ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত
“ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত, নিম না ছাড়েন আপন জাত।”
করালী হল নিম, আর ঘি হল বনওয়ারীর উদার স্নেহ। কথাটা বললে নিমতেলে পানু। সকালেই আজ যাবার কথা জাঙলে ঘোষ-বাড়ি—বনওয়ারীর মনিব-বাড়ির ঘর ছাওয়াতে। ঘোষেদের বাইরের বাড়িটার নাম বাংলাকুঠি; একতলা লম্বা ঘরখানি সাহেবদের ডাকবাঙলার ‘ফেশানে তৈরি করেছেন মাইতো ঘোষ মহাশয়; চুনকাম করিয়েছেন, মেঝে বাধিয়েছেন, দরজায় জানালায় সবুজ বিলাতি রঙ দিয়েছেন, ভিতরে ঘরজোড়া চাদোয়া খাটিয়েছেন যাতে না চালকাঠামো দেখা যায়, মায় টানা-পাঙ্খও খাটিয়েছেন। বাহারের ঘর। জাঙলে লোকের কুটুম-সজ্জন এলে ওইখানেই বাসা দেওয়া হয়। যাদের বাড়ির কুটুম, তাদেরই রাখাল অথবা মান্দের অথবা কৃষাণের ছেলে এই কাহারননই কেউ বারান্দায় বসে টানা-পাখা টানে। কাজেই ঘরখানার সবকিছু কাহারপাড়ার নদর্পণে। সেই ঘরখানা এবার ছাওয়ার কথা নয়, কিন্তু হঠাৎ সেদিন হনুমানের সন্ন্যসীর দলে যুদ্ধ লেগে ধমধম লাফিয়ে ঘরখানার চাল একেবারে তছনছ করে দিয়েছে।
হনুমানের সন্নেসীর দল ক্ষেপলে ভীষণ ব্যাপার। সাধারণত হনুমানের দলে থাকে বিশপঞ্চাশটা হনুমতী, তাদের দলপতি থাকে এক বিরাট হনুমান, কাহারেরা বলে গদা-হনুমান, এই লম্বা এই সাদা দাঁতে দাঁতে অনবরত শব্দ করছে কটকট-কট-কট, ঋ্যাকাচ্ছে খ্যাকোর-এ্য্যাক। মধ্যে মধ্যে গম্ভীর গলায় উপ শব্দ করে লাফ দিয়ে চলছে এ ডাল থেকে ও ডাল; এ গাছ থেকে ও গাছ, গাছ থেকে পাশের ঘরের চালে ধম করে লাফিয়ে পড়ছে। দলের মধ্যে দ্বিতীয় পুরুষ হনুমান নাই। দলের প্রতিটি হনুমতী প্রসব করে তার সন্তান। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। প্রসব হলেই সর্বাগ্রে সে খবর নেবে বাচ্চাটা হনুমান না হনুমতী, হনুমতী হলে থাকবে, হনুমান হলে সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ নখে বাচ্চাটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে কেঁড়ে ফেলবে।
পুরুষ-সন্তান হলে হনুমতীই পালায় এখানে ওখানে লুকিয়ে থেকে সন্তানকে খানিকটা বড় করে ওই সন্যেসীর দলে সমর্পণ করে আবার ফিরে আসে নিজের দলে। সন্যেসীর দলের দলপতির সঙ্গে মধ্যে মধ্যে এই দলের দলপতির যুদ্ধ বাধে। ভীষণ যুদ্ধ। আঁচড়-কামড় চড়চাপড়—সে রক্তারক্তি ব্যাপার! এ ওর টুটি কামড়ে ছিঁড়ে দিতে চায়, ও এর বুকে নখ বসিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে দিতে চায় তার হৃৎপিণ্ড। উপ উপ শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে, গোটা গ্রামের চাল তছনছ হয়ে যায়, দুপদাপ শব্দে এ চাল থেকে ও চালে লাফ দিয়ে এ ওকে ও একে অনুসরণ করে। সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশে সনেসীর দল উৎসাহভরে আক্রোশভরে লাফ মারে। হনুমতীর দলও লাফ দিয়ে এ-চাল ও-চাল করে ফেরে, তারা লাফ দেয় উৎসাহে এবং আশঙ্কায়। একজন হার না মানা পর্যন্ত যুদ্ধ থামে না। একনাগাড়ে তিন দিন চার দিন যুদ্ধ চলে।
এর উপায় নাই, প্রতিবিধান নাই। মাইতো ঘোষের বন্দুক আছে, তিনি আক্ৰোশে গুলি করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বাড়ির লোক গ্রামের লোকে দেয় নাই। হনুমানবীর হনুমান রামচন্দ্রের বাহন; তিনি তাদের দিয়ে দিয়েছেন গাছের ডাল এবং ঘরের চালের রাজত্ব; মানুষের ফসলের একটা ভাগও দিয়ে গিয়েছেন। ‘উনি’রা হলেন পবন-নন্দন, ওঁদের মারলে পবন ঠাকুর মেঘ আনবেন না সে অঞ্চলে, অনাবৃষ্টি হবেই। বনওয়ারীও হাত জোড় করেছে মাইতে ঘোষকে। জল না হলে জাঙলের সদ্গোপেরা তবু বাঁচবেন, ঘরে ধান আছে, টাকা আছে। কিন্তু কাহারদের যে সর্বনাশ! তারা খাবে কি? সবংশে সগোষ্ঠী অনাহারে শুকাবে যে! সে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, গোটা কাহারপাড়া একত্র করে তিন দিনে ঘরখানাকে ছাইয়ে দেবে। ঘোষ জোর তাগিদ দিয়েছেন পরশু। কলকাতা থেকে তার এক বন্ধু আসবেন মেয়েছেলে নিয়ে, বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে আসবেন, যুদ্ধ যতদিন না মেটে বাস করবেন; সুতরাং ঘরে লাগতেই হবে। গতকাল থেকেই তিনি লাগাবার জন্য বলেছিলেন; কিন্তু আর এক মণ্ডলের ঘরে লেগেছিল—ঘর আধ-ছাওয়া হয়ে রয়েছে; তাই কালকের দিনটি ছুটি করে নিয়েছিল বনওয়ারী। আজ লাগবে শপথ করে এ কথা বলে এসেছে। সকালেই সকল কাহারবুড়ো যুবা এসে জুটল, এল না মাথলা নটবর ফড়িং হেবো। করালীর কথা আলাদা। সে চন্ননপুরে খাটে, কাহারপাড়ার কাহার হয়েও কাহার নয়—এক গাছের ফল বটে, কিন্তু নিজেই বোটা ছিঁড়েছে। কিন্তু চার-চারটে জোয়ান ছোকরা এল না কেন?
আর কেন? তারা চার জনে করালীর সঙ্গে চন্ননপুরে গিয়েছে। রেলে কাজ নেবে। নিয়ে গিয়েছে করালী। দলের সকলে ঘাড় নাড়লে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। বনওয়ারী গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। নিমতেলে পানা সুযোগ বুঝে বললে ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত, নিম না ছাড়েন আপন জাত!
বনওয়ারী উত্তর দিতে পারলে না কথাটার। ঘোষ মহাশয়ের ঘর ছায়া অবশ্য আটকাবে না, কিন্তু এ কি হল? এত করে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে করালীর মতি ফিরল না, তার নিষেধ লঙ্ন করে ছোকরাদের নিয়ে গেল! কাহারপাড়ায় ভাঙন ধরিয়ে ছোকরাদের হটাচ্ছে চন্ননপুর ওই দক্ষিণপুরীর পথে।
পাগল এল এতক্ষণে। সে রাত্রিটা ছিল করালীর উঠানে শুয়ে। গরমের দিন, খোলা উঠানে নিজের ঝুলিটা মাথায় দিয়ে একখানা মাদুরের উপরে শুয়ে ছিল। কাহারদের বাড়িতে মাদুর বড় একটা নাই, খেজুরপাতা তালপাতার চ্যাটাই ওরা নিজেই বুনে নেয়, ওই ওদের সম্বল, কিন্তু করালী তাকে মাদুর দিয়েছিল—নতুন মাদুর। সকালে উঠে সে এল বনওয়ারীর ওখানে। বৈশাখ মাস-ঘর ছাওনের সময়, ওইখানেই সকলের সঙ্গে দেখা হবেই। হাসিমুখে গান ধরে সে এসে সঁড়াল
“মন হারিয়ে গিয়েছিলাম কোপাই নদীর তীরে হে—
কে পেয়েছে, ও সইয়েরা, দাও আমাকে ফিরে হে!”
কিন্তু মজলিসের লোকেরা শুধু একবার মুখ তুলে একটু শুকনো হাসি হেসে আবার গম্ভীর হয়ে গেল। বনওয়ারী প্রহ্লাদ রতনের তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা, তারাও চুপ করে রইল। একটু পরে বনওয়ারী বললে—এলি কখন?
—কাল এতে। কিন্তু বেপারটা কি?
–অ্যানেক। তা এয়েছিস ভালই হয়েছে। চল্।
—কোথা?
—ঘোষ মাশায়ের বাঙলাকুঠি তিন দিনে শ্যাম করে দিতে হবে।
—অ্যাই দ্যাখ, আমাকে কেনে? আমাকে ছেড়ে দে।
—কেনে?
–আমার ভাই। হাসলে পাগল, বললে গান গেয়ে ভিখ করে অস পেয়েছি। উ সব খাটুনি-খুটুনিতে নাই।
–না, তা হবে না। ওঠ। ভিখ করবি? লাজ লাগবে না?
হা-হা করে হেসে উঠল পাগল পরিবার না ছেলে, চেঁকি না কুলো, চাল না চুলো, দিন না আত, মাস না বছর; বঁচা না মরা—আমার আবার লাজ-শরম কিসের?
বনওয়ারী হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, বললে—তোর শরম থাকলে কাল এতে এসে তু আমার বাড়ি না এসে করালীর বাড়িতে উঠিস। তা তোকেই বলি, করালীকেও বলি, বলিস। ছোকরাকে বলি, কিছু না থাক, জাতধরম তো আছে? না, তাও নাই?
পাগল একটু ক্ষুণ্ণ হল, বললে–ই কথা বলছ কেনে ভাই?
বলছি সাধে! বলছি অনেক দুঃখে। সে ছোকরা কজনকে নিয়ে চন্ননপুরে গেল। বেজাত। বেধস্মের আড়ৎ–। বনওয়ারী চুপ করে গেল, আর ভাষা খুঁজে পেলে না সে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললে—তু বলছিস ভিখ মাগবি? গতর থাকতে ভিখ মাগবি? বলি-ওরে, একটা কথা শুধাই তোকে। যদি তাকে খেতে দিয়ে জাতটি কেউ মারতে চায়, মারতে দিবি?
পাগল বললে—চল, কথার দরকার নাই। চল, আমি যেছি।
যেতে যেতে বনওয়ারী বললে—তা’পরেতে সাঙাত!
–বল সাঙাত।
—তোর কনে কত বড় হল? ভাল আছে?
–এই তোমার পাচে পড়ল। তা বেশ ডাগর হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এইবার বিয়ে হলেই। হল। হাসতে লাগল পাগল। গান ধরে দিলে—এ বুড়ো বয়সে সে আমার নতুন নেশা হে!
—সেই গানটি গা দিকি-নি।
—কোনটি?
—সেই ‘সায়েব আস্তা বাঁধালে’।
পাগলের বাঁধা রেললাইনের ঘেটুগান। চন্ননপুরে যখন প্রথম রেললাইন বসে তখন এই ঘেটুগান। বেঁধেছিল পাগল, এ গান গেয়ে খুব নাম হয়েছিল। আজও কাহারেরা কখনও কখনও গায়।
ঘোষ মহাশয়ের চালে চেপে পাগল গান ধরলে–
ও সায়েব আস্তা বাঁধলে!
হায় কলিকালে!
কালে কালে সায়েব এসে আস্তা বাঁধলে—
ছোকরারা ধুয়ো গাইলে—
ছ মাসের পথ কলের গাড়ি দণ্ডে চালালে।
ও সায়েব আস্তা—
ঝপাঝপ খড় উঠছে, ছুঁড়ছে নিচ থেকে। বিচিত্র কৌশলে—উপরে চালে বসে বারুইরা বা হাতে ধরছে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। পাশে গাদা করে রাখছে। বাখারিতে বাখারিতে বারুই দড়ির। বাঁধন দিচ্ছে, ঠুকছে, তারপর কোমর থেকে কাটারি বা কাস্তে খুলে দড়ি কেটে আবার সেটা কোমরে খুঁজছে।
বনওয়ারী ঘোষের চালের ‘টুইয়ে অর্থাৎ মাথায় দাঁড়িয়ে মধ্যে মধ্যে তাগিদ মারছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে একবার দেখছে উত্তরে চন্ননপুরকে, একবার হাঁসুলী বাঁকের ঘেরার মধ্যে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়াকে।
হাঁসুলী বাঁকের মানুষগুলি বাঁশবনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এতকাল ওই চন্ননপুরকে দেখে। আসছে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাঁদির কাহারপাড়ার উত্তরে জাঙল, তার উত্তরে পোয়া তিনেক অর্থাৎ দেড় মাইল দূরে চন্ননপুর। কাহারেরা বলে তা খানিক-আধেক বেশি হতে পারেন, কমও হতে পারেন। চন্ননপুর চিরকাল ভয়ের জায়গা। কাহারেরা সাহেবানদের গোলামি করেছে, তাদের। ‘আঙামুখ’ ‘হসাচোখ’ লালচুলকে যত ভয় করেছে, ঠিক ততখানিই ভয় করেছে চন্ননপুরকে। চন্ননপুরের ঠাকুর মহাশয়দের, দোকানদার বণিক মহাশয়দের গেরাম—‘ভগবান-ভগবতী’ অর্থাৎ দেবদেবীর গেরাম। ঠাকুরদের ছিল সূর্যের মত তেজ, এক রাস্তায় হাঁটতে ভয়ে থরথর করে কাপত কাহারেরা; কে জানে বাবা, কোন্ খড়কুটোয় যোগসাজশে ছোঁয়া পড়বে। বণিক মহাশয়দিকে ভয় হিসেবের। বড় বড় মোটা মোটা খাতার গুটি গুটি কালির আখরের লেখন, এক খাতা থেকে এক খাতায় যায়, সুদে সুদে পাওনা বাড়ে, ওদের দোকানে ধার করলে সে পাওনা। পাথরের মত বুকে চেপে বসে। ভগবান-ভগবতীকে আরও ভয়। তারা কাঠাকুর নয়, তারা কালরুদ্র নয়, তাদের পুজোর ঘটা কত, মহিমা কত। তাদের দরবারে পুজোর থান দূরের। কথা-কাহারেরা নাটমন্দিরেও উঠতে পায় না, দূর থেকে দেখতে হয়, তাদের ভোগের সামগ্রীতে কাহারদের দৃষ্টি পড়লে ভোগ নষ্ট হয়ে যায়। নানা ভয়ে কাহারেরা সাধ্যমতে ওপথে হাঁটত না।
নিচে থেকে এক আঁটি বাবুই দড়ি হস করে তার সামনে এসে পড়ল। মুহূর্তে বনওয়ারী সেটাকে ধরে ফেললে। বসে পড়ল, বাঁধন দিতে লাগল। কাজ জোর চলেছে। পাগল মাতিয়েছে ভাল। যেমন গলা তেমনি গাইয়ে। সবচেয়ে সুখ ওকে নিয়ে পালকি বহনে। এমন ছড়ার বোল ধরবে!
পাগল গেয়ে চলেছে ঘেঁটুর গান–
লালমুখো সায়েব এল কটা কটা চোখ–
দ্যাশ-বিদ্যাশ থেকে এল দলে দলে লোক
—ও সায়েব আস্তা—
ও সায়েব আস্তা বাঁধলে–কাহার কুলের অন্ন ঘুচালে
পালকি ছেড়ে র্যালে চড়ে যত বাবু লোক।
—ও সায়েব আস্তা—
মধ্যে মধ্যে সেকালে তাদের ডাক পড়ত ওখানকার ‘বিয়েশাদি’তে পালকি বহনের জন্য। লক্ষ্মীনারায়ণকে বহন করে গড়র পক্ষী, শিবদুর্গাকে বহন করে দুধবরণ সঁড় প্রভু, পিথিমী’তে বর-কনে—সে ঠাকুর মহাশয়রাই হোন আর বণিকেরাই হোন আর মণ্ডলেরাই হোন আর শেখ সৈয়দই হোন, সকল জাতের বর-কনে—বহন করতে আছে এই ‘অশ্বগোত্ত’ কাহারেরা। কাহারেরা পালকি কাধে করলেই পবিত্র। পালকি চেপে ঠাকুরেরা চান করেন না। ওই পুণ্যেই তাদের বাড়বাড়ন্ত। সে কর্ম ঘুচিয়ে দিয়েছে ওই চন্ননপুরের কারখানা।
কালে কালে কাল পাল্টায়। কালারুদ্র চড়কপাটায় ঘুরে কত বছর এল, কত গেল, কে তার হিসেব করে! আঁধার রাত্রে সুচাঁদ গল্প বলে গাজনের। বনওয়ারীর মত কাহার মাতব্বর যারা, তারা উদাস হয়ে গভীর অন্ধকার-ভরা বাঁশবনের দিকে তাকিয়ে ভাবে, দিশেহারা হয়ে যায়; কালে কালে কাল কেমন করে পাল্টায়, সে জানে কোপাই-বেটী। দাঁড়াও গিয়ে কোপাইয়ের কূলে। দেখবে, আজ যেখানে দহ, কাল সেখানে চর দেখা দেয়, শক্ত পাথুরে নদীর পাড় ধসে সেখানে দহ হয়।
কিছুটা জানে কালীদহের মাথার বাবাঠাকুরের ‘আশ্চয়’ অর্থাৎ এই শিমুলবৃক্ষটি। কত কোটরে ভরা, কত ডাল ভেঙে পড়েছে, কত ডাল নতুন হয়েছে, কত পাতা ঝরেছে, কত ফুলও ফুটেছে, কত ফল ফেটেছে, কত বীজ এখানে ওখানে পড়েছে, কত বংশ বেড়েছে, কত বীজ নষ্ট হয়েছে, ওই উনি কিছু কিছু জানেন। তবে উনি তো কথা যাকে-তাকে বলেন না, বলেন। সাধুকে সন্ন্যাসীকে, আর নেহাত যে বাবাঠাকুরের সুনজরে পড়ে তাকে। তাকে বলেন দেখলাম অনেক কাল বাবা! রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখলাম, কেঠাকুর কংসকে মারলেন দেখলাম, বর্গীর হাঙ্গামা দেখলাম, সায়েবদের কুঠি দেখলাম, চৌধুরীদের আমল দেখলাম, চন্ননপুরের ঠাকুর মহাশয়দের বাবুমশায় হতে দেখলাম, কাহারদের ডাক পড়ল চন্ননপুরে—সে তো এই সেদিনের কথা রে বাবা! চন্ননপুরের ঠাকুরেরা বাবু হয়ে পিরান পরলেন, মসমসিয়ে জুতো পায়ে দিলেন, ছুত-পতিত খানিকটা কম করলেন। না করে উপায় কি বল!
তাঁরা জমিজেরাদ কিনলেন, টাকা দান করতে লাগলেন, ইংরিজি শিখলেন। জমিদারিও কিনলেন কতজনে। চাকরি-বাকরিতে দেশ দেশান্তর যেতে লাগলেন। কীর্তনের দল ছিল চন্ননপুরে, সে দল ভেঙে হল যাত্রার দল। সে যাত্ৰাদলের গান বনওয়ারীও শুনেছে অল্পবয়সে। তারপর হয়েছে থিয়েটার। এই কালে কাহারদের ডাক বেশি করে পড়ল চন্ননপুরে। বাবু মশায়দের চাষে খাটতে, বাসে খাটতে, মানে দালানকোঠার ইট বইতে সুরকি ভাঙতে কাহার নইলে চলত না। মেয়েদের ডাক পড়ল মজুরনী হতে। এ কালে তখন সাহেবানদের কুঠি উঠে গিয়েছে, কত্তাঠাকুরের ‘কোশে সাহেব মেম ড়ুবে মরেছে, কাহারেরা চুরি-ডাকাতিও করে, আবার চাষও করে।
কিন্তু চন্ননপুর হাঁসুলী বাঁকের উত্তর দিক হলেও আসলে হল দক্ষিণপুরী, ওখানে গেলে ওদের মঙ্গল হয় না। সেখানে ছিল শাপশাপান্তের ভয়, একালে হল অন্য ভয়। মেয়ে হারাতে লাগল। রাজমিস্ত্রি সকলেই প্রায় শেখ ভাই সাহেব, তারা মেয়েদের সঙ্গে ‘অঙ ধরিয়ে কলমা পড়িয়ে। বিবি করে ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। বাবুদের চাপরাসীও মেয়েদের নষ্ট করতে লাগল। বাবু। ভাইয়েরাও কাহার-মেয়েদের আঁচল ধরে টান দিলেন। ‘বানে’র ছেলে তাদের পরশ কাহারমেয়েরা সইতে পারবে কেন, তারাই ফেটে গেল পাপে। মাতব্বরে মুরুদ্বিতে বারণ করলে, দু হাত বাড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়াল—যাস না। যতটুকু না হলে নয়, যে যাওয়াটা না গেলে চলবে না তার বেশি ও-পথ হাঁটিস না।
আবার কাল পাল্টাল। চন্ননপুরে এল কলের গাড়ি। লোহার লাইন পাতলে, মাটির সড়ক। বেঁধে কোথাও-বা মাটিতে ‘পুল বন্ধন’ হল। চন্ননপুর হল ‘দী’র ঘাট। পিথিমীর কালের ভাঙনের সকল ঢেউ এসে আগে আছড়ে পড়ে ওই চন্ননপুরে। বাবু মহাশয়েরা সে ঢেউ বুক পেতে নিতে পারেন। তাঁরা ‘বান’, তারা ‘নেকনপঠন’ জানেন, ভগবান তাদের ঘরে দিয়েছেন রাজলক্ষ্মী, তার কৃপাতে ওই ঢেউয়ের মুখে ঘরে এসে ঢেকে ভালটুকু যেমন কোপাইয়ের বানে ভাগ্যমন্তের জমিতে পড়ে সোনা-ফলানো পলেন মাটি। কাহারদের বুকে ও ঢেউ লাগলে সর্বনাশ হয়, যেমন কোপাইয়ের বান ভাগ্যহীনের জমিতে চাপায় শুধু বালি, বালি আর বালি। চন্ননপুরে রেললাইন পড়ল, তাতে বাবুদের জমির দাম বাড়ল, ব্যবসা-বাজার ফলাও হল, আর কাহারদের হল সর্বনাশ। একসঙ্গে এক দল মেয়ে চলে গেল। করালীর মা গিয়েছে ওই দলে। হায় রে নিলাজ বেহায়া করালী! আবার এসেছে নতুন ঢেউ যুদ্ধের ঢেউ। যুদ্ধের ঢেউ এসে আছাড় খেয়ে পড়েছে চন্ননপুরের ঘাটে। চন্ননপুরে লাইন বাড়বে। হাতছানির ইশারা দিচ্ছে করালীর হাত দিয়ে কাহারপাড়ায় অবুঝ অবোধদের কাছে। ভুলিস না, ভুলিস না তোরা।
পাগলও এই সময় তার গান শেষ করে তারও গানে এই সুর। ইচ্ছে করেই বনওয়ারী তাকে এই গানটা গাইতে বলেছে। শুনুক, যে সব ছোকরা মনে মনে উসখুস করছে অথচ যেতে পারছে না, দুঃসাহস হচ্ছে না—তারা শুনুক, জ্ঞান হোক। আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। পাগল গেয়ে নিক আগে–
জাতি যায় ধরম যায় মেলেচ্ছো কারখানা
ও-পথে যেয়ো না বাবা, কাবাবার মানা।
গা, তুই গেয়ে যা পাগল—
মেয়েরা ও-পথে গেলে, ফেরে নাকো ঘরে
বেজাতেতে দিয়ে জাত যায় দেশান্তরে।
করালীর মা গিয়েছে। কে জানে পাখীর দশায় কি আছে! দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বনওয়ারী। পাগল গান শেষ করে, গায়—
লক্ষ্মীরে চঞ্চল করে অলক্ষ্মীর কারখানা।
ও-পথে হেঁটো না মানিক কত্তাবাবার মানা।
বনওয়ারী বললে—তবে? পাগল, সাঙাত আমার, তবে?
-–কি তবে?
—করালীর খুব পিঠ চাপুড়েছিস শুনলাম কাল এতে। করালীকে গানটি শোনাস।
পাগল চুপ করে গেল। সে ঠকে গিয়েছে। একটু পরে হেসে বলল—তু খুব ফিচেল বনওয়ারী।
বনওয়ারী বললে—পাখীর কথা বলব না, বলতে নাই আমাকে, আমি মামা। তবে তাকে শুধাস টাকার জন্যে জাত মরবে, সেটা কি ভাল হবে?
বৈশাখ মাস। দারুণ রোদ। তার উপর আজ বাতাস নাই। দরদর করে ঘেমে সারা হল কাহারেরা। তবু মনের আনন্দে গান গেয়ে কাজ করে চলেছে। হঠাৎ পাগল বললে ব্যানো, যা হয়েছে, তা হয়েছে। বাকিটা কোনোরকমে আলগা খড় দিয়ে ঢাকো ভাই, গতিক খারাপ।
আকাশের দিকে চাইলে বনওয়ারী। হ্যাঁ গতিক খারাপই বটে। আকাশ একেবারে ইস্পাতের ‘বন্ন’ অর্থাৎ বর্ণ ধারণ করেছে। ছায়া ঠিক পড়ে নাই, তবে রোদ যেন ‘আমলে’ অর্থাৎ ম্লান হয়ে এসেছে। ঠিক পশ্চিম দিকটা দেখা যাচ্ছে না। একতলা ঘর, নিচু চাল, চারিদিকের গাছপালায় ঢেকে রয়েছে দিকগুলির শেষ সীমানা। তবু ঝড় আসবে বলে মনে হচ্ছে। বনওয়ারী মনে মনে ডাকলে বাবাঠাকুরকে দুটো দিন ঝড় সামল দাও বাবা, দুটো দিন। মুখে সে। তাগিদ দিলে—কতক লোক কাজ কর, হাত চালিয়ে কাজ কর। কতক ওপরে থেকে আলগা খড়ের আঁটি চাপিয়ে দাও। ছোঁড়, খড় ছোঁড়! এই ছোঁড়ারা! এই!
হঠাৎ একটা চিৎকার উঠল—হো—!
ওরে বাপ্রে! আচ্ছা গলা! কে? আকাশে আকাশে ছড়াচ্ছে গলার আওয়াজ!
পাগল আতঙ্কে দাঁড়িয়ে উঠল।–ব্যানো!
—কি?।
–দেখ দেখ!
—কি রে?
–করালী।
–করালী?
করালী বাবাঠাকুরের শিমুলগাছের ডালে চেপে চেঁচাচ্ছে।
চালে দাঁড়িয়ে উঠল বনওয়ারী। সর্বনাশ! আদ্যিকালের শিমুলবৃক্ষ বাবাঠাকুরের ‘আশ্চয়’ সেখানে চেপেছে করালী! পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে-হো! ডাকছে। কাকে ডাকছে?
–হো–ব্যানোকাকা!–হো!–হো!
থরথর করে কেঁপে উঠল বনওয়ারী। ওই উঁচু শিমুলগাছ কাটায় ভরা গদি ডাল। ওর উপর উঠেছে! বাবাঠাকুর যদি ঠেলে দেন! করালীকে লাগছে যেন পুতুলের মত।
—হো—ঝড়-ঝড়। ব্যানোকাকা! পেলয় ঝড়! চাল থেকে নাম। চন্ননপুরে খবর এসেছে তারে। হো—ব্যানো-কা-কা!
নামছে, এইবার করালী নামছে।
পানা বললে—পড়বে। এই–
–পড়ল?
–না, সামলেছে। এই—এই! ওঃ, সামলেছে। আর দেখা যাচ্ছে না।
পাখীর কান্না শোনবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল সকলে। কিন্তু বনওয়ারী কাজ ভোলে না। খড়, খড়। না ঢেকে কেউ নামতে পাবা না। ঢাক। ঢাক।
পাগল বললে—ব্যানো, এইবার দেখ। কত্তাঠাকুরের বেলগাছ আর শিমুলগাছ এক করে দেখ।
কত্তাঠাকুরের বেলগাছের পিছনে সাহেবডাঙায় ওই ‘টেকরের’ অর্থাৎ চড়াইয়ের গায়ে আকাশে ও কি? কালচে মেঘের কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে না? হাঁ, হাঁ। ওই যে বিদ্যুৎ ‘লপে’ অর্থাৎ চমকে উঠেছে ফু-দেওয়া আগুনের আঁচের মত। এই আবার! এই আবার। আসছে তা হলে, আজই আসছে। আসেছ। নিৰ্ঘাত।
আকাশের ‘হেঁড়ে’ অর্থাৎ বায়ু কোণে মেঘের তুলোর উপর কোন ধুনুরী যেন তার আঁতের। ছিলের আঘাতে আঘাতে পিঁজে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আর দু আঁটি খড় জলদি দাও। মাথাটায় আর দু আঁটি চাপিয়ে দি। আকাশের দিকে আর একবার চেয়ে দেখে বনওয়ারী চালের উপর শক্ত হয়ে বসে মাথায় বাঁধন দিতে লাগল।
–বাস, নাম, না। নিজে সে মইয়ের ভরসা ছেড়ে চাল থেকে লাফ দিয়ে পড়ল নিচের খড়ের গাদায়।
—লে এইবার দে ছুট। ঘর–ঘর চ।
কাহারপাড়ার নীল বধের মাথায় দাঁড়িয়ে ডাকিনীর মত হাঁক ছেড়ে শাপান্ত করছে নয়ানের মা। ওঃ, একেবারে দু হাত তুলে ডাকছে, নাচছে যেন।
—এস বাবা, এস। ক্ষ্যাপা বাবা আমার এস।
—এল। হাঁসুলী বাঁকের দেশের কালবৈশাখীর ঝড়। কালো মেঘের গায়ে রাঙা মাটির ধুলোয় লালচে ‘দোলাই’ অর্থাৎ চাদর উড়ছে। কালো কষ্টি পাথরের গড়া বাবা কালারুদ্রের পরনের রক্তরাঙা পাটের কাপড় যেন ফুলে ফুলে উঠছে। হাঁ-হাঁ করে হকতে হকতে আসছে। দু হাত দোলাতে দোলাতে, বুক দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে, সামনে যা পরে সাপটে জাপটে ধরে তুলে আছড়ে মেরে ফেলতে ফেলতে ছুটে চলে পাগলা হাতির মত, শিঙ-বকানো বুনো মোষের মত, গাছ ভাঙে মাঝখান থেকে, ডালও ভাঙে, মূলসুদ্ধ উপড়েও পড়ে, পাতা ফুল ছিঁড়েকুটে সারি সারি। চালের খড় উড়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় বানভাসি কুটোর মত। তালগাছগুলো যুদ্ধ করে। মাটিতে মাথা আছড়ে পড়তে পড়তে আবার খাড়া হয়ে ওঠে, আবার নামে। আকাশ চিরে বিদ্যুৎ খেলে, কড়কড় শব্দে মেঘ ডাকে, সে আলোতে চোখে মানুষ আঁধার দেখে, সে শব্দে কানে তালা ধরে যায়, মন শুকিয়ে ভয়ে এতটুকু হয়ে ভাবে, পিথিমী’ আর থাকবে না। তবু এরই মধ্যে সাহস করে বনওয়ারীর বউ গোপালীবালা ঝড়ঠাকুরকে কাঠের পিঁড়ি পেতে বসতে দেয়, ঘটিতে ভরে জল দেয় পা ধুতে; বলে—ঠাকুর, শান্ত হয়ে বস। বনওয়ারী ঘরের মধ্যে। বসে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। উঃ, অনেকদিন এমন ঝড় হয় নি! ওরে বারে! কি ‘পেচণ্ড ব্যাপার, ‘পলয়’ হয়ে যাবে হয়ত!
আলোতে ধেঁধে গেল সমস্ত। কড়কড় শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল পৃথিবী। বাজ পড়ল। কোথায়? ওরে বাপ রে, মাঠের সেই তালগাছটার মাথা জ্বলতে লেগেছে!
ও কি! ও কার ঘর! কার ঘরের চালখানা দেওয়াল ছেড়ে ঝড়ের বেগে উঠছে আর নামছে! নতুন খড়ে ছাওয়া চাল! করালীর ঘর নয়! হা, করালীর ঘরই তো। ঝড় বইছে উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে, ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণটা উঠছে আর নামছে। বুনো মোষ যেন শিঙ লাগিয়ে ঠেলে ঠেলে তুলছে চালাখানাকে। গেল, আর বুঝি থাকবে না। ক্রমশ যেন দেওয়াল ছেড়ে বেশি ফাঁক হয়ে উঠেছে। এই—এই সর্বনাশ! দেওয়াল ছেড়ে গোটা চালাখানাই ভেসে উঠল আকাশে; চলল, তীর বেগে ভেসে চলল—মাঠের দিকে, ঝড়ের হাওয়ার মুখে। হঠাৎ একটু কাত হল, তারপর হল পুরো কাত-ঘুরপাক খেলে কয়েকবার, নিচে পড়ল হুমড়ি খেয়ে। হাঁসুলী বাঁকের মাঝমাঠে পড়ল।
বনওয়ারী ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল পাগল।–কার ঘর, ব্যানো?
—করালীর মনে হচ্ছে।
—করালীর?
—হ্যাঁ।
আর তার সন্দেহ নাই। নয়ানের মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে এই ঝড়ের মধ্যেও।
করালীর ঘর উড়েছে, তাতে আক্রোশ মেটার আনন্দে নয়ানের মা তারস্বরে এই ঝড়ের মধ্যেই যেন সুরে সুর মিলিয়ে গাল দিচ্ছে। শিউরে উঠল বনওয়ারী নয়ানের মায়ের গালাগাল শুনে।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথার গালাগাল শাপশাপান্ত কোনো কিছুতে রেয়াত করে না, ক্ষমা নাই, ঘেন্নাও নাই তার মধ্যে। চোখের মাথা খায়, গতরের মাথা খায়, স্বামী-পুত্রকে যমের মুখে। দেয়, ঘর-সংসার জ্বালিয়ে ছারখারে দেবার জন্য ভগবানকে ডাকে। চুল যায় এলিয়ে, অঙ্গের বসন পড়ে খুলে, সেদিকে দৃপাত করে না; আক্ৰোশে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কাহার মেয়ে গাল দিতে দিতে নাচতে থাকে, হাতে তালি দেয়, কখনও কখনও দুলতে থাকে। সে সবই বনওয়ারী জানে। শুনতে কটু লাগে, নইলে ওতে কিছু হয় না–এত অভিজ্ঞতাও তার আছে। গত জনমের করমদোষে’ ছোট জাত হয়ে জন্মেছে, এ জন্মেতে এমন পুণ্যি কিছু নাই যে, যা বলবে তাই ফলবে। ভয় ‘বান’-বৈদ্য বড় জাত মহাশয়দের জিভকেও জিভের বাক্যিতে আর শিবের বাক্যিতে তফাত নাই, নয়ানের মায়ের গালিগালাজ শুনে শিউরে ওঠে নাই বনওয়ারী। শিউরে উঠেছে নয়ানের মা ঝড়ের মধ্যে যা দেখেছে তাই শুনে। নয়ানের মা হা-হা করে আসছে আর হাতে তালি দিয়ে বলছে—ম্যাঘের কোণে বাবার বাহন ফণা তুলে উঠেছে। কলকিয়ে জিভ ‘কাড়ছে’ অর্থাৎ বার করছে। ফেঁসফুসিয়ে গজরাচ্ছে। আগুনের আঁচে ঝলসানো অঙ্গের ‘ডাহতে’ ক্ষেপে উঠে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে ঝড় তুলেছে। আমি চোখে দেখলাম, চোখে দেখলাম। যে মেরেছে পুড়িয়ে, তার ঘর দিলে উড়িয়ে। হে কত্তাবাবা, হে বাবাঠাকুর, তুমি ক্ষেপে ওঠ বাবা। বাহনের মাথায় উঠে দাঁড়াও এইবার। আকাশের বাজ নিয়ে নষ্টদুষ্ট বদজাতের মাথায় ফেলো বাবা! কড়কড় করে ডাক মেরে হাক মেরে ফেলে দাও বাজ। পুড়ে ফেটে মরে যাক ছটফটিয়ে। হে বাবা! হে বাবা! হে বাবা!
থরথর করে কেঁপে উঠল বনওয়ারী। সেই ‘বিচিত্ত’ বরন ভয়ঙ্কর সাপটির পুড়ে মরবার দৃশ্যটি তার মনে পড়ে গেল। সুচাঁদ পিসিই কথা প্রথম বলেছিল। তারও মনে কথাটির উপর বিশ্বাস হয়েছিল কিছু কিছু। আজ নয়ানের মা এ কি বলছে! চোখে দেখেছে সে ওই মেঘের মধ্যে তার ফণা, তার জিভ?
পাগল বিস্মিত হয়ে গেল তার ভীতার্ত দৃষ্টি দেখে। সে ঘটনার কিছুই জানে না। শুধু খানিকটা আভাস পেয়েছে মাত্র। তবুও সে বাঁশবাদির কাহার। খানিকটা অনুমান করতে পারছে বনওয়ারীর ভয়। সঙ্গে তারও ভয় লাগছে। সে ভীতকণ্ঠেই ডাকলে—ব্যানো!
—হুঁ।
—কি হল? বনওয়ারী আঙুল দেখালে আকাশের দিকে।–ওই দেখ।
বনওয়ারী আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে। মোটা মোটা জলের ফেঁটা এসে চোখে পড়ছে, তবু সে চেয়ে আছে আকাশের বায়ু কোণের দিকে। বৃষ্টির ধারায় আকাশে ধুলো ধুয়ে নেমে গিয়েছে মাটিতে। বাতাসের বেগে মেঘপুঞ্জের দ্রুত আবর্তন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাদা-কালো মেঘের বিচিত্র বর্ণসংস্থান হয়েছে সেখানে, হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় মানুষের দৃষ্টিতে কত অপদেবতা দেখা দেয়, বর্ষার আকাশে ‘হাতি-নামা’ ধরা পড়ে, কোপাইয়ের বন্যায় বড় মশাল জ্বালিয়ে যক্ষের নৌকা আসা দেখতে পাওয়া যায়। আজও নয়ানের মা দেখেছে মেঘের মধ্যে ঝড়ের মধ্যে কত্তাঠাকুরের বাহনকে। বনওয়ারীও যেন দেখতে পাচ্ছে, হা হা, মেঘের চেহারার মধ্যে সেই মা-মনসার বেটী-কত্তাঠাকুরের বাহন চন্দ্রবোড়া সাপটির দেহের বর্ণবৈচিত্র্যের সঙ্গে মেঘের সাদা-কালো রঙের বর্ণসংস্থানের স্পষ্ট মিল দেখতে পাচ্ছে।
পাগল বুঝতে চেষ্টা করেও ঠিক বুঝতে পারলে না, বনওয়ারী কি দেখতে পেয়েছে। তবে সেও কাহার, সে আর একটা সম্ভাবনা দেখতে পেলে মেঘ এবং প্রকৃতির গতিকের মধ্য থেকে। সে শঙ্কিতভাবে গায়ে হাত দিয়ে বনওয়ারীকে সচেতন করে ডাকলে—ব্যানো ব্যানো! পাথর, পাথর পড়বে! ব্যানো!
–পাথর?
–হ্যাঁ, পাথর।
বৃষ্টি অত্যন্ত মৃদু হয়ে এসেছে। দুটি চারটি কুচি শিল পড়তেও শুরু করেছে।
–ঘরকে চল। পাগল বনওয়ারীর হাত ধরে টানছে। বনওয়ারী হাত ছাড়িয়ে নিলে।
–পাপ করালী! ছাড় পাগল, হাত ছাড়। আগে হে বাবাঠাকুর-ক্ষমা কর তুমি। মাৰ্জ্জনা কর।
পাগল টেনে বনওয়ারীকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। দেখতে দেখতে শিলাবৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠল। ছোট ছোট ছেলেরা মাথায় হাত দিয়ে উঠানে নেমে শিলের টুকরো কুড়িয়ে খেতে আরম্ভ করলে, প্রবীণেরা তাদের ধমক দিয়ে উপরে তুললে। মেয়েরা ছুটে গেল নীল বধের ঘাটে। নীলের বাঁধের জলে আছে হাঁসগুলো। মরবে। ওগুলো হয়ত মরবে। জলে ড়ুবে অবশ্য ওরা থাকতে পারে কিন্তু কতক্ষণ থাকবে?
-আয়—আয়—কো—কো—কো! আয়—কোর্ কোর্ কোর! তি-তি-তি! চমকে উঠল বনওয়ারী একটি কণ্ঠস্বরে! কালোবউ! কালোবউ দুটো হাঁস বগলে নিয়ে বক্রকটাক্ষ হেনে চলে গেল। যাক। ও ভাবনার সময় নাই বনওয়ারীর।
পাগল বললে ভাগ্য ভাল, ছাগলগুলো ঘরে ঢুকেছে। পাগলের পাশেই ব্যানোর ছাগল চারটে দাঁড়িয়ে জল ঝাড়ছে মধ্যে মধ্যে। রোয়াগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে রোমন্থন করছে।
শিল পড়ছে অজস্ৰধারে, ক্রমশ মোটা হচ্ছে আকারে। ঝরঝর শব্দে পড়ছে। চালে ধূপধুপ শব্দ হচ্ছে। জলে চড়চড় শব্দ উঠছে। নীলবাঁধের পদ্মপাতাগুলো ফুটে-ফেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কাহারেরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। দেখছে শিলাবৃষ্টি। নয়ানের মায়ের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত থেমে এসেছে। মাঠঘাট ঘরের চাল সব শিলার খণ্ডে ছেয়ে সাদা হয়ে গেল।
ঝড়বৃষ্টি শিলাবর্ষণে লণ্ডভণ্ড করে ঘণ্টাদুয়েক পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কালবৈশাখী থেমে গেল। অস্ত যাবার মুখে সূৰ্যও দেখা দিলে। লাল হয়ে গেল আকাশটা।
ঝড়বৃষ্টির পরে কাহারপাড়ার মেয়েরা ছেলেরা ছুটল বন-বাদাড় খুঁজতে। কোথায় ডাল ভেঙেছে, পালা ভেঙে তালগাছের শুকনো পাতা খসেছে। কুড়িয়ে আনতে হবে। প্রবীণ-প্রবীণারা ঘর-দোর পরিষ্কার করতে লাগল। খড়কুটোতে ঝড়ে শিলে ছিঁড়ে খসে পড়া গাছের কঁচা পাতায় উঠোন ছেয়ে গিয়েছে।
নসুবালা সুচাঁদ কাঁদছে তারস্বরে। হাঁসুলী বাঁকের নিয়ম। বসন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
ওদিকে নয়ানের মা এখনও ধেই ধেই করে নাচছে। ওর ঘরের চালও আধখানা উড়েছে। তাতেও ভ্রূক্ষেপ নাই।
পাখী করালীকে বলছে—শোন শোন কি বলছে হারামজাদী। অর্থাৎ নয়ানের মা।
করালী একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে চালশূন্য ঘরখানার দিকে। মধ্যে মধ্যে বলছে—শালো! শালো। শালো, নিলি নিলি, আমার ঘরটাই নিলি?
পাগল এসে দাঁড়াল।
করালী বললে—দেখ।
—দেখলাম।
—শালে, আমার উপর দিয়েই গেল হে ঝড়টা!
–পাথর-টাথর বাজে নাই তো?
বেশ হেসে উঠল করালী। বললে–সে এক কাও। ঘরের মধ্যে খাটিয়ার তলায় গরুর মত—। হো-হো করে হেসে উঠল করালী। বললে–পাখী কিছুতে ঢুকবে না। টেনে, বুয়েচ কিনা; হেঁচড়ে ঢোকালাম। তা’পরেতে খটখট পট-পট-ওঃ!
মাথলা নটবর এল। মাথলা বললে—আ, এমন সুন্দর করে ঘরখানা সাজালে—
–দূর শালো। আবার করব। শালোর চালকে এবার লোহার তার দিয়ে বাধেঙ্গা। দেখ না।
তারপর বসল ওদের মজলিস। করালীর মজলিস।
পাগল ধীরে ধীরে অনেক বুঝালে করালীকে। বনওয়ারীর কথা তার মনে লেগেছে।
শেষে বললে—বনওয়ারী একটা কথা দামি বলছে। বললে, টাকা দিয়ে যদি কেউ বলে— জাতটি দাও, দেবে তুমি?
হো-হো করে হেসে উঠল করালী। বললে—জাত জাত লেয় কে? তার ঘর কোন্ খানে? বলি, জাত মারে কে?
—জাত মারে কে! অবাক হয়ে গেল পাগল।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। জাত মারে কে? জাত! জাত যায় পরের এঁটো খেলে, কুড়োলে। ছোঁয়া খেলে যায় না। জাত ওদের গিয়েছে, আমার যায় নাই। বুয়েচ? আমার জাত মারে কে?
পাগল ঘাড় নেড়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল কথাটা। কথাটার মানে নাই, কিন্তু কথাটা কথার মত কথা বটে। ডাকাবুকোর কথা, জবরদস্তের কথা। বেশ কথা।
একজন এসে ডাকলে বাইরে থেকে।পাগল-দাদা, মাতব্বর ডাকছে।
—কেনে রে? এই তো এলাম।
—মিত্তি-গোপালপুরের মিত্তি মশায়ের ঘরের মোক এসেছে। বিয়ে। দুখানা পালকির কাহার চাই। আইবিশের দল চাই।