ভূতুড়ে কান্ড
মিঃ অনিরুদ্ধ বক্সীর আজ ফিরতে একটু রাত হলো। কর্মসূত্রে রাঁচিতে থাকেন। সপ্তাহ শেষে রিষড়া নিজের বাড়ি আসেন।
আষাঢ় মাস সারা আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। কিছু দলভ্রষ্ট মেঘ জায়গায় জায়গায় পুঞ্জীভূত। নিস্তব্ধ পরিবেশ। এমন ঘনঘোর অবস্থায় ড্রাইভারকে তিনি আস্তে গাড়ি চালাতে বললেন। বেতলা ফরেস্টের পাশ দিয়ে যখন গাড়ি ছুটছে তখন হাল্কা বৃষ্টি শুরু হলো।
ফরেষ্ট পেড়িয়ে কিছুটা যেতেই একটা ছোটো আদিবাসী গ্ৰামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা নালার ধারে বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনে মিঃ বক্সী ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। এমন ঘনঘোর যোগে কোন্ বাচ্চা এভাবে কাঁদছে।পথ হারালো নাকি? তিনি নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে।সন্ধান করতে এগিয়ে চললেন কোথা থেকে এই আওয়াজ আসছে।
হাল্কা জঙ্গলে ঘেরা জায়গা। একটু এগোতেই দেখলেন একটা সাদা রঙের শেয়ালের মতো অদ্ভুত দর্শন এক জন্তু মানুষের মত কান্নার আওয়াজ করছে। ওর চোখ দুটো যেন আগুনের মত জ্বলছে। অন্ধকারে সাদা অদ্ভুত চেহারা দেখে মিঃ বক্সী শিহরিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন গাড়িতে।
গাড়ি চলতে থাকে , কিন্তু মিঃ বক্সীর কেবল মনে হয় কেউ যেন তাঁর পাশে বসে আছে। গাড়ির ভিতর এদিক ওদিক অনেক তাকিয়ে খুঁজে যখন কিছু চোখে পড়লো না, তখন ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে ব’লে সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলেন। মনের ভীতি বা ফিলিংসয়ের কথা কিছু ড্রাইভারের সঙ্গে শেয়ার করলেন না। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ি এসে পৌঁছালেন।
বাড়িতে ঢুকে বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুতে গিয়ে বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলেন শেয়ালের মত মুখশ্রী কোনো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
বক্সী মশাই চমকে উঠলেন। তাঁর অনেক পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
মিঃ বক্সীর দু’বার বিয়ে। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান হয়েছিল ফুটফুটে ফর্সা কন্যা। কিন্তু কন্যার নাক মুখ জুড়ে একটা বড় জড়ুল ছিল। যার ফলে, মুখের অংশটা কালো বিশ্রী আর ঠোটের উপর অংশটা সামান্য উঁচু ও সুঁচালো মতো। মেয়ে যত বড় হয় মুখ তত স্পষ্ট হয়। এই কন্যাকে মিঃ বক্সীর একদম পছন্দ না। শুরু হয় মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। নানান অছিলায় মেয়েকে দিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
স্ত্রী মাধবী মানতে চায়না, এই নিয়ে মাঝে মাঝেই বাঁধে অশান্তি।
একদিন দুপুরে মেঘের ঘনঘটা ; মাধবী মেয়েকে নিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে , সেই ফাঁকে মিঃ বক্সী চুপিচুপি মেয়েকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দূরে ঝাড়খণ্ডের দিকে প্রত্যন্ত গ্ৰামে রাস্তার ধারে বসিয়ে রেখে চলে আসেন। মেয়ের তখন বয়স মাত্র দেড় বছর। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মেয়ের কান্না তাঁর মন গলাতে পারেনি।মিঃ বক্সীর ধারণা গ্ৰামের লোকের চোখে পড়লে নিশ্চয় বাড়ি নিয়ে গিয়ে যত্ন করবে।
ঘরে এলে মাধবী মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছেনা জানালে, মিঃ বক্সীর মধ্যে কোনো তাপ – উত্তাপ না দেখে মাধবী আন্দাজ করে , এ নিশ্চয় তাঁর স্বামীর কারসাজি।
অনেক ঝগড়া অশান্তি করে মাধবী চলে আসে বাপের বাড়ি।
নিকটবর্তী থানায় জানানো হয়, কিন্তু শিশুর কোনো হদিস মেলে না।
ওইটুকু শিশু কোথায় আছে? কিভাবে আছে ? আদৌও বেঁচে আছে কিনা এই নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মাধবী শেষে মারা যায়।
মিঃ বক্সী পরে আবার বিবাহ করেন। বর্তমানে তাঁর দুই ছেলে। দ্বিতীয় স্ত্রী অজানা জ্বরে দুবছর আগে গত হয়।
ছেলেরা বড় এবং বিবাহিত।
মিঃ বক্সী রাতে আর কিছু খেতে পারলেন না। মনের মধ্যে একটা ভীতিভাব। অনুভব করছেন কেউ তাঁর সঙ্গ নিয়েছে।
তাহলে কী ভূত! না, ভূতের অস্তিত্ব তিনি মানেন না কোনোকালেই। মনে হচ্ছে শরীর অবশ হয়ে আসছে। একটু জল খেয়ে বক্সী মহাশয় শুয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ যেন তাঁর রক্ত শুষে খাচ্ছে।
ধড়পড়িয়ে উঠে চীৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকে। ছেলেরা ছুটে আসে। বাবার মুখে সব শুনে স্বপ্নে ভ্রম হয়েছে বলে উড়িয়ে দেয়।
মিঃ বক্সী যেখানেই যাচ্ছে বেশ অনুভব করছেন অদৃশ্য কারও অস্তিত্ব।
মন অস্থির কিছুই ভালো লাগছে না। তাই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন ক্লাবের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখেন পাশের সিটে সাদা শেয়ালের মত সেই অদ্ভুত জন্তুটা বসে। শিউরে উঠলো তাঁর গা। মুহূর্তের অখেয়ালে গাড়ি গিয়ে ধাক্কা মারলো ডিভাইডারে। শরীরে অবশ ভাব থাকায় মিঃ বক্সী খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন না। তাই ধাক্কা মারলেও তাঁর বিশেষ ক্ষতি হয়নি, অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।
পথের লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি করে। সুস্থ হলে ছেলেরা ঘরে নিয়ে আসে।
বাবাকে বলে , এ অবস্থায় তোমার আর কাজে যেতে হবেনা। মিঃ বক্সীও এমন দুর্বল অবস্থায় কোনোভাবেই অত দূরে অফিস যাওয়া ঠিক নয় মনে করে চাকরিস্থলে যেতে সাহস করলেন না। মনের মধ্যে একটা ভীতি তাঁকে গ্ৰাস করছে। তাই ভলেন্টারী রিটায়ারমেন্ট নিলেন।
কিন্তু সমস্যা তাঁর পিছু ছাড়ে না। কে যেন প্রতিক্ষণ ছায়া হয়ে সাথে আছে। রাতে ঘুমোলে রক্ত খায়। ভয়ে ঘুমাতে পারেন না।
কাউকে একথা তিনি বিশ্বাস করাতে পারেন না। সকলের ধারণা তিনি মানসিক রোগগ্ৰস্থ। তাই তাঁর কাউন্সিলিং এবং ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা হলো। একা থাকতে ভয় পান বলে সবসময়ের জন্যে আয়া রাখা হলো।
যত দিন যাচ্ছে বক্সি মহাশয়ের চেহারা শীর্ণ রূপ নিচ্ছে। আয়াকে রাত্রিবেলায় ঘুমাতে দেন না। বলেন আমাকে ছুঁয়ে বসে থাকো।সে যে আসে আমার রক্ত খেতে।
আয়া বিরক্ত হয়। সকাল হলে ছেলেদের নালিশ করে। ছেলেরা বাবাকে বকাঝকা করে। বলে, দিন দিন বদ্ধ পাগল হচ্ছো।
কে আসে? তুমি দেখতে পাও?
মিঃ বক্সী বলেন, সাদা শেয়াল। অদ্ভুত দেখতে। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। ছেলেরা হেসে কথা উড়িয়ে দেয়।
বাবাকে বলে, ও তোমার মনের ভুল। আমরা তো কিছুই দেখতে পাইনা। তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো। ও সব ভুলভাল চিন্তা ভাবনা করবে না, দেখবে একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
মিঃ বক্সী যত বলেন রাতে সে আমার রক্ত খেতে আসে, তত ছেলেরা প্রলাপ মনে করে। বলে, খাওয়ার ঠিকমত খাচ্ছো না, তাই শীর্ণকায় হচ্ছো। ওই সব কিছু না, মনের ভয়।
অবশেষে মিঃ বক্সী অতীতের সেই ঘটনা, প্রথম পক্ষের কন্যার কাহিনী ছেলেদের কাছে প্রকাশ করলেন। বললেন, ঐ নির্জন গ্ৰামের পথে সন্ধ্যার সময় রেখে এসেছিলেন ; ভেবেছিলেন যদি কেউ দ্যাখে, কাছে নিয়ে রাখবে। সে মেয়ের কি হয়েছিল জানা হয়নি। খোঁজার চেষ্টাও করিনি। হয়তো সে কোনো জন্তুর আক্রমনে বেঘোরে মরেছে! তাই বুঝি শোধ নিতে এসেছে তার আত্মা।
ছেলেরা শুনে বাবার এমন অন্যায় কাজের ভৎসনা করলো।তারপর বললো, আজ প্রায় চল্লিশ বছরের পুরোনো ঘটনা, তার আত্মা এতদিন পরে এসেছে? ও সব ফালতু।
তোমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে, তাই এসব ভাবছো।
মিঃ বক্সী অসহায়ের মতো কাঁদছে। আয়াকে কেঁদে কেঁদে বলছেন, ওটা রক্তচোষা পিশাচ। প্রতিদিন রাতে আমার রক্ত খায়, আমি মিথ্যা বলছি না।
বেশ কয়েকদিন পর মিঃ বক্সী বুকের যন্ত্রণায় হাসপাতালে ভর্তি হন। আয়াও হাসপাতালে বক্সী মশাইয়ের সঙ্গে থাকে।
একদিন মাঝরাতে আয়া বাথরুম করতে গেছে, হঠাৎ বক্সী মশাইয়ের গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি এসে দেখে একটা সাদা রঙের শেয়ালের মত জন্তু মিঃ বক্সীর বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে জানলা দিয়ে বেড়িয়ে গেল। বিছানার চাদরে তাজা রক্তের ফোঁটা।
মিঃ বক্সী প্রাণহীন নিথর।
আয়া চাক্ষুষ সাক্ষী। তার কাছে স্পষ্ট হলো মিঃ বক্সী ভুল কথা বলতেন না।
ডেথ সার্টিফিকেট -এ লেখা হলো হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু।