লিলি ভালো ঘুমুতে পারে নি
লিলি ভালো ঘুমুতে পারে নি। তিন চার বার ঘুম ভেঙেছে। বিশ্রী বিশ্রী সব স্বপ্ন দেখেছে। একটা স্বপ্ন ছিল ভয়াবহ। তার যেন বিয়ে হচ্ছে। সেজেগুজে বিয়ের আসরে সে বসে আছে, হঠাৎ শুটকো ধরনের একটা ছেলে দৌড়ে ঢুকল। তার হাতে কয়েকটা জর্দার কৌটা। সে বলল, খবরদার কেউ নড়বে না। বোম মেরে উড়িয়ে দেব। চারদিকে কান্নাকাটি, হইচই। এর মধ্যে বোমাফাটা শুরু হয়েছে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে দরজার কাছে হুমড়ি খেয়ে লিলি পড়ে গেছে। স্বাতী এসে তাকে তুলল। স্বাতী বলল, চল পালাই। লেট আস রান। রান বেবি রান।
তারা দুজনই দৌড়াচ্ছে। স্বাতীর গাভর্তি ঝলমলে গয়না। গয়না থেকে ঝমঝম শব্দ আসছে। লিলি ভাবছে, বিয়ে হচ্ছে তার আর স্বাতীর গায়ে এত গয়না কেন?
রাতের ভয়ঙ্কর স্বপ্ন সাধারণত দিনে হাস্যকর লাগে। এই স্বপ্নটা লাগছে না। ভোরবেলা দাঁত মাজতে মাজতে লিলির মনে হলো–স্বপ্নটার কোনো খারাপ অর্থ নেই তো? মার কাছে খোয়াবনামার একটা বই আছে। বই থেকে স্বপ্নের কোনো অর্থ পাওয়া যাবে?
লিলি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দাঁত মাজল। আয়নায় নিজেকে দেখতে-দেখতে পতি ব্রাশ করার আলাদা আনন্দ। তবে আজ আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগছে না। ঘুম না হওয়ায় চোখ লাল হয়ে আছে। চেহারাটাও কেমন শুকনা শুকনা লাগছে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে লিলি ইতস্তত করতে লাগল। সে কি একতলায় যাবে? শতা দেয়া হয়েছে কি-না দেখবে? না নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বই নিয়ে শশবে? আজ বই নিয়ে বসেও লাভ হবে না। মাথায় পড়া ঢুকবে না। তারচেয়ে নিচে যাওয়াই ভালো। নিচে যাওয়ামাত্র এই বাড়ির প্রবল স্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। মিশতে ইচ্ছা করে না। পৃথিবীতে বাস করতে হলে ইচ্ছে না থাকলেও অনেক কিছু করতে হয়।
লিলি তার বড় চাচার ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল।
বড় চাচা আজহার উদ্দিন খাঁ সাহেবের দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। অর্থাৎ, তিনি জেগে আছেন। তিনি জেগে থাকলে বিরাট সমস্যা, তাঁর বন্ধ দরজার সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি প্রায় অলৌকিক উপায়ে টের পেয়ে যাবেন এবং শ্লেষ্ম জড়ানো ভারী গলায় ডাকবেন, কে যায়? লিলি না? মা, একটু শুনে যা তো!
এই ডাকার পেছনে কোনো কারণ নেই। অকারণে ডাকা।
পর্দাটা টেনে দে তো।
কটা বাজছে দেখ তো।
তার ঘরের দেয়ালেই ঘড়ি, তিনি মাথা হেলিয়ে ঘড়ি দেখতে পারেন। হাত বাড়ালেই পর্দা। পর্দা টানার জন্য বাইরের কাউকে ডাকতে হয় না। এমন না যে, তার ঘাড়ে ব্যথা মাথা ঘুরাতে পারেন না, কিংবা হাতে প্যারালাইসিস হয়েছে, হাত বাড়িয়ে পর্দা ছুঁতে পারেন না।
আজও লিলি বড় চাচার ঘরের সামনে দিয়ে পা টিপে টিপে যাচ্ছিল বড় চাচা ডাকলেন, শুনে যা।
লিলি মুখ কালো করে ঘরে ঢুকল।
একতলায় হইচই হচ্ছে কেন?
লিলি কী করে বলবে কেন? বড় চাচা যেমন দোতলায়, লিলিও তেমনি দোতলায়।
ভোরবেলাতেই হইচই চেঁচামেচি। দেখে আয় তো ব্যাপারটা কী?
লিলি ব্যাপার দেখার জন্য নিচে নেমে এসে হাঁপ ছাড়ল। বড় চাচার বেলায় একটা সুবিধা হচ্ছে তাঁর স্মৃতিশক্তি নেই বললেই হয়। একতলার হইচইয়ের কারণ লিলিকে আবার ফিরে গিয়ে জানাতে হবে না। তিনি এর মধ্যে ভুলে যাবেন। এমন ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির একটা মানুষ এত বড় সরকারি চাকরি দীর্ঘদিন কী করে করলেন সে এক রহস্য। কে জানে সরকারি চাকরিতে হয়তো-বা স্মৃতিশক্তির কোনো ভূমিকা নেই। এই জিনিস যার যত কম থাকবে সে তত নাম করবে।
একতলায় হইচইয়ের কারণ জানার লিলির কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু হইচইটা এমন পর্যায়ের যে আগ্রহ না থাকলেও জানতে হলো। তাদের দুধওয়ালার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। গতকাল সে তিন লিটার দুধ দিয়েছিল। সেই দুধ জ্বাল দেবার পর সেখানে একটা মরা তেলাপোকা পাওয়া গেছে। লিলিদের বুয়া সেই তেলাপোকা প্রমাণস্বরূপ খানিকটা দুধসহ একটা গ্লাসে রেখে দিয়েছে। প্রমাণসহ মামলা। দুধওয়ালা প্রমাণ গ্রাহ্য করছে না। অতি মিষ্টি ভাষায় সে বলছে–তেইল্যাচুরা জম্মেও দুধ খায় না।
লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান ফরিয়াদি পক্ষের উকিলের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, তেলাপোকা দুধ খায় না?
জে না স্যার?
সে কী খায়?
তেল খায়। এইজন্য এর নাম তেইল্যাচুরা।
দুধ খাক বা না খাক তোমার আনা দুধের মধ্যে তাকে পাওয়া গেছে। …
লিলির গা ঘিনঘিন করছে। তেলাপোকা তার কাছে জগতের কুৎসিত প্রাণীদের একটি। তার মন বলছে গতকাল বিকেলে এই তেলাপোকা ভেজানো দুধই তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। পুরো এক গ্লাস। তাদের বাড়ি এমন না যে সামান্য তেলাপোকার কারণে পুরো তিন লিটার দুধ ফেলে দেয়া হবে। লিলি রান্নাঘরে তার মাকে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মা কাল বিকেলে তুমি যে আমাকে দুধ খেতে দিলে সেটা কি তেলাপোকা মাখা দুধ?
ফরিদা পেঁপের হালুয়া বানাচ্ছেন। তিনি চোখ না তুলেই বললেন, আরে না। কী যে তুই বলিস!
কাল যে দুধ খেলাম সেটা কোন দুধ?”
তার আগের দিনের দুধ। ফ্রিজে তোলা ছিল। তোকে গরম করে দিয়েছি।
তেলাপোকার দুধ কী করেছ?
ফরিদা বিরক্ত মুখে বললেন, তোকে খেতে দেইনি বললাম তো। কেন অকারণে ঘ্যানঘ্যান করছিস?”
লিলির বমি বমি লাগছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কী অবলীলায় মা মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। মিথ্যা বলার সময় তাঁর মুখের চামড়া পর্যন্ত কুঁচকাচ্ছে না!
ফরিদা বললেন, লিলি যা তো, তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয় চা খাবে না কি। কাল রাতে বেচারা যা কষ্ট করেছে। পেটে গ্যাস হয়েছে। গ্যাস বুকে চাপ দিচ্ছে। এই বয়সে গ্যাস ভালো কথা না। গ্যাস থেকে হার্টের ট্রাবল হয়।
লিলি বলল, তেলাপোকার দুধ কী করেছ?
ফরিদা চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখে বিরক্তি নেই, আনন্দও নেই। পাথরের মতো চোখ-মুখ। দীর্ঘদিন সংসারে থাকলে মায়েরা রোবট জাতীয় হয়ে যান। কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করে না। ফরিদা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যন্ত্রণা করিস না তো লিলি।
যন্ত্রণা করছি না মা। দুধটা তুমি কী করেছ বলো? ফেলে দিয়েছ?
না।
তাহলে কী করেছ?”
বুয়ারা খেয়ে ফেলেছে।
তিন লিটার দুধ দুজনে মিলে খেয়ে ফেলেছে?
ফরিদা এবার চোখ-মুখ করুণ করে বললেন, তোর বাবা চা খাবে কি-না। জিজ্ঞেস করে আয়। লক্ষ্মী মা।
লিলি বাবার ঘরের দিকে রওনা হলো। তিনিও দোতলায় থাকেন। তবে তাঁর ঘর বড় চাচার ঘরের উল্টো দিকে। আবারও বড় চাচার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, তবে সিঁড়ি দিয়ে খুব সাবধানে উঠতে হবে। বড় চাচা পায়ের শব্দও চেনেন। পায়ের শব্দ শুনেই ডেকে বসতে পারেন, যাচ্ছে কে লিলি না? একটু শুনে যা মা।
লিলির বাবা নেয়ামত সাহেব জেগে আছেন। খালি গা, লুঙ্গি হাঁটুর উপর উঠে এসেছে। মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখের নিচে কালি। দুচোখের নিচে না, এক চোখের নিচে। মানুষের দুচোখের নিচে কালি পড়ে। তাঁর কালি পড়ে শুধু ডান চোখের নিচে। তাঁর বোধহয় একটা চোখ বেশি ক্লান্ত হয়। কেমন অসুস্থ অসুস্থ চেহারা।
চা খাবে বাবা?
নেয়ামত সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, হাত-মুখ কিছু ধুই নি, চা খাব কি? সব সময় ইডিয়টের মতো কথা।
মা জানতে চাচ্ছিল চা খাবে কি-না।
খবরের কাগজ দিয়ে যা।
কাগজ এখনও আসে নি।
নটা বাজে এখনও কাগজ আসে নি? হারামজাদা হকারকে ধরে মার লাগানো দরকার। শুয়োরের বাচ্চা…
লিলি বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। কী বিশ্রী পরিবেশ চারদিকে! কোনো আনন্দ নেই। একটা হট্টগোলের বাড়ি। যে বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ধরে যায়। যে বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ বাস করে কিন্তু কারও সঙ্গেই কারও যোগ নেই। যে বাড়ির মানুষগুলো সুন্দর করে, ভদ্র করে কথা বলা কী জানে না।
একতলায় ভেতরের বারান্দায় রুমু ঝুমুর স্যার তার ছাত্রীদের নিয়ে বসেছেন। দুজনেই ক্লাস এইটে পড়ে। এবার নাইনে পড়ার কথা ছিল। একসঙ্গে ফেল করায় এইটে। প্রাইভেট মাস্টারের ব্যবস্থা করে রুমু ঝুমুর প্রতি দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। এই প্রাইভেট মাস্টার না-কি দারুণ ভালো। গেরেন্টি দিয়ে পড়ায়। একটা বেতের চেয়ারকে সে যদি তিন মাস একনাগাড়ে পড়ায় তাহলে বেতের চেয়ারও ফিফটি পার্সেন্ট নম্বর পেয়ে পাস করে যাবে। অঙ্কে পাবে সেভেন্টি পার্সেন্ট।
এই মাস্টারের তেমন কোনো বিশেষত্ব লিলির চোখে পড়ে নি। সে দেখেছে। মাস্টার সাহেব কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না। তিনি যতক্ষণ পড়ান ততক্ষণই মাথা নিচু করে থাকেন। এবং ততক্ষণই অতি কুৎসিত ভঙ্গিতে নাকের ভেতর থেকে লোম ছেঁড়ার চেষ্টা করেন। রুমু ঝুমু এই কুৎসিত দৃশ্য কিভাবে সহ্য করে লিলি জানে না। রুমু ঝুমুর জায়গায় সে হলে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে যেত। মাস্টার সাহেবকে খুন-টুন করে ফেলত।
রুমু ঝুমু দুজনই বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে। ঝুমু লিলির ছোট বোন, রুমু বড় চাচার একমাত্র মেয়ে। এরা দুজন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকে। কেউ কাউকে চোখের আড়াল করে না। তবে তারা যে গল্পগুজব করে তা না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। নিঃশব্দ চলাফেরা। মাঝে মাঝে তারা কোনো একটা বিশেষ ধরনের অন্যায় করে, তখন ফরিদা দুজনকে ঘরে নিয়ে আটকান। দরজা-জানালা বন্ধ করে বেদম মারেন। মারতে মারতে নিজেই ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বের হয়ে আসেন। এরা টু শব্দ করে না। নিঃশব্দে মার খায়। লিলি যদি জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে মা?
তিনি ক্লান্ত গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, কিছু হয় নি।
ওদের মারলে কেন?
সারাক্ষণ মুখ ভোঁতা করে থাকে। মুখে কথা নেই, মারব না তো কি!
মায়ের কথা লিলির কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ মুখ ভোতা করে রাখা, কারও সঙ্গে কথা না বলা এমন কোনো অপরাধ না যার জন্য দরজা-জানালা বন্ধ করে মারতে হয়। রুমু ঝুমুকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু জানা যাবে না। এরা মরে গেলেও মুখ খুলবে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফেলবে। ফিক ফিক করে হাসবে।
লিলি প্রায়ই ভাবে তাদের যদি আলাদা একটা বাড়ি থাকত। ছোট্ট একতলা একটা বাড়ি। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনে অনেকখানি জায়গায় নানা ধরনের ফুল গাছ–আম-জাম-কাঁঠাল। একটা গাছে দোলনা ঝুলানো। বাড়িটা একতলা হলেও ছাদে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ছাদে অসংখ্য টবে ফুল গাছ। সেই বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই। শুধু তারাই থাকে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর। তারা খেতে বসে একসঙ্গে এবং খাবার টেবিলে নানান গল্পগুজব করে। বাবা বলেন তাদের অফিসে মজার কি ঘটল সেই গল্প। লিলি বলে তার ইউনিভার্সিটির গল্প। ইউনিভার্সিটির কত অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা আছে। সেই ঘটনা শোনার মানুষ নেই। ঐ বাড়িটার পরিবেশ এমন হবে যে সবাই সবার গল্প শুনবে। কারও মজার কোনো কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হো হো করে হাসবে।
কোনো কোনো দিন ঝুম বৃষ্টির সময় একসঙ্গে সবাই ছাদে গিয়ে ভিজবে। বছরে একবার তারা বেড়াতে বের হবে। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কুয়াকাটা, সিলেটের চা বাগান। বাড়ির সুন্দর একটা নাম থাকবে–আয়না ঘর বা এই জাতীয় কিছু…
তাদের এখনকার এই বাড়িতে কোনো দিন এ-রকম কিছু হবে না। এই বাড়ির মা নির্বিকার ভঙ্গিতে তেলাপোকা চোবানো দুধ খাইয়ে দেবেন। বাবা হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে চেঁচামেচি করবেন খবরের কাগজের জন্য। রুমু ঝুমুর মাস্টার নাকের লোম ছিড়তে ছিড়তে পা দোলাবে। বড় চাচা সামান্য পায়ের শব্দেই কান খাড়া করে ডাকবেন–কে যায়? লিলি? জানালার একটা পাল্লা খুলে দিয়ে যা তো।
তাদের বর্তমান বাড়ি লিলির দাদাজান ইরফানুদ্দিন খাঁর বানানো। বাড়ি যেমন কুৎসিত, বাড়ির নামও কুৎসিত। রহিমা কুটির রহিমা তাঁর প্রথম স্ত্রীর নাম।
লিলির ধারণা তার দাদাজান সবার একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে বেহেশত কিংবা দোজখ কোনো এক জায়গায় চলে গেছেন। দোজখ হবার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি ছিলেন ইনকামট্যাক্স অফিসের হেড ক্লার্ক। এই চাকরি থেকে করেন নি হেন জিনিস নেই।
কয়েকটা বাড়ি বানালেন। ট্রাক কিনলেন, বাস কিনলেন। পঞ্চাশ বছর বয়সে আবার বিয়ে করলেন। চৌদ্দ বছর বয়সের এক খুকি।
তাঁর একটা হিন্দু কাজের মেয়ে ছিল। রেবতী। একদিন দেখা গেল তার নামেও কলতাবাজারের বাড়িটা লিখে দিলেন। সেই খুকির নামে বাড়ি লিখে দিলেন। দরাজ গলায় বললেন, এর আত্মীয়স্বজন সব ইন্ডিয়া চলে পেছে–এ যাবে কোথায়? খাবে কী? জীবনে সৎ কাজ তো কিছু করি নাই। একটা করলাম আর কি! ক্ষুদ্র একটি সৎ কর্ম। হা হা হা।
এসব ঘটনা লিলি দেখে নি, শুনেছে। দাদাজান যখন মারা যান তখন লিলি ক্লাস সিক্সে পড়ে। পরদিন ভূগোল পরীক্ষা, দরজা বন্ধ করে পড়ছে। বাবা এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। তখন দাদাজানের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে নিশ্বাস স্বাভাবিক হয় তখন কথা বলেন। সব কথাবার্তাই কিভাবে আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকা যায় সেই বিষয়ে…
খাঁটি মৃগনাভি পাওয়া যায় কি-না দেখ। মৃগনাভি মধুর সঙ্গে বেটে খাওয়ালে জীবনী শক্তি বাড়ে।
মৃগনাভির সন্ধানে হেকিমী ওষুধের দোকানে লোক গেল। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, রাতটা কোনো রকমে পার করে দিতে পারলে আর চিন্তা নাই। আজরাইল কখনও দিনে জান কবজ করে না। আজরাইল জান কবজ করে রাতে।
তিনি রাতটা টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। আশা ছেড়ে দিলেন। ততক্ষণে মৃগনাভি পাওয়া গেছে। মরা মানুষের শুকনা চামড়ার মতো এক টুকরা চামড়া যার মধ্যে লোম লেগে আছে। মৃগনাভি থেকে কড়া অডিকোলনের মতো গন্ধ আসছে। তিনি বললেন, মৃগনাভি রেখে দে, লাগবে না। কোরান মজিদ নিয়ে আয়।
কোরান শরিফ আনা হলো। তিনি তার ছেলেদের বললেন কোরান মজিদে হাত রেখে তোমরা প্রতিজ্ঞা করো ভাইয়ে ভাইয়ে মিল মহব্বত রাখবে। তিন ভাই এক বাড়িতে থাকবে এবং আমার মৃত্যুর কারণে বেকুবের মতো চিৎকার করে কাঁদবে না। তিন ভাই মিলে তখনই কান্নাকাটি শুরু করল। হইচই এবং ঝামেলায় এক ফাঁকে আজরাইল টুক করে জান কবজ করে ফেলল।
লিলি তার বাপ-চাচার মতো পিতৃভক্ত মানুষ এখনও দেখে নি। কী অসীম শ্রদ্ধা ভক্তি। বিরাট এক অয়েল পেইন্টিং বসার ঘরে লাগানো। সবার ঘরের যাবতীয় আসবাবে ধুলা জমে আছে কিন্তু পেইন্টিংয়ে ধুলা নেই। সব সময় ঝকঝক করছে। পেইন্টিং দেখলে যে-কেউ বলবে–পুরনো দিনের কোনো ছোটখাটো শুকনো মহারাজ। যার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা বলে মুখ আপাতত বিকৃত।
নেয়ামত সাহেব তার ছেলেমেয়ের জন্ম তারিখ জানেন না। নিজের বিয়ের তারিখ জানেন না। অথচ তার বাবা মুনশি ইরফানুদ্দিন খাঁ সাহেবের মৃত্যু তারিখ ঠিকই জানেন। ঐ দিন বাড়িতে বাদ আছর মিলাদ হয়। রাতে গরিব-মিসকিন খাওয়ানো হয়। এতিমখানায় খাসি দেয়া হয়। নেয়ামত সাহেব পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে অনেক রাত পর্যন্ত কোরান পাঠ করেন। রাতে খেতে বসে ঘনঘন বলেন গ্রেটম্যান ছিলেন, কর্মযোগী পুরুষ। এ-রকম মানুষ হয় না। কী দরাজ দিল! কী বুদ্ধি! ওহ ওহ…। বাবার সদ্গুণের কিছুই পেলাম না। বড়ই আফসোস।
পিতৃভক্ত ছেলেদের মুখে মায়ের নাম তেমন শোনা যায় না। মার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না। কেন হয় না লিলি জানে না। লিলি এ মহিলাকে খুব ছোটবেলায় দেখেছে সেই স্মৃতি তার মনে পড়ে না। দুনম্বর দাদিজানি বেঁচে আছেন। তাঁর কোনো ছেলেপুলে হয় নি। তিনি তার ভাইদের সঙ্গে আলাদা থাকেন। যদিও কাগজপত্রে লিলিরা যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িটা তাঁর।
এই মহিলার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হলেো চেহারায় খুকি খুকি ভাব আছে। স্বামীর মৃত্যু দিবস উপলক্ষে তিনি লিলিদের বাড়িতে আসেন। তাঁকেও ভালোই খাতির-যত্ন করা হয়। লিলির কাছে খুব আশ্চর্য লাগে, এই মহিলাও দারুণ স্বামীভক্ত। লিলিকে ফিসফিস করে বলেন, অসাধারণ একটা মানুষ ছিলরে লিলি। অসাধারণ।
কোনদিক দিয়ে অসাধারণ?
সব দিক দিয়ে।
কাজের মেয়েকে বাড়ি লিখে দিলেন তারপরও অসাধারণ?
লিখে দিয়েছে বলেই তো অসাধারণ। কাজের মেয়ের সঙ্গে কতজন কতকিছু করে। কে আর বাড়িঘর লিখে দেয়।
আপনার এইসব ভেবে অস্বস্তি লাগে না?
মেয়েদের এত অস্বস্তি লাগলে চলে না। পুরুষ মানুষ এ-রকম হয়ই। আদরে আদরে ছোঁক ছোঁক স্বভাব হয়। দোষটা স্বভাবের মানুষের না।
কী যে আপনি বলেন দাদিজান! মানুষ আর তার স্বভাব বুঝি আলাদা?
অবশ্যি আলাদা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এইসব বুঝবি না। এইসব তো আর ইউনিভার্সিটিতে শেখায় না। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবি। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তুই তোর দাদাজানের বুদ্ধি খানিকটা পেয়েছিস, তুই বুঝতে পারবি। তোর বাপ-চাচার কেউ তার বুদ্ধি পায় নি। সব কটা ছাগল মার্কা হয়েছে। বুদ্ধি-শুদ্ধি, চলাফেরা, কাজকর্ম সবই ছাগলের মতো। সবচেয়ে বড় ছাগল হচ্ছে তোর বড় চাচা। জ্ঞানী ছাগল। ওর পাশ দিয়ে গেলে ছাগলের বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়।
বড় চাচা সম্পর্কে দাদিজানের এই কথাগুলো লিলির সত্যি মনে হয়। বড় চাচার কারণে লিলিরা দ্রুত পথে বসতে বসেছে। এই সত্য স্বীকার করা ছাড়া এখন আর পথ নেই। বিষয়-সম্পত্তি সব দেখার দায়িত্ব তার। তাকেই পাওয়ার অব এ্যাটর্নি করে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি একে-একে সব বিক্রি করছেন। অন্য দুই ভাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সংসার ঠিকমতো চলছে, খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কাজেই অসুবিধা কী? অসুবিধা হোক, তারপর দেখা যাবে। তা ছাড়া মুনশি ইরফানুদ্দিন খাঁ মৃত্যুর সময় বলে গেছেন ভাইয়ে ভাইয়ে মিল-মহব্বত রাখবা। পিতৃ আজ্ঞার অন্যথা হয় নি। ভাইয়ে ভাইয়ে মিল মহব্বত আছে। ভালোই আছে।
এই বাড়ি হলো অসুবিধাহীন বাড়ি। এ বাড়িতে কারও অসুবিধা হয় না। সবাই ভালো থাকে। সুখে থাকে। কারও অসুখ হলে ডাক্তার চলে আসে। বাসায় এসে রোগী দেখে যায়। ডাক্তার হলো বড় চাচার বন্ধু সামছুদ্দিন তালুকদার হোমিওপ্যাথ। এক সপ্তাহ তার চিকিৎসা চলে। এক সপ্তাহে কিছু না হলে অন্য ডাক্তার রমজান আলী, এলোপ্যাথ।
লিলির বড় চাচার নিয়মে হোমিওপ্যাথির জন্য এক সপ্তাহ দিতে হবে। এক সপ্তাহে রোগ যত প্রবলই হোক অন্য চিকিৎসা হবে না। সাত দিন সময় না দিলে বুঝা যাবে কেন ওষুধ কাজ করছে না। এলোপ্যাথি হলো বিষ-চিকিৎসা। যত কম করানো যায়।
তবে আজাহার উদ্দিন খাঁ অবিবেচক নন। পরিবারের সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা তিনি দেখেন। লিলির দিকে তাকিয়ে তিনি গাড়ি কিনলেন। সেই গাড়ি কেনার ইতিহাস হচ্ছে–লিলি একবার রিকশা করে আসার সময় রিকশা উল্টে পড়ে গেল। হাত কেটে রক্তারক্তি। হাসপাতাল থেকে সেলাই করিয়ে আনার পর আজহার উদ্দিন খ বললেন, রিকশা নিরাপদ না। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের যাতায়াতের জন্য গাড়ি দরকার। টু ডোর কার, যাতে পেছনের দরজা হঠাৎ খুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে।
আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো, একটা টু ডোর কার এবং একজন বুড়ো ড্রাইভার। স্ত্রী যেমন যত বুড়ি হয় তত ভালো হয়, ড্রাইভারও তেমন। যত বুড়ো ততই অভিজ্ঞ।
এক সপ্তাহের মধ্যে লিলিদের গাড়ি চলে এলো। ফোক্সওয়াগন। রাস্তার সঙ্গে মিশে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলে। গাড়িতে ঢুকতেও হয় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। গাড়ির ড্রাইভারও দর্শনীয়, জহির-বুড়ো। এক চোখে ছানি পড়া, অন্য চোখেও ঝাপসা দেখে। সামনে কিছু পড়লে হর্ন দেয় না। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অতি ভদ্র এবং অতিশালীন ভাষায় গালি দেয়–ঐ রিকশা। গাড়ি আসতেছে শব্দ শুনো না? নড়ো না কেন? গজব পরবো। বুঝলা, গজব!
লিলি যদি বলে, আপনি হর্ন দেন না কেন ড্রাইভার চাচা? হর্ন দিতে অসুবিধা আছে?
ড্রাইভার উদাস গলায় বলে, অসুবিধা আছে গো মা। ব্যাটারির যে অবস্থা হর্ন দিলে ব্যাটারি বসে যাবে। গাড়ি চলবে না। ব্যাটারির কারেন্টের বারো আনাই চলে যায় হর্নে। মানবজাতির দিকে তাকিয়ে দেখো মা, যে যত কথা বলে তত আগে তার মৃত্যু। কথা বলে বলে কারেন্ট শেষ করে ফেলে।
দার্শনিক ধরনের উক্তি। লিলির বলতে ইচ্ছে করে আপনি যে হারে কথা বলেন তাতে আপনার কারেন্ট ছেলেবেলাতেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। শেষ তো হয় নি। যত বুড়ো হচ্ছেন কারেন্ট তত বাড়ছে।
কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলেও লিলি শেষ পর্যন্ত কিছুই বলে না। তার কাউকে কিছু বলতে ভালো লাগে না। তাদের এই বিচিত্র সংসারে বড় হয়ে আজ তার এই সমস্যা হয়েছে। সব সময় মনে হয় হোক যা ইচ্ছা, ড্রাইভার সারাক্ষণ কথা বলে বলুক। কারেন্ট খরচ করুক।
লিলি কিছুক্ষণ দোতলার টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেল। আজ কী বার মনে করতে পারল না। আজ কি তার ইউনিভার্সিটি আছে? সে কি কোনো বিশেষ কারণে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে? হঠাৎ মনে হলো মাস্টার সাহেব রুমু ঝুমুকে সকালে পড়াতে এসেছেন, কাজেই আজ শুক্রবার। একমাত্র শুক্রবারই তিনি সকালে আসেন। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাস নেই। লাইব্রেরিতে গিয়ে নোট করার কথাও নেই। আজ কোথাও যাওয়া যাবে না।
লিলি আবার একতলায় নেমে এলো। কোথাও তার যেতে ইচ্ছে করছে। কোথায় যাওয়া যায়?
টেবিলে নাশতা সাজানো হচ্ছে। গাদাখানিক রুটি ভাজি। বড় এক বাটি পেঁপের হালুয়া। দিনের পর দিন একটাই নাশতা। এই নিয়েও কারও বিকার নেই। একদিন একটু অন্য কিছু করলে হয়। লিলি ভাজি মুখে না দিয়েই বলে ভাজিতে লবণ বেশি হয়েছে। মতির মা বুয়া লবণ বেশি না দিয়ে ভাজি করতে পারে না। লবণ বেশি দেবে, বকা খাবে। মতির মা ধরেই নিয়েছে ভাজি নিয়ে বকাঝকা দিন শুরুর অংশ।
লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান লিলিকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলল, হারামজাদার নাকে এক ঘুসি দিয়েছি, গলগল করে ব্লাড বের হয়ে এসেছে।
কার নাকে ঘুসি দিলে?
দুধওয়ালার নাকে। আমার সঙ্গে তর্ক করে। অন্যায় করেছ ক্ষমা চাও। ক্ষমা করে দেব। ক্ষমা মানবধর্ম। তা না, তর্ক। হারামজাদার সাহস কত। রগে রগে সাহস। সাহস বের করে দিয়েছি।
সত্যি সত্যি মেরেছ?
অবশ্যই মেরেছি। গদাম করে ঘুসি। হারামজাদা, তুমি মানুষ চেনো না। রোজ তেলাপোকা খাওয়াও…।
দুধওয়ালার নাক ভেঙে দিয়ে জাহেদুর রহমানকে অত্যন্ত উৎফুল্ল লাগছে। জাহেদুর রহমানের বয়স পঁয়ত্রিশের উপর কিন্তু চলাফেরা হাবভাব আঠারো উনিশ বছরের তরুণের মতো। সব সময় সেজেগুজে থাকে। প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করা। চকচকে জুতা। রঙচঙে শার্টের কলারের নিচে সোনার চেন ঝকঝক করে। জাহেদুর রহমান গত সাত বছর ধরে ইমিগ্রেশন নিয়ে আমেরিকা যাবার চেষ্টা করছে। তার অধ্যবসায় দেখার মতো। লিলির ধারণা তার ছোট চাচা যদি আমেরিকা যাবার জন্য এখন পর্যন্ত কি কি করেছে তার একটা তালিকা করে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে পাঠায় তাহলে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তাকে সিটিজেনশিপ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে আমেরিকা নিয়ে যাবেন।
লিলি বলল, ছোট চাচা তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে?
জাহেদুর রহমান পা নাচাতে নাচাতে বলল, ফর গুড দিতে পারব না। ধার হিসেবে দিতে পারি।
ধার হিসেবেই দাও।
কত?
পাঁচ শ।
এত টাকা দিয়ে করবি কী? পাঁচ শ তো অনেক টাকা। প্রায় পনেরো ডলার। পনেরো ডলার দিয়ে তুই করবি?
রিকশায় করে শহরে চক্কর দেব। ঘুরব। একদিনের জন্য হিমু হয়ে যাব। মহিলা হিমু।
হিমুটা কে?
তুমি চিনবে না। দিতে পারবে পাঁচ শ টাকা?
তিন শ দিতে পারব। বাকি দুশ অন্যখান থেকে ম্যানেজ কর। ভাইজানকে গিয়ে বল ইউনিভার্সিটিতে পিকনিক হচ্ছে, দুশ টাকা চাঁদা।
মিথ্যা কথা বলতে পারব না।
মিথ্যা কথাটা তুই এত ছোট করে দেখিস কেন লিলি। মিথ্যা আছে বলেই জগতসংসার এত সুন্দর। গাদা-গাদা গল্প উপন্যাস যে পড়িস সবই তো মিথ্যা। লেখকেরা সত্যি কথা লেখা শুরু করলে বই আর পড়তে হতো না। মিথ্যা কথা বলা না শিখলে লাইফ হেল হয়ে যাবে।
লিলি হেসে ফেলল। জাহেদুর রহমান গম্ভীর গলায় বলল, হাসিস না। আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। সত্যি কথা হলো ডিস্টিল ওয়াটারের মতো টেস্টলেস। আয় আমার সঙ্গে, টাকা নিয়ে যা।
কত দেবে, তিন শ?
পাঁচ শ দেব। তোকে খুব পছন্দ করি। এইজন্যই দিচ্ছি। তুই হচ্ছিস অনেস্ট একটা মেয়ে।
লিলি হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে আমাকে পছন্দ করো তার কারণ হলো আমি সব সময় সত্যি কথা বলি। আমি যদি তোমার মতো মিথ্যা বলতাম তাহলে পছন্দ করতে না। কাজেই সত্যি বলার কিছু এ্যাডভানটেজ আছে।
জাহেদুর রহমান চিলেকোঠায় থাকে। তার ঘর ছবির মতো সাজানো। খাটে টানটান করে চাদর বিছানো। টেবিলের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। কোথাও এক কণা ধুলা নেই। জুতা বা স্যান্ডেল পরে তার ঘরে ঢোকা যাবে না। বাইরে খুলে ঢুকতে হবে। লিলি বলল, ঘরে ঢুকব না ছোট চাচা। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি তুমি দিয়ে দাও।
আয়, একটু বসে যা।
লিলি স্যান্ডেল খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার কিছু হয়েছে?
নতুন একটা লাইন ধরেছি। ভালো লাইন। হয়ে যেতে পারে।
কী লাইন?
আমেরিকান এক মরমন পাদ্রির সঙ্গে খাতির জমিয়েছি। প্রতি রোববারে যাই। এমন ভাব করি যেন যিশুখ্রিস্টের অমর বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। তাকে পটাচ্ছি। সে ভাবছে সে আমাকে পটাচ্ছে।
তাকে পটিয়ে লাভ কী?
এক স্টেজে খ্রিস্টান হয়ে যাব। তারপর তাকে বলব–আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা এখন আমাকে মেরে ফেলার জন্য ঘুরছে। আমাকে বাঁচাও। আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও। পলিটিক্যাল এসাইলেমের ব্যবস্থা করো। বুদ্ধিটা তোর কাছে কেমন লাগছে?
লিলি জবাব দিল না। জাহেদুর রহমান ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে করতে বলল, অনেক চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছি। এইবার একটা-কিছু হবেই।
যদি না হয় কী করবে?
আরও দুবছর দেখব। এই দুবছরে না হলে, আশা ছেড়ে দিয়ে বিয়ে-শাদি করব। ফেইথফুলি সংসার করব। টু বাংলাদেশী হয়ে যাব। পয়েলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যাব। গব-গব করে পান্তাভাত খাব।
আমেরিকা যাবে এই জন্যই বিয়ে করছ না?
অবশ্যই। একজনেরই ব্যবস্থা হয় না দুজনের কীভাবে হবে? আমি ভিসা পেয়ে চলে গেলাম তোর চাচি দেশে পড়ে রইল, চোখের জল নাকের জল ক্রমাগত মিক্স করে যাচ্ছে। তখন অবস্থাটা কি হবে? নে, টাকা গুনে নে।
পাঁচ শ টাকার নোট গুনে নেব কি?
ভুলে দুটি চলে গেল কিনা দেখ। আর শোন লিলি, এই টাকা তোকে ফেরত দিতে হবে না। টাকাটা তোকে আমি উপহার হিসেবে দিলাম।
কেন?”
এমনি দিলাম। তুই হচ্ছিস একজন সত্যবাদী মহিলা…
আজ সকাল থেকেই লিলির মন খারাপ হয়েছিল। এখন মন ভালো হতে শুরু করল। ছোট চাচার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তার মন ভালো হয়।
জাহেদুর রহমান একটু ঝুঁকে এসে বলল, টাকাটা তোকে যে শুধু শুধু দিয়ে * দিয়েছি তা না। এর বদলে তোকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আমার যেন কিছু ব্যবস্থা হয় সেই দোয়া করবি। সত্যবাদী মহিলার দোয়া আল্লাহ শুনবেন।
আচ্ছা যাও, দোয়া করব।
আল্লাহকে বলবি এই যে খ্রিস্টান হচ্ছি এটা আমার একটা ট্রিকস। উনি যেন এটাকে আবার সিরিয়াসলি না নেন।
লিলি হাসছে। শব্দ করে হাসছে।
জাহেদুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, গুড গার্ল। চল, নাশতা খেয়ে আসি।
নাশতার টেবিলে দারুণ হইচই হচ্ছে। নেয়ামত সাহেব ভাজির বাটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ভেঙেছেন। এখন বিকট চিৎকার করছেন। ঐ বেটির মুখে এক পোয়া লবণ ঢুকিয়ে দাও। তাহলে যদি শিক্ষা হয়।
মতির মা ভাঙা বাটির টুকরা কুড়াচ্ছে। ফরিদা নতুন করে ভাজি বসিয়েছেন।
লিলি রান্নাঘরে মার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, বাবা এ-রকম বিশ্রী করে চেঁচাচ্ছে কেন মা?
ফরিদা বললেন, পুরুষ মানুষ একটু চেঁচামেচি তো করবেই। পুরুষদের সবকিছু ধরতে নেই। লবণটা একটু দেখ তো মা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ের চোটে দুবার লবণ দিয়ে ফেলেছি।
লিলি সামান্য ভাজি মুখে নিয়ে বলল, দুবার না মা, তুমি তিনবার লবণ দিয়েছ।–বলতে বলতে লিলি হাসল। লিলির হাসি দেখে ফরিদা হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তুই তো দারুণ সুন্দর হয়েছিস লিলি। কী আশ্চর্য কাণ্ড! আমি তো লক্ষই করি নি। তুই কি সকালে গোসল করেছিস?
হা।
তোর বয়েসী মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায় গোসলের পরপর। এত সকালে গোসল করলি কেন?
জানি না কেন। আচ্ছা মা শোনো, আজ আমার কোথাও বেড়াতে যেতে করছে।
কোথায়?
বিশেষ কোথাও না–এই ধরো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাম। নিউমার্কেটের দোকানগুলো দেখলাম।
যাই করিস তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে করব।
সমস্যা তো এইখানেই।
রুমু রান্নাঘরে ঢুকল। তার হাতে একটা সে লিলির হাতে দিয়ে যেভাবে চুপিচুপি এসেছিল সেভাবেই বের হয়ে গেল। ফরিদা বললেন, কার চিঠি?
স্বাতীর চিঠি।
যাক, বাঁচা গেল। আমি ভাবলাম রুমু ঝুমুর মাস্টার বুঝি প্রেমপত্র লিখে ফলেছে। ওর তাকানো ভালো না। শকুনের মতো কেমন করে যেন তাকায়। স্বাতী ঠাৎ চিঠি লিখল কেন?
আজ ওর জন্মদিন। যেতে বলেছে। মা, যাব?
তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
বাবা যেতে দেবে না।
দিতেও পারে। তোকে পছন্দ করে। নরম গলায়, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে দেখ।
এখন বলব?
না, এখন না। খবরের কাগজটা আসুক। খবরের কাগজ হাতে পড়লে মেজাজ একটু ভালো থাকে। তখন এক কাপ চা নিয়ে যাবি তারপর বলবি।
নেয়ামত সাহেব খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সামনে এসট্রে আছে। ছাই এসট্রেতে ফেলছেন না, চারপাশে ফেলছেন। লিলি চায়ের কাপ তাঁর সামনে রাখতে রাখতে বলল, বাবা আমার এক বান্ধবী যে আছে স্বাতী, আজ ওর জন্মদিন।
নেয়ামত সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। লিলি বলল, আমাকে খুব করে যেতে লিখেছে। এক ঘণ্টার জন্য।
তোর বান্ধবীর জন্মদিন?
জি।
বুড়ো ধাড়ি মেয়ের আবার জন্মদিন কি? এসব আমার পছন্দ না। ছুটির দিন বাসায় থাকবি। বাইরে বাইরে ঘুরবি কেন? যা, মাকে সাহায্য কর। একা মানুষ চারদিক সামলাচ্ছে, তাকে দেখে একটু মায়াও হয় না।
নেয়ামত সাহেব আবার কাগজ পড়তে শুরু করলেন। লিলি চায়ের কাপ নামিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।