চাতরায় ফাইনাল খেলাতে
০৬.
চাতরায় একবার ফাইনাল খেলাতে নিয়ে গেছিল পাইকপাড়া অগ্রগামী। সারা রাত চিন্তা করেছিলাম অপোনেন্ট ত্রিবেণী যুব সঙ্ঘের স্টপার আর দুটো ব্যাকের কথা। সেমিফাইনালে চারটে গোল দিয়ে মাঠ থেকে বেরোচ্ছি, তখন যে লোকটি আমায় বলেছিল, খোকা, তুমি তো বেশ খেলো! কিন্তু তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না।
পরে শুনলাম তার নাম ল্যাটা মন্টে। ফাইনালে আমাদের অপপানেন্ট স্টপার। বছর কুড়ি আগে কলকাতা মাঠে খুব নামকরা ফরোয়ার্ড ছিলেন এরিয়ানে। এখন মাঝে মাঝে খেলেন স্টপারে। ওঁর ভাল নামটা কেউ বলতে পারল না। ব্যাক দুটি ক মাস আগেই জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে এশিয়ান ইয়ুথ চ্যামপিয়নশিপ খেলতে গেছিল ব্যাংকক না সিওল-এ। ওদের সেমিফাইনালের খেলা দেখতে দেখতে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাইট ব্যাকটার কী নাম, দাদা?
সুধীর কর্মকার। যে রকম খেলছে নাম করবে মনে হচ্ছে।
ফাইনালের আগের রাতে ঘুমোতে পারিনি, শুধু মাথার মধ্যে অবিরাম গুনগুন করেছে ল্যাটা মন্টের কথাটা, তোমার বাঁ পা যে একদম চলে না আর চোখে ভেসেছে সুধীর কর্মকারের ট্যাকলিং। ফাইনালের দিন সকালে ল্যাটা মন্টে আমাদের ঘরে এলেন। ত্রিবেণী টিম পাশের ঘরেই কাল থেকে রয়েছে। আমাদের নীলেদা ওকে দেখেই খাতির করে বসিয়ে বলল, মন্টেদা, আজ খেলছেন তো?
ভাবছি। শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে, গঙ্গায় সাঁতার কেটে ফিট না হলে খেলব না। সাঁতারের মতো এত ভাল বডি ফিট করার আর কিছু তো হয় না।
আমার বয়স তখন চোদ্দো। কথাগুলো শোনা মাত্র বডি ফিট করার জন্য আনচান করে উঠলাম।
আমার এক্সপিরিয়ান্স থেকে যা বুঝেছি, বুঝলি নীলে, খেলার দিন কোনও রকম প্র্যাকটিস নয়। সকালে শুধু সাঁতার আর দুপুরে রেস্টকষে ঘুম। বিকেলে অদ্ভুত ঝরঝরে হয়ে যায় শরীরটা, ব্রেনও খুব ভাল ফাংশন করে। ফরোয়ার্ডদের তো অবশ্যই সাঁতার কাটা দরকার। হ্যাঁ, তার আগে আচ্ছাসে তেল মেখে ডলাই-মলাই, মানে মাসাজ করে মালগুলোকে আলগা করে নিতে পারলে তো কথাই নেই। গোষ্ঠ পাল, সামাদ থেকে শুরু করে পিকে, চুনি সবাই ম্যাচের দিন সাতার কাটত। ওরা রোম ওলিমপিক-এ হারল কেন জানিস?
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মন্টো একটা সিগারেট ধরিয়ে শতরঞ্চিতে বাবু হয়ে বসলেন। আমাদের রাইট আউট ইস্টার্নরেলে খেলে, খুব বইটই পড়ে। বলল, হাঙ্গেরি টিমে অ্যালবারটো ছিল যে!
থাকলেই বা!
টিচি ছিল।
তাতে কী হয়েছে?
আমরা খুবই দমে গেলাম কারণটা খুঁজে না পেয়ে। মন্টেদা কষে সিগারেটে টান দিয়ে শতরঞ্চি উলটিয়ে মেঝেয় ছাই ঝেড়ে বললেন, যেখানে ইন্ডিয়া টিমকে থাকতে দিয়েছিল, সেখানে সাঁতার কাটার মতো একটা চৌবাচ্চাও ছিল না। বডি ফিট করতে পারেনি ম্যাচের দিন। চুনি-প্রদীপ সারা সকাল অনেক খুঁজেছিল যদি একটা পুকুর কি ভোবাও পাওয়া যায়! পায়নি।
আমি বললাম, ম্যাচের দিন চুনি কি সাঁতার কাটে?
নিশ্চয়! ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, ওর অমন ডজ, অমন স্পিড, অমন ব্রেন হয় কী করে? সবই মা গঙ্গার কৃপায়। যে জলে কারেন্ট আছে, সেখানে সাঁতার কাটার উপকারিতা যে কী, তা তো জানো না? অরুণ ঘোষ এমন দারুণ খেলে কী করে? শিবপুরে বাড়ি, পা বাড়ালেই গঙ্গা।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মন্টেদা উঠলেন, যাই, তেলটেল জোগাড় করিগে।
নিমাই নেই। আনোয়ার আর আমাকে পাইকপাড়া অগ্রগামী খেলাতে এনেছে। আনোয়ারকে বললাম, যাবি গঙ্গায়? ও আঁতকে উঠল, গঙ্গায়! আরে বাপস! চৌবাচ্চায় পর্যন্ত নামি না—সাঁতার জানি না বলে।
কিন্তু ইস্টার্ন-এর রাইট আউট আর স্পোর্টিং ইউনিয়নের লেফট হাফব্যাক সরষের তেলের খোঁজে ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আধ কিলো নিয়ে আমরা চারজন চাতরার গঙ্গার ঘাটে বসে মন্টেদার কথামতো মাসলগুলোকে আধ ঘন্টা ধরে আলগা করে জলে যখন নামলাম, মন্টেদা তখন ছোট্ট একটা তেলের বাটি হাতে ঘাটে এসে বসলেন। বেশ আরামে সাঁতার কাটা শুরু করলাম।
মন্টেদা চিৎকার করে বললেন, ঘাটের কাছে ফুরফুর করে মেয়েদের মতো সাঁতার! তোরা কি ফুটবলার না, লুডো প্লেয়ার?
প্রবল বিক্রমে আমরা মাঝ গঙ্গার দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং আধ ঘন্টা পরে যখন ফিরলাম, তখন দম ফেলতে পারছি না। মন্টেদা বাহুতে মালিশ করতে করতে বললেন, এই তো, একেই বলে সাঁতার। এখন রেস্ট, জলে ফ্লোট করো এবার।
অতঃপর আমরা চিত হয়ে জলে ভাসতে শুরু করলাম। মিনিট দশেক পর পাড়ের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। ভাঁটার টানে চাতরা-ঘাট থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। টানের বিরুদ্ধে সাঁতরে ফিরে এসে ঘাটের সিঁড়িতেই আমরা এলিয়ে পড়লাম।
মন্টো জলে নামতে নামতে গম্ভীর হয়ে বললেন, এবার ভাত খেয়েই শুয়ে পড়বে। মনে রেখো, বিকেলে ফাইনাল খেলা। তার পর কানে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকটা ডুব দিয়েই তিনি উঠে পড়লেন।
গনগনে খিদে পেয়েছিল। গোগ্রাসে ভাত আর মাংস খেয়েই শুয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙিয়ে দিল, সারা টিম তখন ড্রেস করে মাঠে রওনা হবার জন্য তৈরি। সর্বাঙ্গে ব্যথা, মাথা ঝিম ধরে আছে, চোখে ঘুম জড়ানো, পেট ভার। ডাক ছেড়ে আমার কেদে উঠতে ইচ্ছে করল।
থ্রু বাড়িয়ে দিচ্ছে, ছুটতে পারছি না, হেড করার জন্য শরীর তুলতে পারছি না, সামান্য সাইড পুশেই ছিটকে পড়ছি, ভলি মারতে পা উঠছে না। মাত্র দশ গজ দূরে একবার ফাকা গোল পেয়েও শট নেবার আগেই সুধীর কর্মকার পা থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মাঠের চারদিক থেকে টিটকারি আর গালাগাল, বিশেষ করে আমাকেই। কেননা মাঠের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মন্টেদা যে রকম অনায়াসে সব থেকে কনিষ্ঠকে বোকা বানাচ্ছেন, তাতে দর্শকরা মজাই পাচ্ছিল, শুধু পাইকপাড়া অগ্রগামীর অফিসিয়ালরা ছাড়া। হাফ টাইমে আমাকে এবং লেফট হাফ ব্যাককে বসানো হল।
বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত লজ্জায় আমি আর মাথা তুলতে পারিনি। আনোয়ারকে হিংসে করেছিলাম সাঁতার না জানার জন্য। বাঘের মতন ও খেলেছিল। ত্রিবেণী ২-০ গোলে জিতেছিল। প্রথম গোলটা পেনালটি থেকে; মন্টো পেনালটি কিক করেন। আনোয়ার পরে বলেছিল, বলটা স্পটে বসিয়ে মন্টেদা একবার গোলকিপারের দিকে তাকান। গোলকিপার দেখল মন্টেদার চোখ ট্যারা। বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোন দিকে পজিশন নেবে বুঝতেই পারেনি। তার বাঁ দিকে তিন হাত দূর দিয়ে বল গোলে ঢোকে, সে ডান দিকে ডাইভ দিয়েছিল।
রাজস্থানের সঙ্গে খেলার আগের দিন রাত্রে জানলা দিয়ে গঙ্গার মতন ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার চাতরার ফাইনালের কথা মনে পড়ল। আর হাসি পেল। ওপেন নেট মিস করেছিলাম। কাল করব না, হে ভগবান কাল বৃষ্টি দিও না। আমি ইফ নট রেইন-এর লিস্টে আছি। জীবনের প্রথম ঘেরা মাঠে খেলার সুযোগটা নষ্ট করে দিও না। তার পর শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
০৭.
সকালে উঠে দেখি, কখন যেন বেশ ভালই বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশে মাঝে মাঝে নীল রঙের ছোপ। মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। শরীরটা ঝরঝরে তাজা লাগল। মাকে বললাম, আজ আমার খেলা আছে।
কথাটাকে মা গুরুত্ব দিলেন না। খেলা আমার প্রায় রোজই থাকে। বললাম, আজ প্রথম খেলব ফাস্ট ডিভিশনে।
মাকে আজ অন্যমনস্ক লাগল। খুবই সাধারণভাবে বললেন, ভাল করে খেলিস।
আশা করেছিলাম উৎসাহে মার চোখমুখ ঝলসে উঠবে, কিন্তু কিছুই হল না। অভিমানে আর ওই প্রসঙ্গ না তুলে বললাম, খাবার আছে? মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম এবং রেগে উঠলাম। কিন্তু কার উপর রাগ করব ভেবে পেলাম না। অরুণা গ্লাস ফ্যাক্টরি? যেখানে লক আউট চলছে আর তাই বাবা বেকার! বাবা এখন দোকানে সামান্য একটা কাজ করেন, যা পান তাতে দু বেলা কয়েকটা রুটি ছাড়া আর কিছু আমাদের জোটে না।
পিন্টু বুঝতে শিখেছে আমরা দরিদ্র, ওর হাবভাবে এখনই যেন কেমন বুড়োটে। ছাপ পড়ে গেছে। বায়না আবদার বা অভিমান কি রাগারাগি একদম করে না, গম্ভীর হয়ে শুকনো মুখে বেরিয়ে যায়। শুধু কান্নাকাটি জুড়ে দেয় পুতুলটা। তখন নীলিমা ওকে টেনে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় পুতুল খেলা করছে। নীলিমার মা দু বছর আগে মারা গেছেন। সেই থেকে সে সংসারের কর্জী। বাবা টাকা এনে ওর হাতে দেয়, নীলিমা গুছিয়ে হিসেব মতো খরচ করে।
রাগটা শেষ পর্যন্ত নিজের উপরই এসে পড়ে। আমারও তো কিছু করণীয় আছে। আজ পর্যন্ত আমি শুধুই নিয়েছি, কিছুই দিইনি। ক্লাস টেনে ফেল করে। পড়া ছেড়ে দিয়েছি। স্কুল ভাল লাগে না, তা ছাড়া আমি বুঝে নিয়েছি লেখাপড়া করার মতন মাথাও আমার নেই। আমি ফুটবল খেলতে ভালবাসি; শুধু ফুটবলই খেলি। তাতে বাবা, মা, ভাই, বোন—কারও কোনও উপকারই হয় না।
সংসারে বিন্দুমাত্র সাহায্যও আমি করতে পারি না! মাঝে মাঝে নিজেকে ফালতু মনে হয়। শুধু আড্ডা আর খেলা! কোন মুখে আমি সংসারে দু মুঠো ভাত দাবি করব? ফুটবল এখনও আমাকে কিছু দাবি করার মতন জোর দেয়নি। আমার সামনে টাকা রোজগারের একমাত্র পথ খোলা রয়েছে, মাঠে। বড় ফুটবলার না হতে পারলে দেশে আমি আর একটা অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াব মাত্র।
তীব্র একটা জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ড্রেস করে ফুটবলটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঢালাই লোহার নানা রকম জিনিস তৈরির একটা কারখানা মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই, তার গায়ে ছোট এক খণ্ড জমি আমাদের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। এই জমিতেই ফুটবল খেলা শুরু করি। পিন্টু রাস্তায় তার বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক করছিল, কানে এল ওর চিৎকার—য্যা য্যা, জারনেলের মতন স্টপার হতে গেলে নঈমকে আবার নতুন করে খেলা শিখে আসতে হবে।
আমাকে দেখেই পিন্টু ছুটে এল, দাদা, যাব তোর সঙ্গে?
আয়।
বলটা আমার হাত থেকে ও নিয়ে নিল। ক্লাব থেকে বলটা চেয়ে নিয়ে রেখেছি। দুটো তাপ্পি দেওয়া, আকারে অনেকটা পেয়ারার মতন। সকাল বা দুপুরে যখনই পারি রোজ একা একা স্কিল প্র্যাকটিস করি। মাঝে মাঝে পিন্টু আর তার বন্ধুরা আমার সঙ্গী হয়।
আগে বাঁশের কঞ্চি চার হাত অন্তর পুঁতে বল নিয়ে এঁকেবেঁকে ড্রিবল প্র্যাকটিস করতাম। হর্ষদা একদিন বললেন, গ্যারিনচাকে এভাবে প্র্যাকটিস করতে বলায়, সে নারাজ হয়ে বলে, অপোনেন্ট তো আর খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, সে নানাভাবে বাধা দেবেই, কাজেই প্র্যাকটিস করতে হলে সচল মানুষের সঙ্গে ড্রিবল করা দরকার।
কথাটা আমার মনে ধরেছিল। সেই থেকে আমি পিন্টু আর তার বন্ধুদের পেলেই প্র্যাকটিসে ডাকি। আজ ওর বন্ধুরা কেউ এল না। কারণ জিজ্ঞাসা করতে ইতস্তত করে পিন্টু বলল, দরকার নেই ওদের আসার।
কেন, কী হল? ঝগড়া হয়েছে?
পিন্টু চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, তুমি নাকি একদিনও খেলায় চান্স পাওনি, বসিয়ে রেখে দিয়েছে। আনোয়ারদা আর নিমাইদা রোজ খেলে?
আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল, হাঁটুতে চোট রয়েছে। প্র্যাকটিসে টিকাদার বলে একজন এমন ট্যাপ করেছে যে ভাল করে এখনও শট নিতে পারি না।
পিন্টুর মুখ স্বস্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আর আমি মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। ওর কাছে আমি হিরো, আর সেটা বজায় রাখতে মিথ্যে কথাগুলো আপনা থেকেই কেন বেরিয়ে এল, ভেবে পেলাম না। হয়তো ভয়ে। প্রচণ্ড এক স্ট্রাইকার আমার ইজ্জতের ডিফেন্স ভাঙবার জন্য আঘাত হানতে উদ্যত। আমি একটা বিশ্রী ফাউল করে তাকে আটকালাম।
.
কারখানার তিনতলা সমান উঁচু দেয়ালটাকে গোল বানিয়ে টারগেট শুটিং করি। ইট দিয়ে দাগ টেনে মাটি থেকে ৮ গজ x ৮ ফুট একটা ঘর করে সেটাকে ছয় ভাগ করে ১, ২, ৩ লিখে দিয়েছি। পিন্টু বা আর কেউ চেঁচিয়ে নম্বর বলে আর আমি শট করি। দেয়ালে লেগে বল ফিরছে, তখন আবার চেঁচিয়ে নম্বর বলে, আমি ফিরতি বল না থামিয়ে হেড দিয়ে কি শট করে আবার টারগেটে পাঠাই। এভাবে মিনিট দশেকেই হাঁফিয়ে যাই। একটু জিরিয়ে আবার শুরু করি। এভাবে প্র্যাকটিস করতে হর্ষদা আমায় বলে দিয়েছিলেন। কোনও দিন শুধুই পেনালটি শট করি গুনে গুনে একশোটা, কিংবা চিপ করি, কেউ বল ছুড়ে দেয় হেড করি, ভলি মারি আর পিন্টুর পাঁচ-ছ জন বন্ধুর সঙ্গে ড্রিবল করি।
আজ শুধুই পিন্টু। গোলে অর্থাৎ দেওয়ালে শট করছি, পিন্টু পিছন থেকে নম্বর বলছে। বল মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে ছিটকে গেলে আমিই ছুটে কুড়িয়ে আনছি। এক সময় দেখি, নীলিমা দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। বুকের কাছে বইয়ের গোছা, পরনে নীলপাড় সাদা শাড়ি। স্কুল থেকে ফিরছে। শাড়ি পরলে ওকে কিছুটা বড়। দেখায়। ওর স্কুলটা মাইলখানেক দূরে। বাসে দশ পয়সা ভাড়া, যাতায়াতের সেই কুড়িটা পয়সা বাঁচাবার জন্য হেঁটে যায় আর আসে।
বলটা রাস্তার দিকে যেতেই নীলিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ও হাসল। আমি বললাম, স্কুল থেকে? ও ঘাড় নাড়ল। মুখটা শুকননা। কপালে কয়েকটা চুল ঘামে সেঁটে রয়েছে। আঁচল দিয়ে গলা ও ঘাড়ের ঘাম মুছল।
আমার স্কুল বসবে বিকেলে! বলে আমি হেসে উঠলাম।
তাই বুঝি পড়া তৈরি করছ? নীলিমার সাজানো দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল।
আমি খুব খারাপ ছাত্র, প্রমোশন পাব কি না জানি না! হতাশার ভাণ করে বললাম।
খাটলে পাশ করবেই করবে।
নীলিমার স্বরে, চোখে, এমনকী দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর পরিহাস নেই। আমার ভিতরে আলতোভাবে একটা প্রত্যয় পাখির মতন ডানা মেলে ভেসে এল। হাতের বলটাকে হঠাৎ কিক করে সোজা শূন্যে তুলে দিলাম। পিন্টু চিৎকার করে উঠল, তিন।
একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললাম। চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে বলটাকে ব্যাক। ভলি করলাম। এভাবে জীবনে কখনও মারিনি। আশ্চর্য, আশ্চর্য, তিন নম্বর টারগেটের মাঝখানে বলটা দুম করে লেগে ফিরে এল। পিন্টু দু হাত তুলে চিৎকার করে বলটার পিছু ধাওয়া করল। নীলিমার বড় বড় চোখ দুটো আরও বড় হয়ে গেছে, আর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমিই প্রসূন ভটচাজ কি না!
দাদা আর একবার। পিন্টু আমার কাছে বলটা পাঠিয়ে দিয়ে বলল।
ভালভাবেই জানি, ব্যাপারটা আন্দাজে এবং ভাগ্যের জোরে হয়ে গেছে। আর একবার করতে গেলে, কারখানার চালার উপর দিয়ে বল উড়ে যাবে কি রাস্তার ওপরে পড়বে, তা ভগবানও জানে না।
হাঁটুতে একটা চোট আছে, এখনও ভাল করে সারেনি। নীলিমাকে বললাম, ফট করে যদি লেগে যায়…
না না, আর করতে হবে না! নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বলল।
আর একবার মারি।
না না, আগে পুরোপুরি সারুক। নীলিমা হাত তুলে বারণ করল। আমি হাঁফ ছাড়লাম। স্ট্রাইকারকে আটকাতে ছোটখাটো ফাউল করাটা খেলার মধ্যেই পড়ে।
বড্ড খিদে পেয়েছে। পেটে হাত দিয়ে চোখ মুখ করুণ করে তুললাম। আমি জানি, নীলিমার সঙ্গে ছোট্ট একটা প্লাসটিকের পয়সা রাখার ব্যাগ সব সময় থাকে।
অমনি খিদে পেয়ে গেল, পড়া শুরু করতে না করতেই! দু আঙুলে ব্লাউজের মধ্য থেকে ব্যাগটা বার করতে করতে নীলিমা ধমকে উঠল। খুট করে ব্যাগের বোতামটা খুলে ও বলল, বেশি নেই, তিরিশটা পয়সা বড়জোর দিতে পারি।
মোটে তিরিশ! এমন একটা ব্যাক ভলি দেখালাম!
আচ্ছা, পঁয়ত্রিশ।
না না, প্লিজ, আট আনা করো। বদুর দোকানে চারটে কচুরি আর দুটো জিলিপি। ভীষণ খিদে!
এবার আর ভাণ নয়। আন্তরিকতার সঙ্গেই বললাম। নীলিমা আমার মুখ দেখেই বুঝল এবং একটি আধুলি দিল।
ধার রইল।
এই নিয়ে কত হল? গম্ভীর হয়ে নীলিমা বলল।
হিসেব রেখো, সব একবারে শোধ করে দেব।
নীলিমা বাড়ি চলে গেল। গত এক বছরে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট টাকা এইভাবে ওর কাছ থেকে নিয়েছি। প্রতিবারই বলেছি, লিখে রেখো, সব শোধ দিয়ে দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার এই পরিশ্রম বৃথা যাবে না, যেতে দেব না।
পয়সা হাতে আসতেই খিদেটা চনচনে হয়ে চাড়া দিল। বলটা পিন্টুকে দিয়ে বললাম, বাড়ি চলে যা।
আর খেলা উচিত নয়। চোটটা আবার চাগিয়ে উঠতে পারে। বিজ্ঞের মতন পিন্টু আমাকে উপদেশ দিল। হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। পিন্টু বল নিয়ে ধাপাতে ধাপাতে চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরে বদুর দোকানে গরম কচুরি আর জিলিপি খেয়ে জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েই মনে পড়ল, পিন্টুরও খাওয়া হয়নি আজ। পাথর হয়ে গেল আমার সর্বাঙ্গ। শুধু পেটের মধ্যেটা মুচড়ে উঠল।
.
০৮.
আমি আর পলাশ টিকাদার পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের উত্তর আর পুব নীলে-ধূসরে মাখা। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমে গাঢ় কালো মেঘ। বাতাস বইছে না। ভ্যাপসা গরমে আমরা ঘামছি। বৃষ্টি হবে কি হবে না, বোঝা যাচ্ছে না। আমার প্রথম খেলার ভাগ্য লেখা রয়েছে আকাশে।
ঠাণ্ডা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। মেঘটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে তার একটা কোণ মহমেডান মাঠের দিকে। টিকাদারের মুখ খুশিতে ভরে উঠল। বুট পরার জন্য সে টেন্টের ভিতরে চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘটা ছড়াচ্ছে পশ্চিম দিকে, হাওয়া বইছে পশ্চিমে। হাঁফ ছাড়লাম।
বুট পরে টেন্ট থেকে বেরিয়ে টিকাদার আকাশে তাকিয়েই বিরক্ত হল। আমার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখে সে আবার টেন্টে ঢুকে গেল। এর দশ মিনিট পরেই এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে ভেসে পালাল একটা ছোট্ট মেঘ। আমি বুট হাতে শুকনো মুখে টেন্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে। নিমাই বুট পরতে পরতে আমাকে লক্ষ করছিল। কাছে এসে বলল, খেলবি আজ? জবাব না দিয়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে টেন্টের বাইরে চলে গেলাম।
মিনিট পাঁচেক পরই বিপিনদা ব্যস্ত হয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন!
কাণ্ড দ্যাখো তো, খেলার ঠিক আগেই বমি শুরু হল। প্রসূন কোথায়, প্রসূন…এই যে দ্যাখো তো নিমাইয়ের কাণ্ড! যাও, যাও ড্রেস করো।
বেঞ্চে নিমাই শুয়ে। হাত দিয়ে চোখ ঢাকা। হঠাৎ নাকি বমি করতে শুরু করেছে। ড্রেস করে বেরোবার সময় আনোয়ারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হল রে?
নির্বিকার ভাবে আনোয়ার বলল, আধ শিশি আইডিন খেলে বমি তো হবেই।
শোনামাত্র বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল। শুধু বললাম, বাঙালটা সব পারে। নিমাইয়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম, গুনে গুনে তিনটে গোল দেব।
চোখ থেকে হাত না সরিয়ে নিমাই বলল, মোহনবাগানকে তো?
না– শেষ করার আগেই থেমে গেলাম। হাত নামিয়ে নিমাই জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
বললাম, আজকে।
.
আমি হ্যাট্রিক করতে পারলাম না প্রথম খেলায়। শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের ডিফেনডিং জোনে নেমে এসে আমাকে ট্যাক্স করতে হল রাজস্থানের হাফ ব্যাকদের। আনোয়ারের দু পাশ দিয়ে দুটো ছেলে, সুকল্যাণ আর সুভাষ বেরোচ্ছে। আমরা দশজন পেনালটি বক্সের মধ্যে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে পাঁচ গোল খেয়ে যাওয়ার কথা। সুকল্যাণের ডান পা থেকে বেরোনো তিনটে গোলার একটা পোস্টে, একটা আনোয়ারের কাঁধে আর অন্যটা কোন জাদুমন্ত্রে জানি না, বারের উপর দিয়ে তুলে দিল গোলকিপার। বাকি দুটো নষ্ট করল সুভাষ নিজেই। তার পর ১৮ মিনিটে কীভাবে যেন একটা বল ছিটকে সেন্টার লাইনের কাছে চলে এল। আমি বলটা ধরে রাজস্থান গোলের দিকে তাকিয়ে দেখি—গোলকিপার আর আমার মাঝে শুধু ওদের স্টপার ব্যাক ফেন।
মাঝমাঠ থেকে আমি বল নিয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম, একটু কোনাকুনি, ডান দিকের কনার ফ্ল্যাগের দিকে। ফেন আমার সঙ্গেই দৌড়চ্ছে, তার বাঁ দিক কভার করে। লেফট ব্যাক নেমে আসছে। বয়স্ক ফেনকে মুখোমুখি কাটাতে পারব বলে ভরসা হল না। স্পিডে হারাব স্থির করেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলটা বাঁ দিকে প্রায় পনেরো গজ ঠেলে দিয়ে ফেনকে ডান দিক থেকে প্রচণ্ড দৌড়ে পিছনে ফেলে দিলাম। পেনালটি বক্স-এর মধ্যে যখন ঢুকছি, গোলকিপার অরুণ তীরবেগে এগিয়ে আসছে! সেই সঙ্গে দু পাশ থেকে দুই ব্যাক।
আমি শুধু অরুণের শরীরের ভঙ্গিটা লক্ষ করলাম। লাফ দেবার আগে বেড়াল যেমন করে, সেই রকম শরীরটাকে ধনুকের ছিলার মতন টেনেছে। আমি বাঁ দিকে হেলে যাওয়া মাত্রই ও দু হাত বাড়িয়ে ভেসে এল। আমি মুহূর্তে ডান দিকে বলটাকে টেনে নিলাম এবং ডান পায়ের নিখুঁত নিচু পাচ-এ ডান পোস্ট ঘেঁষে বলটাকে গোলের মধ্যে পাঠালাম আর সেই সঙ্গেই লেফট ব্যাকের প্রচণ্ড চার্জে মাটিতে ছিটকে পড়লাম।
আমার প্রথম গোল! মাটিতে কাত হয়ে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর জালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাদামি রঙের ওই গোলাকৃতি বস্তুটা কী নিরীহভাবে বিশ্রাম করছে। আমার সারা পৃথিবী এখন মনে হচ্ছে ওই বলটা। ইচ্ছে করছিল বলটাকে দু হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরি।
আমাকে তুলে ধরল দুজনে। রাইট উইং আর রাইট ইনসাইড আনোয়ার দু হাত তুলে ছুটে আসছে। আমার মাথা ঘুরছে তখন। আনোয়ার কী সব বলতে বলতে। গালে চুমু খেল। মেম্বার গ্যালারির দিকে তাকালাম। গোটা পঞ্চাশেক লোকও হবে না। মাত্র এই কজন সাক্ষী রইল আমার প্রথম গোলের। শোভাবাজারের গোটা টিমটাই আমাকে জড়িয়ে ধরছে, পিঠ চাপড়াচ্ছে। গ্যালারি থেকে কে একজন চিৎকার করে ঠাট্টা করল, হয়েছে রে হয়েছে, এবার সেন্টার কর, যেন শিল্ড পাবার গোল দিয়েছিস! শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম।
দু মিনিটের মধ্যেই রাইট উইং-এর ক্রস সেন্টার থেকে সুভাষ হেড করে গোল করল। পরের মিনিটেই আবার একটা একইভাবে হেড করে। হাফ টাইম-এর সময় বিপিনদা এসে উত্তেজিতভাবে আমায় নির্দেশ দিলেন, নামবে না তুমি, একদম নামবে না সেন্টার লাইনের এধারে। গোল খাই খাব, তুমি উঠে থাকবে। আর রতন, তুই শুধু বল বাড়াবি।
রতন হচ্ছে সেই ছেলেটি, প্রথম দিনে যার নাক ফাটতে দেখেছি প্র্যাকটিসের সময়, আর যাকে বিপিনদা একটা চাকরি দেবেন বলেছেন। রতন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ক্লান্ত শরীরটা মাটিতে শুইয়ে চোখ বুজল।
একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাশ আর এক বালতি জল। একজন জল খেয়ে গেলাশটা আর একজনের হাতে দিচ্ছে, সে বালতিতে ডুবিয়ে জল তুলে খাচ্ছে। গেলাশের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন টিকাদার বলল, খাওয়াচ্ছিস তো আজ!
কেন? বিরক্ত হয়ে বললাম।
সিজনে শোভাবাজারের প্রথম গোল স্কোর করলি!
আমি ফিকে হেসে জলের গেলাশের জন্য হাত বাড়ালাম। টিকাদার বলল, টিমে আমার জায়গাটা তো খেলি, কমপেসেট করবি না?
শুনে আমার ভালই লাগল। বললাম, আজ নয়, আর একদিন।
মাঠে নামবার আগে একবার গ্যালারির দিকে তাকালাম। একেবারে মাথায় এক কোণে কুঁজো হয়ে নিমাই বসে। ওকে আমরা টেন্টের মধ্যে শুইয়ে রেখে বেরিয়ে ছিলাম। আমায় তাকাতে দেখে চট করে ও হাত তুলল। দেখলাম হাতের আগায় তিনটে আঙুল উঠে রয়েছে।
সুভাষের হ্যাট্রিকের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে ওরা আরও দুটো গোল নষ্ট করার পর সুকল্যাণ হঠাৎ একটা গোল করে মুষড়ে পড়ল। ও বুঝতেই পারেনি পনেরো গজ দূর থেকে মারা বলটা বিনা বাধায় গোলে ঢুকে যাবে। সুভাষ বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের ঘুষি মেরে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে ফিরে গেল এবং দু মিনিটের মধ্যেই আনোয়ারকে ছিটকে ফেলে দিল শোর চার্জে।
আমার কিন্তু অবাক লাগল রতনকে। বিপিনদার নির্দেশই শুধু নয়, ও যেন নিজের দলের বাকিদের কথাও ভুলে গেছে। বল পেয়ে ও একাই ছুটছে। আমি চেঁচাচ্ছি বলের জন্য, কিন্তু রতন কানেই নেয় না। জিরজিরে বুকটা হাপরের মতন ওঠানামা করছে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখ লাল, ঘাম গড়াচ্ছে রগ বেয়ে থুতনি পর্যন্ত। তবু রতন তাড়া করছে, বল ধরে আবার একাই এগোচ্ছে এবং যথারীতি ওর পা থেকে বল ওরা কেড়ে নিচ্ছে। কিছু যেন ভর করেছে ওকে, সারা মাঠ চষছে, কিন্তু বোকার মতন, অযথা। আমি অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। মাঠের বাইরে থেকে বিপিনদার চিৎকার কানে এল, বল ছাড়, রতন! বল ছাড়, প্রসূনকে দে!
রতন বল ছাড়ার বদলে নিজেই মাঠ ছাড়ল। পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিল না। দু-তিনজনে ওকে ধরে মাঠের বাইরে রেখে এল আর ওর জায়গায় নামল টিকাদার। তার পরই রাজস্থান পেনালটি পেল। ওদের লেফট আউট আমাদের দুজনকে কাটিয়ে গোল পোস্টের কাছে এসে ব্যাক সেন্টার করতে যাবে, টিকাদার তার পেটে লাথি মারল। পেনালটি থেকে গোলটা করল সুভাষ।
৪-১ গোলে এগিয়ে থেকে ওরা এবার একটু আলগা দিল। আমি দুবার বল। পেয়েও কিছু করতে পারলাম না। রাইট উইং-এর একটা ক্রস পাস ভলি মেরে বারের উপর দিয়ে পাঠালাম। আর একবার দুজনকে কাটিয়ে সামনেই পড়ল ফেন। পাশে কেউ নেই যে ওয়াল করব। তাড়াতাড়ি পেনালটি বক্সের মাথা থেকেই গোলে মারলাম, অরুণ আঙুলের ডগা দিয়ে বলটা তুলে বারের ওপারে পাঠিয়ে দিল।
আমার তখন নিমাইয়ের কথা মনে হল। নিমাই থাকলে, ওকে বলটা ঠেলেই ডান দিকের পোস্ট-এর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ বরাবর আমার জায়গায় চলে যেতাম। নিমাই ঠিক বলটা পাঠিয়ে দিত আমার এক গজ সামনে। তার পর শরীরটাকে বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে ডান পা-টাকে পিছনে এক ফুট তুলে বিদ্যুৎ গতিতে একটি ছোবল।
খেলার শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠেই আনোয়ার আর টিকাদারের মধ্যে একটা খণ্ডযুদ্ধ প্রায় বেধে যাচ্ছিল। কারণ সেই পেনালটি। আনোয়ারের মতে, টিকাদার অযথা গোল খাইয়েছে লাথিটা মেরে। লেফট আউট ব্যাক-সেন্টার করতই, কিন্তু তা থেকে গোল নাও হতে পারত, চান্স পাওয়া যেত ক্লিয়ার করার। কিন্তু পেনালটি করিয়ে টিকাদার রাজস্থানকেই শিওর চান্স করিয়ে দিয়েছে।
জবাবে টিকাদার কতকগুলো অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করল, তখন আনোয়ার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। টিকাদার ভয়ংকর চোখে আনোয়ারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, দাঁত চেপে আচ্ছা, দেখা যাবে বলে মাঠ থেকে বেরিয়ে এল।
নিমাই গ্যালারি থেকে নেমে এসেছে। বিপিনদা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, বেশ, বেশ, ভালই খেলেছ। রতন আমার দিকে অদ্ভুত চোখে একবার তাকাল। কেমন বিষণ্ণতা আর ভয় ওর চাহনিতে। দুটো টোস্ট আর একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে যখন আমরা তিনজন বাড়ির পথে রওনা হচ্ছি, রতন ইশারায় আমাকে ডাকল।
তুমি গরিব ঘরের ছেলে, আমিও তাই, রতন ভারী এবং স্থির স্বরে বলল, এখানে টাকা দেয় না, সুতরাং তুমি নিশ্চয়ই পরের বছর অন্য ক্লাবে যাবে। যাবেই, আমি জানি। তোমার খেলা আছে, তুমি এখানে পচে মরবে কেন!
আমি চুপ করে রইলাম। রতন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, একটা চাকরি দেবেন বলেছেন বিপিনদা।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, জানি।
তুমি যদি চাকরি চাও, তা হলে বিপিনদা আগে তোমার জন্যই চেষ্টা করবেন। আমি জানি, আজ তোমার খেলা দেখে বুঝতে পেরেছি। রতনের স্বর হঠাৎ করুণ দুর্বল হয়ে এল। কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আমার হাতটাও চেপে ধরল, চাকরিটা আমার দরকার! আমার বাড়িতে ভীষণ খারাপ অবস্থা, আমার আগে চাকরিটা দরকার, প্রসূন। কথা দাও, তুমি এখানে কিছু চাইবে না। কথা দাও, তুমি এখানে সামনের বছর থাকবে না।
আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি এখানে থাকতে আসিনি। আরও বড় হতে চাই! বড় ক্লাবে যেতে চাই।
রতন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাতে চাপ দিয়ে বলল, কোথায় যেতে চাও, আমার অনেক চেনা আছে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, এরিয়ান, যুগের যাত্রী?
মোহনবাগানে।
এখনই? না, আর একটা বছর অন্তত কোথাও কাটাও। তুমি এখনও নেহাতই জুনিয়ার। এখনই অত বড় ক্লাবে যেয়ো না, বসিয়ে রাখবে। এখন একটা বছর নষ্ট হওয়া মানে ভীষণ ক্ষতি। দেখছ না, আমার অবস্থা। লোভে পড়ে বড় ক্লাবে একদিন আমিও গেছলুম। বসিয়ে রেখে দিল। বড় ক্লাবের মোহ ছাড়তে পারলুম না। আশায় আশায় পরের বছরও রইলুম। একটা মাত্র ম্যাচ খেলালে। তাও আধখানা। তার পর উয়াড়ি, তার পর এখানে। আমারও ইচ্ছে ছিল তোমার মতন -আরও বড় হব।
রতনের স্বর মৃদু হতে হতে গড়ের মাঠের আবছা সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে গেল। আমার মনটা ভারী হয়ে উঠল, মাথা নামিয়ে চুপ রইলাম। রতন গাঢ় স্বরে বলল, আজ আমি খেলেছি ভয় পেয়ে। তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। টিমে আমার পোজিশন বোধ হয় গেল, এই চিন্তাই শুধু মাথায় ঘুরছিল। কিছু মনে কোরো না! ও আমার হাতে চাপ দিল। আমি মাথা নাড়লাম।
রতন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুমি গোল দাও, অনেক গোল দাও, বড় ক্লাবে যাও। আর শরীরের যত্ন কোরো। আরও ওজন বাড়াতে হবে, আরও খাটতে হবে তোমায়; এজন্য স্বার্থপর হতে হবে, বাড়ির জন্য ভেবে উপোস দিয়ে, বরং অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে খাবে। গরিবদের নিষ্ঠুর হতে হবে যদি বড় হতে চায়, নয়তো আমার মতন হবে; এই রকম স্বাস্থ্য নিয়ে কি বড় ফুটবলার হওয়া যায়? প্রসূন, দয়ামায়া মমতা বড় ভয়ংকর শত্রু।
রতন আচমকাই আমাকে ফেলে রেখে টেন্টের মধ্যে চলে গেল। আনোয়ার আর নিমাই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই ওরা জানতে চাইল, কী কথা হচ্ছিল। আমার মন ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বললাম, পরে বলব। এমন কিছু সিরিয়াস কথা নয়। তার পর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, হ্যাট্রিক হল না রে, নিমাই।
খেলা দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছিল রাজস্থানের দিকে নেমে পড়ি। শিওর তা হলে সুভাষের হ্যাট্রিক করিয়ে দিতাম। নিমাই খুব গম্ভীর হয়ে বলল, কী রকম ডিফে ভেঙে ঢোকে দেখেছিস?
কথাটা আননায়ারের গায়ে লাগল। তাচ্ছিল্য ভরে বলল, দেখেছি, সব তো এক-ঠেঙে। শুধু স্পিড আর শট ছাড়া আছেটা কী? হাবিবকে ওয়াচ করিস। কী রকম ওঠানামা করে, অন্যকে খেলায়, স্পেস কভার করে, কী দারুণ রোখ নিয়ে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
নিমাই আর কথা বলল না। বাসে ওঠার আগে আমি ওদের বললাম, কিন্তু সামনের বছর অন্য ক্লাব দেখতে হবে। এখানে আর নয়।
.
০৯.
বিপিনদা কীভাবে যেন জানতে পারলেন, সামনের বছর আমরা তিনজনই শোভাবাজার ইউনিয়ন ছাড়ব ঠিক করেছি। তিনি আমাদের তিনজনকেই একদিন আড়ালে ডেকে বললেন, তোদের জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলাব, সামনের বছরটা থেকে যা।
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কেউ কথা বললাম না। ভিতরে একটা অস্বস্তি শুরু হল, কেননা আমরা জানি বিপিনদা তা পারেন। আই-এফ-এ-তে শোভাবাজারের সেক্রেটারি পরিমল ভট্টচাজের একটা দল আছে, যারা সব কটা কমিটি দখল করে আছে। তারাই শলা-পরামর্শ করে লিগে ওঠা-নামা বন্ধ করিয়েছে গভর্নিং বডির মিটিং-এ। এতে তাদের বড় লাভ—ফুটবল লিগে প্লেয়ারদের জন্য যে খরচ করতে হত, সেটা আর করতে হল না। কেউ টাকা চাইলেই তারা এখন বলে দিতে পারে—গেট খোলা আছে, বেরিয়ে যাও। আমরা রাস্তা থেকে এগারোটা ছেলে ধরে এনে খেলাব। সব ম্যাচ হারলেও, একটা পয়েন্ট না পেলেও কিছুই আসে-যায় না, ওঠা-নামা তো বন্ধ!
সত্যি বলতে কী, অবস্থাটা এই রকম না হলে আমাদের মতন আনকোরা উটকো তিনজন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পেতাম কি না সন্দেহ। প্রতি বছরই শোভাবাজারের অন্তত দু-তিনজন জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে থাকে জুনিয়ার ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপে। জুনিয়ার ইন্ডিয়া টিমেও দুজন ছিল গত বছর।
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথা? বিপিনদা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন।
না না, তা কেন, তবে– নিমাই আমাদের মুখপাত্র হয়ে বলল।
তবে কী? টাকা চাই, চাকরী চাই?
না, তা নয়, বড় ক্লাবে খেলার ইচ্ছে তো সকলেরই থাকে। নিমাই বলল।
জুনিয়ার বেঙ্গল, জুনিয়ার ইন্ডিয়া, এর থেকেও বড় ক্লাব আর কী আছে! আগে এ সব ছাপ নিয়ে নে, তখন দেখবি, বড় ক্লাব তোদের বাড়িতে গিয়ে সাধাসিধে করবে।
বলতে ইচ্ছে করল, অমন গণ্ডা গণ্ডা ইন্ডিয়া ছাপ মারা প্লেয়ার ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্লেয়ার তো মাত্র দু-তিনজন হতে পেরেছে। কিন্তু এ সব কথা এখন বলে কোনও লাভ নেই, তাতে তিক্ততাই শুধু বাড়বে। তাই বললাম, বিপিনদা, আমরা ভাল করে খেলা শিখতে চাই, ভাল প্লেয়ারদের পাশে থেকে খেলতে চাই। দেখছেন না, প্রত্যেকটা ম্যাচে নিমাই-আনোয়ারের অবস্থা, আমার অবস্থা। কেউ সামলাতে পারে না, আটকাতে পারে না, একটা পাস দিতে পারে না ঠিকমতো, দম নেই, স্কিল নেই, বুদ্ধি নেই। এখানে আমি উৎসাহ পাই না। একা একা কি ফুটবল খেলা যায়?
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। গলা চড়ে গেল। নিমাই আর আনোয়ার আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল।
বিপিনদার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তোরা ক্লাব ছাড়লে পরিমলদা চটবে। ওকে চটিয়ে পারবি উঁচুতে উঠতে? প্রত্যেকটা ক্লাব ওকে ভয় করে। ইন্ডিয়া টিমে তোদের খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, যতই তোরা ভাল খেলিস না কেন। আর, তারই ক্লাবে তোরা খেলবি না, রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও?
আমরা আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
আমরা যে দ্বিধায় পড়েছি বিপিনদা বোধ হয় সেটা বুঝতে পারলেন। একটা বছর থেকে যা। সামনের বছর সম্ভবত আবার প্রমোশন রেলিগেশন চালু হবে। আমাদের ক্লাবের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস, কয়েকটা মাত্র মেম্বার, আই-এফ-এর ডোনেশনে কি সারা বছর এতগুলো খেলা চলে? এর-ওর কাছে। ভিক্ষে করেই চালাতে হয়। তবু কথা দিচ্ছি, সামনের বছর প্রথম কিছু কিছু হাত খরচা দেবার চেষ্টা করব। থেকে যা তোরা। শোভাবাজারই তোদের প্রথম ফাস্ট ডিভিশনে খেলিয়েছে, এটা ভুলে যাসনি। তোরা বড় হবি, ফেমাস হবি—এটা কি আমরাও চাই না? তখন কি আমরাও গর্ব করব না?
বিপিনদাকে অত্যন্ত করুণ দেখাচ্ছে। গলার স্বর গাঢ় আর ভিজে। ভিতরে ভিতরে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ছি। পরিমল ভট্টচাজকে আমরা চোখে দেখেছি মাত্র, আর ওঁর সম্পর্কে শুনেছি অনেক কথা। নিজের স্বার্থ আর ক্ষমতা রক্ষার জন্য উনি যাবতীয় অপকর্ম করতে পারেন ও করেন। যে কোনও ফুটবলারের কেরিয়ার খতম করা ওঁর পক্ষে অতি সামান্য ব্যাপার। বিপিনদা সে সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও দিলেন।
নিমাই হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমরা দু দিন ভেবে আপনাকে জানাব।
বিপিনদা আমাদের তিনজনের মুখের দিকে পর পর তাকিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
.
আমি হর্ষদার কাছে গেলাম। ছাদে গোটা কুড়ি টবের মাঝে উবু হয়ে হর্ষা ফুলগাছের পরিচর্যা করছিলেন। আমার কথা শুনতে শুনতে উনি টবের মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলেন একটা শিক দিয়ে। অনেকক্ষণ কথা বললেন না। একটা গোলাপের শুকনো মরা ডাল গাছ থেকে সাবধানে ভেঙে নিয়ে হর্ষদা মৃদু স্বরে বললেন, তোর ইচ্ছেটা কী?
আমি এখনও ঠিক করতে পারিনি ক্লাব বদল করব কি করব না। নিমাই-আনোয়ারেরও আমার মতন দোটানা অবস্থা। ওরা একবার বলছে, থেকেই যাই, একটা বছর তো! আবার বলছে, ধৃত, একটা বছর স্রেফ অযথা নষ্ট করা।
প্রসূন, এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই-ই ঠিক কর।
আমি শক্ত হয়ে গেলাম, হর্ষদার গলার স্বর অত্যন্ত ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ়। আমি চুপ করে রইলাম মরা গোলাপ ডালটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। হর্ষদা তা লক্ষ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ডালটা মরে গেছে, কিন্তু গাছটা দ্যাখ কেমন জীবন্ত। অন্য ডালে কতগুলো কুঁড়িও ধরেছে। এ রকম হয়, সর্বক্ষেত্রেই হয়। মানুষ বেড়ে ওঠে আর ফেলে যায় তার মরা ডালপালা। নতুন ডালে ফুল ফোটায়। এজন্য পরিচর্যা চাই। সার, জল, রোদের তাপ তাকে দিতে হয়। শিকড় থেকে পাতার মধ্য দিয়ে সে প্রাণশক্তি আহরণ করে। যদি শিকড় নষ্ট হয়, পরিচর্যা না পায়, তা হলে বাড়তে পারে না। মানুষের শিকড় তার চরিত্র। তুই যদি অনুগ্রহ নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে বড় হতে চাস তো তোর শিকড় পচে যাবে। এই গাছটা বেড়েছে ফাইট করে। আমি একে হেল্প করেছি মাত্র। মানুষ হেল্প নাও পেতে পারে, তখন নিজেকে নিজে হেল্প করতে হয়। যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না। হেরে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে, আর মানুষকে তার মোকাবিলা করতে হয়।
শুনতে শুনতে টের পেলাম সারা শরীরে কলকল শব্দে রক্ত ছুটছে, আর দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট একটা স্বরের মতন আমার বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউয়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে কে যেন বলছে, স্ট্রাইকার! স্ট্রাইকার! তোমার সামনে দুর্ভেদ্য ডিফেনস। ভাঙতে কি পারবে না?
আমি মাথা নামিয়ে নিজেকে শুনিয়ে বললাম, পারব।
হর্ষদা অবাক হয়ে একবার তাকালেন, তার পর মরা ডালটা ছুড়ে ফেলে বললেন, মনে আছে, তোকে হেমিংওয়ের একটা গল্প একবার বলেছিলাম—ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি! তাতে এক জায়গায় আছে, ম্যান ক্যান বি ডিফিটেড, বাট…তুই লেখাপড়া শিখলি না কেন রে প্রসূন? তা হলে ইংরিজিতেই বইটা নিজে পড়তে পারতিস। মুখে বললে অনেক কিছু যে নষ্ট হয়ে যায়।
আমার মনে আছে হর্ষদা, মানুষকে হারানো যেতে পারে, কিন্তু ধ্বংস করা যেতে পারে না, তাই না? এই বলে আমি আর সেখানে থাকিনি।
.
১০.
রাস্তায় বেরিয়ে এলোমেলো হাঁটতে শুরু করি। একা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি হাঁটি। অনেক চেনা ছেলের সঙ্গে দেখা হল, কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম না। তারা চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল। অনেক ডাকল, আমি শুনতে পেলাম না। ভূতে পাওয়ার মতন আমি শুধু হাঁটলাম। আর হর্ষদার কথাটা আওড়ালাম মনে মনে, এখন তোর সামনে চ্যালেঞ্জ, নিবি কি নিবি না, সেটা তুই ঠিক কর।
অ্যাই প্রসূন, দেখতেই পাচ্ছ না যে। থমকে দাঁড়ালাম। নীলিমা সামনে। দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে। কোমরে হাত, চোখে বিস্ময়।
বাব্বাঃ, খবরের কাগজে নাম বেরোয়, তাতেই এই—ছবি বেরোলে কী হবে?
লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করে বললাম, যাঃ, ও রকম নাম গণ্ডা গণ্ডা লোকের রোজই বেরোয়। শোভাবাজার ইউনিয়নের প্লেয়ারের আবার নাম! সত্যি বলছি, দেখতে পাইনি তোমায়। কোথায় গেছিলে? বাড়ি যাচ্ছ এখন?
লজ্জাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য এলোপাতাড়ি প্রশ্ন করলাম, প্রেশারে পড়ে গ্যালারিতে বল ওড়ানোর মতন।
নীলিমা এবার সত্যিই অবাক হয়ে বলল, সে কী, এই সময়ে টিউশনি থেকে রোজ ফিরি, তা ভুলে গেছ? কী ব্যাপার, বলো তো? হাত তুলে দাঁড়াতে বললাম, দাঁড়ালে না। একমনে চলেছ তো চলেছই। কথা বলছ, যেন এই মাত্র পরিচয় হল। উঃ, হয়েছে কী?
একটা ব্যাপারে মুশকিলে পড়ে গেছি, সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলুম। হর্ষদার বাড়ি থেকে ফিরছি। চলো একটু হাঁটা যাক।
আমরা দুজনে মন্থরগতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কথা বলছি না। নীলিমা গম্ভীর হলে গিন্নিবান্নি দেখায়। মা-মরা সংসার দু বছর ধরে চালাতে চালাতে ও রীতিমতো ভারিক্কি হয়ে গেছে। নানান দিক ভেবেচিন্তে বাবার সামান্য আয় আর নিজের টিউশনির টাকায় ওকে সংসার চালাতে হয়। তার উপর নিজের স্কুলের পড়া আছে।
হর্ষদার কথাগুলো মনে পড়ছে আর যেন গায়ে ছ্যাঁকা লাগে—যার চরিত্র পচে গেছে, সে পারে না! মানুষের শিকড় তার চরিত্র! চ্যালেঞ্জ নানা রকম চেহারা নিয়ে আসে! ব্যাপার কী! এই সব ভাল ভাল কথা দিয়ে আমি কী করব? ফুটবল, ক্লাব বদল, বেঙ্গল কি ইন্ডিয়া টিমে খেলার সঙ্গে এগুলির কী সম্পর্ক? আমার স্কিল, স্পিড, ড্রিবলিং, স্ট্যামিনা, বুদ্ধি দিয়ে খেলব—এ সবের সঙ্গে চরিত্রের যোগ কোথায়? ভিতরে ভিতরে ছটফট করে উঠলাম এক অসহ্য অসহায়তায়। ধরতে পারছি না আমার অপোনেন্ট যে কে, কী যে তার স্ট্র্যাটেজি, বুঝতে পারছি না।
হালকা হবার জন্যই কথা শুরু করলাম, টিউশনি থেকে আসছ বুঝি?
না, এক পাবলিশারের কাছে গেছিলাম। প্রুফ দেখার কাজ শিখছি, বাবাই ঠিক করে দিয়েছেন।
অনেক টাকা পাওয়া যায়?
নীলিমা মাথা হেলিয়ে পিছন থেকে বেণীটা সামনে টেনে আনল। বেণীর গোড়ার আলগা চুলগুলো আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, অনেক, এক লক্ষ, দু লক্ষ টাকা।
ঠাট্টা করছ!
মোটেই না। কষ্ট করে সভাবে রোজগার করা একটা টাকা আমার কাছে এক লক্ষ টাকার সমান।
আমি এখনও রোজগার করতে পারলাম না। বাড়িতে একটা পয়সাও দিই না। আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। নীলিমাও আমার মতন হাসল।
ফুটবল খেলে তো হাজার হাজার টাকা বছরে পাওয়া যায় শুনেছি। এটাও ততা এক রকমের কাজ। যেমন অফিসে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় লোকে কাজ করে। ফুটবলারকে তো ওদের মতনই শিখতে হয়? নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
নিশ্চয়। আমি তো শিখতেই চাই। এক মুহূর্ত ভেবে আবার বললাম, জানো, এখন যে ক্লাবে খেলছি, সেখানে কিছুই শিখতে পারি না। ওরা আর এক বছর থাকতে বলছে। তা হলে কিছু টাকা দেবে, জুনিয়ার বেঙ্গল টিমে খেলিয়ে দেবে, এমনকী ইন্ডিয়া টিমেও। কী যে করি, ভেবে পাচ্ছি না। যদি ওদের কথা না শুনি, তা হলে এসব খেলা বন্ধ করে দেবে। শোভাবাজারের পরিমল ভট্টচাজের ভীষণ ইনফ্লুয়েন্স অল ইন্ডিয়ায়। ওকে চটিয়ে কোনও ফুটবলার বড় হতে পারে না।
নীলিমা কিছুক্ষণ কথা বলল না। দেখে মনে হল গভীরভাবে ভাবছে। আমি আবার বললাম, হর্ষদা বললেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
আর কী বললেন?
ইতস্তত করে বললাম, গাছ বেড়ে ওঠে শিকড়ের গুণে। শিকড় হচ্ছে চরিত্র, পচে গেলেই মানুষ মরে যায়।
নীলিমা রাস্তার উপর থমকে ঘুরে দাঁড়াল। প্রসূন, যারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বড় হতে পারে না, তারা বড় হবার যোগ্য নয়। প্রসূন, শিক্ষায় যে ফাঁকি দেয় না, সেই একমাত্র বড় হতে পারে। বড় হতে পারে না কাপুরুষেরা। তুমি কি কাপুরুষ, তুমি কি পরিশ্রমে অনিচ্ছুক?
না, তবে সব কিছুতেই ভাগ্য লাগে। পেলে-গ্যারিনচা থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিল তো হেরেছে।
জানি না কে পেলে কে গ্যারিনচা, কেমন তারা খেলে, কিন্তু তাদের পালটা টিমেও তো ভাল প্লেয়ার থাকতে পারে! জ্যাঠামশায়ের ভাগ্য খারাপ, তাই পা নষ্ট করে অপমানিত হয়ে ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছেন। তোমার ভাগ্যে তা নাও হতে পারে। তা ছাড়া, তোমার উচিত নয় কি বাবার অপমানের শোধ নেওয়া? যারা একদিন তাঁর মুখে থুথু দিয়েছিল, তাদেরই সেই থুথু চাটতে বাধ্য করা? বড় প্লেয়ার না হলে, বড় কিছু একটা না করলে তা পারবে কী করে? কাউকে খুশি করে ইন্ডিয়া টিমে খেলতে পারো, কিন্তু বড় প্লেয়ার হতে পারো না।
আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম বড় বড় চোখ দুটোর দিকে। যে পাষাণ ভারটা চেপে বসেছিল বুকে, সেটা সরে যাচ্ছে। হালকা ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। বাবা, আমার বাবা গভীর মর্যাদাবান এক অপমানিত ফুটবলার। ফুটবলকে, হাজার হাজার দর্শককে, তাঁর ক্লাব যুগের যাত্রীকে দিয়েছেন অনেক কিছু বদলে কিছুই পাননি। দিন-রাত এখন সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন চাবুক খাওয়া বলদের মতন। বাবা, আমার বাবা ক্লান্ত নিঃসঙ্গ অপমানিত এক ফুটবলার। আর আমি তাঁর স্বার্থপর ছেলে।
নীলিমা, তুমি আমার বাবাকে ভালবাসো! নিমাই আর আনোয়ার বাদে তুমি আর মা-ই আমার সব থেকে বড় বন্ধু।
নীলিমা শোনামাত্র মুখ লাল করে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে, ধার দেবার মতন পয়সা এখন আমার হাতে নেই। একটা চানাচুরের দোকান পর্যন্ত যাবার ক্ষমতাও কি তোমার ব্যাগটার নেই?