কালরুদ্রের গাজনে
শিবো হে! সকল বুড়ার আদি বুড়া, সকল দেবতার বড় দেবতা—বাবা বুড়া শিব, বাবা কালারুদ্দু! বেলতলার বাবাঠাকুর, কাহারদের দেবতা। তারও দেবতা বাবা কালারুদ্দু। ধৰ্ম্ম রঞ্জ–যে ধম্মরাজ–তারও বড় বাবা কালরুদ্র।
এবার বাবা কালরুদ্রের গাজনে চড়কের গজাল পেটা ঘুরনচাকির গজালের মাথায় শোবার পুণ্য সে অর্জন করবে। করতেই হবে তাকে।
বাবা কালারুদ্দু-কর্তাঠাকুরের উপরওয়ালা-বাবাঠাকুরের বাবা। ‘লারায়ণের’ যেমন ‘লারদ’, বাবা কালারুদ্দুরের তেমনি ন্যাড়ামাথা গেরুয়া-পরা খড়মপায়ে দণ্ড-হাতে কাঠাকুর। কর্তার ইচ্ছেতে কর্ম, কালরুদ্রের হুকুমের মরণ-বাঁচন। গতবারে গাজনের ঠিক পনের দিন পরেই বাবা কালারুদ্দের প্রধান ভক্ত মারা গিয়েছে। প্রধান ভক্তই চড়কের পাটার গজালের ডগায় শোয়, সে-ই দু হাতে আগুন ফুলের ‘আঁজলা’ অর্থাৎ অঞ্জলি নিয়ে চাপিয়ে আসে। বাবার মাথায়, সে-ই নাচে আগুনের ফুলের উপর। মড়ার মাথা নিয়ে তাকেই খেলতে হয়। নিজের অনেক পুণ্যতার অনেক বেশি দেবতার দয়া না থাকলে কালরুদ্রের প্রধান ভক্ত কেউ হতে পারে না। এবার সেই প্রধান ভক্তের খালি ঠাঁইয়ে বনওয়ারী গিয়ে শোবে। সংকল্প দৃঢ় করে। ফেললে সে। বাবা কালারুদ্দের প্রধান ভক্ত চিরকাল হয় নীচ জাতের লোক। সে আদ্যিকালের বাণগোঁসাইয়ের কাল থেকে। সুচাঁদ পিসি বাণগোঁসাইয়ের কাহিনী বলে। বাণগোঁসাই ছিল ছোটজাতের রাজা, কিন্তু ভোলা মহেশ্বর কালারুদ্দের ভক্ত। মদ খেত, ‘মাস’ খেত, কিন্তু বাবার চরণে ফুল দিত, গাজনে সন্যেস করতে কখনও ভুলত না। সন্যেস করে আগুনের আঙারের ওপর বসে বাবাকে ডাকত, লোহার কাটার শয্যেতে ‘শয়েন করত, সোনা রুপো হীরে মানিকের গয়না ছেড়ে মড়ার হাড়ের মালা গলায় পরত। কিবা ‘আত্তি’ কিবা দিন গাল বাজিয়ে করত, বাবার নামগান করত। ‘শিবো হে—শিবো হে—শিবো হে! বাবার দয়াও তার ওপর খুব। পিথিমীর ‘আজা-আজড়া’ থেকে দেবতারা পর্যন্ত বাণগোঁসাইয়ের সঙ্গে এঁটে উঠত না। গোঁসাইয়ের একশো পরিবার। একটি মাত্র সন্তান—তাও কন্যে; কন্যের নাম ‘রুষা’ অর্থাৎ উষা। সেই রুষাকে দেখে লারায়ণের লাতির মন টলল। লারায়ণের লাতি একদিন লুকিয়ে ঢুকল বাণগোঁসাইয়ের বাড়িতে রুষাবতীর ঘরে। বাণগোঁসাই জানতে পেরে বলে—কাটব লারায়ণের লাতিকে। লারায়ণের আসন টলল, মুকুট লড়ল। লারায়ণ বললেন, নারদ, আসন কেনে টলে, মুকুট কেনে লড়ে, গুনে দেখ তো? লারদ খড়ি পেতে গুনে বললেন বিবরণ। নারায়ণ ছুটে এলেন, গোঁসাইয়ের বাড়িতে হানা দিলেন। অ্যাই লেগে গেল লড়াই। পিথিমী টলমল করতে লাগল। জলে আগুন লাগল, মাটির বুক ফেটে জল উঠতে লাগল, আকাশের তারা খসে পড়ল, ‘ছিষ্টি গেল গেল’ রব উঠল। লারায়ণ ‘চক্ক নিয়ে কেটে ফেললেন বাণগোঁসাইয়ের হাত-পা। তবু গোঁসাই হারে না, মরে না, মরে–আবার বাচে। তখন এলেন বাবা কালারুদ্দু। কালারুদ্দু আর লারায়ণ হরি আর হর; হরিহরের মিলন হল। বাবা কালারুদ্ মাঝে পড়ে রুবতীর সঙ্গে লারায়ণের লাতির বিয়ে দিলেন। হরি বললেন বাণগোসাইকে, তোমাকে আমি বর দোব। বর লাও। তোমার কাটা হাত-পা জোড়া লাগবে, তোমাকে পিথিমীর আজা করে দোব। বাণগোঁসাই বললেন–না। কাটা হাত-পা আমি চাই না। আজাও আমি হব না। বর যদি দেবে তো বর দাও কালারুদ্দুর সাথে আমারও যেন পুজো হয়। আমার জাত-জ্ঞাত পেজা সজ্জন ছাড়া বাবার গাজনে ভক্ত যেন কেউ না হয়। হরিহর দুজনেই বললেন—তথাস্তু। সেই জন্যেই তো গোঁসাইয়ের হাত-পা নাই, কেবল আছে ধড় অর্থাৎ শরীরটা আর মুণ্ডু। আর সেই কারণে। বাণগোঁসাই আজ কালারুদ্দুর ভক্ত দেবতা। আগে বাণগোঁসাইয়ের পুজো হবে, তবে বাবা পুজো নেবেন। এই কালারুদ্দুর বাবার দয়াই তাদের সম্বল। সেই ভরসাতেই কালারুদ্দু পুজোয় তারা নিৰ্ভয়ে দেবকাজে এগুতে পারে, নইলে তাদের পুণ্য কতটুকু?
সেই বাবা কালারুদ্দু লারায়ণের আশীর্বাদ আর কাহারদের জেবন-মরণের মালিক বাবা কত্তাঠাকুরের স্নেহ তাকে পেতেই হবে। এইবার বনওয়ারী বাবার প্রধান ভক্ত হয়ে চড়কের পাটায় চাপবেই। বনওয়ারী ঠিক করলে, যা হয় হবে। সে চাপবেই চড়কের পাটায়। পাপ যা আছে, সে খণ্ডিয়ে যাবে এই ‘বেরতোর’ অর্থাৎ ব্রতের পুণ্যে। কর্তাঠাকুরের দয়ায় বাবা। কালারুদ্র পেসাদে গাজনে পাটায় শোওয়া সহ্য হলে নিন্দুকের মুখ বন্ধ হবে। যদি সহ্য না হয়, সে যদি পাপের তাপে ওই চড়কের পাটার উপরেই ফেটে মরে যায়, তাতেও তার ‘দুষ্ক’ কি? ‘যাকে দশে করে ছি, তার জীবনে কাজ কি? সে আবার দশের মধ্যে গণ্য নয়, সে এ পাড়ার পেথম এবং প্রধান, সে মাতব্বর।
কিন্তু পানার শাস্তির প্রয়োজন। শাস্তি অবশ্য দিলেই হল। যে কোনো ছুতোয় একদিন ঘাড় ধরে অঙ্গখানি ঘেঁচে দিতে বনওয়ারী এখনই পারে। ঘাড়ে ধরলেই টিকটিকির মত পরানকেষ্টর পরান চা-ছাড়া হয়ে যাবেন। তবে তা সে করবে না। সত্যকার অন্যায় খুঁজে বার করতে হবে। সত্যিই কেষ্ট পেয়ে চলল সে পাকু মণ্ডলের কাছে!
কীর্তিটি জটিল;–‘ছিমান প্রাণকেষ্টোর একটি জটপাকানো কীত্তি।
পানুর মনিব পাকু মণ্ডল অতি বিচক্ষণ হিসাবি লোক। তার হিসাবের পাক অত্যন্ত জটিল খুলতে গেলেও জট পাকায়, সেই জন্যই তার আসল নামের পরিবর্তে পাকু নাম দিয়েছে লোকে। রতনের মনিবের স্কুল চেহারার জন্য নাম হয়েছে ‘হেদো মণ্ডল’। এ নামগুলি দেয় কিন্তু কাহারেরাই। এ বিষয়ে তাদের একটা প্রাক-পৌরাণিক মৌলিকত্ব আছে। বস্তু বা মানুষের আকৃতি বা প্রকৃতিকে লক্ষ্য করে নিজেদের ভাষাজ্ঞান অনুযায়ী বেশ সুসমঞ্জস নামকরণ করে। যাক সে কথা! পাকু মণ্ডলের কৃষাণ প্ৰাণকৃষ্ণ। সাত বছর ধরে কৃষাণি করছে। প্রতি বৎসরই কৃষাণেরা বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত মনিবের কাছে খোরাকির ধান ঋণ নিয়ে থাকে। বৎসরান্তে পৌষ মাসে ধান তুলে মাড়াই করে হিসাবনিকাশ হয়। শতকরা পঞ্চাশ হারে সুদ, অর্থাৎ এক মন ধান ঋণ নিয়ে দেড় মন দিতে হয়। বৎসরের মধ্যে শোধ না হলে সুদ ও আসল দেড় মনই পরবৎসর আসলে দাঁড়ায় এবং তার সুদ আসে তিরিশ সের এই চিরকালের নিয়ম। এছাড়াও অবশ্য আপদে বিপদে মনিবের কাছে সারের দাদন নিয়ে থাকে। কেউ কেউ মনিবদের বেচে দেয় সে সার। মনিবকে বলেচন্ননপুরের বাবুরা জোর করে নিয়ে গিয়েছে। সেটা ধার দাঁড়ায়। তার সুদ চলে টাকায় দু পয়সা। যাই হোক, এবার পাকু মণ্ডল তিন বৎসর পর হিসাবনিকাশ করে পানুর কাছে নিজের পাওনা ধার্য করে শোধের জন্য চেপে ধরেছিল। পানু তাই এ কীর্তি করেছে। নয়ান কাশীর রোগী হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই মারা পড়বে। বউ পাখী পালিয়েছে। নয়ান নয়ন মুদলে কে তার হয়ে দাবি-দাওয়া করবে? ওই বাঁশঝাড়টা তাই চক্ষু বুজে বেচে দিয়েছে। নয়ানের আবার বিয়ে-সাঙার চেষ্টা করেছে বটে বনওয়ারী, কিন্তু হবে বলে মনে হয় না। ওদের বেচাকেনার দলিলদস্তাবেজ নাই, পাড়ার দু-চারজনকে ডেকে মুখে বলাকওয়া হয়-‘আমি বেচলাম। এই পঞ্চজন সাক্ষী রইল।’ পাকু মণ্ডল কিন্তু হুঁশিয়ার লোক। তিনি ডেমিতে লিখিয়ে পানুর আঙুলের টিপছাপ নিয়েছেন। চৌহদ্দি করে নিয়েছেন; নিজের পাড়ার পঞ্চজন সাক্ষীরও সই নিয়েছেন। তিনি পানাকে মুখে মুখে বলেছেন—তুমি বেটা সহজ পিত্তর নও হে! বেটার চেহারা যেমন লিকলিকে চরিত্তিরও তেমনি একাবেকা। পাকু মণ্ডলের কাছে চৌহদ্দিসমেত সব বুঝে নিলে বনওয়ারী। কিন্তু মণ্ডলের কাছে বনওয়ারী ব্যাপারটা ফাস করে দিলে না। তার মত মাতব্বরের সে কাজ নয়। পাড়ার লোককে বাঁচাতে হবে আগে। পানুকে জব্দ করবার অস্ত্রটি সে নিজের হাতে রাখবে শুধু। পানুকে বধ করবার অস্ত্ৰ তার চাই।
এইসব কারণেই পাকু মণ্ডলের কাছে সত্য কথা না বলে বললো, একটা বাঁশঝাড় আছে ওখানে পানার। তা আপনাকে দেখে বলব পরে। একটুকু গোলমাল যেন অইচে আগছেন।
পাকু মণ্ডল শুনে হাসলে গোঁফের ফাঁকে ফাঁকে। চতুর লোক। বনওয়ারীর মনে হল পানার দোষ তো বটেই। কিন্তু মণ্ডল মহাশয়ও জেনেই করেছেন ব্যাপারটা। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সে। মণ্ডল মহাশয়রা এমন অনেক কাজই তাদের দিয়ে করান। তাদের বলেন না।
পাকু মণ্ডল কথাটা বলে নাই বনওয়ারীকে। দলিলে টিপছাপ দেবার সময় পানুর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, সে তখন সত্য কথা স্বীকার করেছিল। বলেও ছিল না, ওটা থাকুক মুনিব মশায়। পাকু মণ্ডল শোনেন নাই, শুধু দশ টাকা দামের পাঁচ টাকা কমিয়ে ওই দলিলেই পাণুর টিপছাপ নিয়ে বলেছেন—দখলের ভার আমার। তোকে ভাবতে হবে না। আমি প্রকাশও করব না। তু নিশ্চিন্ত থা। কিন্তু পানাকে আবারও তার জব্দ করবার প্রয়োজন হয়েছে, তাই বনওয়ারীর কাছে প্রকাশ করে দিলেন।
পথে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল বনওয়ারী। আটপৌরে-পাড়ায় কিসের জটলা? জটলা কি? বুকটা কেমন করে উঠল তার। পানা আটপৌরেদের নিয়ে সেই ব্যাপারটাকে উপলক্ষ করে তুলমাল করে তুলছে নাকি?
পরমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে—এই! এই! এই!
হা-হা করে কে হেসে উঠল। এমন দাজ জোরালো হাসি কে হাসে? তার বুকের হাপরটা তো কম জোরালো নয়! কে? এইবার তার কথার আওয়াজ পেলে বনওয়ারী এই এই এই!
সঙ্গে সঙ্গে শব্দ উঠছে—ঠক-ঠক-ঠক। দুটো কঠিন বস্তুতে ঘাত-প্রতঘাত চলছে। বুঝতে বিলম্ব হল না বনওয়ারীর, আটপৌরে পাড়ায় খেলা চলছে। পরম সাকরেদদের নিয়ে আখড়া বসিয়েছে। কিন্তু এমন জোরালো সাকরেদজবর মরদ কে আটপৌরে-পাড়ায়? পরমের সঙ্গে লাঠি ধরে এমন করে হাসে!
পরম হাসছে হা-হা করে।
হঠাৎ একটা ঢেলা এসে তার গায়ে পড়ল। চমকে উঠল বনওয়ারী। কে? বুকখানা আবার চমকে উঠল তার। এ ঢেলা কথা বলে—সে কথা বুঝেছে বনওয়ারী। হ্যাঁ, ঠিক। ওই যে কালোশশী বাঁশবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আঙুল নেড়ে ডাকছে তাকে। আঃ, এ কি বিপদ! ছাড়ালে ছাড়ে না? হে বাবাঠাকুর, তুমি রক্ষা কর! সে ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে কালোশশীকে জানালেনা। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে লাঠিখেলার আখড়া।
কালোশশী হেসে উঠল। অদ্ভুত মেয়ে! সাক্ষাৎ ডাকিনী! কামরূপের ডাকিনীর মত যেমন সাহস তেমনি মোহিনী। বনওয়ারী গেল না বলে কালোশশীই বেরিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চোখ দুটি টলটল করছে। ভয় পেলে বনওয়ারী। সম্ভবত কালোশশী মদ খেয়েছে। এখন তাকে কোনো বিশ্বাস নাই। অগত্যা সে ইঙ্গিতে আসতে নিষেধ করে নিজেই এগিয়ে গেল। কি বলছ?
কালোশশী তার হাত ধরে বললে দেখা নাই যে!
বনওয়ারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আটপৌরে-পাড়ার ঘেটুগান শোন নাই?
—শুনেছি। কালোশশী পিচ কাটলে। বললেওকে তা হলে ভয় কর? অর্থাৎ পরমকে?
ভয়?-হাসলে বনওয়ারী।–ভয় একজনাকে করি। বাবাঠাকুরকে। এবার আমি বাবাঠাকুরের আদেশ পেয়েছি ভাই, কালারুদ্দু বাবার চড়কে চাপতে হবে।
শিউরে উঠে কালোশশী তার হাত ছেড়ে দিলে।—না ভাই, তবে তোমাকে ছোব না। কপালে হাত ঠেকিয়ে সে প্রণাম জানালে দেবতাকে।
জয় বাবাঠাকুর, জয় কালারুদ্দু! তোমার দয়ায় পাপীর পাপ খণ্ডায়, যমদূতের হাত থেকে পাপীর পরানপুরুষকে ছিনিয়ে শিবদূতেরা কৈলাসে নিয়ে যায়। কানায় চোখ পায়, ঘোড়ায় হাটে, মানুষের মতি পাল্টায়। কালোশশীর মতি ফিরেছে।
কালোশশী হেসে বললে—পুণ্যির ভাগ দিতে হবে কিন্তুক।
তারপর আবার বললেগাজন হয়ে যাক তা’পরে মাতব কিন্তু একদিন। সে তৰ্জনী তুলে যেন শাসিয়ে দাবি করলে তার পাওনা। হ্যাঁ, পাওনা বৈকি!
বনওয়ারী মনে মনে প্রণাম করলে দেবতাকে। কালোশশী বললে—চুপ করে রইলে যে? সে বোধহয় বুঝেছে বনওয়ারীর মনের কথা। ওর ভুরু কুঁচকে উঠেছে। বনওয়ারী এবার হেসে প্রসঙ্গটা পাল্টাবার জন্যেই বললে-হাসছি পরমের কাণ্ড দেখে। বুড়ো বয়সে লাঠি নিয়ে মাতন দেখে হাসছি। কিন্তু এমন মরদ আটপৌরে-পাড়ায় কে হে, পরমের লাঠি ধরে হা-হা করে হাসে?
কালোশশী বললে—তোমার পাড়ার করালী।
চমকে উঠল বনওয়ারী।—করালী।
হ্যাঁ, করালী। কদিন ধরেই পরামশ্য চলছে আটপৌরেদের, করালীকে হাত করবে। জংশনে সেদিন নাকি দাঙ্গা লেগেছিল দুদলের খালাসীতে, করালী তাতে খুব জোর লাঠি ধরেছিল।
—করালী। বিস্মিত হল বনওয়ারী। সে তো শোনে নাই কথাটা!
–হ্যাঁ। তাই ওকে হাত করবে। তা ছাড়া ওকে পেলে অ্যাললাইনে ডাকাতি করবার খুব সুবিধে হবে। তাই ডেকেছে ওকে।
একটু চুপ করে থেকে বনওয়ারী বললে—তাই মতলব হচ্ছে নাকি? পরমের পাখা গজালছে তা হলে?
পাখা যার ওঠে যে, তার আর ঘোচে না। পালক উঠে যায় আবার গজায়। হাসলে কালোশশী।
বনওয়ারী ঘুরে বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে দূরের আখড়ার দিকে তাকালে। খটখট শব্দ এখন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। কিন্তু করালী শেষ পর্যন্ত? হে ভগবান!
চললাম। লোক। মৃদুস্বরের দুটি কথার সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারী ফিরে তাকিয়ে দেখলে, কালোশশী আত্মগোপন করে চলে যাচ্ছে নিবিড়তর বনের মধ্যে। বনওয়ারী ডেকে বললে— একটা কথা। করালী কি দলে মিশেছে? জান?
একবার দাঁড়াল কালোশশী। একটু ভেবে বললে—তা জানি না। এখনও মনে লাগছে দলে মেশে নাই। তবে চারে ভিড়েছে। তা’পরেতে টোপে ধরলে ঘাই মারবে। মনের মতলব আমি বুঝি তো!
কালোবউ চলে গেল। বনওয়ারী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সাপের হচি বেদেতে চেনে। পরমকে কালোবউ ঠিক চেনে। হে ভগবান, আবার কাহারপাড়ায় দারোগা আসবে, হাঁকবে এই করালী কাহার! জমাদার হাঁকবে—করালীয়া! আরে সারোয়া!