Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হরিপুরের হরেক কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

হরিপুরের হরেক কাণ্ড || Shirshendu Mukhopadhyay

রামপ্রসাদ আর জগা

রামপ্রসাদ আর জগা চটপট মালপত্র হাতিয়ে নিয়ে বেরোতে যাবে। এমন সময় রামপ্রসাদ বলে উঠল, “আরে ভাই, হামারা জুতি কাঁহা গিয়া?”

জগা বলল, “তখন থেকে জুতো-জুতো করে চেঁচিয়ে মরছে দ্যাখো! কেমন চোর তুমি যে জুতো খুলে চুরি করতে ঢোকো? চুরি তো আর পুজো আচ্চা নয় যে জুতো খুলতে হবে!”

“তু দো দিনকা ছোঁকরা, তু কুছু জানিস না। হামারা নাগরা জুতির এইসান আওয়াজ হয় কি মুর্দা ভি উঠকে বৈঠেগা, তাই লিয়ে জুতি খুলকে ঢুকতে হয়।”

“তা অমন বিটকেল জুতো পরোই বা কেন?”

“অ্যায়সা নাগরা জুতি কাঁহা মিলবে রে? তুদের মতো জুতি থোড়াই আছে। হামারা মুলক লালগোপালগঞ্জকা সীতারাম চামারা আপনা হাথে বনায়া গয়া চিজ। নিচে চালিশ গো বুলাকি হ্যাঁয়, উস জুতি বিশ-পঁচিশ সালমে ভি কুছ নেহি হোগা।”

জগা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তবে জুতো নিয়েই থাকো, আমি চললাম। বাড়ির লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে এল বলে।”

রামপ্রসাদ খুব দুঃখের গলায় বলল, “জুতির তু কী জানিস রে জগুয়া! তু তো নাঙ্গা পায়ে ঘুরে বেড়াস।”

কথাবার্তার মধ্যেই বাইরে একটা শোরগোল শোনা গেল। কারা যেন চেঁচাচ্ছে। কে একজন হেঁকে বলল, “খবর্দার, পালাতে যেন না পারে। বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলবি, বাড়ি ঘিরে ফেল এক্ষুনি।”

জগা আর রামপ্রসাদ দুজনে জানালার কাছে পৌঁছে চোখের পলকে জানালা গলে বাইরে পড়ল। তারপর আমবাগানের ভেতর দিয়ে ছুটতে লাগল দু’জনে।

“এ জগুয়া, কাঁহা যাচ্ছিস রে?”

“আর কোন চুলোয় যাব! নিজের বাড়ি যাচ্ছি।”

“হাঁ হাঁ, তো আমাকে ভি লিয়ে যাবি তো!”

জগা তেতো গলায় বলে, “তা আসতে হয় এসো, তবে তা বলে সেখানে জামাই-আদর পাবে না কিন্তু।”

“ভাত খেলাবি তো।”

“এত রাতে ভাত কোথায় পাব? চিঁড়ে আর গুড় দিতে পারি।”

“হোড়া দুধ মিলবে নাই?”

“এঃ, দুধ! তোমার বায়নাক্কা তো কম নয়!”

রামপ্রসাদ ভারি বিরক্ত হয়ে বলে, “তু তো একদম ছোটাখোটা চোর আছিস রে জগুয়া। হামার বাড়িতে যাবি, দেখবি ছোঠো ভেঁস, তিনগো গাই, চার বকরি, সবসুদ্ধ আছে।”

“ছোট চোর বলে কি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছ নাকি? বেশ তাহলে আমার বাড়ি গিয়ে তোমার কাজ নেই। তুমি রাস্তা দ্যাখো।”

“গুসসা হল নাকি রে তুহার? আরে ঠিক আছে, তুকে হামি আইসা চোরি শিখিয়ে দিব যে তু ভি ভঁইস গাই সব কিনতে পারবি।”

জগা ঘরে এসে একটা কুপি জ্বালল। তারপর দুজনে বসল চুরির জিনিসপত্র দেখতে।

পাঞ্জাবির সোনার বোতামটা খুলে হাতে একটু নাচিয়ে নিয়ে জগা খুশির গলায় বলল, “ভরিখানেক হবে, কী বলো রামপ্রসাদদাদা?”

রামপ্রসাদ বোতামটা হাতে নিয়ে কুপির আলোয় একটু দেখে গম্ভীর হয়ে জিনিসটা জগার হাতে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “তু তো একদম বুরবক আছিস রে জগুয়া?”

“কেন, বুরবকের আবার কী দেখলে?”

“উয়ো বুতাম সোনার থোড়াই আছে! উ তো গিলটি মাল।”

“অ্যাঁ।”

“উসি লিয়ে তো বলছি কি তু একদম বুরবক আছিস।”

“সুটকেসটা খুলে খানকতক জামাকাপড় পাওয়া গেল বটে, কিন্তু টাকাপয়সা টুটু।”

জগা ভারি দুঃখের গলায় বলে, “জামাইটা তো বড্ড ঠকিয়েছে আমাদের দেখছি। শুনেছিলাম জামাই বড়লোক, মেলা পয়সা।”

রামপ্রসাদ ঝাঁটা গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল, “হাঁ হাঁ, বড়লুক আছে তো কী আছে? চোরচোট্টা কে লিয়ে কি সুটকেসের ভেতর রুপেয় পইসা থোড়াই রাখবে? রুপেয় পইসা আউর কৌন জঘায় রেখেসে। হামি হলে ঠিক বাহার করে লিতাম। তু ঘরে ঘুষে কাম বিলা করে দিলি।”

জগা ফোঁস করে উঠে বলল, “যত দোষ এখন আমার না?

মানিব্যাগে পঁচিশ টাকাই ছিল। রামপ্রসাদ উদাস গলায় “উ তু লিয়ে লে। পঁচিশ রুপেয় সে হামারা কী হবে! তু ছোটামোটা চোর আছিস, তু হি লিয়ে লে।”

এ-কথায় ভারি অপমান বোধ করল জগা। বলল, “আমি ছোট চোর? আর তুমি কোন বড় চোরটা শুনি? আহা, আমাকে চুরি শেখাতে এলেন! নিজে তো নাগরা জুতোটা পর্যন্ত খুঁজে পেলে না!”

রামপ্রসাদ একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ল। গায়ের মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবিটা খুলে নিংড়ে নিয়ে গাটা একটু মুছে নিয়ে বলল, “তু আভি আরাম কর! হামি চললাম দুসরা শিকার ছুঁড়তে।”

জগা অবাক হয়ে বলে, “বেরোচ্ছ! বাঃ চিড়ে গুড় খাবে না?”

“চুড়া গুড় দিয়ে কী হোবে রে জগুয়া? চুড়া গুড় বসে বসে খেলে কি কামাই হোবে?”

জগা টপ করে উঠে বলল, “কোথায় যাবে রামপ্রসাদদাদা, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চলো।”

“তু তো কাম বিলা করে দিবি।”

“না, না, যা বলবে তাই শুনবো দেখো, মা-কালীর দিব্যি।”

“তব শুনে লে। জবান বনধ রাখবি আর কোই খতরা হোলে মগজ ঠাণ্ডা রাখবি। হামি যৌন বলবে তাই করবি।”

“ঠিক আছে দাদা, তাই সই। এ যা রোজগার হল আজ তা একেবারে যাচ্ছেতাই। চলো যদি একটা দাঁও মারা যায়।”

ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টিটাও প্রায় ধরে এল। এখন টিপ টিপ করে পড়ছে। জলকাদার রাস্তায় রামপ্রসাদ আর জগা পাশাপাশি হাঁটছে।

“কোন বাড়ি যাবে গো রামপ্রসাদদাদা?”

“চল, কুঁড়ে লিব।”

চাপা গলায় জগা বলে, “আহা আমি তো এগাঁয়েরই লোক। সব বাড়ি চেনা। কোন বাড়িতে কী কী মালকড়ি আছে তাও জানা। যে-বাড়ি চলো চোখ বুজে নিয়ে যাব।”

একটা জংলা জায়গা পেরিয়ে জমিদারবাড়ির ফটকের সামনে পড়ে জগা বলল, “এই হল জমিদার মহেন্দ্রচন্দ্রর বাড়ি…আর ওই যে হোমিওপ্যাথ বিশু দত্তর ঠেক। আর একটু এগিয়ে বাঁ ধারে যে পাকা বাড়িটা দেখবে সেটায় নয়ন হাতি থাকে–মস্ত পালোয়ান। আর ই যে…”

“তুকে বলেছি কিনা জবান বন্ধ রাখবি।”

“ও হ্যাঁ, তা তো ঠিক। আচ্ছা আর কথা কইব না।”

একটা মাঠকোটা পেরনোর সময়ে হঠাৎ একটা খুনখুনে সরু গলায় কে যেন বলে উঠল, “কে যায় রে বাপ, চোর নাকি?”

জগা টপ করে উবু হয়ে বসে পড়ল। সর্বনাশ! এ যে গোপেশ্বরের বুড়ি মা শীতলালক্ষ্মী!

বুড়ি ভারি মিঠে করে বলে, “চোর নাকি রে বাপ! চোর হলে একটু ঘরে আয় বাছারা, জরুরী কাজ আছে।”

রামপ্রসাদ ফিরে তাকিয়ে জগাকে বসা দেখে চাপা গলায় বলল, “বসিয়ে আছিস কাহে রে? ভাগবি তো!”

জগা চাপা গলায় বলে, “ডাকছে যে!”

“সো হামি শুনিয়েছি। ঘরে ডেকে লিয়ে পিটাই করবে।”

“আরে না, না। বুড়ি একা একটা ঘরে থাকে।”

জানালা খুলে শীতলালক্ষ্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের গাঁটে ব্যথা হয়ে গেল বাপ। কখন থেকে একটা চোরের জন্য হা পিত্যেশ করে চেয়ে আছি। তা চোরেরও কি আজকাল আকাল পড়ল? আয় বাছারা, ঘরে আয়, ভয় নেই, লোকজন ডাকব না।”

বুড়ি দরজা খুলে লণ্ঠন হাতে দাঁড়াল।

দু’জন গুটিগুটি এগোতেই এক গাল হেসে বলল, “আহা রে, ভিজে যে একা হয়েছিস! আয়, গামছা দিচ্ছি, গা-মাথা মুছে বোস।”

হতভম্ব রামপ্রসাদ জগার দিকে চেয়ে বলে, “এ বুড়িয়া পাগলি আছে নাকি রে?”

“আরে না। চলোই না মজাটা দেখি, আমাদের রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্পান্ন।”

“ও বাত তো ঠিক আছে।”

ঘরে ঢুকতেই শীতলালক্ষ্মী আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ একটা চোর চেয়েছিলাম, ভগবান একেবারে একজোড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। তা বোস বাছারা, ঘন দুধ আছে, চিঁড়ে আছে, মর্তমান কলা আছে, ফেনী বাতাসা আছে, একটু ফলার করবি?”

“এ জগুয়া, ফল্লার কী চিজ আছে রে?”

“খুব ভাল জিনিস। বসে যাও।”

শীতলালক্ষ্মী দুটো আসন পেতে দিলেন মেঝেতে। তারপর দুটো জাম বাটিতে ঘন দুধ, অনেক চিঁড়ে, কলা আর বাতাসা দিয়ে বললেন, “খা বাছারা, আগে পেট ভরে খা, তারপর কাজের কথা হবেখন।”

.

১৭.

বহুকাল এমন খাবার খায়নি দুজনে। সরে ভরা ঘন দুধ, মর্তমান কলা, বাতাসা আর চিড়ে যে কী অমৃত তা বলে শেষ করা যায় না। শীতলালক্ষ্মী একেবারে মুক্তহস্ত হয়ে খাওয়াচ্ছেন। ফলে দুজনেরই দেদার খেয়ে পেট একেবারে টাঁই টাঁই হয়ে গেল।

শীতলালক্ষ্মী দুঃখ করে বললেন, আহা রে বাছারা, কতকাল বুঝি পেট ভরে খাসনি, তা কেমন চোর তোরা যে ভরাপেট খাওয়া জোটে না?

জগা করুণ গলায় বলে, ঠাকুমা, আমি খুবই ছিচকে আর ছোটোখাটো চোর, দিন চলে না।

শীতলালক্ষ্মী রামপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললেন, আর তুই! তুই কেমন চোর রে বাবা?

রামপ্রসাদ খুবই লজ্জার সঙ্গে মাথা নামিয়ে বলল, আমি তো বড়া চোর আছি বুড়িমা। হামার ঘর মে ছোটো ভেঁস, তিনগো গাই, চার বকরি, সবকুছ আছে।

তা বাবা, তোরা বড় চোর আর ছোটো চোর দুটিতে মিলে আমার একটা কাজ উদ্ধার করে দিবি?

হাঁ হাঁ, কিঁউ নেহি? বোলেন বুড়িমা, যো কাজ বলবেন করিয়ে দিব।

জগা বলল, আজ্ঞে শক্ত কাজ হলে আমি কি আর পেরে উঠব ঠাকুমা? ফলার খেয়ে যে নিজেকেই টেনে দাঁড় করাতে পারছি না!

একগাল হেসে শীতলালক্ষ্মী বললেন, ওরে, তোদের দেখছি মরা পেট। এটুকু আর কী খেলি বাছা? আমার দাদাশ্বশুর আস্ত পাঁটার মাংস খেয়ে উঠে আস্ত কাঁটাল দিয়ে দুসের দুধের ক্ষীর খেতেন। তবে তাঁর সেঁকুর উঠত। আর কী ঢেঁকুরই উঠত বাপ, যেন বাঘ-সিংহী ডেকে উঠল। আমার শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনবি? আস্ত একথালা বিশসেরী কাতলা মাছের লেজ থেকে মুড়ো অবধি সাপটে খেতেন। তার পর এক হাঁড়ি দই আর পঞ্চাশটা রাজভোগ তাঁকে কতবার খেতে দেখেছি।

রামপ্রসাদ হাতজোড় করে বলল, উ সব দেওতা আছেন। আমি লোগ ছোটামোটা আদমি আছে বুড়িমা। যদি আউর খিলাবেন তো হামার দম নিকলে যাবে।

জগাও করুণ গলায় বলল, আজ আর নয় ঠাকুমা। অর্ধেকটা বাকি থাক, কাল আবার হবে খন।

আচ্ছা বাবারা, তোদের আর খেতে হবে না, তা বলি বাছারা, আমার একটা ছোটো কাজ করে দিবি?

আজ্ঞে বলে ফেলুন।

কাজ খুব সোজা, তোদের গাও ঘামাতে হবে না। সরলার বাড়ি চিনিস তো!

ঘাড় নেড়ে সোৎসাহে জগা বলল, খুব চিনি, খুব চিনি।

ব্যস, তাহলে তো অর্ধেক কাজ হয়েই গেল।

পুরো কাজটা কী ঠাকুমা।

ওরে সে খুব সোজা কাজ। তার বালিশের পাশে একটা কাঠের বাক্স থাকে। ঘুম না ভাঙিয়ে বাক্সটা আমাকে এনে দিবি বাপ?

জগা বেশ জোরেই হোঃ হোঃ করে হাসল। তারপর বলল, কার ঘুম ভাঙাবো ঠাকুমা? তিনি তো কবেই পটল তুলেছেন।

ওমা! বলিস কি? সরলা মরেছে কবে?

তা হল অনেক দিন।

ওমা! হুঁড়ি তো এই সেদিনও এক্কাদোক্কা খেলত জামতলায়। একরত্তি বয়স।

জগা মাথা নেড়ে বলে, একরত্তিই বটে, তা একশ পুরে তার ওপর আর চার-পাঁচ বছর ধরুন।

শীতলালক্ষ্মীর গালে হাত। চোখ বড় বড় করে বললেন, বলিস কি রে মুখপোড়া! সে যে আমার চেয়েও দশ-বারো বছরের ছোটো!

তা হতে পারে। হতে বাধা কিসের?

হতে পারে মানে? সরলার যদি একশ চার হয় তাহলে আমার কত হচ্ছে?

জগা বলে, তা হবে একশ পনেরো-ষোলো। কিছু বেশিও হতে পারে।

ওরে বাপ রে! এত বয়স হয়ে গেল নাকি রে আমার! তা কেউ তো বয়সের কথাটা আমাকে বলেনি এতদিন। সরলা যে মরেছে সেও তো টের পেলুম না। হ্যাঁ রে বানিয়ে বলছিস না তো!

জগা এক গাল হেসে বলে, না ঠাকুমা, বানিয়ে বলব কেন? দু-চার বছর এদিক ওদিক হতে পারে, তবে মোটামুটি হিসেবটায় খুব গণ্ডগোল পাবেন না। সরলা ঠাকুমা বেঁচে থাকতে তো ও বাড়িতে কম ঘুরঘুর করিনি। রাতবিরেতে গেলে সরলা ঠাকুমা ঘরের ভেতর থেকে কথাবার্তাও বলতেন। তখনই বলেছিলেন, তাঁর তখন একশ চার চলছে। তাও ধরুন চার পাঁচ বছর তো হয়েই গেল। বেঁচে থাকলে সরলা ঠাকুমার বয়স একশ দশটশই হত।

শীতলালক্ষ্মী তাড়াতাড়ি দুহাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, রক্ষে কর, বয়সের হিসেব আর শুনতে চাই না। ফস করে আবার চার-পাঁচ বছর বেড়ে যাবে। যা ছিল তাই থাক।

থাকল ঠাকুমা, তা কিসের বাক্সের খোঁজ করছিলেন যেন?

সরলার বাড়িতে একখানা কাঠের বাক্স আছে রে বাপ। সে যক্ষীবুড়ির মতো আগলে রাখে। ওই বাক্সখানা যদি এনে দিস বাপ, তবে বুড়ো বয়সে একটু সুখে মরতে পারি।

বাক্সে কী আছে গো ঠাকুমা যে সুখে একেবারে ভেসে যাবেন!

ধনরত্ন নয় রে বাবা, সেদিকে টুটু। বাক্সের মধ্যে আছে সাতটা কড়ি আর সাতটা তামার পয়সা।

রামপ্রসাদ আর জগা পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর রামপ্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, উ বাক্সো তো গায়েব হয়ে গেছে ঠাকুমা।

অ্যাঁ! গায়েব হয়ে গেছে মানে! গায়েবটা করল কে?

রামপ্রসাদ উদাস গলায় বলল, ক্যা মালুম! উসি বাক্স লিয়েই তো আমি মুলুক থেকে এতো পরেসান হয়ে আসলাম। কিন্তু ঐ বাড়ির মধ্যে ছোটো গুণ্ডা লোক ঘুসে বৈসে আছে। আজ হামাকে পাকড়েছিল। দুচার ঘুসা ভি মারল। তো বুড়ি মা, ওই সাতটো কড়ি আর সাতটো পইসার বেপারটা কী আছে বলুন তো!

শীতলালক্ষ্মী খুবই ভাবিত হয়ে পড়ে বললেন, সে বাছা বলে আর কী লাভ?

জগা বলল, ওই বাক্সটা নিয়ে খুব কথা হচ্ছে গো ঠাকুমা। কোন হাতি ঘোড়া হবে বাক্সটা দিয়ে?

শীতলালক্ষ্মী দুঃখের গলায় বললেন, হত তো অনেক কিছুই রে বাপ। কিন্তু আর তো কিছু হওয়ার নয়।

বাক্সের রহস্যটা কী ঠাকুমা?

সে আছে বাছা। ভেঙে বলা যাবে না।

কেন ঠাকুমা? অসুবিধে কী?

শীতলালক্ষ্মী মুখোনা তোম্বা করে বললেন, “আমিই কি তার সবটা জানি রে বাছা? তবে শুনেছি, সাতপয়সার হাট নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানে সাতকড়ি নামে একটা লোক থাকে।

তারপর?

আমি ঐটুকু জানি। বাকিটুকু ওই সাতকড়ি জানে।

মাথা নেড়ে রামপ্রসাদ বলল, সমঝমে আসছে না বুড়িমা।

জগা বলল, আমিও বুঝতে পারছি না। সাতপয়সার হাট নামে কোনও গ্রামের নাম জন্মেও শুনিনি।

শীতলালক্ষ্মী বলল, ওরে আছে, আছে। সে যে মস্ত ডাকাতের গাঁ ছিল।

সে কবে ছিল কে জানে। আপনি তো আর আজকের লোক নন। কত যেন বয়স বেরোলো আপনার হিসেবে! দেড়শো নাকি ঠাকুমা?

ওরে বলিসনি, বলিসনি! শুনলে হৃৎকম্প হয়। আমার কথাটা ভাল করে শোন। বাক্সখানা কিন্তু সরলার নয়।

তবে কার?

সরলা দুটো চোরকে লাগিয়ে নিতাই পালের বাড়ি থেকে চুরি করিয়ে আনিয়েছিল।

নিতাই পাল?

হ্যাঁ রে বাবা, নিতাই পাল। কিন্তু ও জিনিস নিতাই পালেরও নয়।

তবে কার?

শোনা যায়, নিতাই পাল ওটা কোন কাপালিকের কাছ থেকে চুরি করে এনেছিল।

ও বাবা! একটা বাক্সের জন্য এত?

হ্যাঁ রে বাবা, ও বাক্স বড় সামান্য নয়।

তাহলে এখন কী করব ঠাকুমা?

বাক্সটা কে চুরি করল এটুকু খুঁজে দেখবি বাবা?

জগা মাথা চুলকে বলল, সাতপয়সার হাট আর সাতকড়ি যখন জানা গেছে তখন বাক্সটা না হলেও চলবে। রহস্য তো ভেদ হয়েই গেছে।

শীতলালক্ষ্মী বললেন, “না রে না, ওই বাক্স না নিয়ে গেলে সাতকড়ি যে রা কাড়বে না।

আহা, সাতটা কড়ি আর তামার পয়সা জোগাড় করা তো আর শক্ত নয়। কাঠের বাক্সও মেলা পাওয়া যাবে।

তোর বুদ্ধির বলিহারি যাই বাপু। এই বুদ্ধি নিয়ে চুরি করে বেড়াস! এই জন্যই তোর কিছু হয় না। ওই কড়ি আর পয়সা আর পাঁচটা কড়ি আর পয়সার মতো তো নয়। ওর মধ্যে অনেক কারিকুরি আছে। তেমন চোখ নাহলে ধরতে পারবি না।

.

১৮.

ভোর না হতেই সুজনের বাড়িতে মেলা লোক এসে হাজির। নগেন দারোগা, গদাই নস্কর, পবনকুমার, মহেন্দ্রচন্দ্র দেবরায়, শহিদলাল, নয়ন হাতি, বজ্র সেন এবং রামহরিও, সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন।

নগেন বললেন, “আগেই বলেছিলুম আপনাকে, বাড়িতে পাহারা বসিয়ে দিই, তা হলে আর বিপদটা হত না। তা লোকগুলোর চেহারার একটা বিবরণ দিতে পারেন কি?”

সুজনের মাথায় ব্যান্ডেজ, শরীরও দুর্বল। মৃদু হেসে বললেন, “না, তাদের মুখ ঢাকা ছিল। ভাল করে কিছু বোঝবার আগেই মাথায় কী দিয়ে যেন মারল। আর কিছু মনে নেই।”

“কী কী নিয়ে গেছে ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?”

“এখন ততটা জোর পাচ্ছি না গায়ে। তবে আমার বাড়িতে দামি জিনিস তেমন কিছু থাকে না। একটা ঘড়ি পাচ্ছি না মনে হচ্ছে।”

“আলমারিটা নাকি ভাঙা ছিল?”

“হ্যাঁ, তাও ছিল। তবে বেশি কিছু নেয়নি।”

হঠাৎ রামহরি বলে উঠলেন, “আপনার ঘরে নেই-নেই করেও দামি জিনিস বেশ কিছু আছে। ডাকাতরা তেমন কিছু নেয়নি, এটা খুব আশ্চর্যের কথা, এমন নয় তো যে, ওরা একটা বিশেষ কোনও জিনিসেরই খোঁজে এসেছিল?”

সুজন রামহরির দিকে চেয়ে বললেন, “কাল আপনি সময়মতো না এলে আমার কপালে আরও কষ্ট ছিল। আপনার কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ কিন্তু ঘটনাটা চাউর করতে যে বারণ করেছিলাম আপনাকে!”

মহেন্দ্র একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি অদ্ভুত লোক মশাই, বাড়িতে ডাকাত পড়ল আর আপনি সেই ঘটনাটাও চেপে যেতে চাইছেন? লোককে ডাকাত সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়াও কি আপনার কর্তব্য নয়? আর গোপন করতে চাইছেনই বা কেন?”

সুজন খুব মৃদু গলায় বললেন, “আসলে আমি নিজেই একটু তদন্ত করতে চাইছিলাম। চাউর হয়ে গেলে ডাকাতরা সাবধান হওয়ার সুযোগ পাবে।”

নগেন দারোগা বললেন, “এটা আপনার ভুল ধারণা। ডাকাতরা–যদি তারা সত্যিই সেরকম ডাকাত হয়ে থাকে–পাবলিসিটিতে ঘাবড়ায় না। তা ছাড়া একা-একা আপনি কী তদন্তই বা করবেন? আপনার কি পুলিশের ট্রেনিং আছে?”

সুজন মাথা নেড়ে বললেন, “না নেই। তবে আমার সঙ্গে এ-গাঁয়ের এবং আশেপাশের গাঁয়ের চোর-ডাকাতদের সঙ্গে একটু চেনাজানা আছে। ভাবছিলাম তাদের কাজে লাগিয়ে যদি কিছু করা যায়।”

“ওটা রিস্কি ব্যাপার সুজনবাবু। আমরা আর রিস্ক নেব না। আপনার বাড়িতে আমরা আজ রাত থেকে দু’জনকে পাহারায় রাখব।”

সুজন উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “রক্ষে করুন। আমি বুড়ো হয়েছি। আমার প্রাণের মূল্য কী? পাহারাদাররা বিপদে পড়তে পারে।”

নয়ন হাতি আর বজ্র সেন একসঙ্গে বলে উঠল, “না হয় আমরাই পাহারা দেব। আমাদের বিপদ সহজে হবে না।”

সুজন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, আমার পাহারার কোনও প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে, আমার লোক আমি নিজেই ঠিক করে নেব।”

নগেন দিজ্ঞেস করলেন, “তারা কারা?”

সুজন মৃদু হেসে বললেন, “নাম না-ই বা শুনলেন। আপনার চোখে তারা ভাল লোক নয়, কিন্তু আমার খুব বিশ্বাসী আর অনুগত।”

“ভাল হলেই ভাল। আমরা আপনার নিরাপত্তা ছাড়া আর কিছু চাই না।”

“আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।

নগেন দারোগা বললেন, “শুনেছেন বোধহয় যে, সরলা পিসির বাড়িতে কিছু সমাজবিরোধী থানা গেড়েছিল। কাল রামহরিবাবু বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে ও বাড়ির বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের কানে শুনেছেন, ভেতরে একটা চোরকে পাকড়াও করে আর এক চোর খুব ধমক-চমক করছে। এবং কথা হচ্ছিল শূলপাণির সেই বাক্সটা নিয়ে, যাতে সাতটা তামার পয়সা আর সাতটা কড়ি ছিল। বুঝতে পারছি না, সেই বাক্সটা নিয়েই বা এত খোঁজখবর হচ্ছে কেন।”

সুজন বললেন, “ওসব বোগাস ব্যাপার, কিছু লোক গুপ্তধনের লোভে মরিয়া হয়ে ওসব করছে।”

মহেন্দ্রচন্দ্র হঠাৎ বললেন, “সুজনবাবুর ওপর হঠাৎ এই হামলাটা হল কেন সেটার পুলিশি তদন্ত হওয়া দরকার, সুজনবাবু ব্যাপারটাকে কেন গুরত্ব দিতে চাইছেন না তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমরা গুরুত্ব না দিলে ভুল করব, এরকম হামলা অন্যের ওপরেও হতে পারে।”

আরও আধঘণ্টা বাদে সবাই নানারকম আশঙ্কা, সান্ত্বনা আর দুঃখ প্রকাশ করে বিদায় নিলেন, একা ঘরে সুজন একটু থমথমে মুখ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে একটু কফি করে খেলেন। তারপর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন। সাতকড়ি ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু সাতটা পয়সার রহস্য ভেদ করা যাচ্ছে না।

দুপুরের দিকে পেছনের জানালার ওপাশে একটা মৃদু গলা খাঁকারির শব্দ পাওয়া গেল।

সুজন চোখ মেলে বললেন, “পাগলু নাকি?”

“যে আজ্ঞে।”

“ভেতরে এসো।”

পাগলু খুব অমায়িক মুখ করে ঘরে এল। মুখে একটু বশংবদ হাসি।

“খবর কী পাগলু?”

“আজ্ঞে, খবর আছে, তবে এবার বন্দোবস্তের কথাটা হয়ে যাক সুজনবাবু।”

“কিসের বন্দোবস্ত?”

“ধরুন, যদি গুপ্তধন পাওয়াই যায় তা হলে আমাদের বখরটা কীরকম হবে?”

সুজন একটু হাসলেন, বললেন, “গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল, ওটা আদৌ গুপ্তধনের সংকেত কি না তাই তো ভাল করে জানা গেল না।”

“সে তো ন্যায্য কথাই। পাওয়া না গেলে বখরার কথাই উঠবে না। কিন্তু ধরুন, যদি পাওয়া যায়, তা হলে?”

“তা হলে কত চাও?”

“আমাদের বখরা আধাআধি।”

সুজন ফের হাসেন, “আধাআধি? বেশ তাই হবে।”

“কথা দিচ্ছেন?”

“দিলাম। এবার খবরটা কী বলবে?”

“বলতেই আসা। কাল রাতে আমার স্যাঙাৎ জগা আর বাইরে থেকে আসা একটা চোর রামপ্রসাদ শীতলালক্ষ্মীর ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। বুড়ি চোর খুঁজছিল।”

“চোর খুঁজছিল? তাজ্জব ব্যাপার!”

“আজ্ঞে, তাজ্জবই বটে। তা বুড়িও ওই বাক্স চায়।”

“তাই নাকি! কেন চায়?”

“বুড়ির কাছেই জগা শুনেছে যে, ওই সাতপয়সার সংকেত হল সাতপয়সার হাট নামে একটা জায়গা। সেখানে সাতকড়ি নামে একটা লোক থাকে। তার কাছে গিয়ে হাজির হতে পারলে আর চিন্তা নেই।”

“সাতপয়সার হাট! সেটা কোথায়?”

পাগলু মাথা নেড়ে বলল, “সেইটেই জানা নেই। আশেপাশে কোথাও সাতপয়সার হাট বলে কোনও জায়গার কথা শোনা যায় না।”

“বুড়ি এত কথা জানল কী করে?”

“তা বলতে পারি না। তবে শীতলালক্ষ্মীর বয়স অনেক। পুরনো আমলের মানুষ। কিছু কানাঘুষো শুনে থাকবে।”

“সাতপয়সার হাটটা কোথায় না জানলে তো কিছু করা যাবে না। জায়গাটার পাত্তা লাগাও পাগলু।”

“যে আজ্ঞে। পাত্তা লাগলেই এসে বলে যাব। কিন্তু একটু বাধাও আছে।”

“কিসের বাধা?”

“শীতলালক্ষ্মী বলেছে, শুধু জায়গাটা বা সাতকড়ি নামের লোকটাকে খুঁজে পেলেই হবে না, ওই বাক্স আর কড়ি আর পয়সা নিয়ে না গেলে সাতকড়ি পাত্তা দেবে না। ওই সাতটা পয়সা আর কড়িই নাকি আসল জিনিস।”

সুজন চিন্তিতভাবে বললেন, “বুঝতে পারছি রহস্যটা আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটা যদি অনেক কাল আগের হয় তা হলে সাতকড়িই কি বেঁচে আছে এতদিন? তবু খোঁজ করতে থাকো। আমিও খোঁজখবর করছি।”

“যে আজ্ঞে।” বলে পাগলু বিদায় নিল।

.

১৯.

জগা আর রামপ্রসাদের এক রাত্তিরেই বেশ ভাব হয়ে গেছে। রামপ্রসাদ দুপুরে জগার ঘরে খেতে বসে বলল, আরে এ জগুয়া, তু কি রোজ এইসন খানা খাস নাকি রে বেওকুফ?

জগা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি গরিব মানুষ, এর চেয়ে আর বেশি কী করতে পারি বলো তো রামপ্রসাদদাদা?

ডাল ভাত আর আলুর হেঁচকি দিয়ে একটা বড় গরাস সাপটে মুখে তুলে রামপ্রসাদ বলল, এইসন খানা খেলে তোর শরীরে তাকৎ আসবে থোড়াই! ছোটামোটা কাম ছোড়িয়ে দে জগুয়া, বড়া বড়া কাম কর।

জগা একটু উজ্জ্বল হয়ে বলে, একটা বড় কাজ হাতে আছে, বুঝলে রামপ্রসাদদাদা? কাজটা করতে পারলে নগদ বিশ হাজার টাকা।

কী কাম রে জগুয়া?

একজন বুড়ো মানুষকে খুন করতে হবে।

আরে রাম রাম! খুন উন খারাপ কাজ আছে। চোর কা ভি কুছ ধরম হ্যাঁয় রে বুরবক। খুন কাহে করবি?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগা বলল, করতে আমারও মন চাইছে না, বুঝলে? কিন্তু দিনু গুণ্ডা কি ছাড়বে ভেবেছো? আগাম ধরিয়ে দিয়ে গেছে, কাজটা করতে না পারলে ব্যাটা আমার মুণ্ডু না নামিয়ে দেয়।

ছিয়া, ছিয়া, খুন খারাবি কি কোই মরদকা কাম আছে রে?

কী করব বলো তো! দিনু ব্যাটা কবে এসে হাজির হয় তার ঠিক নেই।

তু হিয়াঁসে ভাগ যা জগুয়া।

ভেগে কোথায় যাবো? কোন চুলোয় কে ঠাঁই দেবে আমায় বলো তো!

তু হামার মুলুকমে চল।

গিয়ে?

ভেঁস চরাবি, গাই দেখবি, খেতি কা কাম করবি, আউর রাত মে থোড়াবহৎ চোরিওরি ভি করবি, ভেঁসকা দুধ পিয়ে অ্যাইসা তাকৎ হোবে যে দশ-বিশ জোয়ানের সঙ্গে লড়াই করতে পারবি।

আমাকে চাকর খাটাতে চাও নাকি?

আরে নেহি নেহি চাকর থোড়াই বলবি। আধা বখরা হোবে।

মাথা নেড়ে জগা বলে, না গো রামপ্রসাদদাদা, যে আমি পারব না। হরিপুর ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমার মন টিকবে না।

দুজনে খাওয়া শেষ করে উঠে সবে একটু চাটাই পেতে গড়িয়েছে হঠাৎ বাইরে হুংকার শোনা গেল, জগা! অ্যাই জগা!

জগা ধড়মড় করে উঠে বলল, ওরে বাপ!

রামপ্রসাদ নিমীলিত চোখে চেয়ে বলল, কৌন চিল্লাচ্ছে রে?

সাক্ষাৎ যম। ওই তো দিনুগুণ্ডা।

রামপ্রসাদ মিটমিট করে চেয়ে বলল, কেমন গুণ্ডা?

বহৎ গুণ্ডা।

বাইরে ফের হাঁক শোনা গেল, জগা! অ্যাই জগা! দরজা খোল বলছি।

জগা উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, আরে দিনুদাদা যে!

দিনু তার পেল্লায় চেহারাটা নিয়ে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, আজ রাতেই কাজ সারতে হবে। আর সময় নেই।

আজ রাতে! কিন্তু আজ যে আমার একাদশী! এই দিনটায় অন্ন ছুঁই না যে।

দিনু তার ঘাড়টা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আজ আবার কোন পঞ্জিকার একাদশী রে বদমাশ? আমাকে একাদশী চেনাচ্ছিস?

ঝাঁকুনির চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখে জগা চিঁ চিঁ করে বলল, আহা ছাড়ো ছাড়ো দিনুদাদা, তোমার মামার বদলে আমিই যে কেঁসে যাবো!

তোর ঘরে ওটা কে রে?

ওঃ উনি হচ্ছেন রামপ্রসাদ সিং, ভুসওয়ালের দারোগা।

দারোগা!

আজ্ঞে, ছদ্মবেশে রোঁদে বেরিয়েছেন।

শুনে দিনুগুণ্ডা কোমরে হাত দিয়ে এমন হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য করল যে বাইরে কাকেরা ভয় খেয়ে কা-কা করতে লাগল।

দারোগা! বটে! অ্যাই রামপ্রসাদ, উঠে আয় তো দেখি, আয় এদিকে।

রামপ্রসাদ তাড়াতাড়ি উঠে হাতজোড় করে বলল, রামরাম বাবুজী!

তুই নাকি দারোগা? রামপ্রসাদ হাতজোড় করেই বলল, নেহি মালিক, জগা ঝুট বলছে।

তাই বল! কাল যখন সরলাবুড়ির বাড়িতে ঢুকেছিলি তখন এই শর্মার হাতে পড়ে তো চিঁ চিঁ করছিলি, ছিচকে চোর কোথাকার!

জী হজৌর! ছোটামোটা চোর আছে মালিক।

এ গাঁয়ে এখনও ঘুরঘুর করছিস, তোর তো খুব সাহস! কাল যে তোকে নাকে খৎ দেওয়ালাম, তুই যে বললি রাতেই এ গাঁ ছেড়ে চলে যাবি!

উ বাত তো ঠিক আছে মালিক, কাল আপনার ঘুত্সা খেয়ে হাত পাওমে দরদ হচ্ছিল, থোড়া আরাম করিয়ে নিলাম। আজ চলিয়ে যাবো মালিক।

দিনু ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখে বলল, এই ঘরে থাকিস নাকি রে জগা?

আজ্ঞে!

ছোঃ। বড্ড নিচু নজর তোর। এভাবে কেউ থাকে?

আজ্ঞে, অবস্থাটা খারাপই যাচ্ছে।

কাজটা করে ফেল, তোর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।

আজ্ঞে।

কী করতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ভাল করে শোন। ভুলভাল হলে বিপদ আছে।

আজ্ঞে বলুন।

ঠিক রাত আটটায় বেরোবি। মনে থাকবে?

যে আজ্ঞে।

গাঁ থেকে উত্তরে তিন ক্রোশ গেলে পঞ্চসায়রের জঙ্গল পড়বে, চিনিস?

চেনা চেনা ঠেকছে।

মারব গাঁট্টা। পঞ্চসায়রের জঙ্গল চেনে না এমন লোক কে আছে এখানে?

আজ্ঞে চিনি।

পঞ্চসায়রের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ক্রোশটাক গেলে রায়দিঘি।

আজ্ঞে।

রায়দিঘি থেকে ডানহাতি দক্ষিণের রাস্তা ধরে নাক বরাবর গেলে একটা হাট দেখতে পাবি।

হাট?

লোকে বলে ওটা গগনচাঁদের হাট।

মনে থাকবে।

আগে জায়গাটার নাম ছিল সাতপয়সার হাট।

অ্যাঁ।

চমকে উঠলি যে বড়?

জগা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আজ্ঞে ও কিছু নয়।

সাতপয়সার হাট বহু পুরনো জায়গা। দেখবি সব পুরনো আমলের বাড়ি-ঘর আর মন্দির-টন্দির আছে। জায়গাটা খুবই অখাদ্য। মশামাছি আর জোঁকের খুবই উপদ্রব।

যে আজ্ঞে।

সেখানে বুড়ো শিবমন্দিরের পেছনে একটা পাঁচশো বছরের পুরনো বাড়ি দেখতে পাবি।

যে আজ্ঞে।

সেই বাড়িতেই আমার মামা থাকে। সাতানব্বই বছর বয়স। বুঝলি?

আজ্ঞে জলের মতো।

মামার নাম সাতকড়ি গায়েন।

অ্যাঁ!

চমকে উঠলি যে বড়?

আজ্ঞে না, একটা মশা কামড়াল গালে, তাই।

ওই সাতকড়ি গায়েনই হল আমার শত্রুর। বুঝলি?

জলের মতো।

কাজটা খুব সোজা নয়। বরং বেশ কঠিন কাজই বলতে হবে।

যে আজ্ঞে।

মামার চারদিকে বেশ কঠিন পাহারা আছে।

ও বাবা, পাহারা থাকলে কী করব?

তুই বলবি সাতকড়ি গায়েনের কাছে তোর জমি বাঁধা আছে, তুই টাকা দিয়ে ছাড়াতে গেছিস।

বিশ্বাস করবে কথাটা?

খুব করবে।

দিনু পকেট থেকে একখানা তুলোট কাগজের টুকরো বের করে জগার হাতে দিয়ে বলল, এ কাগজটা দেখালেই তোকে পথ ছেড়ে দেবে।

তারপর কী করব?

সাতকড়ি গায়েন নিজের কাজ নিজেই করে। পাওনা গণ্ডার ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করে না। সামনে হাজির হতে পারলে আর চিন্তা কিসের? একখানা দোধার ছোরা রেখে যাচ্ছি। ছোরাটা সোজা বুকে বসিয়ে দিবি।

ও বাবা!

ও বাবা আবার কী? ছোরাটা বসিয়েই চলে আসবি। জলের মতো সোজা কাজ।

.

২০.

যাওয়ার সময় দিনু গুণ্ডা হাজারটা টাকা পকেট থেকে বের করে একরকম জগার নাকের ওপর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুঁড়ে মেরে বলল, নেমকহারামি করলে কিন্তু জান খিচে নেবো।

জগা জিব কেটে বলে, ছি ছি, নেমকহারামি করবে কোন নেমকহারাম? নেমকহারামি ব্যাপারটা আমার আসেই না।

দিনু কটমট করে রামপ্রসাদের দিকে চেয়ে বলল, অ্যাই মর্কট, ঘাপটি মেরে বসে তো সব শুনলি, এসব কথা আর পাঁচ কান হবে না তো!

জী নেহি। পাঁচ কান কিউ, দো কান ভি হোবে না।

ভাল কথা, জানাজানি হয়ে গেলে দুটো লাশই পুঁতে ফেলব।

জী হুজৌর।

কিন্তু শুনেই যখন ফেলেছিস, তখন তুইও কাজে লেগে যা। এসব কাজে একজনের চেয়ে দুজন থাকা ভাল। টাকাটা বরং ভাগাভাগি করে নিস।

রামপ্রসাদ অতি ধূর্ত লোক, চোখ মিটমিট করে বলল, বহুত আচ্ছা মালিক। লেকিন ভাগউগ আপনি নিজে করিয়ে দিন। জগা হামাকে থোড়াই ভাগ দিবে।

অ, অ্যাই জগা, দে ওকে ওই হাজার টাকা থেকে পাঁচশো দে, কাজটা আজই সেরে আয়, কাল বাকি টাকা নগদ বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে যাবো।

জগা বেজার মুখে হাজার টাকা থেকে পাঁচশো টাকা রামপ্রসাদের হাতে দিয়ে বলল, যে আজ্ঞে।

তাহলে চললুম, কাজ যদি ভণ্ডুল করে আসিস তাহলে কী হবে বুঝতেই তো পারিস।

আজ্ঞে, সে আর বলতে!

দিনু চলে যাওয়ার পর জগা আর রামপ্রসাদ দুজনে পরামর্শে বসল।

জগা বলল, রামপ্রসাদদাদা, দিনু গুণ্ডা কি আমাকে ফাঁসাতে চাইছে? ছোটোখাটো চুরিচামারি করি বটে, কিন্তু এসব খুন জখম তো কখনও করিনি। তবু আমাকেই এত বড় কাজটা কেন দিল বলো তো!

রামপ্রসাদ একটা হাই তুলে বলে, তোর নসিব খারাপ আছে রে জগুয়া। খুন করলে বিশ হাজার রুপিয়া তোকে থোড়াই দিবে দিনুগুণ্ডা, তুকে তো সাত পয়সার হাটের গাঁওয়াররা পিটতে পিটতে মেরে দিবে। পুলিশ ভি আছে, ফাঁসি ভি হতে পারে।

তাহলে চলো, পাগলুদাদার কাছে যাই।

পাগলু কৌন আছে রে?

আমার মতোই একজন চোর। তবে বেশ বুদ্ধি রাখে।

বুদ্ধির দরকার হোলে তোকে হামি বুদ্ধি দিব। পাগলু অগলুসে বুদ্ধি নিবি কেন?

পাগলুদাদার বুদ্ধি তোমার চেয়েও ঢের বেশি। আমরা খুব বন্ধুও বটে। পাগলুদাদাই আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিল, খুন-খারাপির কাজ না করতে। তখন শুনিনি, টাকার লোভটা খুব বেশি হয়েছিল, পাগলুদাদার কাছে যাওয়ার আরও একটা কারণ আছে।

কৌন কারণ আছে?

পাগলুদাদা আর আমি একটা ধাঁধা মেলাতে পারছিলাম না। সেটা এবার মিলে গেছে। কথাটা পাগলুদাদাকে বলতে হবে।

রামপ্রসাদ আর দ্বিরুক্তি করল না। উঠে পড়ল। বলল, শুন জগুয়া, রাতের বেলা কুছ আচ্ছা খানাপিনা করতে হবে।

খাওয়ার কথা এখন রাখো তো। আমার বলে বুক হিম হয়ে যাচ্ছে, উনি খাওয়ার গপ্পো ফেঁদে বসলেন। চলো তো, জরুরী কাজটা আগে সারি।

দুজনে বেরিয়ে পড়ল। সন্ধের মুখে গাঁয়ের অন্য প্রান্তে পাগলুর বাড়িতে হাজির হল দুজন।

পাগলু বাড়িতেই ছিল। তাকে আড়ালে ডেকে সংক্ষেপে ঘটনাটা ভেঙে জগা বলল, সেই সাতপয়সার হাট আর সাতকড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। পাগলুদা, এবার আমরা বড়লোক।

কোথায় পেলি?

দিনুগুণ্ডার মামাবাড়ি হল গে গগনচাঁদের হাট, আগে ওটারই নাম ছিল সাতপয়সার হাট।

বলিস কী?

হ্যাঁ। আর দিনুর সাতানব্বই বছর বয়সী মামাই হল সাতকড়ি।

বটে! এ তো সাঙ্ঘাতিক খবর।

তাই বলছি, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। তিনজনে মিলে কিছু একটা করা যাবে।

পাগলু একটু ভেবে বলে, সাত পয়সার হাট আর সাতকড়িকে তো পাওয়া গেল, কিন্তু সেই কাঠের বাক্স কোথায়? সেটা না হলে তো আর সাতকড়ি আমাদের পুঁছবেও না।

পাগলুদাদা, আমি বলি কি, সাতটা পয়সা আর সাতটা কড়ি জোগাড় করা তো কোনও সমস্যা নয়। আর রায়দিঘির গজানন মিস্তিরির দোকান থেকে একটা কাঠের বাক্স কিনে নিলেই হবে।

হবে বলছিস?

না, হবে কেন?

ওই পয়সাগুলোয় যে সন দেওয়া আছে। তা না মিললে?

তাও তো বটে! এরকম একটা কথা যেন শীতলালক্ষ্মীও বলছিল। তবে কি আশা ছেড়ে দেবো?

তা নয়। তবে সংকটকালে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। আমরা হলুম চোর, সব গেরস্তরই ঘরের খবর জানি। আবার চোরদের গতিবিধিও নখদর্পণে। বাক্সটা প্রথমে সরলাবুড়ির বাড়ি থেকে আমিই সরাই।

তুমি! বলছো কী?

ওরে, সে এক বৃত্তান্ত। শূলপাণি যখন হাওয়া হল, তার আগের দিন সুজনবাবু আমাকে বাক্সটা সরানোর জন্য কিছু বখশিশ দেন।

এসব বলোনি তো আমাকে!

গুহ্য কথা তো, তাই বলিনি। বলা বারণ ছিল।

তারপর?

শূলপাণি হাওয়া হওয়ার পর যখন তার বাড়িতে লোকের গাদি লেগে গেল তখন আমি ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে চালের ডোলের মধ্যে সেঁধিয়ে ছিলাম। লোকজন বেরিয়ে গেলে বাক্সটা হাতিয়ে নিয়ে সুজনবাবুকে দিই। তখন কি বুঝেছিলাম ওই বাক্সের এই কদর হবে?

তা সুজনবাবুর কাছ থেকে বাক্সটা ফের হাতিয়ে নিলেই তো হয়।

পাগলু দুঃখিতচিত্তে মাথা নেড়ে বলে, তবে আর সমস্যা হবে কেন? বাক্সটা তাঁর কাছ থেকে চুরি গেছে।

তাহলে?

সেই তো ভাবছি, বাক্সটা নিল কে?

বেশি ভাববার যে সময় নেই পাগলুদাদা। অনেকখানি রাস্তা। রাত আটটা নাগাদ না বেরোলে যে সকালবেলা পৌঁছোনো যাবে না।

পৌঁছে করবিটা কী? দিনুগুণ্ডার মামাকে খুন করবি নাকি?

না করলে যে সে-ই আমাকে খুন করবে!

ওরে দাঁড়া, দিনুর ভয়ে অমন সিটিয়ে থাকিস না। বরং চল, সুজনবাবুর কাছে যাই।

গিয়ে?

তিনি লেখাপড়া জানা বিচক্ষণ মানুষ। সাহসীও বটে। আমাকে খুবই স্নেহ করেন। যাহোক একটা বুদ্ধি তাঁর কাছে পাওয়া যাবে।

শেষমেশ তিনি আবার আমাদের কাঁচকলা দেখাবেন না তো!

না, সে ভয় নেই। আর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে গুপ্তধন উদ্ধার হলে আধাআধি বখরা।

তাহলে চলো।

চল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress