সকাল আটটা বাজে
আমজাদ আলি আতর-বাড়ির অফিস ঘরে চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন। চা বিস্বাদ লাগছে। একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সিগারেটে টান দিতেই মাথায় চক্কর দিল। বমি বমি ভাব হলো। সবই শরীর খারাপের লক্ষণ। রাতে ভালো জ্বর এসেছিল। পা ফুলে ঢোল। তিনি তার ছোট মেয়ে শায়লাকে পায়ে তেল মালিশ করতে বলেছিলেন। শায়লা তেল মালিশ করতে এসে বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার পায়ে কি পানি এসেছে নাকি? তিনি কিছু বললেন না, যদিও মেয়ের কাছে সত্যি কথাটা বলার ইচ্ছা একবার হয়েছিল। মেয়ে কথা রাখতে পারবে না। সবাইকে বলে বেড়াবে এই ভয়ে বলেননি।
তিনি কানে ধরে উঠবোস করছেন— এই ঘটনা অবশ্যই চাপা থাকা দরকার। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে বড় দুটার বিয়ে হয়েছে। ওদের কাছে খবর পৌঁছে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে দুটা অপমানিত হবে। সবচে বড় সমস্যা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। এই মহিলার মাথায় সামান্য গোলমাল আছে। রাগারাগি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, সিলিং ফ্যানে শাড়ি ঝুলানো প্রায়ই করে। কানে ধরে উঠবোসের কথা শুনলে বিরাট কোন কেলেঙ্কারি অবশ্যই করবে।
আমজাদ ভাইয়ের শরীর খারাপ নাকি?
ক্যাশিয়ার সোবাহান সাহেব কখন ঘরে ঢুকেছেন, কখন তার চেয়ারে বসেছেন আমজাদ আলি তা মনে করতে পারলেন না। মনে হয় চায়ের কাপ হাতে নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি সোবাহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু মনে হয় খারাপ। রাতে ঘুম হয় নাই। ভাবছি আজ উঠবোসটা করব না। রেস্ট নেব।
সোবাহান সাহেব বললেন, কিছুক্ষণের জন্যে করুন। স্যার আজ বারান্দায় বসেছেন। বারান্দা থেকে দেখবেন যে উঠবোস চলছে। স্যারের নজরে আসা দরকার না?
অবশাই দরকার।
সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে করেন। কোনো টাইম লিমিট তো নাই।
তা ঠিক।
আমি সবাইকে কঠিনভাবে বলে দিয়েছি কেউ ভিড় করবে না। আর আপনার এত লজ্জা পাওয়ারও কিছু নাই। আগে পেটে ভাত তারপর লজ্জা কী বলেন ঠিক বলছি না?
জি।
আমার ধারণা আরো কয়েক দিন পার হলে স্যার নিজ থেকেই বলবেন—আর লাগবে না। অপরাধ মাপ। সেই সম্ভাবনা আছে না?
আছে।
তাহলে দেরি না করে শুরু করে দিন। স্যার আবার ঘরে চলে যেতে পারেন। চা শেষ করে যান।
আমজাদ আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, হিসাব কে রাখবে?
আপনি বলবেন কত বার হয়েছে আমি লিখে রাখব।
সেটা ঠিক হবে না। স্যার যদি দেখেন বারান্দায় আমি একা, তাহলে ভাববেন কোনো দুই নম্বরি হচ্ছে। খাতা-কলম নিয়ে কাউকে আমার সঙ্গে দিন।
ঠিক বলেছেন। আমি ব্যবস্থা করছি।
আমজাদ আলি উঠবোস শুরু করেছেন। প্রথম দিকে পায়ে টনটন ব্যথা হচ্ছিল। এখন ব্যথা নেই। তবে হাতের কনুই কেন জানি ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে দুই হাতেই কেউ দশ কেজি ওজনের দুটো পাথর ঝুলিয়ে দিয়েছে। বুকে এক ধরনের চাপ বোধ করছেন। এটা হাতের ব্যথার কাছে কিছু না।
সোবাহান সাহেবের ধমকে কাজ হয়েছে। আজ আর তাকে ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে নেই। খাতা-কলম নিয়ে বাজার সর্দার কুদ্দুস বসে আছে। কুদ্দুস মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। তিনি বললেন, কুদ্দুস ভালো আছ?
কুদ্দুস মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, জি স্যার।
বুড়ো বয়সে ভালো বিপদে পড়েছি, তাই না কুদ্দুস?
জি সার।
রোজ হাশরেও আমাদের সবার শাস্তি হবে। আল্লাহপাক স্বয়ং শাস্তি দিবেন। তবে সেই শান্তিতে লজ্জা নাই। কারণ সেই শান্তি অন্য কেউ দেখবে না। বেহেশতাসী একজন আরেকজনকে চিনবে কিন্তু দোজখবাসী কেউ কাউকে চিনবে না।
স্যার কি একটু বিশ্রাম নেবেন?
নাহ।
তাহলে পানি খেয়ে নেন।
আচ্ছা পানি নিয়ে আসো। পানি খাই। বুক শুকায়ে আসছে।
মবিনুর রহমান বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন।
এই বাড়ির বারান্দা পুরনো আমলের বারান্দার মতো। পনেরো হাত পাশের বিশাল বারান্দা। তার চেয়ারটা দেয়াল ঘেঁষে। চেয়ারের সামনে বেতের টেবিল। তার পরেও সাত-আট হতি জায়গা আছে। ঢাকা শহরে যে বাড়ি সেই বাড়ির জন্যে এত বড় বারান্দার কোনোই প্রয়োজন নেই। বারান্দা থেকে দেখার কিছু নেই। দালান, দালান এবং দালান। সাদা দেয়ালের দালাল, হলুদ দেয়ালের দালান, ইটের দালান।
তৰে মবিনুর রহমানকে দালান দেখতে হয় না। দুটা কাঁঠাল গাছ, একটা আমগাছ এবং একটা কামরাঙ্গা গাছ তাঁর বারান্দা শহর থেকে আলাদা করে রেখেছে। বারান্দায় বসলে মনেই হয় না সামনেই দালানের সমুদ্র। বরং মনে হয় তিনি শহরের বাইরে কোথাও আছেন। সে রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ কাঠাল গাছে দুটা পাখি বাসা বেঁধেছে। হলুদ রঙের পাখি যার লেজটা লম্বা। বড় বড় শহরের গায়ে হলুদ পাখি বাসা বাঁধে না! কাক বাসা বাঁধে।
সকাল এগারোটা। মবিনুর রহমানের সামনের টেবিলে দুটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি পত্রিকা রাখা আছে। পত্রিকার পাশে মগ ভর্তি কফি। তিনি এখনো পত্রিকার ভাঁজ খোলেননি, কফিতেও চুমুক দেননি। সব দিন তাঁর পত্রিকা পড়তে ইচ্ছা করে না। যেদিন পত্রিকা পড়েন না সেদিন কফিতেও চুমুক দেন না। মানুষের সব কাজই একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত।
আজ তাঁর মন বেশ খারাপ। গতকাল দুপুরে মুরগির মাংসের ঝোলের সঙ্গে কি খেয়েছেন তা মনে করতে পেরেছিলেন। রাত বারটার দিকে মনে পড়েছিল এখন আর মনে পড়ছে না। বাবুর্চিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই হয়, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। তিনি ঠিক করেছেন আজ সারাদিনই মনে করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তবে মনের উপর বেশি চাপ দেবেন না।
মবিনুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ডাকলেন, বাবুল আসো এদিকে।
শফিক পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
মবিনুর রহমান টেবিলে পা তুলতে তুলতে বললেন, কয়টা বাজে বলো তো?
স্যার এগারোটা বাজে।
কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা না দুএক মিনিট এদিক-ওদিক আছে?
এগারোটা তিন।
তোমার এখান থেকে অফিস ঘরের বারান্দা দেখা যায়?
জি স্যার যায়।
আমজাদ কি এখনো উঠবোস করছে?
জি না।
তুমি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসো।
শফিক চেয়ার টেনে পাশে বসল। তার অস্বস্তি লাগছে। বসের মুখোমুখি বসা যায়। পাশাপাশি কেন জানি বসা যায় না। মবিনুর রহমান বললেন, বাবুল, তোমার কি কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে? নাকি তুমি টি ড্রিংকার?
মাঝে মধ্যে কফি খাই।
তাহলে কফিটা খাও। আমি মুখে দেইনি।
এখন ইচ্ছে করছে না স্যার।
ইচ্ছা না করলে খেতে হবে না। আমি আমার নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপর চাপাতে খুবই অপছন্দ করি, কেন অপছন্দ করি বলো তো?
বলতে পারছি না স্যার।
আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে অন্যের ইচ্ছায়। তিতা করলা আমার খুবই অপছন্দের একটা খাবার। আমার শৈশব কেটেছে তিতা করলা খেয়ে। করলার সিজনে বাবুপুরা এতিমখানায় তিতা করলা হবে না— এটা হতেই পারে না। বাবুল এখন কি করলার সিজন?
জি স্যার।
তাহলে তো একবার করলা ভাজি করতে বলতে হয়। তুমি কি করলা ভাজি পছন্দ করো?
জি করি।
ভেরি গুড, তাহলে আগামীকাল করলা ভাজি হবে। তুমি খাবে। আমি খাব। আমি শুধু দেখব। ঠিক আছে বাবুল?
জি স্যার।
লক্ষ্য করেছ তোমার নাম আমার মনে আছে? ছড়াটা কাজে লেগেছে। তোমার মেয়ের নামও আমার মনে আছে। তোমার মেয়ের নাম নিশো। হয়েছে?
জি স্যার।
নিশো কি করলা ভাজি খায়?
বলতে পারছি না। আমি মনে করতে পারছি না।
তোমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও। তোমার স্ত্রীর নাম কী?
মীরা।
তোমার স্ত্রীর নাম; কিন্তু আমার মনে থাকবে না কারণ তার নাম নিয়ে আমি ছড়া বানাইনি। তোমার স্ত্রীর প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ল— আমি বিয়েও করেছিলাম অন্যের ইচ্ছায়। নিজের ইচ্ছায় না। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। তোমাকে একদিন বলব। শুনলে মজা পাবে। তুমি চাইলে আজও বলতে পারি। বলব?
আপনার বলতে ইচ্ছা করলে বলুন।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আমি তোমাকে কোনো গল্প বললে সেটা মনে করে রাখবে। আমি যদি কখনো শুনতে চাই শুনাবে।
জি আচ্ছা স্যার।
নিজের গল্প অন্যের কাছ থেকে শুনতে ভালো লাগে। ঠিক না?
জি স্যার ঠিক।
এই জন্যেই গল্প মনে রাখতে বলছি, অন্য কিছু না।
মবিনুর রহমান চেয়ারে পা তুলে গুছিয়ে বসলেন। বাবুলের দিকে তাকিয়ে গল্প শুরু করলেন।
সত্যজিৎ রায়ের একটা ছবি আছে না পথের পাঁচালী নাম। আমার বিয়ে হয়েছিল অবিকল পথের পাঁচালী স্টাইলে।
শফিক বিড়বিড় করে বলল, পথের পাঁচালী-তে কোনো বিয়ে কি হয়েছিল?
অবশ্যই হয়েছিল। নায়ক তার বন্ধুর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে সেখানে বিয়ে হলো।
ছবিটার নাম স্যার অপুর সংসার। বিভূতিভূষণের কাহিনী।
কার কাহিনী বলতে পারব না। সত্যজিতের ছবি সেটা মনে আছে। টিভিতে দেখিয়েছিল। শফিক শোনো ছবির স্টাইলে আমার বিয়ে হয়।
শফিক চুপ করে রইল। তাঁকে মাথা ঘুরিয়ে গল্প শুনতে হচ্ছে। চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলে ভালো হতো। সেটা করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
ছবিতে ছিল বন্ধুর মামাতো বোন কিংবা খালাতো বোন আর আমার বেলায় ছিল বন্ধুর আপন বোন। তবে ছবিতে বিয়ের পর ঘর-সংসার করে, আর আমার বেলায় রাত একটায় বিয়ে হয় পরদিন সকালে তালাক হয়ে যায়। খুবই ইন্টারেস্টিং স্টোরি। মেয়েটার নাম লায়লা। লায়লা একটা আরবি নাম। নামের অর্থ হলো রাত্রি। জানো নিশ্চয়ই?
জি স্যার জানি। আলিফ লায়লা—আরব্য রজনী।
আমার বিয়ের গল্পটাও আরব্য রজনী টাইপ। আমি গল্প-উপন্যাস লিখতে পারলে নিজেই একটা গল্প লিখে ফেলতাম। তোমার কি গল্প-টল্প লেখার অভ্যাস আছে?
জি না স্যার।
তোমার পরিচিত কোনো লেখক আছে? অন্যের প্লট নিয়ে গল্প লিখবেন? আমার কাছে অনেক গল্পের প্লট আছে।
আমার তেমন কেউ পরিচিত নেই স্যার।
অসুবিধা নাই। এখন পরিচয় নাই, ভবিষ্যতে হয়তো কারো সঙ্গে পরিচয় হবে তাই না?
জি স্যার।
তুমি নিজেও লিখে ফেলতে পারো। আমার স্ত্রীর নাম লায়লা। এটা লিখে রাখলে সুবিধা হবে, নাম ভুলবে না।
শফিক কিছু বলল না। বুড়োর কথাবার্তায় সে তেমন কোনো আগামাথা পাচ্ছে না।
বিয়ের গল্পটা তাহলে শোনো। বন্ধুর সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে গেছি। বরযাত্রী আসবে ট্রেনে করে। বিকাল পাঁচটায় ট্রেন। বিকাল চারটা থেকে দলবুল নিয়ে স্টেশনে বসে আছি। ট্রেন এলো আধা ঘণ্টা লেট করে। আমরা স্টেশনে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। বর নামবে, ব্যান্ডপার্টি বাজনা শুরু করবে। বর নামল না। সত্যজিৎ বাবুর ছবির সাথে এইখানে একটু গণ্ডগোল। তাঁর ছবিতে বর এসেছিল নৌকায়।
স্যার নৌকায় না, পালকিতে।
ও আচ্ছা, মনে হয় পালকিতে। বর ছিল পাগল। আমার ক্ষেত্রে বর আসেইনি। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কান্নাকাটির কিছু ছিল না। মুসলমানি নিয়মে বিয়ের তারিখে বিয়ে না হলে কিছু যায়-আসে না। হিন্দু নিয়মে বোধহয় বিরাট সমস্যা হয়। লায়লার বাবা মহা হৈচৈ শুরু করলেন, আজকেই মেয়ের বিয়ে দেব। যদি আজ রাতের মধ্যে বিয়ে দিতে না পারি, তাহলে কাঁচা গু খাই। এই সব আজেবাজে কথা। গ্রামের মানুষরা তাল দিতে খুব ওস্তাদ। তারা তাল দিতে লাগল। রাত একটা দশ মিনিটে বিশ হাজার টাকা দেনমোহরে আমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
টেনশনে আমার হয়ে গেল শরীর খারাপ। মাথা সোজা রাখতে পারি না। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। লায়লাদের কোনো এক আত্মীয় এর মধ্যে আমাকে দুই ডেজি হোমিওপ্যাথির কি ওষুধ খাওয়াল। শুরু হলো বমি। এক সময় মনে হলো মারাই যাব। ভোর রাতে মনে হলো শরীর সামান্য সুস্থ হয়েছে। গরম পানি দিয়ে গোসল করলাম। এক কাপ আদা-চা আর অর্ধেকটা বিকিট খেয়ে একটু ভাল বোধ করছি। তখন শুনি হৈচৈ-বরযাত্রী চলে এসেছে। ওরা ভুল করে দুই স্টেশন আগে নেমে গিয়েছিল, সেখান থেকে বাস ভাড়া করে এসেছে। কী রকম ঝামেলা হলো আন্দাজ করতে পারো?
জি স্যার পারছি।
কি হচ্ছে না হচ্ছে আমি অবশ্যি কিছুই জানি না। আমি বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে সারাক্ষণ শুয়েছিলাম। এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে আমার বন্ধু এসে আমাকে ডেকে তুলল, নানা কথা, নানা ধানাইপানাই। মূল বিষয় বিয়ে শুধু কাগজপত্রে হয়েছে। ম্যারেজ কনজুমেট হয়নি। এই বিয়ে ভেঙে দেয়া নাকি কোনো ব্যাপার না। ঐ পার্টি তাই চায়। এইসব হাবিজাবি কথা।
তারাই কাজি ডেকে আনল। তালাক হয়ে গেল। তালাক হয়ে গেল সকাল আটটা দশে। এইখানে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করো। বিয়ে হয়েছিলো একটা দশে। তালাক হবার পর ঘড়ি দেখলাম তখন বাজে আটটা দশ। আটটা দশ না হয়ে আটটা পনের কিংবা বিশও হতে পারত। তা কিন্তু হয়নি। দশ মিনিট একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক বলেছি কিনা বলো?
জি স্যার।
এরপর থেকেই সময়ের ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইম্পর্টেন্ট হয়ে গেছে। তোমাকে এই কারণেই বারবার কয়টা বাজে জিজ্ঞেস করি। আমার বিয়ের গল্পটা কেমন লাগল?
ভালো।
কোন তারিখে বিয়ে হয়েছিল এটা তোমাকে বলতে পারছি না। তারিখটা মনে নেই। মনে অবশ্যই পড়বে, তখন তোমাকে বলব। তুমি খাতায় নোট করে রেখো।
জি স্যার রাখব।
লায়লা এখন নারায়ণগঞ্জে থাকে। একটাই মেয়ে। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে। তবে এখনো বিয়ে হয়নি। আমার সঙ্গে অবশ্যি তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে আমি খোঁজখবর রাখি। মাঝে মধ্যে এটা সেটা উপহার পাঠাই। গত বছর এক ঝুড়ি গোপালভোগ আম পাঠিয়েছিলাম। তোমার আগে যে ম্যানেজার ছিল সে নিয়ে গিয়েছিল। তার কাছে শুনেছি তারা তাকে যত্ন করেছে। চা-কেক খাইয়েছে। লায়লা আমার সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। শরীর কেমন কি। এইসব। ভাবছি এই বছরও কিছু আম পাঠাব। তুমি দিয়ে আসবে। পারবে না?
জি স্যার পারব।
ক্যাশিয়ার সোবাহানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুই ঝুড়ি আম কিনবে। গোপালভোগ আর হিমসাগর। দেখে-শুনে কিনতে পারবে না?
পারব।
বাজারে আম কি উঠেছে?
জি উঠেছে।
দিনাজপুরের লিচু কি পাওয়া যায়?
পাওয়া যায়।
শদুই লিচুও নিয়ে যাবে।
স্যার আজ যাব?
আজ যাবার দরকার নাই। কোনো এক ছুটির দিনে যাবে। লায়লা শুনেছি কোন এক স্কুলে মাস্টারি করে। এমন দিনে যাওয়া উচিত যেন সে বাসায় থাকে। বুঝেছ? অন্য কারো হাতে পাঠালে বুঝতেও পারবে না কে পাঠিয়েছে, কি সমাচার। তাই না?
জি স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও। আজ তোমার ডাল রান্না করার কথা। ভুলে যেও না। কীভাবে রাঁধতে হয় শিখিয়ে দিয়েছিলাম। মনে আছে না?
মনে আছে।
আমি রান্নাবান্না সব এতিমখানার বাবুর্চির কাছে শিখেছি। বাবুর্চির নাম সিদ্দিক। সিদ্দিক ভাই ব্লাঁধতেন, আমি পাশে বসে থাকতাম। রান্নার সময় নানা গল্প-গুজব করতেন। ছড়া বলতেন। সবই রান্না বিষয়ক। একটা ছড়া তোমাকে বলি শোনো। চিংড়ি মাছ বিষয়ক–
ইচা
কাটতে মিছা
ধুইতে নাই
খাইতে গেলে আবার পাই।
ঘটনা বুঝতে পারছ?
জি না স্যার।
ইচা হলো চিংড়ি মাছ। কটিতে মিছা মানে কাটা অনর্থক। ধুইতে নাই মানে ধোবার সময় মাছ খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আবার খেতে গেলে পাওয়া যাবে। বুঝেছ?
জি স্যার।
এখন নিচে গিয়ে খোঁজ নাও আমজাদ এই পর্যন্ত মোট কত বার উঠবোস করেছে।
শফিক দোতলা থেকে একতলায় নেমে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ভালো লাগছে। স্বস্তিবোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বড় সাহেবের সামনে এতক্ষণ সে ত্রিশ কেজি বোঝা মাথায় নিয়ে চেয়ারে বসেছিল সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে বোঝাটা চেয়ারে নামিয়ে এসেছে। আবার যখন তিনি ডেকে পাঠাবেন, বোঝা মাথায় নিয়ে তার আশপাশে ঘুরঘুর করতে হবে। কোনো মানে হয়?
শফিক একতলায় নেমে প্রথম যে কাজটি করল তা হলো সিগারেট ধরালো। প্রথম সিগারেট অতি দ্রুত শেষ করে চায়ের সঙ্গে দ্বিতীয় সিগারেট। একতলায় কর্মচারীদের যে রান্নাঘর আছে, সেখানে চুলায় চায়ের পানি সব সময় ফুটছে। টি ব্যাগ-চিনি-দুধ সবই রাখা আছে। চা বানানোর আলাদা লোক নেই, নিজের হাতে বানাতে হবে।
শফিক চায়ের কাপ নিয়ে একতলার পেছনের বারান্দায় চলে এলো। মেজাজ খুব খারাপ লাগছে। বড় সাহের তাকে কাজ দেবেন বলেছেন। কাজটা কি এখনো জানা যায়নি। মনে হয় তার পরীক্ষা শেষ হয়নি।
শফিক সাহেব চা খাচ্ছেন নাকি?
শফিক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ক্যাশিয়ার সাহেব তার দিকে আসছে। তার কি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানো উচিত? পদাধিকারে ক্যাশিয়ার তার চেয়ে বড় না ছোট? কোনো কিছুই সে জানে না। সে এমন এক চাকরি করছে যে চাকরিতে তার পজিশন কি সে কিছুই জানে না। শফিক উঠে দাঁড়াল না তবে উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করল।
সোবাহান সাহেব যন্ত্রের মতো বললেন, আপনার জন্যে একটা মোবাইল টেলিফোন স্যাংশান হয়েছে। সাইন করে নিয়ে যাবেন। কোনো কারণে চাকরি টার্মিনেট হলে কিংবা আপনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলে সেইটা অফিসে দিয়ে যাবেন।
শফিক হাসি মুখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেও মনে মনে বলল, তোর ঐ সেট তুই…দিয়ে বসে থাক। অতি কুৎসিত এই বাক্য তার মাথায় আসছে কেন সে বুঝতে পারছে না। সোবাহান সাহেব মানুষটার চেহারা ভদ্র। কথাবার্তা ভালো। তাকে দেখে মাখায় গালাগালি আসার কথা না।
শফিক সাহেব চাকরি কেমন লাগছে?
বুঝতে পারছি না কেমন লাগছে।
প্রথম কয়েক দিন মন বসবে না, তারপর ঠিক হয়ে যাবে।
শফিক বলল, প্রথম কতদিন মন বসবে না?
সোবাহান সাহেব বললেন, এটা একটা কথার কথা বললাম। স্যারের এখানে কাজকর্ম কিছুই নাই এইটাই সমস্যা। স্যার যেমন কিছু করেন না, দিনরাত শুয়ে বসে থাকেন, আমাদেরও তাই করতে হয়। মানুষ তো কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। ঠিক বলেছি না?
ঠিক বলেছেন।
গরুকে যেমন সারাদিন ঘাস খেতে হয়, মানুষকেও সে রকম সারাদিনই কিছু কিছু করতে হয়। আমাদের এখানে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। আপনার ইচ্ছা হলে খেলতে আসবেন।
কী খেলা?
সোবাহান সাহেব শফিকের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ক্যারাম আছে, দাবা আছে। রাতে নাইন কার্ড খেলা হয়। নাইন কার্ড জানেন?
না।
ভেরি ইজি। অল্প স্টেকে খেলা হয়। দশ মিনিট খেলা দেখলে শিখে ফেলবেন। তবে আপনি তো রাতে থাকেন না। রাতে থাকলে মজা পেতেন।
শফিক বলল, চা খাবেন? আপনার জন্যে চা নিয়ে আসব? আমি আরেক কাপ খাব এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি।
না চা খাব না। আপনার মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই।
শফিক চা এনে আবার নিজের জায়গায় বসল। তার ক্ষীণ আশা ছিল ফিরে এসে দেখবে সোবাহান সাহেব চলে গেলেন। অকারণ কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছে না। এই লোকের অভ্যাস মনে হয় অকারণ কথা বলা।
সোবাহান সাহেব ঝুঁকে এসে বললেন, আপনি কি দুধ চা খান?
জি।
দুধ চায়ের চেয়ে রঙ চা ভাল। কনডেন্স মিল্কের চা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। কনডেন্স মিল্কের প্রধান ইনগ্রেডিয়েন্ট পামওয়েল। শরীরের জন্যে বিষ বলতে পারেন।
শফিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমার কাজটা ঠিক কী বলতে পারেন?
সোবাহান সাহেব বললেন, আসবেন যাবেন চা খাবেন এই তো কাজ। এর বেশি কিছু না। স্যার অবসর নিয়েছেন। স্যারের সঙ্গে আমরা সবাই অবসরে।
কর্তা যান বঙ্গে আমরা যাই সঙ্গে।
উনি কোথাও বের হন না?
সপ্তাহে একদিন ওনার পীর সাহেবের কাছে যান। বুধবার রাতে।
ওনার পীর আছে নাকি?
সব পয়সাওয়ালা মানুষের একজন পীর-ফকির আছে। রাস্তার কোনো ভিক্ষুককে শুনবেন না সে পীরের মুরিদ। যে কোনো কোটিপতির কাছে যান শুনবেন তিনি পীরের মুরিদ।
স্যার কি কোটিপতি?
কোটি টাকা এখন কোনো টাকাই না। সারের যে টাকা ব্যাংকে জমা আছে তার ইন্টারেস্টই আসে কয়েক কোটি। ওনার টাকা নিয়ে আলাপ করে আমাদের কোনো লাভ আছে? আমার লাভ নাই। আমরা গরুর লেজ। মাছি তাড়ায়ে তাড়ায়ে জীবন শেষ। এই লোক মানুষ হয়েছে এতিমখানায়। কে তার বাপ কে তার মা কিছুই জানে না। বিশ্বাস হয়?
শফিক চুপ করে রইল। সোবাহান সাহেব বললেন, ওনার টাকা-পয়সার হিসাব করে দুইজন চার্টার্ড একাউন্টেট। চারজন ক্যাশিয়ার। কি অবিশ্বাস্য কথা!
আপনি কি চারজন ক্যাশিয়ারের একজন?
আরে দূর দূর। আমি হলাম গুহ্যদ্বারের ক্যাশিয়ার। আমি এইখানকার খরচের হিসাব রাখি। আসল লোকজন বসে মতিঝিলে হেড অফিসে। আপনার বেতন হবে আমার এখান থেকে। ভালো কথা, চাকরির শুরুর প্রথম মাসের বেতন অ্যাডভান্স দেয়া হয়। এটা স্যারের নিয়ম। এই টাকা মাসে মাসে কেটে রাখা হয়। আপনি মনে করে আজ যাওয়ার সময় বেতন নিয়ে যাবেন।
শফিক বিস্মিত হয়ে বলল, পুরো বেতন?
অবশ্যই। এখানে চাকরির মজা আছে। কাজকর্ম কিছু নাই এইটাই সমস্যা। ভাই আমি উঠি। আমজাদ সাহেবের খবর নেই।
ওনার কি হয়েছে?
বমি টমি করে একাকার। এখন শুয়ে আছেন। মাথায় পানি দিচ্ছে। মনে হয় ডাক্তার ডাকা দরকার।
সব মিলিয়ে কতবার উঠবোস হয়েছে? স্যার জানতে চেয়েছেন এই জন্যে জিজ্ঞাস করছি।
এগজাক্ট ফিগার আপনাকে জেনে বলছি। সতেরোশর ওপর হয়েছে। ওনার সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
জি না।
একবার দেখা করবেন। লোক কিন্তু ভালো। আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। এখন আপনার ঘরেই শুয়ে আছেন। এই ঘরটা তার ছিল। চাকরি চলে যাওয়ার পর আপনাকে দেয়া হয়েছে।
ঘর অন্ধকার। দুটা জানালার পর্দা টানা। আমজাদ আলি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মাথা ভেজা। মাথায় তোয়ালে জড়ানো। কিছুক্ষণ আগেই মাথায় পানি দেয়া বন্ধ হয়েছে। পানির বালতি এখনো সরানো হয়নি। শফিকের পায়ের শব্দে তিনি চোখ মেললেন। ফ্যাসফ্যাস গলায় বললেন, কে?
আমার নাম শফিক। শফিকুল করিম।
ভাই সাহেব আপনাকে চিনেছি। আপনি স্যারের নতুন ম্যানেজার। ভালো আছেন?
জি ভালো আছি।
আমার অবস্থা কাহিল। বমি করে বারান্দা ভাসায়ে ফেলেছি। ভাই সাহেব বসেন, দাড়ায়ে আছেন কেন?
শফিক বসল। আমজাদ আলি বললেন, আপনার ঘর দখল করে বসে আছি কিছু মনে নিবেন না।
কোন অসুবিধা নাই। আপনার কি জ্বর। শরীর কাঁপছে।
শীত শীত লাগছে। জ্বর কিনা বুঝতে পারছি না।
গায়ের ওপর একটা চাদর কি দিয়ে দেব?
আমজাদ আলি ব্যাকুল হয়ে বললেন, চাদর-টাদর কিছু আপনাকে দিতে হবে। কাউকে ডাক দিয়ে বলেন দিয়ে দিবে।
শফিক তার কপালে হাত দিল। জ্বর ভালোই আছে।
মবিনুর রহমান তাঁর শোবার ঘরে। ফুট রেস্টে পা তুলে গভীর মনোযোগে টিভি দেখছেন। টিভি দেখছেন বলা ঠিক হবে না, টিভিতে ছবি দেখছেন। সউিন্ড অফ করা। হিন্দি কোনো সিনেমা হচ্ছে। পাত্র-পাত্রীরা সবাই দীর্ঘ ডায়লগ বলছে। সবার চোখেই পানি। মবিনুর রহমানকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি পাত্র-পাত্রীদের ঠোঁট নাড়া দেখে ডায়লগ ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে ডাকলেন, বাবুল।
শফিক জি স্যার বলে ঘরে ঢুকল।
তিনি তার দিকে তাকালেন না। সিনেমায় যে দৃশ্যটা চলছে সেটা শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করলেন। শফিক বলল, স্যার কিছু লাগবে?
তিনি হালকা গলায় বললেন, তোমার হাত কি পরিষ্কার আছে?
জি স্যার পরিষ্কার।
পরিষ্কার থাকলেও একটা কাজ করো বাথরুমে যাও, সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে এসে আমার পায়ে ক্রিম লাগিয়ে দাও। আমার সামান্য ডায়াবেটিসের মতো আছে। ডায়াবেটিসে পায়ের যত্ন নিতে হয়। তুমি যেটা করবে সেটা হলো হালকা করে ম্যাসাজ করবে। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ক্রিম দেবে।
শফিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার কি করা উচিত সে বুঝতে পারছে। ইংরেজি সাহিত্যে তার এমএ ডিগ্রি আছে। ভাইবা পরীক্ষায় এক্সটারনাল এগজামিনার বললেন, আমি একজন বিখ্যাত কবির নিজের লেখা এপিটাফের দুটা লাইন বল। তুমি যদি কবির নাম বলতে পারো তাহলে তোমাকে ভালো নাম্বার দেব। এমনিতেও তুমি ভালো করেছ তারপরেও সুন্দর সুযোগ পেলে। দেখি সুযোগটা কাজে লাগাতে পার কিনা—
I would have written of me on my stone
I had a lovers quarrel with the world.
এই লাইন দুটা কোন কবির লেখা?
শফিক বলল, রবার্ট ফ্রস্ট।
ভাইবায় সে সত্তর পারসেন্ট নাম্বার পেয়েছিল। থিওরি আরেকটু ভাল করলে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যেত। সে মাস্টারি করত ইউনিভার্সিটিতে। ছাত্রছাত্রীদের সাহিত্য পড়াতো। এসথেটিকস শেখাতো। তাদের সঙ্গে একটি মেয়েই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল, সে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছে।
মবিনুর রহমান তার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তিনি মনে হয় কিছু বুঝার চেষ্টা করছেন। শফিকের কাছে এখন তাকে তার এমএ পরীক্ষার ভাইবা বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতো লাগছে। যিনি কখনো কাউকে কোনো প্রশ্ন করেননি। যার একমাত্র কাজ ছিল ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকা।
বাবুল?
জি স্যার।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার পায়ে ক্রিম মাখিয়ে দিতে তোমার কিছু আপত্তি আছে। তোমার বাবার পায়ে তুমি কখনো হাত বুলিয়ে দাওনি?
জি না স্যার।
দাওনি কেন?
বাবা কারোর সেবা নিতে পছন্দ করেন না।
কেন করেন না?
জানি না স্যার।
তিনি কি তোমার সঙ্গে থাকেন?
তিনি একটা হোটেলে রুম নিয়ে থাকেন।
তার জন্যে তাকে মাসে কত ভাড়া দিতে হয়?
তাকে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। হোটেলের মালিক তার ছাত্র। আমার বাবা স্কুল-মাস্টার ছিলেন। ভাড়া দিয়ে হোটেলে বাস করার সামর্থ্য তাঁর নেই।
মবিনুর রহমান তার দৃষ্টি আবারো টিভির দিকে ফিরালেন। আবারো তিনি দুলতে শুরু করেছেন। হঠাৎ দুলুনি বন্ধ করে শফিকের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তোমার বাবা কারেরি সেবা যে নেন না তার কারণ মনে হয় আমি বের করতে পেরেছি। তিনি সেবা নেন না কারণ সেবা নিলে তার মূল্য দিতে হয়। ওনার মূল্য দেবার সামর্থ্য নেই। আমার যেহেতু সামর্থ্য আছে, আমি সেবা নেই এবং সেবা নিতে আমার খারাপ লাগে না। আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে তোমার কেন খারাপ লাগছে আমি বুঝতে পারছি না। তুমি কি আমার চাকরিটা করতে চাচ্ছ না?
চাচ্ছি স্যার! আমি খুবই খারাপ অবস্থায় আছি।
যাও বাথরুম থেকে ক্রিম নিয়ে এসো।
মবিনুর রহমান চোখ বন্ধ করে আছেন। শফিক তার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। মবিনুর রহমান তাঁর বাঁ পা এগিয়ে দিয়েছেন। শফিক পায়ে ক্রিম ঘষছে। ক্রিমের গন্ধ তীব্র। শফিকের মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর গুলাচ্ছে।
শফিক।
জি স্যার।
লায়লাকে মনে আছে?
মনে আছে ওনার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে আপনার বিয়ে হয়েছিল।
তোমার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা হোক—কখন বিয়ে হয়েছিল। কখন ভাঙলো?
রতি একটা দশে বিয়ে হয়েছিল, ভোর আটটা দশে বিয়ে ভেঙেছে।
তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো। এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে। কি কাজ শুনতে চাও।
স্যরি বলুন।
তোমার একমাত্র কাজ লায়লার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তার আস্থাভাজন হওয়া। আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি তুমি জানো না?
জানি। আপনি বলেছেন।
আমার নিকটজন বলতে একজনই— লায়লী। তার প্রতি যদি প্রবল দুর্বলতা বোধ করি সেটা নিশ্চয়ই দোষের না। এমনও তো হতে পারে দেখা গেল আমার মৃত্যুর পর আমি সব কিছুই তাকে দিয়ে গিয়েছি। হতে পারে না?
জি স্যার।
কাজেই লায়লা ভরসা করতে পারে এমন কিছু লোকজনের সঙ্গে আগে থেকেই তার পরিচয় থাকা উচিত। তুমি তাদের একজন। তুমি কখনোই মনে করবে না যে আমি হুট করে তোমাকে নিয়েছি। অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই তোমাকে নেয়া হয়েছে।
মবিনুর রহমান এখন চোখ মেলেছেন। তাকিয়ে আছেন শফিকের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিতে আগের তীক্ষ্ণ ভাবটা নেই। তিনি হালকা গলায় বললেন, আমি ক্যাশিয়ার সোবাহানকে বলে দিচ্ছি তোমাকে যেন একটা সার্বক্ষণিক গাড়ি দেয়া হয়। হুট হাট করে তোমাকে নারায়ণগঞ্জ যেতে হতে পারে।
সোবাহান সাহেব খুবই অবাক হয়ে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন তিনি শফিককে চেনেন না। শফিক অচেনা কেউ। শফিক বলল, কিছু বলবেন? সোবাহান সাহেব নিচু গলায় বললেন, বড় সাহেব আপনার জন্যে একটা ফুল টাইম গাড়ি সংশন করেছেন।
ও আচ্ছা।
আপনি জিপ গাড়িটা নিন। গাড়ি পুরনো হলেও ভালো। ড্রাইভারের নাম রঞ্জু। লোক ভালো। গাড়িতে লগ বুক আছে। কোথায় যান না যান একটু লিখে রাখবেন। তেলের হিসাবের জন্যে, অন্য কিছু না। গাড়ি আপনার বাসায় রাতে থাকবে।
শফিক বলল, আমি দরিদ্র মানুষ। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই।
গ্যারেজ লাগবে না। বাসার সামনে গাড়ি রেখে রঞ্জু গাড়িতে ঘুমাবে। স্যার ফুল টাইম গাড়ি দিতে বলেছেন। গাড়ি ফুল টাইম থাকবে। এইসব বিষয়ে স্যারের নিয়ম-কানুন কঠিন। এক কাপ চা আমার সঙ্গে খাবেন?
না।
আপনার ভাগ্য খুবই ভালো, স্যার আপনাকে পছন্দ করেছেন।
ফুল টাইম গাড়ি দিয়েছেন এই জন্যে বলছেন?
জি না এই জন্যে না। আপনার বেতনও বাড়ানো হয়েছে। পনেরো হাজার করা হয়েছে। আগারগাঁওয়ে আমাদের যে স্টাফ কোয়ার্টার, সেখানে আপনাকে ফ্ল্যাট দিতে বলেছেন।
সোবাহান সাহেব শফিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ চকচক করছে।
শফিক বাসায় ফিরল রাত আটটার দিকে। রিকশায় আসতে হয়নি গাড়ি নিয়ে এসেছে। আজো সে খালি হাতে আসেনি। আধাকেজি রসমালাই নিয়ে এসেছে।
মীরা আনন্দিত গলায় বলল, আজ দেখি সকাল সকাল চলে এসেছ?
শফিক বলল, সকাল সকাল এসে কোনো সমস্যা তো তৈরি করি নি। না-কি কোন সমস্যা তৈরি করেছি?
মীরা বলল, এ রকম রাগী রাগী গলায় কথা বলছ কেন? আমি কথার কথা বলেছি, রাত আটটা এমন কোন সকালও না। যারা অফিস করে দশটা-পাঁচটা করে। তোমার মতো ভোের সাতটায় গিয়ে রাত দশটায় ফেরে না।
এত কথা বলছ কেন? হড়বড় হড়বড় করেই যাচ্ছ। নিশো কোথায়?
তার ছোট মামা এসে নিয়ে গেছে।
কেন?
জলিলের বড় মেয়ের জন্মদিন। জন্মদিনে গেছে।
রাতে ফিরবে না?
না।
তুমি খুব ভালো করে জানো নিশো রাতে বাইরে থাকবে এটা আমার খুবই অপছন্দ।
নিশো খুব যেতে চাচ্ছিল।
মীরা চুপ করে রইল। মানুষটা হঠাৎ কেন এত রাগ করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। মীরা বলল, তুমি কি এখন খাবে না দেরি হবে? দেরি হলে চা করে দেই।
আমি রাতে কিছু খাব না।
কেন?
ক্ষিদে নেই।
কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকি মাছ রান্না করেছিলাম।
হাতির বিচি দিয়ে পুঁটকি মাছ রান্না করলেও খাব না।
এইসব কী ধরনের কথা?
শুনে অপমান লাগছে? আমার সঙ্গে বাস করলে এই ধরনের অপমানসূচক কথা শুনতে হবে। শুনতে যদি ভাল না লাগে এমন জায়গায় চলে যাও যেখানে এ ধরনের কথা শুনবে না।
সেই জায়গাটা কোথায়?
কোথায় তুমি খুঁজে বের করো। তোমার মঞ্জু মামাকে জিজ্ঞেস করো।
ওনার কথা আনলে কেন?
ইচ্ছা হয়েছে এনেছি। যতবার ইচ্ছা হবে আনব। এখন সামনে থেকে যাও।
মীরা শোবার ঘরে ঢুকে গেল। তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। সে ঠিক করে রেখেছিল, নিশোর বাবা অফিস থেকে ফেরার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জলিলের ঝিগাতলার বাসায় নিয়ে যাবে। রাতটা সেখানে থাকবে। শফিক খুব আপত্তি করবে বলেও তার মনে হয়নি। মেয়ের টানে যেতে রাজি হবে। জন্মদিনের ভালো খাবার আছে। মানুষটা ভালো খাবার পছন্দ করে। আর যেতে রাজি না হলেও তাদের সময়টা খারাপ কাটবে না। বিয়ের প্রথম দিকের মতো শুধু তারা দুজন।
শফিক হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকায় মীরা খাটে বসে তাকে দেখতে পাচ্ছে। সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। শফিকের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা আরেকবার করে দেখবে? মানুষটা কি কারণে রাগ করে আছে সেটা জানতে পারলে চেষ্টাটা সহজ হতো। সে চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেতে পছন্দ করে। এক কাপ চা নিয়ে তার কাছে যাওয়া যায়। এতে তার রাগ না কমলেও নিশ্চয়ই বাড়বে না। চুলায় কেতলি বসানো, পানি ফুটছে, চা বানানো কোনো ব্যাপার না। কথা হচ্ছে সে এখন যাবে না আরেকটু পরে যাবে? একটু পরে যাওয়াই বোধহয় ভালো। সময় যত যাবে রাগ তত কমবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাগ বাড়তেও পারে। মীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো।
নাও চা নাও।
শফিক হাত বাড়িয়ে চা নিল। মীরা বলল, গোসল করবে? বাথরুমে পানি আছে।
শফিক বলল, আরেকটু পরে।
চায়ে চিনি কম হয়েছে?
না চিনি ঠিক আছে।
আমি কি তোমার পাশে বসব?
বসতে চাইলে বসে। অনুমতি নেবার কী আছে?
তুমি যে চাকরি পেয়েছ–বাবা-মাকে খবরটা তো এখনো দাওনি। ওনারা খুব খুশি হবেন।
খুশি হবার কিছু নাই। খুশি যত কম হওয়া যায় ততই ভালো।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছ। পাশে বসার ভরসা পাচ্ছি না।
শফিক জবাব দিল না। মীরা পাশের চেয়ারে বসল। কথা বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ বসে থাকাটাও ঠিক হচ্ছে না। মীরা বলল, আজ কি রকম গরম পড়েছে দেখেছ? কাল ছিল ঠাণ্ডা, চাদর গায়ে ঘুমাতে হয়েছে। আজ আবার গরম। তোমার অফিসে নিশ্চয়ই এসি আছে তাই না?
শফিক জবাব দিল না। মীরা বলল, ওরা যে বলেছে তোমাকে একটা মোবাইল টেলিফোন দেবে, কবে দেবে।
দিয়েছে।
মীরা আনন্দিত গলায় বলল, এই খবরটা দাওনি কেন? আচ্ছা এই মোবাইলে কি টিএন্ডটি লাইনও ধরা যায়? ধরা গেলে এক্ষুণি নিশোর সঙ্গে কথা বলতে পারি।
শফিক বলল, কথা বলতে চাইলে বলো।
মোবাইল রেখেছ কোথায়?
শার্টের পকেটে আছে।
এত বড় একটা খবর তুমি গোপন রেখেছ। আশ্চর্য!
মীরা ছুটে বের হয়ে গেল। নিশোর সঙ্গে কথা বলে এখন সে নিশোকে চমকে দেবে। কিছুক্ষণ আগে শফিক তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে এটা এখন আর মীরার মনে নেই।
হ্যালো কে? আমার নিশো মা?
হুঁ।
বলো তো আমি কে?
মা।
হয়েছে। কী করছ মা?
টিভি দেখছি।
কার্টুন?
হুঁ।
বলো তো কার টেলিফোনে টেলিফোন করছি?
জানি না।
তোমার বাবার টেলিফোন। তোমার বাবাকে অফিস থেকে দিয়েছে। তুমি কি বাবার সঙ্গে কথা বলবে?
না। আমি কার্টুন দেখব।
বাবার সঙ্গে কথা বলো। বাবা খুশি হবে।
আচ্ছা।
তুমি ধরে থাকো আমি টেলিফোনটা বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। টেলিফোনটা কানে দিয়ে রাখে। কান থেকে সরাবে না।
মীরা বালিকাদের মতো আনন্দিত ভঙ্গিতে বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়াল। শফিক কঁদছে। নিঃশব্দ কান্না না। শব্দ করে কাঁদছে। মীরা তার ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এই দৃশ্য প্রথম দেখল।