Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সর্বনেশে মাদুলি || Sarbaneshe Maduli by Lila Majumdar

সর্বনেশে মাদুলি || Sarbaneshe Maduli by Lila Majumdar

পুজোর ছুটির পর যখন স্কুল খুলল, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম গুপে ডান হাতে মাদুলি বেঁধে এসেছে। কনুইয়ের একটু উপরে ময়লা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা চকচকে এক মাদুলি। আমি ভাবলাম সোনার বুঝি, কিন্তু গুপে পরে বলল নাকি পেতলের। ঘাম লেগে লেগে সোনার মতো হয়ে গেছে।

টিফিনের সময় জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? তাতে সে এক আশ্চর্য কথা বলল।

তার দাদামশায়ের নাকি যখন অল্প বয়েস, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের তলায় চকচকে এক কুচকুচে কাগের পালক। প্রথমটা খুব খুশি হলেন। ভাবলেন দিব্যি এক খাগের কলম বানিয়ে বন্ধুদের লম্বা লম্বা চিঠি লেখা যাবে। পরে শিউরে উঠলেন। কী সর্বনাশ! কাগ যে ছুঁতে নেই, ইয়ে-টিয়ে খায়, তার পালক বালিশের তলায় এল কোত্থেকে? আর কেউ দেখবার আগেই সেটাকে জানলার শিকের ফঁক দিয়ে উঠোনে ফেলে দিলেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিনও ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের নীচে আবার আরেকটা কাগের পালক! এবার আর কোনো সন্দেহই নেই, দস্তুরমতো কাগ কাগ গন্ধ পর্যন্ত পেলেন। দাদামশাই সেইদিনই মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন, চুল ন্যাড়া করলেন, পাশের বাড়ির লোকদের তাদের গাছ-ছাঁটা কঁচিটা ছ-মাস বাদে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন, গঙ্গাস্নান করলেন।

স্নান করে উঠে, ঘাটের উপর দেখেন দিব্যি ফোঁটা কাটা, তিলক আঁকা, জটাওয়ালা, গেরুয়াপরা এক সন্ন্যাসী বাবা হাসি হাসি মুখ করে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন। দাদামশাই তাকে ঢিপ করে প্রণাম করলেন। অমনি সন্ন্যাসী তার ডান হাতের কনুইয়ের উপর ওই লাল সুতো দিয়ে মাদুলিটা বেঁধে দিয়ে, দাদামশাইয়ের ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কু ডর নেই বেটা। শাপখোঁপ সব কেটিয়ে যাবেন।

দাদামশায়ের ঘাড়ে খুব সুড়সুড়ি লাগা সত্ত্বেও তিনি শুধু একটু কিলবিল করে বললেন, ঠিক বলছ তো ঠাকুর?

গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সন্ন্যাসী ঠাকুর ঝুলির মধ্যে থেকে সুতো বাঁধা এক চশমা বের করে নাকে পরেই আঁৎকে উঠে বললেন, তাঁ! এ কী আছে রে? আরে আমি তো তোমাকে চিনতে পারেনি, উ মাদুলি পলটু জমাদার কো আস্তে বনায়া, দে দে রে বেটা, উ তোমারা নেহি।

কিন্তু কে শোনে? দৈবাৎ অমন মাদুলি মানুষের জীবনে এক-আধবার ঘটে যায়। তাকে কি অমনি অমনি দিয়ে দেওয়া যায়? দাদামশাই ছপাত করে মালকোঁচা মেরে দে দৌড়!

বাড়ি এসে অবাক হয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির আম গাছের যে ডাল পাকা পাকা আমসুষ্ঠু তাঁদের উঠোনের উপর ঝুলছিল, অথচ পাছে নেপালবাবুপুঁতে ফেলেন সেই ভয়ে কিছু করা যাচ্ছিল না, সেসব আম আপনি-আপনি দাদামশায়ের উঠোনে পড়ে গেছে। দেখা গেল নতুন কুয়োতেও ভোর থেকে ঠান্ডা মিষ্টি জল আসছে। রাত্রে ফেলাদা পুকুরে যে ছিপ ফেলে রেখেছিল তাতে মস্ত এক কাতলা মাছ পড়েছে। বেলা না হতেই দাদামশায়ের শালা, গত বছর যে পাঁচ টাকা ধার নিয়েছিল, নিজে থেকে ফেরত দিয়ে গেল। উপরন্তু রবিবার দুপুরে নেমন্তন্ন করে গেল। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখলেন এমনকী দিদিমার পর্যন্ত হাসিমুখ।

মাদুলির গুণ দেখে দাদামশাই অবাক। মনে মনে সন্ন্যাসী বাবার ময়লা পায়ে শত শত প্রণাম করলেন।

সে থেকে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরে গেল। টাকা-পয়সা হল, গোরু-ভেড়া হল, ছেলেরা বড়ো বড়ো চাকরি পেল, মেয়েদের ভালো ভালো বিয়ে হল। এমনকী মামার বাড়ির গোরুর দুধের ক্ষীর, গাছের আম, আর পুকুরের মাছের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনার চোটে গুপে লোম-হর্ষণ সিরিজ-এর বিশ নম্বর বইয়ের পাঁচ ছ-টা পাতার কোনা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।

আরও বলল: এই সেই মাদুলি। একচল্লিশ বছর এক মাস দাদামশায়ের হাতে বাঁধা ছিল, একদিনের জন্যও ভোলা হয়নি, দাদামশায়ের হাতে সুতোবাঁধা মাদুলির সাদা দাগ পড়ে গেছে, গায়ে লেগে শেষটা এমন হয়েছিল যে মাঝে মাঝে নাকি মাদুলিটার উপরও চুলকতো!

সেই মাদুলি দাদামশাই এককথায় গুপের হাতে বেঁধে দিয়েছেন কারণ গুপে বায়না ধরেছিল যে মাদুলি না দিলে নাকি সে তেলও মাখবে না, চানও করবে না, ভাতও খাবে না। আর নেহাত যদি খায়ও তাহলে এত কম খাবে যে কিছুদিন বাদে পেট না ভরে ভরে হাত-পা ঝিমঝিম করবে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, চোখ উলটে যাবে–এই অবধি শুনেই দাদামশাই কানে হাত দিলেন ও তখনি পট করে মাদুলির সুতো ছিঁড়ে সেটাকে গুপের হাতে বেঁধে দিলেন।

গুপে দেখলে মাদুলির গুণ একটুও কমেনি। আধ ঘণ্টার ভিতর ছোটোমামার ফাউন্টেন পেনের নব খারাপ হয়ে গেল, ছোটোমামা সেটা গুপেকে দিয়ে দিল। পরে অবিশ্যি আবার চেয়েছিল, তাইতেই তো গুপে ছুটির দু-দিন বাকি থাকতেই মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিল।

বাড়ি এসেই শোনে মাস্টারমশাইয়ের মাম্পস হয়েছে, গাল ফুলে চালকুমড়ো, সেরে যদি-বা ওঠেনও তবু একটি মাসের ধাক্কা।

এরপর গুপে যা-তা বলতে আরম্ভ করল। নাকি মাদুলি হাতে পরা থাকলে গুপে যখন যা বলবে তাই ঘটতে বাধ্য। একথা শুনে আমরা সবাই ভীষণ আপত্তি করলাম, তা কি কখনো হয়?

নগা বললে, এক যিশু ছাড়া আর কেউ

গুপে ভীষণ রেগে সরু লম্বা ময়লা নখওয়ালা একটা আঙুল নগার দিকে বাগিয়ে বলল, আজ বলে দিলাম তুই ভূগোল ক্লাসে দাঁড় খাবি।

ওমা! সত্যি সত্যি ভূগোল ক্লাসে নগা দাঁড় তো খেলই, তার উপর কানমলাও খেল! এরপর আর কারুর কিছু বলবার জো নেই। গুপে এক বার মাদুলির দিকে তাকালেই হল, সে যখন যা বলে সবাই তা মেনে নেয়। যখন যা চায় সবাই তাই দিয়ে ফেলে।

তিন সপ্তাহক্লাসসুদ্ধ সবাই গুপের দৌরাত্ম্যে খাবি খেলাম। সে খুশি তাই করতে আরম্ভ করল। এমনকী কালীপদর চুল ছাঁটা পছন্দ হচ্ছিল না বলে সে বেচারাকে ন্যাড়া করিয়ে ছাড়ল।

সবাই দিন দিন রোগা হয়ে যেতে লাগলাম।নগার তো পেন্টেলুন এমন ঢিলে হয়ে গেল যে শেষে তার দাদা তাই নিয়ে টানাটানি। বলে কি না–দেখছিস না, ও আমার, তোর গায়ে বড়ো হচ্ছে। হয় আমার, নয় বাবার।

এদিকে যার যা ভালো জিনিস গুপে সব গাপ করতে লাগল। পেনসিল, রবার, পেনসিলকাটা, রঙিন খড়ির বোঝায় গুপের পকেট ঝুলে ঝুলে ছেড়ে আর কী! শেষে কি না সেসব রাখবার জন্য আমার নতুন টিফিনের বাক্সটা একদিন চেয়ে বসল। তখন আমি বেজায় চটে গেলাম। একটু তোতলামি এসে গেল। মাথাটাথা নেড়ে বললাম- দ্যা-দ্যাখ গুপে, দিন দিন তোর বাড় বাড়ছে। কাল তোর সব অঙ্ক কষে দিয়েছি। আমার টিফিনের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছিস। ইংরেজি ক্লাসে ছুরি ফটফট করেছিস আর তার জন্য বকুনি খেয়েছি আমি। বেশি বাড়াবাড়ি করিসনে বলে দিলাম!

এক নিশ্বাসে রাগের মাথায় এতগুলো কথা বলে দেখি গুপে আমাকে শাপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছোটো হয়ে হয়ে আলপিনের ডগার মতো হয়ে গেল, ঢোক গিলে, গলা হাঁকড়ে, আঙুল বাগিয়ে, খনখনে গলায় বলল– আজ তোর জীবনের শেষ দিন। দিনটা কাটলেও রাত কাটবে না। ক্লাসময় একটা থমথমে চুপচাপ। তার মধ্যে নরেনবাবু এসে গেলেন, আর কিছু হল না।

একটু পরেই আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগল, নিশ্বাসটা কীরকম জোরে জোরে পড়তে লাগল, চুলের গোড়াগুলো শিরশির করতে লাগল, পেটের ভিতর কেমন ফঁকা ফঁকা মনে হতে লাগল। বুঝলাম মাদুলির শাপ আমার লেগেছে। কিছু পড়া-টড়া শুনলাম না, হোমটাস্ক টুকলাম না, ড্রইং ক্লাসে বেয়াদপি করলাম। যার দিন কাটলেও রাত কাটবে না, তার আবার ভাবনা কী? টিফিন বাক্সটা ক্লাসের মধ্যেইনগার হাতে তুলে দিলাম, আমি মরি আর গুপে সেটা ভোগ করুক আর কী! ছুটির ঘণ্টা পড়লে পর মনে হল, আমি তো গেলাম, যাবার আগে ওই সর্বনেশে মাদুলিটাকে শেষ করে তবে যাব।

দেখি গুপেদের পুরোনো চাকর ভদু গুপের বই গুছিয়ে নিচ্ছে, আর গুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। হঠাৎ খুন চড়ে গেল, ছুটে গিয়ে এক সেকেন্ডে মাদুলিটা কেড়ে মাড়িয়ে ভেঙে একাকার! তার থেকে অন্তত ধোঁয়াও বেরুনো উচিত ছিল, কিন্তু কিছু হল না। গুপে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওদের চাকরটা হই হই করে ছুটে এসে হাত-পা ছুঁড়ে বললে- যা, কী করলে! আমার পেটব্যথার অব্যর্থ মাদুলি, আমি কালীঘাট থেকে দু-পয়সা দিয়ে কিনে এনেছি। আগেই জানি গুপি দাদাকে যা দেওয়া যাবে তাই আর কিছু থাকবে না!

আমরা সবাই হাঁ করে গুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার নিশ্চয় কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু সে অম্লানবদনে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভদুকে ছুঁড়ে দিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বাড়ি চলে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *