সোনালী সেই দিনের কথা
(এগারো).
” এই পথ দিয়ে
— জীবনানন্দ
এই পথ দিয়ে কেউ চ’লে যেত জানি
এই ঘাস
নীলাকাশ —-
এসব শালিখ সোনালি ধান নর-নারীদের
ছায়া-কাটাকুটি কালো -রোদে
সে তার নিজের ছায়া ফেলে উবে যেত ;
আসন্ন রাত্রির দিকে সহসা দিনের আলো নষ্ট হয়ে গেলে
কোথাও নতুন ভোর রয়ে গেছে জেনে
সে তার নিজের সাধ রৌদ্র স্বর্ণ সৃষ্টি করেছিল।
তবুও রাত্রির দিকে চোখ তার পড়েছিল ব’লে
হে আকাশ, হে সময়, তোমার আলোকবর্ষব্যাপ্তি শেষ হ’লে
যখন আমার মৃত্যু হবে
সময়ের বঞ্চনায় বিরচিত সে এক নারীর
অবোলা রাত্রির মতো চোখ মনে রবে ।
অগ্রন্থিত “
দেখতে দেখতে বয়স আমার তেইশ পেরিয়ে চব্বিশে পড়ল। চোখের স্বপ্নগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল ক্রমশঃ।
এর মধ্যে হুড়মুড়িয়ে এসে গেল ১৯৭৫ সাল।
সারা ভারতে জারী হল জরুরী অবস্থা।
সে এক অস্বাভাকি অরাজক ব্যাবস্থা শুরু হল।
ঘরে থাকা যায় না। থাকলে, আচমকা সি. আর.পি.এফ ( সেন্ট্রাল পুলিশ) ঘরে ঢুকে এসে , যাকে পায় তাকে ধরে মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তোলে।
ওরা আমাদের ভাষা বোঝে না।
আমরাও বুঝি না ওদের ভাষা।
আমরা বুঝি, মার দেওয়া ছাড়া ওদের আর কোন ভাষা জানা নেই।
শিশু বৃদ্ধ যুবক যুবতী সকলেই ওদের চোখে বিপজ্জনক, তাই কারোই রেহাই ছিল না ওদের কাছে। ফলে দিনের বেলা আমাদের মাঠে ঘাটে, বনে বাদারে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাতে হত। বৃদ্ধারাই কেবল ঘর আগলে থাকতেন।
বড় রাস্তায় বের হওয়া যেত না। টহলদারী ভ্যান থামিয়ে রাস্তা থেকে তুলে ধরে নিয়ে যেত
যে কোন তরুণ বা যুবককে। নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তুলতো।
বোকার মত প্রতিবাদ করলে, বাড়তি পাওনা হিসাবে জুটত লাথি চড় কিল ঘুষি, বন্দুকের বাট দিয়ে মাথায় বা ঘাড়ে আঘাত।
সেই পরিস্থিতির আগে থেকে, বছর চারেক ধরেই, একদিকে বাংলা দেশের মুক্তি যুদ্ধ, অন্যদিকে নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। একদিকে হটকারী লাল সন্ত্রাস, অন্যদিকে পুলিশের অমানবিক নির্যাতন ।
CRPF -র(কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী) তাড়া খেয়ে দিনে দুপুরে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া আর আমাদের কোন বিকণ্প উপায় জানা ছিল না।
এরকম ঘোর কাল অন্ধকার সময়ে, মানসিক উদ্বেগে দিন কাটানো, শঙ্কায় রাত পোহানো।
আমরা কয়েকজন তখন, বাঘাযতীনের সাগরিকা – চায়ের দোকানে সময় সুয়োগ পেলে আড্ডা দিই। একদিন সন্ধ্যায় বেদব্যাস (আমাদের পত্রিকা) – এর প্রকাশ উপলক্ষে আমি আর শৌভিক চক্রবর্তী বসে চা পান করছি আর পত্রিকা নিয়ে আলোচনা চলছে, এমন সময় কয়েকজন CRPF ঢুকল। আমাদের মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তুলল।
তারপর আরও কয়েকজনকে এখান- সেখান থেকে ধরে এনে, ভ্যান ভরে ফেলল, ভ্যান ভরে যাওয়ার পর ড্রাইভারকে বলল, ভ্যানটা চালাতে।
ড্রাইভার ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছিল। ভ্যানটা বাঘাযতীনের মিলিটারী রোডের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ।
ভ্যানটা এসে থামল,গাঙ্গুলীবাগানের শক্তি সোমের “বিল্ডার্সের দোকানের” সামনে। বাঙালী অফিসরাটি, আমাদের হাতে বেদব্যাস পত্রিকাটি দেখে, এক হ্যাচকা টানে হাত থেকে কেড়ে নিলেন। আগাপাশতলা চোখ বুলিয়ে পত্রিকাটি দেখলেন। কি বুঝলেন কে জানে?
পরে আমাদের কাছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জানলেন, আমরা পত্রিকাটি প্রকাশ করি। আরও জানলেন, আমরা কবিতা লিখি অর্থাৎ কবি। বাঙালী অফিসারটি আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে আমাদের জরিপ করলেন নিখুঁত ধারালো চোখে।
তারপর বললেন, শক্তি চ্যাটার্জীকে চিনিস?
তখন পর্যন্ত শক্তি চ্যাটার্জীকে মুখোমুখি কখনও দেখিনি। তবে তার নাম জানি,তার অনেক কবিতা পড়েছি।
আমি বললাম, হ্যাঁ চিনি মানে তার কবিতা পড়েছি। মুখোমুখি দেখিনি কখনও।
উনি শুনে কি ভাবলেন কে জানে,
আমাকে বললেন,তুই কবিতা লিখিস?
আমি ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে ঘাড় কাৎ করে সন্মতি জানলাম।
তখন কি জানি, উনি আমার কাছে আমার কবিতা শুনতে চাইবেন। জানলে বলতাম না লিখি না, জানাতাম মাথা নেড়ে। আমাকে বললেন একটা কবিতা শোনাতো তোর। । তখন কি আর কোন কবিতা মনে আসে ছাই। গলা শুকিয়ে কাঠ, ঠিক ভয়ে নয়, দুশ্চিন্তায়, মা বাবা ভাই বোন চিন্তায় অনাহারে ছটফঠ করে বিনিদ্র রাত কাটাবে।
– সে কি রে শালা বল।
অফিসার ধমকালেন। তার মুখ থেকে ঝাঁঝালো মদের গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল।
কোন স্বরচিত কবিতাই মনে আসছে না দেখে, বেদব্যাসের সেই সংখ্যায় প্রকাশিত আমার কবিতাটি পড়ে শোনালাম। কবিতার নাম
” জরুরী অবস্থা” সেই সময়ের পরিপেক্ষিতে লেখা।
( আক্ষেপের কথা কবিতাটি কোন কপি আজ আর আমার কাছে নেই ),থাকলে পুরো কবিতাটা এখানে তুলে দেওয়া যেত।
কিছু কিছু পংক্তি মনে আছে।বলি শুনুন,
” ….. অবস্থাটার জরুরী খুব বেচাল হল হাল
জানি না আর এমন করে কাটবে কত কাল?
ওরা বলে ধৈর্য ধরুন আর কিছুটা কাল,
সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে দেশকে ভালবেসে
জমিতে সবে পড়েছে হাল
ফলবে ফসল ঠিক অবিকল
সোনার মত হেসে।
আমাদের এই দেশে
ফুল ফুটবে,ফল ধরবে শেষে
অবস্থাটা জরুরী তাই
কাজ করে যাও হেসে
ব্যথার কথা বললে এখন
একলা যাবে ফেঁসে।”
অফিসারটি কবিতাটা শোনার জন্যই বোধহয় শুনেছিলেন। কিংবা নিরেট নির্বোধ। অথবা মদের ঘোরেও হতে পারে। কবিতাটার মানে যে কিছুই বোঝেনি বোঝা গেল, ভ্যান থেকে আমাদের নামিয়ে ছেড়ে দেওয়াতে।
বোঝেনি ভালই হয়েছে আমাদের পক্ষে। ভাগ্য ভাল ছিল বলতে হবে আমাদের, বুঝলে দেশদ্রোহীতার অপরাধে আমাদের হাজত বাস ঠেকাতো কারও সাধ্য ছিল না সে’সময়? সে’বারের মত আমরা মুক্তি পেলাম।
তারপরও আরও কয়েকবার আমাকে থানা পরি-দর্শনে যেতে হয়েছিল। সে অন্য গল্প।
মৌ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এখন,লেডিব্রেবন কলেজে পড়ে, পার্কসার্কাসে। আমার সাথে আর তার দেখা হয় না আজকাল।
” শুধুমাত্র তোমাকে
– ভাস্কর চক্রবর্তী
১.
লম্বা, সর্দি—সমস্তদিক অন্ধকার ক’রে, আজ
বৃষ্টি নামলো-তোমার
দূর সম্পর্কের ভাই, প্রতিদিন, খবর আনে আমার জন্যে
তুমি নাকি সেই কবে পাহাড়ে বেড়াতে বেরিয়েছো, ফেরোনি
এখনও—সুটকেশ ভর্তি ক’রে
তুমি নাকি রাশি রাশি জামা-কাপড় নিয়ে গেছো, বই নিয়ে গেছো
আরও কতো কী নিয়ে গেছো, সবকিছু অবশ্য
এখন মনে পড়ছে না আমার—তোমার ভাই
আমার জানলায় এসে বসে আছে এখন—ওকে আমি
অবনীন্দ্রনাথ পড়তে দিয়েছি—অসময়ে প্রায়ই, হঠাৎ
ঘুমিয়ে পড়ি আজকাল—ও এসে
চটপট আমাকে ডেকে তোলে, বলে : তুমি নাকি একেবারেই
চিঠি লেখো না—আমাকে না জানাও
ওকে জানাও, কবে ফিরছো—
ও বেচারা, আমার চেয়েও কষ্টে আছে—আজকাল
কেবলই মনে হয় এইরকম
২.
তোমার হাসি
ভালো লাগে আমার—পথের
মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে
তুমি যখন হেসে ওঠো হঠাৎ—পুলিশও
মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় আমাদের
সিগারেট ধরায়।”
(বারো)
” অপচয়
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি ?
আছে কি স্মরনে,সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্ভ বিস্ময়,
শুন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা,আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা ?
সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্য স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন ;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন।।
মরে না দুরাশা তবু ; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে ।”
জরুরী অবস্থা, আমাদের নাজেহাল করে দিয়েছিল। অস্তিত্বের সংকট তৈরী করে তুলেছিল।
বেধরক ধর-পাকড়ের ফলে, বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপন করলেন।লেখায় সেনসরশিপ চালু হল।
বে-ফাঁস কিছু লেখা প্রকাশ পেলে লেখক ও সম্পাদক দুজনেরই হাল, বেহাল হত সে সময়।তারই প্রতিবাদে ( আগেই বলেছি ) গৌরকিশোর ঘোষ গলায় কুকুরের বকলেস বেধে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। আমরা তার প্রতিবাদের অভিনব ধরণ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম।
মৌ এর সঙ্গে অনেক দিন বাদে হঠাৎ গড়িয়াহাটা মোড়ে দেখা হয়ে গেল। মৌ আমাকে দেখে যেন আনন্দ উচ্ছাসে ফেটে পড়ছিল। চার পাশের লোকজন কৌতূহল বসতঃ আমাদের দেখছে,আমি আড় চোখে দেখলাম। মৌ-এর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ও আমার হাত ধরে টানলো। বলল, চল খুব ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খাব। মৌ এর এই আদিখেত্যা ভাব অনেকের সহ্য হচ্ছিল না। দু একজন চাপা স্বরে বলেই ফেলেছিল, দেখে আর বাঁচি না,শেষ পর্যন্ত কী হলো সমাজের হালচাল। তারপর জ্বাল থেকে বলল, ভবিষ্যতে টিকলে হয়।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের মুখে এসে –
দাস কেবিনে ঢুকে বসলাম। দুটো মোগলাইয়ের অর্ডার দিলাম।
মৌ এর মুখে যেন কথার ফুলঝুরি ফুটছে।
এখন ভাবতে অবাক লাগে, কি করে এই মৌ-ই প্রথমদিকে নির্বাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, আমার পড়া বোঝানো শুনতো।
বলছে ওর কলেজের কথা, কলেজ বন্ধুদের কথা, নিজের পরিবারের কথা। এই সব অবান্তর কথায় কথায় কখন দু জনেরই মোগলাই শেষ। দাম দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
হাঁটতে হাঁটতে মৌকে নিয়ে বাস স্টপেজে এসে দঁড়ালাম। বাস আসতেই মৌ কে বাসে তুলে দিলাম।
ও বাসে ওঠার আগে আমাকে বলল, একদিন আমাদের বাড়িতে এসো। মা প্রায়ই তোমার কথা বলে।
– কি বলে?
– সে কথা এলে তোমায় বলব।
দেখলাম, বাস ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।মৌ যে কবে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে ঠিক খেয়াল নেই।
আমাদের সংসারে দারিদ্রের সংকট যত তীব্র হচ্ছিল, তত আমি লেখার মধ্যে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিলাম। লেখাকেই জীবিকা করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলাম। তখন বুঝিনি কাজটা কত কঠিন। স্বেচ্ছাকৃত কত কৃচ্ছসাধন করে, কত সাধানার ফলে একটা ভাল-লেখা লেখা যায়।
আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর সাহিত্যকে ভালবেসে, একটা কথা বুঝেছি, এ বড় কঠিন তপস্যা। ঈশ্বর প্রাপ্তির সাধনার মত। নিজেকে নিঃস্বার্থে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে সঁপে দিতে হয়। এখানে কোন ফাঁকি চলে না।
উনিশ’শো সত্তর শুরু থেকেই দেখে এসেছি, দেশপ্রিয় পার্কের সুতৃপ্তি রেস্টুরেন্টে রবিবার সকাল নটা-দশটা থেকে শিল্পী সাহিত্যিকদের চাঁদের হাট বসত। চলত বেলা বারোটা পর্যন্ত। সমকালীন লেখক শিল্পিরা অনেকেই আসতেন।
আসতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়,বরেন গাঙ্গুলী,শংকর চ্যাটার্জী, দিব্যেন্দু পালিত, পবিত্র মুখোপধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সমীর রক্ষিত প্রমুখ অনেকেই।
শিল্পিদের মধ্যে আসতেন – শ্যামল দত্তরায়, গনেশ পাইন, সুনীল দাস প্রমুখ।
আমিও নিয়মিত সেই আড্ডার সদস্য হয়ে গেলাম, সেই সব আর্ষণীয় ব্যক্তিত্বদের এক অমোঘ আকর্ষণের ফলে। তখন নিয়মিত সেখানে যেতে না পারলে মনের ভিতর একটা আপসোস থেকে যেত।
” মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
শঙ্খ ঘোষ
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
… তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
….বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে,রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
…. বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্ম ভূমি।
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
…. তোমার সাথে ওতপ্রত
নিয়ন আলোয় পণ্য হলো
যা কিছু আজ ব্যাক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
…. রইলো পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
[কাব্যগ্রন্থঃ সংকলিত (শঙ্খ ঘোষ) ]”
(তেরো)
” অক্টাভিও পাস
(১৯১৪-৯৮).
(মেক্সিকো)
একটি অন্তর্গত বৃক্ষ
আমার মস্তিষ্কের ভেতর একটি বৃক্ষ বেড়ে ওঠে।
একটি অন্তর্গত বৃক্ষ বেড়ে ওঠে।
এর শেকড়গুলো শিরা,
শাখা-প্রশাখা স্নায়ু,
ঘন পত্রসমষ্টি এর ভাবনা।
তুমি তাকালেই তাতে আগুন লাগে;
রক্ত-কমলা
এবং
অগ্নিশিখার ডালিম
এর ছায়াফল।
দেহের রাতে
দিনের আলো ফোটে।
সেখানে, আমার মস্তিষ্কের ভেতরে
বৃক্ষ কথা বলে।
আরো কাছে আসো –
তুমি কি সেকথা শুনতে পাচ্ছো?”
সুতৃপ্তি – তে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে অনেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে তখন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেন গাঙ্গুলী, ফণিভূষণ আচার্য ( পি. আচার্য), রথীন্দ্র ভৌমিক, প্রলয় সেন (মৃত) , নির্মল চট্টোপাধ্যায় ( মৃত) , সত্যেন্দ্র আচার্য়, পুস্কর দাশগুপ্ত ( এখন ফ্রান্সে বসবাস করেন, মেসেঞ্জারে যোগাযোগ আছে এখনও), সর্বপোরি শংকর চট্টোপাধ্যায়( যিনি আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন)।
আর আমাদের তরুণদের মধ্যে ( আমরা তখন তরুন, বয়স ২০ -২৫ এর মধ্যে ) অঞ্জন সেন ( দুই বাংলার কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা করত।) , সমরেন্দ্র দাশ (আত্মপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক) , অভীক রায়, অজয় সেন ( মৃত) , তপন রায় (মৃত, বিন্দু – মিনি পত্রিকার সম্পাদক) , তরুণ চৌধুরী, স্বপন মন্ডল শংকর দাশগুপ্ত ( মৃত, সহজিয়া – গল্প পত্রিকার সম্পাদক ) অজয় নাগ এমন আরও কত সব প্রতিষ্ঠিত ও যশোপ্রার্থী তরুণ কবি ও সম্পাদক।
আমাদের আড্ডার মধ্য মধ্যমণি ছিলেন শংকর চট্টোপাধ্যায়। ওনার মত মানবিক গুনসম্পন্ন কবি আমি খুব কম দেখেছি।
আমাদের থেকে বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও, ব্যয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে, আমাদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মত।
খুব পড়াশুনা করতেন। সমকালীন সাহিত্য গুলে খেতেন সরবতের মত।
সমকালীন কার লেখা কেমন? কার লেখার বিশেষ কি বৈশিষ্ট সব আমাদের বুঝিয়ে বলতেন।
মতি নন্দী আর শ্যামল গাঙ্গুলীর লেখার তফাৎ কোথায়? সুনীল গাঙ্গুলী কিংবা শীর্ষেন্দু মুখার্জীর লেখার মধ্যে অমিল কি?
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখার ঘরানার সাথে সন্তোষ কুমার ঘোষের লেখার ঘরানার পার্থক্য কি?
তার সান্নিধ্য পাওয়ার ফলে , এ সব তার কাছে শুনে বুঝতে শিখেছি , দিন দিন তার আলোচনা শুনে কত ঋদ্ধ হয়েছি,আজ বুঝতে পারি।
তার অকাল প্রয়াণ, আমাদের অনথ করেছে।
তার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
নাম – কেন জন্ম, কেন নির্যাতন। আজ দুষ্প্রাপ্য সেই বই।
অসাধারণ সব নতুন ভাবনার কবিতা। সম্ভব হলে সংগ্রহ করে পড়ে দেখবেন। খুব সম্ভবতঃ ‘এম.সি.সরকার পাবলিশিং হাউজ’ থেকে বেরিয়েছিল।
শংকরদার মুখে সাহিত্যের কত ঘটনা শুনেছি।
কবি জীবনানন্দ দাশ অন্যমনস্ক হয়ে, ট্রামের লাইন ধরে হাঁটছিলেন। ট্রামের ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাননি। ট্রাম সরাসরি এসে তার গায়ের উপর উঠে পড়েছে।
শংকরদা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কয়েকজনকে ও চায়ের দোকানী চূনীলালকে নিয়ে, ট্রামের তলা থেকে টেনে কবির আহত দেহ বের করেছিলেন। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। তা মুখে বর্ণনা শুনে আমরাও মর্মাহত হয়েছিলাম।
মৌ এর সঙ্গে আবার বহুদিন দেখা নেই।
মোবাইলের ব্যবহার তখনও চালু হয়নি। তাই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে পড়ে থাকতে হত, কবে দেখা হবে। আর উপায় ছিল তার বাড়ি যাওয়া কিংবা তাকে চিঠি লেখা। কারও বাড়ি যাওয়া, বা কাউকে চিঠি লেখার আদত আমার স্বভাবে নেই। ফলে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে পড়ে থাকা ছাড়া
আর কোন উপায় ছিল না।
একদিন মৌ এর বাবার সঙ্গে গোলপার্কে দেখা হয়ে গেল, তার কাছে শুনলাম মৌ বি. এ পাশ করে এম. এ ভর্তি হয়েছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শান্তিনিকেতনে হোস্টেলে থাকে এখন । ছুটি-ছাটার সময় বাড়িতে আসে।
শুনে, কেন জানি না, আমার বুকের ভিতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল,যদিও তার তেমন কোন কারণ ছিল না,এখন আমার মনেহয়।
” আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
জসীমউদ্দীম
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
প্রাণ বিনোদিয়া;
আমি আর কতকাল রইব আমার
মনেরে বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া,
আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া,
আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া,
আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া,
আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।”
( চোদ্দ ).
“ঘোষণা –
– নজরুল ইসলাম।
হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে
নাই থাক হাতিয়ার!
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার॥
আনো আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙে করো একাকার॥
ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর
আশরাফ আতরাফ;
এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
করো মিসমার সাফ!
চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,
এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –
সহিবে না আজও আর॥”
“সুতৃপ্তি” ( দেশপ্রিয় পার্ক) থেকে বেলা বারটায় বেরিয়ে, কখনও পবিত্রদার ( পবিত্র মুখার্জী ) সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারীতে “অমৃতায়ণ” রেষ্টুরেন্টে আসতাম। সঙ্গে থাকত সত্যেন্দ্র আচার্য, অশোক দত্ত চৌধুরী, তরুণ চৌধুরী প্রমুখ কিংবা অন্য কেউ।
অমৃতায়ণে এসে দেখা পেতাম, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, বলরাম বসাক, আশিস ঘোষ প্রমুখদের। এরা সকলে মিলে তখন গল্পের নতুনধারা সৃষ্টিতে ব্যাকুল। পঞ্চাশ দশকের লেখকদের থেকে নিজেদের আলাদা করে চিহ্নিত করণের কাজ। এই নতুন ধারার গল্পকাররা আর পুরাতন গল্পকারদের মত, কোন গোল গল্প বা কাহিনীতে জোর দেওয়া বাতিল করেন।
তারা তখন প্রকাশ করতেন – ‘এই দশক’ – নামে একটি পত্রিকা। পরে তাদের – ‘গল্প ‘- নামে আর একটি পত্রিকা বের করেন। এখানে তাদের ভাব ধারার উপর লেখা গল্পই প্রকাশিত হত, অন্য রকম কোন গল্প প্রকাশিত হতো না।
তারা মনে করতেন, গল্পকার কারও দাসত্ব করবে না। না দর্শন, না ধর্ম, না রাজনীতি। গল্প হয়ে উঠবে নিজেই একটা মেরুদন্ডবান গল্প, নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গীর জোরে, প্রকাশ ভঙ্গীর জোরে। গল্প হবে এক বিশেষ শিল্প-রীতি। শিল্প সম্মত নিজস্ব রূপ ফুঠে উঠবে তার অবয়বে, গল্প প্রকাশে, লেখকের লেখার নিজস্ব মুনশিয়ানায়।
এই আন্দোলনের ফলে, আমরা অনেক নতুন কয়েকজন ভাল গল্পকার পেয়েছি। যেমন, রমানথ রায়, আশিস ঘোষ, কল্যান সেন, সুব্রত সেনগুপ্ত, বলরাম বসাক, অতীন্দ্রিয় পাঠক, অমল চন্দ প্রমুখ।
গল্পের মতো কবিতায়ও এ ধারার প্রসারণ ঘটিয়ে ছিলেন, ( শ্রুতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে) মৃণাল বসু চৌধুরী, সজল বন্দোপাধ্যায়, পুষ্কর দাশগুপ্ত, পরেশ মন্ডল, অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা।
এরা কবিতাকে ভার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এরা কবিতাকে সব রকম শৃঙ্খলের, সব রকম দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি দেবার চেষ্টা করে ছিলেন।
সফল হয়েছেন, নাকি ব্যর্থ হয়েছেন,সেটা অন্য প্রশ্ন কালের বিচার্যে। সে ধারা পরবর্তী কালে বজায় রেখে লিখছেন প্রবীর রায় ( সম্প্রতি মৃত, শিলিগুড়িতে বাস করত) , দীপক রায় প্রমুখ।
এবার আমার প্রাক্ কৈশোরের দিকে ঘুরে একবার ঘুরে তাকানো যাক। কিছুই তেমন স্পষ্ট নয়, সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা।
একটি বালক একা একা ঝমাঝম্ বৃষ্টির মধ্যে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটি ফুটবল নিয়ে। তার মনের একান্ত বাসনা, সে একজন ভাল ফুটবলার হবে জীবনে। ফুটবল তখন তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান ছিল।
তাকে তখন অনেকেই, ফুঠবল খেলার জন্য হায়ার করে নিয়ে যায় ম্যাচ জিততে, এখানে সেখানে । খেলতো সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ডে। মাঠে নামলে তার শরীরে যেন অন্য কেউ একজন ভর করে । কারও কোন গোল না হলেও। তার গোল করা কেউ আটকাতে পারে না। একটা না একটা গোল সে করবেই।
সে সময় একটা ঘটনা ঘটার ফলে, সে প্রথম তার শরীরে যৌন অনুভূতির স্বাদ টের পায়।
ক্লাবে সরস্বতী পূজা হবে কাল । আগের দিন রাত্রে কয়েকজন জাগবে ঠিক হল। সেও
রাত জাগবে তাদের সঙ্গে এইরকমই কথা হল। সে আর কেউ নয়, আজকের এই আমি নিজে, তোমাদের কবি শংকর ব্রহ্ম।
” বিশ্বাস করুন বন্ধুরা আমি কবি হতে চাইনি
কবিতা লেখার কোন বাসনাই ছিল না আমার
দায়িত্ব এবং অভাব
দু কাঁধে জোয়ালের মতো চেপে বসে
ছেলেবেলা থেকেই
এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত,অনেক ঘুরিয়ে মেরেছে
ফলে দেখেছি অনেক কিছু
বুঝেছি এত যে কম তার
তাই নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারবার
সে সব নিগূঢ় কথা শুনবে কে আর
সে সব কথাই লিখেছি ডাইরীর পাতায়
সে সব কবিতা হলে আমার কি দায়?
বিশ্বাস করুন সকলে
আমি কখনোই কবি হতে চাইনি।”
(পনেরো)
” কোন্ দেশে
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
কোন্ দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
দলতে হয় রে দুর্বা কোমল?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
সোনার কমল ফোটেরে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে
কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
ফিঙে নাচে গাছে গাছে?
কোথায় জলে মরাল চলে,
মরালী তার পাছে পাছে?
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
চাতক বারি যাচে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!”
এই প্রথম বাইরে কোথায়ও রাত জাগব, ভিতরে ভিতরে এক ধরণের তীব্র উত্তেজনার আবেশ, বাড়ির বাইরে প্রথম রাত যাপনের স্বাধীনতা ভোগ। তার এক অমোঘ আকর্ষণ আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল।
বাড়িতে এসে মাকে বললাম। মা কিছুতেই রাজী হল না, প্রথমে। তারপর অনেক কাকুতি মিনতি, মান অভিমানের পর, নিম রাজী করানো গেল।
মা রাজী মানে, বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব মার।
রাত দশটার মধ্যে, বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে, ক্লাবের প্যান্ডেলে চলে এলাম। এসে দেখি কেউ তখনও আসেনি। একা রমা ( ক্লাব সেক্রেটারী, সুভাষদার বোন) একা বসে বসে, ঠাকুরমশাইয়ের দেওয়া ফর্দ মেলাচ্ছে, সব কিছু দশকর্ম ভান্ডার থেকে কিনে আনা হয়েছে কি না।
আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, এসো, বসো। এক এক করে সবাই আসবে।
আমাদের প্যান্ডেলটা হয়ে ছিল, ঠিক খেলার মাঠের পাশেই। ওখানে একটা ঝাকড়া আমগাছ আছে। সেটা পড়েছে, প্যান্ডেলের ঠিক পিছনেই।
গাছটা বিরাট।
ওটাতে ভূত থাকে ভেবে, সন্ধ্যার পর কেউ, খু্ব একটা যায় না এদিকে।
আমি ভিতরে ঢুকে এসে রমার পাশে বসলাম। ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগালাম।
কাজ করতে করতে হঠাৎ মজা করে বললাম,
এখন যদি আমগাছটা থেকে একটা ভূত নেমে এসে,পূজার এ সব সামগ্রী লন্ড ভন্ড কনে দেয়, কি করবে তখন?
রমা বলল, এ ভাবে বল কেন গো? আমার খুব ভয় করছে।
কেন এত ভয় পাচ্ছ? আমি আছি না, ভূতটাকে তাড়িয়ে দেব।
আচমকা লোড শেডিং হয়ে গেল। সারা পাড়া জুড়ে অন্ধকার, ভূতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এর কোন মানে হয়?
রমা খুব ভয় পেয়ে গিয়ে, আমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রমার শরীরেরস্পর্শে আমার শরীরের ভিতরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। বিদ্যুৎ ছটা।
ওর করুণ শঙ্খের মত স্তনের কুড়ির স্পর্শে,
আমার মনে শিহরণ জাগলেও, শরীর আড়ষ্ট। আমার অস্তিত্ব স্থবির। হাত পা স্ট্যাচু। আমি দিশেহারা।
এ ভাবে কতক্ষণ কেটেছিল জানি না।
দেখলাম, একজন জ্বালানো হ্যাজাক নিয়ে এদিকেই আসছে।
রমা সম্বিত ফিরে পেয়ে, আমায় ছেড়ে দূরে সরে গিয়ে বসল।
দেখলাম, সুভাষদার হাতে হ্যাজাক।
আমি উঠে, তার হাত থেকে হ্যাজাকটা নিতে গেলাম।
সুভাষ দা বলল আমাকে, তুই কখন এসেছি কিরে ভয় পেয়েছিস নাকি? তোর হাত কাঁপছে কেন?
আমি বললাম অনেকক্ষণ, লোডশেডিংয়ের আগেই এসেছি। আমি সুভাষদার মুখের দিকে তাকিয়ে, করুণ হাসলাম।
রমা বলল,কাঁপবে না একা একা অন্ধকারে?
যা ভয় পেয়েছিল শংকর দা। অন্ধকারের মধ্যে, আম গাছ থেকে যদি একটা পেত্নী নেমে এসে, শংকরদাকে চেপে ধরেছিল যে।
বলেই, খিল খিল করে হেসে উঠল।
সুভাষদা বললেন, এখন এ সব ফাজলামির কথা রাখ রমা, অনেক কাজ বাকী আছে। কতটা করেছিস তোরা দেখি।
পূজার পর,খেলাধূলা নিয়ে আবার মেতে উঠলাম আমি।
সামনের বছর টালিগঞ্জ অগ্রগমী ক্লাবে আমাকে ভর্তি করে দেবে, সুভাষদা বলেছে। তাই রোজ দু’ঘন্টা করে মাঠে প্রাকটিশ শুরু করলাম।
“অতি কিশোরের ছড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি,
কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া,
পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া।
তোতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক
খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ।
বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ,
ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব ।
পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,
পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক।
হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি,
যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছুটোছুটি।
পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,
ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তারা।
তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক,
বুঝি কেবল গোময় সেটা,- নয়কো মধুপর্ক।
ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে
খেয়ালমতো কাজ করে যাই, কস্ট পাই কি সাধে ?
সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃস্ট চক্র!
আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র।।”
(ষোল)
“অবনী বাড়ি আছো
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?”
খেলা নিয়ে এত মেতে উঠলাম, পড়াশুনায় একদম মন দিতে পারছিলাম না।
দুদিন বাদে টালিগঞ্জ মাঠে, একটা বড় টুর্নামেন্ট খেলা আছে। অগ্রগামী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খেলা দেখতে আসবেন।
সুভাষদা বারবার বলছেন। ভাল করে খেলবি, প্রেসিডেন্টের চোখে পড়া চাই। আমিও সে ভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। রোজ মাঠে প্রাকটিশ করছি।খেলার দিন এগিয়ে আসছে।
নির্দিষ্ট দিনে মাঠে উপচে পড়া ভিড়। তিল ধারণের জায়গা নেই। জার্সি পরে মাঠে নামলাম সমবেত ভাবে একসঙ্গে।
আমি সেন্টারে খেলি। ফরোয়ার্ড।
টসে জিতে, মাঠের বল আমি সেন্টার করলাম পাশের সহযোগীকে।
খেলা শুরু হয়ে গেল। আমার ভিতরে কেউ যেন ভর করতে শুরু করেছে, টের পেলাম।
হাফ টাইম পেরিয়ে গেল। কোন পক্ষের কোন গোল নেই। দু পক্ষই জুজছে সমানভাবে প্রাণপনে।
দ্বিতীয়ার্ধে, খেলা শুরুর আগে সুভাষদা কানে কানে বলল, তোর খেলা ভাল হচ্ছে। প্রসিডেন্ট দেখছে। এবার অন্ততঃ একটা গোল করা চাই তোর। সুভাষদার ডোজে কাজ হল। মাঠে নেমে আরও চনমনে মনে হল নিজেকে।
দুরন্ত বেগে খেলা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ ভেঙে আসছিল।
গোলের মুখে আমার ডানদিকের সহযোগীকে একটা বল পাশ করলাম, ও একটু পা ছোঁয়ালেই বলটা গোলে ঢুকে যেত, ও সেটা মিস করল।
কর্নার কিক হল।
কর্নার কিকটা হেড দিয়ে, বাঁদিকের সহযোগীর দিকে পাঠালাম।বলটা সে কোন কাজে লাগাতে পারল না, ব্যর্থ হল। বুঝলাম যা করা আমাকেই করতে হবে। নিজেই দাযিত্ব নিয়ে গোলটা দিতে হবে।
সুভাষদা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট খেলা দেখছেন, এই তো তার নজরে পড়ার সুবর্ণ সুযোগ। হাতছাড়া করা যাবে না। আর মাত্র সাত মিনিট বাকী খেলা শেষ হবার। যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
বলটা পায়ে পেয়েই আমি বল নিয়ে তীরের বেগে ছুটলাম গোলের দিকে। একজনকে কাটিয়ে একটু সামনের দিকে এগোতেই, প্রতিপক্ষের আর একজন ছুটে এলো।
কিন্ত সেও আমাকে আটকাতে পারল না। তাকে এক ভড়কি দিয়ে সামান্য একটু পিছিয়ে এসে,তারপর সামনের দিকে এগোতেই, গোলের মুখে প্রতিপক্ষরা আমাকে ব্যারিকেড করে আটকে দিল। আর সামনে এগোনো যাবে না বুঝেই, আমি ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে বলটা ডজ করলাম গোলে।
পিছন থেকে প্রতিপক্ষের একজন এসে অন্যায় ভাবে অকারণ এমন করে ল্যাং মারল আমায়। আমি মাঠে ছিটকে পড়লাম।
মাঠে তুমুল হৈ চৈ আর হাততালির মধ্যে আনন্দ উল্লাসের চিৎকারে –
‘গো – – – ও – – – ল – ল – ল ‘ শব্দটা কানে ঢুকতে ঢুকতে আমি জ্ঞান হারালাম। হাঁটুর নীচের পিছনদিকের শক্ত হাড়টা ভেঙে, ফাঁটা কঞ্চির মতো একটা টুকরো ছিটকে চামড়া ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তারপর হাসপাতালে দেখিয়ে প্লাষ্টার করে, মাস ছয়েক বিছানায় পড়ে রইলাম।
এরপর ফুটবলার হওয়ার সাধ ঘুচে গেল, সে বাসনা অচিরেই ত্যাগ করতে হল।
তারপর সুস্থ হয়ে, কিছুদিন কাটল ঘরেই একটা নাটক লিখে। বছর খানেকপর সেই নাটকটা অভিনিত হলো, দুর্গা ও লক্ষ্মী পূজার পর, ক্লাবের ওই প্যান্ডেলই।
তখনকার দিনে লক্ষ্মী পূজার পর প্যান্ডেলেই একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের আয়োজন করা হতো, সেখানে নাচ গান নাটকের অভিনয় হতো।
নাটকটা সকলের খুব ভাল লেগেছিল। ক্লাব থেকে একটা মানপত্র ও স্মারক দিয়ে ছিল আমাকে।
তখন ব্রেক্ষক্ট ও ইবসেনের নাটক পড়ে নতুন ধরণের নাটক লিখতে ইচ্ছে হতো।
তারপর দু’বছর নাটক লিখে, আর কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করলাম। এরপর অভিনয়ের নেশা চাপল মাথায়। পড়াশুনা মাথায় উঠল।
পরীক্ষার ফল অপ্রত্যাশিত ভাবে খারাপ হল। মায়ের কাছে খুব বকা খেলাম।
বাবা বোঝালেন, পড়াশুনা না করলে খাবি কি করে। মুঠে মজুরের কাজ করতে পারবি?:
কথাটা শুনে খুব অভিমান হয়েছিল তখন।
মনে মনে বলেছিলাম, দেখবে একদিন অভিনয় করে কত টাকা রোজগার করব।
আজ হাড়ে হাড়ে বুঝি, বাবার কথার গুরুত্ব, কতটা গভীর ছিল কথাগুলো।
একদিন, সবার উপরে – নামে একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে, সেখানে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় দেখে, অভিনেতা হওয়ার বাসনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম । এতো ভাল আমি কোর কালেই করতে পারব না বুঝে। তারপর বাঁশদ্রোনীর বাড়িতে বহুদিন সচক্ষে দেখেছি তাকে, একদিন সাহস করে গিয়ে পরিচয়ও করেছিলাম তার সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, তার কিছুদিন পর একদিন শুনলাম, নিজের গাড়িতে করে স্টুডিয়োতে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি।
বিশ্বজিতকেও দেখেছি বাঁশদ্রোনীর খানপুর রোডের বাড়িতে। আলাপ হয়েছিল, খুব সদালাপী মানুষ মনে হয়ে ছিল। এখানে খুব কম থাকতেন। বোম্বে থাকতেন বেশীর ভাগ সময়, তাই খুব কম দেখা হত।
পরবর্তী কালে অসিত সেন ও সুচিত্রা সেন বাঁশদ্রোনীতে বসবাস করেন বহুদিন, তাও দেখেছি, কিন্ত আলাপ করার সুযোগ হয়নি।
বাংলা দেশের নামকরা অভিনেতা রেজ্জাক তখন আমাদের পাশের পাড়া, নাকতলায় থাকতেন।
আমার এক মামার বন্ধু ছিলেন তিনি। মামার বাড়িতে কতদিন দেখেছি তাকে, কত কথা বলেছি তার সঙ্গে। তিনি তখন নাটক করতেন। তার বাড়িতে একটা চানাচুর কারখানা ছিল তার নিজের। সেখানে কতদিন চানাচুর কিনতে গেছি। হঠাৎ একদিন শুনি তিনি বাড়ি, কারখানা সব বেচে দিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছেন। ওখানে গিয়ে অনেক নামকরা সত্বেও, মামার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বহুদিন।
সে সময় অভিনয় জগৎ সম্পর্কে আমার খুব আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল।
আমার পনেরো ষোল বছরের ঘটনা এসব।
ষোল পেরিয়ে এসে পাকাপোক্ত ভাবে সাহিত্যের নেশা মাথায় চাপল, ভূতের মতো। যে ভূত আজও ঘাড়ে চেপে আছে। নামেনি এখনও। কবে নামবে জানি না? নামবে বলে তো মনে হয় না।
” এবার ফিরাও মোরে
– সমর সেন
পড়ন্ত রোদে নগর লাল হল।
বহুদূর দেশে
পাহাড়ের ছায়া প্রান্তরে পড়ে;
সন্ধ্যার অন্ধকারে অন্ধ নদীর
মদির ক্লান্ত টান।
মেমননের স্তব্ধ মূর্তি
রাত্রি হয়ে এল শেষ
এবার ফিরাও মোরে।”
(সতেরো)
” জীবাণু
– বিজয়া মুখোপাধ্যায়
ঝড়ে উড়ে আসে পাতা ধুলো রোগের জীবাণু
আমরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
‘এবার বইমেলায় দেখা হল না
এভাবে একদিন পঁচিশে বৈশাখেও দেখা হবে না’-
তোমার চিঠি।
এভাবেই পালটে যায় দেখাটেখা
পালটে যায় দেখা।
সম্প্রতি কি আরও নিষ্ঠুর হয়েছে পৃথিবী
বিজ্ঞাপন বেড়ে গেছে খুব?
একদিন চিঠিও আসবে না আর
সেদিন আমরা
অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব।”
আমি ছোটবেলা খুব হাঁদা ছিলাম।
আজও খুব চালাক চতুর হতে পেরেছি, তা হয় তো নয়। সেই বোকাই রয়ে গেছি। এমন বোকা যে কেউ উপেক্ষা বা অবহেলা করলে তা বুঝতে পারি না। কেউ চোখে আঙুল দিয়ে সেটা ধরিয়ে দিলে মনে হয়, হ্যাঁ, তাই তো। না হলে চোখেই পড়ে না।
আজ থেকে ষাট ( ৬০) বছর আগের একটা ঘটনা আবছা মনে পড়ে গেল।
আমি তখন
আট বছরের। ১৯৫৯ সালের কথা।
অষ্টমীর দিন মা আর মাসির সঙ্গে কালিঘাটের কালী মন্দিরে গেছি পূজা দিতে ।
তখন কালিঘাটের চেহারা অন্য রকম ছিল। এত ভিড় ছিল না, রাস্তা- বাড়ি ঘর এমন ঝকঝকে ছিল না, ভাঙাচুরা ছিল। রাস্তার পাশে গাছ ছিল, ছায়া ছিল। সুন্দর মনোরম পরিবেশ ছিল।
মা মাসি তো পূজা দেবার পর, মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে, নিজেদের মনে গল্প করতে করতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও ওদের পিছন পিছন, হেলেদুলে চারপাশের গাছ-পালা, বাড়িঘর, লোকজন দেখতে দেখতে মহানন্দে এগিয়ে চলেছি।
ওরা কিছুটা এগিয়ে গেছে, আমি পিছিয়ে পড়েছি।
মা ডাকল, কিরে তাড়াতাড়ি আয়।
– এই তো আসছি।
মাসি বলল, থাক না, ও যেভাবে আসছে আসুক, তাড়া দিচ্ছিস কেন?
মা আর কিছু বলল না।
রাস্তার মোটে ভিড় নেই। হারাবার কোন ভয় নেই।
সোজা রাস্তা, প্রায় ফাঁকাই।
আমার আঙুলে জন্মদিনে, বাবার দেওয়া সোনার আংটিটা ছিল। রাস্তার পাশ থেকে এক দোকানদার আমাকে একগাল হেসে খুব চেনা মানুষের মতো এমন ইশারায় কাছে ডাকল। সেই ডাকে এমন মোহময় আকর্ষণ ছিল যে তার ডাক উপেক্ষা করতে পারলাম না। কাছে গেলাম তার।
– খোকা চকলেট খাবে?
লজেন্সের দাম পাঁচ পয়সা, চকলেটের দাম তখন দশ পয়সা করে।
লজেন্সের চেয়ে চকলেট খেতে ভাল। লজেন্স গোল, লম্বা আর চকলেট চৌকো, হাতের বাহুতে বাধার তাবিজের মতন দেখতে অনেকটা। কাগজ দিযে মোড়া থাকত, লজেন্স তখন কাগজে মোড়া থাকত না, আজকালের মতন। ক্যাডবেরি তখন বাজারে আসেনি, তার অনেক পরে এসেছে বাজারে।
তখন আমার লজেন্স, চকলেট খেতে খুব ভাল লাগত।
আমি মাথা কাৎ করে জানালাম, খাব।
– তবে তোমার আংটিটা খুলে দাও।
আমি নিঃশব্দে আঙুল থেকে আংটিটা খুলে তার হাতে দিয়ে, তার হাত থেকে চকলেট নিয়ে, কাগজের মোড়কটা খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, চকলেটটা মুখে পুরে দিয়ে চুষতে চুষতে একটু দৌঁড়ে মা আর মাসিকে ধরে ফেললাম। আর একটু এগোলেই, বড় রাস্তা, সেখান থেকে আমাদের বাস ধরতে হবে।
বড় রাস্তায় এসে, মা আমাকে কিছু চুষতে দেখে বলল, কিরে, কি চুষছিস?
– চকলেট।
– পেলি কোথায়?
– দোকানদার দিল।
– কোন দোকানদার?
মার কথা শেষ হতে না হতেই, মাসি জানতে চাইল।
– পয়সা কোথায় পেলি?
– পয়সা লাগেনি
– তবে দিল কেন তোকে? মা জানতে চাইল।
ততক্ষণে মাসির নজরে পড়েছে, আমার আঙুলে
আংটি নেই।
– আংটি কোথায় তোর? মাসি জানতে চাইল।
– ওই তো ও নিয়ে নিয়েছে।
– ও কে? দোকানদার ? মা জিজ্ঞেস করল।
আমি মাথা কাৎ করে সন্মতি জানলাম। তখনও চকলেট চুষছি।
মা বলল, আংটিটা দিয়ে চকলেট নিয়েছিস?
বলেই গালে মারলেন সপাটে একটি চড়। মুখ থেকে চকলেট ছিটকে পড়ল মাটিতে।
আমি ভ্যা করে কেঁদে ফেললাম।
মাসি বলল, চল তো কোন দোকানদার, দেখি।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ওদের সঙ্গে, বাস রাস্তা থেকে ফিরে এসে দেখলাম, এ’টুকু সময়ের মধ্যেই দোকানদার দোকান বন্ধ করে দিয়েছে।
আংটি আর ফিরে পাইনি।
মাসি পরদিন আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই দোকানদারকে ধরে ছিল। সে বেমালুম, অস্বীকার করছে। বলেছে, কাল আমি দোকানই খুলিনি।
কাকে, কি সব ফালতু কথা বলছেন?
তর্ক বাড়িয়ে কোন লাভ নেই বুঝতে পেরে, মাসি আমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।
বাবা রাতে শুধু একবার বলেছিল, জন্মদিনের আংটিটা খোয়ালি?
শুনে, মা বললেন, যা হাবা ছেলে হয়েছে তোমার, জীবনে আরও কতকিছু খোয়াবে দেখো।
মা ভুল কিছু বলেননি।
পরবর্তী জীবনে তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম।
” ছুটি ছুটি একান্তই ছুটি
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
চেতনা মেঘের মতো ভাসে
দিন যায় সন্ধ্যা নেমে আসে
জেগে থাকে করতল মুঠি
ছুটি ছুটি একান্তই ছুটি।
এবার বর্ষার জলধারে
সমতল ছেড়েও পাহাড়ে
যাইনি — যাবো না কোনোদিনও
হৃদয় আকণ্ঠ বৃষ্টিহীন।
তুমি থাকো, তুমি থাকো কাছে
বাঁচার দ্যোতনা তবে আছে
মৃত্যুতে যন্ত্রণা কত দামি
সে – বোধে আচ্ছন্ন তুমি – আমি।
চেতনা মেঘের মতো ভাসে
দিন যায়— সন্ধ্যা নেমে আসে
জেগে থাকে করতল মুঠি
ছুটি ছুটি একান্তই ছুটি !
কাব্যগ্রন্থ
‘ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো “
(আঠারো)
” অবুঝের সমীকরণ
আল মাহমুদ
কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর
দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাশী
ডাক্তার উকিল মোক্তার
পুলিস দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব
কাব্যের ব্যাপারে নীরব!
স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল
কবিতা বোঝে না কোনো সঙ
অভিনেত্রী নটী নারী নাটের মহল
কার মনে কাতোটুকু রঙ?
ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে
কবিতা বোঝে না!
কবিতা বোঝে না আর বাংলার বাঘ
কুকুর বিড়াল কালো ছাগ,
খরগোস গিরগিটি চতুর বানর
চক্রদার যত অজগর!
কবিতা বোঝে না এই বাঙলার বনের হরিণী
জঙ্গলের পশু-পাশবিনী।
শকুনী গৃধিনী কাক শালিক চড়ুই
ঘরে ঘরে ছুঁচো আর উই;
বাংলার আকাশের যতেক খেচর
কবিতা বোঝে না তারা। কবিতা বোঝে না অই
বঙ্গোপসাগরের কতেক হাঙর!”
সত্তর সাল, আমি তখন (সাউথ) সিটি কলেজে পড়ি। কাছেই কাকুলিয়া রোডে সাহিত্যিক সুশীল রায়ের ( কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক, প্রবন্ধকার) বাড়ি। ধ্রুপদী পত্রিকা বের করতেন। শততম সংখ্যা বেরিয়ে ছিল সেই সময় সেই পত্রিকার।
তখন তিনি আবার বিশ্বভারতী পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। নিজে প্রাচীন ধারার নিখুঁত ছন্দ মিলের কবিতা লিখলেও, সমকালীন কবিদের ছন্দমিল বিহীন আধুনিক কবিতার প্রতি অদ্ভুৎ আকর্ষণ দেখেছি তার। বাড়িতে মাঝে মাঝে কবি সভা বসত। সেখানে আসতেন সুনীল গাঙ্গুলী, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বিনোদ বেরা প্রমুখ। খুবই সদালোপি ও রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। চোখ দুটো তার সব সময় হাসত যেন।
আমি তখন একদিন শংকর সরকারের স্টলে দাঁড়িয়ে ধ্রুপদী পত্রিকা থেকে সুশীল রায়ের বাড়ির ঠিকানা মুখস্থ করে নিয়ে, খুঁজে খুঁজে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম বিকালের দিকে। তিনি সাদর আপ্যায়ণ করলেন আমার মত কিশোরকে। নানা কথা হল। চা বিস্কুট খাওয়ালেন। আমি আপ্লুত ও অভিভূত হলাম তার আচরণে। তাকে জানালাম আমরা একটা পত্রিকা বের করতে চাই। তিনি শুনে খুশি হলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি নাম দেওয়া যায় বলুন তো একটা।
তখন সন্ধ্যা হয়ে এসে ছিল। বাইরে থেকে একটা জোনাকি উড়ে এসে, ওনার পড়ার টেবিলে বসলো।
দেখে উনি বললেন, পত্রিকার নাম দাও – জোনাকি।
অই ‘জোনাকি’- নামেই আমাদের মিনি পত্রিকার জন্ম হল ১৯৭০ সালে। তিনি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়ই লেখা দিয়ে ছিলেন। সেই সংখ্যায় আরও লিখেছিলেন নারায়ণ গাঙ্গুলী, নীহার রঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ। আমি সুনীল গাঙ্গুলীর প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়ে ছিলাম ওই ‘জোনাকি’ পত্রিকাতেই।
সে সময় মিনি পত্রিকা প্রকাশের একটা হিড়িক পড়ে গেছিল। তাতে মিনি উপন্যাস লিখেছেন সমরেশ বসু, মিনি গল্প লিখেছেন মনোজ বসু, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দু মুখার্জী প্রমুখ( কে নয়) ।
মিনি নাটক, মিনি কবিতা, মিনি ছড়া, মিনি রম্যরচনা ( সব মিনি) । সে সময় আমাদের ‘জোনকি’ পত্রিকাও মিনি পত্রিকা রূপে প্রকাশিত হয়ে খুব সাড়া ফেলেছিল।
প্রথম মিনি পত্রিকা ‘পত্রাণু’ বেরিয়ে খুব নাম করেছিল সে সময়। অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হত। বহুদিন চলেছিল।
তাছাড়া বের হত মিনি পত্রিকা ‘বিন্দু’ তপন রায় আর অঞ্জলী মজুমদারের সম্পাদনায়। এ রকম আরও কিছু মিনি পত্রিকা বের হত সে সময়, এখন সে সবের নাম আর স্মরণে নেই।
সে এক উন্মাদনার সময়।
তার আগই সুশীল রায়ের ধ্রুপদী ঘন্টায় ঘন্টায় প্রকাশিত হয়ে কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছিল। তখন সময়টা ছিল যেন কবিতা নিয়ে মাতামাতির সময়।
আরও কবিতা পড়ুন- লেখা ফেস্টুন হাতে নিয়ে, রাসবিহারী রোডে মিছিল করেছেন সেই সময়কার তরুণ কবিরা ( আলোক সরকার,শংকর চাট্যার্জী প্রমুখ আরও অনেকে) ।
জয়ন্ত দত্ত বের করতেন জ্বালা পত্রিকা। তারুণ্যের জ্বালা তাতে ফুটে বেরত।
এ ছাড়া আলোক সরকারের শতভিষা আর পবিত্র মুখার্জীর কবিপত্র সে সময় আলোড়ণ সৃষ্টিকারী দুটি পত্রিকা, যার প্রতি সেই সময়কার তরুণ প্রজন্মের খুব আগ্রহ ছিল।
” এবার কবিতা লিখে
এবার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাবো
এবার কবিতা লিখে আমি চাই পন্টিয়াক গাড়ি
এবার কবিতা লিখে আমি ঠিক রাষ্ট্রপতি না হলেও
ত্রিপাদ ভূমির জন্য রাখব পা উঁচিয়ে –
মেশপালকের গানে এ পৃথিবী বহুদিন ঋণী!
কবিতা লিখেছি আমি চাই স্কচ, সাদা ঘড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক
মুর্গীর দু ঠ্যাং শুধু, আর মাংস নয় –
কবিতা লিখেছি তাই আমার সহস্র ক্রীতদাসী চাই –
অথবা একটি নারী অগোপন, যাকে আমি প্রকাশ্য রাস্তায় জানু ধরে
দয়া চাইতে পারি।
লেভেল-ক্রসিং এ আমি দাঁড়ালেই তোপধ্বনি শুনতে চাই
এবার কবিতা লিখে আমি আর দাবী ছাড়ব না
নেড়ি কুত্তা হয়ে আমি পায়ের ধুলোর থেকে গড়াগড়ি দিয়ে আসি
হাড় থেকে রক্ত নিংড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছি, ভিক্ষা চেয়ে মানুষের
চোখ থেকে মনুষ্যত্ব খুলে –
কপালের জ্বর, থুতু, শ্লেষ্মা থেকে উঠে এসে
মাতাল চন্ডাল হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফের ছাই থেকে উঠে এসে
আমার একলা ঘরে অসহায়তার মতো হা হা স্বর থেকে উঠে এসে
কবিতা লেখার সব প্রতিশোধ নিতে দাঁড়িয়েছি ।
[ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের –
‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’- কাব্যগ্রন্থ থেকে। ]
(উনিশ)
” আবার রোদ্দুর – ৪
জয় গোস্বামী
সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে তবে
বন্ধু হয়, আমি বন্ধু নই
রোজ যে নৌকোয় আসো তুমি
আমি সে নৌকোর পলকা ছই
দাঁড় বায় তোমার বন্ধুটি
বৈঠায় জাগায় ভাটিয়ালি
উঠে আসে সদ্যস্নাত রাগ
চুল ভর্তি রোদ, ভিজে বালি
আমি ছই, ছায়ামাত্র লোক
দেখো হাতে কালি মুখে কালি
অগোচরে তোমাদের কাছে
ঝারি নিয়ে যাই, লেখা ঢালি
সে-লেখায় দুটো-চারটে গাছ
সে-গাছে দু-চারটে ফুল, কাঁটা
কাঁটায় কাঁটায় ছাওয়া পথ
সে পথে একসঙ্গে সাত পা হাঁটা
অথচ বাস্তবে কোনদিনই
হাঁটিনি তোমার সঙ্গে, ঠিকই
সামনাসামনি কথাও বলিনি
লেখায় তোমার কথা লিখি
সে-ও কি সাত পা-ই হাঁটা নয়?
পায়ে পায়ে মরুভূমি পার?
বন্ধুকে জিগ্যেস করে দেখো
আমি বুঝি বন্ধু না তোমার?
(কাব্যগ্রন্থ : সংযোজন) “
সুশীল রায়ের ঘন্টায় ঘন্টায় (কবিতা ঘন্টকী) ধ্রুপদী পত্রিকা প্রকাশের পর, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত রুদ্রের সম্পাদনায় প্রতিদিন ‘দৈনিক কবিতা’ প্রকাশিত হতে শুরু করে। এতে খুব আলোড়ণ ওঠে সেই সময় তরুণ সাহিত্য অনুরাগীদের মনে।
১৯৭২ সাল থেকে শুরু হয় মনীন্দ্র গুপ্ত ও রঞ্জিত সিংহের সম্পাদনায় ‘এক বছরের শ্রেষ্ট কবিতা’। বেশ কয়েক বছর নিয়মিত বের হয়েছিল ( ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল ) ।
সেখানে সারাবছর ধরে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার যে সব কবিতা লেখা প্রকাশিত হতো, তার থেকে বাচাই ও নির্বাচন করে সংকলনটি প্রস্তুত করা হতো।
সারা বছরে প্রকাশিত বেশীর ভাগ ভাল ভাল কবিতা ওই বইটি পড়লেই পড়া হয়ে যেত বলা চলে।
যা সেই সময় আমাদের তরুণ কবিদের মনের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
মনীন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় সে সময় ‘পরমা’ নামে নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হত।
‘এক বছরের শ্রেষ্ট কবিতা’ বের হত সেই সময়কার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বাছাই কবিতা সংগ্রহ করে। প্রচুর শ্রমসাধ্য কাজ ছিল সেটা।
মনীন্দ্র গুপ্ত ও রঞ্জিৎ সিংহ পাঁচ বছর ধরে নিষ্ঠাভরে সে কাজ করেছিলেন।
এইসব কাজ কর্ম দেখে, আমরা তরুণরা উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরপুর হয়ে মসগুল থাকতাম।
সে সময় নকশাল ভাবধারার অনুকূলে, বেশ কয়েকটি পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হত।
সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ( সাহিত্যিক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট ভাই) সম্পাদনায় স্পন্দন, এছাড়া মেনিফেষ্টো, অনীক, লালতারা, ইস্পাতের চিঠি প্রভৃতি।
হাতে পেলে পড়ে দেখতাম।
সে সময় পড়েছি, নবারুণ ভট্টাচার্যের (মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে) ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’
কাব্যগ্রন্থটি। তাছাড়া মণিভূষণ ভট্টাচার্য্য, তুলসী মুখোপাধ্যায়, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এদের কবিতা পেলেই পড়ে ফেলতাম।
আর পড়তাম তুষার রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (বরেন্য চিত্র পরিচালক) , শামসের আনোয়ার, দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়, মানিক চক্রবর্তী, যোগব্রত চক্রবর্তী, পবিত্র মুখোপাধ্যায় , রাণা চট্টোপাধ্যায়,সজল বন্দোপাধ্যায়, রত্নেশ্বর হাজরা, ভাস্কর চক্রবর্তী, কালীকৃষ্ণ গুহ, মৃণাল বসু চৌধুরী, পরেশ মন্ডল প্রমুখদের সদ্য প্রকাশিত কবিত। এরা সকলেই ষাট দশকের কবি। এদের মধ্যে অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই।
পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় , সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, শান্তি লাহিড়ী, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার, অরবিন্দ গুহ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শরৎ মুখার্জী, কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখার্জী, সমীর রায় চৌধুরী, অরুণ কুমার সরকার( চল্রিশ দশকের কবি), আলোক সরকার, শান্তি ঘোষ, তারাপদ রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত,পূর্ণেন্দু পত্রী, বাসুদেব দেব,মানস রায়চৌধুরী, সামসুল হক, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, জীবতোষ দাস প্রমুখদের কবিতা হাতে পেলেই পড়ে ফেলতাম। কার লেখা পড়িনি সে সময়?
পড়েছি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, রবীন সুর, দেবী রায়, শম্ভু রক্ষিত, শিবশম্ভু পাল, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতী মিত্র, কেতকী কুশারী ডাইসন, শংকর চ্যাটার্জী, ফণিভূষণ আচার্য, লোকনাথ ভট্টাচার্য্য প্রমুখদের
কবিতা ছিল প্রায় নিত্য পাঠ্য বিষয়।
কত না পড়েছি তখন, আজ সে সব কথা ভাবলে নিজেই বিস্মিত হই। ভাবি কি করে পড়েছি বোধহয় এতসব।
এই প্রসঙ্গে তরুণ যশঃপ্রার্থী কবিদের একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না , ভাল কবিতা লিখতে হলে পূর্বসূরীদের ভাল ভাল কবিতা, নিজের আগ্রহে, সংগ্রহ করে বারবার পড়।
দেখবে তা’তে লেখার ক্ষমতা বাড়বে। তখন দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই তোমার নিজের মনের ভাব কবিতায় রূপান্তরিত হয়ে, সহজেই বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে।
আধুনিক ভাল কবিতা লিখতে গেলে শুধু মাত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন দত্ত, মোহতলাল, আর সুকান্ত পড়লেই হবে না।
পড়তে হবে, জীবনানন্দ দাশ ছাড়াও বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন,বিষ্ণু দে, অমিয়
চক্রবর্তী, অশোকবিজয় রাহা, অরুণ মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, হুমায়ুন কবির, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, মণীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখার্জী, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণ ভট্টাচার্য্য, কৃষ্ণ ধর,সিদ্ধেশ্বর সেন, তরুণ সান্যাল, যুগান্তর চক্রবর্তী, শংকরানন্দ মুখোপাধ্যায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, আনন্দ বাগচী প্রমুখদের কবিতা।
ভাল কবিতা লিখতে হলে, প্রতিদিন কবিতা পাঠের অভ্যাস বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।
আমার তো এখনও , কোনদিন একটাও ভাল কবিতা না পড়তে পারলে, মন খারাপ হয়ে যায়।
জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর
” যে-কোনো বিষয় নিয়েই হয়তো এই কবিতাটি লেখা যেতো
পিকনিক, মর্নিং স্কুলের মিসট্রেস
কিংবা স্বর্নচাঁপার কাহিনী; হয়তো পাখির প্রসঙ্গ
গত কয়েকদিন ধরে টেলিফোনে তোমার কথা না শুনতে
পেয়ে জমে থাকা মেঘ,
মন ভালো নেই তাই নিয়েও ভরে উঠতে পারতো এই পঙ্ক্তিগুলো
অর্কিড কিংবা উইপিঙ উইলোও হয়ে উঠতে পারতো
স্বচ্ছন্দে এই কবিতাটির বিষয়;
কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রমত দেশের একজন কবির
মনু মিয়ার হাঁড়ির খবর ভুললে চলে না,
আমি তাই চোয়াল ভাঙা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে
আন্তর্জাতিক শোষণের কথাই ভাবি,
পেটে খিদে এখন বুঝি কবিতার জন্য কি অপরিহার্য
জুঁইফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হিসেবে আমার কাছে তাই
শাদা ভাতই অধিক জীবন্ত- আর এই ধুলোমাটির মানুষ;
এই কবিতাটি তাই হেঁটে যায় অন্ধ গলির নোংরা বস্তিতে
হোটেলের নাচঘরের দিকে তার কোনো আকর্ষণ নেই,
তাকে দেখি ভূমিহীন কৃষকের কুঁড়েঘরে বসে আছে
একটি নগ্ন শিশুর ধুলোমাখা গালে অনবরত চুমো খাচ্ছে আমার কবিতা,
এই কবিতাটি কখনো একা-একাই চলে যায় অনাহারী কৃষকের সঙ্গে
জরুরী আলাপ করার জন্য,
তার সঙ্গে কী তার এমন কথা হয় জানি না
পর মুহূর্তেই দেখি সেই ক্ষুধার্ত কৃষক
শোষকের শস্যের গোলা লুট করতে জোট বেঁধে দাঁড়িয়েছে;
এই কবিতাটির যদি কোনো সাফল্য থাকে তা এখানেই।
তাই এই কবিতার অক্ষরগুলো লাল, সঙ্গত কারণেই লাল
আর কোনো রঙ তার হতেই পারে না-
অন্য কোনো বিষয়ও নয়
তাই আর কতোবার বলবো জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই
অধিক সুন্দর। ”
– কবি মহাদেব সাহা।
(কুড়ি)
কার্তিক-অঘ্রাণ ১৯৪৬
——————————————-
” পাহাড়, আকাশ, জল অনন্ত প্রান্তরঃ
সৃজনের কী ভীষণ উৎস থেকে জেগে
কেমন নীরব হয়ে রয়েছে আবেগ;
যেন বজ্রবাতাসের ঝড়
ছবির ভিতরে স্থির- ছবির ভিতরে আরো স্থির।
কোথাও উজ্জ্বল সূর্য আসে;
জ্যোতিষ্কেরা জ্ব’লে ওঠে সপ্রতিভ রাতে
আদি ধাতু অনাদির ধাতুর আঘাতে
নারীশিক্ষা হত যদি পুরুষের পাশেঃ
আকাশ প্রান্তর নীল পাহাড়ের মত
নক্ষত্র সূর্যের মত বিশ্ব-অন্তর্লীন
উজ্জ্বল শান্তির মত আমাদের রাত্রি আর দিন
হবে নাকি ব্রহ্মান্ডের লীন কারুকার্যে পরিণত।”
[ কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী – জীবনানন্দ দাশ ] “
সে সময় নাকতলায় (কলকাতা – ৭০০ ০৪৭) থাকতেন তারাপদ লাহিড়ী। স্বাধীনতা সংগ্রামের
পুরোধা সৈনিক, বহুবছর কারাগারে ছিলেন। ফরিদপুর জেলার কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।পরে RSP – তে যোগ দেন। কলকাতায় এসে হাইকোর্টে আইন ব্যবস্যা শুরু করেন। আজীবন রবীন্দ্রসদনের কার্যকর কমিটির সান্মানিক সদস্য, কলকাতা পুরসভার অল্ডারম্যান। সারা ভারতে উদ্বাস্তুদের জন্য সংশোধিত লীজ দলিলের রূপকার, খসড়া দলিলটি তারই রচিত। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান থাকা কালিন, কারাবিধি সংস্কারের যুগান্তকারী পরিবর্তন করেন।
তার রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলি জাতীর সম্পদ।
বইগুলি হল –
১. জমিদার দখল বিলের গলদ
২.উপনিষদ বিপ্লব
৩.মার্ক্সীয় অর্থনীতি
৪. মার্ক্সীয় দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের ভূমিকা
৫.ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নানা বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্র মোকর্দমার ইতিহাস
৬.ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি
৭.মেঘদুতম
৮. সাহিত্য দর্পণ
৯.চর্যাপদ
১০.ফুল্লরা কালকেতু
১১. মহা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু
১২ স্বদেশ প্রসঙ্গ
13.Freedom Struggle and Anushilan Samiti
14.Rashbehari Bose The indomittable Revolutionary
15.Crime and Punishment in Ancient India
একাধারে আইনজ্ঞ , ইতিহাসবিদ , সমাজবিজ্ঞানী, শিল্প সাহিত্য সচেতন , বেদ উপনিষদ বিশেষজ্ঞ। তার অগাধ পান্ডিত্বের ছিটে ফোটা পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি।
ঋদ্ধ হয়েছি তার মূল্যবান বইগুলি পড়ে।
তার সঙ্গে আমরা অনায়াসে মিশতাম দুধের সাথে জলের মতো। কত কথা শুনেছি তার মুখে
মার্কসীয় অর্থনীতি, সমাজ-নীতি, রাজনীতি, সাহিত্য – সংস্কৃতি প্রসঙ্গে। শুনে ঋদ্ধ হয়েছি।
নাকতলায় আরও থাকতেন বুদ্ধদেব বসু ( কল্লোল যুগের তিন প্রধানের – অচিন্ত প্রেমেন বুদ্ধ, অন্যতম), তিনিই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময় কম্পারেটিভ লিটারেচার বিভাগের প্রথম প্রবর্তন করেন, আজ যা মহীরূহ।
তার সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনায় আসব।
বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু , কিরণশংকর সেনগুপ্ত (রবীন্দ্র পুরুস্কার প্রাপ্ত কবি, তখন সাহিত্যচিন্তা পত্রিকার সম্পাদক) দীপক মজুমদার (কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক), দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়(আনন্দ মেলার সম্পাদক) , সুব্রত রাহা (বিচিত্রা – সম্পাদক), সুপ্রিয় বাগচী (Editor – Kavita), চূনীলাল রায়, দীপাঞ্জন দত্ত ( আবর্ত – সম্পাদক) , সুবিমল লাহিড়ী (বিশ্বভারতীর প্রুফ রীডার) , অরুনাভ লাহিড়ী, প্রবীর রায় ( মৃত, শিলিগুড়ির বাসিন্দা) , কিছুদিন সে’সময় সজল বন্দ্যোপাধ্যায় নাকতলায় ছিলেন (মৃত, গল্ফগ্রীনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে) ।
আমাদের প্রায়ই আড্ডা হত চায়ের দোকানে বা সজলদার বাড়ি। কবিতা নিয়ে আলোচনা হত। থাকত প্রবীর রায়, সুভাষ দেবনাথ, কখনও বিমল দেব, দীপঞ্জন দত্ত, দীপক রায়, প্রীতম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
সজলদার কাছে প্রথম ‘শ্রুতি’ আন্দোলের বিষয়ে অবগত হই । পরে অনেক কিছু বিস্তারিত ভাবে জানতে পারি তার কাছে সেই আন্দোলন সম্পর্কে।
আর ওনার ছিল সেই বিখ্যাত চুরুট, যা ছাড়া সজলদাকে বেমানান লাগত , ওনার কাছে গেলেই আমার একটা প্রাপ্য ছিল।
সজলদাকে যেমন চুরুট ছাড়া মানাত না। পুষ্কর দাশগুপ্তের তেমন পান ( শ্রুতি আন্দোলনের দুই পুরোধ) সজলদা আজ আর ইহলোকে নেই, পুস্করদা এখন ফ্রান্সে থাকেন।
সে’দিন মেসেঞ্জারে জানতে চেয়েছিলাম, পুস্করদা, এখনও পান খান।
পুস্করদা আক্ষেপের সুরে বলেছেন, পান কোথায় পাব? এখানে পাওয়া যায় না।
গড়িয়ায় (কলকাতা – ৭০০ ০৮৪) রমেশ পুরাকায়স্ত, সুকমল রায় চৌধুরী (হারিকিরি করে মারা যান, ‘ভুল সুকমল’ – নামে একমাত্র কাব্যগ্রন্থ সে সময় বের হয়), হরিজীবন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিত গুপ্ত ( শকুন্তলা – সম্পাদক) , বিমল দেব ( মহাকাব্য – সম্পাদক) থাকে।
আর রামগড়, গাঙ্গুলী বাগানে ( কলকাতা – ৭০০ ০৪৭) থাকতেন আশাপূর্ণা দেবী ( জ্ঞানপীঠ পুরুস্কার প্রাপ্তির পর ওনাকে অভিনন্দন জানতে বাড়িতে গিয়ে, মিষ্টিমুখ সেরে ওনার আশীর্বাদী হাতের স্পর্শ মাথায় নিয়ে, আনন্দে গর্বে বুক ফুলিয়ে ফিরে এসেছিলাম।), গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ( জনপ্রিয় গীতিকার), মনোজিৎ লাহিড়ী ( নাট্যকার, অভিনেতা, অনুবাদক) , কেদার ভাদুড়ী, নির্মল চট্টোপাধ্যায় (গল্পকার), চন্দন সেন ( কবি), দেবানন্দ দে (বেদব্যাস- সম্পাদক) প্রমুখ।
আর বিদ্যাসাগরে (কলকাতা – ৭০০ ০৪৭) ছিলাম আমি শৌভিক চক্রবর্তী ( প্রতিশব্দ – সম্পাদক)।
হাঁটা পথেই তখন সকলের সঙ্গে সকলের দেখা সাক্ষাৎ হত।
অদ্ভুত একটা আন্তরিক আবহ ছিল সে সময়, এই আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে। আমরা তখন সকলে মিলে মিশে যেন, একটা বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের মতন ছিলাম। সে সময়টা ছিল আমার কাছে সাহিত্যের শিক্ষা পর্ব।
” পারিব না
কালীপ্রসন্ন ঘোষ
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার,
পাঁচ জনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার৷
পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার,
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি না ক তাদের আকার
তবে কেন পারিব না বল বার বার?
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তবে নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার৷”