১
হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন’পরি,
গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি —
কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,
কাঁপায়ে নীহারশীতল বায়।
২
স্তব্ধ শিখর স্তব্ধ তরুলতা,
স্তব্ধ মহীরূহ নড়েনাকো পাতা।
বিহগ নিচয় নিস্তব্ধ অচল;
নীরবে নির্ঝর বহিয়া যায়।
৩
পূরণিমা রাত — চাঁদের কিরণ —
রজতধারায় শিখর, কানন,
সাগর-ঊরমি, হরিত-প্রান্তর,
প্লাবিত করিয়া গড়ায়ে যায়।
৪
ঝংকারিয়া বীণা কবিবর গায়,
“কেন রে ভারত কেন তুই, হায়,
আবার হাসিস্! হাসিবার দিন
আছে কি এখনো এ ঘোর দুঃখে।
৫
দেখিতাম যবে যমুনার তীরে,
পূর্ণিমা নিশীথে নিদাঘ সমীরে,
বিশ্রামের তরে রাজা যুধিষ্ঠির,
কাটাতেন সুখে নিদাঘ-নিশি।
৬
তখন ওহাসি লেগেছিল ভালো,
তখন ওবেশ লেগেছিল ভালো,
শ্মশান লাগিত স্বরগ সমান,
মরু উরবরা ক্ষেতের মতো।
৭
তখন পূর্ণিমা বিতরিত সুখ,
মধুর উষার হাস্য দিত সুখ,
প্রকৃতির শোভা সুখ বিতরিত
পাখির কূজন লাগিত ভালো।
৮
এখন তা নয়, এখন তা নয়,
এখন গেছে সে সুখের সময়।
বিষাদ আঁধার ঘেরেছে এখন,
হাসি খুশি আর লাগে না ভালো।
৯
অমার আঁধার আসুক এখন,
মরু হয়ে যাক ভারত-কানন,
চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন
প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক্।
১০
যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে,
প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে,
ডুবাক ভারতে সাগরের জলে,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্।
১১
চাই না দেখিতে ভারতেরে আর,
চাই না দেখিতে ভারতেরে আর,
সুখ-জন্মভূমি চির বাসস্থান,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক।
১২
দেখেছি সে-দিন যবে পৃথ্বীরাজ,
সমরে সাধিয়া ক্ষত্রিয়ের কাজ,
সমরে সাধিয়া পুরুষের কাজ,
আশ্রয় নিলেন কৃতান্ত-কোলে।
১৩
দেখেছি সে-দিন দুর্গাবতী যবে,
বীরপত্নীসম মরিল আহবে
বীরবালাদের চিতার আগুন,
দেখেছি বিস্ময়ে পুলকে শোকে।
১৪
তাদের স্মরিলে বিদরে হৃদয়,
স্তব্ধ করি দেয় অন্তরে বিস্ময়;
যদিও তাদের চিতাভস্মরাশি,
মাটির সহিত মিশায়ে গেছে!
১৫
আবার সেদিন (ও) দেখিয়াছি আমি,
স্বাধীন যখন এ-ভারতভূমি
কী সুখের দিন! কী সুখের দিন!
আর কি সেদিন আসিবে ফিরে?
১৬
রাজা যুধিষ্ঠির (দেখেছি নয়নে)
স্বাধীন নৃপতি আর্য-সিংহাসনে,
কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে,
সেসব কেবল রয়েছে গাঁথা!
১৭
শুনেছি আবার, শুনেছি আবার,
রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার,
শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি,
আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!
১৮
ভারত-কঙ্কাল আর কি এখন,
পাইবে হায় রে নূতন জীবন;
ভারতের ভস্মে আগুন জ্বলিয়া,
আর কি কখনো দিবে রে জ্যোতি।
১৯
তা যদি না হয় তবে আর কেন,
হাসিবি ভারত! হাসিবি রে পুনঃ,
সে-দিনের কথা জাগি স্মৃতিপটে,
ভাসে না নয়ন বিষাদজলে?
২০
অমার আঁধার আসুক এখন,
মরু হয়ে যাক ভারত-কানন,
চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন,
প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক।
২১
যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে,
প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে,
ডুবাক ভারতে সাগরের জলে,
ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্।
২২
মুছে যাক্ মোর স্মৃতির অক্ষর,
শূন্যে হোক্ লয় এ শূন্য অন্তর,
ডুবুক আমার অমর জীবন,
অনন্ত গভীর কালের জলে।’