Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্ট্রাইকার || Moti Nandi » Page 5

স্ট্রাইকার || Moti Nandi

আনোয়ার আর নিমাইয়ের সঙ্গে

২১.

আনোয়ার আর নিমাইয়ের সঙ্গে যাত্রীতে এসে প্রথম দেখা প্র্যাকটিস শুরুর আগের দিন। ড্রেসিং রুমে আমরা জনাকুড়ি, কারোর সঙ্গেই তেমন আলাপ নেই। ওদের দুজনের পাশে আমি বসেছিলাম আড়ষ্ট হয়ে। প্রিয়া আমাদের কাছে ফুটবল সম্পর্কে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেন। ওঁর পাশে বসেছিল ডাকুদা। যুগের যাত্রীর ঐতিহ্য এবং তা বহন করার দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে ডাকুদাও দু-চার কথা বলে।

ফুটবল খুবই সহজ খেলা, যদি না তুমি একে জটিল করে খেলো। প্রিয়দা প্রথমেই এই কথাটা বলেছিলেন, আমরা এত বড়, এত পুরনো টিম, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও লিগ বা শিন্ড পাইনি। একবার মাত্র ফাইনালে উঠেছিলাম, কিন্তু. ডাকুদা থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের চোখ আমার উপর এসে পড়েছিল।

আমি প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যেন তারা অদ্ভুত একটা জন্তু। দেখছে। কারোর ঠোঁট বাঁকা, কেউ কেউ চোখে চোখে হাসল। আমি মাথা নিচু করে ঘেমে উঠলাম। মনে হল, ডাকুদা ইচ্ছে করেই আমাকে এই অবস্থায় ফেলেছে। যেন কিছু একটার প্রতিশোধ নিচ্ছে। নিমাই তখন হঠাৎ বলেছিল, ফাইনালে উঠে কেউ না কেউ তো হারবেই। আমরা আবার যাত্রীকে ফাইনালে তুলব, শিল্ডও নেব। বলে নিমাই সকলের মুখের দিকে তাকায়। শুধু আনোয়ারই বলে, নিশ্চয়ই।

বেলেঘাটায় যাত্রীর মেসে আর চারজনের সঙ্গে নিমাইও থাকে। আনোয়ার আর আমিও ছিলাম লিগ শুরুর আগে পর্যন্ত। সকালের প্র্যাকটিস বন্ধ হওয়ায় আর একটার পর একটা খেলায় বসে থাকায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে আমি বাড়ি চলে আসি। মেসে কারও সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলতাম না।

নিমাই আর আনোয়ারকে বিশেষ করে এড়িয়ে চলতাম। দেখা হলে কথা হত। সাধারণ কথা। আগের মতন গলাগলি আর ফিরে আসেনি। কিন্তু বুঝতে পারি, ওরা চায় আবার আমরা থ্রি মাসকেটিয়ারস হই। কিন্তু আমিই সহজ হতে পারি না। সকলের সামনে ডাকুদা শিন্ড ফাইনালের কথা তোলার পর থেকে আমি কুঁকড়ে গেছি।

বাড়িতে কেউ খেলা নিয়ে কথা বলত না। খেলার দিন দুপুরে যখন বাড়ি থেকে বেরোই, তখন শুধু পিন্টুর কথা মনে পড়ত। কিন্তু ও স্কুলে থাকে দুপুরে। বাড়িতে থাকলেও মাঠে যাবার বায়না ধরবে না। ও বোঝে আমার অবস্থাটা। নীলিমা আর মা, ওরাও কিছু বলে না। দিনরাত পড়াশোনা করে ফেল করলে, বাড়ির লোক যেমন ব্যবহার করে, ওরা তাই করছে। শুধু বিশু দত্ত একদিন দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলেছিল, কী গো প্রসূন, কাগজে আর নামটাম দেখছি না যে?

কখন যে চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে শুরু করেছে বুঝিনি। বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে সেটা গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশিয়ে দিলাম। কানে কানে কে যেন বলল, হাল ছেড়ো না, হতাশ হয়ো না প্রসূন! উদ্যত থাকো, সময় এলেই আঘাত করবে। আমি আপন মনে মাথা নাড়লাম। পারব না, আর আমি পারব না। ইডেনের ধারে বাসস্ট্যান্ড। আমি শেষ বাসে উঠে বাড়ি এলাম।

.

হাওড়া ইউনিয়নের সঙ্গে ৫-০ গোলে যাত্রী জিতছে, খেলা শেষ হতে প্রায় দশ মিনিট বাকি। ডাকুদা ইশারায় প্রিয়দাকে ডাকল। তার পর প্রিয়া আমার কাছে এসে বললেন, ওয়ারম আপ প্রসূন।

অবাক হয়ে গেলাম। তা হলে কি কপাল ফিরল! প্রিয়দা রাইট আউট সলিল করকে ডেকে নিলেন। নামার আগে মাঠে আঙুল ঠেকিয়ে যখন কপালে বুকে ছোঁয়ালাম, সারা শরীর কেঁপে গেল। নিমাই ছুটে কাছে এসে বলল, বল দেব, গোল কর।

আধ মিনিটের মধ্যেই নিমাই বল পাঠাল, হাওড়ার হাফ লাইন বরাবর। ছুটে গিয়ে ধরতে পারলাম না। গ্যালারিতে আওয়াজ উঠল। চারদিকে তাকিয়ে কেমন অস্বস্তি হল। নতুন নতুন লাগছে সব। প্লেয়াররা কত দূরে ঠিক আন্দাজ হচ্ছে না। কখন ছুটব, ফাঁকা জমি কোথায়, বল কোথা থেকে আসবে, কিছু বুঝছি না।

দিনরাত পড়ে জলের মতন যা মুখস্থ ছিল, এখন আর তা মনে পড়ছে না। অনেক দিন বই না খুললে যা হয়। উৎকণ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। ক মিনিট পরেই হুইসল বাজবে। তার মধ্যে একটা কিছু করতেই হবে। ডজ করব কি তিন-চার জনকে? চেঁচালাম, নিমাই, দে।

গ্যালারিতে হাসির রোল উঠল। একজনকে কাটিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বলকে সেই রকম আগের মতন অনুভব করতে পারছি না। বলটা পায়ে আছে কি নেই, বুঝতে পারিনি। শরীরটাকে কতখানি দোলাব, কোমর থেকে ঝাঁকুনিটা কখন দেব, আন্দাজ করতে পারিনি।

নিমাই বল নিয়ে ডান দিকের কনার ফ্ল্যাগের দিকে এগোচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকে এলাম বক্সের মধ্যে। নিমাই কাটাল লেফট ব্যাককে। বলটা আমায় ঠেলেই স্টপারকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে বলল, বল দে আমায়। আমি বল। ঠেললাম সোজা স্টপারের পায়ে। গ্যালারি বিরক্তি জানাল বেশ জোরেই। নিমাই করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘাবড়ে গেছিস। বি স্টেডি।

.

পাঁচ গোলে জিতছি, তাই আমার বোকামি আর অপদার্থতা রাগের বদলে মজার জিনিস হয়ে উঠল গ্যালারিতে। খেলার মধ্যে আর কিছু উত্তেজনা নেই, তাই ওরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। একটার পর একটা ভুল করছি আর মনে হচ্ছে যেন ডুবে যাচ্ছি। বিষ্টু কোমরে হাত দিয়ে হাসছে। অমিয় মজা পেয়ে বলছে, অ্যাই, অ্যাই, প্রসূনকে বল দে। গ্যালারি ফেটে পড়ছে হাসিতে। নিমাইয়ের ডিফেন্স চিরে দেওয়া থু-টা যখন প্রচণ্ডভাবে পোস্টের চার গজ বাইরে মারলাম, তখন হাওড়ার দু-তিনজনও হাসি চাপতে পারল না। আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। আর তখনই খেলা ভাঙার হুইল বাজল। কে এসে আমার পিঠে হাত রাখল। মুখ তুললাম। দেখি, নিমাই চলে যাচ্ছে।

আমি যাত্রীর টেন্টের দিকে লিগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর যাইনি। ক্লাব থেকে লোক এসেছিল ডাকতে। শিবরমনের হাঁটুতে জল জমেছে। এই সিজনে আর খেলতে পারবে না। নিমাই আর বিষ্টুর উপর চাপ পড়ছে খুব। একটা ম্যাচও জিরোতে পারেনি ওরা। মাঝে মাঝে দীপুদাকে খেলানো হয়েছে ওদের একজনকে বসিয়ে। দীপুদা তেরো বছর আগে যাত্রীতে প্রথম খেলা শুরু করেন। এখন আর পারেন না। নতুন ছেলেদের মধ্যে সৌমেন আর বলাইয়ের নাম কাগজে দেখেছি।

যাত্রী লিগে চতুর্থ হয়েছে। বছরের সব থেকে বড় কৃতিত্ব মোহনবাগানের কাছ থেকে একটা পয়েন্ট নেওয়া। নিমাই প্রথমে গোল দিয়েছিল। পেনালটি থেকে প্রণব গাঙ্গুলী শোধ করে। কাগজ পড়ে বুঝতে পারলাম না নিমাই কেমন খেলেছে। রিপোটারদের মধ্যে যাত্রীর সাপোর্টার একজনও নেই। মোহনবাগানকে গোল দিতে পেরে নিমাই যে দারুণ খুশি, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

বিকেলে আমার ছোট্ট পাঠশালায় পিন্টুর বন্ধুদের নিয়ে প্র্যাকটিস করছিলাম। তখন নিমাই আর আনোয়ার এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। ওরা রংচঙে বুশ শার্ট পরেছে, চুলগুলো যেমন বড়, জুলফিও তাই। পায়ে দামি চটি। দুজনেরই হাতে বিদেশি ঘড়ি।

যাস না কেন টেন্টে? নিমাই বলল।

আমি ফিকে হাসলাম। কেন যাই না সেটা তো বুঝতেই পারিস।

ফুটবল খেলায় ওরকম অনেক কিছু হয়। মাঠে আয়, প্র্যাকটিস কর, আবার। খেলা ফিরে পাবি। এই ছোট মাঠে বল নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ঠুকঠুক করে খেলা আরও খারাপ করছিস কেন? আনোয়ার বলল।

তর্ক করতে পারতাম, ইচ্ছে হল না। বললাম, যাবখন। প্র্যাকটিস হচ্ছে নাকি?

হবে না? শিন্ডের খেলা তো এসে গেল। এবার ইন্ডিয়ার বাইরের টিম খেলতে আসছে। তুই আয়, তোকে দরকার। ফরোয়ার্ড আর কেউ তো নেই। বিষ্টু ইনজুরি নিয়ে খেলেছে লিগের শেষ কটা ম্যাচ। আবার লেগে গেলে একদম বসে যাবে। নিমাই ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।

ডাকুদা আমায় খেলাবে ভেবেছিস?

আয় না, তার পর দেখা যাবে। গড়ের মাঠ থেকে দূরে থাকিস না, ওতে ক্ষতিই হবে। সকালে আসিস, কেমন?

মনটা চনমন করে উঠল। গড়ের মাঠ, শিল্ড, ফুটবল এই শব্দগুলোয় শিহরন লাগে। শিন্ডে খেলার লুকোনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিল, আবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর গ্যালারির বিদ্রুপের হাসিও কানে বেজে উঠল। আমি বলে ফেললাম, কেমন যেন ভয় করছে।

ওরা অবাক হয়ে গেল। আনোয়ার বলল, কীসের ভয়? পাবলিককে? গোল দে, দেখবি, ওরাই আবার তোকে মাথায় তুলে নাচবে।

নিমাই বলল, গোল তুই পাবিই, আমি তো আছি। ঘড়ি দেখে বলল, রাজুরা অপেক্ষা করছে রে, আনোয়ার! আর নয়, দেরি হয়ে গেছে। তা হলে কাল, কেমন?

ওরা চলে যাবার পর মনে হল, আগের দিন হলে এমন করে আমায় ফেলে নিমাই কিংবা আনোয়ার চলে যেত না, এমন পোশকি ঢঙে কথা তো বলতই না। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম ওদের কথা। ঠিকই বলেছে, এই ছোট জমিতে ছোটদের সঙ্গে খেলে কিছুই হবে না। গড়ের মাঠের বিরাট জমি, হাজার হাজার লোক, সেই আবহাওয়া আর উত্তেজনার কাছাকাছি থাকতে হবে। দেহে মনে শুষে নিতে হবে। ঠিক করলাম, আবার যাত্রীর মাঠে যাব প্র্যাকটিসে।

.

২২.

আমার যে কত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয় আছে, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝলাম যাত্রী শিল্ড ফাইনালে উঠতেই। টিকিট, টিকিট, একখানা টিকিট। প্রসূন, তোকে সেই কত ছোট্টটি দেখেছি, আর কী বড়ই না হয়ে গেছিস…প্রসূন, মনে আছে কী বলেছিলিস…প্রসূনদা আমি কিন্তু ছাড়ব না, আপনার দরজায় হাংগার স্ট্রাইক হবে, মাঠে যেতে দেব না… ঝালাপালা হয়ে গেলাম আমি। হেসে মাথা নেড়ে আচ্ছা দেখব, চেষ্টা করব এই সব বলে পাশ কাটাচ্ছি। যুগের যাত্রী কুড়ি বছর পর আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে! সেমি ফাইনালে মহামেডানকে এক গোলে হারিয়েছে। গোলটা দিয়েছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি–প্রসূন ভট্টাচার্য।

দ্বিতীয় রাউন্ডে যাত্রীর প্রথম খেলায় আমি আর বিষ্টু আধাআধি খেলি কটক কম্বাইন্ডের বিরুদ্ধে। বিষ্টু খোঁড়াচ্ছিল। ওকে তুলে নিয়ে প্রিয়া আমাকে নামান। ৩-০ জিতি, তার মধ্যে একটা গোল আমার। অমিয়র লম্বা থ্রো নিমাই হেড করে আমার পায়ে ফেলামাত্র হাফ ভলিতে মারি বারো গজ থেকে। গোলকিপার নড়ার সময় পায়নি। তৃতীয় রাউন্ডে গোয়ার ভাসকো ক্লাবকে ২-০ হারালাম। আমি গোল করতে পারিনি, সলিল আর আব্রাহাম গোল দেয়। ও দিক থেকে রেঙ্গুন ইউনাইটেড উঠেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। জলন্ধর লিডারসকে ২-১ গোলে হারিয়ে উঠল সেমি ফাইনালে। এই প্রথম ইডেনে বসে আমি ফুটবল খেলা দেখলাম। রেঙ্গুনের সেন্টার ফরোয়ার্ডের আর রাইট হাফের খেলা আমার ভাল লাগল। আর কারও নাম মনে রাখতে পারিনি, শুধু মংবা আর লি সান ছাড়া। মংবার বেশ বয়স হয়েছে, অন্তত পঁয়ত্রিশ তো বটেই। প্রথম গোল খেয়েই রেঙ্গুন চঞ্চল হয়ে ওঠে, খেলার সাময়িক বিশৃঙ্খলা আসে। মংবা বল ধরে। শান্ত ধীরভাবে প্লেয়ারকে কাটিয়ে দেখেশুনে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। খেলার গতি ধীর করে আবার টিমকে গুছিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত মংবা তার চমৎকার বল কন্ট্রোল ক্ষমতাকে যেভাবে কাজে লাগাচ্ছিল, তাতে শ্রদ্ধা হল ওর উপর। লি সান-ও বয়স্ক, নিজেদের পেনালটি বক্স পর্যন্ত নেমে এসে বল নিয়ে আবার উঠছিল। চট করে একজনকে বলটা ঠেলে দিয়েই লি সান আচমকা বুলেটের মতো এগিয়ে আবার পাশটা নেয়। একসঙ্গে দুজন কেটে যায় সেই দৌড়ে। দু পায়ে তৈরি কি, হেড দিতে ওঠে সবাইকে ছাড়িয়ে। শুনলাম বর্মা টিম থেকে দুজনেই এবার বাদ পড়েছে।

আমরা এরিয়ান আর শিখ রেজিমেন্টাল সেন্টারকে হারিয়ে উঠলাম সেমি ফাইনালে। আমি গোল করতে পারিনি দুটো খেলাতেই। মহামেডান দু দিন ড্র করে ইস্টবেঙ্গলকে এক গোলে হারিয়ে আমাদের সামনে পড়ল, ও দিকে উঠল মোহনবাগান-রেঙ্গুন ইউনাইটেড।

সেমি ফাইনাল খেলার আগের দিন ক্লাব প্রেসিডেন্টের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে

আমাদের রাখা হল। তিনতলায় বিরাট একটা হলঘরে আমরা রইলাম। আব্রাহাম, শ্যাম, অমিয়রা অনেক রাত পর্যন্ত তাস খেলল। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হল শোভাবাজারের টিকাদারের মতো যেন একজনকে ঢুকতে দেখলাম গেট দিয়ে। একটু পরে প্রিয়দা থমথমে মুখে দুজন সিনিয়ার প্লেয়ারকে ডেকে নিয়ে গেলেন।

দুপুরে খাওয়ার পর শ্যাম আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, একটা বিশ্রী খবর এসেছে প্রসূন, আনোয়ার নাকি টাকা খেয়েছে।

থ হয়ে গেলাম আমি। অকল্পনীয় এবং ডাহা মিথ্যে। আমি বললাম, বিশ্বাস করি না।

সত্যি-মিথ্যের কথা নয়! খেলার ঠিক আগে কারও সম্পর্কে এ ধরনের কথা রটলে তাকে বসাতে হয়। মুশকিল হয়েছে ম্যাচটা মহামেডানের সঙ্গে আর আনোয়ারও মুসলমান। চট করে সবাই বিশ্বাস করে নেবে।

খবরটা কে দিল?

সকালে দুবার উড়ো টেলিফোন এসেছে, তা ছাড়া টিকাদার এসেও বলে গেল আনোয়ারকে নাকি পরশু রাতে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরোতে দেখেছে, সঙ্গে ছিল মহামেডানের দুজন অফিসিয়াল।

বাজে কথা! আমি চিৎকার করে উঠলাম। আনোয়ার আর আমি পরশু একসঙ্গে টেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি গেছি। এ সব টিকাদারের বদমাইসি, ও শশাধ নেবার জন্য রটাচ্ছে।

আমি ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, ডাকুদা আর প্রিয়দা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। বাকি সবাই বিস্মিত, অপ্রতিভ চোখে কেউ কেউ নিবাক, কেউ চাপা স্বরে দু-একটা কথা বলছে। ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আনোয়ার বসে।

আনোয়ারের আজ না খেলাই উচিত। ডাকুদা বলল, মনে অস্বস্তি নিয়ে খেলা যায় না।

নিশ্চয়ই খেলবে।

আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, সবাই চমকে উঠল। বাজে মিথ্যা গুজবের কাছে মাথা নোয়াব কেন?

যদি আজ যাত্রী হারে, যদি আনোয়ারের গলদেই গোল হয়, তা হলে আমাদের আর আনোয়ারের অবস্থাটা কী হবে বুঝতে পারছ? ডাকুদা বলল। এত উদ্বিগ্ন হতে কখনও ওকে দেখিনি।

আমি তাকালাম নিমাইয়ের দিকে। নিমাই চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। বলল, আনোয়ার যদি খেলে, যাত্রী হারবে না।

গলা খাঁকারি দিয়ে শ্যাম বলল, আনোয়ার আজ খেলবে। নয়তো আমার বদলে অন্য কেউ গোলে খেলুক।

আব্রাহাম বলল, আনোয়ারকো খেলানেই হোগা।

গড়িয়ে পড়ার একটা শব্দ শুনে আমরা তাকিয়ে দেখি, ঠেস দিয়ে বসা আনোয়ার জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

আনোয়ার বিকেলে খেলেছিল। গোলটা আমি দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একজনে একটা টিমের সঙ্গে কীভাবে লড়তে পারে, সে ধারণাটা সে দিনই প্রথম হল। খেলার পর আমরা আনোয়ারকে কাঁধে করে মাঠ থেকে বেরোই। শ্যাম দুবার মাত্র বল ধরে সারা ম্যাচে। আনোয়ারকে চারবার আমি মহামেডান পেনালটি বক্সের মধ্যে দেখেছি, গোল করতে উঠে এসেছিল।

পর দিন মোহনবাগান হেরে গেল রেঙ্গুন ইউনাইটেডের কাছে ০-২ গোলে।

.

২৩.

রাত্রে ঘুম আসছে না। শিল্ড ফাইনালের আর ৪০ ঘণ্টাও বাকি নেই। কাল সকালে আমরা প্রেসিডেন্টের বাড়িতে জমা হব। সেখান থেকে ফাইনাল খেলতে ইডেনে যাব। ছটফট করছি বিছানায়। অস্বস্তি আর উত্তেজনা, ভয় আর আশা সব মিলিয়ে আমার সারা শরীর দপদপ করছে, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। এমন সময় কে ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে তাকিয়ে বুঝলাম, মা।

পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বললেন, ঘুম আসছে না!

প্রশ্ন নয়, মা যেন খবরটা জানিয়ে দিলেন। আমি উ বলে মার কোলে মাথা তুলে দিলাম।

জানি। এই রকমই হয়। ফাইনাল খেলা কী জিনিস আমার জানা আছে।

বাবা কিছু বলেননি! আমি যাত্রীর হয়ে ফাইনাল খেলব, বাবা কিছু বলেননি?

ও ঘরে তোর মতোই ছটফট করছে।

মা আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসছে। স্নিগ্ধ হয়ে জুড়িয়ে আসছে শরীর। মার শরীর থেকে দূর্বা ঘাস আর ভিজে মাটির গন্ধে ম ম করে উঠছে ঘরটা। মনে হচ্ছে, বল নিয়ে আমি খেলা করছি। ঘুম জড়িয়ে আসছে সর্বাঙ্গে। তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বললাম, কাল টিকিট পাঠিয়ে দেব, তুমি দেখতে যেয়ো!

তার পর আমি সাদা কালো ফুটকি দেওয়া বলটা নিয়ে হেলে দুলে এগোতে লাগলাম, লাফালাম, হঠাৎ ছুটলাম। পড়ে গিয়ে আবার উঠলাম। মার বুকের মধ্যে বড় বড় ঢেউয়ের ওঠা-পড়ার শব্দ হচ্ছে। প্রবল বেগে বাঁধভাঙা বন্যার জল যেন ছুটে আসছে।

পরশু তোর বাবাও খেলবে খোকা। তোর মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে আনবে যা হারিয়েছে। তুই জিতবি, ঠিক জিতবি।

ক্রমশ মার গলার স্বর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আর এগিয়ে আসছে প্রচণ্ড গর্জন।

আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি কোথায় যাব, কোথায় আশ্রয় নেব? সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠলাম—স্ট্রাইকার, স্ট্রাইকার!

গর্জনটা আরও জোরে আমাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরল।

.

এত লোক! ষাট-সত্তর হাজারের কম নয়। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল আমার শট রেঙ্গুনের বার ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতেই। পঁয়ত্রিশ গজ থেকে শটটা নিয়েছিলাম, আচমকা।

বাইরে থেকে প্রিয়দা পাগলের মতন হাত নাড়ছেন, আমাকে পিছিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে দিতে। আজ সকালে বারবার আমাকে বলেছেন, দশ নম্বরের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে গোপাল। তুই নেমে এসে গোপালের জায়গাটা সামলাবি। লি সান-টাই হচ্ছে ডেনজারাস্। ওকে আটকালে ওদের অ্যাটাক খোঁড়া হয়ে যাবে।

গোপালকে নিয়ে লি সান একবার ডাইনে আর একবার বাঁয়ে যাচ্ছে। বড় বড় গ্যাপ পড়ছে আমাদের ডিফেন্স-এ। আমি নেমে এসে কোন দিক যে সামলাব ভেবে পাচ্ছি না। ওদের অ্যাটাক খোঁড়া করতে গিয়ে যাত্রীর অ্যাটাকই খোঁড়া হয়ে গেছে, তবু মাঝে মাঝে এগিয়েছি আর প্রিয়দা হাত নেড়ে আমাকে পিছিয়ে যেতে বলেছেন। এক সময় নিমাইকে বললাম, এভাবে চললে আমরা গোল খাব। ওদের বক্সে বল নিয়ে গিয়ে খেলতে হবে। আমাদের ডিফেন্স থেকে প্রেশার তুলতে হবে, নয়তো এই প্রেশার রাখতে পারব না।

বলতে বলতেই আমরা গোল খেলাম। কনার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে রেঙ্গুনের লেফট আউট সেন্টার করে। লি সানকে নিয়ে গোপাল ব্যস্ত। লেফট ব্যাক উঠে এসেছিল। চলতি অবস্থাতেই কুড়ি গজ থেকে ধাঁধানো শটে বলটা পোস্টে লেগে গোলে ঢুকল। সারা ইডেন স্তব্ধ। শুধু কয়েকটা হাততালির শব্দ শোনা গেল। খেলার বয়স এখন মাত্র কুড়ি মিনিট।

সেন্টারে বল বসাবার সময় নিমাই বলল, উঠে খেল। প্রিয়দার দিকে আর তাকাসনি।

পরের মিনিটেই নিমাই থেকে আব্রাহাম, আবার নিমাই এবং সে দুজনকে কাটিয়ে রিভারস্ পাস দিল আমাকে। গোল হতে পারে! ইডেন দাঁড়িয়ে উঠে খ্যাপার মতো চিৎকার করে উঠল গো ও ও ল, গো ও ও ল। আমার সামনে গোল। স্টপার আর ব্যাকের মাঝখানে একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি। দ্বিধা করলাম, মারলে যদি গোল না হয়! বরং আর একটু এগিয়ে যাই। ভুল করলাম এইখানেই। বলটা ঠেলে দিয়ে এগোতে যাবার মুহূর্তে মংবার পরিচ্ছন্ন স্লাইডিং ট্যাকলে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। স্টপার বলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

যখন উঠলাম, ইডেনের আর্তনাদ তখন আছড়ে পড়ছে গ্যালারি থেকে। আমি মাথা নামিয়ে ফিরে যাচ্ছি, তখন প্যাভিলিয়নের সামনের গ্যালারি থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল, কার ব্যাটা দেখতে হবে তো! আমি মুখ তুলে তাকালাম।

আনোয়ার অনবদ্য খেলছে, অমিয়ও। শ্যামের আজ সেই দিন, যে দিন ও পাগলার মতো খেলে। পর পর তিনটে অবধারিত গোল বাঁচিয়ে যাত্রীর ডিফেনসকে ও চাঙ্গা করে তুলেছে। আঠারো গজ লাইনের কাছে এসে ও উইঙ্গারদের ক্রসগুলো ফরোয়ার্ডের মাথা থেকে তুলে নিয়েছে। বক্সের বাইরে পর্যন্ত বেরিয়ে এসে চার্জ করে বল ক্লিয়ার করেছে। গোলটা খাওয়ার পরই আমাকে উপরে রেখে নিমাই আর সলিল নেমে এসেছে যাত্রীর হাফ এলাকায়।

একা মাঝ-মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হল গ্যালারি থেকে লোকেরা যদি এখন হুড়মুড় করে নেমে আসে? কেন যে মনে হল জানি না, আমি ভয়ে পিছিয়ে এলাম। আর ঠিক তখনই আনোয়ার বলটা লব করে রেঙ্গুন হাফ এলাকার ঠিক সেই জায়গায় ফেলল, যেখান থেকে আমি এইমাত্র পিছিয়ে এসেছি। রেঙ্গুনের স্টপার ছাড়া আর কেউ নেই। বলটা ধরবার জন্য সে বাঁদিকে দৌড়োচ্ছে। আনোয়ার চিৎকার করে উঠল, প্রসূন, বল ধর।

ওর গলার স্বরে কী যে ছিল, মনে হল পারব। মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। স্টপার যখন বুঝতে পারল, তার আগেই আমি বলের কাছে পৌঁছোব, শেষ চেষ্টা হিসাবে সে ঝাঁপ দিল আমার পায়ের উপর। লাফিয়ে উঠলাম, ওকে ডিঙিয়ে মাটিতে পা রেখেই দেখি, আমার সামনে কেউ নেই। শুধু গোলকিপার ইতস্তত করছে গোল ছেড়ে বেরোবে কি না।

বলটাকে সামনে ঠেলে লম্বা দৌড় শুরু করলাম। পিছনে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ইডেনের গর্জন ধাপে ধাপে উঠছে আর রেঙ্গুনের গোল ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। বক্সে ঢুকে পড়েছি। গোলকিপার এবার বেরিয়েছে। কানে তালা লাগানো চিৎকার আমার চারপাশে। বলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানি, পিছনে কেউ আসছে বলটা ছিনিয়ে নিতে।

ডান দিকে হেলে বলটাকে মারার জন্য বাঁ পা তুললাম। গোলকিপার বাঁ দিকে ঝুঁকল। মুহূর্তের ভগ্নাংশে বাঁ দিকে হেলে ডান পায়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার উপর দিয়ে চিপ করে পাঠালাম। বেচারা বাঁ দিকে ঝোঁকা অবস্থায় অসহায়ের মতো ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, বলটা গোলে ঢুকছে।

তার পর যাত্রীর দশজন আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল আর গর্জনে ভেঙে পড়ল ইডেনের আকাশ। যখন সেন্টারে এসে দাঁড়ালাম, তখনও বুঝতে পারছি না কী। ঘটেছে। সত্যিই কি গোল করলাম! বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই হাফ টাইমের বাঁশি বাজল।

.

২৪.

দারুণ গোল হয়েছে…আমি তো ভেবেছিলুম, এটাও মিস্ করবি। প্রিয়দা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন।

এই গোলই মিস করেছিল একজন। পিছন থেকে একটা গলা শুনলাম। আমি ফিরে তাকালাম না। জানি, একজোড়া কটা-চোখ এখন আমার পিঠে বিধে রয়েছে। ভোলেনি, অনেকেই ভোলেনি। ড্রেসিং রুমে কে ট্রানজিস্টর খুলেছে। পুষ্পেন সরকারের গলা শুনতে পেলাম, …শিন্ড ঘরে তুলতে পারবে কি না এখনই বলতে পারছি না, তবে যুগের যাত্রীর তরুণ স্ট্রাইকার প্রসূন ভট্টাচার্য যে অপূর্ব দক্ষতায় গোলটি শোধ দিল তা বহু দিন স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, এই প্রসূনেরই বাবা অনিল ভট্টাচার্য কুড়ি বছর আগে শিল্ড ফাইনাল খেলেছিলেন এই যুগের যাত্রীর হয়ে। পিতা-পুত্রে আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে খেলার নতুন নজির আজ গড়ে উঠল। হয়তো গ্যালারিতে বসে অনিলবাবু এখন দেখছেন…

বাবা! আসবেন কি খেলা দেখতে! কাল চারটে টিকিট পাঠিয়েছিলাম বাড়ির জন্য তিনটে, হর্ষদার একটা। কিন্তু বাবা আসবেন বিশ্বাস হয় না। তবু আবার মাঠে নামার সময় গ্যালারিগুলোর দিকে তাকালাম। অজস্র হাত আমার উদ্দেশে নড়ছে। কিন্তু আমি একটা মুখও দেখতে পেলাম না। শুধু আবছা ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে যেন হাজার হাজার বিন্দুর নড়াচড়া চলেছে কতকগুলো রেখা তৈরি করে। এর মধ্যে কোথাও কি বাবা বসে আছেন!

রেঙ্গুন ইউনাইটেড ঝড়ের মতো শুরু করল। মিনিট পাঁচেক আমাদের কাঁপিয়ে দিয়ে হঠাৎ ওদের যেন দম ফুরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী উঠে এল ওদের হাফ লাইনে। নিমাই, আব্রাহাম চমৎকার বল রাখছে মাটিতে, পায়ে বল ছিটকে যাচ্ছে। ফুলিঙ্গের মতো। নিমাই তছনছ করছে হাফ লাইন পর্যন্ত, কিন্তু নিরেট শক্ত ডিফেন্সের পাঁচিলটা টপকাতে পারছে না। আমি জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি গোলে শট নেওয়ার। কোথাও যদি আলগা থাকে ভিতরে ঢোকার।

গোল হচ্ছে না। খেলা শেষ মুখে এসে গেছে। অধৈর্য গ্যালারির গর্জন উঠছে নামছে। এমন সময় নিমাইকে ফাউল করল ওদের রাইট ব্যাক, আঠারো গজ লাইনের বাঁ দিকে হাত দুয়েক বাইরে। ফ্রি কিক্‌। বলটা বসিয়ে নিমাই আমার দিকে তাকিয়ে দুটো আঙুল দেখাল। বুঝে গেলাম ও কোথায় বল পাঠাবে। প্র্যাকটিসে এই সঙ্কেতগুলো আমরা ঠিক করে নিয়েছি। ওরা পাঁচজনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে। নিমাই আর বিষ্টু তৈরি হয়েছে শট নিতে। আব্রাহাম হঠাৎ বাঁ দিকে ছুটে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ওকে পাহারা দিতে গেল একজন। আমি ডান দিকে সরে গিয়ে তাকালাম ঠিক পেনালটি স্পটে। নিমাই সেটা লক্ষ করল। পাঁচিলের পিছনে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে গোলকিপারের দৃষ্টি ব্যাহত না হয়। রেফারি হুইল দিতেই নিমাই আর বিষ্টু এগোল শট নিতে। নিমাই একটু পিছিয়ে। বোঝা মুশকিল কে শট নেবে। তবে, যে কেউই বুঝতে পারবে এটা বহু ব্যবহৃত একটা প্যাঁচ। বিষ্টু শট নিতে এসে বলের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাবে আর নিমাই শট করবে।

বলের উপর দিয়ে বিষ্টু লাফিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ছুটে গেল, কিন্তু নিমাই শট না নিয়ে বলটা নিখুঁত মাপে চিপ করল পাঁচিলের মাথা ডিঙিয়ে পেনালটি স্পটের উপর। এবার সব কিছু নির্ভর করছে আমার ছুটে যাওয়ার এবং ঠিক সময়ে পৌঁছোনোর উপর। দিনের পর দিন আমার পাঠশালায় পিন্টুকে নিয়ে যার প্র্যাকটিস করেছি, এবার তার পরীক্ষা। মোটরবাইকের হঠাৎ স্পিড় তোলার মতো আমি প্রচণ্ড দমকে, ছিলে-ছেড়া ধনুকের মতো ছিটকে ঢুকলাম।

দেরি হয়ে গেছে। চার পা এগোনো মাত্র বুঝে গেলাম বলটাকে হাফ ভলিতে নিলে বারের উপর দিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ বুকের মধ্যে কে বলে উঠল, স্ট্রাইকার, এবার ঘা মারো, সর্বশক্তি দিয়ে মারো! শেষ চেষ্টায় চার গজ দূর থেকে ঝাঁপ দিলাম। বল থেকে চোখ সরাইনি। কপালের ডান দিকে বলটা লাগছে, হাতুড়ির মতো মাথাটা দিয়ে আঘাত করলাম বলে—আর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লাম।

চারদিক কেমন শান্ত নিস্তব্ধ! ঘাস আর মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধে বুক ভরে যাচ্ছে। আমি মুখ তুলে দেখছি অদ্ভুত একটা দৃশ্য, রেঙ্গুন ইউনাইটেডের গোলকিপার গোলের মধ্য থেকে কুড়িয়ে নিল সাদা কালো ফুটকি আঁকা আমার পৃথিবীটাকে। এর পর ধীরে ধীরে একটা গর্জন আমাকে কাঁপিয়ে দেহের উপর দিয়ে বয়ে যেতে শুরু করল।

.

লক্ষ্মণ মালি এসে বলল, আপনাকে একজন মেয়েছেলে ডাকছে।

যাত্রীর টেন্টের বাইরে তখন উৎসব চলেছে। হাউই, পটকা আর তুবড়ির শব্দে, আলোয় আলোয় ঝলমল করছে গড়ের মাঠের এই দিককার আকাশ। বাইরে এলাম খালি গায়ে। নীলিমা আর পিন্টু দাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম মাকে দেখব।

এ কী তোমরা! খেলা দেখতে তুমি এসেছিলে? এখনও বাড়ি যাওনি, মা কোথায়? একটানা অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। বাড়ির লোককে দেখে সত্যিই ভাল লাগছে।

জেঠিমা সকাল থেকে দক্ষিণেশ্বরে। আর জ্যাঠামশাই বললেন, একটু অপেক্ষা করে যাই, এবার হয়তো বাজি পোড়ানো হবে, তাই

বাবা! বাবা কোথায়? আমার গলা ধরে এল।

বাইরে। বললেন, তোমরাই দেখা করে এসো।

ছুটে বাইরে যেতে গিয়ে থমকে গেলাম। তার পর ফুলগাছগুলোর মধ্য দিয়ে রেলিং-এর ধারে গিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা তুবড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ আলোর ঝাড় চালচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেলাম, অনেক লোকের মধ্যে একজনের কপালে চিকচিক করছে একটা টিপ। অত্যন্ত উজ্জ্বল, মর্যাদাবান।

তুবড়ির আলোয় আমাকে দেখতে পেয়ে তখন অনেকে ছুটে আসছে — প্রসূন, প্রসূন! বলে।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 5 of 5 ): « পূর্ববর্তী1 ... 34 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress