রামায়ণ : সুন্দরাকাণ্ড – বানরগণের মধুবন ভঞ্জন
কটক যুড়িয়া যায় পৃথিবী আকাশ।
দেশে গিয়া উপস্থিত মধুবন পাশ।।
দেখিতে মধুর বন অতি মনোহর।
কোন প্রাণী নাহি যায় তাহার ভিতর।।
সহস্র সহস্র কপি মধুবন রাখে।
বালির সময়াবধি মধুবনে থাকে।।
মধুগন্ধে কপিগণ অত্যন্ত বিকল।
খাইবারে নাহি পারে, হইল চঞ্চল।।
মধুপানে মন্ত্রণা করিল জাম্ববান।
অঙ্গদের ঠাঁই আজ্ঞা মাগ হনুমান।।
আনিয়া সীতার বার্ত্তা দিয়াছ আহ্লাদ।
অঙ্গদের ঠাঁই লহ রাজার প্রসাদ।।
অঙ্গদের কাছে কহে যোড় করি হাত।
রাজার প্রসাদ চাহি বানরের নাথ।।
অঙ্গদ বলেন, বীর যে দিলে আহ্লাদ।
যাহা চাহ তাহা লহ কি রাজপ্রসাদ।।
হনুমান বলে, মধু অমৃত সমান।
সকল বানরে খাই যদি কর দান।।
অঙ্গদ বলেন, মধু খাও ইচ্ছামত।
নহিবেন সুগ্রীব ইহাতে অসম্মত।।
হরষিত সকলে পাইয়া মধুদান।
স্বেচ্ছামত আনন্দে করিছে মধুপান।।
নিঙ্গুড়িয়া খায় কেহ পিয়েত চুমুকে।
সকল ভাণ্ডার শূন্য করিল কটকে।।
মধু পিয়া কপিগণ হইল পাগল।
মারামারি হুড়াহুড়ি করিছে কোন্দল।।
কেহ নাচে কেহ হাসে কেহ গায় গীত।
কেহ নারে কেহ জিনে সবে আনন্দিত।।
রুষিয়া করিল মানা মধুর রক্ষক।
খেদাড়িয়া যায় তারে অঙ্গদ-কটক।।
চুলেতে ধরিয়া কেহ ঘুরায় আকাশে।
মহাক্রোধে যায় কেহ অঙ্গদের পাশে।।
তোমার আজ্ঞায় মোরা করি মধুপান।
কোথাকার বানর লইতে চাহে প্রাণ।।
কুপিল অঙ্গদ বীর শুনিয়া বচন।
সাজ সাজ বলি ডাকে বালির নন্দন।।
কটক লইয়া যুবরাজ যায় কোপে।
কুপিল যে দধিমুখ আসে একচাপে।।
অঙ্গদের প্রতাপ সহিবে কোন্ জন।
দধিমুখে এড়িয়া পলায় কপিগণ।।
অঙ্গদ কহিছে শুন ওরে দধিমুখ।
তোরে আজি মারি যদি তবে যায় দুখ।।
জানিয়া সীতার বার্ত্তা আইল যে জন।
তারে দান দিতে আমি নহিনু ভাজন।।
রামকার্য করি আমি খাই পিতৃধন।
ঘরেতে বসিয়া ভোগ কর মধুবন।।
পিতৃধন মধুবন করিস্ ভক্ষণ।
মনেতে বাসনা তোরে কাটিত এক্ষণ।।
বাপের মাতুল যে সম্বন্ধে বড় বাপ।
তেকারণে না মারিনু তোমা হেন পাপ।।
ওষ্ঠাধর কম্পমান ক্রোধেতে ব্যাকুল।
গোহারি করিতে যায় রাজার মাতুল।।
জর্জ্জর হইল বীর আঁচড় কামড়ে।
শীঘ্র দধিমুখ সুগ্রীবের পায়ে পড়ে।।
পায়েতে পড়িয়া কহে নিজ অপমান।
মধুবন নষ্ট করে অঙ্গদ হনুমান।।
তোমরা দুভাই যাহা করিলে পালন।
এতকালে নষ্ট করে সেই মধুবন।।
শুনে ক্রোধে বলে রাজা বাক্যের গৌরবে।
জিজ্ঞাসেন লক্ষ্মণ সে ভূপতি সুগ্রীবে।।
মামা হয়ে দধিমুখ ধরিল চরণ।
অপমান-কথা কহি করিছে ক্রন্দন।।
না দেহ সান্ত্বনা-বাক্য না দেহ উত্তর।
কি হেতু মামার প্রতি এত অনাদর।।
সুগ্রীব বলেন, শুনি লক্ষ্মণের কথা।
অভিপ্রায় বুঝিলে উত্তর দিব তথা।।
দক্ষিণদিকেতে যারা করিল গমন।
লুটিয়া খাইল তারা রম্য মধুবন।।
মারি খেদাইল এরে এই মধু রাখে।
এই সব কথা কহে মামা দধিমুখে।।
সুগ্রীবে লক্ষ্মণ কহে অপরূপ শুনি।
কে আইল কে কহিল দক্ষিণ-কাহিনী।।
শ্রীরাম বলেন, যারা গিয়াছে দক্ষিণে।
তারা কি আইল, জান বার্ত্তা কি এক্ষণে।।
সুগ্রীব বলেন, মিত্র না হও অস্থির।
দক্ষিণেতে গিয়াছিল বড় বড় বীর।।
আপনি অঙ্গদ আর মন্ত্রী জাম্ববান।
কার্য্যের সাধক স্বয়ং বীর হনুমান।।
তব কার্য্যে হনুমান বড়ই তৎপর।
অবশ্যই হইয়াছে সীতার গোচর।।
ধার্ম্মিক পণ্ডিত হনুমান মহাশয়।
দেখিয়াছে সীতারে সে কহিনু নিশ্চয়।।
শ্রীরাম বলেন, মিত্র তোমার বচনে।
যে আনন্দ পাইলাম কহিব কেমনে।।
হনুমান অঙ্গদেরে ডাকিয়া আনাও।
কহিয়া সীতার বার্ত্তা পরাণ জুড়াও।।
সুগ্রীব বলেন, এস মামা দধিমুখ।
অঙ্গদের বাক্যে মামা না ভাবিহ দুখ।।
সম্বন্ধে তোমার নাহি সেই যুবরাজ।
নাহি টোল করিলে তোমার নাহি লাজ।।
ঝাট চল মামা তুমি আমার বচনে।
অঙ্গদ হনুমানে আন শ্রীরামের স্থানে।।
রাজ-আজ্ঞা পাইয়া হরিষ দধিমুখ।
এক লাফে পড়ে গিয়া অঙ্গদ সম্মুখ।।
মাথা নোঙাইয়া তারে কহে যোড়হাত।
রাজবার্ত্তা কহি শুন বানরের নাথ।।
তব দোষ কহিলাম সুগ্রীবের স্থানে।
তব অপরাধ রাজা না শুনিল কাণে।।
নিজ ধন খাও তুমি বাপের অর্জ্জিত।
সেবক হইয়া কহিলাম অনুচিত।।
শ্রীরাম সুগ্রীব বসি আছে দুই জন।
ঝাট গিয়া কর তুমি রাজ-সম্ভাষণ।।
সেবক-বৎসল বড় সুশীল অঙ্গদ।
মধুবন রক্ষা তারে দিলেন সম্পদ।।
চলিল অঙ্গদ বীর হয়ে হরষিত।
কৌতুকেতে যায় বহু বানর বেষ্টিত।।
সকল ঠাটের আগে বীর হনুমান।
শ্রীরামের ঠাঁই যায় পর্ব্বত প্রমাণ।।
দূরে দেখিলেন রাম পবন-নন্দনে।
বসিয়াছিলেন উঠিলেন ততক্ষণে।।
সশঙ্কিত শ্রীরাম করেন অনুমান।
কি জানি কেমন বার্ত্তা কহে হনুমান।।
সাত পাঁচ ভাবি রাম জিজ্ঞাসেন তাকে।
সত্য কহ হনুমান দেখেছ সীতাকে।।
যদি সীতা দেখে থাক বীর হনুমান।
সর্ব্ব কার্য্য সিদ্ধ হবে তবে রবে প্রাণ।।
শ্রীরাম-চরণে বীর করি প্রণিপাত।
নিবেদন করে বীর করি যোড়হাত।।
লঙ্কামধ্যে দেখিয়াছি অশোক-কাননে।
কহিব সকল কথা প্রভু তব স্থানে।।
এক শত যোজন সে সাগর-পাথার।
অনেক কষ্টেতে আমি হইলাম পার।।
অন্ধকারে করিলাম লঙ্কায় প্রবেশ।
রাজ-অন্তঃপুরে না পাইলাম উদ্দেশ।।
আবাসে আবাসে আমি সীতা নাহি দেখি।
কান্দিলাম বিস্তর হইয়া মনোদুঃখী।।
অকস্মাৎ দেখিলাম অশোক-কানন।
অশোক-বনের জ্যোতি রবির কিরণ।।
দুই প্রহর রাত্রি গতে তৃতীয় প্রহরে।
অশোক-বনের মধ্যে দেখিনু সীতারে।।
হেনকালে তথা গেল রাজা দশানন।
দেবকন্যা সঙ্গে তার বিদ্যাধরীগণ।।
কি বলিয়া সীতারে সম্ভাষে লঙ্কেশ্বরে।
বৃক্ষ-আড়ে রহিলাম শুনিবার তরে।।
অনেক প্রকার স্তুতি করিল রাবণ।
জানকী না শুনিলেন তাহার বচন।।
তোমা বিনা জানকীর অন্যে নাহি মন।
কোপেতে কাটিতে চাহে রাজা দশানন।।
জানকী বলেন, মৃত্যু করিলাম সার।
রামের চরণ বিনা গতি নাহি আর।।
নিরাশ হইল দুষ্ট সীতার বচনে।
বিষম রাক্ষসী চেড়ী ডাক দিয়া আনে।।
ঘরে গেল দশানন ঠেকাইয়া চেড়ী।
সীতারে মারিতে সবে করে হুড়াহুড়ি।।
সীতারে বুঝায় চেড়ী অশেষ প্রকারে।
কোন মতে সীতা দুষ্ট বচন না ধরে।।
ত্রিজটা রাক্ষসী রাত্রে দেখিল স্বপন।
সীতার মঙ্গল সেই চিন্তে অনুক্ষণ।।
স্বপ্ন শুনিবারে চেড়ী গেল তার পাশ।
গাছে থাকি সীতা সহ করিনু সম্ভাষ।।
কোথা হতে এলে মোরে সুধান বৈদেহী।
সুগ্রীবের সঙ্গে সখ্য আমি সব কহি।।
তোমার অঙ্গুরী তাঁরে করাই দর্শন।
অঙ্গুরী পাইয়া সীতা করেন রোদন।।
মেলানি পাইয়া আমি যবে দেশে আসি।
মনে করিলাম কিছু বিক্রম প্রকাশি।।
ভাঙ্গিলাম মনোহর অমৃত-কানন।
কোটি কোটি রাক্ষসের বধিনু জীবন।।
ক্রমে বধিলাম তার বহু সেনাপতি।
প্রাণে মারিলাম অক্ষয়-কুমার প্রভৃতি।।
চক্ষুর নিমিষে সব করিনু সংহার।
ইন্দ্রজিৎ করিল সমরে আগুসার।।
দুই প্রহর তার সঙ্গে করিলাম রণ।
ব্রহ্ম-পাশে সে আমারে করিল বন্ধন।।
ধরিয়া লইয়া গেল রাবণ গোচর।
রাবণের প্রতি গালি দিলাম বিস্তর।।
আমারে কাটিতে আজ্ঞা করিল রাবণ।
নিষেধ করিল তারে ভাই বিভীষণ।।
তার বাক্যে আমি তবে এড়াই মরণ।
লেজে অগ্নি দিল লেজ পোড়াবার তরে।
সেই অগ্নি দিলাম লঙ্কার ঘরে ঘরে।।
লঙ্কা পোড়াইয়া করিলাম ছারখার।
কতেক হইল ভস্ম কতক অঙ্গার।।
আমার বিপদ ভাবি ভাবিছেন মাতা।
হেনকালে উপস্থিত হইলাম তথা।।
আমারে দেখিয়া সীতা হর্ষিতা বিশেষ।
সর্ব্ব কার্য্য সিদ্ধ করি আইলাম দেশ।।
দেখিয়া মা জানকীরে বিরহে মলিনা।
অলসের বিদ্যা বহু দিনে দিনে ক্ষীণা।।
দেখিনু শুনিনু যত কহিনু কাহিনী।
লহ রঘুমণি তাঁর মস্তকের মণি।।
রামহস্তে মণি দিল পবন-নন্দন।
মণি দেখি রঘুমণি করেন ক্রন্দন।।
মণি দিয়া কি কহিলা জানকী আমার।
বল বল ওরে হনু শুনি একবার।।
হনুমান বলে, প্রভু জনক-নন্দিনী।
কান্দিতে কান্দিতে এই কহিলা কাহিনী।।
তুমি মণি, আমি মণি, দুইটি ভগিনী।
দোঁহে পালিলেন যত্নে জনক-নৃপমণি।।
বিবাহের কালে পিতা পরম-আদরে।
অঙ্গুরী করিলা দান শ্রীরামের করে।।
বহুদিন একসঙ্গে আছি দোঁহে ভাই।
তোমার মাথায় করে ধরে রাখি তাই।।
রামের আনন্দ হবে তোমায় দেখিলে।
তোমায় পাঠাই তাই আজ কুতূহলে।।
যত কষ্ট সহিতেছে এই লঙ্কাপুরে।
গিয়া সব কবে তুমি রামের গোচরে।।
রামের ক্রন্দন দেখি কপিগণ কান্দে।
কৃত্তিবাস রচিলেন পাঁচালীর ছন্দে।।