হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গল
হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে। দেবতা কি যক্ষ কি রক্ষ বোঝা যাচ্ছে না। সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কাহারেরা।
কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক—অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যন্ত অল্প-পরিসরের মধ্যে নদী মোড় ফিরেছে, সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মত। বর্ষাকালে সবুজ মাটিকে বেড় দিয়ে পাহাড়িয়া কোপাইয়ের গিরিমাটিগোলা জলভরা নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয়, শ্যামলা মেয়ের গলায় সোনার হাঁসুলী; কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জল যখন পরিষ্কার সাদা হয়ে আসে—তখন মনে হয় রূপোর হাঁসুলী। এই জন্যে বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক। নদীর বেড়ের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকে ঘন বাঁশবনে ঘেরা মোটমাট আড়াই শো বিঘা জমি নিয়ে মৌজাবাঁশবাঁদি, লাট্ জাঙলের অন্তর্গত। বাঁশবাঁদির উত্তরেই সামান্য খানিকটা ধানচাষের মাঠ পার হয়ে জাঙল গ্রাম। বাঁশবাঁদি ছোট গ্রাম; দুটি পুকুরের চারি পাড়ে ঘর-তিরিশেক কাহারদের বসতি। জাঙল গ্রামে ভদ্রলোকের সমাজ–কুমার-সদ্গোপ, চাষী-সদ্গোপ এবং গন্ধবণিকের বাস, এ ছাড়া নাপিতকুলও আছে এক ঘর, এবং তন্তুবায় দু ঘর। জাঙলের সীমানা বড়; হাঁসিল জমিই প্রায় তিন হাজার বিঘা, পতিতও অনেক–নীলকুঠির সাহেবদের সায়েবডাঙার পতিতই প্রায় তিন শো বিঘা ৷
সম্প্রতি জাঙল গ্রামের সদ্জাতির ভদ্রলোক বাবু মহাশয়েরা বেশ থানিকটা ভয়ার্ত হয়ে উঠেছেন। অল্প আড়াই শো বিঘা সীমানার বাঁশবাঁদি গ্রামের অর্থাৎ হাঁসুলী বাঁকের কাহারেরা বলছে— বাবু মশায়ের ‘তরাস’ পেয়েছেন। অর্থাৎ ত্ৰাস। পাবারই কথা। রাত্রে কেউ যেন শিস দিচ্ছে। দিনকয়েক শিস উঠেছিল জাঙল এবং বাঁশবাঁদির ঠিক মাঝখানে ওই হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের প্রথম বাঁকিতে—বেলগাছ এবং স্যাওড়া ঝোপে ভর্তি, জনসাধারণের কাছে মহাআশঙ্কার স্থান ব্রহ্মদৈত্যতলা থেকে। তারপর কয়েকদিন উঠেছে জাঙলের পূর্ব গায়ে কোপাইয়ের তীরের কুলকাটার জঙ্গল থেকে। তারপর কয়েকদিন শিস উঠেছিল আরও খানিকট। দূরে—ওই হাঁসুলী বাঁকের দিকে স’রে। এখন শিস উঠছে বাঁশবাদির বাশবনের মধ্যে কোনখান থেকে।
বাবুরা অনেক তদন্ত করেছেন। রাত্রে বন্দুকের আওয়াজ করেছেন, দু-একদিন লাঠিসোঁটা বন্দুক নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে হৈ-চৈ করেছেন, খুব জোরালো হাতখানেক লম্বা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারিদিক দেখেছেন, তবু কিছুরই সন্ধান হয় নাই। কিন্তু শিস সেই সমানেই বেজে চলেছে। ক্রোশখানেক দূরে থানা। সেখানেও খবর দেওয়া হয়েছে; ছোট দারোগাবাবুও এসেছিলেন দিন তিনেক রাত্রে, কিন্তু তিনিও কোন হদিস পান নাই। তবে নদীর ধারে ধারে শব্দটা ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা ঠিক। এইটাই তিনি সমস্ত শুনে ঠাওর ক’রে গিয়েছেন।
দারোগাবাবু পূর্ববঙ্গের লোক-তিনি বলে গিয়েছেন, নদীর ভিতর কোন একটা কিছু হচ্ছে। ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস।‘ ভাবেন, খানিকট ভাবেন। সন্ধান মিললে পর খবর দিবেন।
‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বার মাস’–কথাটা অবশ্য ডাকপুরুষের বচন–পুরুষানুক্রমে চলেও আসছে দেশে। সে কথা কখনও মিথ্যা নয়, কিন্তু দেশভেদে বচনেরও ভেদ হয়, তাই ওকথাটা হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির জাঙল গ্রামে ঠিক খাটে না। বাংলাদেশের এই অঞ্চলটাতেই খাটে না। সে হল বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল। জাঙল গ্রামের ঘোষ-বাড়ির এক ছেলে ব্যবসা করে। কলকাতায়। কয়লা বেচা-কেনা করে, আর করে পাটের কারবার। বাংলাদেশের সে অঞ্চল। ঘোষবাবু ঘুরে এসেছে। সে বলে-সে দেশই হল নদীর দেশ। জলে আর মাটিতে মাখামাখি। বারটি মাস ভরা নদী বইছে; জোয়ার আসছে, জল উছলে উঠে নদীর কিনারা ছাপিয়ে সবুজ মাঠের মধ্যে ছলছলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে; জোয়ারের পর আসছে ভাটার পালা, তখন মাঠের জল আবার গিয়ে নামছে নদীতে; নদীর ভরা কিনারা খালি হয়ে কুল জাগছে। কিন্তু তাও কিনারা থেকে বড়জোর দু-আড়াই হাত; তার বেশি নামে না। সে নদীও কি এমন-তেমন, আর একটিদুটি? সে যেন গঙ্গা-যমুনার ধারা, অইথই করছে, থমথম করছে; এপার থেকে ওপর পারাপার করতে এ দেশের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। আর সে ধারা কি একটি? কোথা দিয়ে কোন ধারা এসে মিশল, কোন ধারা কোথায় পৃথক হয়ে বেরিয়ে গেল—তার হিসাব নাই। সে যেন জলের ধারার সাতনরী হার,-হাঁসুলী নয়। নদীর বাঁকেরই কি সেখানে অন্ত আছে? ‘আঠার বঁকি’, ‘তিরিশ বঁকি’র বাঁকে বাঁকে নদীর চেহারা সেখানে বিচিত্র। দুধারে সুপারি। আর নারিকেল গাছঃ-সারি নয়—বাগিচা নয়-সে যেন অরণ্য। সঙ্গে আরও যে কত গাছ, কত লতা, কত ফুল, তা যে দেখে নাই সে কল্পনা করতে পারবে না। সে দেখে আশ মেটে না। ওই সব নারিকেল-সুপারির ঘন বনের মধ্য দিয়ে বড় নদী থেকে চলে গিয়েছে সরু সরু খাল, খালের পর খাল। সেই খালে চলেছে ছোট ছোট নৌকা। নারিকেল-সুপারির ছায়ার তলায় টিন আর বাঁশের পাশ দিয়ে তৈরি ঘরের ছোট ছোট গ্রাম লুকিয়ে আছে। সরু খালগুলি কোনো গাঁয়ের পাশ দিয়ে, কোনো গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে–গ্ৰাম থেকে গ্রামান্তরে। ও-দেশের ছোট নৌকোগুলি এ-দেশের গরুর গাড়ির মত। নৌকাতেই ফসল উঠছে ক্ষেত থেকে খামারে, খামার থেকে চলেছে হাটে-বাজারে, গঞ্জে-বন্দরে। ওই নৌকোতেই চলেছে। এ গায়ের মানুষ ও—গাঁয়ের কুটুমবাড়ি, বহুড়ি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি, মেয়ে আসছে বাপের বাড়ি; মেলা-খেলায়। চলেছে ইয়ারবন্ধুর দল। চাষী চলেছে মাঠে-তাও চলেছে নৌকোতেই, কাস্তে নিয়ে লাঙল নিয়ে একাই চলে নৌকো বেয়ে। শরতের আকাশের ছায়াপথের মত আদি-অন্তহীন নদী, সেই নদীতে কলার মোচার মত ছোট্ট নৌকের মাথায় বসে-বাঁ হাতে ও বাঁ বগলে হাল ধরে, ডান হাতে আর ডান পায়ে বৈঠা চালিয়ে চলেছে। ঘোষের ছেলে শতমুখে সে দেশের কথা বলে ফুরিয়ে উঠতে পারে না। এ নদীর ধারে বাসা-ভাবনার কথাই বটে। ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ঘোষের ছেলের চোখে ভয় ফুটে ওঠে-সময়ে সময়ে শরীরে কাঁটা দেয়। ওই নদীর সাতনরী হার আরও নিচে গিয়ে এক হয়ে মিশেছে। তখন আর নদীর এপার ওপার নাই। মা-লক্ষ্মীর গলার সোনার সাতনরী হয়ে উঠেছে যেন মনসার গলার অজগরের বেড়; নদী সেখানে অজগরের মতই ফুসছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলে ফুলে উঠছে, যেন হাজার ফণা তুলে দুলছে। এরই মধ্যে কখনও ওঠে আকাশে টুকরো খানেক কালো মেঘ-দেখতে দেখতে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় তার উপর, যেন কেউ আগুনে-গড়া হাতের আঙুলের ঘা মেরে বাজিয়ে দেয় ওই কালো মেঘের ‘বিষমঢাকি’র বাজনা। যে বাজায় তার মাথায় জটার দোলায় আকাশ-পাতাল দুলতে থাকে। অজগর তখন তার বিরাট অঙ্গ আছড়ে আছড়ে হাজার ফণায় ছোবল মেরে নাচে-কুঁসিয়ে ফুঁসিয়ে মাতনে মাতে। নদীর জলে তুফান জাগে। সে তুফানে বাড়ি ঘর গ্রাম-গোলা-গঞ্জ বন্দর-মানুষ গরু কীটপতঙ্গ সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। আবার তুফান নাই, ঝড় নাই, বাইরে দেখতে-শুনতে সব শান্ত স্থির, কোথাও কিছু নাই।–হঠাৎ নদীর ধারের গ্রামের আধখানা কঁপতে লাগল, টলতে লাগল-দেখতে দেখতে কান্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল অজগরের মত নদীর অথৈ গর্ভে। মানুষকে সেখানে বার মাস এক চোখ রাখতে হয় আকাশের কোলে-কালো মেঘের টুকরোর সন্ধানে আর এক চোখ রাখতে হয় সবুজ ঘাসে-ফসলে-ঢাকা চন্দনের মত মাটির বুকের উপর-ফাটলের দাগের খোজে-ভাবনা সেখানে বার মাসই বটে।
ছোট দারোগা সেই দেশের মানুষ, তাই ও-কথা বলছেন। কিন্তু হাঁসুলী বাঁকের দেশ আলাদা। হাঁসুলী বাঁকের দেশ কড়াধাতের মাটির দেশ। এ দেশের নদীর চেয়ে মাটির সঙ্গেই মানুষের লড়াই বেশি। খরা অর্থাৎ প্রখর গ্ৰীষ্ম উঠলে নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়, ধু-ধু করে বালি–এক পাশে মাত্র একহাঁটু গভীর জল কোনোমতে বয়ে যায়-মা—মরা ছোট মেয়ের মত শুকনো মুখে দুৰ্বল শরীরে, কোনোমতে আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে। মাটি তখন হয়ে ওঠে। পাষাণ, ঘাস যায় শুকিয়ে, গরম হয়ে ওঠে আগুনে-পোড়া লোহার মত; কোদাল কি টামনায় কাটে না, কোপ দিলে কোদালা-টোমনারই ধার বেঁকে যায়; গাইতির মত যে যন্ত্র সে দিয়ে কোপ দিলে তবে খানিকটা কাটে, কিন্তু প্রতি কোপে আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ে। খাল বিল পুকুর দিঘি চৌচির হয়ে ফেটে যায়। তখন নদীই রাখে মানুষকে বাঁচিয়ে; জল দেয় ওই নদী। নদীর ভাবনা এখানে বার মাসের নয়।
নদীর ভাবনা এখানে চার মাসের। আষাঢ় থেকে আশ্বিন। আষাঢ় থেকেই মা-মরা ছোট মেয়ের বয়স বেড়ে ওঠে। যৌবনে ভরে যায়। তার শরীর। তারপর হঠাৎ একদিন সে হয়ে ওঠে ডাকিনী। কাহারদের এক-একটা ঝিউড়ী মেয়ে হঠাৎ যেমন এক-একদিন বাপ-মা-ভাইভাজের সঙ্গে ঝগড়া করে, পাড়া-পড়শীকে শাপ-শাপান্ত করে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে গায়ের পথে, চুল পড়ে এলিয়ে, গায়ের কাপড় যায় খসে, চোখে ছোটে আগুন, যে ফিরিয়ে আনতে যায় তাকে ছুঁড়ে মারে ইট পাটকেল পাথর, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলে কুলে কালি ছিটিয়ে দিয়ে, তেমনিভাবেই সেদিন ওই ভরা নদী অকস্মাৎ ওঠে ভেসে। তখন একেবারে সাক্ষাৎ ডাকিনী! ক্ষমা নাই—ঘেন্না নাই, দিগম্বরীর মত হাঁক ছেড়ে, ডাক পেড়ে, শতমুখে কলকল খলখল শব্দ তুলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে। গ্রাম বসতি মাঠ শ্মশান ভাগাড়, লোকের ঘরের লক্ষ্মীর আসন থেকে আঁস্তাকুড়—যা সামনে পড়ে মাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে চলে যায়। সেও এক দিন দুদিন। বড়জোর কালে-কম্মিনে চার-পাঁচ দিন পরেই আবার সংবিৎ ফেরে। কাহারদের মেয়েও যেমন রাগ পড়লে এসে চুপ করে গায়ের ধারে বসে থাকে, তারপর এক পা, দুপা করে এসে বাড়ির কানাচে শুয়ে গুনগুন করে কাঁদে কি গান করে, ঠিক ধরা যায় নাতেমনই ভাবে কোপাইও দুদিন বড়জোর চার দিন পরে আপনি কিনারায় নেমে আসে, কিনারা জাগিয়ে খানিকটা নিচে নেমে কুলকুল শব্দ করে বয়ে যায়। চার মাসের মধ্যে এমনটা হয় পাঁচ বার কি সাত বার, তার বেশি নয়। তার মধ্যে হয়ত এক বার, কি দু তিন বৎসরে এক বার ক্ষ্যাপামি করে বেশি। কোপাই নদী ঠিক যেন কাহার-কন্যে।
তবে কন্যার পাপে কুল নষ্ট। কোপাইয়ের বন্যায়। ঘরঢ়োর না ভাঙলেও ভুগতে হয় বৈকি। জল সরে গেলে ভিজে মাটি থেকে ভাপ উঠতে আরম্ভ করে-মাছিতে মশাতে ভরে যায় দেশ। মানুষ চলে, মানুষের মাথার উপর ঝাকবন্দি মশা সঙ্গে চলে ভনভন শব্দ তুলে, মানুষের শরীর শিউরে ওঠে, তাদের কামড়ে অঙ্গ দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে ওঠে। গরুর গায়ে মাছি বসে থাকে চাপবন্দি হয়ে, লেজের ঝাপটানিতে তাড়িয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তারা অনবরত শিঙ নাড়ে, কখনও কখনও চার পা তুলে লাফাতে থাকে। তাকে সাহায্য করে চাষী, তালপাতা চিরে বঁটার মত করে বেঁধে তাই দিয়ে আছড়ে মাছি মারে, তাড়িয়ে দেয়। এর কিছুদিন পরেই আরম্ভ হয় ‘মালোয়ারী’র জ্বর।
আরও আছে-কোপাইয়ের বন্যার দুর্ভোগ। সাঁওতাল পরগনার পাহাড়িয়া নদী কোপাইয়ে ওই দু-তিন বৎসর অন্তর যে আকস্মিক বন্যা আসে যাকে বলে ‘হাড়পা বান’, সেই বন্যার স্রোতে পড়ে কৃচিৎ কখনও একটা-দুটো ‘গুলবাঘা’ ভেসে এসে হাঁসুলী বাঁকের এই খাপছাড়া বাঁকে, বাঁশবাদি গায়ের নদীকূলের বাঁশবনের বেড়ার মধ্যে আটকে যায়। কখনও মরা, কখনও জ্যান্ত। জ্যান্ত থাকলে বাঘা এই বাঁশবনেই বাসা বাঁধে। আর আসে ভালুক; দুটো-একটা প্রতি বৎসরেই আসে ও-বেটারা। কিন্তু আশ্চৰ্য, ও-বেটারা মরে কখনও আটকে থাকে না বাঁশবনে। জ্যান্ত বাঘ কদাচিৎ আসে, মরাও ঠিক তাই। গোটা এক পুরুষে দুটো এসেছে-একটা মরা, একটা জ্যান্ত। মরাটাকে টেনে বের করে জেলার সায়েবকে সেটার চামড়া দেখিয়ে জাঙলের ঘোষেরা বন্দুক নিয়েছে। জ্যান্তটাকে কাহাররাই মেরেছিল, সেটা দেখিয়ে বন্দুক নিয়েছে গন্ধবণিকেরা। ভালুক এলে কাহারেরাই মারে, প্রতিবার বন্যার পর বাঁশবন খুঁজে-পেতে দেখতে পেলে লাঠিসোটা খোঁচা বল্লম তীরন্ধনুক নিয়ে তাড়া করে মেরে হইহই করে নৃত্য করে; নিজেদের বীৰ্যে মোহিত হয়ে প্রচুর মদ্যপান করে। আর এখানেই আছে বুনো শুয়োর, কাহারদের লাঠিসোটা খোঁচা বল্লম সত্ত্বেও এখানে বুনো শুয়োরের একটা দস্তুরমত আডা-আড়ত গড়ে উঠেছে। অবশ্য বাঁশবাদির বাঁশবেড়ের জঙ্গলে নয়, এখান থেকে খানিকটা দূরে সাহেবডাঙায়। কাহারদের দৌরাত্ম্যে ওরা বাঁশবাদির এলাকায় বাসা বেঁধে রক্ষা পায় না। ওদের বড় আড্ডা হল প’ড়ো নীলকুঠির কুঠিবাড়ির জঙ্গলে। রাত্রে শূকরের দল ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে নদীর ধারে ছুটে বেড়ায়, দীতে মাটি খুঁড়ে কন্দ তুলে খায়। কখনও কখনও দুটো—একটা ছটকে এসে গায়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। অকস্মাৎ কেউ কেউ সামনে পড়ে জখম হয়। তখন কাহারেরা ওদের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করে। অস্ত্র নয়, ফাঁদ। বুনো শুয়োর মারবার আশ্চর্য কৌশল ওদের। হাতখানেক লম্বা বাখ্যারির ফালির মাঝখানে আধ হাত লম্বা শক্ত সরু দড়ি বেঁধে প্ৰান্তভাগে বাধে ধারালো বড়শি। বড়শিতে টোপের মত গেথে দেয় কলা এবং পচুই মদের ম্যাত। এমনই আট-দশটা ছড়িয়ে রেখে দেয় পথে প্রান্তরে। মদের ম্যাতার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে শুয়োর ব্যাটারা মাটি শূকে শূকে এসেই পরমানন্দে গাপ করে মুখে পুরে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে বড়শি গেথে যায় জিভে অথবা চোয়ালের মধ্যে। তখন পায়ের খুর দিয়ে টেনে বড়শি ছাড়াতে চেষ্টা করে-তাতে ফল হয় বিপরীত, চেরা খুরের মধ্যে বঁড়শির দড়ি ঢুকে গিয়ে শেষে আটকায় এসে বাখ্যারির ফালিতে। একদিকে বড়শি আটকায় জিভে, অন্যদিকে দড়ি পরানো খুর আটকায় বাখ্যারিতে, বেটা শুয়োর নিতান্তই শুয়োরের মত ঠ্যাঙ তুলে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সকালে কাহারেরা আসে। লগুড় হাতে, এসেই দমাদম ঠেঙিয়ে মেরে টেনে নিয়ে গিয়ে ভোজনযজ্ঞে লাগিয়ে দেয়।
আর আসে মধ্যে মধ্যে কুমির। প্রায়ই সব মেছো কুমির। কুমির এসে জাঙলের বাবুভাইদের মোছ-ভরা পুকুরে নামে। সে আর উঠতে চায় না। বাবুরা বন্দুক নিয়ে দুমদাম গুলি ছেড়ে, কুমির ভুস করে ডোবে আবার এক কোণে নাকটি জাগিয়ে ওঠে। কাহারেরা পাড়ের উপর বসে খুঁকো টানে আর আমোদ দেখে; তবে হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাদির ঘাটের পাশে যে দহটা আছে, সেখানে আসে সর্বনেশে মানুষ—গরু-খেকো বড় কুমির—এখানকার লোকে বলে, ‘ঘড়িয়াল’। তখন কাহারেরা চুপ করে বসে থাকে না। তারা বের হয় দল বেঁধে; সর্বাঙ্গে হলুদ মাখে, সঙ্গে নেয় কোদাল কুড়ুল লাঠি সড়কি, বড় বড় বাঁশের ডগায় বাধা শক্ত কাছির ফাঁস। নদীর ধারে ধারে খুঁজতে থাকে কুমিরের আস্তানা। পাড়ের ধারে গর্তের মধ্যে শয়তানের আস্তানার সন্ধান পেলে মহা উৎসাহে তারা গর্তের মুখ বন্ধ করে উপর থেকে খুঁড়তে থাকে সেই গর্ত। তারপর গর্তের নালার মধ্যে অবরুদ্ধ শয়তানকে তারা হত্যা করে। কখনও সুকৌশলে ফ্যাস পরিয়ে বেঁধে টেনে এনে নিষ্ঠুরভাবে দু-তিন দিন ধরে ঠেঙিয়ে মারে। গর্তে কুমির না পেলে গোয়ালপাড়ার গোয়ালাদের মহিষের পাল এনে সেগুলোকে নামিয়ে দেয় দহে। মহিষে জল তোলপাড় করে তুলে ঘড়িয়ালকে বের করে। তারপর কুন্তীরবন্ধের পালা। সে প্রায় এক দক্ষযজ্ঞ। কুন্তীর বেটাকে দক্ষের সঙ্গে তুলনা করা কখনই চলে না, কিন্তু কাহারদের মাতন—সে শিবঠাকুরের অনুচরদের নৃত্য ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।
মোটকথা, এ দেশে-হাঁসুলীর বাঁকে নদীর ভাবনা খুব বেশি নয়; যেটুকু আছে, তার একটুমাত্র ‘মালোয়ারী’র পালাটা ছাড়া সকল ভাবনার ভার একা বাঁশবাদির কাহারদের উপর। কিন্তু এবারের এই শিস দেওয়ার ব্যাপারে তারাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম তাদের ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা চোর ডাকাতের নয়, ব্যাপারটা বৃন্দাবনী ধরনের কিছু। তারা ক্ষেপেও উঠেছিল। কারণ এই অঞ্চলের বৃন্দাবনী ব্যাপারের নায়িকারা একশো জনের মধ্যে নিরেনধ্বই জনই হয় তাদের ঘরের মেয়ে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের এ ধারণা পাল্টে গিয়েছে। এখন তাদের ধারণা ব্ৰহ্মদৈত্যতলার ‘কর্তা’ কোনো কারণে এবার বিশেষ রুষ্ট হয়েছেন। হয়ত—বা তিনিই ওই বেলবন ও শেওড়া জঙ্গল থেকে বিদায় নিয়ে নদীর ধারে ধীরে চলে যাচ্ছেন–শিস দিয়ে সেই কথা জানিয়ে দিয়ে চলেছেন হাঁসুলী বাঁকের অধিবাসীদের। এ নিয়ে তাদের জল্পনা-কল্পনা চলছিল। ঘরে ঘরে কুলঙ্গিতে সিঁদুর মাখিয়ে পয়সাও তুলেছে তারা, এবং এ বিষয়ে জাঙলের ভদ্রলোক মহাশয়দের উদাসীনতা দেখে তারা অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছে। বেচারি কাহারদের আর সাধ্য কি? জ্ঞানই-বা কতটুকু? তবু একদিন সন্ধ্যায় ওরাই বসালে মজলিস। কিন্তু কাহারদের আবার দুটি পাড়া, বেহারাপাড়া আর আটপৌরে পাড়া। বেহারা পাড়ার মাতব্বর বনওয়ারী আটপৌরেদের সম্পর্কে ঘাড় নেড়ে হতাশা প্ৰকাশ করে বললে-বছরে একবার পুজো, তাই ভাল করে দেয় না। তা ‘লতুন’ পুজো দেবে!
নিমতেলে পানূর ভাল নাম প্ৰাণকৃষ্ণ। পাড়ায় দুজন প্ৰাণকৃষ্ণ থাকায় এ প্রাণকৃষ্ণের বাড়ির উঠানের নিমগাছটির অস্তিত্ব তার নামের আগে জুড়ে দিয়ে নিন্মতেলে পানু বলে ডাকা হয়। সে বললে-জান মুরুবি, কথাটা আমি বাপু ভয়ে বলি নাই এতদিন। তা কথা যখন উঠল, বুয়েছ। কিনা, আর কি বলে যেয়ে-কাণ্ড যখন খারাপ হতেই চলেছে, তখন আর চেপে থাকাটা ভাল লয়। কি বলা?
গোটা মজলিসটির লোকের চোখ তার উপর গিয়ে পড়ল। বনওয়ারী বসে বসেই ঘেঁষড়ে খানিকটা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলে—কি হয়েছেন বল দিকিনি?
মুখ খুলেছিল পানু, কিন্তু তার আগেই একটা সুচালো বাঁশির শব্দ বেজে উঠল। সেই শিসের শব্দ! শব্দটা আসছে-বাঁশবাদি গায়ের দক্ষিণের বাঁশবন থেকে। সকলে চকিত হয়ে কান খাড়া করে চুপ করে রইল। বনওয়ারী বসে ছিল উত্তর মুখ করে, বা হাতে ছিল ইকো—সে ডান হাতটা কাঁধের উপর তুলে, পিছনে তর্জনীটা হেলিয়ে ইঙ্গিতে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিলে সকলকে। পিছনে দক্ষিণ দিকে বাঁশবেড়ের মধ্যে শিস বাজছে।
আবার বেজে উঠল শিস! ওই!
কাহার-বাড়ির মেয়েরা সব উদ্বিগ্ন মুখে উঠানে নেমে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে। কারও হাতে রান্নার হাত; কেউ ছেলে ঘুম পাড়াচ্ছিল, তার কোলে ছেলে; কেউ কঁকুই দিয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল, তার বা হাতে ধরা রইল চুলের গোছা, ডান হাতে কাঁকুই; কেউ কেরোসিনের ডিবে জ্বেলে ঘরের পিছনে দেওয়াল থেকে ঘুটে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিল, সে কেরোসিনের ডিবে আর খানচারেক ঘুটে হাতেই ছুটে এসে দাঁড়াল দশজনের মধ্যে। কেবল বদ্ধকালা বুড়ি সুচাঁদ কাহারনী সকলের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল; সে উপরের অঙ্গের কাপড়ের আঁচলটা নিঃসঙ্কোচে খুলে কঁথা-সেলাই-করা সুচে পুরনো কাপড়ের পাড়ের কস্তা পরিয়ে একটা লম্বা ছেড়া জুড়ছিল, ভুরু কুঁচকে নীরব প্রশ্ন তুলে সকলের দিকে চেয়ে সে শুধু বসে রইল। কিছু বুঝতে না পেরে অবশেষে সে তার স্বাভাবিক মোটা গলায় অভ্যাসমত চিৎকার করে প্রশ্ন করলে–কি?
সুচাঁদের মেয়ে বসন-অৰ্থাৎ বসন্ত, মায়ের বিধিরত্বের জন্য লজ্জা পেয়ে পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললে—মর তুমি।
সুচাঁদ আবার প্রশ্ন করলে—এবং আরও বেশি একটু চিৎকার করেই বললে-বলি, হল কি? উঠে দাঁড়ালি যে সবাই?
এবার নাতনী পাখী–অর্থাৎ বসন্তর মেয়ে পাখী এসে তার মুখের কাছে চেঁচিয়ে বললে—শি—স।
—শিস? তা ওই জাঙলের ছোড়ারা কেউ দিচ্ছে।
–না-না। হাত নেড়ে বুঝিয়ে বললে—সেই শি-স!
এই মুহূর্তটিতেই আবার শিস বেজে উঠল।
পাখী দিদিমাকে ঠ্যালা দিয়ে বললে-ওই শোন। কিন্তু সুচাঁদ চকিত হয়ে পাখীর মুখে হাত চাপা দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। শুনতে পেয়েছে সে। এবং সে উঠে দাঁড়াল; প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পা দিয়ে অবধি সে গায়ে-ঘরে বুকে কাপড় নামমাত্রই দিয়ে থাকে, তাও দেয় মেয়ে বসন্তের অনুরোধে। এবং সেই উদ্দেশ্যেই আজ এই মুহূর্তে ছেড়া আঁচলটা সে সেলাই করছিলকিন্তু ছেড়া আঁচলটা টেনে গীয়ে তুলতে সে ভুলেই গেল। আঁচলটা টানতে টানতে এসে বনওয়ারীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে খুব চিৎকার করে বললে-দেবতার পুজো-আচ্চা করাবি, না গাড়োপাড়ে যাবি?
বনওয়ারীও খুব চিৎকার করে বেশ ভঙ্গি করে হাত-পা নেড়ে বললে—দেবতার পুজো কি আমা-তোমাদের থেকে হয় পিসি? বাবুরা কিছু না করলে আমরা কি করব?
–তবে মরবি? মরতে যে তোদের মরণই হয় আগে?
-–তা কি করবি বল? ভগবানের বিধেন যা তাই তো হবেন। গাঁয়ের দক্ষিণ দিক আগুলে যখন আছি, আর আমরাই যখন কি বলে-ছিষ্টির ওঁচা, তখন আগেই আমাদিগে মরতে হবেন বৈকি।
নিমাতেলে পানু বলে উঠল-না মুরুব্বি। এবার খ্যানত হলে আগে তোমার ওই চৌধুরী—বাড়িতেই হবেন। তা আমি জানি।
বনওয়ারী ভুরুতে এবং দৃষ্টিতে সুগভীর বিস্ময় ও প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে বললে-ব্যাপারটা কি বল দি-নি?
সুচাঁদ বললে–কি? কি বললি?
–কিছু লয় গো। তোমাকে বলি নাই। বাস দিকি তুমি।
পাখী এসে সুচাদকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে বললে—বস এইখানে।
পানু বললে—ইবারে যে পুজোটি গেল মুরুবি, তার পাঠাটি খুঁতো ছিলেন।
সবিস্ময়ে সকলে বলে উঠল-থুতো ছিল? মেয়েরা শিউরে উঠল–হেই মা গো!
পানু বৃত্তান্তটি প্রকাশ করলে। পানুর ছাগলের একটি বাচ্চাকে খুব ছোটতে কুকুরে কামড়েছিল।–হেই এতটুন বাচ্চা তখন তোমার, তখন এক শালার কুকুর খপ করে ধরেছিল। পেছাকার পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিল লটবরের মা, ঝাটা হাতে ছিল—কুকুরটাকে এক বঁটা মেরে ছাড়িয়ে দিয়েছিল; কিন্তুক দুটি দাঁত বসে গিয়েছিল। হলুদ—মলুদ লাগিয়ে সেরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম-ওটাকে খাসি করে দেব। তা তোমার এখন-তখন করে হয় নাই, বড় হয়ে গেল। তখন ভেবেছিলাম, কেটে-মেটে একদিন পাড়ায় ভাগ দিয়ে খেয়ে লোব। ই বছর বুঝলে কিনা, একদিন শালার পাঁঠা করেছে কি-চলে গিয়ে ঢুকেছে চৌধুরী-বাড়ি; আর খাবি তো খাবাবুদের শখ করে লাগানো-কি বলে বাপু, সেই ফুলের গাছ। এখন ধরে বেঁধে রেখেছিল। খোজে খোজে আমি গেলাম। গেলাম তো চৌধুরীদের গোমস্ত মারলে আমাকে তিন থাপ্নড়। তারপর সেই গাছ দেখিয়ে’ বললে-কলকাতা থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে কলম এনেছিলাম। তোর দাম দেওয়া লাগবে কলমের। আমি কি বলব? দেখলাম-বেটা পাঁঠা গাছটার পাতা—ডাল খেয়েই ক্ষ্যান্ত হয়ে নাই।–টেনে-উপড়ে একেবারে গাছের নেতার মেরে দিয়েছে। আমি তো পায়ে–হাতে ধরলাম। শেষমেশ পাঠাটাকে দিয়ে খালাস। আমি বললাম-কিন্তু দেখেন মশায়, খুঁতো পাঁঠা, কেটে ফিষ্টি-মিষ্টি করে খাবেন, কিন্তুক দেবতা-টেবতার থানে যেন পুজো-টুজো দেবেন। না মশায়। তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি, নিজের বেটা ওই লটবরের মাথায় হাত দিয়ে কিরে করে বলতে পারি মুরুবি, আমি দুবার বলেছিলাম-খুঁতো পাঁঠা, খুঁতো পাঁঠা, হেই মশায়, যেন দেবতা-থানে দেবেন না। তা এবার বেহ্মদত্যিতলায় কত্তার পুজোতে দেখি–পেরথম চোটেই চৌধুরীবাবুদের সেই পাঁঠা পড়ে গেল। ’এশ্বর’ জানেন-আমার দোষ নাই।
সুচাঁদ খুব বেশি সরে যায় নাই। কাছেই বসে একদৃষ্টি পানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলি শুনছিল; তারই হাতের ডিবেটার আলো পরিপূর্ণভাবে পড়েছিল পানুর মুখের উপর। সে এবার প্রায় কথাগুলিই বুঝতে পেরেছে। সে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললে-ভাল লয়, ভাল লয়, এ কখনও ভাল লয়।
সমস্ত মজলিসটা থমথম করে উঠল। মনে হল, সুৰ্চাদের মুখ দিয়ে যেন দেবতাই ওই কথাগুলি বললেন-ভাল লয়, ভাল লয়, এ কখনও ভাল লয়।
সকলে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল।
সেই থমথমে মজলিসে সুচাঁদ আবার আরম্ভ করলে—এই বাবার দয়াতেই হাঁসুলী বাঁকের যা কিছু। ওই চৌধুরীরা তিন পুরুষ আগে তখন গেরুস্ত, সাহেবদের নীলকুঠির গোমস্তা। কুঠিরও তখনও ভাঙা-ভাঙটা অবস্থা। সেবার এল কোপাইয়ের ‘পেলয়’ বান। সে অনেক দিন আগে, তখন আমরা হই নাই; বাবার কাছে গল্প শুনেছি। দুপুরবেলা থেকে ভাসতে লাগল কোপাই। রাত এক পহর হতে তু-ফা-ন! ‘হদের পুকুরের শাহী পাড় পর্যন্ত ড়ুবে গেল। নীলকুঠির সাহেব মোম গাছে চড়ল। তারপর সমস্ত রাত হাড়-হড়-হড়-হড়ী বান চললই-বান চললই। চারদিক আঁধার ঘুরাঘুট্টি। আর ঝম-ঝম জল। সে রাত যেন আজ পার হয়ে কাল হবে না। এমন সময়, রাত তখন তিন পহর চলছে,-হাঁসুলী বাঁকের অনেক দূরে নদীর বুকে যেন আলো আর বাজনা আসছে বলে মনে হল। দেখতে দেখতে পঞ্চশব্দের বান্দ্যি বাজিয়ে নদীর বুক আলোয় ‘আলোকীন্নি’ করে এক বিয়েশাদির নৌকের মত নৌকো এসে লাগল হাঁসুলী বাঁকের দহের মাথায়। সায়েব দেখেছিল-সে ঝাঁপিয়ে নামল জলে। মোম বারণ করলে। সায়েব শুনলে না। তখন মেম আর কি করে। মেমও নামল। সায়েব এক কোমর জল ভেঙে চলল নৌকো ধরতে। হঠাৎ ওই বাবার থান থেকে বেরিয়ে এলেন কত্তা। বলতে কাঁটা দিয়ে উঠছে পায়ে।–সত্যিই শিউরে উঠল সুচাঁদ।-এই ন্যাড়ামাথা, ধবধব করছে রঙ, গলায় রুদ্দাক্ষি, এই পৈতে, পরনে লাল কাপড়, পায়ে খড়ম-কত্তা জলের ওপর দিয়ে খড়ম পায়ে এগিয়ে এসে বললেন—কোথা যাবে সায়েব? নৌকে ধরতে? যেয়ো না, ও নৌকা তোমার লয়। সায়েব মানলে না সে কথা। বললে-পথ ছাড়, নইলে গুলি করেঙ্গা। কত্তা হাসলেন,–বেশ, ধরাঙ্গা। তবে নৌকে। বাস্, যেমনি বলা আমনি সায়েব-মোমের এক কোমর জল হয়ে গেল অথৈ সঁতার। সঙ্গে সঙ্গে, এক ঘুরনচাকিতে পাক দিয়ে ড়ুবিয়ে কো—থা—য় টেনে নিয়ে গেল-শো করে। চৌধুরী ছিল সায়েবের কাছেই আর একটা গাছের ডালে বসে। কত্তা এসে তাকে ডাকলেন-নেমে আয়। চৌধুরী তখন ভয়ে কাঁপছে। কত্তা হেসে বললেন-ওরে বেটা, ভয় নাই, নাম্। তুই ড়ুববি না। বললে না। পেত্যয় যাবে বাবা-চৌধুরী নামল, তো এক হাঁটুর বেশি জল হল না। কত্তা হাসলেন, তা’পরে আঙুল দেখিয়ে বললেন-নৌকো লেগেছে দেখেছিস? ও নৌকো তোর! আমার পুজো করিস, দেবতার কাছে মাথা নোয়াস, অতিথকে জল দিস, ভিখিরিকে ভিখ দিস, গরিবকে দয়া করিস, মানুষের শুকনো মুখ দেখলে মিষ্টি কথা বলিস। যখের কাছে ছিলেন লক্ষ্মী, তোকে দিলাম। যতদিন আমার কথা মেনে চলবি-উনি অচলা হয়ে থাকবেন। অমান্যি করলে ছেড়ে যাবেন, আর নিজেই ফলভোগ করবি। তাকেই–সেই কত্তাকেই-এত হতচ্ছেদা! মা-লক্ষ্মী তো গিয়েছেন। অধর্মের তো বাকি নাই। শেষমেশ সেই কত্তার থানেই খুঁতে, কুকুরে ধরা, এঁটো পাঠার পুজো! এতে কি আর দেবতা থাকেন! দেবতাই বটেন-দেবতাই শিস দিচ্ছেন। চলে যাবেন, তাই জানিয়ে দিচ্ছেন।
নদীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে বেঁকে চলে গিয়েছে গ্রামের বাঁশের বেড়। হাঁসুলীর মত গোল নদীর বেড়, তাই তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে যে বাঁশবেড় বা বাঁশের বাঁধ সেও গোলাকার। বাঁশৰ্বাদিকে ঘিরে রেখেছে সবুজ কস্তার ড়ুরি মালার মত। সেই বাঁশবন থেকে অন্ধকার গোল হয়ে এগিয়ে আসছে কাহারপাড়ার বসতিকে কেন্দ্র করে। উঠানের মজলিসের আলোটার মাথার উপরে এসে আলোর বাধা পেয়ে যেন থমথম করছে। প্যাঁচগুলো কৰ্কশ চেরা গলায় চিৎকার করে উড়ে যাচ্ছে। বাদুড় উড়ছে-পাখসাটের শব্দে মাথার উপরের বাতাস চমকে চমকে উঠছে। মধ্যে মধ্যে দুটোতে ঝগড়া করে পাখসাট মেরে চিলের মত চিৎকার করছে। এরই মধ্যে সুচাঁদের এই গল্পে সেই বেলবন ও শেওড়াবনের কর্তার মাহাত্ম্য, তার সেই গেরুয়াপরা ন্যাড়ামাথা, রুদ্ৰাক্ষ ও ধবধবে পৈতাধারী চেহারার বর্ণনা শুনে এবং সেই কর্তার কাছে কুকুরে-ধরা পাঁঠা দেওয়ার অপরাধের কথা মিলিয়ে সকলে একেবারে নিদারুণ ভয়ে আড়ষ্ট পঙ্গু হয়ে গেল। কার একজনের কোলের ছেলেটা কেঁদে উঠল। মজলিসসুদ্ধ লোক বিরক্তিভরে বলে উঠল-আঃ!
ছেলেটার মা স্তন মুখে দিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করলে, কিন্তু সাহস হল না এক ঘরের ভিতরে যেতে।
সুচাদ হঠাৎ আবার বললে-পানী, অপরাধ কিন্তু তোমারও বটে বাবার থানে।
পানু এমন অভিযোগের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তা ছাড়া ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, কেন কে জানে ভয় তারই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সূৰ্চাদের কথা শুনে সে উত্তর দিতে চেষ্টা করলে, কিন্তু পারলে না!
তারপর বনওয়ারী সুচাদকে সায় দিয়ে বললে—তা ঠিক বলেছ পিসি। পাঠটি তো পানুর ঘরের।
সুচাঁদ এতক্ষণ ধরে নিজে একই কথা বলে আসছিল—কানে না শোনার সমস্যা ছিল না। বনওয়ারী কথা বলতেই সমস্যাটা নতুন করে জাগল। এমন গুরুতর তত্ত্বে রায় দেবার অধিকার কাহারপাড়ায় প্রাচীন বয়সের দাবিতে সুঁচাদ তার নিজস্ব বলে মনে করে। তাতে কেউ বাদ-প্রতিবাদ করলে সে ‘রূরপমান সুচাঁদের সহ্য হয় না। এদিক দিয়ে তার অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি। বনওয়ারীর কথা কানে শুনতে না পেয়ে সে ধারণা করলে-বনওয়ারী তার কথার প্রতিবাদ। করছে, তার কথাতে সে মৃদুস্বরে কথা বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে সে বনওয়ারীর দিকে একটু ঝুঁকে হাত নেড়ে বললে–তোর মত বনওয়ারী, আমি ঢের দেখেছি।-বুঝলি! তুই, তো সেদিনের ছেলে রে ; মা মরে যেয়েছিল, ‘মাওড়া’ ছেলে-অ্যাই ডিগডিগে ‘প্যাট’। আমার দুধ খেয়ে তোর হাড়-পাজরা ঢাকল। আমার গতির তখন ভাগলপুরের গাইয়ের মতন, বুকের দুধও তেমনি অ্যাই মোষের গাইয়ের মতন। তু আজ আমার ওপর কথা কইতে আসিস? এই আমি বলে রাখলাম, তু দেখিস-গায়ের নোকেও দেখবে-বছর পার হবে না, পানুর ‘খ্যানত’ হবে।
পানু শিউরে উঠল। পানুর বউ দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে-মেয়েদের মধ্যে;-মৃদু অথচ করুণ সুর তুলে সে কেঁদে উঠল।
বনওয়ারী এবার চিৎকার করে বললে—তাই তো আমিও বলছি গো! তুমি যা বলছি, আমিও তাই বলছি।
–তাই বলছিস?
—হ্যাঁ। বলছি, পাঁঠাটি যখন পানুর ঘরের, তখন পানুর অপরাধ খণ্ডায় কিসে? সুচাঁদের ঘোলাটে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল-বুদ্ধিমত্তার তৃপ্তির একটা হাসিও ফুটে উঠল। মুখে, সে বলল-অ্যা-অ্যাই! খণ্ডায় কিসে?
পানু কাতর হয়ে প্রশ্ন করলে—তাই তো বলছি গো, খণ্ডায় কিসে তাই বল? শুনছ?—বলি ‘পিতিবিধেন’ কি বল? তার স্বরে চিৎকার করে বললে শেষ কথা কটি।
–পিতিবিধেন?
–হ্যাঁ।
একটু ভাবলে সুচাঁদ। বনওয়ারী প্রমুখ অন্য সকলে আলোচনা আরম্ভ করলো।–তা কাল একবার চল সবাই চৌধুরী-বাড়ি। বলা যাক সকল কথা খুলে।
সুচাঁদ বললে—আর একটি পাঠা তু দে পানু। আর পাড়া-ঘরে চাঁদা তুলে বাবার থানে পুজো হোক একদিন। জাঙলের নোকে যদি ‘রবহেলা’ করে–আমার আপনাদের কত্তব্য করি। না, কি বলিস বনওয়ারী? আর পিতিবিধেন কি আছে বল? কত্তা তো দেবতা-তিনি তো বুঝবেন আমাদের কথা।
বনওয়ারী বারবার ঘাড় নাড়লেন। হ্যাঁ তা বটে, ঠিক কথা। কি বল হে সব? সকলেই ঘাড় নাড়লে। প্ৰহাদ, গোপীচাঁদ, পাগল, দু নম্বর পানু, অমণ, সকলেই সন্মত হল,-হোক, পুজো হোক।
ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎ রাক্রির অন্ধকারটা একটা নিষ্ঠুর চিৎকারে যেন ফালি ফালি হয়ে গেল। কোনো জানোয়ারের চিৎকার। সে চিৎকার তীব্রতায় যত যন্ত্রণাকর তীক্ষ্ণতায় সে তত অসহনীয়। বুনো শুয়োরের বাচ্চার চিৎকার। সম্ভবত দল থেকে ছিটকে পড়েছিল কোনো রকমে, সুযোগ বুঝে শেয়ালে ধরেছে। শুয়োরের বাচ্চার মত এমন তীরের মত চিৎকার কেউ করতে পারে না। আর পারে খরগোশে-বুনো মেটে খরগোশ। এ চিৎকার খরগোশেরও হতে পারে।
ঠিক এই সময়ে ঘেউ ঘেউ করে শব্দ করে ছুটে এল একটা কুকুর। কালো রঙের প্রকাণ্ড বড় একটা কুকুর দৃপ্ত ভঙ্গিতে, সতেজ চিৎকারে পাড়া মজলিস চকিত করে মজলিসের মাঝখান দিয়ে লোকজন না মেনেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল ওই চিৎকার লক্ষ্য করে। কুকুরটার গায়ের ধাক্কা লাগল সুচাঁদের গায়ে। ধাক্কা খেয়ে এবং ঠিক কনের কাছে ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে সুচাঁদ চমকে উঠল। পরমুহূর্তে সে চিৎকার করে বলে উঠল—এই দেখ বনওয়ারী, এই আর এক পাপ। ওই যে হারামজাদা বজাত-ওই ওর পাপের পৌরাশ্চিতি করতে হবে সবাইকে, ওই হারামজাদার জরিমানা করু। তোরা। শাসন করু। শাসন কর। শাসন করু।
বনওয়ারী কিছু উত্তর দেবার আগেই মেয়েদের মধ্য থেকে ফোঁস করে উঠল সুৰ্চাদের নাতনী-বসন্তের মেয়ে পাখী। সে বলে উঠল—ক্যানে, সে হারামজাদা আবার করলে কি তোমার? ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। যত রাগ সেই হারামজাদার ওপর।
মেয়েরা এবার মুখ টিপে হাসতে লাগল। আশ্চর্য নাকি মানুষের জীবনে রঙের ছোঁয়াচের খেলা। এ দেশের এরা, মানে হাঁসুলী বাঁকের মানুষেরা, নরনারীর ভালবাসাকে বলে ‘রঙ’। রঙ নয়-বলে ‘অঙ’। ওরা রামকে বলে ‘আম’, রজনীকে বলে ‘আজুনী’, রীতকরণকে বলে ‘ইতকরণ’, রাতবিরেতকে বলে ‘আতবিরেত’। অর্থাৎ শব্দের প্রথমে র থাকলে সেখানে ওরা র-কে আ করে দেয়। নইলে যে বেরোয় না জিভে, তা নয়। শব্দের মধ্যস্থলের র দিব্যি উচ্চারণ করে। মেয়ে—পুরুষের ভালবাসা হলে ওরা বলে–অঙ লাগায়েছে দুজনাতে। রঙ-ই বটে। গাঢ় লাল রঙ। এক ফোঁটার ছোঁয়াচে মনভরা অন্য রঙের চেহারা পাল্টে দেয়। যে মেয়েরা এতক্ষণ আশঙ্কায় কাজকর্ম ছেড়ে নির্বাক হয়ে মাটির পুতুলের মত দাঁড়িয়ে সুঁচাদের রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছিল এবং আশঙ্কাজনক ভবিষ্যতের কথা ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছিল না, তারাই পাখীর কথার মধ্যে সেই রঙের ছোঁয়াচ পেয়ে মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল, মুখে হাসি দেখা দিল। ব্যাপারটার মধ্যে ‘রঙ’ ছিল।
সুচাঁদের ওই ‘হারামজাদা’টির নাম করালী। করালী এই পাড়ারই ছেলে। চন্দনপুরে রেলের কারখানায় কাজ করে করালী। কথায় বার্তায় চালে চলনে কাহারপাড়ার সকলের থেকে স্বতন্ত্র। কাউকেই সে মানতে চায় না, কিছুকেই, সে গ্রাহ্য করে না। যেমন রোজগোরে, তেমনই খরচে। সকালে যায় চন্দনপুর, বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়। আজ বাড়ি ফিরে শিস শুনেই সে কুকুর আর টর্চ নিয়ে বেরিয়েছে। এই করালীর সঙ্গে পাখীর মনে মনে রঙ ধরেছে। তাই পাখী দিদিমার কথায় প্ৰতিবাদ করে উঠল। ওদের এতে লজ্জা নাই। ভালবাসলে, সে ভালবাসা লজ্জা বল, ভয় বল, পাড়াপাড়শীর ঘৃণা, বল, কোনো কিছুর জন্যই ঢাকতে জানে না কাহারেরা। সে অভ্যাস ওদের নাই, সে ওরা পারে না। সেই কারণেই মধ্যে মধ্যে কাহারদের তরুণী মেয়ে বানভাসা কোপাইয়ের মত ক্ষেপে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে দাঁড়ায়। তার উপর পাখী বসন্তের মেয়ে, বসন্তের ভালবাসার ইতিহাস এ অঞ্চলে বিখ্যাত। তাকে নিয়ে সে এক পালাগান হয়ে গিয়েছে একসময়। গান বেঁধেছিল লোকে, ‘ও–বসন্তের অঙের কথা শোন!’
সে অনেক কথা। তবে বসন্তের মেয়ে পাখীর কথা এদিক দিয়ে আরও একটু স্বতন্ত্র। এই গীয়েই তার বিয়ে হয়েছে। কাহারপাড়ার পূর্বকালের মাতব্বর-বাড়ির ছেলের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্য মন্দ-সে। রুগৃণ, হাঁপানি ধরেছে এই বয়সে। এদিকে পাখী ভালবেসেছে করালীকে। কারালীকে সমাজের মজলিসে এইভাবে অভিযুক্ত করায় সে মজলিসের মধ্যেই দিদিমার কথার প্রতিবাদ করে উঠল।
দিদিমাও পাখীকে খাতির করবার লোক নয়; সেও সুচাঁদ। সুচাদও পাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল-ওঃ, আঙ যে দেখি মাখামাখি। বলি ওলো ও হারামজাদী! আমি যে নিজের চোখে ছোড়াকে ওই কত্তার থানে ওই কেলে কুকুরটাকে সাথে নিয়ে বাঁটুল ছুঁড়ে ঘুঘু মারতে দেখেছি।
ঠিক সেই সময় মজলিসের পিছন থেকে কেউ, অর্থাৎ করালীই বলে উঠল-কত্তা আমাকে। বলেছে, তু যখন আমার এখানে বঁটুল ছুড়ছিস, তখন আমি একদিন ওই বুড়ি সুচাঁদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বা দড়াম করে। তু সাবধান হোস বুড়ি, বিপদ তোরই। সে হা—হা করে হেসে উঠল। তার হাসির দমকায় মেয়েদের হাসিতে আরও একটু জোরালো ঢেউয়ের দোলা লাগল।
বনওয়ারী হঠাৎ একটা প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে উঠল–অ্যাই করালী!
করালী হেসে উঠে বললে-ওরে ‘বানাস’ রে! ধমক মারে যে?
—বস বস হারামজাদা, তু বস।
–দাঁড়াও, আসছি আমি।
–কোথা যাবি?
—যাব।–হেসে বললে—দেখে আসি কাণ্ডটা কি? তাতেই তো কুকরটাকে ছেড়ে দিলাম।
–না। কাণ্ড কি সে তোমার দেখবার পেয়োজন নাই। সে আমরা জানি। তোমাদের পাপেই সব হচ্ছে।
হা-হা করে হেসে উঠল করালী।-কি? ওই বেহ্মদত্যি ঠাকুর? উঁহুঁ।
–খবরদার করালী! মুখ খসে যাবে।
-–এই দেখ! আমার মুখ খসে যাবে তো তোমাদের খবরদারি কেন?
ওদিকে বাঁশবনের মধ্যে কোথাও কুকুরটার চিৎকারের ভিতর হঠাৎ যেন একটা সতর্ক ক্রুদ্ধ আক্রমণোদ্যোগের সুর গর্জে উঠল। এই মুহূর্তে সে নিশ্চয় কিছু দেখেছে, ছুটে কামড়াতে যাচ্ছে। করালী একটা অতি অল্প-জোর টর্চের আলো জ্বেলে প্রায় ছুটেই পুকুরের পাড় থেকে নেমে বাঁশবাদির বাঁশবেড়ের গভীর অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। গোটা মজলিসটা স্তব্ধ হয়ে গেল। করালীর কি অসীম স্পর্ধা, কি দুৰ্দান্ত দুঃসাহসী! শুধু পাখীই খানিকটা এগিয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে, ডাকলে—যাস না। এই, যাস না বলছি। ওরে ও ডাকাবুকো! এই দেখ। ওরে ও গোয়ার-গোবিন্দ। যাস না! যাস না!
তার কণ্ঠস্বর ঢেকে গেল কুকুরটার একটা মৰ্মান্তিক আৰ্তনাদে।
বনওয়ারী বললে-হারামজাদা মরবে, এ তোমাকে আমি বলে দেলাম সুচাঁদপিসি।
কুকুরটা আর্তনাদ করতে করতে ছুটে ফিরে এল। সে এক মর্মান্তিক আৰ্তনাদ।
পিছন পিছন ফিরে এল করালী। কালুয়া, কালুয়া!
কালুয়া মনিবের মুখের দিকে চেয়ে স্থির হবার চেষ্টা করলে, কিন্তু স্থির হতে পারলে নে সে। কোন ভীষণতম যন্ত্রণায় তাকে যেন ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পাক দিয়ে ফিরতে লাগল কালুয়া। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পড়ে গেল মাটিতে, মুখ ঘষতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে গোঙাতে লাগল।
করালী তার পাশে বসে গায়ে হাত বুলাতে লাগল, কিন্তু কুকুরটা যেন পাগল হয়ে গিয়েছে, মনিব কেরালীকেও কামড়াতে এল। ছটফট করতে লাগল, মাটি কামড়াতে আরম্ভ করলে, কখনও মুখ তুলে চোঁচালে-অসহ্য যন্ত্রণা অভিব্যক্তি করলে, তারপরই মাটিতে মুখ ঘষতে লাগল।
করালী স্থির হয়ে বসে দেখছিল। তার টর্চটার দীপ্তি ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। হঠাৎ সে মৃদুস্বরে ও বিস্ময়ে আতঙ্কের সঙ্গে বললে—রক্ত!
–রক্ত!
–হ্যাঁ।
সে আঙুল দেখালে-কালুয়ার নাকের ছিদ্রের দিকে। মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে। শেষে ঘটল একটা বীভৎস কাণ্ড! হঠাৎ চোখ দুটো ফুলে উঠে ফেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রক্তের ধারা পড়ল কালো রোমের উপর দিয়ে। সমস্ত কাহারপাড়া দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল।
বনওয়ারী ভয়ার্ত বিজ্ঞস্বরে বললে–কর্তা!
কর্তা বোধহয় খড়মসুদ্ধ বাঁ পা-টা কুকুরটার গলায় চাপিয়ে চেপে দিলেন।