এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই ।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে ।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই ,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই ,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই ,
কোথা ভেসে যাই দূরে ।
বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে ,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত —
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো ।
সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী ,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি —
আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি
রহস্যে নিমগন ।
এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে ,
এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে ,
এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে
অন্তরবিদারণ ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায় ,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে ।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা ,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা ,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে ।
কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার ,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর ,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার
দেখে তুমি হাস বুঝি ।
কে গো তুমি , কোথা রয়েছ গোপনে ,
আমি মরিতেছি খুঁজি ।
এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছ কই ।
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে ,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে ,
গোঠে ধায় গোরু , বধূ জল আনে
শত বার যাতায়াতে ,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায় —
মনে ছিল , দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে ।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক ,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক ,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে ।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের ‘ পরে
চলেছি পাগল-বেশে ।
কভু বা পান্থ গহন জটিল ,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল ,
কভু সংকটছায়াশঙ্কিল ,
বঙ্কিম দুরগম —
খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ ,
ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন ,
আশেপাশে হতে তাকায় মরণ
সহসা লাগায় ভ্রম ।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায় ,
কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায় ,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে ।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে ।
খেপার মতন কেন এ জীবন ,
অর্থ কী তার , কোথা এ ভ্রমণ ,
চুপ করে থাকি শুধায় যখন —
দেখে তুমি হাস বুঝি ।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে
আমি যে তোমারে খুঁজি ।
রাখো কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ।
আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব
বলে দাও মোরে অয়ি ।
আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার ,
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূর্ছনাভরে গীতঝংকার
ধ্বনিছ মর্মমাঝে ?
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ , অপার বাসনা ,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
মোর বেদনায় বাজে ?
মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্ অনাদি কাহিনী ,
কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী
জাগাও গভীর সুর ।
হবে যবে তব লীলা-অবসান ,
ছিঁড়ে যাবে তার , থেমে যাবে গান ,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
তব রহস্যপুর ?
জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্ দেবতার
রহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে ?
নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান ,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে ।
অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে
বুঝিবে কি , কেন এসেছিনু ভবে ,
কেন জ্বলিলাম প্রাণে ?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তোমার বিজন নূতন এ পথে ,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
জনতার মাঝখানে ?
জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল
সেদিন কি হবে সহসা সফল ?
সেই শিখা হতে রূপ নির্মল
বাহিরি আসিবে বুঝি!
সব জটিলতা হইবে সরল
তোমারে পাইব খুঁজি ।
ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী ,
জীবনের শেষে কী নূতন বেশে
দেখা দিবে মোরে অয়ি!
চিরদিবসের মর্মের ব্যথা ,
শত জনমের চিরসফলতা ,
আমার প্রেয়সী , আমার দেবতা ,
আমার বিশ্বরূপী ,
মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
দাঁড়াবে কি চুপিচুপি ?
ললাট আমার চুম্বন করি
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি ,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি ,
জানি না চিনিব কি না —
শূন্য গগন নীলনির্মল ,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল ,
না বহে পবন , নাই কোলাহল ,
বাজিছে নীরব বীণা —
অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে ,
কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে ।
গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার ,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার ,
নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার
পরশরসতরঙ্গে ।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি
অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি
বরষি করুণাভরে ।
নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
অশ্রুবাষ্পথরে ।
নাহিকো অর্থ , নাহিকো তত্ত্ব ,
নাহিকো মিথ্যা , নাহিকো সত্য ,
আপনার মাঝে আপনি মত্ত —
দেখিয়া হাসিবে বুঝি ।
আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে ,
ফিরিতে হবে না খুঁজি ।
যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
ওগো কৌতুকময়ী ,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী ,
তবে তাই হোক । দেবী , অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো ,
নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে ।
নব নব রূপে — ওগো রূপময় ,
লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয় ,
কাঁদাও আমারে , ওগো নির্দয় ,
চঞ্চল প্রেম দিয়ে ।
কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে ,
কখনো আলোকে কখনো তিমিরে ,
কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে
পরশ করিয়া যাবে —
বক্ষোবীণায় বেদনার তার
এইমতো পুন বাঁধিব আবার ,
পরশমাত্রে গীতঝংকার
উঠিবে নূতন ভাবে ।
এমনি টুটিয়া মর্মপাথর
ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর ,
জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর
বহিয়া চলিবে দূরে ।
বরষ বরষ দিবসরজনী
অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
আমার গানের সুরে ।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার —
ওগো মায়াবিনী , কত ভুলাবার
মন্ত্র তোমার আছে!
আবার তোমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে ,
পথ হতে পথে , ঘর হতে ঘরে
দুরাশার পাছে পাছে ।
এবারের মতো পুরিয়া পরান
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান ,
সে সুরা তরল অগ্নিসমান
তুমি ঢালিতেছ বুঝি!
আবার এমনি বেদনার মাঝে
তোমারে ফিরিব খুঁজি ।