Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বামীর আত্মা || Samaresh Majumdar

স্বামীর আত্মা || Samaresh Majumdar

সকালবেলার সদ্য চায়ের কাপ শেষ করেছে সৌরভ, বেল বাজল।

আজ রবিবার, ক্রমাগত বেল বাজবেই। গত রবিবারে দরজা খোলা নিয়ে তৃণার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। হকারের দল, ঝি, দুধওয়ালা থেকে শুরু করে সৌরভের বন্ধুবান্ধব আসার আর শেষ নেই। আজ সৌরভই দরজা খুলল। খুলে জিজ্ঞাসা করল, একি? আপনারা?

শাশুড়িঠাকরুন গম্ভীর মুখে বললেন, খুশি হওনি মনে হচ্ছে?

সেকি! আসুন-আসুন। হঠাৎ না বলে কয়ে এলেন কেন? সরে দাঁড়াল সৌরভ।

শ্বশুরমশাই দরজায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, তিনু কোথায়?

ভেতরে। মানে রান্নাঘরে।

সঙ্গে-সঙ্গে শ্বশুমশাই শাশুড়িঠাকরুনের দিকে তাকালেন। যেন খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন। শাশুড়িঠাকরুন দ্রুত ছুটলেন ভেতরে। তারপরই তাঁর গলা পাওয়া গেল, ওগো, এদিকে এসো। তিনু লুচি বেলচে!

অ, লুচি বেলচে? বলে শ্বশুরমশাই ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

সৌরভ কিছুই বুঝতে পারছিল না। শ্বশুরমশাই বাইরে ঘরের সোফায় বসলেন। অগত্যা তাকেও বসতে হল। টেবিলে রাখা খবরের কাগজটি তুলে শ্বশুরমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি রোজ আনন্দবাজার পড়ো?

হ্যাঁ! ছেলেবেলা থেকে ওই কাগজটা…।

তুমি কখন বাড়ি ফেরো? অফিস তো পাঁচটায় ছুটি হয়ে যায়।

কোনও ঠিক নেই। আটটা নটা হবে।

আমি যখন চাকরি করতাম তখন সাড়ে পাঁচটা থেকে পৌনে ছটায় বাড়িতে ফিরে আসতাম। অতক্ষণ বাইরে কী করো?

এই মানে বন্ধুবান্ধব, ক্লাব–।

ভেগ কথাবার্তা। কোন ক্লাবের মেম্বার তুমি?

কেন বলুন তো? থই পাচ্ছিল না সৌরভ।

তুমি শেষবার আমাদের বাড়িতে কবে গিয়েছ মনে আছে?

হ্যাঁ, মানে এত ঝামেলায় থাকি…

তিনু ভাইফোঁটায় গেল, তুমি গেলে না?

ও ওর ভাইয়ের কাছে গেল, আমি আমার বোনের কাছে গিয়েছিলাম।

জামাইষষ্ঠীতে যাওনি।

দেখুন বিয়ে হয়ে গেছে বছর আটেক, এখনও ওসব….।

যখন তুমি বিয়ে করেছিলে তখন সাধারণ ক্লার্ক ছিলে, এখন অফিসার।

আপনাদের আশীর্বাদ ছাড়া এটা হত না।

এই সময় শাশুড়িঠাকরুন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দু-প্লেট লুচি আর বেগুনভাজা নিয়ে। সামনে রেখে বললেন, ব্যাপারটা কি জানো, আগে মেয়েদের বিয়ে হত এগারো-বারো বছর বয়সে। শাশুড়ির কাছে রান্না শিখত তারা। তাই তাদের বরদের মনে হত মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি। এখন তো বাইশ-তেইশের নিচে কেউ বিয়ে করে না। যা কিছু শিখে আসে তা নিজের। মায়ের কাছেই শেখে। সে রান্না যদি বরদের পছন্দ না হয়, হতেই পারে পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু মানিয়ে নিতে দোষ কি। তোমার ধরো লাল-লাল লুচি পছন্দ, তরকারিতে মিষ্টি একদম সহ্য করতে পারো না, তিনু আবার মিষ্টি দেওয়ার ধাতটা আমার কাছেই পেয়েছে, হুট করে তো টেস্ট পালটাতে পারে না।

সৌরভ হতভম্ব গলায় বলল, এসব কথা উঠছে কেন?

শাশুড়িঠাকরুন শ্বশুরমশাই-এর দিকে তাকালেন। তিনি মাথা নেড়ে কিছু ইশারা করতে গিয়েই সামলে নিলেন, বললেন, খাওয়া যাক। ঠান্ডা করে লাভ নেই।

এই সময় আবার বেল বাজল। সৌরভ গেল দরজা খুলতে। ভবমামা দাঁড়িয়ে আছেন। কলকাতা পুলিশের জাঁদরেল অফিসার ছিলেন। এখনও তাঁর খুব প্রতাপ। ওদের বিয়েটা ভবমামাই দিয়েছেন সম্বন্ধ করে।

বাড়ির খবর কী? হুঙ্কার উঠল।

ভালো। মিনমিন করে বলল সৌরভ, গত পাঁচ বছর ভবমামা এখানে আসেননি।

তাহলে বাড়িতে ঢুকতে পারি? জিজ্ঞাসা করে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে ভবমামা ভেতরে ঢুকলেন। ঢোকামাত্র তাঁর নজরে পড়ল শ্বশুরমশাই লুচি দিয়ে বেগুনভাজা মুড়ছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর গলা থেকে শব্দ বের হল, যাক, মিত্তিরমশাই তাহলে জামাই-এর বাড়িতে এসে লুচি খাচ্ছেন। আমি তো ব্রেকফাস্ট না করেই ছুটে এলাম! শাশুড়িঠাকরুন বললেন, আপনি কি লুচি খাবেন?

নো। শসা-টোস্ট, ঘি এবং জেলি ছাড়া আর দু-মুঠো মুড়ি। ভবমামা সোফায় বসলেন। বসেই জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ভাগ্নে হয়ে তুমি, তুমি–।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সৌরভ কাতর গলায় বলল।

লুচি খাও? তুমি জানো না লুচি একটা মানুষকে খুন করতে পারে?

সপ্তাহে একদিন। আমাকে মা প্রতি রবিবার সকালে লুচি ভেজে দিতেন।

দিদির কোনও ডিসিপ্লিন সেন্স ছিল না। তোমার বাবা ব্লাড সুগার, ক্লোরোস্টাল, ইউরিক অ্যাসিড কাম হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন ওইসব খাবার খেয়ে-খেয়ে। আমি তো দিদিকে বলেছি। জামাইবাবুকে তুমিই খুন করেছ। তাই আত্মগ্লানিতে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করল। ভবমামা সশব্দে নিশ্বাস ছাড়লেন।

শ্বশুরমশাই-এর লুচি বেগুনভাজা পোরা হাঁ-মুখ বন্ধ হল না, সৌরভের মা আত্মহত্যা করেছেন। একথা বিয়ের আগে বলেননি কেন?

বললে বিয়ে দিতেন না? ভবমামা সটান জিজ্ঞাসা করলেন।

আলবত দিতাম না।

ব্যাপারটা ভাবার বিষয়। জামাইবাবু মারা যাওয়ার পর দিদির মনে বৈরাগ্য এল। তিনি লুচি, পরোটা, মাছ, মাংস তো ছাড়লেনই, চব্বিশ ঘণ্টায় একবার বিকেল সাড়ে তিনটের সময় চারটি ভাত আর একটু তরকারি খেতেন। তারপর সারা বিকেল-সন্ধে-রাত অম্বলের জ্বালায় জ্বলতেন। কাউকে কিছু বলেননি। যখন ধরা পড়ল তখন সিরোসিস অব লিভার। বেশি মদ্যপান করলে যে রোগ হয়। তা আপনি একে আত্মহত্যা বলবেন না মিত্তিরমশাই? জামাইবাবু যদি আমার মতো। শসা-টোস্ট-মুড়ি খেতেন তাহলে দিদিকে বিধবা হতে হত না, আর তাহলে সিরোসিস অব লিভারের প্রশ্ন উঠত না।

এই সময় শাশুড়িঠাকরুন একটা শসা চার পিস করে কেটে দুটো সেঁকা পাঁউরুটির সঙ্গে নিয়ে এলেন। সঙ্গে এক বাটি শুকনো মুড়ি। জিজ্ঞাসা করলেন, চা খাবেন তো?

কোথাকার চা? ভবমামা জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তরটা সৌরভকেই দিতে হল, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট থেকে।

মাই গড! কোন বাগানের চা?দার্জিলিং, ডুয়ার্স না আসাম?

হ্যাপি ভ্যালি।

গুড। চিনি এবং দুধ ছাড়া।

খাওয়াদাওয়া শেষ হতে-না-হতেই আবার বেল বাজল। সৌরভ দরজা খুলে দেখল রোগাসোগা একজন দাঁড়িয়ে আছেন।

সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, বলুন?

আপনি মিস্টার সৌরভ দত্ত?

হ্যাঁ।

আমি লোক্যাল থানার ওসি।

ও।

আপনার স্ত্রী কোথায়?

রান্নাঘরে, লুচি ভাজছে।

লুচি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গ্যাসে, না কেরাসিনে?

গ্যাস শেষ হয়ে গিয়েছে। কাল দেবে বলেছে। কেরাসিনেই ভাজছেন।

মিস্টার ভবরঞ্জন বসু আপনার মামা?

হ্যাঁ। উনি ভেতরে আছেন।

ও, তাই নাকি? ওসি ভেতরে এলেন। ভেতরে এসে মামাকে বললেন, আমি এসে গিয়েছি মিস্টার বোস।

ভবমামা বললেন, জীবনে প্রমোশন হবে না।

আমি ঠিক… ওসি থতমত হয়ে গেলেন।

কেরাসিনের ভয়ঙ্করত্ব জানা সত্বেও আপনি কোনও স্টেপ নিলেন না। উলটে এখানে এসে মিস্টার বোস মিস্টার বোস করছেন। আমাদের আমলে রিটায়ার্ড সিনিয়র অফিসারদেরও আমরা স্যার বলতাম।ভমামা গম্ভীরমুখে শসা চিবোতে লাগলেন।

ওসি ব্যস্ত হয়ে উঠতেই শাশুড়িঠাকরুন তাঁকে জানালেন স্টোভ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, আপাতত চিন্তার কোনও কারণ নেই। শ্বশুরমশাই ওসিকে বসতে অনুরোধ করলেন। ওসি চেয়ারে বসে ভবমামাকে জিজ্ঞাসা করলেন। স্যার, এবার কী করতে হবে?

ভবমামা শাশুড়িঠাকরুনকে বললেন, মিসেস মিত্তির, আপনি শুরু করুন।

শাশুড়িঠাকরুন শ্বশুরমশাই-এর দিকে তাকালেন, তিনি মাথা নাড়লেন। শাশুড়িঠাকরুন বললেন, কী বলব! এসব তো আমাদের আমলে কখনও ছিল না।

কীসব? ওসি জিজ্ঞাসা করলেন।

ভবমামা বলে উঠলেন, হচ্ছে না। এভাবে হবে না। বউমা কোথায়? বউমা?

তৃণা মাথা নিচু করে এসে দাঁড়াল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে।

এঃ, সাতসকালে ঘেমেনেয়ে একসা হয়ে গেছে। এত টেনশন হচ্ছে কেন তোমার?

সৌরভ বলল, আজ্ঞে রান্নাঘরে খুব গরম তো!

গরম যদি মনে হয়ে থাকে তাহলে ফ্যান লাগাওনি কেন?

গ্যাস স্টোভ নিভে যাবে যে। রাবিশ। হ্যাঁ বউমা, ইদানীং তোমার কী হয়?

তৃণা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর সৌরভের দিকে তাকাল, তুমি কিছু মনে করবে না তো? বিশ্বাস করো, আমি একটুও বিশ্বাস করি না, তবু ভয় হয়।

ভবমামা বললেন, ভয় হয়? ওসি নোট করুন। কেন ভয় হয়?

খবরের কাগজ পড়ে।

কী পড়ো তুমি?

গত তিনমাসে একশো বাইশটা বউ হয় খুন হয়েছেনয় আত্মহত্যা করেছে।

ওসি চমকে উঠলেন, মাই গড! স্ট্যাটিস্টিকসটা পেলেন কি করে?

খবরের কাগজ থেকে। আমি লিখে রেখেছি। তৃণা দ্রুত একটা খাতা নিয়ে এল। ভবমামা সেটা নিয়ে চোখ বোলালেন, মগরার নমিতা মণ্ডল, গুসকরার অঞ্জলি দাস, লিলুয়ার কৃষ্ণা দত্ত…ও, এগুলো খুনের লিস্ট। আত্মহত্যার লিস্টটা দেখছি বেশ বড়। আত্মহত্যার আবার রকমফের। আছে, কেরাসিনের আগুনে, গলায় দড়ি দিয়ে, বিষ খেয়ে, জলে ডুবে, ট্রেনের তলায় মাথা দিয়ে। শেষের দুটো সংখ্যা দেখছি খুবই কম।

ওসি খাতাটা চেয়ে নিয়ে দেখলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এসব খবর কাগজে পড়ে আপনার নিজের জন্যে ভয় করে?

হ্যাঁ।

আপনার কি মনে হয় আপনার অবস্থা এইসব মহিলার মতো হতে পারে?

তৃণা জবাব দিল না। শাশুড়িঠাকরুন ওর পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলেন, জবাব দে, তিনু। তোর চিঠি পড়ে আমাদের প্রেশার বেড়ে গেছে। সবাইকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছি।

হঠাৎ ভবমামা বলে উঠলেন, ওই ছোঁকরা তোমাকে খুন করতে পারে বলে সন্দেহ করছ?

আজ্ঞে না। তবে–।

তবে কী?

ওইসব স্বামীরাও তো ভালো ছিল। কাঁপা গলায় জবাব দিল তৃণা।

শ্বশুরমশাই বললেন, সব জামাই প্রথম-প্রথম সোনার টুকরো থাকে।

ওসি বললেন, এক মিনিট। বিয়ের সময় যা-যা পণ জামাই চেয়েছিল দিয়ে দিয়েছেন?

ভবমামা মাথা নাড়লেন, নো। সৌরভ এক পয়সা পণ নেয়নি।

শ্বশুরমশাই বললেন, কথাটা সত্যি।

আপনার স্বামীর জীবনে অন্য কোনও মহিলা এসেছে?

কী করে বলব?

বলব মানে? স্ত্রীদের ঘ্রাণশক্তি ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। ওসি বললেন।

আমি বুঝতে পারি না।

তাহলে আসেনি। থার্ড পয়েন্ট, আট বছরে আপনাদের কোনও ইস্যু হয়নি?

না।

এটা একটা সিরিয়াস পয়েন্ট। কিন্তু ম্যাডাম, কী থেকে মনে হল আপনার স্বামী আপনাকে খুন করতে পারেন? ওসি জিজ্ঞাসা করলেন।

আমার ঠিক তা মনে হয়নি, আবার…। আসলে রেগে গেলে ওর চোখ খুনির মতো হয়ে যায়। তখন চিনতে পারি না ওকে।

তাই! রাগে কেন?

রান্না ভালো না হলে রেগে যায়, এক কথা বারবার বললে রেগে যায়…!

তখনই খুনি-খুনি দেখতে হয়ে যায়?

ওর চোখদুটো।

ভবমামা শব্দ করে হেসে উঠলেন, মাতুল বংশের ধারা। আমারও নাকি ওরকম হয়।

শ্বশুরমশাই বললেন, আপনি অবিবাহিত, আপনার চোখ নিয়ে কে ভাবছে?

ওসি জিজ্ঞাসা করলেন, এ বাড়িতে আর কে-কে থাকেন?

শাশুড়িঠাকরুন বললেন, কেউ না। একটা ঠিকে ঝি আছে। সে দেখছি আজ আসেনি।

ভবমামা বললেন, তাহলে তো বউমাকে সব কাজ নিজের হাতে করতে হয়। ক্রিমিন্যাল।

এতক্ষণ সৌরভ অসহায় হয়ে শুনে যাচ্ছিল। এবার না বলে পারল না, আপনারা কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমি ওকে খুন করতে যাব কেন? তৃণা, তুমি আমাকে এত অবিশ্বাস করো আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

শাশুড়িঠাকরুন বললেন, ও তোমাকে অবিশ্বাস করে না। কিন্তু চারপাশে যা ঘটছে, সেটা ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এ বাড়িতে তোমার বাবা-মা-কাকা-জেঠা থাকলে তো ও ভয় পেত না!

ভবমামা বললেন, এটা কীরকম কথা হল? বিয়ের সময় ছেলে বউকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে শুনে খুশিতে ডগমগ হয়েছিলেন, কী হননি?

তখন এত খুন আত্মহত্যা হত না। শাশুড়িঠাকরুন বললেন।

ওসি বললেন, দাঁড়ান। আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে দিন। তৃণা দেবী, আপনার কি মাঝে-মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে?

তৃণা মাটির দিকে তাকাল। তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

সবর্নাশ! কেন করে? ওসি চিৎকার করে উঠলেন।

ও যখন আমাকে ভুল বুঝে রেগে যায়, তখন।

আপনি ডিভোর্স চান?

ওমা, কেন? ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না। পারব না বলে খুন হতে অথবা আত্মহত্যা করতে একদম চাইনা। তৃণা জোরে-জোরে মাথা নাড়ল।

ওসি ভবমামার দিকে তাকালেন, স্যার, আপনি তো আইন জানেন। আগামের ব্যবস্থা এখানে আছে। আগাম জামিন যেমন নেওয়া যায় তেমনই আশঙ্কার কথা থানায় জানানো যায় আগাম। সেটা কেউ করলে পুলিশ অ্যাকশন নিতে বাধ্য।

শ্বশুরমশাই বললেন, সেটা আমি লিখিতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি।

ওসি বললেন, আপনি নন, ওঁকে জানাতে হবে। সেটা পাওয়ামাত্র আমি সৌরভবাবুকে জানিয়ে দেব যে তৃণা দেবীর আত্মহত্যা অথবা খুনের দায়িত্ব তাঁর ওপরই পড়বে। অন্য কেউ করলেও তিনি রক্ষা পাবেন না।

শাশুড়িঠাকরুন বললেন, চমৎকার! আমার মেয়েটা যদি খুন হয়ে যায় তাহলে তাকে কোথায় পাব আমি? খুন যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করুন।

এই সময় আবার বেল বাজল। সৌরভ উঠল না। তৃণাই গেল দরজা খুলতে। একটা বারো-তেরো বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে, কালোর মা তোমাদের বাড়িতে কাজ করে?

হ্যাঁ, কেন রে?

আমাকে বলতে পাঠাল আজ আসতে পারবে না। কাল আসবে।

কী হয়েছে ওর?

কাল রাতে কালোর বাপ মারা গিয়েছে। বডি আনতে হাসপাতালে গেছে সবাই।

সেকি, কী করে হল?

কী করে আবার? মাল খেয়ে গাড়ির তলায় পড়েছে। সবাই বলছে কালোর মা বেঁচে গেল। খুব প্যাঁদাত তো! কান্নাকাটি করছে না। আমায় বলল খবরটা দিতে।

এ ঘরের সবাই শুনছিল সংলাপগুলো। ওসি বললেন, ও, ওই লোকটার বউ বুঝি এখানে কাজ করে! হ্যাঁ, কাল মারা গিয়েছে। গিয়ে ফ্যামিলিটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। যাক গে, সৌরভবাবু, আপনাকে আমার শুধু একটা কথা বলার আছে। মেয়েদের মন খুব টেন্ডার হয়, সাবধানে হ্যান্ডেল করবেন। আচ্ছা চলি স্যার।

দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, আপনি বিয়ে করেছেন?

না, কেন? ও, আরে বইতে তো পড়েছি। কুসুম কোমল। হে হে হে। ওসি চলে গেলেন।

ফিরে এসে সৌরভ বলল, তৃণা, আমার মনে হয় তোমার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া উচিত।

একদম নয়। বিয়ের পর কেউ বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকে নাকি? তৃণা প্রতিবাদ করল।

এই যে আজ যা করলে–।

আমি কিছুই করিনি। দেখেছ মা, খামোকা আমাকে দোষ দিচ্ছে। একটু পরেই ওর চোখ লাল হয়ে যাবে, ঠিক খুনির মতো।তৃণা মায়ের কাছে চলে গেল।

ভবমামা বললেন, না সৌরভ, চোখ লাল করার অভ্যেস ছাড়ো। আমার মনে হয় এখন তোমার উচিত ছোটদি, তোমার মেজমামি, বড়মামিদের ডেকে এনে পালা করে বাড়িতে রাখা। আমিও মাঝে-মাঝে থাকতে পারি। আপনারাও আসুন। কী বলেন?

শাশুড়িঠাকরুন বললেন, জামাই-এর বাড়িতে তো বেশিদিন থাকা শোভন নয়, মেয়েজামাই আমাদের ওখানে পাকাঁপাকি থাকতে পারে।

তৃণা বলল, এখন না মা। কটা দিন দেখি, তারপর বলব।

দুপুরের স্নানখাওয়া শেষ করে ওঁরা বিদায় নিলেন। সৌরভের মনে হচ্ছিল বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। তৃণাকে সে এত ভালোবাসে, তবু ও তাকে এতটা সন্দেহ করে! কেউ সন্দেহ করলে তার মন জোর করে পরিষ্কার করা যায় না। কালোর বাবার সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য নেই। তবু লোকটা মদদ খেয়ে জীবনটা তার মতো উপভোগ করে গেছে। নিজেকে প্রচণ্ড অপমানিত বলে মনে হচ্ছিল তার।

এই সময় তৃণা কাছে এল, এই, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?

সৌরভ জবাব দিল না।

আসলে জানো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কিছু মেলে না।

এতদিন বলোনি তো?

বললে তুমি শুনতে? আমার যা করতে ইচ্ছে করে তা তোমার ভয়ে করতে পারতাম না।

তাই নাকি? যেমন?

যেমন ধরো, আমার কোনও ছেলেবন্ধু নেই। বিয়ের আগেও ছিল না, এখন তো কথাই ওঠে না। কিন্তু বইতে পড়ি দ্রৌপদীর সখা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তোমাকে ওই ইচ্ছের কথা বললে তুমি শুনতে?

বেশ তো, এখন যাও না, শুধু কৃষ্ণ কেন আরও চার পাণ্ডবকে ডেকে আনন।

ধ্যাত! ওটা বিশ্রী ব্যাপার। তৃণা চলে গেল, যেন লজ্জা পেয়েছে।

রাত্রেও তেমন কথা হল না। কথা বলতে ইচ্ছেই করছিল না সৌরভের। কিন্তু সে খুব চেষ্টা করে ক্রোধ সংবরণ করছিল।

পরদিন সকালে কালোর মা এল, কাল কামাই করতে হল, কিছু মনে কোরো না বউদি। লোকটা হাজার হোক মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেছিল। বডি বের করে না পুড়িয়ে থাকি কী করে!

তোমার একটুও কষ্ট হয়নি? তৃণার গলা।

নাঃ। বেঁচে থাকতে যা কষ্ট দিয়েছে তাতে সব সয়ে গেছে।

এক ফোঁটা কাঁদোনি?

না, কাঁদব কেন? বেঁচে গেছি আমি। ও না মরলে আমাকে ঠিক খুন করত। কাজে লেগে গেল কালোর মা।

পায়ে-পায়ে ঘরে এল তৃণা। বিছানায় বসে পাথর হয়ে কথাগুলো শুনছিল সৌরভ। তৃণা এসে ওর গায়ে ঠেলা দিল, এই, কী ভাবছ?যাঃ, এরকম করে বসে থেকো না। বিধবা হওয়ার কথা ভাবলে আমার এখনই কী কান্না পায়, এই জানো?

তখন কেঁদে কি লাভ হবে? অদ্ভুত গলায় বলল সৌরভ।

শুনেছি বিধবা বউ কাঁদলে স্বামীর আত্মা শান্তি পায়। বাঙালি মেয়ের উচিত স্বামীকে শান্তি দেওয়া, তাই না? ওঠো বলছি। তৃণা হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল।

রেগে যেতে-যেতেও নিজেকে সামলে নিল সৌরভ। চাপা গলায় বলল, তুমি আমাকে অপমান করেছ।

তৃণা চেঁচাল, মোটেই না, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি আত্মহত্যা করলে বা খুন হলে পুলিশ তোমাকে ধরতই। সারাজীবন ধরে জেলে যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে তা থেকে বেঁচে গেলে, একটু কৃতজ্ঞ হও, প্লিজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress