Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সূর্যাস্তের পাখি || Sukanta Gangopadhyay

সূর্যাস্তের পাখি || Sukanta Gangopadhyay

ভ্যানরিকশাটা হঠাৎ লাফাতে শুরু করল। দিব্যি আসছিল এতক্ষণ। রিকশার পাটাতন চেপে ধরে চিত্রা, আড়চোখে চালকের ও পাশে বসা অঞ্জনকে দেখে। তার দিকেই চেয়ে আছে অঞ্জন। হাসছে। বলে উঠল, পশ্চিমবঙ্গ শেষ। ওড়িশায় চলে এলাম আমরা। রাস্তার অবস্থা দেখেছ।

ওড়িশা সরকার এ দিককার রাস্তার কেন যত্ন নেয়নি, বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত দিঘাকে পায়নি বলে অভিমান হয়েছে। কারণ যাই হোক, রিকশার এই ঝাঁকুনিটা বিষম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে চিত্রাকে। প্রতিটা জার্কের ভাঁজে ভাঁজে চলকে উঠছে নার্ভাসনেস। রাস্তার গর্তের মতোই ক্ষণে ক্ষণে বুকের মধ্যে তৈরি হচ্ছে খোদল।

চিত্রা জানত, এই ট্যুরটা দৃশ্যত দু’জনের হলেও, অদৃশ্য এক সঙ্গী, মানে ‘ভয়’ তাদের সঙ্গে সব সময় থাকবে। সেটাকে মোকাবিলা করার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। ভোরের আলো ফোটার পর ব্যাগ কাঁধে যখন একা বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, টের পায় সহোদরার মতো ভয়ও তার পাশে আছে। পুরনো বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে ছিল মা, পিছনে ঘুমচোখে ভাইবউ সুমিতা। মা বলেছিল, সাবধানে যাস। পৌঁছে ফোন করবি।

সহোদরা ‘ভয়’ পাশ থেকে উত্তর দিয়েছিল, চিন্তা কোরো না মা। আমি তো আছি সঙ্গে।

মা জানে বন্দনার দেশের বাড়ি মেদিনীপুরে যাচ্ছে মেয়ে। বন্দনা, চিত্রা একই স্কুলে পড়ায়। বন্দনা পার্মানেন্ট স্টাফ, চিত্রা প্যারাটিচার। স্থায়ী শিক্ষিকারা একটু ঘ্যাম নিয়ে চললেও, বন্দনা কেন কে জানে, চিত্রাকে প্রথম থেকেই বন্ধু করে নেয়। কারণটা জিজ্ঞেস করলে বলে, তোকে আমি হিংসে করি বলেই, ভাব করে নিয়েছি। আমার বাবা বলেন, যার প্রতি ঈর্ষা হবে, বন্ধুত্ব করে নিলেই দেখবে জ্বালা কমে যাচ্ছে।

হিংসে করার মতো আমার মধ্যে কী পেলি? জানতে চেয়েছিল চিত্রা। বন্দনা উত্তর দেয়, তুই এত সুন্দর দেখতে, পার্সোনালিটিও অসম্ভব গ্রেসফুল, হিংসে হবে না!

সুন্দর না ঘেঁচু। পুরো পাঁচ ফুট হাইটই নয় আমার, তার আবার পার্সোনালিটি! চিত্রার কথার পর বন্দনা ওর গাল দুটো ধরে বলেছিল, তুই যে কী, তুই নিজেই জানিস না পাগলি। আমি যদি…

থাক হয়েছে। বলে বাধা দিয়েছিল চিত্রা। ঠাট্টার সুরে বলেছিল, তোর আবার অন্য কোনও রোগটোগ নেই তো?

নট অ্যাট অল। একটি চার বছরের ছেলের আমি গর্বিত জননী। কনজুগাল লাইফেও

সুখী। তা বলে একটা সুন্দর মেয়েকে ভালবাসব না। সুন্দর ফুল, পাখি দেখেও তো লাফিয়ে উঠি।

এরকমই খোলামেলা, হ্যাপি গো লাইক বন্দনাকে ক দিন আগে চাপা গলায় চিত্রা বলেছিল, আমার একটা উপকার করবি?

বলার ধরনে গোপনতার আভাস দেখে ভ্রূ জোড়া ঘনিষ্ঠ করেছিল বন্দনা। জিজ্ঞেস করে, কী উপকার?

চিত্রা তখন বন্ধুর সঙ্গে লুকিয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানটা জানায়। একই সঙ্গে বলে, বাড়িতে বলব বন্দনার সঙ্গে ওদের দেশের বাড়ি যাচ্ছি। তোর ফোন নম্বরটা দিয়ে রাখব। মা যদিও ফোন করবে না, বাই এনি চান্স করে ফেলে, ম্যানেজ দিয়ে দিস। এমন ভাব করবি যেন দেশেই আছিস, আমি নাগালের মধ্যে নেই। তাই কথা বলাতে পারছিস না। মায়ের ফোন রেখে আমার সেলে ইন্টিমেশনটা দিবি। আমি বাড়িতে কন্ট্যাক্ট করে নেব।

কথাগুলো শোনার পর বন্দনা খানিকক্ষণ বোবা হয়ে বড় বড় চোখ করে বসেছিল। বিস্ময় কাটিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, তোর পেটে পেটে এত বদমাইশি ! কই, এতদিন হয়ে গেল, কখনও তো বলিসনি তোর বয়ফ্রেন্ড আছে।

প্রসঙ্গ আসেনি, তাই বলিনি। বলেছিল চিত্রা।

বন্দনা বলে, প্রসঙ্গ অনেকবারই এসেছে, তুই স্রেফ চেপে গিয়েছিস। এখন হেল্‌ল্পের দরকার, বাধ্য হলি বলতে। প্রমাদ গুনেছিল চিত্রা। অভিমানে বন্দনা হয়তো অনুরোধটা রাখবে না। মিনিট খানেক গুম মেরে থেকে রাজি হল বন্দনা। তবে শর্তসাপেক্ষ, আলাপ করিয়ে দিতে হবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে।

চিত্রা বলেছিল, বেড়িয়ে আসি, তার পর।

নামটা অন্তত বল। কী করে না করে, দেখতে কেমন, থাকে কোথায়… ক্রমশ কৌতূহল বাড়ছিল বন্দনার। চিত্রা বিশদে যায়নি। বলেছে, মাঝারি একটা চাকরি করে, ডোমজুড়ে থাকে, নাম অনুপম। কেমন দেখতে, দেখা হওয়ার পর বুঝে নিস।

উত্তর দেওয়ার ধরন দেখে চিত্রাকে আর ঘাঁটায়নি বন্দনা। আন্দাজ করে নিয়েছে অনুপমের সঙ্গে আলাপের পরই ওদের সম্পর্কটা সবিস্তার জানা যাবে। বেচারা! আলাপ তো দূর অস্ত, নামধামটাও সত্যি জানল না। অঞ্জন থাকে কলকাতার মানিকতলায়, ওকে আদৌ বন্দনার মুখোমুখি করা সম্ভব কি না, জানে না চিত্রা। পরে বন্দনাকে কীভাবে ম্যানেজ দেবে তা-ও ঠিক করা নেই। ‘অনুপম’ নামটাও আশ্চর্যভাবে মুখে চলে এসেছিল। অঞ্জনের নাটকদলের যে শো-টা এখন কলকাতার স্টেজগুলোয় হচ্ছে, তার মেন চরিত্র অনুপমের রোলটা করছে অঞ্জন। সেই চরিত্রের বয়স অঞ্জনের চেয়ে প্রায় পনেরো বছর বেশি, মানে ষাট ছুঁই ছুঁই। সাদা দাড়িগোঁফের মেক-আপ নিয়ে অভিনয় করে। আড়ালে চাপা পড়ে যায় আসল অঞ্জন, ক্লিন শেভেন, ফরসা, লম্বা, বিনীত মানুষটা। যার চোখ সর্বদাই দিশা, ভাষাহীন। সেই দৃষ্টি যখন চিত্রার চোখে স্থির হয়, যেন দীর্ঘ উড়ানের পর পাখি ডানা মুড়ে বসল।

নাটকে ভিলেন রাজনৈতিক নেতার অভিনয় করে অঞ্জন। কী ক্রূর তার চাউনি! একটা অখাদ্য টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করে। ব্যবসায়ী বাড়ির বড় ছেলের রোল। দু’দিন দেখেছে

চিত্রা। অঞ্জনের পরনে ছিল চকচকে সবুজ পাঞ্জাবি। লম্পট টাইপের লাগছিল দেখতে। কোনওদিন যদি এই ড্রেসটা পরে চিত্রার সামনে চলে আসে অঞ্জন, ফালাফালা করে ছিঁড়ে দেবে। তবে ওই সব ছদ্মবেশের একটা সুবিধেও আছে, ওর প্রচারিত চেহারার সঙ্গে প্রকৃত মানুষটার কোনও মিল নেই। বন্দনার সঙ্গে যদি একদিন আলাপ করিয়েও দেয় চিত্রা, নাটক সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর সঙ্গে অঞ্জনকে মেলাতে পারবে না। কিন্তু ওই একদিনই, তার বেশি ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। চিনে ফেললেই অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়বে অঞ্জন।

রিকশা আর লাফাচ্ছে না। রাস্তাটা একটু পদের হয়েছে এখন। বাঁ পাশের ঝাউবন অনেক আগেই উধাও। বাসস্ট্যান্ড মতো এলাকায় এসে পড়েছে চিত্রাদের ভ্যানরিকশা। বড্ড ধুলো। রাস্তার একপাশে মাঝারি মানের দোকানপাট, ইতস্তত মানুষজন। রোদ আছে, তেমন তাপ নেই। ঝাঁকুনি না থাকলেও, চলকে ওঠা ভয়টা কণ্ঠহারের মতো চিত্রার বুকে ঝুলছে। এই অনুভূতিটা নিজেদের কেশবপুর পেরোনোর আগেই আশ্চর্যভাবে উধাও হয়েছিল। সম্ভবত মল্লিকবাড়ির বাগান থেকে ভেসে আসা ছাতিমের গন্ধটা ভুলিয়ে দিয়েছিল ভয়। হেমন্তের ওই সুবাসে চিত্রা খুঁজছিল অন্য কিছুর ব্যঞ্জনা। ‘সৌন্দর্য উপলব্ধির ভিতর লুকিয়ে থাকে আর এক সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা।’ এ কথা অঞ্জনের। বলেছে, কোনও ভাললাগার মুহূর্তে মনের গভীরে ডুব দাও, শুনতে পাবে তোমার বাসনার কিঙ্কিণির শব্দ।

মল্লিকবাড়ির পাঁচিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বাসনাকে চিনেছিল চিত্রা। ছাতিম গন্ধের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সানাইয়ের সুর। এমনটা শোনা খুব স্বাভাবিক। কারণ, এই প্রথম পারিবারিক সূত্রের বাইরের কোনও পুরুষের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাবে চিত্রা। হোটেলের রুম হলেও, সেটা প্রকৃত বিবেচনায় চিত্রার ফুলশয্যার ঘর… বুকটা ধক করে উঠল চিত্রার। ঠিক ভয় নয়। মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে কী একটা যেন নিতে ভুলে গেছে। কী ভুলল? প্রথমেই মনে পড়ে সেলফোনের কথা। কাঁধে রাখা হ্যান্ডব্যাগটা কোলের ওপর নেয়। খুলে দেখে, ফোন আছে। তা হলে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। তবে সে শিয়োর ভুল একটা হয়েইছে।

অন্যমনস্কভাবে চিত্রার হাত চলে গেছে পিছনে রাখা কিটব্যাগের ওপর, ব্যাগের বদলে অঞ্জনের হাতের স্পর্শ পায়। অঞ্জনের দিকে তাকাতে দেখে, দায়িত্ব-গর্বে মিটিমিটি হাসছে। অনেক আগেই দু’জনের ব্যাগ আগলে বসে আছে অঞ্জন। উৎকণ্ঠা চেপে নিষ্প্রাণ হাসে চিত্রা। রিকশায় বসে ব্যাগ ঘাঁটা সম্ভবও নয়, হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই দেখতে হবে, কী ভুল হয়েছে নিতে। গুরুত্বপূর্ণ কোনও জিনিস, মন অন্তত তাই বলছে।

বাড়ি থেকে এতটা পথ, একবারও খটকাটা লাগেনি। মল্লিকবাড়ির ছাতিম গন্ধে সেই যে বিহ্বল হয়েছিল চিত্রা, কেশবপুর থেকে হেঁটে বেগড়ি পৌঁছে বাস ধরে। সাঁতরাগাছিতে নেমে অটো করে স্টেশনে যায়। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় থাকা অঞ্জনকে দেখে, দুশ্চিন্তা আশঙ্কা সব উধাও। ট্রেনে চড়ে দিঘা। রুটটা নতুন চালু হয়েছে। রেললাইন ঘেঁষা পুকুর, ফসলের খেত, মানুষের উৎসুক মুখ, সবই খুব সতেজ। চোখ ভরে যায়। দিঘা স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশায় তালসারির উদ্দেশে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পেরোতেই এবড়োখেবড়ো রাস্তা, ভয় ফিরে এল। এখন আবার মনে হচ্ছে, কী যেন নেওয়া হয়নি। এটা কি নার্ভাসনেসের আর একটা রূপ?

মূল সড়ক ছেড়ে রিকশা এখন ইটপাতা শাখা রাস্তা ধরেছে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে এই পথ। আন্দাজ করা যায় তালসারি খুব দূরে নেই, হাওয়ায় আবছা সমুদ্রগন্ধ। আশপাশে তাল নয়, খেজুর গাছেরই আধিক্য। পথের ধারে কিছু দূর অন্তর কেয়াঝোপ। গরানে ছোট ছোট সীমানা দেওয়া চাষের জমি। অন্যান্য সমুদ্র নিকটবর্তী এলাকার মতো এই গ্রামটা সবুজহীন নয়। চাষাবাদেও রুটিরুজি চালায় এরা। প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে, এখানকার সমুদ্র ততটা চঞ্চল নয়। অঞ্জনের মতো পরিণত, স্থিতধী।

হাতে খড়বিচালি, গাছকোমর করে শাড়ি পরা মেয়ে উলটো দিক থেকে আসছিল। চিত্রাদের দেখে সাধারণ কৌতূহলে রাস্তার ধারে দাঁড়াল, অল্প বয়েস, কালোর ওপর মিষ্টি দেখতে, ঠোঁটে চিলতে হাসি, সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর। বেশিদিন বিয়ে হয়নি… চিত্রার মনে পড়ল ভুলে যাওয়া কথাটা। রিকশাওলাকে বলে, একটু দাঁড় করাবে ভাই।

দাঁড়িয়ে যায় রিকশা। সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে অঞ্জন বলে, কী হল, দাঁড়াতে বললে! পাটাতন থেকে লাফিয়ে নামে চিত্রা। অজুহাত দেয়, অনেকক্ষণ বসে আছি, এবার একটু হাঁটা যাক।

রিকশাওলার চোখেমুখে শান্তি নেমে এল, ইট ভেঙে গিয়ে রাস্তার অবস্থা এখানে বেশ খারাপ। অঞ্জন চিত্রার পাশে এসে বলে, এই রোদে হাঁটবে!

রোদ কোথায়, গাছপালার ছায়ায় বোঝাই যাচ্ছে না এত বেলা হয়েছে। বলে হাঁটতে থাকে চিত্রা।

দু’জনের লাগেজ নিয়ে রিকশা চলেছে সামনে। ফের চিত্রা বলে, একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে কিন্তু।

কী ভুল? জানতে চায় অঞ্জন।

চিত্রা বলে, হোটেলে ঢোকার আগেই ভুলটা শুধরে নিতে হবে। তোমার তো কিছুই মনে থাকে না।

অঞ্জন সত্যিই ভুলো মানুষ। বিব্রত গলায় জানতে চায়, ব্যাপারটা কী বলবে তো!

সিঁদুর, সিঁদুর লাগাতে হবে না মাথায়!

কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগে অঞ্জনের। ব্রীড়াবনত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে চিত্রা। অঞ্জন হেসে ফেলে বলে, ধুর, আজকাল ও সব উঠে গেছে। হোটেলের লোক সিঁদুর দেখে ঘর দেয় না। তা ছাড়া অনেক মেয়ে ও সব পরেও না ইদানীং।

চোখমুখ কুঁচকে অঞ্জনের দিকে তাকায় চিত্রা। গাছের ফাঁক দিয়ে মুখে রোদ পড়াতে এই ভঙ্গি। নরম গলায় বলে, আমাকে তো তা হলে হোটেলের লোক খারাপ মেয়েও ভাবতে পারে। হায়ার্ড গার্ল।

সেই মেয়েরাই বরং আগেভাগে সিঁদুর পরে নেয়, বলে উদাসীন হয়ে যায় অঞ্জন। চিত্রার মনটা তবু খচখচ করছে, ছোট্ট রুপোর কৌটোতে সিঁদুর সে এনেছে। ভেবেছিল আড়াল পেলেই পরে নেবে। একই সঙ্গে চাগাড় দিয়েছিল আরও একটা অভিলাষ, অঞ্জনকে বলবে পরিয়ে দিতে। নাটক সিরিয়াল ভেবেই না হয় দেবে। এখনও এই খোলামেলা প্রকৃতিই যেন মস্ত আড়াল। আশপাশে মানুষজন নেই। রিকশাওলাও এখন পিছন ফিরবে না… ভাবনা

থেমে যায় অঞ্জনের কথায়, দেবারতিও তো অনেক দিন সিঁদুর পরা ছেড়েছে, র‍্যাশ বের হয়। ওকে এখানে বেড়াতে নিয়ে এলে কি ও সব পরাতে হত?

মেজাজটা পুরো খিঁচড়ে গেল চিত্রার। অঞ্জন কথার খেলাপ করছে। ও শর্ত দিয়েছিল, এই ট্যুরে দেবারতির প্রসঙ্গ আনা চলবে না। অথচ নিজেই উত্থাপন করল। যদিও ওর মন্তব্যে চিত্রা, দেবারতির অবস্থান সমান। দু’জনেই সিঁদুরহীন। তবুও শর্ত ইজ শর্ত। মেনটেন করা উচিত।

রিকশার পাটাতনে রাখা নিজের ব্যাগের ওপর লক্ষ স্থির করে হাঁটছে চিত্রা। ওর মধ্যেই আছে মন্দিরের আদলে রুপোর ছোট্ট সিঁদুরকৌটো। মেজপিসি বেনারস থেকে মায়ের জন্যে এনেছিল। এত সুন্দর কারুকাজ, নিত্যদিনের জিনিসের থেকে আলাদা করে রেখেছিল মা। ওটার ওপর লোভ চিত্রার অনেক দিনের। এই প্রথম ব্যবহার করার সুযোগ এসেছিল। উঠে পড়ুন বাবু। এবার রাস্তা ঢালু। হু হু করে নেমে যাব।

রিকশাওলার ডাকে এগিয়ে যায় দু’জনে। ফের পাটাতনে গিয়ে বসে।

অঞ্জনের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। বলেছিল, নির্জনতা বোধের অন্তিমে হচ্ছে তালসারি। এক এক সময় নিজেকে পরিত্যক্ত মনে হবে— একটু ডিঙি মেরে বাথরুমের কাচের জানলা তুলছে চিত্রা। বেশ খানিকটা বালিয়াড়ির পর শান্ত জল, তারপর চড়া। সেখানে ঝাউবন, আরও কিছু গাছপালা। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রুপোলি জলের সমুদ্র। বাস্তবিকই যেন সাগর ফেলে দিয়ে গেছে এই বেলাভূমি। আর কোনওদিন ফিরবে না। হোটেলটাও যেন নির্জনতার গুমঘর। আপাতত তিনতলার এই হোটেলটার একমাত্র বোর্ডার চিত্রারা। তালসারিতে এই একটাই হোটেল, আর আছে ওড়িষা সরকারের ট্যুরিস্ট লজ। রাত কাটাতে ট্যুরিস্টরা এখানে বড় একটা আসে না। চিত্রাদের পেয়ে হোটেল ম্যানেজার একেবারে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। সিঁথির দিকে তাকালই না।

অঞ্জন রেজিস্টারে মিথ্যে নাম না লিখলেও, শর্টে লিখল এ মজুমদার অ্যান্ড মিসেস মজুমদার। রিলেশনে লিখল ওয়াইফ। ঠিকানা, ফোন নম্বর সত্যি দিল না। ম্যানেজার চোখ বোলাল না পর্যন্ত। অঞ্জনের চাহিদামতো রুম নম্বরের জায়গায় একশো তিন লিখল। এই রুমটা অঞ্জন পছন্দ করে যায় মাস চারেক আগে।

সিরিয়ালের আউটডোর পড়েছিল তালসারিতে। টোটাল ইউনিট থাকত দিঘার হোটেলে। খাবার আসত ওখান থেকেই। ইউনিটের লোকেরা চা-টা খেতে ঢুকত এই হোটেলে। ম্যানেজার চান্স পেলেই শ্যুটিং-এর লোকদের ভজাত, আমাদের হোটেলটা একবার ঘুরে দেখুন না। নতুন হয়েছে। লেটেস্ট ডিজ়াইনের রুমটুমগুলো দেখুন। পরে কখনও যদি

ফ্যামিলি নিয়ে আসেন, থেকে যাবেন একরাত। বাকি রাত না হয় দিঘাতেই কাটাবেন।

ম্যানেজারের কথায় কেউ কান দিচ্ছে না দেখে, মায়া হয় অঞ্জনের। বলেছিল, চলুন দেখি আপনাদের রুমগুলো।

ম্যানেজার উৎসাহিত হয়ে হোটেলের ঘরগুলো খুলে দেখাতে থাকে অঞ্জনকে। তিনতলায় একশো তিনের দরজা খোলার পর থমকে দাঁড়িয়ে ছিল অঞ্জন। দেখতে পায় সদ্যোস্নাত

কালো তাঁতের শাড়ির চিত্রাকে। হ্যালুসিনেশন। আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে বিভ্রমের চিত্রা জানতে চায়, পেলে খুঁজে।

জাগ্রত স্বপ্নে মাথা নেড়েছিল অঞ্জন। স্বপ্নের একটু পিছন দিকটাও সে তখন দেখতে পাচ্ছে, অঞ্জন, চিত্রা যেন খানিক আগে সমুদ্র থেকে স্নান করে এসেছে। চিত্রা হারিয়েছে এক কানের দুল। সি-বিচে দুলটা খুঁজতে গিয়েছিল অঞ্জন। পাওয়া যায়নি… স্বপ্ন ভেদ করে ঢুকে পড়েছিল ম্যানেজারের গলা, এই রুমটা অন্যভাবে সাজানো হয়েছে।

চিত্তবিভ্রম কাটিয়ে অঞ্জন দেখেছিল, দুটো সিঙ্গল খাট দু’পাশের দেওয়াল ঘেঁষা। বিছানা দুটোর মাথার কাছে রঙিন শার্শির লম্বাটে জানলা। ড্রেসিং আয়না, আলমারি একটা করে। অঞ্জন জানতে চেয়েছিল, রুমটা এভাবে সাজানোর মানে? এটাও তো ডাবলবেড ঘর।

ম্যানেজার বলেছিল, বুদ্ধিটা আমাদের মালিকের। উনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী সর্বক্ষণ এক বিছানায় থাকাটা বোরিং। প্রয়োজনে সিঙ্গলবেড সাফিশিয়েন্ট। তারপর যে যার আলাদা জগতে চলে যাবে। তাদের জন্যে জানলাও সেপারেট।

আইডিয়াটা অঞ্জনের অভিনব লাগে। বলেছিল, এই রুমটা নিশ্চয়ই আপনাদের বেশি বুকিং হয়?

কোথায় বুকিং! এমনিতে তালসারিতে ট্যুরিস্ট আসে কম, হোটেলটার খবর খুব কম লোকই জানে। বলেছিল ম্যানেজার। সেই লোকটাকে এবারে কিন্তু দেখতে পায়নি অঞ্জন। তবে যিনি আছেন, ধরে রেখেছেন আগের ম্যানেজারের অ্যাটিটিউট।

অঞ্জনের থেকে শোনা একশো তিন নম্বর রুমে আজ যখন পা রেখেছিল চিত্রা, দেখেছিল অঞ্জনের কল্পনার কালো শাড়ির চিত্রাকে। আজও সে জিজ্ঞেস করেছিল, পেলে জিনিসটা? এবারের জিজ্ঞাসাটা ছিল বাস্তবের চিত্রাকে। সে উত্তর দেয়, যে জিনিস ঠিক মতো পেলামই না, তাকে হারাব কী করে!

দুল নয়। বাস্তবের চিত্রা অঞ্জনের ভালবাসার কথা বলেছিল কল্পনার চিত্রাকে। উধাও হল সেই চিত্রা। অঞ্জন যাকে স্নানস্নিগ্ধ কালো শাড়িতে দেখেছিল। বাস্তবের চিত্রা আরও একটু বেশি দেখে, কল্পনার চিত্রার সদ্যোস্নাত চুলে ভিজে গেছে কালো ব্লাউজ। ওর হাতে ছিল মায়ের সেই সিঁদুরকৌটো। চুল আঁচড়ানোর পর পরবে।

ওই কল্পদৃশ্যের কারণেই স্নানের ইচ্ছে চাগিয়ে উঠল চিত্রার। ঘরে ঢুকে অঞ্জন বাঁদিকের বেড বেছে নিয়ে চলে গিয়েছিল জানলার কাছে। চিত্রা হা-ক্লান্ত হয়ে বসেছিল চেয়ারে। দরজা ছিল খোলা। দু’জনের কেউই আগ বাড়িয়ে বন্ধ করতে চায়নি। অঞ্জনের অর্ডার অনুযায়ী দু’কাপ চা নিয়ে এসেছিল বয়। চা খেয়ে চিত্রা বলে, আমি স্নানটা করে নিই, গাহাত-পায়ে ধুলো ভরতি…

আড়মোড়া ভেঙে অঞ্জন বলেছিল, হ্যাঁ যাও, সেরে এসো। তার পর আমি যাব।

উদ্বাহু হয়ে বিছানায় চিত হল অঞ্জন। স্নানের টুকিটাকি নিয়ে বাথরুমে ঢুকল চিত্রা। সেই থেকে এখানেই আছে। জানলার কাচ নামিয়ে চলে এসেছে শাওয়ারের নীচে। পোশাক খুলতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বন্ধ দরজার ওপারে অঞ্জন। যদি এসে নক করে, দরজা না খুলে উপায় নেই। চেঁচামেচি তো করতে পারবে না। ব্যাপারটা হাস্যকর হবে। যে বয়টা

চা দিতে এসেছিল, চিত্রাকে বউদি বলে ডেকেছিল। বউদি, লাঞ্চ কী হবে, মাছ না মাংস? মাছের অর্ডার দেয় অঞ্জন। এখন চিৎকার করলে কী ভাববে হোটেলের লোক! শাড়িটা খুলে ফেলে চিত্রা। ব্লাউজের বোতামে হাত দিতেই বুক ঢিপঢিপ করে। বাথরুমের দেওয়ালে আধমানুষ সমান আয়না লাগানো আছে, সেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে হেসে ফেলে চিত্রা, যেন হিন্দি সিনেমার ধর্ষণ দৃশ্যের একটু আগের নায়িকা। শাড়ি দিয়ে আয়নাটা চাপা দেয়। তারপর এক এক করে খুলতে থাকে পোশাক।

নগ্ন হয়ে দাঁড়ায় শাওয়ারের জলের তলায়। আঃ, কী শান্তি! চারপাশ নিস্তব্ধ বলে জলের আওয়াজটাকে বৃষ্টির শব্দ মনে হচ্ছে। কান খোলা রেখেছে চিত্রা, বন্ধ দরজায় যদি মৃদু শব্দ ওঠে, দৌড়ে গিয়ে এ পার থেকে বলবে, শর্তে কিন্তু এ সব ছিল না। রুল ব্রেক করছ তুমি।

এখানে আসতে রাজি হওয়ার আগে দুটো বিষয়ে অঞ্জনকে কড়ার করিয়ে নিয়েছে চিত্রা। প্রধান শর্ত, শরীর নিয়ে আবদার নয়। দুই, ড্রিঙ্ক করা চলবে না। মদ খেয়ে মানুষ হামেশাই বেড়া ডিঙোয়। পরে ক্ষমা চায়। বলে, মাতাল হয়ে করে ফেলেছি।

দুটো শর্তেই রাজি হয়েছে অঞ্জন। শুধু বলেছিল, শরীরের ব্যাপারে যতটুকু এগিয়েছি, ততটা চলবে তো?

না। জোরের সঙ্গে আপত্তি জানিয়েছিল চিত্রা। কারণ সে জানে, ফাঁকা সিনেমা হলে অতি সতর্কতায় যে চুমু অঞ্জন খেয়েছিল, তাতে ছিল দুর্নিবার তৃষ্ণা! এই নির্জনতায় ওকে আশকারা দিলে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাবে সব কিছু।

একসঙ্গে একরাত বাইরে কাটানোর ব্যাপারে অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিল অঞ্জন। এখানের শ্যুটিং থেকে ফিরে, তালসারির সমস্ত বর্ণনার পর বলেছিল, আমরা তো কল্পনায় কত জায়গায় বেড়াতে যাই। সঙ্গী নির্বাচনে কোনও বাধা নেই সেখানে। ধরে নাও না, কল্পনাতেই বেড়াতে যাব তালসারিতে। পুরো ট্যুরটা আসলে একটা ড্রিম।

ওই স্বপ্নে কী সম্পর্ক হবে আমাদের। কৌতুকভরে জানতে চেয়েছিল চিত্রা। অঞ্জন বলেছিল, প্রেমিক-প্রেমিকার।

সে তো বাস্তবেও তাই। স্বপ্ন যখন, পোলাওতে ঘি ঢালতে কিপটেমি করব কেন? চিত্রার কথা শুনে অঞ্জন জানতে চেয়েছিল, তুমি কী সম্পর্ক চাও? স্বামী-স্ত্রীর। তবে তাতে বাস্তবের শরীর কিন্তু আসা চলবে না।

হেসে ফেলে রাজি হয়েছিল অঞ্জন। না হয়ে ওর উপায় ছিল না। কেননা, সম্পর্কের কিছুদিনের মধ্যেই অঞ্জন বলে রেখেছে, তোমাকে ভীষণ ভাললাগে, প্রচণ্ড ভালবাসি। তবু সংসার থেকে বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, দেবারতির বিরুদ্ধে আমার কোনও কমপ্লেন নেই।

আপনি কি বউদিকে ভালবাসেন? জানতে চেয়েছিল চিত্রা। তখন ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করত।

একটু ভেবে অঞ্জন বলেছিল, বোধহয় না। তবে ঘৃণাও করি না। একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর ওপর সম্পর্কটা টিকে আছে।

কোনওদিন কি ভালবাসতেন?

সেরকম নাছোড় ভালবাসা ওর প্রতি কখনও আমার জন্মায়নি। বিয়ে হয়েছিল অ্যারেঞ্জ করে। তোমাকে দেখার জন্যে হঠাৎ আমার যেমন সুতীব্র ইচ্ছে হয়, তেমনটা ওর বেলায় হয় না। ওকে ছেড়ে অফিসের কাজে বাইরে থেকেও দেখেছি, সেভাবে টান অনুভব করি না। অ্যারেঞ্জ করে বিয়ে হয়, প্রেম তো সম্ভব না। আবার এ সবের জন্যে দেবারতিকে দোষ দিই কী করে।

এরকম আরও কিছু কথপোকথনের পর গুম মেরে বসেছিল চিত্রা। একসময় বলেছিল, আমিও চাই না কারও সংসার উজাড় করতে। আমাদের রিলেশনটা যতদূর এগিয়েছে সেটাই মেনটেন করা ভাল।

তেমনটাই চলল অনেকদিন। কিন্তু মানুষের সামর্থ্য শেষ হলে দিতে চায় স্বপ্নের উড়ান। অঞ্জন তালসারি যাওয়ার প্ল্যানটা মুড়ে ফেলল কল্পনার মোড়কে। বলেছিল, স্বপ্নটা এতটাই নিশ্ছিদ্র হতে হবে, যেন ভুলেও আমাদের বাস্তব দায়বদ্ধতা ঢুকে না আসে। মনেই রাখব না আমার একটা সংসার আছে। তুমি যে অবিবাহিত সেটাও ভুলে থাকবে তুমি।

কিন্তু শরীর! কল্পনার মধ্যে সে ঢুকে এলে অপবিত্র হবে এই অভিযান। নিজেদের মনে হবে ঠগ। অঞ্জন অতটা অবিশ্বাসী নয়। জোর করে কিছু অধিকার করার ঝোঁক ওর নেই। বিয়ের আগে চিত্রার সঙ্গে না দেখা হওয়াটা নিজের অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। সংকুচিত থাকে সর্বক্ষণ। চিত্রা কি নিজেও খুব বিশ্বাসী? তাই যদি হত, এখানে বেড়াতে আসার আগে অবাঞ্ছিত রোম রিমুভ করেছে, পার্লারে গিয়ে ভ্রূ প্লাক, ফেশিয়াল ম্যানিকিয়োর, পেডিকিয়োর… সাজিয়েছে শরীরকেই, কেন?

অনেকক্ষণ স্নান হল। বেশ শীত শীত করছে। পাথরের মেঝে থেকেও উঠে আসছে ঠান্ডা। জলের ধারা বন্ধ করে চিত্রা। দরজায় একবারও নক হয়নি। নাকি হয়েছে, শুনতে পায়নি? কানে আসে অন্যরকম একটা আওয়াজ, ফড়ফড়ানি মতো। চোখ চলে যায় শব্দের উৎসে। চমকে ওঠে চিত্রা, বড়সড় একটা ফড়িং! কখন যেন জানলা গলে চলে এসেছে। গোটা স্নানঘর জুড়ে উড়ছে। হ্যাঙার থেকে তড়িঘড়ি তোয়ালেটা টেনে গায়ে জড়ায় চিত্রা। ফড়িংটা হঠাৎ মুখ লক্ষ করে এগিয়ে আসতেই, ও মা! বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কানের পাশ দিয়ে চলে যায় ওটা। আবার ফিরবে। এবার দরজায় ঠকঠক। শোনা যাচ্ছে অঞ্জনের গলা, কী হল চিত্রা, হোয়াট হ্যাপেন?

তোয়ালেটা যথেষ্ট বড়। বুক থেকে হাঁটু অবধি জড়ানো গেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাথরুমের দরজা খোলে চিত্রা। উৎকণ্ঠিত মুখে অঞ্জন জানতে চায়, চেঁচালে কেন, কী প্রবলেম? এত কম পোশাকে অঞ্জনের সামনে এই প্রথম, লাজুক শিহরন নিয়ে চিত্রা কাঁপা গলায় বলে, ফড়িং।

অঞ্জনের দৃষ্টি থমকে আছে অর্ধোন্মুক্ত ভেজা চিত্রার দিকে। দ্রুত ঘোর কাটিয়ে অঞ্জন জানতে চায়, কোথায় ফড়িং, দেখি। মেয়েরা তো আরশোলায় ভয় পায়, তুমি,…

কথা শেষ না করে চিত্রার গা বাঁচিয়ে বাথরুমে ঢোকে অঞ্জন এ দিক ও দিক চোখ বুলিয়ে বলে, কই, দেখছি না তো!

চলে গেছে, তা হলে। কী বড়! বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে চিত্রা। অঞ্জন মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।

ফের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিত্রা। জানলার ফাঁকটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওখান দিয়ে চলে গেছে ফড়িংটা। এসেছিল হয়তো দূর চরার জঙ্গল থেকে। উড়ে যেতে যেতে ফড়িংটা মনে হয় দুয়ো দিচ্ছে, দূর বোকা মেয়ে, এত বড় একটা সুযোগ করে দিলাম, কাজে লাগাতে পারলি না!

বিকেল এল অনেকক্ষণ ধরে, মগ্ন শিল্পীর আলতো তুলি চালানোর লয়ে। বালির চরার ওপর শুয়ে থাকা রোদ পালটে ফেলল গায়ের রং। খাঁড়ির জল হয়ে গেল আয়নার কাচের মতো। দূরের সমুদ্র গাঢ় সবুজ। চিত্রা উপুড় হয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে দেখল নিসর্গের বদলে যাওয়া রূপ। এক দঙ্গল ট্যুরিস্ট এসে ঘুরে গেল তালসারির সি-বিচ। সমুদ্রতট এখন ফাঁকা। ও পাশের বিছানায় বেমালুম ঘুমোচ্ছে অঞ্জন। লাঞ্চের পর বিশাল হাই তুলে বলেছিল, আমি কিন্তু ভাই ঘুমোব। এরকম দিবানিদ্রার চান্স সচরাচর আসে না।

সামান্য হলেও ইনসাল্ট ফিল করছিল চিত্রা। তাদের যদি এই হনিমুনটা সত্যিকারের হত, পারত ঘুমোতে অঞ্জন? তখন কিন্তু সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সেন্টিমেন্টের কথা ভাবতে হতই। কল্পনার মধুচন্দ্রিমায় এতগুলো শর্ত আরোপ হয়ে আছে, ব্যাপারটা ঠিক জমাট বাঁধছে না। অঞ্জনের ঘুমোতে যাওয়ার তোড়জোড় দেখে চিত্রা ঠেস মেরে বলেছিল, অনেকের কমপ্লেন থাকে, বাড়িতে খেতে দেয় না, তোমাকে কি ঘুমোতে দেয় না?

যে-কোনও প্যাঁচালো প্রশ্নের সামনে অদ্ভুত এক ধরনের হাসি হাসতে পারে অঞ্জন, কোনও উত্তর দেয় না। এবারও তাই করে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মাঝে নাক ডাকল খানিকক্ষণ। ওকে একটু ঠেলা দিতে থেমেও গেল ডাকটা। এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুমের মধ্যে নিভে যাচ্ছে একটা সোনারঙের বিকেল।

নিজের বিছানা থেকে নেমে এসে অঞ্জনের গা ধরে মৃদু ঝাঁকায় চিত্রা, অ্যাই, আর কতক্ষণ ঘুমোবে?

চোখ না খুলে অঞ্জন বলে, আমি জেগেই আছি।

তা হলে উঠছ না কেন? বেরোব না আমরা?

একই ভঙ্গিতে অঞ্জন জানতে চায়, বিচ এখন ফাঁকা? চেনাজানা আবার কাউকে দেখা যাবে না তো?

গেলে যাবে। তা বলে এত সুন্দর একটা বিকেল ঘরে বসে থেকে মিস করব!

এবার চোখ খুলে উঠে বসে অঞ্জন। বলে, তুমিই তো বলেছিলে লোকজনের সামনে বিশেষ বার হব না।

সেটা তোমার সুবিধের জন্যে বলেছিলাম। বলে, বিছানার নীচে রাখা নিজের ব্যাগ খুলতে বসে যায় চিত্রা। কাপড়জামা বার করতে করতে বলে, আমি ঠিক দশ মিনিট নেব রেডি হতে। তুমিও তৈরি হয়ে নাও।

আমার আবার রেডি! এই পাজামা পাঞ্জাবি পরেই চালিয়ে দেব।

মৃদু শাসনের সুরে চিত্রা বলে, একদম না। ওগুলো কুঁচকে গেছে। ইস্ত্রি করা জামাকাপড় পরবে।

কথা শেষ করে ড্রেস চেঞ্জ করতে বাথরুমে ঢুকছিল চিত্রা। অঞ্জন বলে, তুমি কী পরবে দেখি, হাতে ওটা কী?

মুঠোতে ধরা হলুদ সালোয়ার কামিজটা তুলে দেখায় চিত্রা। অঞ্জন বলে, শাড়ি নয় মনে হচ্ছে।

চিত্রা মাথা নাড়ে। ড্রেসটা খুলে ধরে জানতে চায়, খারাপ

? খারাপ কেন হবে। তবে শাড়ি পরলেই ভাল হয়।

কেন?

আমার জেনারেশনের প্রেমিকারা শাড়িই পরত।

মনটা দমে গেল চিত্রার। সালোয়ার কামিজটা তার পরাই হয়নি। শখ করে কিনেছিল। ফের ব্যাগ খুলে শাড়ি বাছতে লাগল চিত্রা।

দরজায় কে যেন নক করছে। ওপার থেকে ভেসে এল

সার্ভিস বয়ের গলা, স্যর, চা।

খোলাই আছে দরজা, ঢুকে এসো। বলল অঞ্জন। দরজাটা অঞ্জন ভেজিয়েছিল, সাহসে কুলোয়নি ছিটকিনি তোলার। ট্রে-তে টি-পট সমেত চা নিয়ে এসেছে বয়। টেবিলের ওপর রাখে। অঞ্জন বয়কে জিজ্ঞেস করে, এখন সমুদ্রের দিকে যাওয়া যাবে?

কেন যাওয়া যাবে না স্যর। এটাই তো যাওয়ার সময়। নৌকো করে চরায় চলে যাবেন। দারুণ সানসেট দেখতে পাবেন সমুদ্রে।

তার মানে তো অনেক ভিড় হবে ওখানে! বলে অঞ্জন।

বয় বলে, কোথায় ভিড়! ট্যুরিস্টরা জানেই না তালসারিতে এত ভাল সানসেট পয়েন্ট আছে। সবাই বসে থাকে দিঘায়।

চিত্রার দিকে মুখ ফিরিয়ে অঞ্জন বলে, তা হলে যাই চলো, দেখে আসি অনবদ্য বিরল সূর্যাস্ত।

উৎসাহের সম্মতি ফুটে ওঠে চিত্রার অভিব্যক্তিতে। বয় চলে যায়। দু’জনে তুলে নেয় চায়ের কাপ।

নৌকোয় চেপে চরায় এসে উঠল দু’জনে। অঞ্জন ঠাট্টার গলায় মাঝিকে বলে, দেখো বাপু, ফেলে চলে যেয়ো না আবার। সারারাত এখানেই থাকতে হবে।

মাঝিও রসিক উত্তর দেয়, খারাপ লাগবে না বাবু, মাত্র চারদিন হল পূর্ণিমা গেছে, ভালই চাঁদ উঠছে এখন।

কলেজবেলার হাসি ফিরে আসে অঞ্জন চিত্রার মুখে। ঘুরে গিয়ে হাঁটতে থাকে ওরা। চাঁদ ইতিমধ্যেই আকাশ মঞ্চে এসে গেছে, খুবই ম্রিয়মাণ তার উপস্থিতি। এখনও অনেক দেরি আছে সূর্য ডুবতে। চরাটার আয়তন যে এতটা, হোটেলের ঘর থেকে বোঝা যায়নি। বালিতে অনেক লাল কাঁকড়া। একবার বকখালিতে গিয়ে এই কাঁকড়া দেখেছিল চিত্রা। এবারে এদের আরও ভাল লাগছে, পিঠে পড়েছে সূর্যাস্তের রং। আগুনের গোলা হয়ে হুটোপুটি করছে।

পায়ের শব্দ পেলেই ঢুকে যাচ্ছে গর্তে। সমুদ্রের জলে লালচে ছোঁয়া। সূর্যটাকে কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে না। অঞ্জনের দিকে তাকায় চিত্রা। সূর্যটা কোথায়? জিজ্ঞেস করবে ভাবে। করা হয় না। বিকেলের আলোয় কী অপূর্ব লাগছে অঞ্জনকে! হাওয়ায় উড়ছে আধ কোঁকড়ানো মাথার চুল। খাঁড়া নাক, টানা চোখ, খাঁজকাটা চিবুক। যেন স্বর্গভ্রষ্ট কোনও দেবতা, অনন্ত যৌবন যার অলংকার। অপার মুগ্ধতায় চিত্রা মনে মনে বলে, ওর পাশে কি আমায় মানাচ্ছে? জানে মানাচ্ছে না। এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই ওর। বরং অঞ্জনই ভোগে হীনম্মন্যতায়। তাই তো একটা লেম এক্সকিউজ দিয়ে সালোয়ার কামিজটা পরতে দিল না। চিত্রার থেকে অঞ্জন প্রায় বারো বছরের বড়। গড়নে ছোটখাটো চিত্রা। দাম্পত্যের স্বাদ নিতে হয়নি বলে বত্রিশের কমই লাগে। আজ সকালে ট্রেনে ওঠার আগে অঞ্জন বলেছিল, চ্যাংড়া ছেলেরা আমাদের ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ বলে আওয়াজ দিতে পারে তৈরি থেকো।

কেউ এখনও পর্যন্ত দেয়নি। সামান্য চোখও কোঁচকায়নি কোনও লোক। তা হলে কি মানিয়ে গেল? দেবারতি বউদির পাশে অঞ্জনকে কেমন লাগে জানে না চিত্রা। দেবারতিকে সে কখনও দেখেনি। অঞ্জনের বারো বছরের ছেলে আয়ুসও অদেখা থেকে গেছে। চিত্রা চেয়েছিল দেখতে। বলেছিল, এমনিই একজন নাট্যকর্মী হিসেবে চলে যাব তোমার বাড়ি। দেখব আয়ুস আর বউদিকে।

অঞ্জন রাজি হয়নি। বলেছে, আমার সো কলড সুখী গৃহকোণ, সংসার, তৃপ্ত বউ, বাবাকে আইডল করে নেওয়া ছেলেকে দেখে তুমি দুর্বল হয়ে পড়বে। চাইবে না ওদের কোনও ক্ষতি হোক। ফলস্বরূপ আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। কিন্তু সংসার বাদ দিয়েও যে আমি একটা আলাদা মানুষ, আমার আর্তি ভাললাগা যে এখনও জীবন্ত, এ সব কথা তোমার মাথায় আসবে না। এ ছাড়াও আরও একটা বিপদ আছে, তুমি আমি যদি একসঙ্গে দেবারতির সামনে যাই, ও ঠিক ধরে নেবে আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে। কী করে? জানতে চেয়েছিল চিত্রা।

অঞ্জন বলে, আমরা যেহেতু একে অপরের প্রতি দুর্বল, লুকোতে চাইলেও পারব না আমাদের বিশেষ দৃষ্টি বিনিময়, কথোপকথনে অকারণ সতর্কতা। প্রেম চিনতে মানুষের ভুল হয় না। স্বামীর প্রেমিকাকে চিহ্নিত করতে কয়েক মুহূর্ত মাত্র লাগবে।

তুমি তো অভিনেতা। পারবে না অ্যাক্টিং করে সিচুয়েশানটা ম্যানেজ দিতে? বলেছিল চিত্রা।

অঞ্জনের জবাব ছিল, আমি হয়তো পারব। কিন্তু তুমি তো অভিনেত্রী নও।

এ কথার পর আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি চিত্রা। ঠিকই, তার অপটু অভিনয়ের কারণে একটা সংসারে বিষ বাতাস ঢুকে পড়ুক অথবা অঞ্জন তার জীবন থেকে হারিয়ে যাক, কোনওটাই সে চায় না।

চরা ধরে অনেকটা হাঁটা হয়ে গেল। এখনও চোখে পড়েনি সূর্য। শাল, পিয়াল, ঝাউয়ের বন আড়াল করে আছে। চরায় মানুষ বলতে কয়েকজন মৎস্যজীবী, পাড়ে বসে জাল তুলে কী যেন দেখছে। ইতিউতি দু’-চারটে নৌকো। এ সব ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চিত্রারা। অঞ্জন সিগারেট ধরিয়েছে। এখানে আসার পর থেকে কথাবার্তা বলছে বড্ড কম। এমনিতে দেখা

হয় পনেরো-কুড়ি দিন অন্তর। খুব যে কথা হয় তা নয়। অঞ্জন কাজের মানুষ। অফিস এবং

অভিনয় দিনের বেশিরভাগ সময়টা খেয়ে নেয় ওর। এর ফাঁকেই সময় দেয় চিত্রাকে। সেল ফোনেও কথা হয়। চিত্রাই বেশি করে। কথাগুলো হয়ে যায় কস্টলি (আর্থিক অর্থে)। গায়ে লাগে বেশ। প্যারাটিচারের মাইনে বড্ড কম। অঞ্জন অবশ্য ফোনে টানা কথা চালাতে পারে না। বলে, অপরপক্ষের এক্সপ্রেশন না দেখতে পেলে কথা হারিয়ে যায় আমার। এই সব আক্ষেপ তালসারিতে এসে পুষিয়ে নেবে ভেবেছিল চিত্রা। কিন্তু অঞ্জন কেমন যেন একটু বেশিই চুপ হয়ে আছে। অপরাধবোধে ভুগছে কি? অবিচার করা হয়ে যাচ্ছে স্ত্রীর প্রতি। অন্যায়ের সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগে। এখন গম্ভীর হয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। বিবাহিত হয়েও অঞ্জন প্রেমে পড়েছে চিত্রার। ঘটনা ঘটেছিল এইভাবে, চিত্রাদের স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি চালু হল। আগে ছিল মাধ্যমিক পর্যন্ত। প্রধান অতিথি হয়ে এল ইতিহাসের টিচার সোনালিদির দাদা অঞ্জন মজুমদার। নামটা আবছা চেনা ঠেকেছিল চিত্রার কাছে। অন্যান্য দিদিমণির কাছে জানল অঞ্জনের সবিস্তার পরিচয়। গ্রামের স্কুল, ফান্ড কম। চেনাজানার পরিধি সীমিত, তাই হাতের পাঁচ অঞ্জনকে আনা হচ্ছে। লোকাল নেতারা আসার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। গাড়িভাড়াও লাগত না। হেডদিভাই চান না কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আসুক। অঞ্জন বাসে চেপে প্রথমে সোনালিদিভাইয়ের বাড়িতে এসেছিল। সেখান থেকে আনা হল গাড়িতে। স্টেজে এসে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেয় অঞ্জন। ওর কণ্ঠস্বরে, চেহারায় বক্তব্যে প্রবলভাবে আকর্ষিত হচ্ছিল চিত্রা। লক্ষ করছিল অন্য দিদিভাইরাও হচ্ছেন। অঞ্জনের পরনে ছিল অতি সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবি। অথচ ওর শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল অদ্ভুত এক বৈদগ্ধ্য মেশানো ব্যক্তিত্ব। প্রধান অতিথির আনুষ্ঠানিক সম্মান শরীর থেকে নামিয়ে আন্তরিকভঙ্গিতে বলেছিল কয়েকটা কথা। যার কিছু এখনও মনে আছে চিত্রার। শিক্ষিকাদের উদ্দেশে অঞ্জন বলে, সব ছাত্রীকে পড়াশোনায় ভাল করতে যাবেন না। যাদের খেলা, গান, নাটক, নাচ ইত্যাদি ভাল লাগে, সেই ব্যাপারে উৎসাহ দিন। নয়তো বাঙালি সংস্কৃতিমনস্ক জাতি, এই অহংকার আমাদের মুছে যাবে। ব্যক্তিজীবনের সমস্যা মাথায় নিয়ে স্কুলে ঢুকবেন না। দারোয়ানের কাছে গচ্ছিত রাখবেন। বাড়ি যাওয়ার আগে নিয়ে যাবেন মনে করে। জানবেন, আপনাদের সমস্যাগ্রস্ত মুখ ছাত্রীরা পছন্দ করে না। তেমনই আপনাদের ব্যক্তি সমস্যাগুলো সহ্য করতে পারে না ছাত্রীদের। আপনারা অজান্তেই স্টুডেন্টদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে ফেলেন। এরপর ছাত্রীদের বলেছিল, বাড়িতে তোমাদের একটি বা দুটিকে সামলাতে মা হিমশিম খান। স্কুলের দিদিমণিদের ক্লাসসুদ্ধু মেয়েদের সামলাতে হয়। তোমরা যদি শান্ত হয়ে পড়াশোনা না করো, ওঁরা পারবেন কী করে… কথাগুলো শুনতে শুনতে গোমড়া টিচারের মুখও নরম হয়ে আসছিল। স্টেজ থেকে নেমে আসতেই অঞ্জনকে ঘিরে ধরেছিল সবাই। বেশ কয়েকজন অটোগ্রাফও নিল। চিত্রার খুব ইচ্ছে করছিল আলাপ করতে, কে করিয়ে দেবে? অন্য সব দিদি ওকে চা-টা খাওয়াতে ব্যস্ত। আশ্চর্যভাবে বরাত খুলে গেল চিত্রার, হেডদিভাই হঠাৎ তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল চিত্রা। উনি বললেন, শোন, গাড়ি এবার অঞ্জনবাবুকে পৌঁছে দিচ্ছে সাঁতরাগাছি স্টেশনে। তুই ড্রাইভারের সঙ্গে যা। আমাদের পক্ষ থেকে একজন কারও স্টেশন অবধি থাকা উচিত।

চিত্রাদের যেহেতু মেয়েদের স্কুল, হেডদিভাই পছন্দ করেন মেয়েরাই অধিকাংশ কাজ করুক। পারলে সবটাই। কদাচিৎ ছেলেদের ডাকা হয়। চিত্রার সঙ্গে আরও দু-একজন টিচার যেতে চাইছিল। হেডদিভাই আটকালেন। বললেন, না, তোমরা কোথাও যাবে না। এখানে অনেক কাজ।

হেডদিভাই কেন তাকে এই কাজটা দিয়েছিলেন, তার একটা কারণ আন্দাজ করতে পারে চিত্রা, ওদের স্কুলের ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হওয়ার ক্ষেত্রে সে সবচেয়ে এগিয়ে।

ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে, ঘাড় ঘুরিয়ে অঞ্জনের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিল চিত্রা, আপনি এত সহজভাবে আসল কথাগুলো বললেন, আমাদের সবার খুব ভাল লেগেছে। আপনি শিল্পী বলেই এটা পারলেন। অ্যাকাডেমিশিয়ান বা নেতা টেতা হলে একগাদা ভারী ভারী কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিত।

আমি শিল্পী হিসেবে কতটা ওজনদার, আপনি জানেন?

কেন জানব না। বলে, যতটা কলিগদের কাছে শুনেছিল চিত্রা, সব বলল। শুনে অঞ্জন বলেছিল, আপনাকে দেখে মনে হয় না টিভির সিরিয়াল টিরিয়াল দেখেন। ছোট পরদায় কোনওদিন আমায় দেখেননি। না দেখে অবশ্য ভালই করেছেন। আমি নাটকটা মন দিয়ে স্বাধীনভাবে করি। যদি পারেন সোনালির সঙ্গে গিয়ে অ্যাকাডেমিতে দেখে আসবেন। আমি টিকিট পাঠিয়ে দেব।

পাঠিয়ে ছিল দুটো পাস। সোনালিদিভাই নিয়ে গেল সঙ্গে করে। নাটকের পর অঞ্জন এসে দেখা করেছিল। কথা হল মামুলি, চিত্রা মুগ্ধতা চেপে রাখতে পারছিল না। দারুণ লেগেছিল অঞ্জনের অভিনয়। যদিও অঞ্জন এখন বলে, তুমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলে বলে বেশি ভাল লেগেছিল। হবেও বা। একমাস বাদ ওদের দলের অন্য নাটকের টিকিট পাঠাল। সময় বার করতে পারল না সোনালিদি। দুটো টিকিটই চিত্রার হাতে দিয়ে বলেছিল, বন্ধু বা বাড়ির লোককে নিয়ে চলে যাস।

ইচ্ছে করে কাউকে নেয়নি চিত্রা। অঞ্জনের সঙ্গে একা দেখা করতে চেয়েছিল। হল দেখা। কথা হল অনেকক্ষণ ধরে। সোনালিদি থাকতে একটু যেন সপ্রতিভ ছিল অঞ্জন। এভাবেই আলাপ গড়াতে গড়াতে কখন যেন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। প্রায় বিনা প্ররোচনায়। যেভাবে নদীর অজান্তে চরা জেগে ওঠে বুকে।

চিত্রারা যে চরার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেটাও অনেকদিনের। ঘাসে ঢেকে গেছে বেশ কিছুটা অঞ্চল। চরার কিছুটা অংশ মূলভূমির সঙ্গে জুড়ে আছে। সেখানেই ঝাউ, শালপিয়ালের সারি। আরও কিছুটা হাঁটার পর আধো অরণ্যে পৌঁছে গেল চিত্রারা। একটা ঢিবি মতো জায়গায় উঠতেই, সামনের দৃশ্য দেখে দু’জনেই স্ট্যাচু হয়ে গেল। অঞ্জন অস্ফুটে বলে, কী অপরূপ না!

চিত্রার সায় দেওয়ার ক্ষমতা নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে অনন্য সুন্দর সূর্যাস্তের দিকে। জীবনে এর চেয়ে ভাল দৃশ্য চিত্রা দেখেনি। শিল্পীর কল্পনাকেও হার মানায় এই চিত্রপট। এখানে প্রকৃতিকে মনে হচ্ছে এয়োতির প্রতীক। লাল বড় সূর্যটা যেন সিঁদুরের টিপ। জলে ছড়িয়ে আছে তার আভা নাকি অহংকার! ওই বিশালতার সামনে বিহ্বল হয়ে কখন

যেন বালিতেই বসে পড়েছে দু’জনে। বিষম আলস্যে সূর্য ডুবছে। নিস্তব্ধতা আরও গভীর করতে মাথার ওপর ডাক দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে সিগাল!

অঞ্জনের কাঁধে মাথা রেখেছে চিত্রা। এই নিসর্গে অঞ্জন হয়ে উঠেছে বড় আপনার। জলের ওপর এই সিঁদুরখেলায় নিজেকে আর কল্পনার স্ত্রী মনে হচ্ছে না। অঞ্জন বলেছিল এই ট্যুরে নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক পরিচয় ভুলে থাকতে হবে। সত্যিই বিস্মরণ ঘটেছে চিত্রার। অঞ্জনের কি তাই? জানতে ওর চোখের দিকে তাকায় চিত্রা। অঞ্জনও দৃষ্টি নামায়। ওর চাউনি এখন একেবারে স্মৃতিহীন। দু’জনের ঠোঁট চুম্বকের প্রাণ পায়। চুম্বনের দীর্ঘসূত্রতায় মাথা হেঁট করে সূর্য। অঞ্জন ঠোঁট ফেরত নিয়ে বলে, চলো, একটু পরেই অন্ধকার নামবে।

কথাটা বলে, আরও কিছুক্ষণ চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে অঞ্জন। বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চায়, তুমি কাঁদছ কেন?

ও কিছু না। বলে উঠে দাঁড়াল চিত্রা। চোখ মুছে নেয় রুমালে। অঞ্জন দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করে না। ধরে নিয়েছে আনন্দাশ্রু। ফিরতে থাকে দু’জনে।

অনেকের মতো অঞ্জনও হয়তো জানে না ‘আনন্দাশ্রু’ বলে কিছু হয় না। অশ্রু সব সময়ই দুঃখের। ত্বক কেটে ছড়ে গেলে যেমন রক্ত বের হয়, তেমনই মনের সবচেয়ে নরম জায়গায় আঘাত লাগলে আপনা থেকেই অশ্রু বার হয়ে আসে। কিছুক্ষণ আগে অঞ্জনকে নিবিড়ভাবে পেয়েও এতটুকু অধিকার অর্জন করতে পারেনি চিত্রা। যেমন স্বপ্নে কাউকে স্পর্শ করা যায় না। দুর্লঙ্ঘ্য এক দূরত্ব থেকে যায়। দু’জনের রিলেশন রয়ে গেল একই অবস্থানে, অনির্দিষ্ট পরিচয়ে।

সন্ধে নেমে গেল নিশ্চুপে। চরাচর এখন অন্ধকার। হোটেলে ফিরে এসেছে চিত্রারা। ডাইনিং-এ বসে চা খেল দু’জনে। হোটেল স্টাফের সঙ্গে গল্পে জমে গেছে অঞ্জন। চিত্রা বলল, আমি রুমে যাচ্ছি।

যাও, একটু পরে যাচ্ছি আমি। বলে রুমের চাবি বাড়িয়ে দিল অঞ্জন।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে চিত্রা। পায়ে এত ব্যথা কেন! খুব বেশি হাঁটা হয়ে গেল কি? শাড়িতে বালি কিচকিচ করছে। গিয়েই শাড়ি ছাড়তে হবে। বন্দনার কথা মনে পড়ছে, একবারও তো খোঁজ নিল না! মা না হয় মনে করে মেয়ে তার যুধিষ্ঠিরের হারিয়ে যাওয়া বোন। কখনও মিথ্যে বলে না। হোটেলে পা দিয়েই বাড়িতে ফোন করেছিল চিত্রা। ভাইবউ ধরে। চিত্রা বলেছিল, মাকে বলে দিয়ো পৌঁছে গেছি। বন্দনা তো ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞেস করে একটা ফোন করতে পারত। চেষ্টা করেও ভাল থাকার উচ্ছ্বাসটা গলায় লুকোতে পারত না চিত্রা। বন্দনা অবাক হত চিত্রার অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে।

একশো তিনের দরজায় এসে দাঁড়ায় চিত্রা। তালা খুলে ঘরে ঢোকে। না, কালো শাড়ি পরা সেই চিত্রা এখন নেই। বদলে ঘর জুড়ে কেমন যেন পুরুষ-পুরুষ গন্ধ। একটা ভাপ মতো। কান মাথা গরম হতে থাকে চিত্রার। বিছানা দুটোই আরামের আহ্বান জানাচ্ছে। নিজেকে ভয় পেতে শুরু করে চিত্রা। বুঝতে পারে আজ রাতে বড় অঘটনটা ঘটেই যাবে।

হামাগুড়ি দিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ঢোকে মাথায়, দুর্ঘটনার কথা ভেবে আগাম সতর্কতা নিয়েছে তো অঞ্জন? নাকি ভাবুক মানুষ, ধরে বসেই আছে কল্পনাতে শরীর ঢোকা বারণ যখন, কন্ট্রাসেপটারি নেওয়ার দরকার নেই।

দরজা বন্ধ করে অঞ্জনের ব্যাগটা বিছানায় তোলে চিত্রা। সামান্য খোঁজাখুঁজিতে ছোট একটা মদের বোতল পাওয়া গেল। এটাও তো বারণ ছিল নেওয়া। কিন্তু অন্য প্যাকেট বা ফয়েল কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তন্নতন্ন করে খোঁজে চিত্রা। কেন নেয়নি অঞ্জন! চিত্রার শরীর জুড়ে কেমন একটা অস্থিরভাব শুরু হয়েছে। একে কি কাম বলে?

দরজায় ঠক ঠক। চমকে উঠে অঞ্জনের ব্যাগের চেন টানে চিত্রা। লাগেজটা মাটিতে বেডের পাশে রেখে দেয়। দরজা খুলে দিয়ে চিত্রা নিজের বিছানায় গিয়ে বসে। ঘরে ঢুকে অঞ্জন জানতে চায়, মুখটা এমন থমথম করছে কেন? বাড়ি থেকে ফোনটোন এসেছে নাকি?

চিত্রা কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে যায়। দরজার ছিটকিনি তোলে। সুইচ টিপে ঘরের আলোটাও নিভিয়ে দেয়। চিত্রার বিছানাতে অবাক ভঙ্গিতে বসে আছে অঞ্জন। চিত্রা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে অঞ্জনের দিকে। মনে মনে বলে, হোক, তোমার জন্য আমার সর্বনাশ হোক। কী ভেবেছিলে, আমার শরীর এতই উপেক্ষার বস্তু। কখনওই প্রলুব্ধ হবে না। তাই নাওনি কোনও সতর্কতা?

অঞ্জনের সামনে এসে সম্পূর্ণ শরীরটা ছেড়ে দেয় চিত্রা। ওর কানে আসে দরজার ওপারের ফিসফাস। মৃদু হুড়োহুড়ি। সমবয়সি, অল্পবয়সি সখীরা ফিরে এসেছে আবার। যাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। চিত্রার ঠোঁটে ফুটে ওঠে বেহায়া হাসি। বন্ধুরা একটু পরেই ক্লান্ত হয়ে শুতে চলে যাবে। অঞ্জন নিজেকে সামলে নিতে গিয়েও হার মানে কামনার কাছে। বাধা দেওয়ার বদলে পরম আশ্লেষে আলিঙ্গন করে চিত্রাকে। আগ্রাসী চুম্বনে চিত্রা ফেরত নিতে চায় এতদিনের ভালবাসায় সুপ্ত থাকা যৌনঋণ। অঞ্জনের হাত স্পর্শ করছে অনাবিষ্কৃত সব উপত্যকা, উপেক্ষিত অথচ আপন গরিমায় ডগমগ যুগল তুষার শৃঙ্গ। নির্জন হ্রদের মতো নাভি টেনে নিয়ে যাচ্ছে শিহরিত কুহকে। পোশাক সরিয়ে চিত্রার অবরুদ্ধ যৌবন শ্বাস ছাড়ছে, অদ্ভুত এক কামনার গন্ধ। চিত্রা তো আনাড়ি, সম্পূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা তার হয়নি। অঞ্জনও যেন হারিয়ে ফেলেছে সমস্ত কৌশল। দু’জনেই নিজেদের আবিষ্কার করছে আশ্চর্য এক মিলনে।

আচ্ছা, তুমি তো কখনও জানতে চাওনি, কেন এখনও বিয়ে করিনি আমি। কৌতূহল হয় না? আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন সকলেরই এই নিয়ে বিরাট প্রশ্ন। নিজের মতো করে কারণও খুঁজে নেয় তারা।

চিত্রার কথাটাকে বাতাসে খানিকক্ষণ ভাসতে দিল অঞ্জন। ওরা এখন হোটেলের ছাদে। আকাশে পূর্ণিমা অতিক্রান্ত অনুজ্জ্বল চাঁদ। অজস্র তারা। একশো তিনের ঘূর্ণিঝড়ের কোনও ছাপ নেই কোথাও। মদের ছোট বোতল আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম নিচু টেবিলে, পাশের চেয়ারে অঞ্জন। মদ্যপান বাধা দেয়নি চিত্রা, যে ভয়টা পাচ্ছিল, সেটা তো ঘটেই গেছে।

কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে কৌতূহল দেখানোটা আমার কাছে অশোভন বলে মনে হয়। এতক্ষণ পর উত্তর দিল অঞ্জন।

ছাদের পাঁচিলে ঠেস দিয়ে অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রা। ওর পিছনে চালচিত্রের মতো চাঁদের আলো লাগা সমুদ্র, ছায়াঘন ঝাউবন, ডানার অন্ধকার ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে উড়ে যাচ্ছে বড়সড় পাখি। চিত্রা জানতে চায়, আমাদের সম্পর্কটা কি পার্সোনাল পর্যায় নয়? একটু পজ দিয়ে চিত্রা নিজেই উত্তর দেয়, সম্ভবত নয়। আমার অতীত জানতে না চেয়ে তুমি একটা দূরত্ব বজায় রাখতে পারো।

তক্ষুনি কোনও প্রতিক্রিয়া জানায় না অঞ্জন। গ্লাসের শেষটুকু গলায় ঢেলে, নতুন করে ভরে নেয়। ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরিয়ে বলে, তোমার মতো সুন্দরীর এখনও বিয়ে না করার একটাই কারণ হতে পারে, কাউকে ভালবেসে ঠকে গেছ। ভুলতে পারছ না তাকে।

তাই যদি হবে, তোমাকে এত ভাল বাসলাম কী করে? চিত্রার প্রশ্নে নীরব থাকে অঞ্জন। ফের চিত্রাই বলতে শুরু করে, আমরা যখন এতই একে-অপরের মনের কাছাকাছি, পরস্পরের অতীত জানব না কেন? প্রথমে আমি শুরু করি, তার পর তুমি। একটু দম নিয়ে বলতে থাকে চিত্রা, আমার ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর পারিবারিক ব্যাবসা, হার্ডওয়্যারের দোকান বাবা, কাকা পায়। বাবা নরম, ভালমানুষ গোছের। কাকা ঠিক তার উলটো। ব্যাবসাটা কাকা প্রধানত চালাত, বাবা হিসেব লিখত শুধু। আমার তখন কলেজে ফাইনাল ইয়ার, কাকার কী মনে হল, ভাগ করতে চাইল ব্যাবসা, বাড়ি। সম্ভবত কাকার মাথায় ঢুকেছিল, খেটেখুটে ব্যাবসার উন্নতি করছে কাকা। বাবা তার লাভ ভোগ করছে অর্ধেক। অতএব যে যার বুঝে নাও। বাবার জন্যে নতুন দোকান সাজিয়ে দিল কাকা। বাবা একা ব্যাবসা সামলাতে হিমশিম খেতে লাগল। সংসারে শুরু হল টানাটানি। তখন থেকেই আমি বাড়িতে বড় ছেলের রোল প্লে করতে শুরু করি। এম এ পড়ছি, একই সঙ্গে ব্যবসায় হেল্প করছি বাবাকে। আমার ভাই ছোট থেকেই আড্ডাবাজ, পড়াশোনা মাধ্যমিকের গণ্ডি ডিঙোল না। ওকে বললাম বাবার সঙ্গে ব্যবসায় বসতে। বাড়ির মধ্যে আমাকে একটু ভয় পায় বলে বসল, কিন্তু মন পড়ে রইল বাইরে। চান্স পেলেই বাবাকে দোকানে ফেলে পালিয়ে যেত আড্ডা মারতে। ওর সম্বন্ধে বেশ কিছু খবর আসত কানে, বিভিন্ন মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ফেঁসে গেল একদিন। কলোনি এলাকার একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল, ওদের বাড়িতেও যেত ভাই। তবু অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরছে দেখে মেয়েটার দাদারা জোর করে ভাইয়ের সঙ্গে তাদের বোনের বিয়ে দিল। বরবউকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বলল, বোনের ওপর যেন কোনও অত্যাচার না হয়। ভাইবউয়ের বড়দা পার্টির গুন্ডা।

সমাজ, পরিবারে মর্যাদা ক্ষুণ্ন হল আমাদের। তার প্রভাব পড়ল ব্যবসায়। মানসিক ধাক্কায় মা-বাবা কেমন যেন গুটিয়ে গেল। ভাইটাও হয়ে গেল ভ্যাবলা মতো। তবে নতুন বউ কলোনি কালচার জাহির করার সুযোগ পায়নি। আমাকে বেশ সমীহ করে চলে। এইসব সামলাতে গিয়ে কখন যেন বিয়ের বয়স পার হয়ে গেল আমার। এখন বাড়ির অবস্থা মোটের ওপর স্থিতিশীল, মা সুযোগ পেলেই কানের কাছে গুনগুন করে, এবার বিয়েটা

করে নে। এখন তো বেশি বয়েসেও বিয়ে করছে মেয়েরা।

করছ না কেন বিয়ে? জানতে চায় অঞ্জন।

পাঁচিলের ধার থেকে এগিয়ে আসে চিত্রা। অঞ্জনের সামনে এসে দাঁড়ায়। কনুই ভাঁজ করা হাত রাখে ওর দুই কাঁধে। নিজের কপালটা অঞ্জনের কপালে ঠেকিয়ে বলে, তোমার জন্যে।

ছাদের খোলা দরজায় মৃদু টোকা পড়তে, চোখ তোলে চিত্রা। খুবই সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বয়। বলে, বউদি, ডাইনিং-এ আপনাদের ডিনার রেডি।

সূর্যোদয় দেখা হল না। দু’জনেরই ঘুম ভাঙল দেরি করে। রাতে আবারও ঝড় উঠেছিল রুমে। আজ বিকেলে ফিরে যাবে ওরা। এখন ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়াতে বেরিয়েছে। সমুদ্রতট আগের মতোই নির্জন। ইতিউতি দু’-চারজন ট্যুরিস্ট দেখা যাচ্ছে। চিত্রা পরেছে এথেনিক প্রিন্টের শাড়ি, চোখে ভ্রূ অবধি ঢাকা রোদচশমা। কিছুক্ষণ অন্তর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে অঞ্জন। চিত্রা জিজ্ঞেস করে, কী দেখছ এত বলো তো?

তোমাকে যে একেবারে ফিল্ম অ্যাকট্রেসদের মতো লাগছে। আজ সকাল থেকে আরও যেন ভাল দেখতে হয়ে গেলে! রহস্যটা কী?

চিত্রা লাজুক হাসে। মনে মনে বলে, তোমার অকৃপণ আদর পেয়ে দেখতে ভাল হয়ে গেছি। মুখে বলে, এখন কী দেখছ, স্কুল-কলেজবেলায় যদি দেখতে, পাড়াকাঁপানো মেয়ে ছিলাম! ব্যক্তিত্বের কারণে ছেলেরা আবার ভিড়তে ঠিক সাহস পেত না।

আরও খানিকক্ষণ হাঁটার পর চিত্রা বলে, তোমার বিগত জীবনের কথা কাল কিন্তু কিছু বললে না। কেন নিজেকে লুকিয়ে রাখছ বলো তো?

কলুষহীন বাতাসে বড় একটা শ্বাস নিয়ে অঞ্জন বলে, নাথিং স্পেশাল। এমনিই একটা মামুলি জীবন কাটিয়েছি। মধ্যবিত্ত পরিবার। লেখাপড়ায় মাঝারি। চাকরি পেলাম। দেখেশুনে বিয়ে হল। নাটক করে একটু ভাল থাকার চেষ্টা করি। ভীষণ বোরিং। তুমিও যে লাইফ কাটিয়ে এসেছ, সেটাও খুব একটা রেয়ার নয়। অনেক মেয়ের জীবনেই এমনটা ঘটে। এরকম নানা সমস্যার ঘেরাটোপে আয়ু একদিন ফুরিয়ে যায়। তাই তো আমি সমান্তরাল আর একটা জীবনের খোঁজে এখানে এসেছি। এটা অনেকটা নিজের অস্তিত্ব থেকে পালিয়ে আসা।

অঞ্জনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল চিত্রা। হঠাৎ কানে আসে, দিদি, আপনি এখানে!

চমকে উঠে ঘাড় ফেরায় চিত্রা, এক চান্সে চিনতে পারে, ভাইয়ের মেজশালা সুশান্ত। পাশে ওর সদ্য বিয়ে করা বউ। সপ্তাহখানেক আগে বউকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। ওদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও চিত্রা যায়নি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে চিত্রা বলে, বেড়াতে এসেছি।

দিঘায় উঠেছেন, না এখানে?

এখানেই। বলেই চিত্রা বুঝতে পারে ভুল হয়ে গেল।

কাল এসেছেন নিশ্চয়ই? এত সকাল সকাল তো এখানে পৌঁছোনো যাবে না। আমরাও এসেছি গতকাল। দিঘায় উঠেছি। ওকে চন্দনেশ্বর, তালসারি দেখাতে নিয়ে এলাম। আমি আগে এসেছি। দুর্দান্ত জায়গা। তবে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা। ননস্টপ বকে থামল সুশান্ত। এখন ওর দৃষ্টি অঞ্জনের দিকে। আলাপ না করিয়ে উপায় নেই। চিত্রা বলে, আমার বন্ধু… নমস্কারের ভঙ্গি করে অঞ্জন নিজের নামটা বলে দেয়। আর এক সর্বনাশ হল, মিথ্যে নাম বলবে ঠিক করেছিল চিত্রা। প্রতি নমস্কারে সুশান্ত নিজের নাম বলে এবং চিত্রাদের সঙ্গে রিলেশনটাও জানায়। তারপর চিত্রাকে জিজ্ঞেস করে, এখানকার হোটেল কেমন? রেট নিশ্চয় ভালই।

পা বসে যাচ্ছে বালিতে। হঠাৎ যেন নরম হয়ে গেছে বালি। চিত্রা কোনওক্রমে বলে, ওই আর কী।

কবে ফিরছেন?

আজই।

আমরা কাল ফিরব। পরশু যাব আপনাদের বাড়ি। বোন দিঘা থেকে একটা জিনিস এনে দিতে বলেছে, দেখি পাই কি না। এগোই তা হলে?

ঘাড় হেলায় চিত্রা। সুশান্তর বউ চিত্রা-অঞ্জনকে আড়ষ্ট নমস্কার জানিয়ে এগিয়ে যায়। খানিক পরে বউটা ঘুরে দেখে চিত্রাদের। একবার নয়, দু’বার। হাঁটুর সমস্ত শক্তি হারিয়ে চিত্রা বসে পড়ে বালিতে। চোখে হতাশ চাউনি।

অঞ্জন নিচু হয়ে কাঁধে হাত রাখে। এই সাক্ষাৎ, পরের বিপদ সে-ও টের পেয়েছে। আশ্বাসের সুরে বলে, এত ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে! ভেবেচিন্তে কিছু একটা বুদ্ধি বার করা যাবে খন।

বেগড়ি বাস স্টপেজ অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল অঞ্জন। দিঘা থেকে এতটা রাস্তায় কোনও জোরালো বুদ্ধি দিতে পারল না। সুশান্তর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে দু’জন ক্ষণে ক্ষণে বাড়িতে বলার মতো অজুহাত খাড়া করেছে, বাতিল করে দিয়েছে পরক্ষণেই। দুপুরে লাঞ্চ না করেই হোটেল ছেড়েছে ওরা। রাস্তায় অল্প কিছু স্ন্যাকস নিয়েছে। এখানে পৌঁছে গেল সন্ধের মুখে। এত ভাবনাচিন্তার মধ্যে অঞ্জন কিন্তু একটা ব্যাপার ভোলেনি। ভ্যান রিকশায় চেপে দিঘায় আসার পথে ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল। চিত্রা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, ওষুধ কেন?

অঞ্জন দিয়েছিল ছোট্ট উত্তর, কাল রাতের জন্যে।

অ্যাবরশন করতে যাওয়া ডাক্তারের পায়ের ছন্দে ‘পিল’ কিনে এনেছিল অঞ্জন। হাতে দিয়ে বলে, এখনই খেয়ে নাও।

বীজনাশক ট্যাবলেটটা রিকশায় বসেই খেয়েছিল চিত্রা। অঞ্জনের আচরণে কোনও নিষ্ঠুরতা ছিল কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তখন অন্য দুশ্চিন্তা, সুশান্ত তালসারি থেকেই বোনকে ফোন করে দিল না তো? হয়তো হাসতে হাসতে বলেছে, তোর ননদকে দেখলাম তালসারিতে এসে ফস্টিনষ্টি করছে।

সুশান্তর স্বভাব-চরিত্র ভালমতো জানা নেই চিত্রার। ওর গুন্ডাদাদার ছায়ায় ঢাকা পড়ে

গেছে বাকি ভাই-বোন। যদি দাদার মতো বদ না-ও হয় সুশান্ত, কেচ্ছাটাকে হাতছাড়া করবে না। তুলে দেবে বোনের কাছে। বোন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে অপদস্থ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। তখন কী অবস্থা হবে মা-বাবার সম্মানের। ভাই যতই লুচ্চা হোক, দিদিকেই মানে বেশি। হয়তো গর্বও বোধ করে। বউয়ের কাছে ছোট হয়ে যাবে ভাই… এ সব ভাবতে ভাবতে কখন যে মল্লিকবাড়ির গা দিয়ে বাড়ির দরজায় চলে এসেছে চিত্রা, খেয়ালই নেই। ছাতিমের গন্ধটা পর্যন্ত পেল না।

ভয়ে ভয়ে কলিং বেলে হাত রাখে। এতক্ষণে বাড়ির সবাই সব কিছু জেনে গেছে। মেয়েকে দেখেই ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেবে।

দরজা খুলল ভাইবউ। চিত্রাকে দেখে বলে উঠল, এই তো দিদি এসে গেছে। মা তখন থেকে চিন্তা করছেন।

চৌকাঠ ডিঙানোর সময় সন্দিগ্ধ কণ্ঠে চিত্রা জানতে চায়, কেন মা চিন্তা করছে? আমি তো বলেছিলাম আরও রাত হবে ফিরতে।

চিত্রাকে অনুসরণ করে সুমিতা বলে, না, আসলে বাবার শরীরটা খারাপ। ও গেছে দোকান খুলতে। আপনি না থাকলে বাড়ির কেউই তো তেমন বল-ভরসা পায় না।

একটা উৎকণ্ঠা আপাতত কাটে চিত্রার, সুশান্ত মনে হচ্ছে এখনও বোনকে ফোনে কিছু

জানায়নি। নতুন উদ্বেগে ভাইবউকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বাবার? তেমন কিছু না, সকাল থেকে জ্বর এসেছে।

সুমিতার হাতে লাগেজ দিয়ে চিত্রা বলে, আমার ঘরে রেখে এসো। বাবাকে দেখি আগে।

এখন রাত দশটা। রাতের খাওয়া সেরে চিত্রা মোবাইল ফোনটা নিয়ে ছাদে এসেছে। মাথা এখন অনেকটাই ভারহীন। বাবার এমন কিছু শরীর খারাপ হয়নি। চিত্রা না থাকাতে বাড়ির লোক ঘাবড়ে গিয়েছিল। খেতে বসে মা জানতে চাইছিল বেড়ানোর খুঁটিনাটি। চিত্রা বলেছে, আজ টায়ার্ড, পরে বলব। এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে একটা বিশেষ কারণ আছে। সুশান্ত আজ ফোন না করলেও, পরশু এ বাড়িতে আসছে। তখন হয়তো সবার সামনে তালসারির প্রসঙ্গ তুলে হেনস্থা করবে চিত্রাকে। তার আগেই পরিস্থিতিটা সামলানোর বুদ্ধি বার করে ফেলেছে চিত্রা। সেটাই এখন ফোনে বলবে, অঞ্জনকে।

মোবাইলের সুইচ টিপতে থাকে চিত্রা। বেজে গেল অঞ্জনের ফোন। একটু অপেক্ষা করে চিত্রা। অঞ্জন বোধহয় বউদি, ছেলের কাছাকাছি আছে। আলাদা হয়ে ফোন করবে ঠিক। প্রায় দশ মিনিট বাদে করল, বলো?

চিত্রা বলতে থাকে তার প্ল্যানটা, অঞ্জন কাল চিত্রাদের বাড়িতে আসবে। চিত্রা আলাপ করিয়ে দেবে মা-বাবার সঙ্গে। জানাবে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে তারা। মায়ের কাছে স্বীকার করে নেবে, বন্দনার দেশের বাড়ি যায়নি। গিয়েছিল অঞ্জনের সঙ্গে তালসারি। তা হলেই সুশান্তর আক্রমণগুলো ভোঁতা হয়ে যাবে।

পুরোটা শুনে অঞ্জন বলল, বিয়ের জন্যে মা যখন তাড়া দিতে থাকবেন তোমায়, কী করবে?

পয়েন্টটা ভাবাই ছিল চিত্রার। বলে, বলব ঝগড়া হয়ে গেছে ওর সঙ্গে। বিয়ে করব না। তখন আর আউটিং-এ যাওয়াটা অনাচার হিসেবে গণ্য হবে না। সুশান্তও ততদিনে পিকচার থেকে আউট হয়ে যাবে।

কিন্তু একটা মুশকিল আছে, তোমার বাড়ির লোক আমায় চিনে ফেলতে পারেন। বাংলা সিরিয়াল নিশ্চয়ই দেখেন ওঁরা। একটু খোঁজ নিলেই আমার সমস্ত খবরাখবর পেয়ে যাবেন।

অঞ্জনের কথার উত্তরে চিত্রা বলে, মা টিভি বড় একটা দেখে না। বাবা, ভাইয়ের নিউজ আর খেলার প্রতি আগ্রহ। ভাইবউ সিরিয়াল দেখে। তোমাদেরটা দেখে কি না জানি না। তবে ও যা হাঁদা। সিরিয়ালের চরিত্রের সঙ্গে তোমাকে মেলাতেই পারবে না।

তবুও, একটু বেশিই ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে না?

চিত্রার কথায় ভরসা না পেয়ে বলে অঞ্জন।

চিত্রা ওর আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলে, কিচ্ছু হবে না। তুমি এসো তো। এটা একটা গেঁয়ো জায়গা, মানুষগুলোও বোকাসোকা। তোমার কোনও ভয় নেই। কাল অফিসের পর চলে এসো।

ও কে, দেখছি। বলে, ফোন ছেড়ে দিল অঞ্জন।

ঠিক যেন ‘কথা’ দিল না। তা হলে কি না-ও আসতে পারে? আবার একবার ফোন করবে চিত্রা? না, ছোট করবে না নিজেকে। চিত্রার সম্মান বাঁচাতে কেন এই ছোট্ট অভিনয়টুকুও করবে না? দিনরাত অভিনয় নিয়েই তো থাকে।

মাঝে একটা দিন কেটে গেল। অঞ্জন এল না। আজ সকালে ফোন করেছিল চিত্রা। অঞ্জন বলল, ওর শ্বশুরমশাই নাকি বাথরুমে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন, দেখতে যেতে হয়েছিল। কাল অফিস ডুব গেছে, কাজের চাপ থাকবে আজ। তবু আসবে, যে করে হোক।

এখনও এল না। সন্ধে উতরে গেল। যে-কোনও সময় সুশান্ত চলে আসতে পারে। অঞ্জনকে ফোন করবে ভেবেও, করতে পারছে না চিত্রা। যদি বলে আজও আসতে পারছি না। অথবা এই তো অফিস থেকে তোমাদের বাড়ির উদ্দেশেই বেরোচ্ছি। ঘণ্টা দুয়েক লেগে যাবে আসতে। এই সময়টুকু বড় অমূল্য চিত্রার কাছে। নিজের ঘরে বসে হাঁফিয়ে উঠছে চিত্রা। ও কি বাইরে ঘুরে আসবে খানিকক্ষণ? আবার ইতিমধ্যে যদি সুশান্ত… কলিং বেল বেজে উঠল।

অঞ্জন নয়। সুশান্তই এল। পাশের ঘরে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, বউকেও এনেছে সম্ভবত। একটা হইচই ‘ভাব। যে-কোনও মুহূর্তে সুশান্তর ছড়ানো বিষ চলে আসতে পারে এ ঘরে। আড়ষ্ট হয়ে বিছানায় বসে থাকে চিত্রা। সুশান্ত এসে ঢুকল। মুখে ওরকম একটা অপরাধমার্কা হাসি কেন? বউকে নিয়ে ঢোকেনি। সে বোধহয় রইল সুমিতার ঘরে। অনিচ্ছেতেই ভ্রূ কুঁচকে আছে চিত্রার। সুশান্ত প্রথমেই যেটা বলে, চমকে ওঠে চিত্রা, আমি 88

বাড়িতে কিছু বলিনি। বোন বলছিল, আপনি নাকি ক’দিন বন্ধুর বাড়ি ঘুরে এসেছেন? চিত্রা দম বন্ধ করে সুশান্তর দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটা কি তাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায়?

বসতে পারি? বিছানায় বসার অনুমতি চাইল সুশান্ত। ঘাড় হেলায় চিত্রা। সুশান্ত খাটের প্রান্তে গিয়ে বসে। বলে, আমি তো আপনার বন্ধুকে চিনতে পারিনি, আমার বউ চিনেছে। ও কলকাতার মেয়ে। অঞ্জনদার নাটক দেখেছে। ওদের পাড়ায় কল শো হয়েছিল। টিভিতে তো দেখেইছে। কাল সিরিয়ালটা আমায় দেখাল। বউকে আমি মুখ বন্ধ রাখতে বলেছি। আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথাটা যেন কাউকে না বলে। শিল্পী, সেলেব্রেটি মানুষদের এক-দু’জন গার্লফ্রেন্ড থাকেই। নয়তো কাজের উৎসাহ পাবেন কোথা থেকে? ও সব নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল।

একটু থামে সুশান্ত। চিত্রা বুঝতে পারছে না প্রসঙ্গ কোন দিকে যাচ্ছে, আক্রমণ আসছে কোন পথে। ফের সুশান্ত শুরু করে, আপনাকে একটা উপকার করতে হবে দিদি, আমাদের পাড়ার ফাংশনে অঞ্জনদার দলের নাটক আনব। চেনাজানা সূত্রে রেট একটু কম নিতে বলবেন। এটা আমার ভাই হিসেবে রিকোয়েস্ট আপনাকে। ক্লাবে একটু র‍্যালা নিতে পারব আর কী।

সুশান্তর কথাগুলো বিপজ্জনক না হলেও, ব্যক্তিত্ব কেমন যেন ঢিলে পড়ে যাচ্ছে চিত্রার। বুঝতে পারছে এ বাড়ির প্রতি তার কর্তৃত্বও খানিক আলগা হয়ে গেল। চিত্রা বলে, ঠিক আছে, বলে দেব আমি।

থ্যাঙ্ক ইউ। বলে, খুশি মুখে ঘর ছাড়ে সুশান্ত।

নিজের ফোনসেটের দিকে চেয়ে বসে থাকে চিত্রা, অঞ্জনের কোনও খবর এল না। কতটা সময় কেটে গেল, খেয়াল নেই। ঘরে ঢুকল মা। বলল, বুঝলি চিত্রা, আজ একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছি।

কপালে ভাঁজ নিয়ে চিত্রা জানতে চায়, কী ধরলে?

এ বাড়ি থেকে জিনিস পাচার হচ্ছে।

কীরকম?

ক’দিন ধরে তোর মেজপিসির দেওয়া সিঁদুর কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছি না। আজ মনে হয় পাচার হয়ে গেল বউমার ভাইয়ের হাতে।

শান্তভাবে খাট থেকে নামে চিত্রা। বলে, না মা, ওটা আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। তুই! কেন?

উত্তর না দিয়ে চিত্রা মেঝেতে রাখা কিটব্যাগের দিকে যায়। কৌটোটা বার করে নিয়ে আসে মায়ের কাছে। ফাঁকা ভেবে মা কৌটোটা হাতে রাখল হেলানো অবস্থায়। ঢাকাসুদ্ধু সিঁদুর ছড়িয়ে গেল মেঝেতে।

অবাক হয়ে মা জিজ্ঞেস করে, এতে সিঁদুর নিয়ে গিয়েছিলি কেন?

বন্দনাদের গৃহদেবতাকে পরাব বলে। খুব জাগ্রত। মাথায় যা এল, বলে দিল চিত্রা। মা ফের জিজ্ঞেস করে, এয়োতি না হলেও সিঁদুর পরাতে দেয়?

নীরব থাকে চিত্রা। মাকে মনে মনে বলে, এয়োতি মানে কি ওই চিহ্নটুকুই। ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মা বলল, বউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঘরটা পরিষ্কার করে দেবে।

একটু পরে জলের বালতি, মগ নিয়ে এল সুমিতা। কালো সিমেন্টের মেঝে থেকে ধুয়ে দিচ্ছে সিঁদুর। স্থির চোখে সেই দিকে চেয়ে আছে চিত্রা। লাল রংটা নালা দিয়ে বেরিয়ে নদীতে পড়বে। জল বাষ্প হলেও থেকে যাবে রং। তালসারির মোহনা পেরিয়ে যখন সাগরের অস্তরাগে মিলিত হবে, তখনই ফিরে পাবে তার অহংকার। ওই দৃশ্যটা তো কল্পনার ছিল না। স্বচক্ষে দেখেছে চিত্রা। এয়োতির সেই ব্যাপ্ত ব্যঞ্জনা, কোনও পুরুষের পরিচয়ে তাকে বাঁধা যায় না। মনের চোখে দৃশ্যটা ক্রমশ প্রাণ পাচ্ছে, সিগালের ডাক পর্যন্ত ভেসে আসছে কানে।

না। এটা বিভ্রম। চিত্রার সেল ফোনটায় রিং হচ্ছে। সেটটা তুলে নেয় চিত্রা, স্ক্রিনে অঞ্জনের নাম। অন না করে ফোনের পরদার দিকে তাকিয়ে চিত্রা বলে, বলব না কথা। থাকো নিজের পরিচয়ে বন্দি হয়ে, পরদার আলো নিভে যায়। ফোন অফ করে দিয়েছে চিত্রা।

সানন্দা পার্বণী ২০০৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *