হোটেলের দরজা সারারাত খোলা
হোটেলের দরজা এমনিতেই সারারাত খোলা থাকে। আজ শনিবার, লোকজনের আনাগোনার বিরাম নেই। রাস্তার ঈষৎ অন্ধকার প্রান্ত থেকে আলোয় উজ্জ্বল হোটেলের দরজার কাছে আসবার আগে তপন দ্বিতীয় রুমালটি নিয়ে আর একবার মুখ মুছে নিল ভালো করে। আগে একটা রুমাল রক্তে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তপন সেটা ফেলে দিয়েছে, বাঁ-চোখে ভোঁতা ধরনের ব্যথা, আঙুল দিয়ে তপন অনুভব করে দেখল–ভুরুর কাছে এর মধ্যেই বেশ ফোলা।
হোটেলের দরজা ঠেলে ঢুকেই তপনের যেন কীরকম একটা অনুভূতি হল। তপন যথাসম্ভব মাথাটা নীচু করে মাতালের ভঙ্গিতে ঢুকেছিল–যাতে অন্য কেউ তার আহত মুখখানা লক্ষ না করে, তবুও তপন কিছু-একটা অনুভব করে চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখল। লাউঞ্জে অ্যালিস বসে আছে। তপনকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল, তপন তার দিকে এক পলক চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। সোজা কাউন্টারের সামনে এসে নিজের ঘরের চাবি চাইল, ডেস্ক ক্লার্ককে গুড নাইট জানিয়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে।
অ্যালিস ততক্ষণে তপনের পাশাপশি চলে এসেছে। অ্যালিস কিছু বলবার আগেই তপন বলল, কী খবর, অ্যালিস? এত রাত্রে? শান্ত নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর তপনের, কোনো অভিযোগ বা অভিমান বা ক্রোধ নেই, যেন একটা শিশুর সঙ্গে কথা বলছে। অ্যালিস কিছুই বলল না, সে তপনের সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছে লিফটের দরজার কাছে। তপনই আবার নরম গলায় বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে অ্যালিস, এখন বাড়ি যাও!
এতক্ষণ সোজাসুজি তপনের মুখের দিকে তাকায়নি অ্যালিস, এই প্রথম সে তপনের অস্বাভাবিক মুখখানা দেখতে পেয়ে একটা আর্তনাদ করতে গিয়ে তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিল। পাতলা সাদা দস্তানা পরা হাত অ্যালিসের, মনে হয় ধবল তুষারের মতো। সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তোমার চোখে কী হয়েছে? কী করে হল?
লিফটের জন্য বোতাম টিপে তপন বলল, বিশেষ কিছু না, সিঁড়িতে পা স্লিপ করে গিয়ে ধাক্কা লেগেছে। অনেক রাত হয়েছে, তুমি এখন বাড়ি যাও!
তোমার এক্ষুনি কোনো ডাক্তার দেখানো উচিত।
ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি, তিনি বলেছেন, কিছুই হয়নি, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।
স্বয়ংক্রিয় শূন্য লিফট নীচে নেমে এল, দরজা খুলে গেল। তপন লিফটের মধ্যে এক পা বাড়িয়ে ঠিক আগেকার মতনই শান্ত নিরুত্তাপ গলায় বলল, বাড়ি যাও, অ্যালিস, গুড নাইট!
অ্যালিস উত্তর দিল না, দরজা বন্ধ হবার আগেই সে তাড়াতাড়ি লিফটের মধ্যে এসে ঢুকল, নিজেই বোতাম টিপে দিল। চতুষ্কোণ লিফটের বন্ধ বাতাসের মধ্যে ওরা শুধু দু-জন। কেউ আর কোনো কথা বলল না। অ্যালিস উৎসুকভাবে তপনের দিকে চেয়ে আছে, তপন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। অত কাছাকাছি, ওদের পরস্পরের নিশ্বাস পর্যন্ত মিলে-মিশে যাচ্ছে এক সঙ্গে, তবু কোনো কথা নেই।
চারতলায় এসে লিফট থামতেই তপন বেরিয়ে এল, সঙ্গে সঙ্গে অ্যালিস। করিডোরে দাঁড়িয়ে তপন প্রায় মিনতির ভঙ্গিতে বলল, আমি এখন একা থাকতে চাই, প্লিজ অ্যালিস, তুমি বাড়ি যাও!
উত্তরের অপেক্ষা না করেই তপন হাঁটতে শুরু করল, উত্তর না দিয়েই ওর সঙ্গে সঙ্গে এগোল অ্যালিস। লম্বা বারান্দাটা সম্পূর্ণ নির্জন, চাপা আলোয় ছাওয়া, পিছনে না তাকিয়েও তপন অ্যালিসের জুতোর খট খট শব্দ শুনতে লাগল। নিজের ঘরের সামনে এসে দরজার ফুটোয় চাবি ঢুকিয়েছে। অ্যালিস তখন আবার ফিসফিস করে বলল, প্লিজ, প্লিজ, টপন, আমাকে কিছুক্ষণের জন্য তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দাও!
তপন যেন ক্লান্ত, খুবই ক্লান্ত–সেইরকমভাবে করুণ ও মিনতিভরা গলায় বলল, আমার সত্যিই এখন ভালো লাগছে না অ্যালিস, আমি এখন সম্পূর্ণ একা থাকতে চাই! প্লিজ, আমি অনুরোধ করছি এখন বাড়ি যাও!
দরজা খুলে তপন ঘরে ঢুকতেই খানিকটা জোর করেই অ্যালিসও ঢুকে এল, দরজা বন্ধ করে সেখানে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে দু-ফোঁটা জল টলটল করছে। একটু হাওয়া দিলেই যেন তা গড়িয়ে পড়বে।
তপন দু-এক সেকেণ্ড স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল তার দিকে, যেন সে এক্ষুনি তাকে আলিঙ্গন করবার জন্য হাত বাড়াবে। অ্যালিসের শরীরটা দুলছে, যেন তপন তার দিকে হাত বাড়াবার সামান্য চেষ্টা করলেই সে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তপনের মুখের কোমল ভাবটা হঠাৎ বদলে গেল, অস্বাভাবিকভাবে সে চেঁচিয়ে উঠল, গেট আউট! উইল য়ু? হাউ অ্যাবাউট লিভিং মি ইন পীস! তপনের চিৎকারে যেন সারা-হোটেলটাই কেঁপে উঠল। অ্যালিস এগোতে এগোতে বলতে লাগল, টপন, আমাকে একটু দয়া করো, আমাকে একটু সময় দাও!
বেরিয়ে যাও বলছি, কুত্তি কাঁহাকা! তোকে হাজার বার বলেছি, তোর ওই জঘন্য মুখ আমি আর দেখতে চাই না!
প্লিজ টপন, আমাকে একটা কথা বলতে দাও।
না! আমি তোকে
টপন, ক-দিন আগেও তুমি আমাকে–সেই কথা ভেবে–শুধু একবার।
আমি সহ্য করতে পারছি না তোকে, আ আম টায়ার্ড, আ আম টায়ার্ড অব য়ু! এভরি টাইম আই সি য়ু, ইউ গড ড্যাম লিটল বিচ, য়ু ক্ৰল অল ওভার মি! নাউ, গেট আউট। ভালো চাও তো এক্ষুনি বিদাও হও!
অ্যালিস আর পারল না, ভেঙে পড়তে পড়তেও তপনের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল, তপন তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। অ্যালিস ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, টপন, তুমি আমাকে বরং মারো, মারো, তবু ওই বিশ্রী আমেরিকান ভাষায় গালাগাল দিয়ো না!
গালাগাল দেব না! গালাগাল শোনার জন্য কে তোকে এখানে আসতে বলেছে? আমি বারবার বারণ করিনি! নির্লজ্জ বেশ্যা কোথাকার!
তোমাকে বলতেই হবে, আমার কী দোষ!
তোমার কোনো দোষ নেই!
টপন, কেন তুমি আমাকে দেখলেই পাগলের মতন ব্যবহার করছ!
তার কারণ, আমি পাগল! হয়েছে তো! বিদেয় হও!
টপন, তুমি সব কথা খোলাখুলি বলছ না কেন?
আমার কিছু বলার নেই। আমার মেজাজ এখন ভয়ংকর খারাপ, আমি একা থাকতে চাই, কেন আমাকে জ্বালাতে এসেছ?
আমি তোমাকে ভালোবাসি–গত চার-পাঁচ দিনের মধ্যে আমি একটি মুহূর্তও তোমাকে ভুলতে পারিনি–এই ভালোবাসা আমাকে সর্বস্বান্ত করে দেবে–তুমি দু-একদিনের মধ্যেই চলে যাবে–তোমাকে বলে যেতেই হবে, তুমি কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ, কেন তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে চাও না।
আঃ ভালোবাসা, আর ভালোবাসা! ভালোবাসা কি একটা চেয়ার না টেবিল না ঘড়ি না এক বোতল মদ–যে আমি নেব? তোমাকে আমি সহ্য করতে পারি না–তোমার ভালোবাসা কি আমি ধুয়ে খাব? আই কেয়ার আ লিটল ফর ইয়োর লাভ। আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে, তুমি এখন ভালো চাও তো যাও, আমি তোমাকে অনেকবার সাবধান করেছি।
অ্যালিস আচ্ছন্নের মতো এগিয়ে এল তপনের দিকে। সারামুখ তার কান্নায় ভেসে যাচ্ছে। হেঁচকি তোলা কান্নায় সে বলল, তোমাকে ভালোবাসতে হবে না, তুমি শুধু একবার আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলো, একবার আমার দিকে তাকাও।
রাগের সময় তপনের কোনো কান্ডজ্ঞান থাকে না। সে অন্ধ গোঁয়ার হয়ে যায়। অ্যালিসের অশ্রুময় সুন্দর মুখখানি দেখে তপন একটুও বিচলিত হল না, আরও চেঁচিয়ে বলল, না, না, দেখতে চাই না ওই মুখ। তারপরই তপন প্রচন্ড শক্তিতে এক থাপ্পড় বসাল অ্যালিসের গালে, অ্যালিস ঘুরে পড়তে পড়তেও খাটের বাজু ধরে সামলে নিল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল তপনের দিকে। তপনের বাঁ-চোখটা প্রায় কেটে গেছে–ভুরুর কাছে এত ফোলা। চোখের ভেতরটা টকটকে লাল–চুলগুলো এলোমেলো। অ্যালিস এবার আর কাঁদল না। যেন তার ওপর কিছু একটা ভর করেছে–সেইরকম ঘোরের মধ্যেই সে আবার এগিয়ে এল তপনের দিকে। বলল, আমি যাব না, আমি যাব না। তুমি আমাকে খুন করলেও আমি এখান থেকে যাব না।
তুমি জানো না আমি কীরকম অবস্থার মধ্যে আছি! তুমি যদি এক্ষুনি না যাও, আমি হয়তো সত্যিই তোমাকে খুন করতে পারি। আমি আবার সাবধান করে দিচ্ছি, এখনই যাও।
তাই করো, আমাকে খুন করো, যদি তুমি তাই করতে চাও। অ্যালিস আচ্ছন্নের মতন একেবারে তপনের সামনে এসে গলাটা বাড়িয়ে দিল। তপন উন্মত্তভাবে, কোনো বিবেচনা না করেই দুই শক্ত হাত দিয়ে গলা টিপে ধরল অ্যালিসের, অ্যালিস মুখ দিয়ে একটা চাপা আওয়াজ করে ছটফটিয়ে উঠল, তপন এক ঝটকা দিয়ে তাকে ফেলে দিল মাটিতে। অ্যালিস হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর কোনো শব্দ করল না। তবুও রাগ গেল না তপনের, একটা লাথি কষাল অ্যালিসের পড়ে থাকা মূর্তির গায়ে। তারপর বাথরুমের দিকে এগোল হাত-মুখ ধুতে।
এই সময় দরজায় ধাক্কা। তপন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কে? এতরাত্রে আমি কারুর সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
কোনো উত্তর এল না, দরজায় আবার ধাক্কা পড়ল।
তপন রুদ্র মূর্তিতে এসে খটাং করে দরজা খুলে আগলে দাঁড়াল, জিজ্ঞেস করল, কী চাই? একজন প্রৌঢ় শ্বেতাঙ্গ, সৌম্যমুখ–সম্ভবত ইংরেজ নয়, ইউরোপের অন্যদেশীয়, ঈষৎ ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ইয়ংম্যান, তোমার ঘরের মধ্যে কী হচ্ছে? এত শব্দ!
তপনের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। কর্কশভাবে উত্তর দিল, কিছু হয়নি, মাইণ্ড ইয়োর বিজনেস।
কিন্তু আমার মনে হল
তোমার কী মনে হল না হল, তা জানার কোনো কৌতূহল আমার নেই। এত রাত্রে আমাকে বিরক্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই।
কিন্তু তোমার চেঁচামেচিতেই আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে।
তাহলে শ্লিপিং পিল খাও।
তোমার ঘরে স্পষ্ট মেয়েলি গলার কান্না শুনতে পেয়েছি, কেউ যেন পড়ে গেল।
বল্ডারড্যাস! গুড নাইট!
লোকটি তবু মুখ বাড়িয়ে তপনের ঘরের মধ্যে দেখার চেষ্টা করল। তপন তার কাঁধে হাত দিয়ে আটকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শোনো, তোমার যদি কোনো কমপ্লেন থাকে তাহলে ম্যানেজারকে বলো–কিংবা ডাক্তারের কাছে যাও–কিন্তু তোমার ওই নোংরা নাক গলিয়ে আমাকে আর বিরক্ত করতে এসো না।
লোকটি হতভম্বের মতো তপনের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটি আগাগোড়া নম্রভাবেই কথা বলছিল, তপনের কাছ থেকে এইরকম ব্যবহার সে আশা করেনি। তার প্রায় মুখের উপরই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল তপন। মাটিতে পড়ে থাকা অ্যালিসের দিকে সে আর তাকিয়েও দেখল না। আবর্জনার স্তূপের মতন তাকে পাশ কাটিয়ে আবার চলে এল বাথরুমের কাছে। ক্রোধে তখনও তপনের নাকের ডগা, চোখের কোণ আর আঙুলের ডগাগুলো জ্বালা করছে। সিঙ্কের কাছে এসে ঠাণ্ডা জলের কল খুলে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিল কয়েকবার। বাথরুমের আয়নায় নিজের অস্বাভাবিক বিকৃত মুখখানা দেখেও সে বিচলিত হল না, কাটা ঠোঁট কিংবা ফোলা চোখ নিয়ে সে এক মুহূর্ত চিন্তাও করল না। গরম হালকা হাওয়ার মতন অসহ্য রাগ আর শরীরের মধ্যে ঘুরছে, এখন তার সবকিছু তুচ্ছ হয়ে গেছে। এক-এক সময়ে এইরকম দুর্দান্ত ধরনের রাগ হয় তপনের, তখন আর কোনো যুক্তিবোধ থাকে না। এরকম রাগ হলে তার শরীর এক মুহূর্ত স্থির হতে পারে না। নিশ্বাস পর্যন্ত আটকে আসে।
মাটিতে পড়ে-থাকা অ্যালিসের দিকে ঘুরে চলে এল তপন। অ্যালিসের সঙ্গে হ্যাণ্ডব্যাগটাও ছিটকে পড়েছে টেবিলের নীচে। সাদা, প্রায় স্বচ্ছ একটা গাউন পরেছে অ্যালিস, সেটা হাঁটুর অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে–দেখা যায় অ্যালিসের তুষার শুভ্র ঊরু। একখানা পা তার বিশ্রীভাবে দুমড়ে রয়েছে, মুখটা দেখা যায় না, অঞ্জলি দেবার মতন দু-টি হাতের ভঙ্গি। সোনালি চুলের গোছা উলটে গেছে, দেখা যায় তার মাখনের মতো নরম ঘাড়। অ্যালিসের দিকে তাকিয়ে তপনের মন একটুও টলল না। সেই নিস্পন্দ মূর্তির দিকে চেয়ে সে ভাবল, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেল নাকি? ন্যাকামি? ওসব ন্যাকামি তার ঢের দেখা আছে। লণ্ডনে তো সাদা চামড়ার ষাঁড় অনেক আছে, তাদের কারুর সঙ্গে ওসব ন্যাকামি করো না! তপন পায়ের ধাক্কায় অ্যালিসকে উলটে দেবার চেষ্টা করল। সামান্য একটু কাৎ হয়ে সেইভাবেই পড়ে রইল অ্যালিসের দেহ।
তপনের মাথার মধ্যটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, পা-দুটো খুব দুর্বল, যেন সে আর দাঁড়াতে পারবে না। আবার বাথরুমে এসে কল খুলে কলের তলায় অনেকক্ষণ মাথা দিয়ে রইল। কনকনে ঠাণ্ডা জলে মাথার মধ্যে অসংখ্য ছুঁচ ফুটছে। জল নিয়ে কুলকুচি করতে লাগল, আঁজলা পেতে সেই জল খানিকটা খেয়ে নিল। বেশ খানিকটা বাদে তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মুখ মুছল, ডেটলের শিশি এনে মুখের ক্ষতস্থানে লাগাল। বাঁ-চোখটা টেনে ধরে আয়নার সামনে ভালো করে দেখল। চোখের অর্ধেকটা টকটকে লাল, তপন বুঝতে পারল ভেতরে হেমারেজ হয়েছে, ঘুসিটা ঠিক চোখের ওপর লাগেনি, লেগেছে ভুরুর কাছাকাছি। কিন্তু দৃষ্টিশক্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। লাল বাঁ-চোখটা দিয়ে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বলে তপন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল, তাহলে বিশেষ কিছু না।
গেলাসে ঠাণ্ডা জল ভরে নিয়ে তপন অ্যালিসের দিকে ফিরে এল। মাটি থেকে তার মুখখানা সামান্য তুলে জল ছিটিয়ে দিল অনেকখানি। জলের ঝাপটাতেও অ্যালিস চোখ মেলল না। তপনের বুকের মধ্যে হঠাৎ একবার ধক করে উঠল, মরে যায়নি তো? সে কি খুব জোরে ধাক্কা মেরেছে? আবার গেলাসে জল ভরে এনে জলটা সবই একসঙ্গে ঢেলে দিল অ্যালিসের চোখে। অ্যালিস তখনও নিস্পন্দ। অ্যালিসের কবজি ধরে সে নাড়ি দেখার চেষ্টা করল।
তপন অ্যালিসকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় এনে শোয়াল। তোয়ালে দিয়ে জল মুছিয়ে দিল ভালো করে। এখন স্মেলিং সল্ট জোগাড় করা অসম্ভব। তপনের কাছে ভালো ওডিকোলন ছিল। রুমালে অনেকখানি ভিজিয়ে এনে অ্যালিসের নাকের কাছে ঘষতে লাগল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকাল অ্যালিস। চোখ মেলেই সে দেখল তপন তার মুখের ওপর ব্যথভাবে ঝুঁকে আছে।
তপন জিজ্ঞেস করল, তোমার বেশি লেগেছে, অ্যালিস?
অ্যালিস ওঠার চেষ্টা করল না, মৃদুভাবে বলল, না।
তপন বিষণ্ণভাবে থেমে থেমে বলল, তোমাকে এত করে বারণ করলাম, তবু তুমি আমার ঘরে কেন এলে, অ্যালিস? আমি অনেকবার তোমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছি। তুমি জানো না, আমি কে। আমি হয়তো রাগের মাথায় সত্যিই তোমাকে খুন করে ফেলতে পারতাম! অ্যালিস, তুমি জানো না, আমি তোমার পিতৃহন্তার ছেলে। আমারই বাবা তোমার বাবাকে খুন করেছিলেন।
অ্যালিস আগের মতো মৃদুভাবে বলল, আমি জানতাম।
তুমি জানতে? কী করে?
টপন, আমার কি একটুও বুদ্ধি নেই? আমার ঘরে সেই ছবিটা দেখার পরই তুমি উত্তেজিত হয়ে উঠলে, তোমার মুখের চেহারা বদলে গেল–তারপর তুমি গল্পটা শোনার জন্য জেদ করছিলে, তারপরই তুমি অন্য মানুষ হয়ে গেলে–তখনই বুঝেছিলাম তোমারই নিকট আত্মীয়
শুধু আত্মীয় নয়, রক্তের সম্পর্ক, আমার বাবা-–আমি তাঁর একমাত্র ছেলে কিন্তু একথা জেনেও তুমি কেন বারবার আমার কাছে আসছ? আমাকে ভয় করে না তোমার?
ভয়? আমার কাছে অতীতের কোনো মূল্য নেই, ওসব ঘটনা আমার কাছে গল্পের মতনই অবাস্তব-টপন, মৃতেরা আমাদের কেউ নয়–তাদের কথা ভেবে আমরা আমাদের নিজেদের জীবন নষ্ট করতে পারি না–ওই অভিশপ্ত ছবিটা কেন যে আমি ঘরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। সেদিনই ওটা ফেলে দিয়েছি–টপন, তুমি ওসব কথা একেবারে ভুলে যেত পার না?
তপনের মুখের স্বাভাবিক রং অনেকটা ফিরে এসেছে, তার নিশ্বাসে আর আগুন নেই। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে সে বলল, অত সহজে কি ভোলা যায়? রক্তের টান–ব্লাড ইজ আ সুইট জুস-তুমি গ্যেটে পড়নি, ব্লাড ইজ আ সুইট জুস
টপন, তুমি আমাকে আর ভয় দেখিও না।
ভয় না দেখিয়ে আমার উপায় কী? অ্যালিস, আমার বাবা তোমার বাবাকে খুন করেছিলেন –সেজন্য আমি একটুও লজ্জিত নই, আমি একটুও অনুতপ্ত নই–আমার বাবার সেই রাগ আমার শিরার মধ্যে এখনও থেকে গেছে–আমার ইচ্ছে করে একটা ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে আমি এই গোটা ব্রিটিশ জাতটাকে হত্যা করি–দোষী-নির্দোষ সবাইকে, নারী-শিশু কারুকে বাদ দেব না–সেভাবেই আমার বাবা-জ্যাঠামশায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
তুমি কী বলছ, টপন? এ তুমি কী বলছ! শান্ত হও, নিজের মধ্যে ফিরে এসো–এ-রকম করে ভাবলে যে তুমি পাগল হয়ে যাবে। আমি জানি তুমি মোটেই এরকম চাও না, এটা তোমার কথার কথা, তুমি নিজেই তো বলেছ, তুমি আর ভারতবর্ষের কেউ নও, তুমি আর সেখানে ফিরে যাবে না, তোমার কোনো দেশ নেই–তাহলে এ-রকম বীভৎস দেশপ্রেমের কথা তুমি কেন বলছ? চলো, টপন আমরা দুজনেই অন্য কোনো দেশে চলে যাই।
আমরা? অ্যালিস, সত্যি করে বলো তো, তুমি আমার কাছে কী চাও?
কিছু চাই না! আমি তোমাকে ভালোবাসি, শুধু তোমাকে—
মিথ্যে কথা! তুমি আমাকে ভালোবাস না–একে ভালোবাসা বলে না! তুমি এসেছ আপোশ করতে। তুমি ব্রিটিশ, তোমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ আছে–তাই আমাকে তোমার পিতৃহত্যাকারীর ছেলে জেনেও তুমি এসেছ উদারতা দেখাতে? সিলি!
না, না, বিশ্বাস করো, এর আগেও তো অনেক ব্রিটিশ মেয়ের সঙ্গে অনেক ভারতীয় ছেলের ভালোবাসা হয়েছে, বিয়ে হয়েছে–টপন, তুমি অতীতকে বড়ো করে দেখছ, আমি অতীতের কথা ভাবিই না।
অতীত ছাড়া ভারতবর্ষের আর কী আছে! অতীত নিয়েই ভারতবর্ষের গর্ব, অতীত নিয়েই কান্নাকাটি। তুমি যদি বুঝতে এর কারণ–
কিন্তু, এসব বাদ দিয়েও কি দু-জন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা হতে পারে না? টপন তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না কেন? আমি একবার ভালোবাসায় ভুল করেছিলাম–দ্বিতীয়বার ভুল হলে আমি বাঁচব কী করে? এ ক-দিন আমি নিজেকে অনেক যাচাই করেছি–হয়তো আমার ব্যবহারের কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না–এর মধ্যে তুচ্ছ অতীতকে টেনে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
অ্যালিস, আমার বুকের ভেতরটা শুকনো, ভীষণ শুকনো, সেখানে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই।
টপন, তোমার চোখ-মুখ ওরকমভাবে কাটল কী করে? আমাকে আগে সেকথা বলো, আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।
ও কিছু না। আমার এক বন্ধু, দিবাকর, তার বাড়ির সিঁড়ি থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম। –অ্যালিস আমাকে যদি তুমি সত্যি ভালোবেসে থাক, তা হলে তুমি দারুণ ভুল করেছ। এবারেও ভালোবাসায় ভুল হয়েছে তোমার।
তুমি জানো না, পরশু দিন রাত্রে তিন বার তোমাকে টেলিফোন করেও কানেকশান না পেয়ে–আমার হঠাৎ আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছিল। জানি না কেন, জীবনে কখনো আমার এরকমভাবে মরতে ইচ্ছে হয়নি।
তুমি মরার জন্যই আমার কাছে এসেছ?
হ্যাঁ। তুমি আমাকে মারো। মারো। তাতেই যদি তোমার রাগ কমে–শুধু আমাকে মেরে তুমি অন্যদের ক্ষমা করে দাও।
তপন একটুক্ষণ নিঝুম হয়ে বসে রইল। একদৃষ্টে অ্যালিসের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার পক্ষে তোমাকে ভালোবাসা সম্ভব নয়, আমাকে তুমি ক্ষমা করো! আমি
এই সময়ে দরজায় আবার ঠক ঠক শব্দ হল। তপন দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলে দেখল, সেই প্রৌঢ় লোকটি, হোটেলের ভ্রকুঞ্চিত ম্যানেজার এবং একজন পুলিশ কনস্টেবল। রাসভারী পুলিশটি প্রশ্ন করল, হেই, হোয়াটস গোয়িং অন ইন হিয়ার?
ওদের দেখেই তপনের চোয়াল আবার কঠিন হয়ে গেল। নীরস গলায় বলল, কিছু না।
কিন্তু, এই ভদ্রলোক অভিযোগ জানিয়েছেন, তোমার ঘরের মধ্যে মারামারি কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা গেছে।
কিছু হয়নি। আমার এ ধরনের ধারণা ছিল, এটা লণ্ডনের একটা সম্ভান্ত হোটেল এবং আমি যেহেতু অগ্রিম ভাড়া দিয়েছি, সুতরাং আ অ্যাম এনটাইটলড টু গেট আ লিটল প্রাইভেসি, স্পেশালি অ্যাট দিস আওয়ার।
প্রাইভেসি মানে মারামারির অধিকার নয়। তোমার চোখ ফোলা, মুখ দেখলেও মনে হয় না–খুব শান্তিতে ঘুমোচ্ছিলে। দেখি ঘরে কে আছে? হেই! দেয়ার ইজ আ হোয়াইট গার্ল! ইউ বাস্টার্ড।
শাট আপ।
অ্যালিস দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, এসব কী হচ্ছে কী? আমি আমার নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছি। এখানে কোনো গন্ডগোল হয়নি। উই আর ফ্রেণ্ডস।
হোটেলের ম্যানেজার এ ক-দিন তপনের সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহারই করেছে, আজ হঠাৎ নেশার ঘোরে কিংবা যেকোনো কারণেই হোক তপনকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে গেল। অ্যালিসকে তপনের ঘরে দেখে সে যেন খেপে গেছে। সরাসরি সে তপনকে নিগার বলে ফেলল। এইসব নিগার এসে সে লণ্ডন ছেয়ে ফেলছে এবং তারা ব্রিটিশ মেয়েদের নষ্ট করছে–সেকথা জানাতেও দেরি করল না। তপন আর কোনো কথা না বলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে পুলিশটা তপনকে বলল, তৈরি হয়ে নাও, তোমাদের দুজনকেই একবার থানায় যেতে হবে।
তপন গম্ভীরভাবে বলল, আমি তৈরিই আছি। যদি থানায় যেতেই হয়, তাহলে আর দেরি করে লাভ কী? কিন্তু অফিসার, তোমার ওই ব্ল্যাবর মাউথ ম্যানেজারটাকে চুপ করতে বলো এবার।
.
০৮.
দমদমের আকাশে বিশাল জেটবিমানটা চক্রাকারে ঘুরছে। বৃষ্টি, দারুণ বৃষ্টি, পাইলট সম্ভবত এয়ারপোর্টের নির্দেশ ঠিক মতন পাচ্ছে না। জানলার কাঁচে জলকণার পাতলা পর্দা, তপন কিছুই দেখতে পেল না বাইরে তাকিয়ে–আকাশ-ফাটানো বৃষ্টির ধারায় বাইরের সব কিছুই অস্বচ্ছ। সাড়ে পাঁচ বছর বাদে তপন ফিরছে বাংলায়, কিন্তু আকাশ থেকেই বাংলাকে এক ঝলক দেখে নেবার সুযোগ পেল না।
সিটবেল্ট কোমরে বাঁধা হয়ে গেছে, সিগারেট নিবিয়ে ফেলার অনুরোধ ভেসে উঠেছে মাইক্রোফোনে, সবাই নামার জন্য প্রস্তুত, অনেকেই ব্যগ্রভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জানলা দিয়ে, বিমানটা তবু ঘুরছে। তপনের পাশের সিটে বসেছিল একজন জাপানি ভদ্রলোক, শুধু তার মুখখানাই দুশ্চিন্তাহীন নিরেট। তপনের একবার মনে হল, সে নিজের দেশকে অস্বীকার করেছে বলেই বোধ হয় তার দেশ তাকে গ্রহণ করতে চাইছে না। তার জন্যেই এতগুলো যাত্রীর দুর্ভোগ, প্লেন এখানে ল্যাণ্ড করতে না পারলে হয়তো চলে যাবে হংকং কিংবা কাঠমাণ্ড, আবার সেখান থেকে কলকাতায় ফেরা–কিংবা প্লেনটা এতদূর পথ নির্বিঘ্নে এসে এখানে এই বাংলার আকাশে ক্র্যাশ হলে কেমন হয়? টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে খসে পড়বে তপনের হাড়-পাঁজরা–ধুৎ, যতসব সেন্টিমেন্টাল চিন্তা, তপনও সেই জাপানি ভদ্রলোকটির দৃষ্টান্তে মুখে নিরুদ্বিগ্ন ভাব ফোঁটাবার চেষ্টা করল, জানলা থেকে চোখ সরিয়ে বসল হেলান দিয়ে।
সেই রাত্তিরে পুলিশের ঝঞ্ঝাটের জন্য তপনকে আরও দু-দিন থেকে যেতে হয়েছিল লণ্ডনে। থানা থেকে অবশ্য সে-রাত্রেই ছাড়া পেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ রমণীর সঙ্গে অসমীচীন ব্যবহারের অভিযোগ টেকেনি। অ্যালিস বারবার দৃঢ় স্বরে বলেছে, তাকে কেউ প্রলোভন দেখিয়ে ভুলিয়ে আনেনি, সে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় গিয়েছিল হোটেলের ঘরে তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তারা কোনোরকম চেঁচামেচি বা গন্ডগোল করেনি–নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার সময় গলার স্বর কখনো একটু উঁচু হয়ে যেতে পারে–কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি।
তপন নিজে থেকে কিছুই বলেনি অবশ্য, একরোখা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রথমে শুধু একবার বলেছিল, আমি একজন কালো লোক, সুতরাং আমি যা বলব–তা সবই তোমরা মিথ্যে বলে ধরে নেবে জানি,আমার যা বলার আমি কোর্টে গিয়ে বলব। তোমাদের যা খুশি করতে পার।
চিফ কনস্টেবল লোকটি ছিল রসিক, গল্পের দারোগার মতন তারও ছিল বেশ পুরুষ্টু পাকানো গোঁফ, তপনের কথা শুনে সামান্য হেসে বলেছিল, না, না, মিথ্যে কথা বলার অধিকার শুধু কালো লোকদেরই আছে–একথা আমি স্বীকার করতে চাই না, শ্বেতাঙ্গদেরও ওই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। এই মেয়েটির সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?
তপন বলেছিল, আমি এ সম্পর্কে কিছুই বলতে চাই না!
আপনি কি আজই একে রাস্তা থেকে পিক আপ করেছেন?
আই রিফিউজ টু আনসার
দারোগাটি ঠোঁট টিপে হেসে তপনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। উত্তেজনায় তপনের মুখখানা লাল। তপনের স্বভাবই এইরকম, যখন সে কোনো কারণে খুব অপমানিত বোধ করে, তখন সে একেবারে মরীয়া হয়ে ওঠে, নিজের সম্মান বাঁচাবার জন্য কিংবা নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যও কোনোরকম চেষ্টা করতে চায় না। শক্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল তপন, চেয়ারে না বসে তার ওপর একটা পা তুলে দিয়েছিল। অ্যালিস তার পাশেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু তপন আর অ্যালিসের দিকে তাকাচ্ছে না একবারও।
দারোগাটি এবার অ্যালিসের দিকে ফিরল, নম্রভাবেই প্রশ্ন করল, মিস উডল্যাণ্ড, এই ভারতীয় ভদ্রলোকটির সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
অ্যালিস বেশ স্পষ্টভাবেই মিথ্যে কথা বলল। একটুও দ্বিধা বা দেরি না করে বলল, অন্তত আঠাশ বছর ধরে, সেই ভারতবর্ষ থেকে।
ভারতবর্ষ থেকে? আই সি, আই সি।
তপন চমকে উঠে একবার অ্যালিসের দিকে না তাকিয়ে পারল না। অ্যালিস মুখখানা সোজা করে আছে, তবুও দেখলেই বোঝা যায়, অনেক যন্ত্রণা সে প্রাণপণে গোপন করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে।
দারোগাটি আবার বলল, ভারতবর্ষ থেকে? ভারতবর্ষে কোথায়?
বাংলাদেশে, ঢাকা শহরে, আমার বাবা সেখানে পোস্টেড ছিলেন আমি সেখানে ওর সঙ্গে একসঙ্গে খেলা করেছি ছেলেবেলায়।
তপন প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না, আবার অ্যালিসের দিকে তাকাল। ঢাকা শহরের কিছুই মনে নেই তপনের, অ্যালিসেরও মনে নেই–ওরা সেখানে একসঙ্গে খেলা করত? এই চরম মিথ্যেটাও একটা ছবি হয়ে ফুটে ওঠে, তপন এক পলকের জন্য দেখতে পায়– মাথায় সোনালি চুল ভরা একটি ফুটফুটে ফর্সা মেয়ের সঙ্গে তপনের পাঁচ বছরের শিশুমূর্তি খেলা করছে। ধুৎ যত সব বাজে, কোনো ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে কোনোদিন কোনো নেটিভদের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খেলা করেনি।
দারোগাটি বলল, আমিও ঢাকায় ছিলাম কিছুদিন, বিটুইন নাইনটিন ফরটি-টু অ্যাণ্ড ফরটি ফোর–তখন যুদ্ধের সময়, আমি
তপনের মনে হল, দারোগাটি যখন ঢাকায় ছিল, তখন অ্যালিসের বাবার মৃত্যুর ঘটনাও নিশ্চয়ই জানে, লোকমুখে শুনেছে, এবার সেটা মনে পড়বে। অ্যালিস তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে আরও বিপদ ডেকে আনছে। তা হোক, লোকটি যদি কথায় কথায় সেই প্রশ্ন তোলে, তপন গোপন করবে না যে তার বাবাই অ্যালিসের বাবার হত্যাকারী। অ্যালিস এবার মুখ ফিরিয়েছে তপনের দিকে, চোখাচোখি হয়ে গেল দু-জনের, অ্যালিসের চোখে সনির্বন্ধ মিনতি।
দারোগাটি কিন্তু সেদিক দিয়ে গেলই না, স্মৃতিমন্থনের সুরে বলল আমি জন্মেছিলাম বার্মায়। এমনই নেমেসিস, সেই বর্মা ফ্রন্টেই আমাকে লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল, তোমাদের সেই বোস, সেই নেতাজি বোস, তার আর্মির সঙ্গে, কোহিমাতে আমি ধরা পড়েছিলাম, পি ও ডবলু হিসেবে ছিলাম আই এন এ ক্যাম্পে, তখন তোমাদের নেতাজিকে দেখেছিলাম, লোকটার রিয়েল গাটস ছিল–
দারোগাটি তারপর গল্প জুড়ে দিয়েছিল। হোটেলের ম্যানেজার প্রতিবাদ করতেও কান দেয়নি, বরং ধমকে দিয়েছিল তাকে।
থানা থেকে একসঙ্গে বেরিয়েছিল তপন আর অ্যালিস, নির্জন রাস্তায় কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি একসঙ্গে। তপন শেষপর্যন্ত বলেছিল, অনেক রাত হয়ে গেছে, অ্যালিস, তোমাকে আমি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব?
না, তার দরকার হবে না। থ্যাঙ্ক ইউ। আমি একাই যেতে পারব।
একটা চলন্ত ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে উঠে পড়তে পড়তে অ্যালিস বলেছিল, গুড বাই তপন –। তখন তার কণ্ঠে একটুও অভিমান ছিল না।
–ফাসন ইয়োর সিট বেল্টস, প্লিজ–তপন আবার সচকিত হয়ে উঠল, প্লেন এবার সত্যি নামছে, বৃষ্টি তখনও পড়ছে অঝোর ধারায়, তবুও দমদমেই ল্যাণ্ড করবে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল, অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে গাছপালা ও বাড়ির রেখা, বহুকাল আগে দেখা কোনো দৃশ্যের স্মৃতির মতন। তপন আগে কোনোদিন দমদম এয়ারপোর্টে আসেনি, বাবার সময় তাকে মুম্বাই থেকে যেতে হয়েছিল। তাই মুম্বাই পর্যন্ত গিয়েছিল ট্রেনে। তবুও আকাশ থেকে দেখা দমদমের দৃশ্য তার মনে হল, যেন খুব চেনা, আগে সে অনেকবার দেখেছে, ওই পাশাপাশি তিন বৃদ্ধের মতন তিনটি তালগাছকে সে অনেকদিন থেকেই দেখছে দাঁড়িয়ে থাকতে। ঝাঁকুনি লাগতেই বুঝল, প্লেন মাটি ছুঁয়েছে এবার।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ই দেখা যায়, এই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। কত লোকের কত প্রিয়জন ফিরছে বিদেশ থেকে, কত দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার মিলন হবে, উৎসুক জনতা চেঁচিয়ে হাত নাড়ছে। তপনের জন্য কেউ ওখানে নেই, তার ফেরার জন্য কেউ প্রতীক্ষা করে নেই, তার উদ্দেশ্যে কেউ রুমাল নাড়বে না। তবুও তপন দূরের সেই ভিড়ের দিকে হাত নেড়ে দিল, যেন তার জন্যেও কেউ অপেক্ষা করে আছে ভিড়ের মধ্যে, ওরা তো আর অতদূর থেকে কারুকে চিনতে পারছে না।
কাস্টমস বেরিয়ারে দীর্ঘ প্রতীক্ষা। তপনের কোনো ঝঞ্ঝাট নেই, সে দু-তিনটে ক্যামেরা আনেনি; টেপরেকর্ডার কিংবা ট্রানজিস্টর রেডিয়ো আনেনি, সে এখানে থাকতেও আসেনি। বিদেশি টুরিস্টদের মতন দু-এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে এসেছে। তপন এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে অন্যদের আগে সুযোগ করে দিল। ওপাশ থেকে কত চেঁচামেচি, কেউ ডাকছে, মন্টুদা, মন্টুদা। মেয়েলি গলায় সরু কলধ্বনি, জামাইবাবু, জামাইবাবু! ওভারকোটপরা একজন বাঙালি যুবক রয়েছে তপনের পাশে, তাঁর দু-কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুলছে দু-তিনটে ক্যামেরা, বায়নোকুলার, জিনিসপত্রে ঠাসা সুটকেস-প্রচুর ডিউটি দিতে হবে ওকে। কোথায় গেল সেই জামাইবাবু। শ্যালিকাদের উদ্দেশ্যে খানিকটা গর্ব, খানিকটা লজ্জা মেশানো ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। তপনকে একজনও চেনে না, কেউ ডাকল না তপন, তপন বলে।
বিমান কোম্পানির বাসই ধর্মতলার সিটি অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিত, কিন্তু তপন তাতে গেল না। একটা ট্যাক্সি নিল! ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন? তপন একটু চিন্তা করে বলল চলুন তো আগে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত।
কোথায় যাবে তপন জানে না। কলকাতায় তার কোথাও যাবার জায়গা নেই।
কলেজে পড়ার সময় বরাবর থাকত মির্জাপুর স্ট্রিটের একটা মেসে। কলকাতায় আসবার খবর জানিয়ে সে কোনো বন্ধুবান্ধবকেও চিঠি লেখেনি, কারুকে খবরও দেয়নি। আজই ছোটোকাকার কাছে সিউড়িতে যাওয়া কি সম্ভব? ট্রেন-ফ্রেন কখন তা জানা নেই, তা ছাড়া কাকার মেয়ের বিয়ের দেরি আছে, এখনও দিন সাতেক, এই সাতদিন ধরে সে মফসসলে থাকতে চায় না।
ট্যাক্সি ছুটছে যশোর রোড ধরে, একটা সিগার ধরিয়ে তপন জানলা দিয়ে চেয়ে রইল। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার পরেই তপন একটা গন্ধ পাচ্ছে, যাকে বলা যায় টিপিক্যাল কলকাতা শহরের গন্ধ, পৃথিবীর আর কোনো শহরে এ-রকম গন্ধ নেই। রাস্তার পাশের খোলা ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তার ওপরই জমা করে রাখা, মানুষজনে গিস গিস করছে, সব কিছুই যেন নোংরামির প্রতিমূর্তি। এত নোংরা আর আবর্জনার মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে।
তপনের হঠাৎ একটু হাসি পেল। সত্যি সত্যি সে আমেরিকান টুরিস্টদের চোখেই দেখছে এই শহরকে। অথচ পাঁচ বছর আগেও সে এদেরই একজন হয়ে বেঁচে ছিল। জীবনের সেই ছাব্বিশ বছরের তুলনায় এই পাঁচ বছরের মূল্য কি বেশি? তপন এবার একটু অন্য চোখে তাকাল–পরিচিত দৃশ্য আবার দেখার মতন–তার মনে হল, শহরের চেহারা আর একটু জরাজীর্ণ হয়েছে, রাস্তা-ঘাটগুলো আগের চেয়েও খারাপ, সাধারণ মানুষের চেহারা আরও বেশি দুঃস্থ–ক্রমশ অবনতির দিকেই যাচ্ছে শহরটা।
এসপ্লানেডের কাছাকাছি এসে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল এবার কোথায় যাব স্যার? তপন তখনও মনস্থির করতে পারেনি। একবার ভেবে নিল টালিগঞ্জে দিবাকরদের বাড়িতে যাবে, দিবাকরদের বিশাল বাড়িতে অনেক ঘর, ওর বউদিও তপনকে একসময় খুব ভালোবাসতেন –কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা মন থেকে বাতিল করে দিল। কারুর বাড়ি-টাড়িতে অযাচিতভাবে গিয়ে থাকা তার পোষাবে না। অন্য কোনো নতুন শহরে গেলে তপন এয়ারপোর্টে নেমেই টুরিস্ট গাইডের শরণাপন্ন হয়, বিশ্বাসযোগ্য হোটেলের লিস্ট চেয়ে নিয়ে মাঝারি দামের কোনো হোটেল বুক করে নেয় টেলিফোনে–কলকাতা শহরে এসেও সেই ব্যবস্থা করার কথা তপনের মনে পড়েনি।
একবার ভাবল, সরাসরি গ্র্যাণ্ড কিংবা গ্রেট ইস্টার্নেই উঠবে, কতই-বা খরচ–ওর তিনগুণ দামি হোটেলে খেয়েছে প্যারিসে। কিন্তু সেটাও সত্যি আমেরিকান টুরিস্টদের মতনই ব্যাপার হবে ভেবে, তপন একটা মাঝারি ধরনের হোটেলে উঠল।
মিউজিয়ামের পাশের রাস্তায় হোটেলটা। আপাত চাকচিক্য আছে, কিন্তু পরতে পরতে ময়লা লুকোনো। কাউন্টারের ম্যানেজারের ভাবভঙ্গিতে একটা চূড়ান্ত সাহেবিয়ানা রয়েছে, তবুও বোঝা যায় লোকটা অশিক্ষিত। এসব তপনের চোখ এড়ায় না কিছুতেই। বিশেষত ময়লা সিঁড়ি কিংবা নোংরা জানলার পর্দা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। দোতলায় তার ঘরের নম্বর দু-শো চোদ্দো। দু-শো বারো নম্বরের ঘরের পাশে ঘর, দু-শো তেরো নম্বরের কোনো ঘর নেই–বিলিতি কুসংস্কারটা পর্যন্ত বজায় রাখতে চেয়েছে এরা। নিজের ঘরে ঢুকে তপনের আবার মন খারাপ হয়ে গেল, মোটামুটি বড়োই ঘরটা, আলো-হাওয়া আছে কিন্তু আসবাবপত্রে একটা সস্তা চালিয়াতি। পাশের বাথরুমের কলে ছড়ছড় করে শব্দ হয়ে জল পড়ছে, নিশ্চয়ই কলটা ঠিক মতন বন্ধ হয় না। খাটের ওপর পরিষ্কার ধপধপে চাদর পাতা, তবু তপন চাদরটা তুলে তোশকটা দেখে নিশ্চিত হল। যা ভেবেছিল তাই, তোশকটায় অসংখ্য নোংরা দাগ। গা ঘিনঘিন করে এইসব বিছানায় শুতে। তপন বিরক্তি দমন করে মৃদু হাসল। মনে মনে বলল, খুব সাহেব হয়েছিস তপন তাই না? বিদেশে যাবার আগে কলকাতার এইসব হোটেলে ঢুকে তোর তো চা খাবারও মুরোদ হত না। কিন্তু অভ্যাস বদলে গেছে তার আমি কী করব।
ভালোভাবে স্নান করে তখন ঘরেই খাবার আনিয়ে নিল, অনেকদিন বাদে ঝাল ঝাল পাঞ্জাবি রান্না মন্দ লাগে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে খাটে বসল। বাইরে গনগন করছে দুপুর। এখন বেরোবার কোনো মানে হয় না, তা ছাড়া বেরিয়ে যাবেই-বা কোথায়? বরং ঘুম লাগালেই ভালো। বহুকাল পরে আবার বাংলার মাটিতে ঘুম।
কিন্তু ঘুমটা তার তেমন স্বচ্ছন্দ হল না। ছোটো ছোটো অনেক স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে যেতে লাগল, তন্দ্রা ভেঙে যেতে লাগল মাঝে মাঝে। তা ছাড়া কিছু একটা গোলমালেও বিরক্ত বোধ করছিল। কারা যেন জোরে জোরে কথা বলছে। কেউ যেন একবার তপন বলে ডেকে উঠল। আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে বসল ধড়মড় করে। কে ডাকছে তার নাম ধরে? কলকাতা শহরের কেউই তো জানে না, সে ফিরে এসেছে, উঠেছে এই হোটেলে! তপন কান পেতে রইল, আর কেউ ডাকল না। ভাবল, ঘুমের মধ্যে এ-রকম হয়, এ-রকম ডাক শোনা যায়। মানুষ বোধ হয় নিজেকেই নিজে ডাকে। সেও কি ঘুমের মধ্যে নিজেকেই ডেকে কিছু বলতে যাচ্ছিল? পাশের ঘরে কয়েকটি মেয়ের জোর গলায় কথা আর হাসাহাসির শব্দ আসছে। মেয়েগুলোর হাসির আওয়াজ কেমন যেন অসভ্য ধরনের। খিলখিল করে হেসে উঠেই আবার ফিসফিস করে কী যেন বলছে। একজন কে যেন বলল, এই মালতী! এই মুখপুড়ি? তপন খুবই বিরক্ত হচ্ছিল, কিন্তু মুখপুড়ি শব্দটা শুনে আবার একটু মজা পেল। এই পাঁচ বছরে নানা দেশে অনেক বাঙালির সঙ্গেই তার দেখা হয়েছে। কিন্তু মুখপুড়ি কথাটা বাংলা ছাড়া আর কোথাও শোনা সম্ভব নয়। মেয়েদের মধ্যেই একজন আবার তপন, তপন বলে জোরে ডেকে উঠল। এবার সে নিশ্চিন্ত হল, তপন তা হলে অন্য কারুর নাম, হোটেলের কোনো বেয়ারাও হতে পারে কলকাতা শহরে তপন নামে গন্ডায় গন্ডায় লোক রয়েছে।
আর ঘুম হবে না। গেঞ্জি গায়েই তপন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। পাশের ঘরটার দিকে একবার তাকাল আড়চোখে। তিন-চারটি মেয়ে ও দু-জন পুরুষ বসে জটলা করছে সে-ঘরে, সারি সারি সোডার বোতল সাজানো দেখে মনে হয়, ওখানে মদ্যপান চলছে। তপন একটু অবাক হল, দিনদুপুরে মেয়েরা বসে মদ খাচ্ছে, বাংলাটা কি ক-বছরে এত বদলে গেছে? কোনো ইংরেজ বা আমেরিকান মেয়েও তো এ-রকমভাবে দুপুর বেলা হোটেলে বসে মদ খায় না।
একটুবাদেই দু-টি মেয়ে বেরিয়ে পাশের ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়াল। তপনের দিকে তাকিয়ে তারা পরস্পর ফিসফিস করে কী যেন বলতে লাগল হাসতে লাগল, হাসতে লাগল ঠোঁট টিপে। তপন অবাক হয়ে ওদের দেখছিল, একটি মেয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে এক চোখ বুজিয়ে তপনের দিকে কী যেন ইশারা করল। এতক্ষণে তপন বুঝতে পারল, মেয়েগুলো নষ্ট চরিত্রের, সম্ভবত বেশ্যা। তপন চোখ সরাল না, ওদের দিকেই তাকিয়ে রইল। মেয়ে দু-টি যেমন নির্লজ্জা তেমনি বেপরোয়া– সোজাসুজি ইঙ্গিত করছে এখন। মেয়ে দু টির স্বাস্থ্য মন্দ না, খুব টাইট ভাবে শাড়ি ব্লাউজ পরেছে, ব্লাউজটা মাছধরা জালের মতন ভেতরের কালো ব্রেসিয়ার স্পষ্ট দেখা যায়, পনিটেল-এর কায়দায় চুল বেঁধেছে। এতদূর থেকেও তপনের মনে হল, ওদের গায়ে নিশ্চয়ই শস্তা সেন্টের বিকট গন্ধ! নিশ্চয়ই ওদের ঘাড়ের কাছে ময়লা জমে থাকে! আগেকার দিন হলে, এতক্ষণ কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তপনের কান লাল হয়ে যেত লজ্জায়। এখন আর ওসব কিছু হয় না। নারী শরীর সে অনেক দেখেছে, সম্পূর্ণ নিরাবরণ শরীর, প্যারিসের স্ট্রিপটিজ ক্লাবের মেয়েরা শেষপর্যন্ত শুধু সেলোফিনের জাঙিয়া পরে থাকে।
শুধু শরীর সম্পর্কে তার আর লোভ নেই। এতদিন পর, বাংলার মেয়েরা তাকে এইভাবে অভ্যর্থনা জানাল! পয়সার বিনিময়ে এক তাল মাংস! ঠিক ঘৃণায় নয়, খানিকটা বিস্ময়ভরা করুণার চোখে তপন ওদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। একবার তার ইচ্ছে হল, বাঁদর নাচ দেখার পর যেমন ওপর থেকে ছুঁড়ে পয়সা দেয়, সেইরকম ওই মেয়ে দু-টোর দিকেও সে শ-খানেক টাকা ছুঁড়ে দেবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর সেরকম কিছুই করল না, মেয়ে দুটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকাল।
হেমন্তের ক্ষণস্থায়ী বিকেল, রোদূরের তেজ নেই, রাস্তায় অনেক মানুষ। এরপর তপন কোথায় যাবে? সাধারণ হোটেলে বসে থাকা তো সম্ভব নয়! কলকাতার রাস্তায় একা একা ঘুরবে? বন্ধুবান্ধব যারা ছিল একসময় তারা কোথায় সবাই ছড়িয়েছিটিয়ে গেছে, কোনো যোগাযোগ নেই। তপনই কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি! আজ কলকাতায় সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, একজন কারুর নামও মনে পড়ল না, যার সঙ্গে সে এখন গিয়ে দেখা করতে পারে! আজ কী বার? তপন মনে করার চেষ্টা করল–কাল এই সময় রোমে ছিলাম, ভিয়া ভেনেত্তোয় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, মাথায় গুঁতো খেয়েছিলাম একটা দোকানের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আজ আমি এই হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলকাতার রাস্তা দেখছি– মাথায় এখনও রোমে সেই গুতো লাগবার ব্যথাটা রয়েছে। মনে পড়েছে, আজ শনিবার কেননা রোমে প্যান-অ্যাম বিমান কোম্পানি বলেনি, রবিবার তাদের কোনো ফ্লাইট নেই।
এই অঞ্চলটা দেখলে কলকাতা বলে ঠিক চেনা যায় না। রাস্তাঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন, বাড়িগুলো সুন্দর, মানুষজনের চেহারা ও পোশাক ঝকঝকে–এ জায়গাটার সঙ্গে লণ্ডনের কোনো একটা নির্জন রাস্তার কোনোই তফাৎ নেই। আকাশটা পরিষ্কার ঝকঝকে, লণ্ডনের আকাশ এ-রকম হয় না।
হঠাৎ তপনের একটা কথা মনে পড়ল। মিউজিয়ামের পাশের এই রাস্তাটার নাম সদর স্ট্রিট–ট্যাক্সি ড্রাইভার কিংবা হোটেলের ম্যানেজার অবশ্য বলল স্যাডার স্ট্রিট, কিন্তু তপন জানে। এই সেই সদর স্ট্রিট, এখানকারই কোনো একটা বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি লিখেছিলেন না? এই সদর স্ট্রিটেরই এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনের সব আবরণ সরে গিয়েছিল, এই দৃশ্যমান জগৎ তাঁর কাছে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। আমিও তো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি–আমার তো সেরকম কিছুই হল না, আমার চোখে পড়ল ক-টা নষ্ট মেয়ে আর এই ধূসর বিকেলে ব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি।
রেলিং-এর ওপর থুতনি রেখে তপন অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মধ্যেই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল সেখানে। হঠাৎ তপন দেখল, তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, দু-চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এসেছে থুতনি পর্যন্ত। জীবনে তপন কখনো এত অবাক হয়নি। তার চোখে জল? কেন? হঠাৎ কীজন্য? একটুক্ষণ সে অন্যমনস্ক ছিল, তার মধ্যেই.. তপন বাঁ-হাতের উলটোপিঠ দিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে গেল, কিন্তু মোছা হল না, নিজের অজান্তেই প্রায় তার বুক থেকে একটা ফোঁপানি উঠে এল, হু-হু করে কান্না এসে গেল আরও, তপন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারল না। তার মতন জেদি, একরোখা ছেলে– সমস্তরকম দুর্বলতাকেই যে হেসে উড়িয়ে দিতে শিখেছে, কিন্তু হঠাৎ তারও মনে হল, এই পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা, তার কেউ নেই, তার জীবনটার কোনো মূল্য নেই, শুধু অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকা। পৃথিবীর অনেক শহরের অনেক হোটেলেই সে একা একা কাটিয়েছে, কোথাও কোনোদিন সে এত বেশি নিঃসঙ্গতা বোধ করেনি, কোথাও এমন দুর্বল হয়ে পড়েনি। কিন্তু এই বাংলায় এসে, কলকাতা শহরের হোটেলে সে একা দাঁড়িয়ে আছে, এখানে কেউ তাকে চেনে না, কোথাও তার যাবার জায়গা নেই–এই কথা ভেবেই সে অনুভব করল যেন এক ভয়ংকর শূন্যতার মধ্যে তুলোর বীজের মতন উদ্দেশ্যহীনভাবে সে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে কিছুতেই সংযত করতে পারল না তপন, সদর স্ট্রিটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁধ না-মানা কান্নায় ডুবে গেল।
পাশের বারান্দার মেয়ে দুটি স্তম্ভিতভাবে চোখ গোল গোল করে তপনের দিকে চেয়েছিল। একটু পরে সেটা খেয়াল হতেই বিষম লজ্জা পেয়ে তপন ছুটে ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে।