সেদিনের অমলেন্দু
গ্ৰামের ছেলে অমলেন্দু খুব দুরন্ত। যতরকম দুষ্টুমি আছে সে ও তার বন্ধুরা মিলে করে বেড়ায়। সাঁতার কাটা, ঘুড়ি ওড়ানো, ডাংগুলি খেলা, লোকের বাড়ির ফল চুরি করে খাওয়া সবেতেই তারা ওস্তাদ। তবে লোকের উপকারেও দৌড়ে যায় আগে।
অমলেন্দু খুব সাহসী, স্পষ্ট কথা বলে। এমনকি গ্ৰামের জমিদারের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে দ্বিধা করেনা।
গ্ৰামে তারা পাঁচ বন্ধু সুকোমল, টৌটন, বুবাই, রাজা আর অমলেন্দু পঞ্চপান্ডব নামে পরিচিত। গ্ৰামের বিশ্বকর্মা পূজা জমিদার বাড়ির পাশের মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পঞ্চপাণ্ডবরা নানান রঙের ঘুড়ি বানিয়ে, তাতে লম্বা লেজ লাগিয়ে দল বেঁধে সেই মাঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। মাঞ্জা দেওয়া সুতোর প্যাঁচে ঘুড়ির লড়াই চলছে।
সকলে দারুণ উত্তেজিত। অন্যান্য বাচ্চারা,বড়োরা সব দাঁড়িয়ে দেখছে। একসময় রাজার ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে উড়তে উড়তে এসে আটকায় জমিদার অবণী বসুর বাগানের জামরুল গাছে। টোটন সেই গাছে উঠে ঘুড়ি পাড়তে গেলে জমিদারের নাতি বুবলার সঙ্গে লাগে ঝামেলা। বুবলা বলে আমাদের বাগানের গাছে আটকেছে, এ ঘুড়ি আমাদের। ঘুড়ি পেড়ে আমার হাতে দিবি, নাহলে বেরোতে দেবো না। দূর থেকে অমলেন্দু ঝামেলা শুনে ঘুড়ি গুটিয়ে ছুটে আসে। টোটনকে চেঁচিয়ে বলে, তুই নামিয়ে আন, তারপর দেখি কে নেয়? শুরু হয় তুমুল বচসা। ঝগড়া শুনে জমিদার অবণী বসু এসে দাঁড়ায় এবং নাতির সপক্ষে সওয়াল করে। অমলেন্দু মুখের উপর বলে, আপনি কেমন জমিদার, পরের ঘুড়ি নাতনির বলছেন! আপনার বাড়ির গাছে আটকেছে বলে ঘুড়ি আপনাদের হয়ে গেল?
জমিদার কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন, আজকে নিয়ে যাচ্ছো নিয়ে যাও, এরপর বাগানের গাছে ঘুড়ি আটকালে দেওয়া হবেনা।
অমলেন্দুরা সেদিন থেকে আর ওই মাঠে ঘুড়ি না উড়িয়ে দূরে অন্য মাঠে চলে যায়।
এবার অমলেন্দুর ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে পাশের গ্ৰামের জমিদার অম্বিকা লাহিড়ির বাড়ির উঠানে গিয়ে পড়ে। অমলেন্দু দলবেঁধে গিয়ে ঘুড়ি চেয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু সেখানে অমলেন্দুর নজরে পড়ে পাশে দুটো ঘোড়া বাঁধা আছে। তার ইচ্ছে হয়, ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুটবে অনেক দূর। কী করে পায় এই ঘোড়া! চাইলে তো ঘোড়া দেবেনা, তাই চুড়ি করবে ঠিক করে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পরদিন ভোর অন্ধকারে সব এসে পাঁচিল টপকে ঢুকে উঠোনের দরজা খুলে ঘোড়া নিয়ে একটা আমবাগানে লুকিয়ে রাখে।
সকালে উঠে অম্বিকাবাবু ঘোড়া দেখতে না পেয়ে খুঁজতে লোক পাঠায়। তারা হন্যে হয়ে খুঁজবার সময় লোকমুখে শুনতে পায় ছেলের দল লুকিয়ে রেখেছে। হয়রান হয়ে শেষে ছেলেদের ধরে একে একে জিজ্ঞাসা করলে সকলেই জানেনা বলে। কিন্তু অমলেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলে সে সত্যি কথাই বলে।
অমলেন্দুকে নিয়ে আসা হয় জমিদার অম্বিকা লাহিড়ি কাছে। ঘটনাচক্রে সেদিন জমিদার অবণী বসু এসেছিলেন অম্বিকাবাবুর বাড়িতে।
অমলেন্দুকে সামনে আনা হলে , জমিদার খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ঘোড়ার খবর জানো?
অমলেন্দু- জানি।
জমিদার – কোথায় রেখেছো?
অমলেন্দু – আমবাগানে
জমিদার – কেন নিয়েছো?
অমলেন্দু – চড়বো বলে।
জমিদার – চড়তে জানো?
অমলেন্দু – জানি।
জমিদার – চেয়ে নিলে না কেন?
অমলেন্দু – চাইলে আপনি দিতেন না।
জমিদার – চড়া হয়ে গেলে কী করবে?
অমলেন্দু – ছেড়ে দেবো।
অমলেন্দুর এইরকম সহজ সরল চটপট উত্তর শুনে জমিদার অম্বিকাবাবু মনে মনে খুশি হলেন এবং অমলেন্দুকে সুন্দর সুন্দর জিনিস পুরস্কার দিতে চাইলেন, কিন্তু অমলেন্দু রাজি হলোনা। তখন জমিদারবাবু বললেন, ঠিক আছে ঘোড়াটা তোমায় দিয়ে দিচ্ছি। অমলেন্দু তাতেও না বললো। শেষে অম্বিকাবাবু হেসে বললেন, ঠিক আছে তোমার যখন ইচ্ছা হবে তখন এসে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসবে।
অমলেন্দুর গ্ৰামের জমিদার অবণী বসু বসে অমলেন্দুর সততা ও সাহসিকতা দেখে ভাবেন এ ছেলে স্পষ্টবাদী ও সত্যকথা বলে। চেহারায় দৃপ্তভাব। ভবিষ্যতে বড় কিছু হবে। তারপর অম্বিকাবাবুকে বললেন,আমার গ্ৰামের ছেলে। আগে কোনোদিন দেখিনি! শুনেছি দুষ্টুমি যেমন করে মেধাবীও তেমন।
তারপর গাছে ঘুড়ি আটকানোর গল্পটা বললেন।
অম্বিকাবাবুও বললেন, ছেলেটার সাহসিকতা ও সত্য কথা শুনে মুগ্ধ হলাম। এ ছেলে তোমার গ্ৰামের মুখ উজ্জ্বল করবে।
স্কুলের পড়াশোনা শেষে অমলেন্দু কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে চলে যায়। পরে বড় ডাক্তার হয়ে নিজের গ্ৰামে ফিরে আসে। গ্ৰামে গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। বাড়িতেই তার ছোটো চেম্বার। ছোটোবেলায় অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় বাবাকে হারায়। মা লোকের বাড়ি মুড়ি ভেজে স্বল্প আয়ে অতি কষ্টে তাকে পড়িয়েছে, তাই গ্ৰামেই রাতদিন গরিবদের চিকিৎসা তার ব্রত হয়।
একসময় গ্ৰামে কলেরার মড়ক লাগে। গ্ৰামের পর গ্ৰাম তা ছড়িয়ে পড়ে। অমলেন্দু খবর পায় তার বন্ধু সুকমলের মা কলেরায় আক্রান্ত, কেউ ওদের বাড়ি যাচ্ছেনা। খুব গরিব, পথ্য কেনার পয়সা নেই। অমলেন্দু একসপ্তাহের খাবার,পথ্য নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে হাজির। সুকোমল দেখে কেঁদে ফেলে। বলে, মা বাঁচবেনা। আমি বড় অসহায়! কী যে করি !
অমলেন্দু সান্ত্বনা দিয়ে নিজের হাতে সেবা করে তার মা’কে সুস্থ করে তোলে।
এরপর পাশের গ্ৰামের জমিদার অম্বিকাবাবুর পরিবারে কলেরা হয়েছে জেনে শেখানে গিয়ে চিকিৎসা ও সেবা করে। অম্বিকাবাবু খুব প্রশংসা করে বলেন, অবণীর নাতি বুবলা কলেরায় মৃত্যুশয্যায়, তুমি তাড়াতাড়ি সেখানে যাও বাবা, দেখো ছেলেটাকে বাঁচাতে পারো কিনা!
অমলেন্দু দ্রুত অবণী জমিদারের বাড়িতে চলে আসে। দেখে জমিদারও আক্রান্ত। অমলেন্দুকে দেখে অবণী জমিদার কেঁদে বলে, তুমি বুবলা’কে বাঁচাও, আমার তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, আমি মরলে কিছু এসে-যাবে না।
অমলেন্দু নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত দুজনের চিকিৎসা ও সেবা করে সুস্থ করে তোলে।
গ্ৰামের ঘরে ঘরে গিয়ে রোগীদের সেবা করে অমলেন্দু সকলকে বাঁচায়।
আস্তে আস্তে কলেরার প্রকোপ কমে সব স্বাভাবিক হয়।
জমিদার অবণীবাবু খুশিতে তাঁর বৈঠকখানা অমলেন্দুকে ছেড়ে দিয়ে বলেন, তুমি এখানে বড় চেম্বার খুলো, আমি তোমার পাশে সবসময় থাকবো।