Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিকরি ডিকরি ডক রহস্য || Syed Mustafa Siraj

হিকরি ডিকরি ডক রহস্য || Syed Mustafa Siraj

হিকরি ডিকরি ডক রহস্য

অ্যান্টিক ঘড়ি চুরি

ভোরবেলা থেকেই আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। এতক্ষণে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার আমাদের প্রিয় হালদারমশাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বৃষ্টির শব্দ শুনে জানালার দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠলেন, -ব্যস! জব্বর একখান বাধল এবার!

বললুম, –তা বাধুক না হালদারমশাই! আমরা কর্নেলের গেস্ট হয়ে খিচুড়ি খাব। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানী অর্কিড সংক্রান্ত একটা রঙিন ছবির বই পড়ছিলেন। বললেন, – সুখবর আছে। জয়ন্ত! ষষ্ঠী আজ বাজার থেকে বাংলাদেশের ইলিশ এনেছে। হালদারমশাই বিরস মুখে বললেন, –কয় তো পদ্মার ইলিশ! আসলে কোলাঘাটের। হাসতে-হাসতে বললুম, -ও! আপনি তো খাঁটি বাঙাল। আমরা ঘটি। আমাদের মুখে সব ইলিশই ইলিশ!

হালদারমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ডোরবেল বাজল। কর্নেল অর্কিডের বই টেবিলে রেখে হাঁক দিলেন, -ষষ্ঠী!

তারপর অ্যাশট্রে থেকে আধপোড়া চুরুটটা তুলে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। সাদা দাড়ি ঝেড়ে তিনি বললেন, –ডাঃ চক্রবর্তী আসছেন। তার খাতিরে আর এক দফা কফি খাওয়া যাবে।

একটু অবাক হয়ে বললুম, -তাঁর আসবার কথা ছিল বুঝি?

-নাহ। কথা ছিল না।

-তাহলে কী করে বুঝলেন?

আমার কথা থেমে গেল। সত্যিই পাড়ার ডাক্তার তারক চক্রবর্তী হাতে ডাক্তারি ব্যাগ এবং গলায় স্টেথিসকোপ ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর আমাদের দেখে সহাস্যে বললেন, -বাহ! বেশ জমাট আড্ডায় ঢুকে পড়লুম তাহলে!

কর্নেল বললেন, –বুঝলেন ডাঃ চক্রবর্তী? জয়ন্ত এইমাত্র জিজ্ঞেস করছিল, আপনিই যে ডোরবেলের সুইচ টিপেছেন, তা বুঝলুম কী করে? বুঝলুম দুটো কারণে। দোতলায় লিন্ডাদের কুকুরটা চাঁচাল না, এবং ডোরবেল খুব আস্তে বাজল।

ডাঃ চক্রবর্তী অবাক হয়ে বললেন, -কী অদ্ভুত!

মোটেও নয়। -কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, কোনও লোক যদি তেতলায় আমার ডেরায় প্রায়দিনই আসে, লিন্ডাদের কুকুর রেক্সি চুপ করে থাকে। কিন্তু মাঝে-মাঝে এলে একটুখানি চাঁচায়। কেউ কদাচিৎ এলে বা প্রথমবার এলে রেক্সি প্রচণ্ড চ্যাঁচামেচি করে। তো লিন্ডার। ঠাকুরদা মিঃ জেভিয়ার অসুস্থ এবং আপনাকে রোজই এ সময় আসতে হচ্ছে। তাই রেক্সি চুপ করে ছিল। আর ডোরবেল! আপনি ডাক্তার মানুষ। যে সুইচ নানারকম লোকেরা আঙুল দিয়ে টেপে, আপনি তা একটুখানি ছুঁয়ে দেন। হা-এটা আমি লক্ষ করেছি। আপনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, এটা তো ঠিক কাজ। কারও সুইচ জোরে টিপে ডেটল-জলে হাত ধোয়াটা কাজের কথা নয়। ধরুন, আপনার আগে যে সুইচ টিপেছিল, তার আঙুলে বা হাতে কোনও ক্ষত আছে, যা থেকে বিষাক্ত ভাইরাস সুইচে আটকে গেছে।

ডাঃ চক্রবর্তী হো-হো করে হেসে উঠলেন, –এনাফ! দ্যাটস্ এনাফ কর্নেলসায়েব! আপনি সত্যি বলেছেন। বিশেষ করে আপনার ঘরে ঢুকলে এক পেয়ালা কফি না খেয়ে যাব না। বাঁ হাতে এই ব্যাগ, ডানহাতের আঙুলে সুইচ টিপি। অবশ্য এ আমার বাতিক, তা নিজেও বুঝি!

ষষ্ঠী সকালবেলায় কফির জল তৈরিই রাখে। ঝটপট ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি, চামচ আর চারটে কাপ আনল। কর্নেল বললেন, -যে যার নিজের পছন্দমতো কফি তৈরি করে নিন। আগে ডাঃ চক্রবর্তী।

কফি খেতে-খেতে কর্নেল দোতলার জেভিয়ার সায়েবের অসুখ সম্পর্কে ডাঃ চক্রবর্তীর কাছে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এই সময় দেয়ালঘড়িতে চারবার পিয়ানোর মিঠে সুর বাজার পর ঢং-ঢং করে নটা বাজল।

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, -বাহ! ঘড়িটা তো সুন্দর বাজনা বাজায়।

কর্নেল বললেন, -জাপানি ঘড়ি। ব্যাটারিতে চলে। পনেরো মিনিটে একটা সুর, আধঘন্টায় দুটো সুর, পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তিনটে আর পুরো ঘন্টায় চারটে সুর বাজে।

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, -তবে যা-ই বলুন কর্নেলসায়েব! পুরোনো আমলের ঘড়ির কারিগরি ছিল ভারি আশ্চর্য! আমার দাদামশাইয়ের বাড়ি ময়ূরগড়ে ছোটবেলায় সেখানে বেড়াতে যেতুম। ময়ুরগড়ের জমিদার ছিলেন আমার দাদামশাইয়ের বন্ধু। তার সঙ্গে জমিদারবাড়ি গিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে যেতুম। জমিদারবাবুর ঘড়ির নেশা ছিল প্রচণ্ড। দোতলায় যে ঘরে উনি থাকতেন, সিঁড়ির দু-ধারের দেয়াল থেকে শুরু করে বারান্দা, তারপর ঘরের ভেতর চারদেওয়ালে অজস্র নানা সাইজের ঘড়ি টাঙানো থাকত। আর সে কী বাজনা! তবে তার চেয়ে অদ্ভুত, কোনও ঘড়ির ভেতর খুদে পাখি ঘটা বাজছে, ততবার একটা ঘণ্টিতে ঠোঁট ঠুকত। আবার কোনও ঘড়ির ভেতর পেতলের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে খুদে এক ইঞ্চি এক সায়েব নেমে এসে ঘণ্টিতে খুদে হাতুড়ির ঘা দিত। ওহ! না দেখলে কল্পনা করা যায় না!

হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। এবার বলে উঠলেন, -ডাক্তারবাবু ময়ূরগড় না কী কইলেন য্যান?

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, –হ্যাঁ। ময়ুরগড়। দুর্গাপুরের কাছে।

গোয়েন্দামশাই ব্যস্তভাবে একটা খবরের কাগজ তুলে পাতা ওলটাতে থাকলেন, -কোন্ পাতায় খবরটা দেখলাম য্যান?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, –ছয়ের পাতায়, মফস্বলের খবরে পাবেন। অ্যান্টিক ঘড়ি চুরি।

ডাঃ চক্রবর্তীও নড়ে বসলেন, –ময়ূরগড়ের সেই জমিদারবাড়ির ঘড়ি চুরি গেছে?

হ্যাঁ। আপনার দেখা সেই জমিদার প্রমোদরঞ্জনের এক ছেলে মনোরঞ্জন রায় ওই বাড়িতে বাস করেন। অন্য ছেলে সুরঞ্জন রায় দুর্গাপুর থাকেন।

হালদারমশাই খবরটা বিড়বিড় করে পড়ার পর সোজা হয়ে বললেন। তার গোঁফ তিরতির করে কাঁপছিল। বুঝলুম, উনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন লিখছে, ছয়খানা অ্যান্টিক ঘড়ি চুরি গেছে। অ্যান্টিক কী?

কর্নেল বললেন, শতাধিক বছরের পুরনো জিনিসকে সাধারণত অ্যান্টিক বলা হয়। যে কোনও অ্যান্টিক জিনিসের বাজারদর চড়া। বলা যায় না, ছখানা অ্যান্টিক ঘড়ির দাম লাখ-দেড়লাখ টাকা হতেই পারে।

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, -এক দেড়লাখ কী বলছেন কর্নেলসায়েব? ওই বাড়িতে যে সব ঘড়ি দেখেছি, তার একটার দামই হয়তো এক-দেড়লাখ। ওইসব ঘড়ি চোখে না দেখে কল্পনা করা যায় না সেকালের ঘড়ি তৈরিতে কী অসাধারণ দক্ষতা ছিল!… খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। চল্লিশবছর হয়ে গেল প্রায়। আর ময়ুরগড়ে যাওয়া হয়নি। দাদামশাইয়ের মৃত্যুর পর মামারা। দুর্গাপুরে গিয়ে বাড়ি করেছিলেন। কার কাছেই বা যাব?

বলে ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। কফির জন্য কর্নেলকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

হালদারমশাই বললেন, -চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। এমন ঘড়ি চুরির কেস কখনও হাতে পাই নাই। ডাক্তারবাবু যে সব ঘড়ির কথা কইয়া গেলেন, তাও চোখে দেখি নাই।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, -সব ঘড়ি তো চুরি যায়নি লিখেছে। এখনও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ঘড়ি থাকতে পারে। ইচ্ছে হলে ময়ুরগড় গিয়ে দর্শন করেও আসতে পারেন।

গোয়েন্দাপ্রবর হাসলেন, ইচ্ছা তো করে। ক্লায়েন্ট আমারে হায়ার না করলে যাই ক্যামনে?

– আপনি তো ছদ্মবেশ ধরতে পটু। ছদ্মবেশে চলে যান। কোনও একটা ছলছুতো করে মনোরঞ্জনবাবুর সঙ্গে গিয়ে আলাপ করুন। আপনার তো ডিটেকটিভ এজেন্সির লাইসেন্স আছে। অসুবিধে কীসের?

হাসতে-হাসতে বললুম, কর্নেল আপনাকে তাতাচ্ছেন হালদারমশাই!

হালদারমশাই হাসলেন, না জয়ন্তবাবু! কর্নেলস্যার যা-ই কন, আমার কিন্তু সত্যই দেখতে ইচ্ছা করতাছে। ডাক্তারবাবু পাখির কথা কইলেন। এক ইঞ্চি সায়েবের সিঁড়ি দিয়া নামিয়া ঘণ্টি বাজানোর কথা কইলেন।

বললুম–তাহলে চলে যান।

–যাব?

–হ্যাঁ। স্বচক্ষে গিয়ে দেখে আসুন। লোকে সুন্দরবনে বাঘ দেখতে যায় না?

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। জানালা দিয়ে বৃষ্টির অবস্থা দেখে বললেন, -নাহ। বৃষ্টি কমছে। যাই গিয়া।

কর্নেল বললেন, খিচুড়ি আর ইলিশের কী হবে হালদারমশাই?

আইজ না কর্নেলস্যার! বাড়িতে কুটুম্ব। যাই গিয়া! –বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর ঘর থেকে কেন যেন সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

বললুম, -কাজটা ঠিক করলেন না কর্নেল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হালদারমশাই আজই ময়ূরগড়ে চলে যাবেন। আর খামোকা নাক গলাতে গিয়ে বিপদে পড়বেন।

কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। আস্তে বললেন, -আমরাও আজ ময়ুরগড় রওনা হচ্ছি জয়ন্ত!

চমকে উঠে বললুম, তার মানে?

-মানে অতি সহজ ডার্লিং! প্রাক্তন খনি ইঞ্জিনিয়ার মনোরঞ্জন রায় আমার বন্ধু। বছর পাঁচেক আগে ময়ুরগড় এলাকার পোড়োখনিগুলোতে এক বিশেষ প্রজাতির অর্কিড দেখেছিলুম। এই বর্ষাকালে সেগুলোর মধ্যে বেছে তিন-চারটে আনতে পারলে আশা করি শীত নাগাদ ফুল ফোঁটাতে পারব।

উঁহু! শুধু অর্কিড বলে মনে হচ্ছে না! রহস্যের ঝুলিটা একটু খুলুন কর্নেল!

কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন, -রহস্যের ঝুলি খোলা খুব। সহজ নয় জয়ন্ত! কারণ রায়মশাই গত রাতে ময়ুরগড় থেকে ট্রাংককল করে শুধু বললেন, শিগগির যেন তাঁর কাছে যাই। তিনি নাকি খুব বিপদের মধ্যে আছেন। ব্যস! এই দুটি কথা। তারপর আজ সকালের কাগজে তাঁর বাড়ি থেকে ছটা মূল্যবান অ্যান্টিক ঘড়ি চুরির খবর পড়লুম। মফস্বলের খবর। কাজেই তুমি নিজে সাংবাদিক হয়ে বুঝতে পারছ, এসব খবর একটু দেরি করেই ছাপে।

সায় দিয়ে বলুম, -হ্যাঁ। নিছক খালি জায়গা ভরাতেই ছাপা হয়।

কর্নেল হাঁকলেন, -ষষ্ঠী!

ষষ্ঠীচরণ পরদার ফাঁকে মুখ বের করে বলল, আজ্ঞে বাবামশাই?

– এবেলা খিচুড়ি আর দুরকমের ইলিশ। তোর দাদাবাবুর নেমতন্ন।

ষষ্ঠী হাসল, – আজ্ঞে বাবামশাই, তা কি আর বুঝিনি?

.

পায়ে-পায়ে বিপদ

হাওড়া স্টেশনে দুর্গাপুরগামী ট্রেন ধরতে গিয়ে সেদিন বিকেলেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ট্রেন ছাড়ার কথা সাড়ে তিনটেতে। সদ্য বাঁদিকের প্লাটফর্মে একটা মেল ট্রেন এসে পৌঁছেছে এবং ডানদিকের প্লাঠফর্মে আমাদের ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। তাই প্লাটফর্মে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কর্নেল আগে এবং আমি তার পেছনে ডানদিক ঘেঁষে ভিড় ঠেলে হাঁটছিলুম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ চাপাস্বরে বলে উঠল, বুড়ো মরতে চলেছে রে!

সঙ্গে-সঙ্গে পিছু ফিরেছিলুম। কিন্তু পেছনের অসংখ্য মুখের ভিড়ে কোন মুখ থেকে কথাটা বেরিয়েছে, বুঝতে পারলুম না। বারবার পিছু ফিরে লক্ষ রাখতে যাচ্ছিলুম। এই সময় কর্নেল ভিড়ের মাঝে হঠাৎ থেমে একটু হেসে বললেন, -লক্ষণ শুভ জয়ন্ত! যাত্রার শুরুতেই হুঁশিয়ারি!

বললুম, -কথাটা আপনি শুনতে পেয়েছেন?

– হ্যাঁ। এমনকী তাকে সম্ভবত দেখতেও পেয়েছি।

-আপনি তো পিছু ফেরেননি!

কর্নেল হাসলেন, –আমার পেছনেও চোখ আছে ডার্লিং! যাই হোক, আমরা ফার্স্টক্লাসের সামনে এসে গেছি। রিজার্ভেশনের দরকার মনে করিনি। দেরি একটু করলেও পানাগড় হয়ে ট্রেনটা রাত আটটার মধ্যে পৌঁছনোর কথা। চলো, ওঠা যাক।

ফাস্টক্লাসে উঠে খুঁজতে-খুঁজতে একটা খালি কুপ পাওয়া গেল। দুদিকে জানালার ধারে দুজনে বসলুম। কর্নেলের কিটব্যাগ সিটে তার পাশে রইল। অন্য ব্যাগটা সিটের তলায় ভরে দিলেন উনি। গলায় ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার ঝুলছিল। সেটা ওঁর পেটের কাছে আটকে থাকল।

মাথার টুপি খুলে টাকে হাওয়া দিতে দিতে বললেন, -ট্রেন ছাড়বার সময় ফ্যান চালু হবে। কী ভ্যাপসা গরম! আবার বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।

আমার ব্যাগ পায়ের কাছে রেখে আরাম করে বসেছিলুম। কিন্তু একটু পরেই এক প্রৌঢ় অবাঙালি ভদ্রলোক দুটো প্ৰকাণ্ড সুটকেস কুলির মাথায় চাপিয়ে কুপে ঢুকে আমাকে বললেন, -ইয়ে লোয়ারবার্থ হামনে রিজার্ভ কিয়া। উয়ো সিট হামারা হ্যায়।

অগত্যা জানালার মায়া ত্যাগ করে কর্নেলের পাশে গিয়ে বসলুম। তারপর কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে এক দম্পতি ঢুকলেন। তাঁদেরও এই লোয়ারবার্থ রিজার্ভ করা। কিন্তু এই ভদ্রলোক বাঙালি। তার স্ত্রী সম্ভবত কর্নেলের ঋষির মতো চেহারা দেখে ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, –না-না! আপনি বসুন। এই টিংকু! কী হচ্ছে? রিংকু! অমন করে না! দাদুকে বসে থাকতে দাও।

ততক্ষণে কর্নেল কচি ছেলে-মেয়ে দুটিকে পাশে জানালার ধারে বসিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। তারাও কর্নেলের দাড়ি দেখে অভিভূত। তাদের বাবা-মা আমার পাশে বসেছেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কতদূর যাবেন আপনারা?

বললুম, দুর্গাপুর! আপনারা?

আমরা পাটনা। –তিনি ঘড়ি দেখলেন, আপনারা আটটা- সওয়া আটটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন, যদি লেট না করে। মধ্যে মাত্র দুটো স্টপ। বর্ধমান আর পানাগড়।

এবার ঢুকলেন বেঁটে মোটাসোটা এক ফো ভদ্রলোক। তাঁর হাতে শুধু একটা ব্রিফকেস। অবাঙালি ভদ্রলোকের লোয়ার বার্থ এবং তার আপার বার্থ! তিনি আমাদের উল্টোদিকের সেই লোয়ার বার্থে বসে পাইপ ধরালেন। তারপর কর্নেলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। দৃষ্টিটা কেমন যেন সন্দেহজনক। অথবা আমার চোখের ভুল!

ঠিক সাড়ে তিনটেতে ট্রেন ছাড়ল। তার কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির ছাট আসছিল। অবাঙালি ভদ্রলোক কাচ নামিয়ে দিলেন। কিন্তু মায়ের বকুনি সত্ত্বেও টিংকু-রিংকু দাদু-কে কাচ নামাতে দিল না। তারা বৃষ্টি দেখবেই।

দু-ঘন্টা পরে ট্রেন বর্ধমান পৌঁছল! এইসময় কর্নেল উঠে গেলেন। সম্ভবত কফির নেশায়। তার একটু পরে সেই গুফো ভদ্রলোকও উঠে গেলেন। দশ মিনিটের স্টপ। সময় কাটতে চায় না। টিংকু-রিংকু এবার কর্নেলের সিটে বসেছে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ল, তবু কর্নেলের পাত্তা নেই। একটু উদ্বিগ্ন হয়ে কুপের দরজা দিয়ে উঁকি মারলুম। কিন্তু কর্নেলকে দেখতে পেলুম না। তারপর করিডরে ডাইনে তাকাতেই দেখি, কর্নেল তুম্বামুখে এগিয়ে আসছেন। বললুম, -এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?

কর্নেল জবাব না দিয়ে কুপে ঢুকে টিংকু-রিংকুর পাশে বসলেন। তারপর সেই ফো ভদ্রলোককে এতক্ষণে ফিরতে দেখলুম। তার ব্রিফকেস সিটেই ছিল। তিনি সিটে বসে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, -ওভাবে ট্রেন ছাড়ার সময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে কফির কাপ ফেলে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি। আপনি বৃদ্ধ মানুষ। কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত!

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, আমি পেপারকাপ ফেলে দিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু আপনি দরজায় যে-ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাতে আমার অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত। ভাগ্যিস আমি আপনার হাতটা আঁকড়ে ধরেছিলুম।

ভদ্রলোক খাপ্পা হয়ে বললেন, -আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, না টেনে প্লাটফর্মে নামিয়ে ছিলেন? তারপর তো আপনি দিব্যি চলন্ত ট্রেনের অন্য দরজা দিয়ে উঠে পড়লেন। আমি যদি উঠতে না পারতুম?

উঠতে পেরেছেন তো! –বলে কর্নেল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।

গুঁফো ভদ্রলোক সরোষ দৃষ্টিতে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে ফেস শব্দে শ্বাস ছেড়ে বললেন, -মাঝখান থেকে আমার তিনশো টাকা দামের বিলিতি পাইপটা গচ্চা গেল! দেবেন কিনে?

কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন, -আবার যদি দেখা হয়, সুদে-আসলে পুষিয়ে দেব।

আমার পাশের বাঙালি ভদ্রলোক-মানে টিংকু-রিংকুর বাবা মধ্যস্থতা করার জন্য বললেন, -ট্রেন ছাড়বার সময় দরজা একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েই থাকে।

গুঁফো ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, –না! উনি আমার হাত ধরে টেনে প্লাটফর্মে ফেলে দিয়েছিলেন।

কর্নেল চোখ খুলে এবার একটু হেসে বললেন, -উঁহু! উনি আমাকে উঠতে বাধা দিচ্ছিলেন। অগত্যা ওঁকে টেনে প্লাটফর্মে নামাতেই হল। যাওয়া না হয় তো দুজনেরই হোক।

বাজে কথা বলবেন না! –গুফো ভদ্রলোক বললেন? জানেন আমি কে? পানাগড়ের সিনহা সাপ্লাই কোম্পানির ম্যানেজার। আমার নাম ভূতনাথ হাজরা। আমার কোম্পানি পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্পে অর্ডার সাপ্লাই করে।

কর্নেল বললেন, – বাহ! তাহলে তো আপনি মিলিটারি বিমান ঘাঁটির ক্যাপ্টেন ডি. এন. সাঠেকে চেনেন! তাঁকে বলবেন, বর্ধমান স্টেশনে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে একটু মল্লযুদ্ধ হয়েছিল।

ভূতনাথ হাজরা কথাটা গ্রাহ্য করলেন না। কিন্তু বাঙালি ভদ্রমহিলা-টিংকু-রিংকুর মা অমনি বলে উঠলেন–কী অবাক! তাই আপনাকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ক্যামেরা, বাইনোকুলার! আমার কী সৌভাগ্য! এতদিন ছবিতে দেখেছি।

বলে তিনি উঠে ঝটপট কর্নেলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, –আর আপনি নিশ্চয় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিখ্যাত সেই সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি? নমস্কার! আপনার কত লেখা পড়েছি। কর্নেলসায়েবকে নিয়ে লেখা সাংঘাতিক সব অ্যাডভেঞ্চার। ওগো! এঁরা দুজনেই বিখ্যাত লোক। তুমি তো বই-টই পড়ো না। বাংলা কাগজও পড়ো না!

টিংকু-রিংকুর বাবা আমাদের নমস্কার করলেন। তার স্ত্রী আবার গদগদ হয়ে বললেন, -গতবার কলকাতা বইমেলায় আমি পুরো সেট কর্নেল সমগ্র কিনেছি। আর টিংকু-রিংকুর জন্য কিনেছি প্রেতাত্মা ও ভালুকরহস্য। ওরা বড় হয়ে পড়বে।

আলাপ জমে গেল। টিংকু-রিংকুর বাবার নাম অমল ঘোষ। মায়ের নাম সুনন্দা ঘোষ। অমলবাবু। পাটনায় গর্দানিবাগ এলাকায় কেন্দ্রীয় শিল্প দফতরের অফিসে চাকরি করেন। তার বাড়িও সেখানে। সুনন্দা দেবীর বাবা-মায়ের বাড়ি কলকাতার ভবানীপুরে।

কথায়-কথায় পানাগড় এসে গিয়েছিল। ভূতনাথ হাজরা কর্নেলের দিকে আবার সরোষে দৃষ্টিপাত করে বেরিয়ে গেলেন।

ট্রেন আবার ছাড়লে সুনন্দা দেবী বললেন, -কর্নেলসায়েব নিশ্চয়ই কোথাও রহস্যভেদ করতে যাচ্ছেন?

কর্নেল হাসলেন, -নাহ। যাচ্ছি ময়ূরগড়ে অর্কিডের খোঁজে। আমরা দুর্গাপুরে নেমে যাব।

সুনন্দা দেবী বললেন, –কিন্তু আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে, ওই গুফো লোকটা ইচ্ছে করেই আপনাকে ট্রেনে উঠতে দিচ্ছিল না। ওর চেহারা দেখে কেমন যেন গা-ছমছম করছিল।

কর্নেল বললেন, –ওঁকে আমি কস্মিনকালে দেখিনি। আমার সঙ্গে ওঁর কী শত্রুতা থাকতে পারে?

সুনন্দা দেবী মুখ টিপে হেসে বললেন, -আপনি এখন কিছু খুলে বলবেন না, তা জানি। আপনি অর্কিড নয়, নিশ্চয়ই ময়ূরগড়ে কোনও রহস্যের পেছনে ছুটে যাচ্ছেন। ওই লোকটা তা টের পেয়েই আপনাকে আক্রমণ করেছিল। ঠিক আছে। না বলুন এখন। যথাসময়ে দৈনিক সত্যসেবকের পাতায় জয়ন্তবাবু স্টোরিটা লিখবেন। তারপর সামনের বছর কলকাতা বইমেলায় তা বই হয়ে বেরুবে।

দুর্গাপুর স্টেশনে পৌঁছুনোর আগেই সুনন্দা দেবী আমার দিদি হয়ে উঠলেন। টিংকু-রিংকু কর্নেলকে কর্নেলদাদু আর আমাকে জয়স্তমামা বলতে শুরু করল। ট্রেন পৌঁছুল সাড়ে আটটায়। আধঘন্টার বেশি লেট। আমরা নেমে গেলুম। সুনন্দ দেবী দরজায় এসে বিদায় দিলেন। বললেন, -একবার যেন পাটনায় আপনারা আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন! নেমকার্ডটা যেন হারাবেন না।

অমলবাবু কর্নেলকে আগেই নেমকার্ড দিয়েছিলেন। কর্নেল হাত নেড়ে জানালায় টিংকু-রিংকুর মুখের দিকে তাকিয়ে টা-টা করলেন। ওরা হেসেই অস্থির।

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি এতক্ষণে বললুম, -কর্নেল! ওই ভূতনাথই যে হাওড়া স্টেশনে পেছন থেকে বুড়ো মরতে চলেছে রে বলেছিল, তাতে ভুল নেই।

কর্নেল একটু হেসে চাপাস্বরে বললেন, –নাহ। ওর এক চেলা। বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই আমি কফি আনতে নেমে গেলুম। আমার দু-হাতে দুটো পেপারকাপে কফি ছিল। এককাপ তোমার জন্য। তো ট্রেনে ওঠার সময় দেখি, পেছনের কামরা থেকে নেমে এসে সে ভূতনাথ হাজরার সঙ্গে কথা বলছে। কিছুতেই আমাকে উঠতে দেবে না। তখন চেলাটাকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ফেলে দিলাম। গরম কফির ছ্যাকায় সে বাপরে করে উঠেছিল। কফির দুটো কাপই বরবাদ হল। তারপর অগত্যা ভূতনাথকে হ্যাঁচকা টানে নামালুম। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিল। দৌড়ে গিয়ে অন্য দরজায় উঠে পড়লুম। ভূতনাথও তাই করল। ওর চেলাটার অবস্থা আর লক্ষ করিনি।

–ওর সেই চেলাই যে বুড়ো মরতে চলেছে রে বলেছিল, কীভাবে টের পেলেন?

– কথাটা কানে যেতেই মুখ ঘুরিয়েছিলাম। অমন কথা যদি কেউ বলে, বলার পরও তার মুখে সেই কথার ভাবটুকু মিলিয়ে যেতে দেরি হবে। এটা মনস্তত্ত্ব, জয়ন্ত! রাগের কথা শেষ হওয়ার পরও মানুষের মুখে রাগের ভাবটা থেকে যায় কিছুক্ষণ। ওই কথাটা ব্যঙ্গের। কাজেই ছোরার মুখের কথা শেষ হওয়ার পরও যে ব্যঙ্গ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ছিল, তা আমার চোখে পড়েছিল। বয়স কুড়ি-বাইশের মধ্যে। পরনে জিনস্ আর গোলগলা চকরাবকরা গেঞ্জি। গলায় নকল সোনার হার আর বাঁহাতে শেকলের মতো রুপোর ঢিলে বালা- আজকাল যা স্টাইল! যাগগে। চলো! আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।

– তারপর ময়ুরগড় কীভাবে যাব আমরা?

-চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

একটা কফির স্টলে গিয়ে পেপারকাপে কফি খাওয়া হল। সেই সময় আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জুলাই মাসে বৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু এই বৃষ্টির রাতে ময়ুরগড় কীভাবে যাওয়া হবে বুঝতে পারছিলুম না।

কর্নেল পিঠে কিটব্যাগ এঁটে ডানহাতে অন্য একটা ব্যাগ নিয়ে বললেন, -এসো।

বললুম, -বৃষ্টিতে ভিজে যাব যে!

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, -স্টেশনের গেটে গেলেই আশা করি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বৃষ্টির জন্য স্টেশনে ক্রমে ভিড় জমেছিল। গেটের কাছে যেতেই ভিড় ঠেলে খাকি রঙের উর্দি পরা একটা রোগাটে চেহারার লোক এসে কর্নেলকে সেলাম ঠুকল। সে হাসিমুখে বলল, –মুখার্জিসাব আমাকে গেটে ওয়েট করতে বলেছিলেন। তো টেরেন চলে গেল। আমি শোচ্ করছিলাম কী, কর্নিলসাব কি আসলেন না?

কর্নেল বললেন, –কফি খাচ্ছিলুম ইসমাইল! তো তুমি কেমন আছ?

–আমি ঠিক আছি সাব! এক মিনিট। আমি গাড়ি সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসছি।

বললুম, -বাহ! সব ব্যবস্থা পাকা!

হ্যাঁ। পাকা। -কর্নেল বললেন, মুখার্জিসায়েব হলেন ময়ুরগড় বন-দফতরের বড়কর্তা। পার্বতীনাথ মুখার্জি। তুমি খিচুড়ি-ইলিশ খেয়ে যখন ঘুমোচ্ছিলে, তখন ট্রাংককলে ওঁকে জানিয়েছিলাম আমরা যাচ্ছি।

– ময়ুরগড়ে বনজঙ্গল আছে নাকি?

-ময়ুরগড়ে নেই। কাছাকাছি আছে। আমরা মনোরঞ্জন রায়ের বাড়িতে উঠছি না-অন্তত অবস্থা না বুঝে। উঠছি তার বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে বনবাংলোতে। অবশ্য বাংলোটা জঙ্গলের ভেতরে নেই। আছে জঙ্গলের সীমানায় একটা টিলার গায়ে। নিচে একটা ঝরনা আছে। ঝরনাটার পথ কিন্তু রহস্যময়।

– কেন?

-পোড়োখনি এলাকা ওটা। খনির খাদ ভেতর দিয়ে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে এগিয়ে গেছে দামোদর নদের দিকে। ব্রিটিশ আমলের খনি সব। অভ্র, ডলোমাইট, আরও কত রকমের খনি ছিল! এখন আর কিছুই নেই। এসো। গাড়ি এনেছে ইসমাইল!

সে ছাতি বের করে দরজা খুলছিল। কর্নেল বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই গাড়িতে ঢুকলেন। আমি ইসমাইলের ছাতির তলায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলুম।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইসমাইল বলল, -মুখার্জিসাব জিপ নিয়ে আসতে বলেছিলেন। তো পরে উনি শোচ করলেন কী, বরষাতে জিপে এলে কর্নিলসাব ভিজে যাবেন। তাই অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি দিলেন। এ গাড়ি উনার নিজের গাড়ি সাব!

আলোকিত এলাকা পার হয়ে গাড়ি অন্ধকারে হেডলাইট জ্বেলে সাবধানে ছুটছিল। দু-ধারে ঝোপঝাড়, কখনও উঁচু গাছের সারি চোখে পড়ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, –ময়ূরগড় কত দূর?

ইসমাইল বলল, ওই দেখুন সাব! রাস্তার মধ্যিখানে একটা বড় পাথর ফেলেছে হারামজাদা শয়তানরা। এ রাস্তায় রাতে রাহাজানি করে ডাকাতরা।

তুমি হেডলাইট জ্বেলে রাখো-বলে কর্নেল বাইনোকুলারে কিছু দেখে নিলেন। তারপর শার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তার রিভলভার বের করলেন। আস্তে বললেন, –ইসমাইল! তুমি আস্তে এগিয়ে চলল। দুটো লোক ডানদিকে শালগাছের আড়ালে বসে আছে।

ইসমাইল একটু দ্বিধার পর এগিয়ে চলল। এতক্ষণে পাথরটা দেখতে পেলুম। পাথরটার ডাইনে বা বাঁদিক দিয়ে গাড়ি যাবে না। পাথরটার কাছাকাছি যেতেই দুটো মুখোশপরা লোক ডানদিক থেকে বেরিয়ে এল। একজনের হাতে একটা ভোজালি, অন্যজনের হাতে একটা লম্বা দা। গাড়ি পাথরটার হাত দশেক দূরে থামল। তারপরই কর্নেল দরজা খুলে নেমে রিভলভার থেকে তাদের পায়ের কাছে গুলি ছুড়লেন। অমনি তারা লাফ দিয়ে উঠে শালবনের ভেতর ঢুকে পড়ল। কর্নেল শালবনের দিকে আর একবার গুলি ছুড়লেন। তারপর হেট হয়ে পাথরটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন। ইসমাইল হাসতে হাসতে বলল, -ডাকুরা শোচ করেনি গাড়িতে কে আছেন।

কর্নেল এসে বললেন, -আশা করি আর হামলা হবে না।

গাড়ি আবার চলতে থাকল। বৃষ্টির মধ্যে এই আকস্মিক হামলায় আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসে ছিলাম। একটু পরে বললুম, -কী সর্বনেশে লোক ওরা! আশ্চর্য! কল্পনাও করিনি!

কর্নেল বললেন, –তার চেয়ে আশ্চর্য, তোমার কাছেও লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস আছে। তুমি সেটার কথা ভুলে গিয়েছিলে। তুমিও বাঁদিক থেকে নেমে রিভলভার বের করে ওদের মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছুড়লে ওরা আতঙ্কে মূৰ্ছিত হতো। তখন ওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওদের দিয়েই পাথরটা সরানো যেত।

বললুম, –আসলে আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলুম।

ভবিষ্যতে যেন আর হকচকিয়ে যেয়ো না। –বলে কর্নেল একটুকরো ভেজা কাগজ দেখালেন। তাতে লাল ডটপেনে বড় বড় হরফে লেখা আছে : সাবধান।

বললুম, –এটা কোথায় ছিল?

–পাথরটার তলায়। তাই বেশি ভিজে যায়নি।

-কী সর্বনাশ! তাহলে এ কি সেই ভূতনাথ হাজরার আয়োজন?

– হতে পারে। তবে বোঝা যায়, লোকদুটো আমাদের নিছক ভয় দেখাতে এসেছিল, যাতে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে দুর্গাপুরে ফিরে যাই জয়ন্ত! ওরা যার লোকই হোক, সে চায় না আমি ময়ূরগড়ে যাই।

–কিন্তু সে টের পেল কী করে?

-সম্ভবত রায়মশাইয়ের ফোন ওরা ট্যাপ করে রেখেছে।

কথাটা শুনে আমি এবার হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলে আমার রিভলভারের বাঁটটা মুঠোয় ধরে বসে রইলুম। মনে পড়ল, বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় কর্নেল বলেছিলেন, –সব সময়ের জন্য তৈরি থাকতে হবে জয়ন্ত! সম্ভবত আমরা এমন পথে যাত্রা শুরু করেছি, যেখানে পায়ে-পায়ে বিপদ আসতে পারে।

কেন বলেছিলেন, তার জবাব পাইনি। কিন্তু যা দেখছি, আমাদের পথে সত্যিই বিপদ ওত পেতে আছে।

.

হিকরি ডিকরি ডক

বনবাংলোয় অবশ্য নির্বিঘ্নে পৌঁছেছিলুম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। বাংলোটা সুন্দর। বিদ্যুৎ আছে। কেয়ারটেকার-কাম-পাঁচক সিদ্ধেশ্বর কর্নেলের পরিচিত। চৌকিদার সুখরামও তা-ই। বুঝলুম, কর্নেল- এই বাংলোয় আগেও এসেছিলেন।

ইসমাইল সকালে আসবে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিল। রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসে কর্নেল সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। সে কটকেন্দ্র লোক। এই বাংলোতে তার দশবছর কেটে গেছে বনজঙ্গল আর অর্কিডের খোঁজখবর নিতে নিতে কর্নেল বললেন, -আচ্ছা সিদ্ধেশ্বর, কাগজে পড়েছি, ময়ূরগড়ের জমিদারবাড়ি থেকে নাকি অনেকগুলো ঘড়ি চুরি গেছে?

সিদ্ধেশ্বর মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে ছিল। সুখরামও একটু তফাতে উবু হয়ে বসে মাঝে মাঝে কথা বলছিল। কর্নেলের কথার জবাবে সিদ্ধেশ্বর বলল, -শুনেছি তো চুরি গেছে। আমার কী মনে হয় জানেন স্যার? বাড়ির লোকেই চুরি করে কাউকে বেচে দিয়েছে। রায়মশাইয়ের ঘর, না কেল্লা- আপনিই দেখেছেন। বলুন? বাইরের কে ওই কেল্লায় ঢুকতে পারবে?

কর্নেল বললেন, -ঘরের লোক বলতে কে?

– আজ্ঞে, রায়মশাইয়ের বাড়িতে ওঁর দূরসম্পর্কের এক ভাগনে আছে। সে বড়ই নেশাখোর উড়নচন্ডী। আর আছে পুরোনো কাজের মেয়ে সৌদামিনী। তার স্বামী শশধর দুবছর আগে মারা গেছে। ছেলে রাজু মায়ের কাছে থাকে। রাজুরও বদনাম আছে। মস্তানি করে বেড়ায়। রায়মশাই তো বিয়ে করেননি, তা আপনি জানেন। হা-আর সেই পিনাকীবাবুর কথা মনে আছে আপনার? রায়মশাইয়ের বাবার আমলের কর্মচারী।

–পিনাকীবাবু এখনও আছেন ও বাড়িতে?

– আছেন। যাবেন কেথায়? উনি ও রায়মশাইয়ের মতো বিয়ে করেননি। বুড়ো মানুষ। বাড়ির কাজকর্ম করে দেন। ঘড়িগুলোতে উনিই বরাবর দম দিতেন। রায়মশাইয়ের খুব কাছের লোক বলতে উনিই।

–মানে- রায়মশাই পিনাকীবাবুকে বিশ্বাস করেন?

সিদ্ধেশ্বর হাসল, –না করে উপায় কী? রায়মশাইয়ের ভাই সুখরঞ্জনবাবুর খবর জানো?

–উনি তো দুর্গাপুরেই থাকেন। শুধু কালীপুজোর সময় ফ্যামিলি নিয়ে দাদার বাড়ি আসেন।

-কালীপুজো তাহলে এখনও চালু আছে জমিদার বাড়িতে?

– আছে। তবে আগের মতো জাঁকজমক হয় না। নমো-নমো করে নেহাত দায়সারা পুজো হয়। আর-আপনি তো জানেন, রায়বাড়ির কালী বিসর্জন হয় না।

– হ্যাঁ। অষ্টধাতুর কালীপ্রতিমা।

এইসময় সুখরাম হাই তুলে বলল, দো রোজ আগে আমি সন্ধের টাইমে বাড়ি থেকে আসছিল। তো দেখলাম কী, পুঁটুবাবু আর রাজু পশ্চিম মাঠ থেকে আসছে। আমাকে দেখে আচানক ছুপা হইয়ে গেল! মালুম হল না, কাহে ছুপা হইয়ে গেল। রাজু বহত হারামি লড়কা আছে কর্নেলসাব!

কর্নেল বললেন, পশ্চিমের মাঠ মানে তো পোড়োখনি এলাকা!

জি হ্যাঁ।

সিদ্ধেশ্বর হাসল, -হ্যাঁ স্যার! আমিও কয়েকবার এই বাংলো থেকে দেখেছি, দুজনে ঝরনার ধারে বসে আছে। লুকিয়ে গাঁজা খেতে যায় হয়তো।

আবার হঠাৎ বৃষ্টি এল। জোরালো বৃষ্টি। কর্নেল বললেন, -আচ্ছা সিদ্ধেশ্বর! তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত এগারোটা বাজে। আমরাও শুয়ে পড়ি। হ্যাঁ বাংলোয় মশার উৎপাত নেই তো?

– না স্যার! উঁচু জায়গা। সবসময় খুব হাওয়া। দেখবেন ফ্যানের হাওয়াতে শীত করবে। তবে মশা হয় শীতের সময়। সে-ও সামান্য।

ওরা উঠে বাংলোর বারান্দা দিয়ে পেছনে চলে গেল। আমরা ঘরে ঢুকলুম। বললাম, -জানালাগুলো কি খোলা থাকবে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -থাকবে। তোমার ভয়ের কারণ নেই জয়ন্ত! বাংলোর চারদিকে আলো। এখানে শিল্পনগরী দুর্গাপুর থেকে বিদ্যুৎ আসে বলে লোডশেডিং হয় না। তাছাড়া চারদিকের বাউন্ডারি ওয়ালের মাথায় পাঁচফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। গেটে তালা বন্ধ থাকে। আর সুখরামকে দেখলে। ওর কান ঘুমের মধ্যে যেন জেগে থাকে। সুখরাম একসময় এই মুলুকের সেরা কুস্তিগির ছিল। এখন বয়স হয়েছে। তবু পুরনো সুনামের জোরে লোকেরা ওকে খুব সমীহ করে চলে! হ্যাঁ তোমাকে বলা উচিত। সুখরাম একবার এই বাংলোর কাছে একটা মানুষখেকো বাঘকে টাঙিতে কুপিয়ে মেরেছিল। সরকার থেকে সেইজন্য তাকে পাঁচহাজার টাকা বখশিস দেওয়া হয়।

–জঙ্গলে এখনও বাঘ আছে নাকি?

– রিজার্ভ ফরেস্টে বাঘ থাকবে না? হাতি ভালুক শুয়োরও আছে। পাইথন সাপও আছে। তবে তোমার তাতেও ভয়ের কিছু নেই কোনও হিংস্র জানোয়ার এই বাংলায় ঢুকতে পারবে না।

বৃষ্টির রাতে এমন নিরাপদ বনবাংলোতে আমার স্বস্তির সঙ্গে ঘুম এসে গিয়েছিল, যদিও নতুন জায়গায় গেলে সহজে আমার ঘুম আসে না।

সেই ঘুম ভাঙল সকাল সাতটা নাগাদ। সিদ্ধেশ্বর বেড-টি এনে ডাকছিল। কর্নেলকে দেখতে পেলুম না। জিজ্ঞেস করলে সিদ্ধেশ্বর বলল, -কর্নেলসায়েব ভোরবেলা বেরিয়েছেন। ওঁর স্বভাব। তো জানি স্যার! অর্কিড বা প্রজাপতির-কিংবা ধরুন কোনও পাখির পেছনে ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছেন।

সকালে বৃষ্টি ছিল না। ভাঙাচোরা মেঘের ফাঁকে রোদ ঝলমল করছিল। বেড-টি খেয়ে বারান্দায় গেলুম। সকালের রোদে চারপাশটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। পূর্বে দূরে ময়ুরগড় দেখা যাচ্ছিল। রীতিমতো ছোট শহর। উত্তরে অসমতল সবুজ বনভূমি আর উঁচু-নিচু টিলাপাহাড়। পশ্চিমে ঢেউখেলানো মাঠ। প্রকাণ্ড সব পাথর আর টাড় মাটি। কদাচিৎ কোথাও ঝোপঝাড় বা গাছ। বাংলোর নিচেই পশ্চিমে একটা ঝরনা ছোট নদীর মতো বয়ে চলেছে। বর্ষাকাল বলে জলটা একটু ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। ঝরনাটা এসেছে উত্তরদিকের বনভূমির ভেতর থেকে এবং বাংলোর কাছাকাছি বেঁকে পশ্চিমবাহিনী হয়েছে। পশ্চিমের অসমতল মাঠটাই যে খনি এলাকা ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল।

বাথরুম সেরে আবার বারান্দায় এলুম। তারপর চোখে পড়ল, পোড়োখনি এলাকার একটা ঢিবির মাথায় বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। তারপর তিনি টিবি থেকে নেমে অদৃশ্য হলেন।

অদৃশ্য হলেন তো হলেন। প্রায় আধঘন্টা তাকে আর খুঁজে পেলুম না। সিদ্ধেশ্বর সাইকেল নিয়ে লনে এসে বলল, -বাজারে যাচ্ছি স্যার! চা-কফির দরকার হলে সুখরামকে ডাকবেন আর ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা আছে। কর্নেলসায়েব ফিরলে সুখরাম তো রইল।

পূর্বদিকে যে রাস্তা দিয়ে আমরা রাত্রে এসেছি, তার মোড়ে কর্নেলকে এতক্ষণে দেখতে পেলুম। তার পেছনে একটা সাদা গাড়ি আসছিল। গাড়িটা তার কাছে থেমে গেলে কর্নেল ঢুকে গেলেন। বুঝলুম; ইসমাইল গাড়ি আনছে।

হর্ন শুনে সুখরাম গেট খুলে দিল। গাড়িটা এসে পোর্টিকোর তলায় থামল। কর্নেল বেরিয়ে বললেন, -মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে?

বললুম, -মর্নিং বস্! আপনি পোড়োখনির মাঠে ঢিবিতে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে কি ভূতনাথের কোনও চেলাকে দেখছিলেন?

কর্নেল হাসলেন, –নাহ্। লাল ঘুঘুর ঝাঁক দেখছিলুম। ওরা টাড় জমিতে বসে ছিল। কিন্তু বড্ড চালাক। ছবি তুলতে দিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রেকফাস্ট করে কফি পানের পর কর্নেল বললেন, -চলল জয়ন্ত! জমিদারবাড়ি যাওয়া যাক।

গাড়িতে জমিদারবাড়ি যেতে মিনিট দশেক লাগল। বাড়িটা শহরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা উঁচু জমিতে জীর্ণ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। গড়নে কতকটা ক্যা বা দুর্গপ্রাসাদের মতো। চারদিকে উঁচু-গাছ। লোহার প্রকাণ্ড গেট। বাড়ির ভেতর জেলখানার মতো উঁচু বাউন্ডারি-ওয়ালা। ফুলবাগান আগাছায় ঢাকা পড়েছে। পামগাছ, বর্মি বাঁশের ঝাড়, কতরকমের বিদেশি গাছপালা জঙ্গল হয়ে আছে।

হর্ন শুনে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে গেট খুলে দিয়ে কর্নেলকে দেখে করজোড়ে নমস্কার করলেন। তাঁর দাড়ি আর চুড়োবাঁধা চুল, কপালে সিঁদুরের ছোপ মুখে সাধুসন্ন্যাসীর আদল ফুটিয়েছে। কিন্তু গায়ে সাদা ফতুয়া আর পরনে ধুতি। বাঁ-হাতে রিস্টওয়াচ। পায়ে সাদাসিধে চপ্পল।

গাড়ি পোর্টিকোর সামনে থামলে কর্নেল বেরুলেন। তিনি বললেন, -পিনাকীবাবু, আপনি কেমন আছেন?

বৃদ্ধ বললেন, -মায়ের আশীর্বাদে একরকম কেটে যাচ্ছে স্যার! একটু আগে রায়মশাই আপনার আসার কথা বলছিলেন। গেস্টরুম গুছিয়ে রেখেছি।

কর্নেল বললেন, –আমরা বনবাংলোয় উঠেছি পিনাকীবাবু! আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

-এটা স্যার ঠিক করেননি। রায়মশাই দুঃখ করবেন। আসুন। ওঁর শরীর আগের মতো জুতসই নয়। তাতে গত সপ্তাহে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে আমরা বারান্দায় উঠলাম। তারপর বারান্দার শেষপ্রান্তে গিয়ে আবার ঘোরালো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলুম। সিঁড়ির দুধারের দেয়ালে ডাঃ চক্রবর্তী ছোটবেলায় নাকি অনেক ঘড়ি দেখেছিলেন। সে-সব নেই। দোতলার বারান্দায় ছড়ি-হাতে এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে পাজামা আর তাঁতের ছাইরঙা পাঞ্জাবি। সুচলো পুরু কাঁচাপাকা গোঁফ আর ঝাঁকড়া চুল। সব মিলিয়ে তার চেহারায় বনেদি আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। নমস্কার করে গম্ভীরমুখে বললেন, –আসুন কর্নেলসায়েব! ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মুখুজ্জে একটু আগে আমাকে টেলিফোনে জানাল, আপনারা তাদের গেস্ট। যাই হোক, আপনার যা ইচ্ছা! পিনাকীদা! তুমি সদুকে গিয়ে কফি করতে বলো! আর–পুঁটু আছে?

পিনাকীবাবু বললেন, -পুঁটুবাবু কি বাড়িতে বসে থাকার ছেলে? বোধ করি ক্লাবে আড্ডা দিতে গেছেন।

– রাজু?

রাজুকে ভোরবেলা থেকে দেখছি না। সদুকে জিজ্ঞেস করেছিলুম। বলল, কোন চুলোয় গেছে কে জানে।

– ঠিক আছে। তুমি যাও। আসুন কর্নেলসায়েব।

একটা বিশাল ঘরে আমরা ঢুলুম। ঘরের শেষপ্রান্তে একটা উঁচু মেহগনি কাঠের নকশাদার পালঙ্ক। সব আসবাবই সেকেলে। কিন্তু চোখে পড়ল চারদিকের দেয়ালে শুধু ঘড়ি আর ঘড়ি। গোল, ডিমালো, চৌকো ছোট-বড় অদ্ভুত গড়নের সব ঘড়ি। অনেক ঘড়িতে দোলক আছে। ঘর ভরে যাচ্ছে টি-টি শব্দে। আমার কানে বিরক্তিকর। কিন্তু রায়মশাইয়ের তো কান সওয়া।

খাটের কাছাকাছি সোফাসেট আর ডিভান। ইতস্তত সাজানো ব্রোঞ্জ, পেতল, কালোপাথর আর মার্বেলের বিচিত্র ভাস্কর্য। আলমারিতে-আলমারিতে পুরনো বই। আমরা সোফায় বসলুম। রায়মশাই মুখোমুখি ডিভানে বসলেন। তারপর কর্নেল আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। রায়মশাই বললেন, –দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা এখানে আসে। তবে আমি ইংরাজি পেপার রাখি। খবরটা দুর্গাপুরের কোনও সাংবাদিক পুলিশ সূত্রে পেয়ে সব কাগজকে বিলি করেছিল। সুরঞ্জন কাল সকালে জিপে চেপে ছুটে এসেছিল। ওকে বললুম, ছটা ঘড়ি বারান্দায় ছিল। সেইগুলো চোরেরা খুলে নিয়ে গেছে। ওগুলো তত কিছু উঁচুদরের জিনিস নয়। সুখরঞ্জন দুপুরে খেয়ে চলে গেল।

কর্নেল বললেন, –কিন্তু আপনার বিপদটা কী?

রায়মশাই আস্তে বললেন, গত একমাস যাবৎ কে বা কারা ডাকে একটা করে চিঠি পাঠাচ্ছে। মোট পাঁচখানা চিঠি পেয়েছি। পোস্ট অফিসের ছাপ খুব অস্পষ্ট। একটা চিঠির স্ট্যাম্পের ওপর ছাপ আবছা হলেও পড়তে পেরেছিলুম। পানাগড় থেকে ডাকে ফেলা হয়েছে।

অমনি বলে উঠলম, -কর্নেল! সেই ভূতনাথ হাজরা!

কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, -চিঠিগুলো দেখি।

রায়মশাই একটা টেবিলের ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে একগোছা খাম আনলেন। বললেন, –সব চিঠিতেই লাল ডটপেনে শুধু একটা ছড়া লেখা। তলায় একটা মড়ার খুলি আঁকা। আপনি দেখুন। তবে আশ্চর্য, এই ছড়াটা ছোটবেলায় আমার ঠাকুরদা আমাদের দুই ভাইকে মুখস্ত করিয়েছিলেন। এ ছাড়া আমার ছোটবেলায় সুর ধরে আওড়াতুম!

কর্নেল ততক্ষণে চিঠিগুলো বের করে ফেলেছেন। তারপর আতশ কাচ দিয়ে খামের স্ট্যাম্পে ডাকঘরের ছাপ পড়ার চেষ্টা করছেন।

রায়মশাই বললেন, ছড়াটা অদ্ভুত। মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। শুনুন বলি।

বলে তিনি সুর ধরে আওড়ালেন :

হিকরি ডিকরি ডক
নকড়ি ছকড়ি ক্লক
ধরোটি বারোটি পাক
বাজিলে চিচিং ফাঁক

কর্নেল এবার চিঠিগুলোতে চোখ বুলিয়ে বললেন, -হ্যাঁ। সব চিঠিতে একই হাতের লেখা ওই ছড়া। হিকরি ডিকরি ডক একটা ইংরেজি পদ্যের লাইন। ছোটবেলায় পড়েছিলুম। ঘড়ির শব্দের অনুকরণ।

রায়মশাই বললেন, -হ্যাঁ। ঠাকুরদা ওই লাইনটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছড়াটার বাকি অংশের অর্থ শোনাবার আর সুযোগ পাননি। হঠাৎ মারা যান।

কর্নেল বললেন, ভুল হতেও পারে। তবে একটা চিঠি কলকাতার জি পি ও-তে পোস্ট করা। দুটো চিঠি দুর্গাপুর থেকে। একটা বর্ধমান আর একটা পানাগড় থেকে।

এইসময় পিনাকীবাবু ট্রে-হাতে ঘরে ঢুকলেন। সেন্টারটেবিলে ট্রে রেখে বললেন, আমি বাজারে যাই রায়মশাই! সায়েবরা তো বাংলোতে উঠেছেন। নাকি দুপুরবেলাটা এখানে।

কর্নেল বললেন, -না পিনাকীবাবু! যখন আসব এ বাড়ি, তখন জানিয়েই আসব এবং খাব।

রায়মশাই পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে পিনাকীবাবুকে দিলেন। তারপর বললেন, – সদুকে বলে যাও পিনাকীদা! পুঁটু হোক, কি রাজু হোক, এই সিঁড়ি দিয়ে যেন না ওঠে। বাইরে থেকে সিঁড়ির দরজা সদুকে আটকে দিতে বলল। পুঁটু এলে হলঘরের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে যেন নিজের ঘরে যায়। আর শোনো! তুমি দেখে যাও বারান্দায় এ ঘরে আসার পার্টিশান ওয়ালের দরজা ভেতর থেকে আটকানো আছে কি না।

পিনাকীবাবু চলে গেলেন। কর্নেল বললেন, -এবার বলুন, বারান্দার ছটা ঘড়ি কীভাবে চুরি গেল?

রায়মশাই বললেন, গত সপ্তাহে শনিবার, আজ হল শুক্রবার, রাত্রে কী করে যে চোর ঢুকল, বুঝতে পারছি না। বাবার আমলে –আপনার মনে পড়বে, সিঁড়ি থেকে তিনটে ঘড়ি চুরি যাওয়ার পর দোতলার বারান্দায় সিলিং পর্যন্ত দেয়াল গাঁথা হয়েছিল, হলঘরের ভেতরকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে কেউ যাতে এই ঘরে না আসতে পারে। মজবুত একটা দরজা অবশ্য বসানো হয়েছিল। ওটা আমি রোজ রাত্রে চেক করে তবে শুই। যে সিঁড়ি দিয়ে আপনারা উঠলেন, সেটাও ভেতর থেকে আটকে দিই। আবার বারান্দায় ঢোকার মুখে সিঁড়ির মাথায় আর একটা দরজা দেখলেন। ওটাও ভেতর থেকে বন্ধ রাখি। এদিকে বারান্দার থামে গ্রিল আছে। তাহলে চোর ঢুকল কোন পথে, এটাই অদ্ভুত!

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, –সেদিন আপনি কত রাতে শুয়েছিলেন?

–রাত সাড়ে দশটায় আমি ঘরের দরজা এঁটে শুয়ে পড়ি।

-ওটায় তো অ্যাটাচড বাথরুম?

-হ্যাঁ। ওটা ঠাকুরদার আমলে তৈরি। কিন্তু আমি বাথরুমের দরজার হ্যাঁচকল টেনে আটকাতে ভুলি না।

–আপনি কি শনিবার সন্ধ্যায় বা তারপর কোনও কারণে নিচে নেমেছিলেন?

রায়মশাই তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, -হ্যাঁ। মনে পড়ে গেল। রাজুকে সৌদামিনী পেটাচ্ছিল। চ্যাঁচামেচি হচ্ছিল খুব। তাই বিরক্ত হয়ে আমি নিচে নেমে গিয়েছিলুম। অবশ্য মিনিট পাঁচেক পরে ফিরেছিলুম।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -অতএব আমার মতে, ওই সুযোগে চোর ঢুকে সম্ভবত আপনার খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল। এটা পাটিগণিতের অঙ্ক রায়মশাই! যেমন কী না ওই হিকরি ডিকরি ডক!

রায়মশাই বলে উঠলেন, -তা সম্ভব। খুবই সম্ভব। কারণ আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুই। কিন্তু আপনি হিকরি ডিকরি ডক ছড়াটাকে পাটিগণিতের অঙ্ক বলছেন কেন?

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, -মনে হচ্ছে কোনও অঙ্কের সূত্র এতে নিশ্চয় লুকোনো আছে। তা না হলে আপনার ঠাকুরদাই বা এটা আপনাদের দুই ভাইকে মুখস্থ করাবেন কেন এবং সেই ছড়ালেখা চিঠিই বা কেউ ডাকে পাঠিয়ে আপনাকে মৃত্যুর ভয় দেখাবে কেন?

– হ্যাঁ। মড়ার খুলি এঁকে পাঠাচ্ছে বলেই আমি সত্যি ভয় পেয়েছি।

আমি কফি খেতে-খেতে ঘড়িগুলো ঘুরে-ঘুরে দেখছিলুম। বললুম, -কোনও ঘড়িতে ঘন্টার সময় হলে খুদে পাখি ঘণ্টিতে ঠোরায় শুনেছি। সেটা কোথায়?

রায়মশাই বললেন, ও ওই যে বেঁটে চ্যাপ্টা ঘড়িটা দেখছেন!

এতক্ষণে ঘড়িটা চোখে পড়ল। দোলকের তলায় একটা সরু দাঁড়ে খুদে পেতলের পাখি বসে আছে। বললুম, -ওটা বাজে?

– হ্যাঁ। একটু পরে দশটা বাজবে। তখন দেখবেন।

–আর একটা ঘড়িতে নাকি সিঁড়ি বেয়ে খুদে সায়েব এসে ঘণ্টি বাজায়?

–সেটাও আছে। ওই দেখুন বড় চৌকো ঘড়িটা। সিঁড়িটায় আলো পড়েনি। তবে ঘণ্টার সময় হলেই টুপিপরা সায়েব হাতুড়ি হাতে নামতে শুরু করলে চোখে পড়বে।

– ঘড়িগুলো সবই কি একসঙ্গে বাজে?

-প্রায় একসঙ্গেই বাজে। এক-আধ সেকেন্ড কোনওটা আগে-পরে বাজে এই যা!

রায়মশাই উঠে গিয়ে আমাকে ছড়ি দিয়ে ঘড়ি দেখাতে শুরু করলেন। আমিও ওঁর কাছে গেলাম। উনি বললেন, -তিনটে বাদে পনেরোটা ঘড়ি এখনও সচল। রাইট টাইম দেয়। ওই। তিনটে আমি বাবার আমলেও বাজতে শুনিনি। তবু ঠাকুরদার স্মৃতি হিসেবে টাঙানো আছে।

বলে তিন দেয়ালে তিনটে ঘড়ি তিনি দেখিয়ে দিলেন।

জিগ্যেস করলুম, -পনেরোটা ঘড়িতে কি রোজ দম দিতে হয়?

রায়মশাই বললেন, -হ্যাঁ। ঠিক সকাল আটটায় দম দিতে শুরু করি। তবে আমি একা পারিনে। হাত ব্যথা হয়ে যায়। পিনাকীদাও দম দেয়। আর মাঝে-মাঝে বছরে অন্তত একবার কারিগর ডেকে এনে অয়েলিং করাতে হয় মাত্র।

কর্নেল বললেন, -কারিগর মানে সেই অঘোরবাবু?

– অঘোরবাবু দুবছর আগে মারা গেছেন। ওঁর ছেলে নরেনও পাকা কারিগর আর বিশ্বাসী। নরেন গত শীতে অয়েলিং করে দিয়ে গেছে। কিন্তু কোনও ঘড়ি গন্ডগোল করেনি এ পর্যন্ত। শুধু ওই তিনটে ঘড়ি অঘোরবাবু বা তার ছেলে সচল করতে পারেননি। তিনটেই নাকি বিগড়ে গেছে।

রায়মশাই ডিভানে এসে বসলেন। আমিও সোফায় বসে পড়লুম। কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপরই ঘড়িগুলো থেকে আশ্চর্য মিঠে সেতারের ঝংকারের মতো শব্দ শোনা গেল এবং পরক্ষণে দশবার নানা সুরে ঘণ্টার বাজনা শুরু হল। সেই বাজনার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। মনে হল, সারা ঘর জুড়ে মনমাতানো অর্কেস্ট্রা বাজছে। আমরা যেন এক মধুর অর্কেস্ট্রার ধ্বনিঝংকারের মধ্যে ভেসে চলেছি। আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলুম।

সেই ঘড়ির পাখি বা আরেকটা ঘড়ির সায়েবকে যে দেখব, সে-কথা মনেই রইল না। বললুম, –অপূর্ব! অসাধারণ! এ যেন জাদুকরের তৈরি এক মায়াজগৎ রায়মশাই!

কর্নেলের মুখে কিন্তু নির্বিকার ভাব লক্ষ করে অবাক হলুম। রায়মশাই বললেন, –বারান্দার ছটা ঘড়ি চুরির জন্য আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। পুলিশ যা করার করুক। কিন্তু ওই চিঠিগুলো।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। হিকরি ডিকরি ডক।

.

আড়িপাতা যন্ত্র আবিষ্কার

ভেবেছিলুম, কর্নেল এবার উঠবেন। তিনি উঠলেন না। মোফায় হেলান দিয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কিছু চিন্তাভাবনার পর বললেন, -এবার আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই রায়মশাই! রায়মশাই বললেন, -করুন!,

– পানাগড়ের ভূতনাথ হাজরা নামে বেঁটে মোটাসোটা ফো কোনও ভদ্রলোককে আপনি চেনেন?

-ভূতনাথ হাজরা? না তো! তবে-

বলুন!

–চেহারার যে বর্ণনা দিলেন, আমার দূর সম্পর্কের ভাগনে স্বপন- মানে পুঁটুর এক কাকার চেহারার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। পুঁটু আমার পিসতুতো বোনের ছেলে। ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। পিসতুতো বোন লতিকার অনুরোধে ওকে নিয়েছি। ইচ্ছা আছে যদি ওর স্বভাব চরিত্র শোধরায়, তাহলে ওকে দত্তক নেব। তো ভদ্রলোকের গায়ের রং শ্যামবর্ণ। পুঁটুর উনি কাকা, মানে- সেও বড় জটিল সম্পর্ক। লতিকার স্বামী ইন্দ্রনাথের ভায়রাভাই কালীনাথ রায়চৌধুরি। গতবছর একদিন পুঁটু ওঁকে বাজারে দেখতে পেয়ে এ বাড়িতে এনেছিল। কালীনাথবাবুর পানাগড়ে কী যেন কারবার আছে। উনি আমাকে ঘড়ি বিক্রির লোভ দেখিয়েছিলেন। এই সব অ্যান্টিক ঘড়ির দাম নাকি দশ-পনেরো হাজার। আমি মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলুম।

-গায়ের রং শ্যামবর্ণ? কপালের ডানদিকে ক্ষতচিহ্ন আছে?

রায়মশাই একটু পরে বললেন, -হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাকে আপনি চেনেন নাকি?

-চিনি। এবার বলুন, গত রবিবার আপনি ঘুম থেকে কখন উঠেছিলেন?

-ছটায়। রোজ ছটায় আমার ঘুম ভাঙে।

-রাত্রেও তো ঘড়িগুলো বাজে। আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না?

রায়মশাই হাসলেন, হয় বলেই তো শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের পরামর্শে ঘুমের বড়ি খেয়ে শুই।

–রবিবার ঘুম ভাঙার পর এই ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, না খোলা ছিল?

– সমস্যা হল, কড়া ঘুমের ওষুধ। তাই ছটায় উঠি বটে, কিন্তু ঘোর কাটে না। তাই মনে পড়ছে না দরজা খোলা ছিল, না বন্ধ ছিল। প্রথমে বাথরুমে ঢুকে তারপর বারান্দায় গিয়ে বসি কিছুক্ষণ। সদু নিচে থেকে চা নিয়ে ডাকে। তখন বারান্দার দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচের দরজা খুলি। চা খাওয়ার পর ঘোরটা কেটে যায়। তো সেদিন সদুই সিঁড়ির দরজা আর বারান্দার দরজা খোলা দেখে উঠে এসেছিল। তারপর তারই চোখে পড়েছিল, বারান্দার দেয়ালের ছটা ঘড়িই নেই।

-হুঁ। চোর আপনার ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কথা জানে। সে পালঙ্কের তলায় লুকিয়ে ছিল।

-কিন্তু অতগুলো ঘড়ি একা সে কী করে নিয়ে গেল বুঝতে পারছি না।

-একা নয়। তার এক বা একাধিক চেলা উঠোনের জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে ছিল হয়তো।

– পুলিশও তা-ই বলেছে। তবে পালঙ্কের তলায় কারও লুকিয়ে থাকার কথা তাদের মাথায় আসেনি। যাইহোক, সদুর ছেলে রাজুকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা করেছিল। তার মুখ দিয়ে কিছু বের করতে পারেনি পুলিশ। শেষে সদুর কান্নাকাটিতে আমিই রাজুকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিলুম। তবে এ কথা ঠিক, রাজু বোকাবুন্ধু গবেট প্রকৃতির ছেলে। নেশা-ভাং করে বলে মায়ের কাছে মার খায়।

–পুঁটুকে পুলিশ কিছু।

রায়মশাই কর্নেলের কথার ওপর বললেন, -থানায় নিয়ে জেরা করে ছেড়ে দিয়েছিল। তার কথায় সন্দেহযোগ্য কিছু পায়নি পুলিশ। এমনকী পিনাকীদাকে আর সদুকেও পুলিশ জেরায় জেরবার করেছিল।

পানাগড়ে আপনার পিসতুতো বোনের নাম-ঠিকানা চাই রায়মশাই! –বলে কর্নেল কিটব্যাগের চেন খুলে খুদে একটা নোটবই বের করলেন। পকেট থেকে কলম টেনে নিলেন।

রায়মশাই বললেন, লতিকা মজুমদার। ওর স্বামীর নাম ইন্দ্রনাথ মজুমদার। ইন্দ্রনাথ ডাক্তারি করে। তার মহামায়া নার্সিং হোম সবাই চেনে। হোমের পেছনেই তার পৈতৃক বড়ি।

কর্নেল নাম-ঠিকানা লিখে বললেন, – ডাঃ মজুমদারের নিশ্চয়ই টেলিফোন আছে?

–আছে। আমার লাইন এস. টি. ডি. নয়। আপনি চাইলে ট্রাংক করতে পারি।

নাহ। –বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন, আপনার টেলিফোন লাইনটা একটু পরীক্ষা করতে চাই।

–করুন। ওই তো টেলিফোন।

-নাহ। প্রথমে টেলিফোন বক্স। তারপর অন্যত্র।

-বক্স নিচের বারান্দায় আছে। একেবারে গেটের কাছাকাছি।

–আপনি বসুন। আমি দেখে আসি। জয়ন্ত! তুমি বরং আমার সঙ্গে এসো। তোমাকে দরকার হতেও পারে।

রায়মশাই বিস্মিত হয়ে বসে রইলেন। কর্নেলের সঙ্গে আমি বেরিয়ে গেলুম। পোর্টিকোর সামনে গাড়িতে ঠেস দিয়ে ইসমাইল এক প্রৌঢ়ার সঙ্গে কথা বলছিল। প্রৌঢ়া কর্নেলকে দেখে করজোড়ে ঝুঁকে প্রণাম করল। বলল, -কত বছর পরে এলেন কর্নেলসায়েব! ভালো ছিলেন তো?

কর্নেল বললেন, –ভানু মারা গেছে শুনে কষ্ট হল সৌদামিনী।

– সবই কপালের লেখন কর্নেলসায়েব! দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খাচ্ছিল-দাচ্ছিল। হঠাৎ রাত্তিরে বুকে ব্যথা উঠল। ডাক্তারবাবু আসতে আসতে শেষ।

– আচ্ছা! পরে কথা হবে। ইসমাইল! একটুখানি দেরি হবে। তাড়া নেই তো তোমার?

ইসমাইল ড্রাইভার বলল, –কী যে বলেন স্যার, মুখার্জিসাবের হুকুম আছে, আপনি যেখানে যাবেন, যত টাইম থাকবেন, আমাকেও হাজির থাকতে হবে। কুছু শোচ করবেন না।

কর্নেল বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে শেষপ্রান্তে গেটের কাছাকাছি টেলিফোন বক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পিঠে কিটব্যাগটি আঁটা। বক্স বন্ধ ছিল। কিন্তু তালা আঁটা ছিল না। বক্স খুলে তিনি খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, -ওভারহেড লাইন। চলো, বাইরে গিয়ে দেখি।

গেটের একটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে তিনি বাড়ির বাইরে দেয়ালে সাঁটা কালো রবারের পাইপ দেখতে-দেখতে থমকে দাঁড়ালেন। বাইনোকুলারে টেলিফোনের তার দেখতে থাকলেন। কালো পাইপ থেকে ফোনের তার বেরিয়ে একটা শালকাঠের খুঁটিতে পৌঁছেছে। খুঁটির পেছনে একটা লম্বাটে গাছ। কর্নেল বললেন, -বাহ! অদ্ভুত কৌশল।

বললুম, -কী ব্যাপার?

–খুঁটির মাথায় তারের মাত্র দু-তিন সেন্টিমিটার জায়গার রবার কেটে কেউ বা কারা আড়িপাতা খুদে টেপ জুড়ে রেখেছে। আড়িপাতা যন্ত্রটা কাঠের খাঁজে এমনভাবে বসানো, সহজে চোখে পড়বে না। এইসব জাপানি খুদে যন্ত্র আজকাল সর্বত্র পাওয়া যায়। যন্ত্রটা দরকারমতো খুলে আনা যায়। তারপর টেপরেকর্ডারে ঢুকিয়ে ফোনের কথাগুলো শোনা যায়।

– তাহলে খুঁটি বেয়ে উঠতে হবে।

– খুঁটিটা আঁকাবাঁকা। খাজও আছে। ওঠা-নামা সহজ কাজ। মনে হচ্ছে রায়মশাই সম্প্রতি অনেক টাকা খরচ করে টেলিফোন লাইন নিয়েছেন।

বলে কর্নেল চারদিক দেখে নিয়ে একটু হাসলেন, -জয়ন্ত! তোমার তো মাউন্টেনিয়ারিংয়ের ট্রেনিং নেওয়া আছে। উঠে গিয়ে সাবধানে ওটা খুলে আনো। যেন মূল তার না ছেড়ে। চিয়ার আপ!

একটু ইতস্তত করে বললুম, –ভেঙে পড়বে না তো?

–আমার ওজনে কী হবে জানি না। তবে এটা শালকাঠ। তোমার ওজনে ওর কিছুই হবে না। অগত্যা বাঁকা অংশ আর খাঁজে পা রেখে সাবধানে উঠে খুদে টেপ যন্ত্রটা খুলে ফেললুম। এটার সঙ্গে জোড়া দেওয়া মিহি তারটুকু মূল তারের সঙ্গে জড়িয়ে দিলুম। তারপর বললুম, -একটু কালো টেপ কেটে সেলোফেন ছাড়িয়ে তারটাতে জড়িয়ে টিপে আটকে দিলুম। এবার নামতে তত অসুবিধে হল না। পায়ে রবারসেলের খাঁজকাটা জুতো। কর্নেলের সঙ্গে পাহাড়জঙ্গলে অভিযানে বেরুলে এই দুতো পরেই আসি।

কর্নেল কালো টেপ এবং আড়িপাতা যন্ত্রটা কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, -চলল! এবার রায়মশাইয়ের কাছে যাই।

গিয়ে দেখি, রায়মশাই সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে উত্তেজনার ছাপ। বললেন, জয়ন্তবাবু শালকাঠের খুঁটিতে উঠেছিলেন দেখছিলুম। কী ব্যাপার?

বারান্দায় উঠে কর্নেল বললেন, -আপনার টেলিফোনের লাইনে আড়িপাতা যন্ত্র আটকানো ছিল।

– কী অদ্ভুত!

ঘরে ঢুকে আমরা সোফায় বসলুম। রায়মশাই আগের মতো মুখোমুখি ডিভানে বসলেন। কর্নেল বললেন, আপনার কি টেপরেকর্ডার আছে?

– না তো! পুঁটুর আছে। রাজুরও একটা আছে। সদু ছেলের বায়না মেটাতে কিনে দিয়েছে।

– এই খুদে টেপ যন্ত্রটা তাহলে সৌদামিনিকে বলে বা পুঁটুর কাছ থেকে টেপরেকর্ডার কোনও ছলে চেয়ে নিয়ে গোপনে বাজাবেন। অন্তত গতকাল সকাল থেকে আজ আমরা আসবার সময় পর্যন্ত টেলিফোনে আপনার এবং অন্য কারও মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছে, সব এতে রেকর্ড করা আছে।

রায়মশাই বাগিং যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বললেন, –এ কাজ কার হতে পারে?

– যে ছড়া লিখে আপনাকে হুমকি দিচ্ছে, তার।

-বুঝলাম। কিন্তু ছড়া লেখার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।

–রায়মশাই! সে ধরেই নিয়েছে, আপনি ওই ছড়ার মর্ম জানেন। তাই যে জিনিসটা ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে, সেটার দাবিতে সম্ভবত এবার শিগগির চিঠি পাবেন। আসলে পাঁচটা চিঠি লিখে সে যাচাই করে নিচ্ছে আপনার কী প্রতিক্রিয়া। এবার আপনি যেহেতু আমাকে ডেকেছেন, তাই সে ওটা দাবি করবেই। অন্তত আমার অঙ্কটা এই। কারণ আপনি যে সেই জিনিসটা বাইরে কোথাও রেখে আসেননি, বা কাকেও বিক্রি করে দেননি, তা সে বিলক্ষণ জানে।

– ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে আছেটা কী?

-সম্ভবত আপনার পূর্বপুরুষের কোনও সম্পদ, যা খুবই দামি।

রায়মশাই মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে বললেন, -আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ঠাকুরদা আমাকে কী বিপদের মধ্যে ফেলে গেছেন!

কর্নেল আস্তে বললেন, -সেই দামি জিনিস আপনার ভাইয়ের কাছেও নেই। এর একটাই অর্থ হয়। জিনিসটা হয়তো এইসব ঘড়ির মধ্যেই লুকানো আছে। কারণ ঠাকুরদার সব ঘড়ি আপনার কাছে।

রায়মশাই মুখ তুলে বললেন, –যদি তা বারান্দার ঘড়িগুলোর মধ্যে লুকোনো থাকে?

-চুরি যাওয়া ঘড়িগুলোর মধ্যে ওটা থাকলে আর আপনার কাছে চিঠি আসবে না।

-তবু যদি আসে?

–তাহলে বুঝবেন, ঘড়ি-চোর অন্য লোক। আর চিঠি লিখছে অন্য লোক।

–কেন? এমন তো হতেই পারে, ওই ছটা ঘড়ি একই নোক চুরি করেছে এবং সেগুলোর মধ্যে জিনিসটা না থাকায় আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখছে!

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, –হ্যাঁ। তা হতেই পারে। তবে আমার ধারণা অঙ্কই বলতে পারেন, ওই আড়িপাতা যন্ত্র বলে দিচ্ছে লোকটা মহা ধূর্ত। পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা দামি জিনিস যে-ঘড়িতে লুকোনো আছে, সেটা আপনি বারান্দায় টাঙিয়ে রাখবেন না, এটা বোঝা তার পক্ষে খুবই সহজ। কারণ আগেই বললুম, সে ধরেই নিয়েছে, ছড়াটার মর্ম আপনি জানেন।

রায়মশাই বললেন, -ঠিক। আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এ ঘরের এতগুলো ঘড়ি কতবার অয়েলিং করানো হয়েছে, কোনওটার মধ্যে তো কিছু পাওয়া যায়নি। এমনকী অচল তিনটে ঘড়ির মধ্যেও কিছু নেই।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, -এবার চলি। আপনার ওপর আপাতত হামলার সম্ভাবনা নেই। আমার পক্ষে বনবাংলোতে থাকা এখন উচিত। কারণ আমি আপনার বাড়িতে থাকলে আমার গতিবিধির ওপর লোকটা নজর রাখতে পারবে। তাই আমি বাইরে থেকেই আপনার জন্য কাজ করে যাব। হা- গোপনে আড়িপাতা যন্ত্রটার মধ্যে থেকে টেপরেকর্ডার বের করে নিয়ে টেপরেকর্ডারে বাজিয়ে শুনবেন। তারপর আমাকে জানাবেন, কী- কী কথা শুনলেন। এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।

বলে কর্নেল বেরুলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।

.

পোড়োখনির বন্দি

বনবাংলোয় ফিরে কর্নেল ইসমাইলকে বললেন, আজ আর গাড়ির দরকার হবে না। তুমি মুখার্জিসায়েবকে বোলো, কাল সকালে আমরা পানাগড় যেতে চাই। যদি অসুবিধে না হয়, তিনি যেন তোমাকে গাড়ি দিয়ে পাঠান।

ইসমাইল বলল, -ফাস্টকেলাস রোড হয়েছে সার! পানাগড় যেতে দো ঘণ্টাভি লাগবে না। আমি মুখার্জিসাবকে জরুর তলব দিচ্ছি।

সে সেলাম ঠুকে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আকাশে টুকরো-টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। তাই মাঝে-মাঝে রোদ মাঝে-মাঝে ছায়া পড়ছে। এগারোটা বাজে। সুখরাম এসে সেলাম দিয়ে জানতে চাইল, কফি লাগবে কি না। কর্নেল বললেন, -না সুখরাম! আর কফি নয়। সাড়ে বারোটা নাগাদ লাঞ্চ খাব।

সে বলল, –আস্নান করলে পানি বাথরুমের চৌবাচ্চায় পাবেন সার! ভরতি করে দিয়েছি।

ঠিক আছে। –বলে কর্নেল বাইনোকুলারে পশ্চিমদিকে পোড়োখনি এলাকা দেখতে থাকলেন।

বললুম, -হঠাৎ ওদিকে কী দেখছেন?

– লাল ঘুঘুর ঝাঁক।

-আপনি একবার বলেছিলেন লাল ঘুঘুর ঝাঁক খুব অলুক্ষণে।

-হ্যাঁ। যতবার যেখানে লাল ঘুঘুর ঝাঁক দেখেছি, ততবার সেখানে

বলে তিনি হঠাৎ থেমে বাইনোকুলার নামালেন। তারপর ঘরে ঢুকে আওড়ালেন :

হিকরি ডিকরি ডক
নকড়ি ছকড়ি ক্লক
ধরোটি বারোটি পাক
বাজিলে চিচিং ফাঁক

বললুম, –আগের দিনের লোকেরা বড্ড হেঁয়ালির জট পাকানো ধাঁধা তৈরি করত।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আজকাল কিছু গোপন রাখতে হলে যেমন কম্পিউটারে ডাটা ফিড করিয়ে কোডনাম্বার রাখা হয়। কোডনাম্বার না জানলে তুমি বুঝতেই পারবে না কী তথ্য লুকোনো আছে।

–আচ্ছা কর্নেল, রায়মশাইয়ের শত্রুপক্ষ কোথাও ওত পেতে নিশ্চয় বাগিং যন্ত্র উদ্ধার দেখে ফেলেছে!

অসম্ভব নয়। –বলে তিনি হাসলেন : তুমিই ওটা ছিঁড়েছ। কাজেই সাবধান! তোমার সিক্স রাউন্ডার রিভলভার সবসময় তৈরি রাখবে।

– কাল রাতের ব্যাপারটা এমন অভাবিত যে তৈরি ছিলুম না!

তৈরি থাকা উচিত ছিল। আমার সামরিক জীবনের শিক্ষা জয়ন্ত! যুদ্ধের মধ্যে পা বাড়ানোর মুহূর্ত থেকে তৈরি থাকতে হয়। তৈরি ছিলুম বলেই বর্ধমান স্টেশনে ভূতনাথ হাজরা ওরফে কালীনাথ রায়চৌধুরির মতলব টের পেয়েছিলুম।

–কাল পানাগড়ে কি তার খোঁজেই যাবেন?

-জানি না কার খোঁজে যাব। তবে রায়মশাইয়ের পিসতুত বোনের সঙ্গে আগে দেখা করব।

কর্নেল সপ্তাহে বড়জোর দুদিন স্নান করেন। শীতকালে তো মাসে মাত্র দুদিন। স্নান না করে ওঁর কোনও অসুবিধে হয় না। সামরিক জীবনের অভ্যাস।

কিন্তু আমি স্নান না করে থাকতে পারি না। বাংলোর পেছনে কুয়ো আছে। টিলার গায়ে কুয়ো শুনে অবাক হয়েছিলুম। কর্নেলের কাছে জানতে পারলুম, ওটা একটা প্রস্রবণ ছিল। কুয়োর মধ্যে তাকে ভরে বাড়তি জল নালা দিয়ে নিচের ঝরনায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

জলটা যেমন স্বচ্ছ, তেমনি ঠান্ডা। আরামে স্নান করলুম। তারপর সাড়ে বারোটায় লাঞ্চ সেরে ঘুমোনোর জন্য বিছানায় বসেছি, কর্নেল বললেন, -আজ ভাতঘুম নয়, জয়ন্ত! আধঘন্টা পরে বেরুব।

– কোথায় বেরুবেন? বৃষ্টি হতে পারে যে-কোনও সময়। বর্ষাতি আনিনি।

-বৃষ্টি নামলে মাথা বাঁচানোর প্রচুর জায়গা পাবে।

-কোথায়?

-পোড়োখনি এলাকায় প্রচুর গুহার মতো জায়গা আছে।

-ওখানে কেন যাবেন?

– আশ্চর্য জয়ন্ত! আমরা কি নিছক বেড়াতে এসেছি? হ্যাঁ আবার বলছি, তৈরি হয়ে থেকো যেন।

আধঘন্টা পরে যখন কর্নেলের সঙ্গে ফুলেফেঁপে-ওঠা ঝরনার তীর দিয়ে হাঁটছিলুম, তখন আকাশ মেঘলা। কিন্তু বৃষ্টির জন্য নয়, খানা-খন্দে ভরা দুর্গম এলাকা আর প্রকাণ্ড সব পাথরের আড়ালে ভূতনাথ হাজরা ওরফে কালীনাথের চেলারা ওত পেতে আছে বলে মুহুর্মুহু গা-ছমছম করছিল। কর্নেল মাঝে-মাঝে কোনও ঢিবিতে উঠে বাইনোকুলারে লক্ষ রাখছিলেন। যেতে-যেতে গুহার মতো একটা করে খনির গহুর চোখে পড়ছিল। অনেক গহ্বরের মুখে পাথর আটকানো। কিছুক্ষণ পরে ঝরনাটাকে একটা প্রকাণ্ড সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখলুম।

ঢিবির ওপর এবং পাথরের ফাঁকে ঝোপঝাড়, কোথাও বা গাছ। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। গত রাত্রে আসার পথে দুটো লোকের হাতে যে চকচকে ধারালো অস্ত্র দেখেছি, তা বারবার মনে পড়ছিল।

একসময় চাপাস্বরে কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম, – আমরা কোথায় যাচ্ছি?

কর্নেল শুধু বললেন, – চুপ।

একটু পরে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে থাকল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে একটা পাথুরে টিবির গুহায় ঢুকে টর্চের আলো জ্বাললেন। ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার ছিল। বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে এই গুহাটা ভালো একটা আশ্রয় বটে, কিন্তু এ যেন এক সুড়ঙ্গ। সামনে বাঁক নিয়ে পাতালে নেমে গেছে। গুঁড়ি মেরে বসে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, -এটা ছিল ডলোমাইটের খনি। খনিমুখ সিল করা ছিল পাথর দিয়ে। বছর পাঁচেক আগে এসে তা দেখেছিলুম। এখন দেখছি কেউ বা কারা পাথরগুলো সরিয়েছে। আরে! এগুলো কী?

বলে তিনি কাছেই টর্চের আলোতে কয়েকটুকরো পুঁটলিপাকানো কাগজ কুড়িয়ে নিলেন। তারপর শুঁকে দেখে একটু হেসে বললেন, -নিষিদ্ধ মাদক হেরোইনের পুরিয়া। কারা এখানে এসে হেরোইন খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে।

বললুম, -সুখরাম বলছিল দুদিন আগে এই এলাকায় পুঁটু আর রাজুকে দেখেছে।

তাহলে তারাই। -বলে কর্নেল টর্চ জ্বেলে গুঁড়ি মেরে কিছুটা এগিয়ে গেলেন।

আমিও টর্চ জ্বেলে তাকে অনুসরণ করলুম। তারপর দেখি, সামনে কুয়োর মতো গহুর। কর্নেল টর্চের আলোয় সেই গহুরটা দেখতে-দেখতে বললেন, –মাত্র ফুট ছ-সাত গভীর। ওই দেখো, তলায় আবার সুড়ঙ্গের মতো পথ। ডলোমাইটের গুঁড়ো পড়ে আছে।

কথাটা বলেই তিনি বাঁদিকে সরে গেলেন এবং আমাকেও ঠেলে সরালেন। চমকে উঠে বললুম, -কী?

– আলো নেভাও!

কর্নেল টর্চ নিভিয়েছিলেন সঙ্গে-সঙ্গে। আমিও নিভিয়েছিলুম। কিন্তু নেভাবার মুহূর্তে যা দেখলুম, আমার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল যেন। রিভলভারটা আগেই বের করে ডান হাতে রেখেছিলুম। ইচ্ছে করছিল ট্রিগার টেনে গুলি করি। একটা প্রকাণ্ড মোটা সাপ গহর থেকে সবে মাথাটা আমাদের ডানদিকে তুলে উঠে আসছিল।

কর্নেল কিছুক্ষণ পরে টর্চের আলো ফেললেন পেছনে, যেদিক থেকে আমরা ঢুকেছি। এবার দেখলুম সাপটা গুহামুখের দিকে চলেছে। কর্নেল বললেন, –পাইথন। বাংলায় বলা হয় ময়াল সাপ। সংস্কৃত ভাষায় একেই বলে অজগর। কারণ এই সাপ অজ অর্থাৎ ছাগলজাতীয় প্রাণী গিলে খায়।

সাপটার লেজের দিকে আলো। তাই গুহা থেকে সোজা বেরিয়ে গেল। চোখে আলো পড়লে নিশ্চয়ই ঘুরে আমাদের গিলতে আসত। বললুম, –কী ভয়ঙ্কর জায়গা! পুঁটু আর রাজু এর পাল্লায় পড়লে কী হতো?

কর্নেল বললেন, পাইথন এমনিতে নিরীহ সাপ। মানুষ ওর খাদ্য নয়। কিন্তু ওর গায়ে পা পড়লে পা জড়িয়ে ধরে হাড় গুঁড়ো করে দেয়। তবে ক্ষুধার্ত হলে মানুষের ঠ্যাং গিলতে দ্বিধা করে না।

বললুম, –তাহলে আমরা জোর করে বেঁচে গেছি!

-নাহ! নির্বিষ সাপ। চোখে কয়েক সেকেন্ডের আলো পড়ার জন্য এই গর্ত থেকে ওঠার মুখে একটু থমকে গিয়েছিল। আলো জ্বেলে রাখলে চোখ ধাঁধিয়ে যেত ওর। একখানে স্থির থাকত। সাপটাকে আমি চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি।

গুহার বাইরে বৃষ্টিটা ততক্ষণে থেমে গিয়েছিল। আমরা বেরিয়ে গিয়ে আবার সাপটাকে দেখতে পেলুম। একটা প্রকাণ্ড পাথরের পাশে ঝোপের ভেতর সাপটা ঢুকে যাচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, –সাপটা এই গুহায় থাকে সম্ভবত। এবেলা হয়তো খরগোশের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। এলাকায় প্রচুর খরগোশ, শেয়াল আর খেকশিয়াল বাস করে।

বলে তিনি আবার হাঁটতে থাকলেন! এবার ধারে ঢিবি। মধ্যিখানে সংকীর্ণ জায়গায় সাবধানে পা ফেলে আমরা এগিয়ে গেলুম।

এঁকেবেঁকে কিছুদূর চলার পর ডাইনে এতক্ষণে ঝরনাটাকে দেখতে পেলাম। একটা শেয়াল ঝরনার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের সাড়া পেয়ে তক্ষুনি উধাও হয়ে গেল। কর্নেল বললেন, শেয়ালটা মাছের আশায় ওত পেতে ছিল। ঝরনায় প্রচুর মাছ আছে।

– শেয়াল মাছ খায়?

কর্নেল হাসলেন, -শেয়াল কী খায় না?

ঝরনা ডাইনে রেখে তিনি বাঁদিকে বটগাছের গুঁড়ির নিচে দুটো লোক দেখেছিলুম। তারা আদিবাসী নয়। কাজেই ব্যাপারটা দেখা দরকার।

বাঁদিকে আবার একটা টিবি আর তার ওপর ঝাকড়া বেঁটে বটগাছ। ঢিবির গায়ে গুহায় মতো সেইরকম গোলাকার সুড়ঙ্গ। বুঝলুম, এটাও কোনও পোড়োখনি। কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে টিবিতে উঠে গেলেন। তারপর বটগাছটার গুঁড়ির নিচে প্রকাণ্ড শেকড়ের পাশে অনেকগুলো সিগারেটের ফিলটারটিপ চোখে পড়ল।

কর্নেল একটা আধপোড়া এবং গুঁড়িতে ঘষে নেভানো সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে আতশ কাচ দিয়ে দেখে বললেন, -সিগারেটটা বিদেশি। ফাইভ ফাইভ ফাইভ। লোকটা শৌখিন।

অমনি মনে পড়ে গেল। বললুম, কর্নেল! ট্রেনে ভূতনাথ হাজরা এই ব্রান্ডের প্যাকেট বের করেছিল।

কর্নেল আবার বাইনোকুলারে চারদিক দেখছিলেন। বললেন, হ্যাঁ। বাইনোকুলারে তাকেই দেখেছিলুম। যাই হোক, এখানে সঙ্গে সেই ছোকরাকে নিয়ে সে বসেছিল কেন, সেটাই কথা। চলল, নিচের খনিমুখে ঢুকে দেখা যাক কিছু সূত্র মেলে নাকি।

হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, বটগাছের অন্য পাশে খানিকটা ছাই। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে আছে। বললুম, -কর্নেল! এখানে ওরা আগুন জ্বেলেছিল!

কর্নেল বললেন, -দেখেছি জয়ন্ত! এসো।

নিচে নেমে খনিমুখের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলুম, এটাও পাথর দিয়ে বন্ধ করা ছিল। কিন্তু কারা প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথরগুলো সরিয়ে ফেলেছে, তা স্পষ্ট। সেই পাথরের ওপর দিয়ে গুঁড়ি মেরে টর্চ জ্বেলে কর্নেল আগে ঢুকলেন। তারপর আমি। ভেতরটা পরিষ্কার। তারপরই কর্নেল বলে উঠলেন, – কী একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এসো তো দেখি।

সুড়ঙ্গটা বেশ লম্বা এবং আঁকাবাঁকা। আমার কানেও ভেসে এল শব্দটা। কতকটা উ আঁ উঁ আঁ এই ধরনের। যেন কোনও প্রাণী গোঙাচ্ছে। দুটো বাঁক ঘুরেই কর্নেল বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ!

টর্চের আলোয় দেখলুম, একটা লোক খালি গায়ে পড়ে আছে উপুড় হয়ে। তার পরনে গেরুয়া একটুকরো খাটো কাপড় কোনওরকমে জড়ানো এবং আন্ডারপ্যান্ট দেখা যাচ্ছে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। পাশেই পড়ে আছে জটাজুট অর্থাৎ পরচুলা। তার হাতের বাঁধন কর্নেল ছুরি দিয়ে কেটে বাকি দড়িগুলো খুলে ফেললেন। তারপর তাকে চিত করে শোয়ালেন। অমনি চমকে উঠে বললুম, –সর্বনাশ! হালদারমশাই যে!

তার মুখে টেপ সাঁটা ছিল। কর্নেল টেপ খুলে ফেলতেই তিনি উঁহু হু হু আর্তনাদ করলেন। সত্যিকার গোঁফের সঙ্গে টেপ আটকানো ছিল। কর্নেল বললেন, –উঠে পড়ুন হালদারমশাই।

হালদারমশাই অতিকষ্টে উঠে বসে বললেন, -স্বপ্ন? না সত্য?

সত্য হালদারমশাই!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার বললেন, -বুঝি না ক্যান যে দুই হালায় আচমকা আমারে বাঁধল? কইলাম, আমি সন্ন্যাসী। আমারে বান্ধো ক্যান? ওহ!

–আপনি বটতলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসেছিলেন, তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে কেন বসেছিলেন?

–সব কমু। আমারে জল খাওয়ান। আর বটের গুঁড়ির ওপর আমার ব্যাগ লুকানো আছে। তাতে আমার জামাপ্যান্ট আছে। চলেন, পোশাক পরব।

জলের বোতল কর্নেলের কিটব্যাগে ছিল! জল খেয়ে অতিকষ্টে হালদারমশাই আমাদের সঙ্গে বেরুলেন। তারপর ঢিবিতে উঠে বটতলায় গিয়ে লম্বা হাত বাড়িয়ে খুঁড়ির ওপরদিক থেকে কিটব্যাগ পেড়ে নিলেন।

জিজ্ঞেস করলুম, –আপনার রিভলভার ছিল। সেটা ব্যবহার করেননি কেন?

হালদারমশাই গেরুয়া কাপড়টুকু ফেলে দিয়ে প্যান্ট-শার্ট পরতে পরতে বললেন, -হাতের কাছে রাখি নাই জয়ন্তবাবু! আমি ভাবি নাই দুই শয়তান আচমকা আমার উপরে হামলা করব। রিভলভার এই শেকড়ের তলায় রাখছিলাম।

কর্নেল ওদিকে মোটা শেকড়ের তলার ফঁক থেকে তার রিভলভারটি বের করে তাকে দিলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, -বড় ক্ষুধা পাইছে।

কর্নেল বললেন, -চলুন! বাংলো পর্যন্ত কষ্ট করে গেলেই খেতে পাবেন।

বললুম, -আপনি সম্ভবত কয়েক ঘন্টা ওই অবস্থায় বন্দি ছিলেন। হাঁটতে পারবেন তো?

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কী যে কন জয়ন্তবাবু! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। বারবার ট্রেনিং লইছি। একটু আস্তে হাঁটব এই যা। পাও দুখান অবশ হইয়া গেছে।

বলে তিনি দুই ঠ্যাং ছুঁড়ে রক্ত চলাচল ঠিক করলেন। তারপর আর্তস্বরে বললেন, –কিন্তু আমার জুতা? জুতা কই গেল?

কর্নেল বললেন, -জুতোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সাবধানে আস্তেসুস্থে চলুন।

.

অজগরের ডেরায় চোরাই মাল

বনবাংলোয় ফিরতে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। সিদ্ধেশ্বর ও সুখরাম হালদারমশাইকে দেখে অবাক হয়েছিল। কর্নেল সিদ্ধেশ্বরকে তাঁর অতিথির জন্য শিগগির কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। ইতিমধ্যে হালদারমশাই স্নান করে কর্নেলের চটি পরে ধাতস্থ হয়েছিলেন। সিদ্ধেশ্বর ফুলকো লুচি আর দুপুরের একটা তরকারি দিয়ে গিয়েছিল। খেতে-খেতে হালদারমশাই তার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে তিনি সেদিন বাড়ি যান। তারপর সেজেগুজে বেরিয়ে হাওড়ায় সাড়ে বারোটার ট্রেন ধরেন। দুর্গাপুর নেমে সন্ধ্যা নাগাদ তিনি বাসে ময়ুরগড় পৌঁছে মা তারা হোটেলে ওঠেন। থানায় গিয়ে নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়েও প্রাইভেট গোয়েন্দা পাত্তা পাননি। পুলিশ সর্বত্র প্রাইভেট গোয়েন্দাদের নাক গলানো পছন্দ করে না। রাত্রে তিনি জমিদারবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফেরেন।

সকালে তিনি জমিদারবাড়ি আসার সময় লক্ষ করেন, দুজন লোক একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একজন যুবকের সঙ্গে কথা বলছে। যুবকটির পরনে ধোপদুরস্ত একেলে পোশাক। লোকদুটো তার হাতে একটা নোটের বান্ডিল গুঁজে দিলে যুবকটি শিস দিয়ে গানের সুর ভাজতে-ভাজতে হালদারমশাইয়ের পাশ দিয়ে ময়ূরগড়ের দিকে চলে যায়। আর সেই লোকদুটি, একজন মধ্যবয়সি বেঁটে গুঁফো এবং অন্যজন জিনস-গেঞ্জি পরা ছোকরা, অসমতল মাঠের দিকে হন্তদন্ত হেঁটে চলে যায়। ব্যাপারটা রহস্যজনক। তাই হালদারমশাই ওদের অনুসরণ করেন।

কিছুক্ষণ পরে তাদের দেখতে পান ওই ঢিবির ওপর বটগাছের তলায়। তখন হালদারমশাই গুঁড়ি ঘিরে পাথর আর ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে ঢিবির তলায় পৌঁছান। তার কানে আসে, ওরা ঘড়ি নিয়ে কথাবার্তা বলছে। কিছুক্ষণ পরে তারা টিবি থেকে নেমে উল্টোদিকে চলে যায়। ঢিবিতে চড়ে হালদারমশাই তাদের আর দেখতে পাননি। তখন তার সন্দেহ হয় ওরাই ঘড়ি চোর আর কাছাকাছি কোথাও ওদের গোপন ডেরা আছে। তাই তিনি চটপট নকল জটাজুট গোঁফদাড়ি পরে যথারীতি সন্ন্যাসী সেজে বটতলায় বসে থাকেন। কিটব্যাগে পোশাক খুলে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। রিভলভার তো পাশে শেকড়ের তলায় ছিল। তিনি বটতলায় শুকনো কিছু পাতা ও কাঠকুটো কুড়িয়ে অনেক কষ্টে আগুন জ্বেলে ধুনি তৈরি করেন। পাতা-কাঠকুটো ভিজে ছিল। অনেক চেষ্টার পর আগুন জ্বলে ওঠে।

সন্ন্যাসীবেশী হালদারমশাই সতর্কভাবে লক্ষ রেখেছিলেন চারদিকে। অথচ কীভাবে যে লোকদুটো চুপিসাড়ে কখন ঢিবিতে উঠেছে, তিনি দেখতে পাননি। আসলে তখন বৃষ্টি পড়ছিল। তাই তিনি মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সুযোগে আচমকা তারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কাবু করে ফেলে। দড়ি দিয়ে বেঁধে তার মুখে টেপ সেঁটে তারা তাকে ধরাধরি করে নামিয়ে নিয়ে গুহার ভেতর উপুড় করে ফেলে রাখে। মধ্যবয়সি লোকটা বলে, –ব্যাটা টিকটিকি! তোমাকে দেখেই টের পেয়েছিলুম কে তুমি। এই বটতলায় কস্মিনকালে সাধুসন্ন্যাসী দেখিনি। এটা পোড় খনি এলাকা। এখানে সাধুবাবা আসবেন কেন? থাকো তুমি। এবার অজগর সাপ এসে তোমাকে গিলে খাক।

ছোকরাটি যাওয়ার সময় বলছিল, বাবু! অতগুলো ঘড়ি বয়ে নিয়ে যাবেন কী করে? কাল্প-গুল্লুকে খবর দিন। আমরা চারজনে একে-একে ভাগাভাগি করে নিয়ে যাব। আপনার গাড়িতে তুলব সন্ধ্যাবেলা।

ফো বলছিল, -কাল্লু-গুল্লু ভিতুর ভিতু! ওরা বলেছে, আর আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। গতরাতে তারা নাকি গুলি খেতে-খেতে বেঁচে গেছে।

-তাহলে এক কাজ করুন। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ গাড়িটা যতটা সম্ভব কাছাকাছি এনে রাখুন। আমরা দুজনে কিছু কিছু করে বয়ে নিয়ে যাব।

–ঠিক বলেছ ছোট্টু। ওখানে আবার ওরা দুজনে লুকিয়ে নেশা করতে আসে। ওরা সন্ধ্যার আগেই চলে যাবে। তখন আর অসুবিধে নেই।

এই অভিজ্ঞতার কথা বলে গোয়েন্দাপ্রবর হঠাৎ নড়ে বসলেন, -হঃ! জুতার কথা মনে পড়ছে। জুতাজোড়া ঝোপের মইধ্যে লুকাইয়া রাখছিলাম।

কর্নেল চুরুট টানতে টানতে মন দিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, -তাহলে আমাদের সন্ধ্যা ছটায় বেরুতে হবে। বৃষ্টি-বাদলা যা-ই হোক রায়মশাইয়ের চুরি যাওয়া অ্যান্টিক ঘড়িগুলো কোথায় লুকানো আছে বুঝতে পেরেছি।

বললুম, -পুলিশকে খবর দিলে ভালো হতো না?

সময় নেই। -বলে কর্নেল বারান্দায় গিয়ে আকাশ দেখলেন। তারপর বাইনোকুলারে পোড়োখনির এলাকা দেখতে থাকলেন।

তারপর ঘরে ঢুকে বললেন, -বরং চোরের ওপর বাটপাড়ি করা যাক। হালদারমশাই! আপনি বরং বিশ্রাম করুন। আমরা এখনই বেরুচ্ছি।

-গোয়েন্দাপ্রবর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন, -আমিও যামু। জুতা! আমার জুতাজোড়া!

–পারবেন তো হাঁটতে?

–কর্নেলস্যার কী যে কন! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশ লাইফের এক্সপিরিয়েন্স!

সুখরামকে ঘরে তালা এঁটে রাখতে বলে কর্নেল বেরুলেন। তার পেছনে উত্তেজিত হালদারমশাই এবং তার পেছনে আমি। আগে যে পথে গিয়েছিলুম, সেই পথে হেঁটে চললুম আমরা।

আধঘন্টা পরে কর্নেল যেখানে থমকে দাঁড়ালেন, সেখানে বৃষ্টির জন্য মাথা বাঁচাতে আমরা গুহা অর্থাৎ পোড়োখনিমুখে ঢুকেছিলুম। সাপটার কথা মনে পড়ে গা-ছমছম করছিল। কিন্তু কর্নেল চারদিক বাইনোকুলারে দেখে নিয়ে গুহার ভেতর টর্চ জ্বেলে ঢুকলেন। তারপর আস্তে বললেন, -যে গর্ত থেকে সাপটা উঠেছিল, সম্ভবত সেই গর্তে ঘড়িগুলো আছে।

তিনি টর্চ জ্বেলে সেই প্রকাণ্ড গর্তের ভেতর আলো ফেললেন এবং লাফ দিয়ে নামলেন। গর্তটা যে ছফুটের বেশি নয় তা কর্নেলের মাথার মাপে বোঝা গেল। তিনি বললেন, -বস্তায় ভরা আছে। এই বস্তাটাকে জড়িয়ে সম্ভবত সাপটা শুয়ে ছিল। এটাই সাপটার ডেরা। হালদারমশাই! জয়ন্ত! আমি বস্তাটা তুলে ধরছি। আপনারা নিঃশব্দে টেনে নেবেন। তারপর জয়ন্ত তুমি গুহার বাইরে গিয়ে লক্ষ রাখবে।

তিনি দু-হাতে ঘড়ি বোঝই বস্তাটা তুলে ধরলেন। ছটা ঘড়ি বেশ ওজনদার। বস্তাটা ওপরে তোলার পর আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। রিভলভার হাতে নিয়ে লক্ষ রাখলুম।

একটু পরে দেখি, হালদারমশাই কুঁজো হয়ে বস্তাটা কাঁধ থেকে পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসছেন।

ফেরার পথে তিনি বস্তাটা কর্নেল বা আমাকে বইতে দিলেন না। প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টরের পেটাই ট্রেনিংপ্রাপ্ত শরীর। পথে শুধু বার দুই কাধবদল করলেন এই যা।

বাংলোয় ফিরে দেখি, সুখরাম অবাকচোখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। বাংলোর গেটে উঠতে কিন্তু হালদারমশাই এবার হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। বললেন, -খালি টিকটিক কড়া-কড়া শব্দ হয় ক্যান?

বস্তাটা সুখরাম এসে তার কাছ থেকে নিয়ে বলল, -ইয়ে কৌন চিজ আছে কর্নেলসাব?

কর্নেল বললেন, -কাউকে যেন বোলো না সুখরাম। তোমার চাকরি চলে যাবে। এ হল জমিদারবাড়ির চোরাই ঘড়ি। গর্তে লুকিয়ে রেখেছিল চোর!

হায় রামজি! –বলে সুখরাম কপালে করাঘাত করল।

-তুমি সিদ্ধেশ্বরকে বলল, তিনকাপ কফি চাই।

–জি কর্নেলসাব!

কর্নেল ঘরের মেঝেয় বস্তার মুখ খুলে একটা করে নানা সাইজের ঘড়ি বের করলেন। ছটা ঘড়ি বের করে বললেন, -হালদারমশাই বলছিলেন, টিকটিক কড়া-কড়া শব্দ হচ্ছে কেন? সেকালের দক্ষ কারিগরের হাতে তৈরি সব বিদেশি ঘড়ি। ঝাঁকুনি খেয়ে কোনও-কোনওটা চালু হয়ে গিয়েছিল। দম ফুরিয়ে গেছে। তবু এত সূক্ষ্ম এগুলোর যন্ত্রপাতি যে নড়াচড়া করলেই কিছুক্ষণ চালু থাকে।

সিদ্ধেশ্বর কফির ট্রে এনে ঘড়িগুলি দেখেই মাতৃভাষায় বলে উঠল, –হা জগড়নাথঃ!

কর্নেল বললেন, -সিদ্ধেশ্বর! তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।

উত্তেজিত সিদ্ধেশ্বর বলল, –বলুন সার!

–তুমি এখনই সাইকেলে চেপে থানায় যাও। আমার এই কার্ডটা ও. সি. বা কোনও অফিসারকে দেখিয়ে শুধু বলবে, ইনি জমিদারবাড়ির হারানো ঘড়ি উদ্ধার করেছেন। আপনারা এখনই আসুন। আর বলবে, ওঁরা যেন টেলিফোনে কথাটা রায়মশাইকে অবশ্যই জানিয়ে দিয়ে এখানে চলে আসেন।

সিদ্ধেশ্বর তখনই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল সহাস্যে বললেন, -ঘড়িগুলো উদ্ধারে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব আমাদের প্রিয় হালদারমশাইয়ের।

গোয়েন্দাপ্রবর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, -কিন্তু আমার জুতা? ঘড়ি জুতার কথা ভুলাইয়া দিল।

–জুতো কাল সকালে গিয়ে উদ্ধার করবেন।

–কিন্তু যারে টাকা দিতে দেখছি, সেই ছ্যামড়াটা কে?

কর্নেল হাসলেন, -তাকে যথাসময়ে দেখতে পাবেন।

বললুম, -ভুতনাথ কেন এতদিন পরে টাকা দিল তাকে?

–সম্ভবত কিস্তিতে দিচ্ছে। তবে যথাসময়ে এসব কথা জানা যাবে।

–আচ্ছা কর্নেল, ওই যুবকটি পুঁটু নয় তো?

–আবার কে হতে পারে? সঙ্গে বোধ করি রাজও আছে। দুজনেই হেরোইন খায়।

বললুম, –ঠিক বলেছেন। সুখরাম দুজনকে ওই এলাকায় দেখেছিল।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, -কিন্তু হিকরি ডিকরি ডক এবার দেখছি আমাকে গণ্ডগোলে ফেলে দিল।

-কেন বলুন তো?

–তখন রায়মশাইকে বলছিলুম, ঘড়ি চোর আর এই ছড়া লিখে পাঠানো লোক, যে টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়েছিল, তারা আলাদা। এখন দেখছি, সেই ভূতনাথ অর্থাৎ পানাগড়ের ব্যবসায়ী কালীনাথ চোরাই ঘড়ি কিনেছে এবং সে-ই কিনা আমাকে ময়ূরগড়ে আসতে দু-দুবার বাধা দিয়েছিল। তার মানে সে জানত আমি ময়ূরগড়ে আসছি। এ-ও জানত, আমি কে। অতএব আড়িপাতা যন্ত্রে সে রায়মশাইয়ের আমাকে ট্রাংকল করা শুনেছিল। শোনার পরই কলকাতা ছুটে গিয়েছিল। তা-ই মনে হয় না?

-হ্যাঁ। কলকাতা থেকে সে তার চেলাকে নিয়ে আমাদের ফলো করেছিল, এটা তো স্পষ্ট।

কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানতে থাকলেন। বুঝলুম, রহস্যভেদী রহস্যের সুড়ঙ্গে ঢুকে অন্ধকারে পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। একটু পরে তিনি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, -নাহ জয়ন্ত! আমার থিয়োরি ঠিক। ছড়া লিখে যে হুমকি দিচ্ছে, সে দ্বিতীয় লোক। ভূতনাথ ওরফে কালীনাথের অগোচরে সে তাকে কাজে লাগিয়েছে। কালীনাথ- আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তার টোপ গিলেছে। অ্যান্টিক ঘড়ি বেচে সে প্রচুর টাকা কামাবে। কিন্তু কালীনাথ ছড়া-রহস্য জানে না।

হালদারমশাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটিপ নস্যি নিলেন। নস্যির কৌটো তার ব্যাগে ছিল। উত্তেজনায় তার গোঁফ তিরতির করে কাঁপছিল।

থানা থেকে পুলিশের জিপ এসে ঢুকল, তখন প্রায় সাতটা বাজে। একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে কর্নেলকে সহাস্যে নমস্কার করে বললেন, নমস্কার স্যার! আমি ও. সি. দীপক ভদ্র। কাল রাত্রেই বর্ধমান থেকে এই রেঞ্জের ডি. আই. জি. মিঃ অরবিন্দ বোস আপনার আগমনের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। আমার বড় সৌভাগ্য, এতদিনে আপনাকে চর্মচক্ষে দর্শন করলুম।

কর্নেল বললেন, একটু দেরি হয়ে গেছে। তবু যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, ঘড়ি-চোরদের ধরা যাবে। সাড়ে সাতটা নাগাদ ওদের গাড়ি আসবে ওই খনি এলাকার কাছাকাছি। এই ঘড়িগুলো নিয়ে যেতেই তারা আসবে। কাজেই কোনও গাড়ি ওই এলাকায় দেখলেই।

কর্নেলের কথার ওপর দীপক ভদ্র বললেন, -নো প্রবলেম স্যার! আমার কাছে সেলুলার ফোন আছে। এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার অপরাধ দমনের জন্য সরকার আমাদের আধুনিক সরঞ্জাম দিয়েছেন। আমি আমার উপযুক্ত সহকর্মীকে এখনই জানিয়ে দিচ্ছি।

ও. সি. বারান্দার একপ্রান্তে গিয়ে পকেট থেকে সেলুলার ফোন বের করে তার খুদে অ্যান্টেনা টানলেন এবং বোম টিপে চাপাস্বরে কাউকে কিছু নির্দেশ দিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে ঘড়িগুলো দেখে বললেন, -এ যে লক্ষ-লক্ষ টাকার ঘড়ি কর্নেলসায়েব! এ সব অ্যান্টিক ঘড়ি চোরাপথে বিদেশে চালান যায়। কী করে এগুলো উদ্ধার করলেন?

কর্নেল বললেন, আমি উদ্ধার করলেও এগুলোর খোঁজ পেয়েছিলুম এই ভদ্রলোকের কাছে। ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে, কে, হালদার। আমাদের প্রিয় হালদারমশাই।

হালদারমশাই সুযোগ পেয়ে ক্ষোভে বললেন, -থানায় প্রথমে গিয়েছিলাম। আপনারা আমারে পাত্তা দ্যান নাই।

ও. সি. দীপক রুদ্র জিভ কেটে সহাস্যে বললেন, -ভেরি সরি মিঃ হালদার! আসলে আমাদের কাজে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের ঢুকতে দেওয়ার রিস্ক আছে। কে কোন ছলে ঢোকে। যাই হোক, আমি এজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

হালদারমশাই তখন খুশি হয়ে বললেন, -মশয়! চৌতিরিশ বৎসর আমি পুলিশে চাকরি করছি। ইন্সপেক্টর হইয়া রিটায়ার করছিলাম। তো এখনও শরীর ফিট আছে। তাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলোম।

দীপক ভদ্র বললেন, কী কাণ্ড! সব কথা আপনার খুলে বলা উচিত ছিল।

কর্নেল হাসলেন, -ঘড়ি উদ্ধার কাহিনি আগে শুনুন দীপকবাবু! তাহলে বুঝবেন হালদারমশাই কী সাংঘাতিক অবস্থায় পড়েছিলেন।

বলে তিনি হালদারমশাইয়ের সব ঘটনা ও. সি.-কে শোনালেন। এই সময় তার সেলুলার ফোন বিবি শব্দ করতে থাকল। তিনি দ্রুত অ্যান্টেনা টেনে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন, -ওকে শ্যামলবাবু! ওয়েলডান!… দুজন? …ও! বুঝেছি, এ সেই কুখ্যাতমস্তান ছোকরা ছোটু… গাড়ি আটক করে থানায় নিয়ে যান। … পানাগড়ের ব্যবসায়ীটিকে জেরা করা দরকার। এই এলাকা থেকে অনেক অ্যান্টিক মূর্তি চুরির কেস আছে। বোধ করি, ইনিই তিনি। … হ্যাঁ। আমি ঘড়িগুলো নিয়ে এখনই বেরুচ্ছি। ওভার।

.

গ্রিক দেবতা কিউপিড

এ রাতে হালদারমশাইকে সুখরাম পাশের ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। খাওয়ার পর কর্নেল তাকে জোর করে শুতে পাঠালেন। বললেন, -আপনার ঘুম দরকার হালদারমশাই! তাহলে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারবেন। অবশ্য আর আপনার তত চিন্তাভাবনার দরকার নেই। শুধু প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করবেন। মূল রহস্য এখনও ফাঁস করা যায়নি, তা তো বললুম আপনাকে। হা- দরজা বন্ধ করতে ভুলবেন না যেন।

রাত সওয়া দশটা বাজে। আজ রাতেও ঝমঝমিয়ে এতক্ষণে বৃষ্টি নামল। কর্নেল চেয়ারে বসে মুখে জ্বলন্ত চুরুটসহ বললেন, -কী অদ্ভুত ধাঁধা! জয়ন্ত, তুমিও জট ছাড়ানোর চেষ্টা করো!

হিকরি ডিকরি ডক
নকড়ি ছকড়ি ক্লক
ধরোটি বারোটি পাক
বাজিলে চিচিং ফাঁক

বললুম, –এ হিং টিং ছট বোঝার চেষ্টা আমি করব না। আপনিই করুন। তো কাল সকালে কি পানাগড় যাবেন?

–নাহ। আর যাওয়ার দরকার দেখছি না। কালীনাথের ব্যাকগ্রাউন্ড-পুলিশের কাছে পাওয়া যাবে।

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে দরজা এঁটে দিলেন। তারপর বাথরুমে ঢুকলেন। পোশাক বদলে রাতের পোশাক পরে তিনি টেবিলের সামনে বসলেন। টেবিলল্যাম্প জ্বেলে সেই চিঠিগুলো কিটব্যাগ থেকে বের করে বললেন, –জয়ন্ত! তুমি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি এগারোটায় সোব। তার আগে আমার ঘুম আসে না তা তো জানো!

সকাল সাতটায় সুখরাম বেড-টি এনে আমাকে ডাকছিল। উঠে বসে দেখলুম, বাইরে রোদ ঝলমল করছে। কর্নেল অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। সুখরাম মুচকি হেসে বলল, -সিধুদাদা এখনই বাজারমে চলিয়ে গেল। কাহে কী, পুলিশ কোন-কোন আদমিকে পাকড়াল, খবর লিবে।

– তোমার কী মনে হয় সুখরাম?

–সার! সব চোরি-ডাকাতিকি পিছে বাড়ির কোই-না কোই আদমি থাকে। ওহি পুঁটুবাবু, হারামি লড়কা রাজু দোনো পাকাড় যাবে। পুলিশ তাদের ছাড়বে না, দেখে লিবেন।

আটটায় ইসমাইল গাড়ি আনল। তখন হালদারমশাইয়ের কথা মনে পড়ল। পাশের ঘরের দরজায় তালা আঁটা। সুখরামকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, -উনহিভি কর্নেলসাবের সঙ্গেতে চলিয়ে গেছেন।

ইসমাইল পোর্টিকোর তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হুমড়ি খেয়ে গাড়ির তলায় কিছু দেখছিল। এবার সে উঠে দাঁড়াল। আমাকে সেলাম দিয়ে বলল, –দেরি হইয়ে গেল সার! গাড়ির সাইলেন্সর পাইপ টুটে আওয়াজ হচ্ছিল। গ্যারিজে ঝালাই করিয়ে আনতে হল। কর্নেলসাবকে দেখছি না?

বললুম, পানাগড় যাচ্ছেন না উনি। তাই বেড়াতে বেরিয়েছেন।

ইসমাইল খৈনি বের করে ডলতে-ডলতে বাংলোর পেছনে সুখরামের সঙ্গে গল্প করতে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, সিদ্ধেশ্বর বাজার করে ফিরছে। টিলার চড়াইটুকু তাকে নেমে সাইকেল ঠেলে আনতে হচ্ছে।

লনে ঢুকে সে একগাল হেসে বলল, রায়মশাই ঘরে চোর পুষছিলেন। তাঁর আদরের পুঁটুবাবু আর রাজুকে পুলিশ শেষরাত্রে ধরে নিয়ে গেছে। কর্নেল সায়েব আর হালদারসায়েবের সঙ্গে পথে দেখা হল। কর্নেলসায়েব দুটো অর্কিডের চারা পেয়েছেন। বললেন, ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করে বেরুবেন আবার।

আরও আধঘন্টা পরে দেখলুম দুই রহস্যভেদী কথা বলতে-বলতে ফিরে আসছেন। কর্নেলের হাতে প্লাস্টিকের থলেয় ভরা মাটিসুদ্ধ অর্কিডের চারা। আর হালদারমশাইয়ের হাতে কর্নেলের চপ্পল। তার পায়ে এখন নিজের জুতো। বুঝুলুম, জুতো উদ্ধারের জন্যই গোয়েন্দামশাই কর্নেলের সঙ্গী হয়েছিলেন।

লনে এসে হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, –জুতা ভেজে নাই। ঝোপের মধ্যিখানে পাতা চাপাইয়া রাখছিলাম।

বললুম, -কর্নেল! পুঁটু আর রাজুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। সিদ্ধেশ্বর বলল।

কর্নেল বললেন, -রায়মশাই মনে কষ্ট পাবেন। তাকে সান্ত্বনা দিতে ব্রেকফাস্ট করেই বেরুব।

ব্রেকফাস্ট করে আমরা তিনজনে বেরোলুম। ইসমাইল কর্নেলের নির্দেশে জমিদারবাড়ির দিকে গাড়ি ছোটাল। কালকের মতোই হর্ন শুনে সেই পিনাকীবাবু গেট খুলে দিলেন। তিনি গম্ভীরমুখে বলতে-বলতে এলেন, -পুঁটুবাবু আর রাজুকে পুলিশ শেষরাতে ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে ছোট রায়মশাই এই মাত্র দুর্গাপুর থেকে এলেন। সদু দুই ভায়ের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছিল। কাঁদলে কী হবে? ওই ছেলের জন্য ওর কপালে কত ভোগান্তি আছে।

পোর্টিকোর তলায় একটা জিপসি মারুতি দেখতে পেলুম। ইসমাইল একটু তফাতে গাড়ি দাঁড় করাল। পিনাকীবাবু চেঁচিয়ে বললেন, -ওগো মনো! ও রায়বাবু! কর্নেলসায়েবরা এসেছেন।

রায়মশাই নিচের সিঁড়ির দরজা আটকে রেখে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। নেমে এসে গম্ভীরমুখে বললেন, -আসুন! দরজা খোলা থাক।

দোতলার বারান্দায় উঠে তিনি বললেন, -কিছুক্ষণ আগে দুর্গাপুর থেকে সুরঞ্জন এসেছে। এবার তাকেও ছড়াটা লিখে কেউ হুমকি দিচ্ছে। একই হাতের লেখা।

কর্নেল বারান্দাতেই তার সঙ্গে হালদারমশাইয়ের আলাপ করিয়ে দিলেন। ঘরের ভেতর সোফায় চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরবয়সি এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। তার চেহারার সঙ্গে মনোরঞ্জনবাবু অর্থাৎ রায়মশাইয়ের তত মিল নেই। রায়মশাই তার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, -সুখরঞ্জন। চিঠিটা কর্নেলসায়েবকে দেখাও।

সুরঞ্জনবাবু বুকপকেট থেকে খামে ভরা চিঠি বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল চিঠিতে চোখ বুলিয়ে বললেন, -হ্যাঁ। একই হস্তাক্ষর। যাই হোক রায়মশাই! তাহলে দেখা যাচ্ছে শনিবার সন্ধ্যায় পুঁটুবাবুই আপনার খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলেন। তিনি ভালোই জানেন, আপনি ঘুমের ওষুধ খান। রায়মশাই বললেন, -পুঁটুকে আমি আর এ বাড়ি ঢুকতে দেব না। সদুকে বলে দিয়েছি, যতই কান্নাকাটি করো, তোমার ছেলেকে এ বাড়ি ঢুকতে দেব না। তাতে তুমি চলে যাও তো যাও।

হঠাৎ কর্নেল বলে উঠলেন, –আচ্ছা সুরঞ্জনবাবু, পৈতৃক সম্পত্তিতে তো আপনারও অধিকার আছে। আপনি ঘড়ির ভাগ কেন নেননি?

সুরঞ্জনবাবু হঠাৎ এই প্রশ্নে যেন হকচকিয়ে উঠেছিলেন। আস্তে বললেন, -আমি ঘড়ি নিয়ে কী করব? আমি নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।

-রায়মশাই বললেন, তাহলে খুলে বলি। সুরঞ্জনকে ঘড়ি আমি দিইনি। তার বদলে আমার নিজের লাগানো এক একর জমির শালগাছ বিক্রি করে দেড়লাখ টাকা ওকে দিয়েছিলাম।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, আহ দাদা! এসব পারিবারিক কথা কেন তুমি

রায়মশাই উত্তেজিতভাবে বললেন, –কেন বলব না? তুমি যখন-তখন এসে পূর্বপুরুষের লুকোনো কী মাথামুন্ডু সম্পদ দাবি করবে, যা কোথায় আছে আমি আজও জানি না।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, -বাইরের লোকের সঙ্গে এসব আলোচনা আমি পছন্দ করি না।

-এটা আর ঘরের ব্যাপার হয়ে নেই সুরঞ্জন! কে আমাকে এবং তোমাকেও হুমকি দিয়ে চিঠি লিখছে। একখানা চিঠি পেয়েই তুমি মাথাখারাপ করে দৌড়ে এসেছ। আর আমি পেয়েছি পাঁচখানা চিঠি।

কর্নেল বললেন, –আচ্ছা রায়মশাই, একটা কথা জিগ্যেস করি। ধরা যাক, সত্যিই এ বাড়িতে কোথাও আপনাদের পূর্বপুরুষের মূল্যবান সম্পদ লোকানো আছে। তার অংশ তো সুরঞ্জনবাবুরও প্রাপ!

রায়মশাই আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, -সুরঞ্জনকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমি যা দিয়েছি, তা অনেক। আমার সম্বল বলতে শুধু এই বাড়ি আর স্বোপার্জিত টাকা ব্যাঙ্কে রেখে মাসিক হাজার তিনেক টাকা সুদ। এ বাজারে কষ্টেসিষ্টে চালাতে হয়। তাছাড়া পুঁটুকে আমি তাড়িয়ে দেব। আমার মৃত্যুর পর তো সুরঞ্জনই সব পাবে।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, এটা কিন্তু ঠিক বললে না দাদা! আমার কানে এসেছে, তুমি তোমার সব সম্পত্তি একটা আশ্রমের নামে উইল করে রেখেছে।

-সেই উইল বাতিল করা বা না করা নির্ভর করছে তোমার আচরণের ওপর। বারবার এসে তুমি আমাকে উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছ।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রায়মশাই গিয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন, –কে?…হা! কর্নেলসায়েব এখানে আছেন। …হ্যাঁ, ধরুন। দিচ্ছি।

কর্নেল বললেন, -কে থানার ও.সি.।

কর্নেল ফোনে শুধু অনবরত হা, হঁ বলে গেলেন। তারপর টেলিফোন রেখে আগের জায়গায় বসলেন।

সুরঞ্জনবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, -আমি উঠছি। যদি আমার বরাতে খারাপ কিছু ঘটে যায়, তুমিই কিন্তু দায়ী হবে দাদা!

কর্নেল বললেন, -প্লিজ একটু বসুন সুরঞ্জনবাবু! আমার কয়েকটা কথা আছে।

-কী বিষয়ে?

–আপনি কীসের ব্যবসা করেন?

ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামের। মডার্ন সবরকম গ্যাজেট–কম্পিউটারও বিক্রি করি। —

পানাগড়ে কি আপনার কোনও ব্রাঞ্চ আছে?,

–আছে। বর্ধমানেও আছে।

–আপনি ভূতনাথ হাজরা নামে কাউকে চেনেন?

সুরঞ্জনবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, -নাহ। কেন?

–আসার পথে ওই নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারও

বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন, -যাকগে! আপনার কেন ধারণা যে ঠাকুরদার শেখানো ছড়ার মধ্যে কোনও গোপন সম্পদের সূত্র আছে?

–থাকতে বাধ্য। ছোটোবেলায় বুঝিনি। এখন বুঝতে পেরেছি।

–ছড়াটা আপনার মুখস্থ তো?

–আলবাত মুখস্থ।

–বলুন তো, শোনা যাক।

সুরঞ্জনবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, আপনি দাদার বন্ধু। রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার। আপনাকে আমি বছর পাঁচেক আগে এ বাড়িতে আসতে দেখেছিলুম। আপনার পরিচয় আমি ভালোই জানি। আপনার উদ্দেশ্য কী আগে বলুন তো?

–ছড়ার কথাগুলো আপনার দাদার মুখে শুনেছি। আপনার মুখেও শুনতে চাই। কারণ আমার যেন ধারণা, ছড়াটা উচ্চারণের মধ্যে যে মূল ছন্দ আছে, তা সঠিক উচ্চারিত হলে সম্ভবত ধাঁধাটার সুত্র মিলতে পারে।

সুরঞ্জনবাবু আওড়ালেন :

হিকরি ডিকরি ডক
নকড়ি ছকড়ি ক্লক
ধরোটি বারোটি পাক
বাজিলে চিচিং ফাঁক

কর্নেল বললেন, -নাহ। একই ছন্দ।

এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। রায়মশাই বারান্দায় গেলেন। তার একটু পরে ও.সি. দীপক ভদ্র, আর একজন পুলিশ অফিসার এবং দুজন তাগড়াই চেহারার কনস্টেবলকে বারান্দায় দেখা গেল। রায়মশাই বললেন, -কী ব্যাপার দীপকবাবু?

–আপনার অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে চাই।

–কেন বলুন তো?

কারণ আছে। কর্তব্যে বাধা দেবেন না প্লিজ!-ও.সি. দীপক ভদ্র ঘরে ঢুকে সোজা সুরঞ্জনবাবুর কাছে গিয়ে বললেন : আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন সুরঞ্জনবাবু।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, -তার মানে? কোথায় যাব আমি?

থানায়। সুরঞ্জনবাবু! নিজের দাদার বিরুদ্ধে পানাগড়ে আপনার ব্রাঞ্চ অফিসের ম্যানেজার কালীনাথ রায়চৌধুরির সঙ্গে গোপন চক্রান্ত এবং ঘড়ি চুরিতে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য আপনাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হলুম। আসুন।

রায়মশাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুরঞ্জনবাবু মুখ নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, –নিচে আমার গাড়ি আছে।

দীপকবাবু বললেন, –গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের লোক আছে। আপনার গাড়িও আমাদের আটক করতে হচ্ছে। কারণ আপনার মারুতির ডিকিতে নিষিদ্ধ মাদক আছে। সে খবর আমাদের সোর্স থেকে অলরেডি জেনে গেছি।

কর্নেল বললেন, -পুঁটুবাবু আর রাজুকে সুরঞ্জনবাবুই হেরোইন জোগাতেন!

ও.সি. হাসলেন, -ঠিক ধরেছেন। পুঁটুবাবু আর রাজু এবার পিটুনি খেয়ে সব কবুল করেছে। গত সপ্তাহে ঘড়িচুরির ব্যাপারে ওদের জেরা করলেও রায়মশাইয়ের খাতিরে পিটুনি দেওয়া হয়নি।

সুরঞ্জনবাবুর কাঁধে হাত রেখে দীপক ভদ্র বেরিয়ে গেলেন। রায়মশাই দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নাজড়ানো গলায় বলে উঠলেন, -সুরঞ্জন! তোর মনে এই ছিল? তুই এত লোভী?

কর্নেল বললেন, রায়মশাই! শান্ত হয়ে বসুন! হালদারমশাই! আপনি নিচের সিঁড়ির দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে আসুন।

হালদারমশাই ঝটপট বেরিয়ে গেলেন এবং দু-মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।

কর্নেল বললেন, -কাল সকালে যখন আপনার ঘরে এলুম, তখন ফ্যানের হাওয়ায় এই পোস্টকার্ডটা এই টেবিল থেকে আমার পায়ের কাছে উড়ে এসে পড়েছিল।

তিনি বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা একটা পোস্টকার্ড বের করলেন, এটা আপনার ছোটোভাই সুরঞ্জনবাবুর লেখা।

রায়মশাই রুমালে চোখ মুছে বললেন, আপনাকে খুলে বলা উচিত। সুরঞ্জন আমার সভাই।

-জানি। সেবার এসে পিনাকীবাবুর কাছে আপনাদের পরিবারের অনেক কথা শুনেছিলুম। তাই গোড়া থেকেই আমার একটা চোখ ছিল সুরঞ্জনবাবুর দিকে। এবার দেখুন, এই পোস্টকার্ডের লেখা আর লাল ডটপেনে ছড়ার লেখার মধ্যে শুধু অক্ষরের ছোটো-বড়োর তফাত। কালই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম–তো সে-কথা থাক। এবার শুনুন! ছড়ার অর্থ আমি উদ্ধার করতে পেরেছি।

বলে কর্নেল মাথার ওপর কড়িকাঠ দেখালেন, –হিকরি ডিকরি ডক বললেই ঘড়ি বোঝায়। এবার নকড়ি ছকড়ি ক্লক। এই ঘরে গুনে দেখেছি নটা কড়িকাঠ আছে। সেটা হল নকড়ি। এবার ছকড়ি। গতরাত্রে আমি এটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বের করেছি। নটা কড়িকাঠ পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে ছটা কড়িকাঠ পর্যন্ত এলুম। কেমন তো? এবার ওই দেখুন একটা বেঁটে প্রকাণ্ড চৌকো ঘড়ি। ওদিক থেকে গুনলে ছটা কড়ির নিচে আর উলটোদিক থেকে গুনলে তিনটে কড়ির নিচে। নকড়ি ছকড়ি!

রায়মশাই বললেন, –কিন্তু ওটা তো অচল ঘড়ি। ওটার ভেতরে কিছু নেই।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -এবার ছড়ায় আছে ধরোটি বারোটি পাক। লক্ষ করুন ঘড়ির মাথায় ইংরেজিতে পেতলের টি অক্ষর সাঁটা আছে। এই টেবিলটাই যথেষ্ট। হালদারমশাই! প্লিজ এটা ধরুন।

দুজনে ছোটো টেবিলটা ঘড়ির তলায় নিয়ে গেলেন। কর্নেল তাতে সাবধানে উঠে বললেন, –ধরোটি মানে টি অক্ষরটা ধরো। এই দেখুন, ধরলুম। মানে একটু চাপ দিলুম। দেখছেন? টি অক্ষরটা খাঁজ থেকে বেরিয়ে এল। এবার ছড়া বলছে, ধরোটি বারোটি পাক। তার মানে, টি ধরে বারোবার পাক দাও। দিচ্ছি। এক… দুই… তিন… চার…

কর্নেল বারো গোনার পরই কর শব্দ হল। তারপরই বেশ জোরে ঘণ্টা বাজতে থাকল। বারোবার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে-সঙ্গে কর্নেল ঘড়িটা দেয়াল থেকে খুলে নামালেন। হালদারমশাই ধরলেন ঘড়িটা। অবাক হয়ে দেখলুম দেয়ালে একটা চৌকো ছোটো কপাটের মতো ইঞ্চি ছয়েক অংশ খুলে গেছে। কর্নেল বললেন, -বাইরে থেকে রংটা দেয়ালের রঙে মেশানো। কিন্তু এটা পাতলা একটা তামার পাত। ঘড়িটা বারোবার বাজলে সেই শব্দের ধাক্কায় পাতটা খুলে যায়। অর্থাৎ বাজিলে চিচিং ফাঁক। দেখা যাক, ভেতরে কী আছে। খোদলটাতে ঠাসা একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি।

কর্নেল ভেতর থেকে একটা কালো ছইঞ্চি লম্বা তিন ইঞ্চি চওড়া বাকসো বের করে টেবিল থেকে নামলেন। ঘড়িটা টেবিলে রেখে হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে সোফায় কর্নেলের পাশে বসে পড়লেন। রায়মশাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।

বাকসোটার মাথা গালা দিয়ে সিল করা আছে। কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে একটা স্ক্রডাইভার বের করে সিলটা ছাড়ালেন। তারপর মাথাটা ধ্ৰু-ডাইভার ঢুকিয়ে ফাঁক করলেন। লাল, মখমলে মোড়া যে জিনিসটা এবার বেরুল, সেটা একটা চার ইঞ্চিটাক উঁচু ঝকঝকে সোনার মূর্তি। চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল আলোয়। কর্নেল বললেন, এটার চোখ দুটো হিরের। ঠোঁটদুটো পদ্মরাগ মণির। জুতোর সোনায় পান্না খচিত। আর মাথার মুকুটে এই উজ্জ্বল ধাতুটি সম্ভবত মরকতমণি। ডানাদুটোও সোনার। রায়মশাই! এই মূর্তি এদেশি নয়। এটি গ্রিক দেবতা কিউপিডের মূর্তি।

রায়মশাই বললেন, -হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা নাকি ইউরোপে প্রায়ই বেড়াতে যেতেন। তার নানা দেশে বন্ধু ছিলেন। ঘরে ওই যে সব বিদেশি ভাস্কর্য দেখছেন, ওগুলো তারই সংগৃহীত। কিন্তু কী আশ্চর্য! ঠাকুরদা কেন আমাদের কথাটা খুলে বলেননি? বাবাকেও বলেননি।

কর্নেল বললেন, –সম্ভবত আপনার ঠাকুরদাকেও তার ঠাকুরদা শুধু ছড়াটাই শিখিয়েছিলেন। তাই আপনার ঠাকুরদা খুলে বলতে পারেননি। ভেবেছিলেন, বংশের কেউ-না-কেউ একদিন ছড়াটার অর্থ খুঁজে বের করবে।

হালদারমশাই বললেন, আমাদের এই কর্নেলস্যারের ব্রেন-বুঝলেন রায়মশায়? এক্কেরে ভগবানের নিজের হাতে তৈরি। ওহ! আমাগো মাথা ব্যাবাক গুলাইয়া যায়। কী য্যান ছড়াটা?

কর্নেল আওড়ালেন :

হিকরি ডিকরি ডক
নকড়ি ছকড়ি ক্লক
ধরোটি বারোটি পাক
বাজিলে চিচিং ফাঁক

তারপর বললেন, –রায়মশাই! এবার মূর্তিটা আগের মতো গর্তে ঢুকিয়ে রেখে ঘড়িটা তার ওপর টাঙিয়ে রাখা যাক। কী বলেন?

–নিশ্চয়ই। এ গোপন রহস্য আমি জেনে রাখলুম। এই যথেষ্ট।

ঘড়িটা আগের মতো অচল হয়ে টাঙানো রইল। কর্নেল ও হালদারমশাই টেবিলটা সরিয়ে আনলেন। তারপর রায়মশাই বললেন, -পিনাকীদাকে ডেকে কফি বলে আসি।

তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরই কালকের মতো সারা ঘর জুড়ে সেতারের মতো ঝংকার শোনা গেল এবং তারপর দশবার নানা সুরে মিঠে-কোমল ঘণ্টা বাজতে থাকল। হালদারমশাইয়ের চোখ গুলিগুলি এবং গোঁফ উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপতে থাকল। কিছুক্ষণ যেন এক জাদুকরের তৈরি মায়াজগতের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলুম। কালকের মতো খুদে পাখির ঠোঁটের ঠোকর বা খুদে সায়েবের সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাতুড়ি দিয়ে ঘন্টি বাজানো লক্ষ করতে ভুলেই গেলুম।

কিশোর কর্নেল সমগ্র ২য় খন্ড (Kishore Cornel Samagra)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *