Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হোঁৎকার কোঁৎকা || Shaktipada Rajguru

হোঁৎকার কোঁৎকা || Shaktipada Rajguru

আমাদের স্কুলের নতুন হেড মাস্টারের চেহারাটা বেশ লম্বা-চওড়া। গুরু-গম্ভীর ধরনের মানুষ। গলার স্বরটাও বেশ কঠিন ও ওজনদার তার চেহারার মতই। একজোড়া পুরুষ্ঠ গোঁফ আর চোখদুটো যেন বাঘের মত—যেন চারদিকে সব সময় ঘুরছে।

নতুন স্কুলে জয়েন করেই—আমাদের স্কুলে নতুন হেডমাস্টার বিক্রম সরখেল বেশ কিছু নিয়ম জারি করলেন—পাঁচ মিনিটের লেটে কেউ ক্লাসে ঢুকলে তাকে ক্লাসে কল দেওয়া হবে না ৷

স্কুল চলাকালীন পাঁচিল টপকে কোনো ছাত্র পালাবার চেষ্টা করলে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

ক্লাসে বদমাইশি-মারপিট করলে গার্জেন কল করা হবে ইত্যাদি।

ফলে হোঁৎকা এবং তার দলবলের খুবই অসুবিধা হয়ে গেল। কারণ স্কুলের বেশিরভাগ বেনিয়মই তারা করে। ফলে এইরকম বেনিয়ম করতে গিয়ে এর মধ্যেই হোঁৎকা ধরা পড়ে গেছে—সেদিন পাড়ার ফুটবল ম্যাচের ফাইনাল খেলা, হোঁৎকা নিজে খেলছে—হোঁৎকা আর গোবর্ধন ওরফে গোবরা দুজন দলের ব্যাক। তাই ফোর্থ পিরিয়ডের ক্লাস না করেই পাঁচিল টপকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়বি তো পড় একেবারে হেড স্যারের চোখে পড়েছে।

বিক্রমবাবু সেদিন স্কুলের পিছনদিকে বিল্ডিং-এর কাজ দেখে ফিরছিল আর সেই মুহূর্তে হোঁৎকা পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে তার ঘাড়েই পড়েছে। হোঁৎকা-গোবরা ভাবতেই পারেনি যে হেড মাস্টার এভাবে এদিকে এসে পড়বে। হেড স্যার তাদের দুটোকে ধরে নিয়ে এসে সেদিন স্কুলের অফিসের সামনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন স্কুল ছুটির পর অবধি।

ওদিকে গোবরা আর হোঁৎকাকে ছাড়াই তার ফুটবল টিম ফাইনাল খেলায় নেমেছে— শেষ পর্যন্ত তাদের টিম ছ-খানা গোল খেয়ে গো-হারান হয়েছে ।

স্কুল থেকে ছাড়া পাবার পর ক্লাবে এসে দেখে দলে জয়জয়কার নয়—হাহাকার চলছে। টিম ছয় গোল খেয়ে বসে আছে। হোঁৎকার এবার রাগ গিয়ে পড়ে স্যারের উপর। হোঁৎকা বলে, ওই হেডুরে আমিও দেইখা লইমু। অর জন্যে জেতা খেলা হাইরা গেলাম। ছ-ছয় খান গোল খাইলাম।

গোবরা বলে-কি করবি?

হোঁৎকা বলে—কি আর করব? যা হবার তো হইয়া গেছে।

চ্যালেঞ্জ কাপ খানা হাত থেকে চলে গেল।

গোবরা – ছেড়ে দে যা হবার হয়ে গেছে।

হোঁৎকা বলে–যা লজ্জাজনকভাবে আমাদের হারতে হইল তাতে আমাগো সুইসাইড ছাড়া কোনো পথ নাই।

আমি বলি—হ্যাঁরে। সুইসাইড মানে তো আত্মহত্যা। তুই কি তাই করবি ভাবছিস।

গোবরা ভরসা দেয়—থাম তুই। উঃ বুকখানা ফেটে যাচ্ছে রে হোঁৎকা। ওই হেডু স্যারই আমাদেরকে মার্ডার করল।

ক্লাসে আমরা সকলেই সন্ত্রস্ত। পান থেকে চুন খসলেই হেড স্যারের তলব। স্কুলে কেউ গোলমাল পাকালে কেউ মারপিট করলে অমনি বিক্রম স্যারের তৎপরতা শুরু হল।

সেবার পলাশ ক্লাসে যেভাবে নিত্যকে সামান্য কি কারণে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে তার বুকের ওপর চেপে বসে স্কুলের নাটকের দুঃশাসনের মত গর্জন করে বলছিল,—রক্তপান করে তৃষ্ণা মেটাইবো মোর ।

হেডস্যারের নজরেই পড়ে যায় সেই রক্তপানের দৃশ্যটা। তিনি দুঃশাসনরূপী নেতার কান ধরে টেনে তুলে বেশ করে মুলে দিয়ে গার্জেন কল করে গার্জেনকে ডেকে নিত্যর মহাভারত কাহিনি ব্যাখ্যা করে তাঁদেরকে হুঁশিয়ারি দেয় ।

ক্লাস নাইনের দোল গোবিন্দ ভালো হিন্দি গান গায়। আমরা ওকে ক্লাস কুমার বলি। তার গান শুনে সেবার স্যার ক্লাসে ঢুকে দোল গোবিন্দের গলাটাই টিপে ধরে—তাতে করে বেচারার দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল। এমনকী পাঁচ পিরিয়ড পর্যন্ত বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এ যেন আমাদের সকলেরই অপমান।

এভাবেই যতদিন যায় বিক্রম স্যারের বিক্রম ক্রমাগত বেড়ে যেতে লাগল আর আমাদের লাইফও হেল হয়ে উঠল।

এদিকে হোঁৎকাও নীরব রাগে ফুঁসছে—তার টিম ছ-গোলে গোহারান হেরেছিল। হোঁৎকার মাথায় মাঝে মধ্যেই নানা উদ্ভট বুদ্ধি খেলে। আমাদের ক্লাসে সেই বিশেষ পরামর্শদাতা । যতিন-অর্করাও বলে—একটা কিছু কর হোঁৎকা। এ তো স্কুল নয় রে—যেন জেলখানা হয়ে গেছে রে।

হোঁৎকা বলে—ভাবতাছি এই স্কুলই ছাইরা দিমু-তয় মোকা খুইজ্যা হেডুরে এমন গোঁত্তা দিয়া যাইবো। হোঁৎকা তার দেশজ ভাষাতেই কথা বলে।

আমি বলি—যাবার আগে কিছু একটা কর। একটা ফিনিসিং টাচ্ দিয়ে যা ।

কদিন পরেই আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা উৎসব। এবারে বৈশাখের শেষদিকে পড়েছে উৎসবটা। এতদিন স্কুলের মাঠেই মঞ্চবেঁধে উৎসব পালন করা হত—সেখানে কিছু নেতা-শিক্ষকরা ভাষণ দেন। তারপর আমাদের নাচগান-নাটক করা হত।

এইবারে বিক্রম সরখেল এই উৎসব আরও ঘটা করে করতে চান—যাতে স্কুলের প্রচার বেশি করে হয়। এবার সব ছাত্রদের নিয়ে বিক্রমবাবু বলেন—বেলা নয়টায় স্কুল থেকে পদযাত্রা শুরু হবে প্রসেসান করে। সব ছেলেকে সেই শোভাযাত্রায় অংশ নিতে হবে। শহর পরিক্রমা করে দুপুরে এই পদযাত্রা ফিরে আসবে স্কুলে।

বিকালে আবার সন্ধে পর্যন্ত ভাষণ-নাচগান অন্যান্য অনুষ্ঠান হবে।

বিক্রমবাবু অর্ডার দেন—সব ছাত্রকেই উপস্থিত থাকতে হবে পদযাত্রায় ।

বৈশাখ মাস—অনেকদিন বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই। সকাল থেকেই রোদ, সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে জেরবার হতে হচ্ছে।

আমাদের শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে। রোদের তাপও বাড়ছে। সমবেত গান গাইতে গাইতে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে এগিয়ে চলেছে শোভাযাত্রা। রোদের তাপটা ক্রমশ বাড়ছে। বোতলে জলও শেষ। এদিকে আবার গান থামালেই বিক্রমবাবু গাড়ি থেকে চিৎকার করবে—থামলে কেন? গান গেয়ে যাও-

আর গান। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘামছি-রোদের তাপে চোখে সরষের ফুল দেখছি—পথ চলতে চলতে মনে হয় মাথা ঘুরেই এবার ছিটকে পড়তে হবে। তবু গলা ছেড়ে গাইতে হচ্ছে।

পথের দুদিকে উৎসাহী দর্শকের ভিড়—ঠা ঠা রোদে আমাদের করুণ অবস্থা তারাও দেখছে। জনতার মধ্যে থেকে গুঞ্জন ওঠে—এই ঠা ঠা রোদে ছেলেগুলোকে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে?

কে বলে–বেচারারা আধমরা হয়ে গেছে। সান স্ট্রোক না হয়ে যায়।

ওদের দেহয় দয়ামায়া আছে, হেড স্যারের তা নেই। চলতে আর পারছি না।

গোবরা বলে– মাথা ঘুরছে রে।

ওদিকে গুম হয়ে চলেছে হোঁৎকা। সেও শুনেছে—গোবরা কি বলেছে—পা আর চলতে চাইছে না তবু চলতে হচ্ছে,—তবু গান গাইতে হচ্ছে।

হরিসাধন বলে—মরে যাব রে হোঁৎকা। কিছু একটা কর।

হোঁৎকা গুম মেরে চলেছে। হেড স্যারের আবার চিৎকার শোনা যায়। হঠাৎ কলরব ওঠে—হোঁৎকা রোদের মধ্যে হঠাৎ ছিটকে পড়েছে রাস্তায়।

হোঁৎকা রাস্তায় ছিটকে পড়ে ছটফট করছে—চোখ কপালে উঠে গেছে—মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরুচ্ছে। শোভাযাত্রা থমকে যায়। পথচারীদের ভিড় জমে যায় মুহূর্তে। এর মধ্যে পথের ধারে দোকান থেকে জল এনে চোখে-মুখে দেওয়া হয়েছে। হোঁৎকা তবু ছটফট্ করেই চলেছে সঙ্গে গোঙানির শব্দ ওঠে।

লোকজন এবার ফুঁসে ওঠে—এই রোদে ছেলেগুলোকে পদযাত্রা করাচ্ছেন মশাই। আপনারা মানুষ না অন্যকিছু। বিক্রম স্যারও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে-পথচারীরা এবার হেডস্যারকেই আক্রমণ করে।—মারবেন নাকি মশাই, এই বাচ্চা ছেলেগুলোকে। এ রোদে কেউ ছেলেদের নিয়ে এইভাবে বাইরে বেড়ায়। আপনি মাস্টার না মার্ডারার। বন্ধ করুন আপনাদের এই পদযাত্রা। না হলে আমরাই প্রতিবাদ করব।

এর মধ্যে কে যেন অ্যাম্বুলেন্সেও খবর দিয়েছে—ইতিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সও এসে পড়ে। চোখে-মুখে জল দিতে হোঁৎকা এবার একটু সাড়া দেয়।

হেড স্যারও ঘাবড়ে গেছে—বাবা হোঁৎকা। এখন কেমন লাগছে?

—অ্যাঁ। হোঁৎকা একটা শব্দ করেই আবার লেপটে পড়ে। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় হোঁৎকাকে।

হেডু-র পদযাত্রা এখানেই ভেস্তে যায়। হেড স্যার বাধ্য হয় তার সাধের পদযাত্রার ইতি টানতে।

আমরা হোঁৎকাকে হাসপাতালে রেখে বাড়ি ফিরে গেলাম। মনটা ভালো নেই। বিকালে তবু স্কুলে আসতে হয়েছে। আমাদের অনুষ্ঠান আছে—তাছাড়া হেড স্যারের হুকুম। পরের দিন দেখি যথারীতি ক্লাবে এসেছে হোঁৎকা। সঙ্গে গোবরাও আছে।

আমি বলি–কি রে? হাসপাতাল থেকে এত তাড়াতাড়ি তোকে ছুটি দিয়ে দিল?

হোঁৎকা বলে—ধুস। ওসব আমার কিছুই হয়নি। তোরা রোদে আর হাঁটতে পারছিলি না আর হঠাৎ লোকজনের মুখে সান স্ট্রোকের কথাটা শুনে হেডুকে একটা শিক্ষা দেবার মওকা হাতছাড়া করতে পারলাম না। আর তাই রাস্তায় ছিটকে পড়ে একটা নাটক করলাম। আমার কিছুই হয়নি। ডাক্তাররাও তাই আমাকে ছাইরা দিল।

পরের দিন থেকে হেড স্যারের ব্যবহারটা কেমন যেন একটু নরম হয়ে গেছে। শুধু হোঁৎকা কেন অনেককেই একটু ছাড়পত্র দিয়েছেন। হোঁৎকাও তাই এই স্কুলেই রয়ে গেছে আগের মতই ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *