Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হরতন ইশকাপন – মিসির আলি || Humayun Ahmed » Page 4

হরতন ইশকাপন – মিসির আলি || Humayun Ahmed

আতরের গন্ধে বাড়ি ম মা করছে। আজমল সাহেবের পীর ভাই–হুজুরে কেবলা বিন নেশান আলি আসগর কুতুবী মিসির আলির বসার ঘরে বসে আছেন। আজমল সাহেব হুজুরে কেবলাকে এখানে বসিয়ে রেখে নাশতার জোগাড় করতে গেছেন। হুজুরে কেবল বসে আছেন মূর্তির মতো। মূর্তিও মাঝে মধ্যে বাতাসে এদিক-ওদিক দুলে–পীর ভাই-এর মধ্যে সেই দুলুনিও নেই।

মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?

তিনি জবাব দিলেন না। তবে মিসির আলির দিকে তাকালেন। সামান্য হাসলেন।

যিনি কথা বললে জবাব দেন না তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর প্রশ্ন ওঠে না। মিসির আলি চুপচাপ বসে রইলেন। আজমল সাহেব তাঁর পীর ভাইকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন এটা ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। হয়তো ধর্মের লাইনে মিসির আলিকে টানতে চান। সব মানুষই নিজের দিকে মানুষকে টানতে চায়। এক চোর অন্য একজনকে চোর বানাতে চেষ্টা করে। সাধু চেষ্টা করে সাধু বানাতে।

মিসির আলির সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। তার পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটও আছে। দেয়াশলাইও আছে। সিগারেট ধরালে এই পীর সাহেব কি মনে করেন তা বুঝতে পারছেন না বলেই সিগারেট ধরাচ্ছেন না।

হুজুরে কেবল এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। তাঁর মাথাও খানিকটা ঝুকে এসেছে। থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। ভদ্রলোক কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লে সিগারেট একটা ধরানো যেতে পারে। ভদ্রলোকের চোখের পাতা দেখতে পারলে মিসির আলি সহজেই ধরতে পারতেন। ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন কি-না। চোখের পাতা দেখা যাচ্ছে না।

মিসির আলিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক হঠাৎ মাথা তুললেন। চোখ মেললেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন–কেমন আছেন? আমি সেই প্রশ্নের জবাব দেই নাই। কারণ তখন ওজিফা পাঠ করছিলাম। জবাব না দেওয়ায় আপনি হয়তো ভেবেছেন আমি বেয়াদবি করেছি। ইচ্ছাকৃত বেয়াদবি করি নি। আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনিচ্ছাকৃত বেয়াদবি করেছি–তার জন্যে ক্ষমা চাই।

মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম।

শুকরিয়া।

মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম ঠিকই, আপনি কিন্তু এখনো প্রশ্নের জবাব দেন নি। এখনো বলেন নি কেমন আছেন।

হুজুরে কেবলা শব্দ করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, জনাব আমি ভালো আছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সামনে সিগারেট খেতে পারেন। আমি এমন কোনো ব্যক্তি না যে আমার সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। যদিও এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

মিসির আলি সামান্য চমকালেন। হুজুরে কেবলা এমন ভঙ্গিতে কথা বলেছেন যাতে মনে হতে পারে তিনি থট রিডিং জানেন। মিসির আলি মনে মনে ঠিক যা ভাবছেন তা বলতে পারছেন।

সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা মিসির আলির হচ্ছে এটা ঠিক। হুজুরে কেবলার জন্যে সিগারেট ধরাতে সংকোচ হচ্ছে এটাও ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা হুজুরে কেবলার জানার কথা না।

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। হুজুরে কেবল বললেন, আপনাকে সিগারেট ধরাতে বলেছি। এতে আপনি সামান্য চমকেছেন বলে আমার মনে হলো। চমকানোর কিছু নেই। আপনার এশট্রেতে সিগারেট দেখে বুঝেছি আপনি সিগারেট খান। আপনার গা থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসছিল। যারা সিগারেট খায় তারা যখন অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে তখন তাদের সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা! করে। আমার সামনে আপনি বসে আছেন, আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন, আমি জবাব দিচ্ছি না। আপনি পড়েছেন অস্বস্তিকর পরিবেশে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনার সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা হচ্ছে।

মিসির আলি এতক্ষণ ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে তাকান নি। এবার তাকালেন। বয়স অল্প। পাঁচিশ-ছাব্বিশ। টকটকে গৌরবর্ণ। টানাটানা চোখ সুরমা দিয়ে সেই চোখ আরো টানা হয়েছে। ঠোঁট টকটকে গোলাপি। পুরুষদের যে কোনো সৌন্দৰ্য প্রতিযোগিতায় তিনি অবশ্যই ফাস্ট প্রাইজ কিংবা রানার্সআপ প্ৰাইজ নিয়ে নেবেন।

মিসির আলি সাহেব!

কি।

আমি বুদ্ধি খাটিয়ে এ রকম দু’একটা কথা বলি। লোকে মনে করে আমার বিরাট আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। কেউ চিন্তাও করে না। আমার ক্ষমতাটা আধ্যাত্মিক নাও হতে পারে। আমি যতদূর শুনেছি আপনি একজন মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি যখন বলেন তখন কিন্তু আপনার ক্ষমতাকে কেউ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ভাবে না।

মিসির আলি বললেন, আমি যদি আপনার মতো লম্বা দাড়ি রাখি, চোখে সুরমা দেই, মাথায় পাগড়ি পরি তখন আমার ক্ষমতাকেও লোকে ভাববে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা।

হুজুরে কেবলা বললেন, আমি মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করি। আমাকে করতে হয়। আমি যাকে যা বলি তাই নাকি সত্যি হয়। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি।

মিসির আলি বললেন, আপনি হয়তো নস্ট্রাডেমাস স্টাইলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

সেটা কি?

নস্ট্রাডেমাসের জন্ম ফরাসিতে ১৫০৩ সনে। তিনি অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হৈচৈ হচ্ছে। কারণ সবাই বলছে তিনি যা বলেছেন সব মিলে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু তা না। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কবিতার আকারে। সরাসরি কখনো কিছু বলেননি। এই কারণে মনে হয় যা বলা হচ্ছে সবই মিলে যাচ্ছে।

ভদ্রলোকের নাম কি বললেন?

নস্ট্রাডেমাস।

উনি অস্পষ্টভাবে কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন?

জি।

উদাহরণ দিতে পারবেন?

উনি বলেছেন

An emperor will be born near Italy.
Who will cost the empire very dearly.

খুবই অস্পষ্ট কথা। এই emperor নেপোলিয়ান হতে পারেন, আবার হিটলারও হতে পারেন। আবার অস্ট্রিয়ার রাজাও হতে পারেন।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝেছি। তবে আমি কিন্তু অস্পষ্টভাবে কিছু বলি না। আমি যা বলি স্পষ্টভাবে বলি। আপনার সম্পর্কে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব?

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, করুন।

পীর ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি দু’একদিনের মধ্যে বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। এমন বিপদ যার কোনো পারাপার নাই।

কি ধরনের বিপদ?

জীবন সংশয় হয় এমন বিপদ। এর বেশি কিছু বলব না।

পীর ভাই উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। পীর ভাই-এর মুখে হাসি। হাসির মধ্যে শিশুর ভঙ্গিমা আছে। শিশুরা কোনো একটা চালাকি করে বড়দের হারিয়ে দিলে এ রকম করে হাসে।

রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন লম্বা এক মানুষ তাঁর ঘরে ঢুকেছে। মানুষটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। স্বপ্ন হবে বর্ণ এবং গন্ধহীন, তাহলে তিনি গন্ধ পাচ্ছেন কেন? লম্বা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আসসালামুআলাইকুম। তার গলা অপূর্ব সুরেলা। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি উঠে বসলেন। লম্বা মানুষটা বললেন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে মিসির আলি সাহেব?

মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছ। আপনি।

লম্বা মানুষটা বললেন, কথার জবাব দিন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে?

মিসির আলি বললেন, না। আমি কোনো বিপদে পড়িনি। আঁখিতারা বিপদে পড়েছে।

আপনি বিপদে পড়েছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না।

মিসির আলি বললেন, আপনার কথা আমি সত্যি বলে ধরে নিলাম। ধরে নিলাম আমিই বিপদে পড়েছি। এখন বলুন আপনি কি করে বুঝলেন আমি বিপদে পড়ব।

সেটা বলব না।

কেন বলবেন না?

সব কিছু সবাইকে বলতে নেই। সব রহস্য সবাইকে জানতে নেই।

মিসির আলি বললেন, রহস্য আগলে রাখা ঠিক না। বিজ্ঞানীরা যখনই কোনো রহস্য ধরে ফেলেন তখনই তাঁরা তা সবাইকে জানান। পৃথিবী যে আজ এত দূর এগিয়েছে এই কারণেই এগিয়েছে। তারা রহস্য আগলে বসে থাকলে আমরা এত দূর আসতে পারতাম না। অন্ধকারে ড়ুবে থাকতাম।

অন্ধকারে ড়ুবে থাকাই ভালো।

তাই কি?

হ্যাঁ ভাই। আপনি ঘুমুচ্ছেন। ঘুম হলো অন্ধকার। অন্ধকার ভালো না?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *