Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বর্গের বাহন || Syed Mustafa Siraj » Page 4

স্বর্গের বাহন || Syed Mustafa Siraj

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রামবাবু কলকাতা ফিরে গেলেন। কর্নেল সেই ‘মার্ডার উইপন’ঝামা ইটের টুকরোটা আতস কাঁচের সাহায্যে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলেন। সেই সময় মুনারুনার কাছে শোনা ‘বোররাখ’-এর ছবির ব্যাপারটা বললাম ওঁকে। কবরখানার সেই জিনটির কথাও বললাম–যে নাকি মহাকাশের কোন গ্রহের প্রাণী এবং ফেরারি হয়ে পৃথিবীতে অজ্ঞাতবাসে আছে। এও বললাম, “সেই গ্রহের পুলিশ এসে আসামিকে গ্রেফতার করলে দারুণ ব্যাপার হবে কী বলেন? জিন-পুলিশেরা মানুষ-পুলিশ থেকে নিশ্চয় বেশি তেজী। তাদের বন্দুক-পিস্তল থেকে গুলির বদলে সম্ভবত লেসার রশ্মি বেরোয়।”

কর্নেল আমার রসিকতায় একটুও হাসলেন না। ইটটাকে হাতে নিয়ে বেরুলেন। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম, সেটাকে ছুঁড়ে পোড়ো আগাছার জমিতে ফেলে দিলেন। বললাম, “এ কী করলেন! মার্ডার উইপন ফেলে দিলেন কেন?”

কর্নেল ঘরে ঢুকে মুচকি হেসে বললেন, “তুমি অবভাস-তত্ত্ব কাকে বলে জানো, জয়ন্ত?”

বিরক্ত হয়ে বললাম, “তত্ত্ব-উত্ত্ব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হাতে মার্ডার উইপন পেয়েও”।

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “অবভাস-তত্ত্ব অনুসারে হোয়াট অ্যাপিয়ারস ইজ নট রিয়্যাল–যা প্রতীয়মান, তা বাস্তব নয়। যেমন ধরো, রেললাইনে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকালে মনে হবে দুটো লাইনের ব্যবধান কমতে কমতে ক্রমশ একত্র মিশে গেছে। কিন্তু বস্তুত তা নয়। দুটো লাইন সমান্তরাল থেকে গেছে। শেষ পর্যন্ত।”

“বুঝলাম। ইটটা মার্ডার উইপন নয়, বলছেন তো?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে বললেন, “ইটটাতে রক্ত লেগেছিল এবং সেটা নাসির খায়ের হাতে ছিল, এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, নাসির সাহেব তাহের মিয়া খুন হওয়ার পর কোনো একসময় কবরখানায় ঢুকেছিলেন। এছাড়া আরও একটা তথ্যও অনুমান করা চলে। হাতে এই ইটটা উনি তুলে নিয়েছিলেন কেন? নিশ্চয় কাউকে মারার জন্যে?

রামবাবুকে নয় তো? রামবাবুও তো কবরখানায় ঢুকেছিলেন এবং–”

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “তাহলে রামবাবু তাই বলতেন। উনি নাকি কোন কবরের ভেতর একটা শুটকো মড়াকে গিরগিটির মতো ঢুকে যেতে দেখেছিলেন। ব্যাপারটা যাই হোক, বোঝা যায় নাসির খাকে রামবাবু দেখেননি। তার মানে, তাহের মিয়া খুন হবার সময় থেকে রামবাবুর কবরখানায় ঢোকার সময় পর্যন্ত নাসির খাঁ এবং অন্য একটা লোক সেখানে ছিল।”

“তাহলে সেই লোকটাই তাহের দর্জির খুনী!”

“নিশ্চয় করে বলার মতো তথ্য হাতে নেই ডার্লিং!” কর্নেল একটু হাসলেন। “কেসটা তুমি যতটা সহজ ভেবেছিলে, হয়তো তা নয়।”

“কিন্তু ছবিটার কথা বিড্ডুও বলেছে। এদিকে মুনারুনাও যা বলল, তাতে মনে হয় ওই ছবির জন্যই এই খুনোখুনি। আপনি বেগমসায়েবাকে জিগ্যেস করছেন না কেন?”

কর্নেল সে-কথার জবাব দিলেন না। বললেন, “শীতের সময়ও ভাত-ঘুমের অভ্যাসটা না ছাড়তে পারলে ভবিষ্যতে তোমাকে ভুগতে হবে, জয়ন্ত! উঠে পড়ো। আমরা বেরুব।”

করুণ মুখ করে বললাম, “আপনি তো পাখি-প্রজাপতির পেছনে ঘুরবেন। আমি খামোকা গিয়ে কী করব?”

কর্নেল আমাকে টেনে ওঠালেন। “পাখি-প্রজাপতি নয়, অর্কিড। জাহানাবাদে একসময় প্রচুর আমবাগান ছিল। এই নবাবদেরই অনেক বাগান ছিল। সেই সব বাগানের আমের কথা শুনলে জিভে জল আসবে তোমার। কী সব নাম! কহিতুর, বেগমখোশ, বাদশাভোগ, শাদুল্লা! যাই হোক, তুমি নিশ্চয় জানো, আমগাছে একজাতের অর্কিড থাকে। এই শীতের সময় সেই অর্কিডের ফুল ফোটে। জয়ন্ত, তুমি শুনলে অবাক হবে যে এদেশে আমও যেমন বিদেশি গাছ, তেমনি ওই অর্কিডও বিদেশি।”

কর্নেলও রামবাবুর চেয়ে কোনো অংশে কম যান না। তাঁর সুদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ হল কেল্লাবাড়ির বাইরে পৌঁছে নহবতখানা নামক প্রাচীন দেউড়ির বাইরে সদরদরজায় গিয়ে। একটা সাইকেল রিকশো ডেকে তাতে উঠে বসলাম দুজনে। তারপর কর্নেল রিকশোওলাকে বললেন, “রোশনিবাগ।”

জাহানাবাদকে একটা পুরনো গঞ্জ বলাই ভালো। কিন্তু যেদিকে তাকাই, খালি ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। তার মাঝে মাঝে নতুন বা পুরনো ঘরবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল রিকশোওলার সঙ্গে কথা বলছিলেন। টুরিস্টদের ব্যাপারে রিকশোওলা তেতোমুখে জানাল, ইদানীং ট্যুরিস্ট আসা একেবারে কমে গেছে। কারণ এ তল্লাটে খুনখারাপি, ছিনতাই আর চুরিডাকাতির উপদ্রব বেড়ে গেছে। গত শীতের মরসুমে যাও কোনো-কোনো দিন কিছু ট্যুরিস্ট দেখা গেছে, এবার তাও দেখা যাচ্ছে না। এলে তারা গাড়ি চেপে আসে এবং কিছুক্ষণ থেকেই ফিরে যায়। তবে এবার নাকি সরকার কেল্লাবাড়ির ভার হাতে নিয়েছেন। রিকশোওলা আশা করছে, টুরিস্টদের ভিড় হতেও পারে। আসলে জাহানাবাদে রাত কাটানোর জায়গা নেই। সরকার যদি ট্যুরিস্ট লজ তৈরি করেন, তাহলে ভাল হয়।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “কে যেন খুন হয়েছে আজ, জানো নাকি?”

রিকশোওলা বলল, “সে তো তাহের দর্জি। কেল্লাবাড়ির কবরখানায় খুন হয়েছে। আসলে কী জানেন স্যার? তাহের ছিলো মাগলার। কবরখানায় মাগলাররা মাল লুকিয়ে রাখে। সেই নিয়ে কী ঝগড়া। শেষে জানেই মেরে দিল।”

“শুনেছি নবাবদের এক জামাইও নাকি কবরখানায় খুন হয়েছিলেন।”

রিকশোওলা এক কথায় বলে দিল, “ওই মাগলারি কারবার।”

“তিনিও স্মাগলার ছিলেন নাকি?”

রিকশোওলা খি খি করে হাসল। “এই যে দেখছেন জাহানাবাদে যত লোক, তার অর্ধেক মাগলার।” বলে সে রিকশোর গতি কমিয়ে জানাল, আমরা রোশনিবাগ এসে গেছি।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “রিকশাওলা, তোমার নামটা কী ভাই?”

“আমার নাম স্যার রশিদ।”

“রশিদ, তুমি গিয়াসুদ্দিন সাহেবের বাড়ি চেনো?”

রশিদ রিকশোওলা রিকশোর ব্রেক কষে একটু চিন্তাভাবনা করে বলল “গিয়াসুদ্দিন তো দুজন আছে। এক গিয়াসুদ্দিন তো সেই নহবতখানার কাছে থাকে। তবে রোশনিবাগে–হ্যাঁ, হ্যাঁ! আপনি তাহলে স্যার গিয়াসুদ্দিন পাঠানের কথা বলছেন।”

“তার ছেলে কলকাতায় জাহানাবাদের বড়নবাবসাহেবের কাছে থাকেন। ফরিদ তাঁর নাম।”

রিকশাওলা হাসল। “তাই বলুন! ফরিদ পাঠানের বাবা গিয়াসুদ্দিন। ঠিকই ধরেছি। আসুন, বাড়ি দেখিয়ে দিই।”

সে রিকশোটা রাস্তার ধারে রেখে আগাছাভরা জমির ভেতর পায়ে চলা পথে আমাদের নিয়ে চলল. একটা প্রাচীন মসজিদের পাশে একতলা জরাজীর্ণ বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে আমাদের আদাব দিলেন। তার মাথায় সাদা টুপি, পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। রশিদ রিকশোওলা বলল, “আপনারা ফিরে যাবেন তো স্যার?”

কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ। তুমি অপেক্ষা করো গিয়ে।”

রিকশাওলা চলে গেলে বিস্মিত বৃদ্ধ বললেন, “আপলোক কাহাসে আতা, সাব?”

কর্নেলও উর্দুতে বললেন, “কালকাত্তাসে। আপকা আওলাদ ফরিদসাব হামলোগোঁকা জানপহচান আদমি। তো উনহিনে বাতায়া, কী–”।

গিয়াসুদ্দিন সাহেব একটু হেসে বললেন, “আইয়ে, আইয়ে! তশরীফ ফরমাইয়ে!”

কর্নেল কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, “শুকরিয়া!” তারপর দুজনের মধ্যে যে কথাবার্তা হল, তা এরকম :

“নিজামতকেল্লায় বেড়াতে আসার সাধ ছিল বহুদিনের। তো ফরিদসাহেব বলেছিলেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন নবাবসাহেবের বোনের বাড়িতে। যাই হোক, ফরিদসাহেবই বলেছেন, তাঁর বাবার খোঁজ নিয়ে যেতে, তিনি কেমন আছেন। সেজন্যই এলাম আপনার কাছে। আপনার সব কুশল তো?”

“আমার আর কুশল! কোনোরকমে বেঁচে আছি। ফরিদ আমার খোঁজ নিতে বলেছে শুনে অবাক লাগছে। সে তো ভুলেও আমার নাম করে না। একটা চিঠি পর্যন্ত লেখে না।”

“সময় পান না আসলে।”

“ফরিদের আশা আমি করি না। আমি তাকেও খরচের খাতায় ধরেছি। জাভেদ যেমন গেছে, তেমনি ফরিদও গেছে। দুজনেই নিপাত্তা হয়ে গেছে বলে ধরে নিয়েছি। কাজেই ওদের জন্য আমার কোনো দুঃখ-বেদনা নেই।”

“জাভেদ কে?”

“আমার ছোট ছেলে। হঠাৎ একদিন সে নিপাত্তা হয়ে গেল তো গেলই। পুলিশকে জানালাম। কোনো ফল হল না। লোকে বলে হয়তো স্মাগলারদের পাল্লায় পড়েছিল। মেরে গুম করে দিয়েছে।”

“কতদিন আগে সে নিখোঁজ হয়েছে?”

“প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল।”

“জাভেদসাহেবের বয়স কত ছিল?”

“পঁয়ত্রিশ হবে। খুব জোয়ান, শক্ত সমর্থ চেহারা ছিল তার। স্বভাবে ফরিদের একেবারে উল্টো। তবে আপনি ফরিদের চেনা লোক। আপনাকে গোপন করব না, জাভেদের নাম পুলিসের খাতায় উঠেছিল।”

“কেন?”

“জাভেদ খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খুন-ডাকাতি মারদাঙ্গা এইসব করে বেড়াত। নিজের ছেলে। বেশি কী আর বলব, বলুন। তবে কি না বাপের মন। কষ্ট হয়!”

বৃদ্ধ গিয়াসুদ্দিন চোখ মুছে বললেন, “এভাবে দাঁড়িয়ে কথা না বলে দয়া করে ভিতরে এসে বসুন। অন্তত একটু চা খেয়ে যান গরিবের বাড়িতে।”

কর্নেল বললেন, “ক্ষমা করবেন। আমাদের খুব তাড়া আছে। চলি। তবে ফরিদসাহেবকে বলব–”

গিয়াসুদ্দিন বাধা দিয়ে বলল, “ছেড়ে দিন। আমি ওদের দয়ার প্রত্যাশী নই।”…

রিকশোয় উঠে চাপা স্বরে বললাম, “ফরিদসাহেবের বাবার কথা কোথায় শুনলেন?”

কর্নেল গুম হয়ে কী ভাবছিলেন। আনমনে বললেন, “বেগম-সায়েবার কাছে।”

“জাভেদের কথাও নিশ্চয় বেগমসায়েবা বলেছেন?”

“হু।” বলে কর্নেল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “রোখকে! রোখকে!” তারপর রিকশো থামলে নেমে দাঁড়ালেন। পার্স বের করে বললেন, “ঠিক আছে রশিদ। তুমি এস। আমরা এবার পায়ে হেঁটে একটু ঘরব।”

রশিদ রিকশোওলা দশ টাকার নোট পেয়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে সেলাম ঠুকল। তারপর হুঁশিয়ার করে দিল। আমরা ছিনতাই বা ডাকুর পাল্লায় পড়তে পারি বলেই। আজকাল নাকি সন্ধ্যার মুখে লোকেরা একদোকা ঘুরতে সাহস পায় না।

সে চলে গেলে কর্নেল বাঁ দিকে একটা জঙ্গুলে জায়গার দিকে পা বাড়ালেন। জিগ্যেস করলাম, “এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? অর্কিডের খোঁজে বুঝি?”

কর্নেল হাসলেন। “ঠিক ধরেছ, ডার্লিং! ওই বিশাল আমগাছটার দিকে তাকালেই তোমার চোখ জ্বলে যাবে।”

চোখ অবশ্য জ্বলে গেল না। তবে লাল অর্কিড ফুলের ঝালরগুলো সত্যিই সুন্দর। কর্নেলের খালি চোখে কিছু দেখে যেন তৃপ্তি হয় না। বাইনোকুলারে চোখ রেখে কিছুক্ষণ ফুলবতী অর্কিডটাকে দেখলেন। তারপর পা বাড়িয়ে বললেন, “ফেরার সময় অন্তত একটা গুচ্ছ সঙ্গে নিয়ে যাব।”

“অত উঁচু থেকে পাড়া যাবে না!”

কর্নেল উৎসাহে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আবু নিশ্চয় গাছে চড়তে পারে। অসুবিধে হবে না।”

“আবু! সে আবার কে?”

“বেগমসায়েবার বান্দা।”

“লোকটার নাম শুনেছি–যদিও এখনও তাকে চোখে দেখিনি।”

“দেখেছ।”

“মনে হচ্ছে না তো!”

“দুপুরে তোমার সিগারেট এনে দিল। গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের দরজা খুলে দিল। ডার্লিং, তোমাকে বহুবার বলেছি, ভাল রিপোর্টার হতে হলে একটা জিনিস খুব জরুরি–অবজার্ভেশন। পর্যবেক্ষণ।”

“হা,–গাঙ্গুলিদা বলছিলেন বটে। কিন্তু আবু নামে কোনো লোক–” লাফিয়ে উঠলাম। “মাই গুডনেস! সে তো একটা পুঁচকে ছেলে। আমার সিগারেট এনে দিল যে ছেলেটা।”

“সেই আবু।”

“কী আশ্চর্য! আমি ভাবছিলাম–”

“তুমি ভেবেছিলে আরব্য উপন্যাসের সেই বান্দা আবদালাকে। কারণ মিনাকে তুমি মর্জিনা ধরে নিয়েছিলে!”

“ঠিকই বলেছেন। নবাব বাদশা বান্দাবাদীদের ব্যাপার কি না।”

“ডার্লিং, আবু ছেলেটি মিনার সহোদর ভাই। ওরা ভাইবোন অনাথা বেগমসায়েবা ওদের আশ্রয় দিয়েছেন।”

জিভ কেটে বললাম, “ছ্যা ছ্যা! আমি আবু-মিনা সম্পর্কে কী সব ভেবে বসে আছি!”

কথা বলতে বলতে আমরা একটা ভাঙা মসজিদের কাছে এসে পড়েছিলাম। তার নিচে একটা জলা। জলার ধারে পৌঁছে কর্নেল বললেন, “সকালে এই জলাটাতে একঝক বুনোহাঁস দেখেছিলাম।” বলে বাইনোকুলার স্থাপন করলেন, চোখে।

দিনের আলো কমে আসছে দ্রুত। জলার ধারে হাওয়াটাও এরই মধ্যে ঠাণ্ডাহিম হয়ে উঠেছে। গাছপালার গায়ে দিনমানে যে ফিকে নীল কুয়াশার হাল্কা আলোয়ান চাপানো ছিল, এখন ক্রমশ তার রঙ ঘন নীল হয়ে উঠেছে। কর্নেলের পেছন-পেছন হেঁটে জলার সীমানা পেরিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। বললাম, “আপনি কি সত্যি বুনোহাঁস খুঁজছে, কর্নেল?”

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে চুরুট ধরালেন। এখন আমরা একটা ঘাসে একটা ঢাকা নিচু বাঁধের ওপর পৌঁছেছি। বাঁধটা জলা ঘুরে ডাইনে বেঁকে গেছে এবং তার ওধারে গাছের ফাঁকে অস্তসূর্যের শেষ আলোয় যা ঝলমল করছে, তা নিশ্চয় গঙ্গা। বাঁধটার বাঁদিকে জলার দক্ষিণে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। ডান দিকে ধ্বংসস্তূপ, খাড়া দেয়াল, গম্বুজাকৃতি জীর্ণ কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন সুতরাং আমরা ঘুরপথে নিজামতকেল্লার কাছেই ফিরে এসেছি আবার।

কর্নেল বাঁধ থেকে ডানদিকে নেমে গিয়ে বললেন, “সর্বত্র বন্দুকবাজদের অত্যাচারে পাখিরা অতিষ্ঠ। সকালে যে হাঁসের ঝাকটিকে দেখেছিলাম তারা মনে হচ্ছে কোনো বন্দুকবাজের তাড়া খেয়েই পালিয়ে গেছে। ঘাসের ভেতর একটা কার্তুজের খোল পড়ে থাকতে দেখলাম।” বলেই হন্তদন্ত হয়ে ঝোঁপঝাড় ভেঙে এগিয়ে গেলেন।

জায়গাটা একে তো ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি, তাতে আবার অজস্র ইটের টুকরো পড়ে রয়েছে। পায়ে-পায়ে ঠোক্কর খেতে-খেতে হাঁটছিলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম, “এমন করে যাচ্ছি কোথায় আমরা?”

কর্নেল আমার অনেকখানি আগে হাঁটছিলেন। হঠাৎ কাউকে বললেন, “এই যে ভাই! শুনুন, শুনুন।”

এতক্ষণে লোকটাকে দেখতে পেলাম। বেঁটে গোলগাল গড়ন, মাথায় টাক এবং পুরু গোঁফ, পরনে একটা ছাইরঙা আঁটো প্যান্ট আর নীলচে শার্ট, এবং হাতে বন্দুক।

এই তাহলে সেই বন্দুকবাজ। লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে আমাদের দেখছিল। ভাবলাম কর্নেল তাকে বকাবকি করবেন। কারণ আজকাল শিকারের ব্যাপারে আইন-কানুন খুব কড়া।

কিন্তু কর্নেল অমায়িক হেসে জিগ্যেস করলেন, “মারতে পারলেন কিছু?”

লোকটি হাসল। “জী না স্যার! পাখিরাও আজকাল বড় চালাক হয়েছে। তা আপনারা কি সরকারি লোক?”

কর্নেল বললেন, “মোটেই না। আমরা ট্যুরিস্ট। নিজামতকেল্লা দেখতে এসেছি।” কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন। “আর কী কী দেখার জিনিস আছে এখানে, বলুন তো ভাই! আপনি যখন স্থানীয় লোক, তখন তো সবই জানেন!”

লোকটি খুব উৎসাহে গাইডের ভূমিকা নিল। জলাটা দেখিয়ে বলল, “এই হল রোশনি ঝিল। নবাব সুজাউদ্দিন এই ঝিলের ধারে প্যালেস তৈরি করেছিলেন। আমরা কিন্তু সেই প্যালেসের ওপর দিয়ে হাঁটছি।” সে প্রচুর হাসল এবং ব্যাপারটা গভীরভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য জুতোর ডগা দিয়ে একটুকরো ইটে আঘাত করল। “আর ওই যে গম্বুজঘর দেখছেন, ওটা কলজেখাকির কবর। কোন আমলে জানি না, নবাবদের এক বিধবা বোন ছিল। রোজ সে মানুষের কলজে খেত। বিস্তর মানুষ মারা পড়েছিল, বুঝলেন স্যার? তখন বুড়ো নবাব মেয়েকে জ্যান্ত কবর দিলেন ওখানে।”

কর্নেল বললেন, “জাহানাবাদে দেখছি খালি কবর আর কবর!”

লোকটি চঞ্চল হয়ে বলল, “জী, তা ঠিক। তবে আপনারা কি নবাবদের কবরখানা দেখতে যাচ্ছেন?”

“কেন? কী আছে সেখানে?”

“খুব জেন্দা কবরখানা স্যার!”

“জেন্দা মানে?”

লোকটি গম্ভীর মুখে বলল, “শোনা কথা। তবে সন্ধ্যা লাগলে আমারও সাহস নেই ওখানে যেতে। সন্ধ্যায় নাকি পুরনো, নবাবদের চলাফেরা শুরু হয়। কবর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সামনে মানুষ পড়লে তার বিপদ। বাইরের লোকের কথা কী বলব স্যার, ছোটনবাবই তো পাগল হয়ে গেছে ডরের চোটে।” বলে। সে দাঁড়িয়ে গেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল ফের, “আজই তো তাহের নামে এক দর্জির লাশ পাওয়া গেছে ওখনে। রাগের চোটে এমন আছাড় মেরেছে, মাথার খুলি চুরমার হয়ে গেছে।”

সে আবার পা বাড়ালে কর্নেল বললেন, “আপনার নামটা, কী ভাই?”

“ইদ্রিস। ইদ্রিস আলি। নহবতখানার দেউড়ি দেখেছেন তো?”

“দেখেছি।”

“তার নজদিগে আমার বাড়ি। আমি পঞ্চায়েতের মেম্বার, স্যার।”

“সেই কবরখানাটা কোনদিকে?”

“ওই তো!” সে হাত তুলে উত্তর-পশ্চিম কোণে নির্দেশ করল। তারপর বলল, “আপনারা কি এখন সেখানে যাবেন ভাবছেন? আমি বলি কী, এখন ওখানে না যাওয়াই ভাল। সন্ধ্যা হয়ে এল। তা আপনারা কি কারুর বাড়িতে উঠেছেন?”

‘হ্যাঁ।”

“তাহলে কাল দিনেসবরেই দেখে আসবেন। আপনারা কার বাড়িতে উঠেছেন স্যার?”

“স্টেশনমাস্টারের। উনি আমার আত্মীয়।”

ইদ্রিস আলি বন্দুক কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেল। সূর্য। গঙ্গার ওপারে অস্ত গেছে ততক্ষণে। কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে একটু হেসে বললেন, “এস জয়ন্ত, আমরা নবাবী গোরস্তানের পাশ দিয়েই ডেরায় ফিরি।”

হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “গোরস্তানটা সম্পর্কে অদ্ভুত কুসংস্কার তাহলে এখানে চালু আছে দেখছি!”,

“চালু করা হয়েছে।”

“কেন?” বলেই স্মাগলার-চক্রের কথাটা মনে পড়ে গেল। তাই বললাম ফের, “হ্যাঁ–স্মাগলিংয়ের স্বার্থে। রাতের দিকে সম্ভবত চোরাচালানিরা এসে ওখানে–”।

কর্নেল হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “চুপ!” তারপর আমার কাঁধে চাপ দিয়ে আমাকে নিয়ে বসে পড়লেন ঝোঁপের আড়ালে। তারপর গুঁড়ি মেরে কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। উনি আমার কাধ চেপে গুঁড়ি মেরে চলতে বাধ্য করেছেন। একটু পরে ঝোঁপের ফাঁকে মাথা তুলে চাপা স্বরে বললেন, “এবার তুমিও দেখতে পারো, ডার্লিং!”

ঝোঁপের সামনে টানা একটা পাঁচিল। পাঁচিলটা ফুট ছয়েকের বেশি উঁচু নয়। দেখামাত্র বুঝতে পারলাম, নবাবী কবরখানার দক্ষিণ প্রান্তে এসে পড়েছি আমরা। কবরখানাটা উঁচুতে। যথেষ্ট গাছপালা, ফুলের ঝোপে ভর্তি। তারপর দেখি, সেই ইদ্রিস আলি কবরখানার ভেতর এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হেঁটে চলেছে। একটু পরে সে বসে পড়ল। আর তাকে দেখতে পেলাম না। বললাম, “কী ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে না তো!”

কর্নেল হাসলেন। “তোমাকে সবসময় বলি জয়ন্ত, অবজার্ভেশন–পর্যবেক্ষণ একজন ভাল রিপোর্টারের জন্য জরুরি। তুমি একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারতে, ইদ্রিস আলি বাংলা বলছে চমৎকার। কিন্তু তার দন্ত্য স জোরালো। তাছাড়া তার উচ্চারণভঙ্গিতে সূক্ষ্ম পার্থক্য। তুমি ভাবছিলে বাঙালি মুসলিমরা হয়তো জ্যান্তোকে জেন্দা, ভয়কে ডর বলেন। তাই এতটা লক্ষ্য করোনি। জাহানাবাদে প্রচুর মুসলিম আছেন, যাঁদের মাতৃভাষা এখনও উর্দু। তারা অনেকেই চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। কিন্তু সুক্ষ্ম উচ্চারণ-পার্থক্য ধরা যায়। যাই হোক, এই ইদ্রিস আলির চেহারা দেখেও তোমার চেনা মনে হওয়া উচিত ছিল। কারণ কলকাতায় তার দাদাকে তুমি দেখেছ!”

উত্তেজিতভাবে বললাম, “কর্নেল! এই লোকটিই কি তাহলে নিরুদ্দিষ্ট জাভেদ পাঠান?”

“আস্তে!” কর্নেল হুঁশিয়ারি দিলেন। “ওর হাতে যেটা তুমি সাধারণ বন্দুক ভেবেছ, লক্ষ্য করলে দেখতে ওটা একটা রাইফেল। হতভাগ্য পাগল নাসির খায়ের জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে, জয়ন্ত!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress