময় ছেলের সঙ্গে বাংলায় কথা বলি। এখানে কোনও বাড়িতে যাওয়ার আগে আগে ওকে একলা পাঠিয়ে দিয়ে দেখি সব ঠিকঠাক বলতে পারে কি না!
কাকাবাবু বললেন, সবই ঠিক বলেছে। তবে ওর নামটা বুঝতে পারলাম না। পুড়ু? এটাই ওর ভাল নাম?
গৌতমকাকু বললেন, পুড়ু নয়, পুরু। ও যখন জন্মায়, তখন আমরা গ্রিসে ছিলাম। অনেকে বলল, ছেলের নাম রাখো আলেকজান্ডার! আমি বললাম, কেন? আমরা ভারতীয়। আলেকজান্ডার ভারতে গিয়ে মহারাজ পুরুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। সেই বীরের প্রতি বীরের মতন ব্যবহার, মনে নেই? ওর নাম সেই পুরু।
কাকাবাবু বললেন, পুরু? বেশ ভাল নাম। পুড়ু শুনে ধরতে পারিনি।
গৌতমকাকু বললেন, আমরা তো বাঙাল, তাই র আর ড়-এর গোলমাল হয়ে যায়।
কাকাবাবু বললেন, তুই বাঙাল হতে পারিস, ও কী করে বাঙাল হবে? ও কি ওসব দেশ দেখেছে?
গৌতমকাকু বললেন, রক্তের মধ্যে থেকে যায়।
কাকাবাবু বললেন, অধিকাংশ সাহেব ত উচ্চারণ করতে পারে না কেন বুঝি না। তুমি-কে বলে টুমি, আস্তে-কে বলে আটে! আমরা তো ত আর ট দুটোই বলতে পারি।
গৌতমকাকু বললেন, হ্যাঁ, এটাই মজার ব্যাপার। ত বলতে পারে না, থ আর দ পারে, কিন্তু ধ বলতে অসুবিধে হয়। আর চন্দ্রবিন্দু তো একেবারেই অসম্ভব। কোনও সাহেব চঁাদ বলতে পারবে না।
মিলিকাকিমা বললেন, বাঙালরাও চাঁদ বলতে পারে না। ফাঁদ বলতে পারে।
গৌতমকাকু বললেন, এই তো আমি বলতে পারি, চাঁদ, চাঁদ, চাঁদ। ফাঁদ, ফাঁদ, ফাঁদ। কাঁদো নদী কাঁদো। বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও! আমি সব চন্দ্রবিন্দু পারি। আমার ছেলেরও সব উচ্চারণ ঠিক করে দেব।
এই সময় রঘু দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, চা কফি কিছু লাগবে?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, লাগবে।
গৌতমকাকু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, এ রঘু না? কতকালের পুরনো লোক। কী রঘু, আমায় চিনতে পারছ?
রঘু বলল, কেন পারব না। আপনি তো সেই গোবর্ধন দাদাবাবু।
সবাই হেসে উঠল। শুধু মিলিকাকিমা ঠোঁট উলটে বললেন, বাবা রে বাবা!
পুরু এমন একমনে কম্পিউটার দেখে যাচ্ছে যে, অন্য কিছু যেন শুনছেই না।
গৌতমকাকু বললেন, রঘু, ছোটবেলায় আমি যখন এ বাড়িতে আসতাম, তখন এ-পাড়ার একটা দোকানে খুব ভাল শিঙাড়া পাওয়া যেত, ভেতরে কিশমিশ দেওয়া। সেই শিঙাড়া খাওয়াবে?
রঘু একগাল হেসে বলল, সে-দোকানটা কবে উঠে গেছে। এখন সেখানে দরজির দোকান।
সন্তু বলল, হাজরার মোড়ে একটা দোকানে ভাল শিঙাড়া পাওয়া যায়, নিয়ে আসব?
মিলিকাকিমা বললেন, না না, শিঙাড়া খেতে হবে না। খেলেই ওর পেট খারাপ হবে।
গৌতমকাকু বললেন, হোক পেট খারাপ। তবু খাব। কলকাতায় এসে শিঙাড়া না খেলে চলে?
কাকাবাবু বললেন, তোদের ওদেশে শিঙাড়া পাওয়া যায় না? আজকাল তো শুনেছি সবই পাওয়া যায়।
গৌতমকাকু বললেন, পাওয়া যায় মাঝে-মাঝে। কিন্তু কলকাতার মতন কি স্বাদ হয়? যা তো সন্তু, নিয়ে আয়। পুরুকেও সঙ্গে নিয়ে যা। ও কলকাতার রাস্তাঘাট চিনুক। দোকানে গিয়ে ওকে কথা বলতে দিবি! এই পুরু, ওঠ।
পুরু বাধ্য ছেলের মতন কম্পিউটার ছেড়ে উঠে এল।
গৌতমকাকু বললেন, দোকানে গিয়ে পনেরোটা শিঙাড়া কিনবি। কী বলবি?
পুরু বলল, পনেরো মানে হাউ মেনি?
গৌতমকাকু বললেন, পনেরো মানে পনেরো। ফিফটিন। তোকে বাংলা এক-দুই শিখিয়েছিলাম, ভুলে গেছিস? সন্তু তোকে ভাল করে বাংলা শিখিয়ে দেবে।
সন্তু পুরুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
কাকাবাবু তাঁর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এখন কোথায় থাকিস?
গৌতমকাকু বললেন, কানেটিকাট। বাংলায় যাকে বলে কানেকটিকাট। নিউ ইয়র্কের পাশেই।
কাকাবাবু বললেন, তোরা তা হলে ওদেশেই থেকে গেলি, আর ফিরবি না? গৌতমকাকু বললেন, আর কি ফেরা হবে? ছেলেটা ওদেশে পড়ছে। এখন এখানে এলে পড়াশুনোয় সুবিধে করতে পারবে না। মিলি আর আমি হয়তো বুড়ো বয়েসে ফিরে আসব। পুরু ওদেশে থেকে গেলেও ও যাতে বাঙালি পরিচয়টা ভুলে না যায়, সে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওকে আমি বাংলাটা ভাল করে শেখাবই। বাংলা বইটই পড়তে পারে।
মিলিকাকিমা বললেন, বাবা রে বাবা! তুমি এক-একসময় এত বাড়াবাড়ি করো। ছেলেটা বাংলা কথা খুঁজে না পেয়ে হাসাস করে।
গৌতমকাকু বললেন, আর একটা বছর চাপে রাখলেই ও সব শিখে যাবে। তোমাকে বারণ করেছি না, ওর সঙ্গে কক্ষনও ইংরিজিতে কথা বলবে না!
কাকাবাবু বললেন, শুধু বই পড়ে কি বাংলা শেখা যায়? দেশটাকেও চেনাতে হয়। তুই নিজেও তো পশ্চিমবাংলার অনেক কিছুই দেখিসনি।
গৌতমকাকু বললেন, দেখব কী করে? উনিশ বছর বয়েসে বিদেশে চলে গেছি। মিলির বাপের বাড়ি কানপুরে, ও কলকাতা ছাড়া আর কিছুই চেনে না। কলকাতার এত কাছে সুন্দরবন, তাও কখনও যাওয়া হয়নি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, চা বাগান দেখেছিস?
মিলিকাকিমা বললেন, শুধু ছবিতে দেখেছি। বিদেশেও দার্জিলিং-এর চায়ের খুব নাম। অনেক সাহেব-মেমও জিজ্ঞেস করে, এ তো তোমাদের দেশের চা, তোমরা সে চা-বাগান দ্যাখোনি?
কাকাবাবু বললেন, উত্তরবঙ্গ ভর্তি চা-বাগান। সেখানে অনেক জঙ্গলও আছে। আর কালিম্পং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য কী অপূর্ব। আরও কত ভাল ভাল জায়গা আছে।
গৌতমকাকু বললেন, রাজা, তা হলে এক কাজ করা যাক। তোর হাতে কি এখন খুব কাজ আছে? না থাকলে, চল না, সবাই মিলে কোনও একটা জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসি কয়েকদিনের জন্য। তুই যে-জায়গা ঠিক করবি, আমরা সেখানেই যাব।
মিলিকাকিমা বললেন, তা হলে খুব ভাল হয়। চলুন না, প্লিজ চলুন। আমার চা-বাগান দেখারই খুব ইচ্ছে।