Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy » Page 2

সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy

সাউথ পয়েন্ট জেলখানার পাশে বাঁক ঘুরে একটা পথ চড়াই-উতরাইতে দোল খেতে খেতে কারবাইনস কোভ, ব্রুখসাবাদের দিকে চলে গিয়েছে। বাঁকের মুখে একটা সাদা বিন্দু ফুটে বেরুলো। একটু একটু করে বিন্দুটা স্পষ্ট হতে হতে এবারডিন জেটিতে এসে একটি মানুষের আকার নিল।

মোগলাই চেহারা। মাথায় জরিদার তাজ। ঢিলেঢালা পাজামা, কলিদার কুর্তা, শুঁড়তোলা বাহারি নাগরা। খানদানি পোশাক-আশাক। ধবধবে ভুরু এবং দাড়ি পরম স্নেহে লালিত। সূচিমুখ গোঁফদু’টিতে পরিচর্যার অভাব নেই। কানে সুগন্ধি তুলো গোঁজা। দাড়ি আর কান থেকে আতরের মৃদু খুসবু যুগপৎ তার শৌখিনতা এবং রুচির পরিচয় দিচ্ছিল।

তাঁর নাম বান্দা নওয়াজ খান।

এবারডিন জেটিতে চাঞ্চল্য দেখা দিল। কয়েদিরা সরে সরে তাঁকে পথ করে দিতে লাগল। বান্দা নাওয়াজ খান জেটির শেষ মাথায় এসে দাঁড়ালেন।

চারপাশ থেকে কয়েদিরা সসম্ভ্রমে বলতে লাগল, আদাব, আদাব–

দীর্ঘ ঋজু দেহটা সামনের দিকে ঈষৎ হেলিয়ে নওয়াজ খান জবাব দিতে লাগলেন, আদাব, আদাব–-প্রসন্ন হাসিতে তার মুখ ভরে রয়েছে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন নওয়াজ খান। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একটা মোপলা টিণ্ডাল। নাম উলফৎ। সে ডাকল, খান সাহেব।

হাঁ–অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন নওয়াজ খান।

এবার দো মাহিনা বাদ জাহাজ এল।

হাঁ।

একটু ইতস্তত করল উলফৎ। তারপর নওয়াজ খানের আরো কাছে ঘন হয়ে দাঁড়াল। বলল, সুন্দর সাহেব কি এই জাহাজে আসছেন?

না।

নওয়াজ খানের কণ্ঠে একটিমাত্র শব্দ ফুটল। আর এই একটি শব্দে অনেক বেদনা, হতাশা এবং অভিযোগ মিশে রয়েছে।

উলফৎ নওয়াজ খানের মনোভাবটা বুঝল। চমকে একবার তার দিকে তাকাল। দেখল, তার শাদা প্রু দু’টির নিচে সুর্মারঞ্জিত টানা চোখজোড়া চিকচিক করছে।

হঠাৎ উলফৎ বলে ওঠে, এই জাহাজে সুন্দর সাহেবের চিঠি জরুর এসেছে।

নওয়াজ খান জবাব দিলেন না।

রস এবং বেলী নামের দুই মোটর বোট এলফিনস্টোন জাহাজের গায়ে লেগেছে। বোটের শব্দে যে সিন্ধুশকুনশুলো মাউন্ট হ্যারিয়েটের দিকে পালাতে শুরু করেছিল, তারা আবার জাহাজের মাস্তুলে ফিরে আসছে।

নওয়াজ খান অন্য কথা পাড়লেন। একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ, যার সঙ্গে সুন্দর সাহেবের কিছুমাত্র যোগ নেই। তিনি বললেন, শুনলাম, দরিয়া বাওরা হয়ে উঠেছিল, জাহাজ নাকি ঝড়ে পড়েছিল। আশ্চর্য! তার গলার স্বরে একটু আগের ক্ষোভ বেদনা, কিছুই নেই।

উলফৎ বলল, হাঁ, বহুত ভারী তুফান উঠেছিল।

খোদার দোয়া, তাই জাহাজ ডোবে নি। এতগুলো কয়েদির জান বেঁচে গেছে।

সত্তর পেরিয়েছেন বান্দা নওয়াজ খান। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে এখনও ঝঙ্কার আছে। এমন সুললিত গলা কদাচিৎ শোনা যায়। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, এই ঝড় তুফান, এই জিন্দেগি–বেবাক খোদার মর্জি। এই–ধীরে ধীরে তার গলা ভারী হয়ে এল।

উলফৎ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

ইতিমধ্যে কয়েদিদের মধ্যে ফের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। গুঞ্জনটা একটু একটু করে একটা হল্লার রূপ নিল।

দুটো টিণ্ডাল আর একটা পেটি অফিসার ঘুরে দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে উঠল, এ উল্লুলোগ, চিল্লাও মাত–

তৎক্ষণাৎ হল্লার রেশ ঝিমিয়ে এল।

নওয়াজ খান অস্ফুট গলায় বললেন, জাহাজটা দু’মাস পর এল। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। একবার জেটিতে ঘুরে যেতে ইচ্ছে হল। তাই চলে এলাম।

উলফৎ উৎকর্ণ হয়ে ছিল। নওয়াজ খানের প্রতিটি কথা ঠিক ঠিক শুনে ফেলল।

উলফৎ জানে, উলফৎ কেন, এদিকে ব্রুখসাবাদ, ওদিকে মোঙলুটন হামফ্রেগঞ্জ, সেদিকে ভাইপার, মিঠাখাড়ি, বাম্বুফ্ল্যাট–পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের সবাই তো জানেই, যে হাজার কয়েক কয়েদি দ্বীপান্তরের সাজা ভোগ করতে এই আন্দামানে এসেছে, তাদের প্রত্যেকে জানে, কিসের খোঁজে বান্দা নওয়াজ খান এবারডিন জেটিতে এসেছেন।

তারা জানে, পাঁচ বছর ধরে জাহাজ আসার দিনটিতে নওয়াজ খান জেটিতে আসছেন। তারা জানে, যতদিন সুন্দর খান আন্দামানে না ফিরবে, ততদিন তিনি জেটিতে আসবেন।

বিচিত্র মানুষ বান্দা নওয়াজ খান। এইদ্বীপের কে না চেনে তাকে? প্রতিটি মানুষ তাঁকে মান্য করে। ঋজু পুরুষটি যখন দীর্ঘ পদক্ষেপে পথ দিয়ে চলেন, দু’পাশে সসম্ভ্রমে সবাই বলে, আদাব, আদাব–

এই মানুষটি সম্বন্ধে আন্দামানের কয়েদিদের মনে কৌতূহলের অন্ত নেই। বান্দা নওয়াজ খানের হাল হকিকত সম্পর্কে তারা যতখানি ওয়াকিবহাল, তার অতীত ততখানিই অজানা, দুয়ে। এই দ্বীপে তিনি কবে এসেছিলেন, সাজার মেয়াদ কত বছর ছিল, কোথায় তার মুল্লুক, কোতল রাহাজানি আদপেই করেছিলেন কিনা, এ-সব ব্যাপারে আন্দামানের যত কয়েদি, ঠিক ততগুলিই মত।

পাহাড়গাঁওয়ের উজাগর সিং, গারাচারামার সুলেমান মোপলা, বিগি লাইনের মনসুর আলি, মিয়া খান, এবারডিন বাজারের দিগিন্দর সাহা–এমনি পুরনো আমলের জনকতক কয়েদি বান্দা নওয়াজ খান সম্বন্ধে অনেক, অনেক কথাই জানে। কিন্তু তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও বিশেষ সদুত্তর মেলে না।

হাল আমলের কয়েদি, যারা মাত্র দু-চার বছর এইদ্বীপের মাটিতে সাজা ভোগ করেছে, তাদের কেউ বলে, নওয়াজ খানের মুল্লুক বুম্বাই। কেউ বলে তাঁর মুল্লুকই নেই। কেউ বলে, তার নাকি বহোত ভারী ডাকাতের দল ছিল। কেউ বলে, খান সাহেব ডাকাতের সিরদার নন, পয়লা নম্বরের খেয়ালি মানুষ। মর্জি হয়েছে, তাই আন্দামানে এসে রয়েছেন। আজাদির জন্য সাহেব লোকদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান সিপাহিদের লড়াই বেধেছিল। কেউ কেউ অনুমান করে, তিনি সেই যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

অদ্ভুত মানুষ বান্দা নওয়াজ খান। অমায়িক ব্যবহার, মধুর স্বভাব। দিলদরিয়া, দরাজ মানুষ। মুখে সব সময় মৃদু, প্রসন্ন হাসি লেগে থাকে।

রোজ পোর্ট ব্লেয়ার শহরটা একবার চক্কর দেন নওয়াজ খান। হ্যাঁডো, ডিলানিপুর থেকে রেণ্ডিবারিক জেলখানা, ওদিকে নয়া গাঁও থেকে ফিনিক্স বে পর্যন্ত সবগুলো টাপুতে আর বিজনে ঘুরে ঘুরে কয়েদিদের খোঁজখবর নেন। কুশল প্রশ্ন করেন। মাঝে মাঝে ফিনিক্স বে থেকে লং ফেরিতে উপসাগর পেরিয়ে চলে যান ব্যাম্বু ফ্ল্যাট, ডান্ডাস পয়েন্টে। আবার শহর ছাড়িয়ে যে পথগুলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কয়েদিদের গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে, সে সব দিকেও যান। চাষ-আবাদের খবর নেন, নতুন মসলি ধানটা কেমন ফলছে, সুপারি নারকেলের চারাগুলি পাহাড়ি জমিতে কেমন বাড়ছে, জংলি জারোয়ারা হানা দেয় কিনা, তার খোঁজ নেন। সাজার মেয়াদ শেষ করে যে-সব কয়েদি গৃহস্থ হয়েছে, তাদের নতুন নতুন রোজগারের ফিকির বলে দেন। তরিবত করে তাদের দেওয়া তামাক টানেন, তাদের সঙ্গে খানা খান, তাদের পাতা বিছানায় আরাম করে চোখ বোজেন।

বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালায় যে বন্দি উপনিবেশ গড়ে উঠেছে, তার প্রতিটি কয়েদির সঙ্গে তার দিলের যোগ। পথ চলতে চলতে চোখ বুজে তাদের কথা ভাবেন। নওয়াজ খান তাদের মেহমানদারি এবং দিলের উত্তাপ অনুভব করেন।

নতুন যে কয়েদিটি এল, মুল্লুকে তার প্রিয়জন পরিজন কে কে আছে, পুরনো কয়েদিদের কার মেয়াদ বাড়ল, কার কমল, দীর্ঘ দিনের কয়েদ খেটে কে পরের জাহাজেই দেশে ফিরবে, কোন কয়েদি সেলফ সাপোর্টার্স টিকিট পেল, কে শাদির জন্য কমিশনারের অফিসে দরখাস্ত করেছে, সব–সব হিসাব নওয়াজ খানের কণ্ঠস্থ।

নওয়াজ খান সম্বন্ধে সম্ভ্রম যতখানি, সংশয় তার তিলমাত্র কম নয়। কয়েদিদের টাপুতে, বিজনে আর গাঁওয়ে গাঁওয়ে ঘুরে ঘুরে তাদের দেহাত মুল্লুকের, হাল হকিকতের খবর নিয়ে এই রহস্যময় মানুষটা কোন দুৰ্জ্জেয় মতলব হাসিলের ফিকিরে আছে, কেউ জানে না।

নওয়াজ খান নামে এক দীর্ঘ, ঋজু পুরুষ আন্দামানের বিস্ময়, কৌতূহল আর সংশয়ের মধ্যে মিশে রয়েছেন।

হাল আমলের কয়েদিদের কেউ জানে না, কিন্তু পুরনো দিনের উজাগর সিং কি মিয়া খান, সুলেমান মোপলা কি দিগিন্দর সাহা তার অতীত-কথা জানে।

আঠারো শ’ আটান্নর চোঠা মার্চ ওয়াকার সাহেব যে দু শ’ জন বন্দি নিয়ে প্রথম আন্দামান এসেছিলেন, বান্দা নওয়াজ খান সে দলে ছিলেন। এখানে আসার আগে তিনি ছিলেন ঘোড়সওয়ার সিপাইদের রিসালদার।

দিল্লিতে সিপাইদের সঙ্গে ইংরেজের যে লড়াই বেধেছিল, সে লড়াইতে তার ভূমিকা অসাধারণ।

হঠাৎ পাশ থেকে মোপলা টিণ্ডাল উলফৎ ডাকল, খান সাহেব–

এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন নওয়াজ খান। চমকে উঠলেন, আঁ, কী বললে?

একটু দ্বিধা করল উলফৎ, চনমনে চোখে ইতিউতি তাকাল। দেখল, নওয়াজ খান তার দিকেই সরাসরি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখ নামিয়ে উলফৎ বলল, কুছ নেহী খান সাহেব–

জাহাজটার দিকে আবার চোখ ফেরালেন নওয়াজ খান।

মাস্তুলের ডগার চারপাশে সাগরপাখিগুলো সমানে পাক খাচ্ছে। দেখতে দেখতে মন কেমন যেন উদাস লাগে নওয়াজ খানের।

খানিক পরে উলফৎ আবার ডাকে, খান সাহেব—

নওয়াজ খান ঘুরে দাঁড়ালেন।

উলফৎ বলল, জাহাজ করোজ থাকবে আন্দামানে?

চার পাঁচ রোজ।

তারপর তো মাদ্রাজ যাবে?

হ্যাঁ। কেন?

বলছিলাম–থতমত খেল উলফৎ। গোটা কয়েক ঢোক গিলল। শেষ পর্যন্ত কী ভেবে বলেই ফেলল, আপনি এই জাহাজেই ইন্ডিয়ায় যান খান সাহেব–

সুর্মারঞ্জিত দীর্ঘ চোখে নওয়াজ খানের দৃষ্টিটা তীব্র হয়ে উঠল। কঠিন গলায় তিনি বললেন, কিউ?

গলার স্বর কেঁপে গেল উলফতের, বলছিলাম, সুন্দর সাহেবকে যদি ইন্ডিয়া থেকে খুঁজে নিয়ে আসতেন–

ভীষণ গলায় ধমকে উঠলেন বান্দা নওয়াজ খান, চোপ রও বেয়াদব। দিল্লাগি করার আর লোক পেলে না!

উলফৎ অবাক দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশের কয়েদিরা চমকে উঠেছে। তাদের হল্লা থেমে গেল।

প্রসন্ন হাসিতে যে নওয়াজ খানকে সব সময় পীর দরবেশের মতো সুন্দর দেখায়, সেই মানুষকে এমন ভীষণ হয়ে উঠতে আন্দামানের কেউ কোনো দিন দেখে নি, এমন ভয়ঙ্কর গলায় ধমকে উঠতেও কেউ কোনো দিন শোনে নি।

মোটর বোটে ডাক্তার এসেছিল।

খানিকটা আগেই কয়েদিদের ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে।

খোলা ডেকে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল লখাই। পাশেই সেই পাঠান হাবিলদারটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

উপসাগরের নীল জলে এলফিনস্টোন জাহাজটা মৃদু মৃদু দুলছে।

হাবিলদারটা ভারী বুট দিয়ে লখাইর পাঁজরায় ঠোক্কর বসিয়ে দিল। রক্তাভ, ভীষণ চোখে তার দিকে তাকাল লখাই। বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য গলায় কী যে বলল, কিছুই বোঝা গেল না।

দু’পা পিছিয়ে হাবিলদারটা খিঁচিয়ে উঠল, এ শালে, কুত্তীকা বাচ্চা, অ্যায়সা আঁখ দেখাবি না। অ্যায়সা বিজির বিজির মাত্ কর।

লখাই জবাব দিল না।

খানিক পরে হাবিলদারটা আবার ঘন হয়ে দাঁড়াল। লখাইর পিঠে একটা হাত রাখল। যে মানুষ বাকি জিন্দেগিটা আন্দামানে দ্বীপান্তর ভোগ করবে, হয়তো তার জন্য পাঠানের কঠোর, নীরস মনে কিঞ্চিৎ মায়া জন্মে থাকবে। ঈষৎ নরম গলায় এবার সে ডাকল, এ লখাই–

লখাই চোখ তুলল।

হাবিলদার দূরে জেটির দিকে আঙুল বাড়াল। বলল, ওটা হল হাবরাডিন (এবারডিন) জেটি। ওখানে তোদের নামতে হবে।

কেন?

সসুরাকা কোঠি যাবি না?

খুব একটা উচ্চাঙ্গের রসিকতা করেছে ভেবে মনে মনে নিজেকেই তারিফ করল হাবিলদারটা। তারপর মোটা পাটকিলে রঙের জিভটা বার করে একচোট হেসে নিল। হাসির দমকে বিরাট দেহটা কাঁপতে লাগল। পাঠানের হাসি, একবার তোড়ে আরম্ভ হলে হঠাৎ থামে না।

সসুরাকা কোঠি! লখাইর কাছে রসিকতাটা নতুন নয়। দেশের কয়েদখানায় মেট, কালাপাগড়ি এবং সিপাইদের মুখে বহুবার শুনেছে।

তবু এই মুহূর্তে অদ্ভুত গলায় লখাই বলল, সসুরাকা কোঠি! কোথায়?

কোনাকুনি আঙুল বাড়িয়ে একটি টিলার মাথায় অনেকগুলো লম্বা তিনতলা বাড়ি দেখাল হাবিলদারটা। বলল, পাক্কা মোকাম, আরামসে থাকবি। তোদের তকদির বহোত আচ্ছা। বলে একটু থামল। ফের একচোট হেসে শুরু করল, ওই মোকামগুলোতে বিটিশ লোক শের পোষ মানায়। সমঝা?

লখাই চুপচাপ দেখতে লাগল।

উপসাগরের নীল জল থেকে খানিকটা ভূখণ্ড বিরাট এক ভ্রুপের মতো কুঁড়ে বেরিয়েছে। সেটাকে পুরোপুরি টিলাই বলা চলে। টিলাটা নারকেল গাছে ছয়লাপ। গাছের ফাঁক দিয়ে উঁচু প্রাচীর দেখা যায়। প্রাচীরের মধ্যে লাল রঙের এক সারি বাড়ি মাথা তুলে রয়েছে।

পাঠান হাবিলদারটা বলল, ওটা হল আন্দামানের কয়েদখানা, উসকো নাম সেলুলার জেল। ওটার অন্দরমে এক হাজার কুঠরি আছে।

লখাই বলল, আপনি সব জানেন হাবিলদারজি?

জরুর। হর মাহিনা তোদের মতো মেহমান নিয়ে আন্দামানে আসছি। আর জানব না! সব কিছু জানি, আন্দামানের সব আমার জান-পয়চান। হাবিলদারের মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটল।

বিহ্বল চোখে সেলুলার জেলটার দিকে তাকিয়ে রইল লখাই। কদিন ধরে বঙ্গে পিসাগরের কালা পানি সমানে দেখেছে সে। ঝড়ের সমুদ্র উন্মাদ হয়ে এলফিনস্টোন জাহাজটাকে এলোপাতাড়ি ঝাঁকিয়েছে। কিন্তু কালাপানি, খ্যাপা তুফান আর উদ্দাম বাতাস লখাইর বুকে তরাস ধরাতে পারে নি। দরিয়া দেখে অন্য কয়েদিরা যখন ডাক ছেড়ে কেঁদেছে, সে তাদের বিদ্রূপ করেছে, ধমকেছে। ডরোকদের ভয় দেখে অশ্রাব্য খিস্তি করছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে অনেক দূরের টিলার মাথায় লাল রঙের কয়েদখানাটা দেখতে দেখতে এমন দুর্দান্ত লখাইর বুকও ছমছম করে উঠল। ভাবল, চিৎকার করে একবার কেঁদে ওঠে, কিন্তু পারল না। তালুটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। গলার মধ্যে একরাশ ধারাল, কর্কশ বালি যেন খরখর করছে। ঢোক গেলা যাচ্ছে না।

হাবিলদারটা বলল, এইবার তোদের নামতে হবে। কুর্তা কম্বল গুছিয়ে নে। বলেই ডান চোখটা কুঁচকে তাকাল। মুখে শয়তানি হাসি দেখা দিল। তারপর কর্কশ, চড়া গলায় সুর তুলে গাইল :

নওজোয়ান আলি যাবে
সসুরাকা কোঠি।
গোস্ত খাবে, খোবানি খাবে
আউর খাবে রোটি।
আন্ধেরা রাতমে মিলবে
সসুরাকা বেটি।

হাবিলদার মোলায়েম স্বরে বলতে থাকে, বহোত আচ্ছা গানা। রোটি মিলবে, খুবানি মিলবে, গোস্ত মিলবে আউর আন্ধেরা রাতে সসুরাকা বেটি ভি মিলবে। আলির বরাত খুব ভাল, কি বলিস লখাই? হাবিলদারকে ডগমগ দেখায়। তেরছা নজরে সে লখাইকে লক্ষ করতে থাকে।

হঠাৎ লখাই বলে বসে, আচ্ছা হাবিলদারজি–

ফরমাইয়ে জনাব–

হাবিলদারের ভাবভঙ্গি দেখে প্রথমে দমে যায় লখাই। কিন্তু তার বোলচালে কোথায় যেন খানিকটা আশকারা রয়েছে। লখাই উৎসাহিত হয়। ইতি-উতি তাকিয়ে বলে, ওই কয়েদখানায় সব কয়েদি থাকে?

প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে হাবিলদার।

লখাই আবার বলে, বলছিলাম, মরদানা কয়েদি তো থাকে, আওরত কয়েদিও থাকে?

এক মুহূর্ত কী যেন ভাবে হাবিলদারটা। তারপর ডান চোখটা আরো কুঁচকে, শয়তানি হাসিটা আরো প্রকট করে ফিসফিস গলায় বলে, মরদানা জেনানা একসাথ থাকলে বোত সুবিধা হয়, তাই না জনাব?

লখাই জবাব দেয় না।

হাবিলদারটা বলতে থাকে, সবাই মিলে একেবারে জাহান্নাম বানানো যায়!

লখাই অস্ফুট শব্দ করল। কী যে সে বলল, ঠিক বোঝা যায় না।

এবার হাবিলদারটা লখাইর কানে মুখ গুঁজে দেয়। বলে, যে কুঠরিতে আপনোক থাকবেন জনাব, সেটার পাশের কুঠরিতে দিলের রোশনি থাকবে।

দিলের রোশনি কে! লখাইর গলায় বিস্ময় ফোটে।

যার খোঁজে জাহাজ ছুঁড়তে ছুঁড়তে আওরত কয়েদিদের ডেকে ঢুকেছিলেন, সেই সোনিয়া।

সোনিয়া!

হাঁ জনাব। হাবিলদার বলে, জনাবের মর্জি হলে জেলার সাহেবকে বলে একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।

লখাই মুখ তোলে।

হাবিলদার বলে, সোনিয়াকে পাশের কুঠরিতে না রেখে একেবারে জনাবের কুঠরিতেই রাখা হবে। ঘাবড়াইয়ে মাত্ বলতে বলতে খসখসে, রুক্ষ গলায় খ্যাখ্যা করে হাসে হাবিলদার। একটু পর সে চলে যায়।

হাবিলদারের কথাগুলো পুরাপুরি বিশ্বাস করতে লখাইর মন সায় দেয় না।

একবার ওপর দিকে তাকাল লখাই। মাস্তুলের ডগায় সেই সাগরপাখিটা বসে রয়েছে। দরিয়ার অগুনতি পাখির মধ্যে সেই পাখিটাকে চিনে নিতে অসুবিধা হল না তার। ডানায় কালো দাগটা পরিষ্কার মনে আছে।

ঝড়ের সমুদ্রে পাখিটা কোথায় যে লুকিয়ে ছিল, কে জানে। হুগলি নদী থেকে যে সিন্ধুশকুন জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে আন্দামান পর্যন্ত এসে পড়েছে, তার জন্য খুনি লখাইর মনে। খানিকটা মায়া হয়ে থাকবে।

সিন্ধুশকুন–দরিয়ার সঙ্গী। একদৃষ্টে পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল লখাই।

খানিক পর পায়ের বেড়ি বাজাতে বাজাতে ভিখন আহির এল। তাকে দেখে লখাই খেপে ওঠে। দাঁত খিঁচিয়ে বলে, আয় শালা, শুয়ারকা বাচ্চা, তোকে কোতল করি।

পোড়া মুখের একটি মাত্র চোখ ঝিকিয়ে উঠল ভিখনের। কিন্তু মুহূর্তের জন্য। তারপরেই বীভৎস মুখটা কাচুমাচু দেখাল। টেনে টেনে বলতে লাগল, এ লখাই ভেইয়া, কী কসুর হল আমার? গালি দিচ্ছিস কেন?

আওরত কয়েদিদের ডেকে, হাবিলদার সিপাইদের নিয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পর এই দু-তিনটে দিন ভিখনের পাত্তা মেলে নি। এত বড় এলফিনস্টোন জাহাজটার কোথায় যে হারামিটা লুকিয়ে ছিল, লখাই তার হদিস পায় নি।

কিছুক্ষণ রক্তচোখে ভিখনের দিকে তাকিয়ে রইল লখাই। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, সিপাইদের নিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিলি কেন?

ভেইয়া, এই জন্যে গোসা হবি না। তোর গোসা দেখলে আমার ডর লাগে। একটু থেমে ভিখন আবার শুরু করে, সিপাই আর হাবিলদারজিরা তোকে খুঁজে না পেয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে কয়েদিলোকের হাড্ডি চুর চুর করে দিল। তা না হলে তুই ভেইয়া আওরত লোকের বেহেস্তে রয়েছিস, আরাম করছিস, তোকে ধরিয়ে দিতে পারি! জানিস না, তোকে কত পেয়ার করি। ডাণ্ডা আর রদ্দা খেয়ে খেয়ে যখন খুন গিরতে লাগল, তখন তুই কোথায় আছিস, বলে দিলাম।

লখাই কথা বলে না। রাগে গরগর করে। উত্তেজিত হয়ে উঠলে তার গলায় একটা শির লাফাতে থাকে।

লখাইর একটা হাত ধরে সমানে তোয়াজ করতে থাকে ভিখন।

হঠাৎ লখাই বলে, তুই কেমন করে জানলি, আমি মাগী কয়েদিদের কাছে গিয়েছিলাম?

পোড়া মুখে অদ্ভুত হাসি ফোটে ভিখনের। একমাত্র চোখটা বুজে তীক্ষ্ণ, রহস্যময় গলায় সে বলে, আমার দিলটা বহুত আজীব চিজ লখাই ভেইয়া। কৌন শালে কয়েদি কোথায় কী কুঁড়ছে, কার মগজে কৌন মতলব ঘুরছে, ঠিক ঠিক মালুম পাই। দাদা রে, তোর সঙ্গে মুল্লুকের কয়েদখানায় তিন সাল কাটালাম। আর তোর দিলের মতলব বুঝব না! কী যে বলিস দাদা! একটু থামে ভিখন, পরক্ষণে ফের শুরু করে, তোকে সেদিন আফিং জুটিয়ে দিলাম। আওরতের খবর বাতালাম। পেটে যখন তোর নেশা ঢুকেছে তখনই জানি আওরত তোের চাই-ই। দ্বিক কি কি–বলে তীক্ষ্ণ গলায় টেনে টেনে হাসে ভিখন।

খানিকটা সময় কাটে।

লখাই ফুঁসতে থাকে। তাকে উত্তেজিত দেখায়। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রুদ্ধ, ভীষণ গলায় সে খেঁকিয়ে ওঠে, কুত্তীকা বাচ্চা।

ভিখন বলে, গোসা করবি না লখাই। নগদ একটা দো-আনি খসিয়ে খবর এনেছি।

কী খবর?

পোড়া, বীভৎস মুখটা কাঁচুমাচু করে ভিখন বলে, খবরটা ভাল না। শুনলে তুই আমাকে রদ্দা হাঁকাবি।

লখাই জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে।

মাঝখানে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ভিখন সরে বসে। তারপর বলে, শুনলে তোর দিলের ধড়কানা বন্ধ হয়ে যাবে।

লখাই গর্জে উঠল, বল শালে—

আওরত কয়েদিদের নাকি আলাদা কয়েদখানা। মরদানা কয়েদিরা সেখানে ঢুকতে পারে না।

হঠাৎ লাফিয়ে উঠে পড়ে লখাই। দুটো থাবা সামনের দিকে বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ভিখন বেড়ি বাজাতে বাজাতে ছুটে পালায়।

আক্রোশে, রোষে এবং উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে লখাই। রক্তাভ চোখ দুটো থেকে ফুলকি ছোটে। দাঁত দিয়ে নিচের পুরু ঠোঁটটা ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে ফেলতে সে চিৎকার করে, শালেকে আবার পেলে বাকি চোখটা উপড়ে নেব। আওরত কয়েদিদের আলাদা কয়েদখানা! দিল্লাগি করার কুঁসতে ফুঁসতে ফের ডেকের ওপর বসে পড়ে লখাই। যেদিকে ভিখন উধাও হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে সমানে চিল্লাতে থাকে।

কদিন অবিরাম জাহাজের দোলানি খেয়েছে। লখাইর মনে হয়, মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে আপনা থেকেই দুলছে, টলছে। জাহাজের দোলানির বিচিত্র এক নেশা আছে।

সেদিন ভিখন খানিকটা আফিম জুটিয়ে এনেছিল। এ ছাড়া জাহাজের এ কটা দিন পেটে এক বিন্দু নেশার চীজ পড়ে নি।

এরই ভেতর কেমন যেন মৌতাত ঘনায়। একটা বুঁদ বুদ ভাব। জাহাজের দোলানি যে এমন সাধের নেশা ধরাতে পারে, লখাই কস্মিনকালে ভাবে নি। আমেজে দু’হাঁটুর ফাঁকে মাথা গোঁজে সে।

জাহাজের চারপাশে সাগরপাখিরা পাক যায়। মাস্তুলের দখল নিয়ে তাদের বিবাদ মুহূর্তের জন্য থামে না। কোনোক্রমে যে পাখিটা মাস্তুলের ডগায় গিয়ে বসে, অন্য হিংসুটে পাখির ধারাল ঠোঁটের ঠোকর খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দখল ছেড়ে দেয়। পাখিদের চেঁচামেচি থামে না। পাখনা ঝাঁপটিয়ে বাতাস তোলপাড় করে তারা একে অপরের ওপর হানা দেয়।

কোনোদিকে তেমন লক্ষ্য নেই লখাইর। হাঁটুর ফাঁকে মাথা রেখে সে আকাশ পাতাল ভাবে।

বিবি বাজারের মোতি, আউটরাম ঘাট, কালাপানির তুফান, সোনিয়া, ভিখন আহির, সেসনস কোর্ট, পাঠান হাবিলদার–নানা ভাবনা, নানা মানুষ মগজে জটলা করে। সবগুলো একাকার হয়ে তালগোল পাকায়। মনে হয়, এক ভাবনার সঙ্গে অন্যটার তিলমাত্র মিল নেই, সামঞ্জস্য নেই। তবু কোথায় যে সোনিয়ার সঙ্গে কালাপানির, জাহাজের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের, বিবিবাজারের মোতির সঙ্গে ভিখন আহিরের, একের সঙ্গে অন্যের একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় যোগাযোগ রয়েছে, ঠিক হদিস পায় না লখাই।

ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। বিড়বিড় করে কী যেন সে বকে। সম্ভবত গালিগালাজই করে। মগজ থেকে দুর্বহ, অসহ্য ভাবনাগুলো ঝাঁকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু যে ভাবনা হাজার থাবায় তাকে ঠেসে ধরেছে তার হাত থেকে এত সহজে রেহাই মেলে না।

মোটর বোটের আওয়াজে মাথা তুলল লখাই। সামনের দিকে নজর পড়ল। আওরত কয়েদিদের নিয়ে মোটর বোটটা জেটির দিকে ছুটেছে।

হঠাৎ দৃষ্টিটা ভীষণ ভাবে চমকে উঠল লখাইর। চোখের চমক মুহূর্তে শিরা-উপশিরা বেয়ে রক্তে রক্তে ছুটে বেড়ায়। মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা কী একটা যেন সড়াৎ করে নেমে যায়। হৃৎপিণ্ডটা তীব্র ঝকানি খেয়ে ঝনঝন করে ওঠে।

চিনতে ভুল হয় নি লখাইর। ঝড়ের সমুদ্রে একটা পুরা রাত যে-নারীর সান্নিধ্যে কাটানো যায়, যে নারীর কোমল হাতের ডলা বুকের তলায় শিরশিরানির লহর তোলে, সে কি দু-দিনেই মন থেকে মুছে যায়!

সোনিয়াকে নিয়ে উপসাগরের নীল জলে সাদা ফেনার রেখা টানতে টানতে মোটর বোটটা দূরে, অনেক দূরে এবারডিন জেটির দিকে চলে গেল। এখান থেকে অস্পষ্ট বিন্দুর মতো দেখায় মোটর বোটটাকে। এতদূর থেকে সোনিয়াকে আর চেনাই যায় না।

একটু পর ডেরিকের পাশ থেকে পাঠান হাবিলদারের বিরাট মুখ দেখা দিল। চিকন গোঁফজোড়া সস্নেহে তোয়াজ করতে করতে সে বলল, এ জনাব, ঘোড়া মেহেরবানি করকে উঠিয়ে। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। এবার পারে নামতে হবে।

লখাই উঠে পড়ল।

কতকালের এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ।

ইতিহাসের সেদিন সৃষ্টিই হয় নি, বঙ্গোপসাগরের অথৈ অতল থেকে দু শ’ চারটি ছোট বড় দ্বীপ এখানে মাথা তুলেছিল। সেদিনের সাল তারিখের নজির কোথাও মেলে না। ভূতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্ববিদরা অনুমান করেছেন, সুদূর অতীতে আন্দামান নিকোবর সুমাত্রা এবং ব্রহ্মদেশ মিলিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে এক অখণ্ড বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ছিল। কালক্রমে সমুদ্রের খেয়ালে মাঝখানের যোগসূত্রগুলি ছিন্ন হয়ে যায়। খণ্ড খণ্ড হয়ে আন্দামান ব্ৰহ্ম নিকোবর সুমাত্রা, সব পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।

এশিয়া মহাদেশের মানচিত্রে দেখা যায়, বিপুল সমুদ্রবক্ষে কয়েকটি নগণ্য বিন্দুর মধ্যেই আন্দামানের অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ। এই দ্বীপমালা ভূগোলের পৃষ্ঠায় অতি সামান্য স্থানই দখল করতে পেরেছে। পূর্বদেশের ইতিহাসে আন্দামানের উল্লেখ নেই বললেই চলে। থাকবেই বা কেমন করে?

এই দ্বীপপুঞ্জে মোগল-পাঠান কোনোকালে তাঁবু ফেলে নি, শক-হুঁন কোনোদিন হানা দেয় নি। ওলন্দাজ-দিনেমার-ইংরেজ-ফরাসি–বিদেশি সওদাগর সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনোদিন এখানে বাণিজ্যপোত ভেড়ায় নি। আরমানিবা হার্মাদ লুটেরারা সম্পদের লোভে আন্দামানের উপকূলে হন্যে হয়ে যোরে নি।

কোনো দিগ্বিজয়ী সম্রাট এই দ্বীপে এসে পূর্বদেশের ভাগ্য নির্ধারিত করে যায় নি। কখনও এখানে সৃষ্টিছাড়া এমন কিছুই ঘটে নি যার চমকে তামাম দুনিয়ার চোখে ধাঁধা লাগবে।

কী আছে এই দ্বীপের যে ইতিহাসে গৌরবান্বিত অধ্যায় যোগ করবে? কিছুই নেই। সম্পদ নেই, যার লোভে দেশ-দেশান্তর থেকে বীর যোদ্ধা আসবে, অশ্বারোহী সৈনিকের তলোয়ারের ফলায় বিদ্যুৎ চমকাবে। বৈভব নেই, যার খোঁজে বণিক সওদাগর এসে বন্দর সাজাবে।

এই দ্বীপের গরিমা নেই, মহিমা নেই, মাহাত্ম্য নেই। সভ্যতার কিংবা সময়ের উত্থানপতনের কোনো দুর্লভ কাহিনীও এখানে পাওয়া যাবে না।

যা আছে, তা হল ছোটবড়-মাঝারি দুশ চারটিদ্বীপ, দৈর্ঘ্যে দু শ’ উনিশ মাইল, প্রান্থে বিশ মাইলের বেশি কোথাও নয়।

বিরাট অজগর-দেহের মতো বঙ্গোপসাগরে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে আন্দামান।

আন্দামানের পাহাড়ি টিলায় গহন অরণ্য, হাজার বছরের বিশাল সব বনস্পতি আর কূলে কূলে ঘোড়র ক্ষুরের আকারে নীল জলের উপসাগর। দূরে নিঃসীম সমুদ্র, নাম আন্দামান সী। সমুদ্রের বুকে কালো জলরাশি, পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গ আর অবিরাম গর্জন।

আন্দামানের অরণ্য-উপসাগর, পাহাড়-সমুদ্রই শুধু নেই, মানুষও আছে। তোমার আমার জানাশোনা মানুষের সঙ্গে এইসব মানুষের মিল নেই। এই মানুষের রক্তে-মাংসে-অস্থিতে শুধু লালসা। কামে-মত্ততায়-প্রতিহিংসায় এই মানুষ কুটিল, কঠোর, ভয়াল, ভীষণ। মানচিত্রের কয়েকটি বিন্দুতে এই মানুষের অস্তিত্ব নেই। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এই মানুষের উল্লেখ আছে, কিন্তু আদত পরিচয় নেই।

ভারত-ব্রহ্মের মূল ভূখণ্ড থেকে কয়েক শ’ মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালা। প্রতি মাসে জাহাজে ভরে যাদের এখানে পাঠানো হয় তারা দস্যু, হত্যাকারী, লুটেরা। তাদের কেউ কেউ দীর্ঘ মেয়াদের, আর কেউ কেউ যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আসামী।

এখানে সৎ ভদ্র সুস্থ মানুষ কস্মিনকালেও আসে না। আন্দামানের নামে অনেক দূরের শান্ত মানুষের পৃথিবী শিউরে ওঠে।

ভয়ঙ্কর সব হননকারী। তাদের উপদ্রবে মেইনল্যান্ডের মানুষের ধনপ্রাণের নিরাপত্তা ছিল না। আতঙ্কে লক্ষপতি শেঠের চোখে ঘুম আসত না। আশঙ্কায় কোনো সওদাগর রাতের দিকে বাণিজ্যবহর ভাসাত না। সুন্দরী রমণী দিবারাত্রি ঘরে খিল দিয়ে থাকত। নারী এবং সম্পদের সন্ধানে তারা হন্যে হয়ে ঘুরত। শৃঙ্খলা এবং শান্তি ভেঙে ফেলার মধ্যেই তাদের যত উল্লাস, সভ্য দুনিয়ার সব কানুন তছনছ করে অরাজকতা চালানোর মধ্যেই যত নেশা।

আইনের বিচারে জীবন থেকে তারা বাতিল হয়ে গিয়েছে। সৎ মানুষের আদালত তাদের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দিয়েছে। অনেক দূরের সমুদ্রে তাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তোমার আমার পৃথিবী নিশ্চিন্ত হয়েছে, স্বস্তি পেয়েছে।

আঠারো শ’ আটান্ন সালে ডক্টর জে পি ওয়াকার সেই যে দু শ’ কয়েদি নিয়ে আন্দামান এসেছিলেন, তারপর কত বছর পার হয়ে গিয়েছে। কত কয়েদিই না এসেছে! জটিল অরণ্য নির্মূল করে এই দ্বীপে তারা স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলেছে।

আশ্চর্য, এই সব কয়েদিরও জীবন আছে। সে জীবনের একটা নির্দিষ্ট রীতিও আছে। আন্দামানের কয়েদির জীবন তোমার আমার কি আর দশজন ভদ্র সন্তানের জীবন যে খাতে বয়, সে খাতে চলে না।

এ জীবন অদ্ভুত, বিচিত্র।

তোমার আমার অন্তরাত্মা যে জীবনযাপনের কল্পনায় শিউরে ওঠে, এ জীবন হুতা-ই। তোমার আমার পৃথিবীকে নিঙড়ে যে পুঞ্জীভূত ক্লেদ তলানির মতো পড়ে থাকে, তা দিয়ে এই জীবনের সৃষ্টি।

এ-জীবন যে খাত বেয়ে চলে, সেটি হল ক্ষুধার খাত, দৈহিক এবং জৈবিক ক্ষুধা। যে রীতি মেনে এ-জীবন চলে তা হল লালসা-কাম-মত্ততার রীতি।

তীব্রস্বাদ খাদ্যে, উগ্র উত্তেজক মদে চরসে পিনিকে এবং কামাতুর নারীমাংসে এই জীবনের চরিতার্থতা। কিন্তু তেমন খাদ্য নেশা এবং নারীদেহ কোথায় মিলবে এই দ্বীপে? যে সামান্য কয়েকটি আওরত কয়েদি রয়েছে সাউথ পয়েন্ট জেলখানায়, সেখানে ঘেঁষার হুকুমও নেই, উপায়ও নেই। বিরাট বিরাট প্রাচীরের আড়ালে সিপাইদের পাহারায় তারা থাকে।

এইদ্বীপের নেশাহীন নারীসঙ্গহীন নিরুৎসব জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে। বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্নভাবে কাটিয়ে কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে যায়, কেউ কেউ সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়।

ভারত-ব্রহ্মের মূল ভূখণ্ড থেকে এখানে দ্বীপান্তরের সাজা ভোগ করতে আসার পথে কয়েদি তার অতীত, তার মনের সুকুমার বৃত্তিগুলি (যদি কিছু থেকে থাকে) দরিয়ার জলে ডুবিয়ে আসে।

এ এক নিদারুণদ্বীপ। এখানে স্নেহ নেই, মমতা নেই। আছে শুধু গ্লানি আর নৃশংসতা।

শান্তির ঈশ্বর, ন্যায়ের ঈশ্বর, সতোর ঈশ্বর কোনো কালে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এই দ্বীপে আসে না। পৃথিবীর সব মাধুর্য, মমতা, প্রেম থেকে ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপ অনেক, অনেক দূরে পড়ে আছে।

বঙ্গোপসাগরের জলে মরশুমে মরশুমে কত ঝড় বয়ে যায়, কত তুফান ওঠে। তবু মাসে মাসে এখানে কয়েদি আসার বিরাম ঘটে না। আর দিনের পর দিন এইদ্বীপ তোমার আমার মতো সৎ এবং ভদ্র মানুষের মনে আরো বিভীষিকা, আরো রহস্য ঘনিয়ে তোলে।

নারী কয়েদি নিয়ে মোটর বোটটা এবারডিন জেটিতে এসে ভিড়ল। পুরনো পুরুষ কয়েদিদের যে জটলাটা জেটির এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, হঠাৎ সেটা মিলেমিশে একাকার হয়ে মোটর বোটের ওপর হুড়মুড় করে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। একসঙ্গে অনেকে মুখে আঙুল পুরে সিটি দিয়ে উঠল।

তুমুল হল্লা শুরু হয়ে গেল। কনুই দিয়ে ঠেলে গুতিয়ে সবাই মোটর বোটে উঠতে চায়।

মোটা, কর্কশ গলায় এক কয়েদি বলল, খুবসুরতী জেনানা—

অন্য একজন বলল, উ আওরত মেরা দিলকে রানী—

দুটো টিণ্ডাল আর তিনটে পেটি অফিসার হুমকে উঠল, উল্লুকা বাচ্চা, চিল্লাও মাত্। হঠ–হঠ–

অনেক, অনেকদিন পর এই দ্বীপে নারী কয়েদি এসেছে। এখানকার বাতাসে নারী দেহের গন্ধ নেই, এখানে নারী একান্ত দুর্লভ।

কতদিন যে এইসব কয়েদি নারীমাংসের স্বাদ পায়নি! যারা এইদ্বীপে দীর্ঘদিনের মেয়াদ খাটছে, তারা কেউ কেউ মেয়েমানুষ না দেখে দেখে তাদের চেহারানমুনাই ভুলতে বসেছে।

এই মুহূর্তে মেয়ে কয়েদিদের দেখতে দেখতে তাদের শিরায় শিরায় এতকালের বুভুক্ষু লালসা দাপাদাপি শুরু করে দিল। রক্তের কণিকাগুলি সরীসৃপের মতো কিলবিল করতে লাগল।

সকলেই মোটর বোটে লাফিয়ে পড়তে চায়। হল্লা তুমুল হয়ে উঠতে থাকে।

পেটি অফিসার, টিণ্ডাল সমানে চিল্লায়, হঠ, হঠ গাদ্ধেকো পাটঠে। আওরত দেখলে শালেরা পাগলা বনে যায়।

সত্যিই, মেয়েমানুষ দেখলে তারা উন্মাদ হয়ে ওঠে। পেটি অফিসার আর টিণ্ডালদের ধমকে, হুমকিতে তারা এক ইঞ্চিও পিছু হটে না।

কেউ কেউ আওরত কয়েদিদের দিকে হাত বাড়িয়ে কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি করে। শিস দেওয়া চলছেই। কেউ কেউ ডাকে, এই মেরে পেয়ারে, এই লম্বরদারনী–ইধার–হাঁ হাঁ–

এ কয়েদানি, মেরে জান–মেরে দিলজ্বালানেবালী–

এবারডিন জেটিতে খিস্তি-খেউড়ে, শিসে, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গিতে অশ্লীল রস গেঁজে উঠতে থাকে।

রশিম্যান দড়িদড়া দিয়ে মোটর বোটটাকে জেটির সঙ্গে বেঁধে ফেলল। বোটের সঙ্গে জেটির ফারাক আর নেই।

কয়েদিদের জটলাটাকে ভেঙে ছত্রখান করে একেবারে সামনে এগিয়ে এল চান্নু সিং। প্রথমে চিৎকার করে উঠল, ওয়া গুরুজিকা ফতে–

চান্নু সিং-এর চিৎকারে পুরুষ কয়েদিদের হল্লা মুহূর্তের জন্য থামল। মোটর বোটে মেয়ে কয়েদিরা চমকে তাকাল। দেখল, বিকট চেহারার এক শিখ পারে দাঁড়িয়ে আছে।

গুরুজির নাম নেওয়ার পর যতখানি সম্ভব গলাটাকে নরম করে চান্নু সিং হাঁকল, কৌন রে সোনিয়া? সোনিয়া কৌন?

সোনিয়া শিউরে উঠল। জবাব দিল না।

একের পর এক কয়েদিনীদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে চান্নু সিং হাঁকতে লাগল, তুই সোনিয়া? তুই? তুই?

কেউ জবাব দেয় না। বসে বসে শুধু চাল্লু সিং-এর কাণ্ড দেখে। তাদের চোখের পাতা পড়ে না।

রোমশ বুক, বিশাল চেহারা, চওড়া কাঁধ, থলথলে মাংসল উদরের চান্নু সিং এবার উত্তেজিত, অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। বলল, শালীলোগ, কথা বলছিস না কেন? কৌন সোনিয়া, জলদি বাতাও। না বাতালে

শাসানির সবটা মুখ থেকে বার হল না চান্নু সিং-এর। তার আগেই চিৎকার শুরু হল। পুলিশ আ গিয়া–

কয়েদিরা জটলা ভেঙে চতুর্দিকে ছুটতে লাগল।

উঁচু টিলার মাথায় কয়েদখানা। তার পাশেই লম্বা লম্বা ব্যারাক। এগুলো বিজন। বিজনগুলোর পাশ দিয়ে ঢালু উতরাই বেয়ে জনকতক পুলিশ আর একটা হাবিলদার এবারডিন জেটিতে এসে পড়ল।

কয়েদিরা দূরে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। ভাবগতিক সুবিধাজনক বুঝলে সামনে এগোবে।

চান্নু সিং এবং আরো দু-পাঁচজন কয়েদি, নারীমাংস সম্বন্ধে যাদের কোনোকালে উৎসাহের খামতি নেই, তারা জেটি ছেড়ে নড়েনি।

হাবিলদার দাঁত খিঁচিয়ে বলল, বেশরম কুত্তীকা বাচ্চা, ভাগ এখান থেকে।

দুর্বিনীত ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল চান্নু সিং। রক্তাভ চোখজোড়া ঝকঝক করে উঠল তার। ভাগবার কোনো লক্ষণই সে দেখাল না।

হাবিলদার ফের হাঁকল, কুত্তীকা বাচ্চা, হঠ হিঁয়াসে–

না–

না! কিঁউ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল হাবিলদার।

সোনিয়া এসেছে, আওরত কয়েদানী। উসীকো আমি শাদি করব। শুনছি বহুত খুবসুরতী লেড়কি–

শাদি করবি! পুলিশদের দিকে তাকিয়ে হাবিলদার গর্জে উঠল, শালার মুখ তোড় দো, ডাণ্ডা হাঁকিয়ে পাছা ঢিলা কর দো–

পুলিশগুলো যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। হুকুম পাওয়ামাত্র চার পাঁচটা পুলিশ চান্নু সিং এর পিঠে বুকে মাথায় ডাণ্ডা চালাতে লাগল।

অন্য কটা পুলিশ চান্নু সিং-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কেউ কুর্তার হাত ধরে, কেউ গর্দান পাকড়ে, কেউ পায়জামার রশি ধরে টানতে টানতে তাকে জেটির বাইরে নিয়ে এল। গতিক গড়বড় বুঝে যে দু-পাঁচ জন চান্নু সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চক্ষের পলকে নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়েছে।

চান্নু সিং-এর কপাল আর থুতনি ফেটে রক্ত ঝরছে। রোমশ বুকটা ভিজে গিয়েছে। গলার মোটা হাড় ফুলে উঠেছে। ভুরুটা কেটে একদলা মাংস চোখের ওপর ঝুলছে। হাউ হাউ করে বিকট অঙ্গভঙ্গি করে কাঁদছে চান্নু সিং। আর সমানে অশ্রাব্য খিস্তি করছে, হারামি, তেরি

আরো খানিকটা পর সাউথ পয়েন্ট জেলখানা থেকে মেম জেলার এলেন।

এবার একে একে মেয়ে-কয়েদিরা এবারডিন জেটিতে নামতে লাগল।

চান্নু সিং দৌড়ে লাফিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছিল। পুলিশের এলোপাথাড়ি ডাণ্ডা খেয়ে তাকে পিছু হটতে হল।

বান্দা নওয়াজ খান জেটির একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধীরে ধীরে কয়েদিনীদের কাছে এগিয়ে এলেন। একে একে সকলের নাম জিজ্ঞেস করলেন। মুলুকের খোঁজ নিলেন। কার সাজার মেয়াদ কত বছর, দেশ-গাঁওয়ে স্বজন-পরিজন-রিস্তাদার, কার কে কে আছে, সব খবর নিলেন। সিপাই, হাবিলদার, টিণ্ডাল, পেটি অফিসার বা মেম জেলার–কেউ তাঁকে বাধা দিল না।

আঠার শ’ আটান্নতে ওয়াকার সাহেবের সঙ্গে যে দু শ’ কয়েদি এই দ্বীপে প্রথম এসেছিল, নওয়াজ খান সে দলে ছিলেন। আন্দামানের মাটিতে তার তিপ্পান্নটা বছর কাটল। এই দ্বীপের সবাই তাকে খাতির করে, সম্ভ্রম জানায়।

মাসে মাসে জাহাজ ভরে যে-সব কয়েদি এইদ্বীপে সাজা ভোগ করতে আসে, জেটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের নাম-ধাম-মুলুকের খোঁজখবর নেন। সকলের সঙ্গে জান পয়চান করেন। তিপ্পান্ন বছরে অভ্যাসটা পাকা হয়ে গিয়েছে।

সূর্যটা সরাসরি মাথার ওপরে চলে এসেছে। উপসাগরের নীল জল ঝকমক করছে। তীরের কাছে উড়ুক্কু মাছগুলো জল কেটে কেটে খানিকটা ছুটেই সমুদ্রে অদৃশ্য হচ্ছে।

এই সময় সিপাই, হাবিলদার, টিণ্ডাল, পেটি অফিসারদের পাহারায় মেয়ে-কয়েদিরা সাউথ পয়েন্ট জেলখানার দিকে রওনা হল।

অর্ধবৃত্তাকার উপসাগর। কিনারে পাথরের পর পাথর গেঁথে সমুদ্র বাঁধা হয়েছে। সমুদ্র কি বশ মানতে চায়? অথৈ দরিয়া থেকে দুর্জয় তরঙ্গমালা ছুটে এসে পাথরের দেওয়ালে আছাড় খায়।

উপসাগরের পাশ দিয়ে পাথর-কাটা সড়ক। সড়কটা সোজা সাউথ পয়েন্ট জেলখানায় ঢুকেছে।

কয়েদিরা চলেছে। তাদের পাশে পাশে সিপাই, হাবিলদার, পেটি অফিসার, টিণ্ডালরা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর চলেছে চান্নু সিং। অন্য কয়েদিরাও একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে।

হঠাৎ চান্নু সিং মরিয়া হয়ে উঠল। পাহারাদারদের ধাক্কা মারতে মারতে একেবারে কয়েদিনীদের কাছে এসে পড়ল।

পুলিশ, পেটি অফিসাররা টেনে হেঁচড়ে, ধাক্কা মেরে তাকে এতটুকু হটাতে পারল না। শেষ পর্যন্ত চান্নু সিং-এর ওপর ডান্ডার পর ডাণ্ডা পড়তে লাগল। হাড্ডি ফাটল, নাক বাঁকল, শির ভেঁচল, কাধ তুবড়ে গেল। তবু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই চান্নু সিং-এর। দু’হাত বাড়িয়ে ডাণ্ডা ঠেকাতে ঠেকাতে সে কয়েদিনীদের দিকে চোখ রেখে চিল্লাতে লাগল, এই, তোর নাম কী?

রূপীবাঈ।

না না, তুই না। আর একজনের দিকে হাত বাড়াল চান্নু সিং। তুই, তুই কৌন?

মোতিবিন বিবি।

এবার অন্য একজনকে চান্নু সিং বলল, জরুর তুই সোনিয়া—

নেহী। আমি প্রেমা—

চড়া গলায় চান্নু সিং খেঁকিয়ে উঠল, শালী, তোকে কৌন মেঙেছে? সোনিয়া কৌন বাতিয়ে দে–

মুখে চোখে সমানে ডাণ্ডা পড়ছে চান্নু সিং-এর। চামড়া ফেটে ফিনকি দিয়ে তাজা রক্ত ছুটছে। তবু সে পিছু হটে না। কাঠের চিরুনি দিয়ে লম্বা লম্বা চুলগুলো আটকানো ছিল। ডাণ্ডার বাড়িতে দুখণ্ড হয়ে গিয়েছে চিরুনিটা। এলোমেলো চুল বাঁধনমুক্ত হয়ে মুখের ওপর লুটোচ্ছে। উন্মত্তের মতো টলতে টলতে এগোচ্ছে চান্নু সিং। এই মুহূর্তে একটা রক্তাক্ত জানোয়ারের মতো দেখায় তাকে।

এত মার খেতে দেখে ঈষৎ নরম হল সোনিয়া। ধারীওয়ালা কুর্তার নিচে ঘাতক কয়েদিনীর আওরতী দিলটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। সে বলে ফেলল, আমি, আমি সোনিয়া। কী দরকার?

তুই! গাঢ় স্বরটা খাদে নামিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করেই থেমে গেল চান্নু সিং। একদৃষ্টে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

চিকন মাজার ওপর সুঠাম মাংসল শরীর। কালো মসৃণ চামড়ায় এমন চকমকানি যে চোখে ধাঁধা লাগায়। সোনিয়ার চোখের সাদা অংশে আড়াআড়ি লাল দাগ। টান টান ধনুকের মতো বাঁকানো ভুরু দুটো যেখানে এসে জোড়া লেগেছে, সেখানে শ্বেতির চিহ্ন।

মাজা বাঁকিয়ে চুরিয়ে এগিয়ে চলেছে সোনিয়া।

সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিশেষ কিছুই দেখছিল না চান্নু সিং। মেয়েমানুষটার বুকের দু পিণ্ড টাটকা, কঠিন মাংস আর সুডৌল পাছার দোলানির সঙ্গে তার চোখজোড়া সামনে পেছনে ছোটাছুটি করতে লাগল। গালের দুকশ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। ভাঙাচোরা কদাকার দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে। গলার ভেতর থেকে গোঙানির মতো একটা আধফোঁটা জান্তব আওয়াজ বেরুচ্ছে।

রক্তাক্ত বীভৎস মুখে হাসছে চান্নু সিং। অদ্ভুত হাসি। উল্লাসের সঙ্গে সে হাসিতে তীব্র যন্ত্রণাও মিশে রয়েছে।

চান্নু সিং বলতে লাগল, হে হে, মুন্সিজি ঠিক খবর দিয়েছে। তুই বহুত খুবসুরতী। আমি সিরকারের (সরকারের) টিকিট পেয়েছি। তোকে শাদি করব। জরুর–

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ডাণ্ডা পড়ল মুখে। নিচের পাটিতে একটা দাঁত কটাং করে ভেঙে গেল। গলগল করে রক্ত ছুটছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল চান্নু সিং।

সোনিয়ারা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। মুখে হাত চেপে একসময় চান্নু সিং উঠে দাঁড়ায়। তারপর ছুটতে ছুটতে মুহূর্তের মধ্যে নারী কয়েদিদের আরো কাছাকাছি চলে আসে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল সোনিয়া। বলল, কেন আসছ মরদ? ডাণ্ডা খেয়ে খেয়ে খতম হয়ে যাবে যে।

কপাল আর ভুরু ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। মোটা পাটকিলে রঙের জিভ বার করে সেই রক্ত চাটতে চাটতে চান্নু সিং হাসল। সে হাসি বড় করুণ, বড় নরম। যে-হাসিতে তাজা গাঢ় রক্তের স্বাদ মিশে থাকে, তার রকমই আলাদা। চান্নু সিং হাসতে লাগল।

সোনিয়া আবার বলল, তুমি ফিরে যাও মরদ। আমার পিছু পিছু এসে ডাণ্ডা খেয়ে কৌন ফায়দা?

বিরাট আকারের চান্নু সিং এবার বলে, বহুত ফায়দা সোনিয়া। সে তুই সমঝবি না। বলে চান্নু সিং ফের হাসতে থাকে।

সোনিয়া জবাব দেয় না। চান্নু সিং আবার বলে, ইয়াদ রাখিস সোনিয়া, বিলকুল ইয়াদ রাখিস, তোর জন্যে আমি বহুত খুন দিলাম।

সোনিয়া এবারও কথা বলে না। অন্য কয়েদিনীদের সঙ্গে পা মিলিয়ে সাউথ পয়েন্ট জেলখানার দিকে এগিয়ে যায়।

এবারডিন জেটি থেকে সাউথ পয়েন্ট জেলখানায় যাওয়ার সড়কটা ফুরিয়ে এসেছে। সামনেই কয়েদখানার ফটক। হঠাৎ ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে চান্নু সিং। ডাকে, এ সোনিয়া–

ক্যা?

আমার সিরকারি টিকিট মিলেছে। এবার শাদি করতে পারব। তোকে ছাড়া আর কাউকে শাদি করব না। একটু থামে চান্নু সিং। হাঁপায়। ঘন ঘন শ্বাস টেনে দম নেয়। বলে, শাদির প্যারিডের সময় আমি আসব। আমার শিরে লাল সাফা (পাগড়ি) থাকবে। ইয়াদ রাখিস, চিনতে ভুল করিস না সোনিয়া। গুরুজি কসম, তোকে না পেলে আমার জান বরবাদ হয়ে যাবে।

চান্নু সিং-এর রক্তাক্ত, বীভৎস মুখটা এই মুহূর্তে বড় কোমল দেখায়।

সোনিয়া শব্দ করে না। তার ঠোঁট দুটো বিচিত্র হাসিতে বেঁকে যায়। চোখের কোণে কী যেন ঝিলিক হানে। যে নারী কোতল করে দ্বীপান্তরে এসে চান্নু সিং-এর মতো জবরদস্ত মরদের এত খুন আর কাতরতা দেখেও মুখ বুজে, ঠোঁট টিপে হাসে, তার দুয়ে দুর্বোধ্য হৃদয় কী দিয়ে গড়া, কে বলবে। সোনিয়ার মনে কী আছে, কে জানে!

অন্য পুরুষ কয়েদিরা একটু দূর দিয়ে আসছিল। আচমকা তারা হল্লা বাধিয়ে দিল। কয়েদিনীদের লক্ষ করে বলতে লাগল, এ আওরত, শাদির প্যারিডের সময় হামি ভি আসব। এই দ্যাখ হামার হাতে পিত্তলকা আঙ্গুটি, নীলা পাথর।

এ মহবৃতকা পেয়ারী, আমিও আসব। আমার গোরে (পায়ে) থাকবে লোহার কাঙ্গন (কঙ্কণ)। ইয়াদ রাখিস।

হামি ভি আসব—

হামি ভি আসব–

হল্লা তুমুল হয়ে উঠতে লাগল।

কয়েদিরা কয়েদিনীদের কাছাকাছি ঘেঁষে এসেছে। সিপাই, পেটি অফিসাররা ডাণ্ডা হাঁকিয়ে ফের তাদের হটিয়ে দিল।

একটু পর সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় ঢুকে গেল সোনিয়ারা। চান্নু সিংও তাদের সঙ্গে ফটকের ভেতর চলে আসছিল। দুটো টিণ্ডাল আর তিনটে পেটি অফিসার হাত-পা-গলা ধরে টানতে টানতে তাকে বাইরে নিয়ে এল।

জেলখানার ফটকের পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল। জ্বলন্ত চোখে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার দিকে তাকিয়ে রইল চান্নু সিং।

এ-বেলা পুরুষ কয়েদিদের জাহাজ থেকে নামানো হবে না।

এবারডিন জেটি থেকে জটলাটা ভেঙে যেতে শুরু করল।

রোদের তেজ এখন মারাত্মক। উপসাগরের শান্ত জল ফুলতে শুরু করেছে। বিরাট বিরাট ঢেউগুলো ফুঁসতে ফুঁসতে পাথরের দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

দূরের এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বান্দা নওয়াজ খান। সবুজ রঙের জাহাজটা উপসাগরের জলে মৃদু মৃদু দুলছে। ফোরমাস্টের মাথায় সাগরপাখিগুলোকে সাদা-সাদা বিন্দুর মতো দেখায়।

বিশ বছর আগের একটা দিনের কথা ভাবছিলেন বান্দা নওয়াজ খান। আজ যেখানে এলফিনস্টোন জাহাজটা অল্প অল্প দুলছে, সেদিন ওখানেই নোঙর ফেলেছিল আর একটা জাহাজ। নামটা নির্ভুল মনে আছে তার। এস. এস. ম্যাককয়। ম্যাককয় জাহাজের সাদা রংটাও তিনি ভোলেননি।

বিশ বছর পরও এস. এস. ম্যাককয় নওয়াজ খানের স্মৃতিতে হুবহু একই রকম রয়েছে, এতটুকু বিবর্ণ হয়নি। না হওয়ারই কথা। ওই জাহাজেই সুন্দর খান আন্দামানে এসেছিল।

নওয়াজ খান সেই দিনটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। বিশ বছর আগের একটা অদ্ভুত দিন।

সেদিন উপসাগরের নীল জল আশ্চর্য শান্ত। মাস্তুলের মাথায় এক ঝাক সাগরপাখি নিয়ে মৃদু মন্থর গতিতে ম্যাককয় জাহাজ সিসোস্ট্রেস বের মধ্যে ঢুকে পড়ল। নোঙর ফেলার আগে উপসাগরটাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে ভো বাজল।

সেদিন মাথার একটা চুলও পাকেনি নওয়াজ খানের। শরীরে বয়সের কুঞ্চন দেখা দেয়নি। অটুট মেরুদণ্ডের ওপর ঋজু, সুন্দর চেহারা। পরনে কলিদার কুর্তা, ঢোলা পাজামা, সুর্মা-আঁকা চোখ-লম্বা শৌখিন নওয়াজ খান অভ্যাসবশে সেদিন এবারডিন জেটিতে এসেছিলেন।

ভাবনায় ছেদ পড়ল। কে যেন পাশ থেকে তাকে ডেকে উঠল। নওয়াজ খান ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন হানিফ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হানিফ আবার ডাকল, আব্বাজান–

কী বলছ?

আম্মা আপনাকে যেতে বলেছেন।

তুমি যাও, আমি পরে যাব।

নওয়াজ খান ফের উপসাগরের দিকে তাকালেন।

এবারডিন জেটিটা এখন একেবারে নির্জন। নতুন কয়েদিদের দেখার জন্য যেসব পুরনো কয়েদি ভিড় জমিয়েছিল, কয়েদিনীদের সঙ্গে সঙ্গে তারা সাউথ পয়েন্ট জেলখানার দিকে চলে গিয়েছে।

পাথরের জেটিটার ওপর বিরাট বিরাট ঢেউ বিচিত্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নোনা জল ছিটকে নওয়াজ খানের পাজামা কুর্তা ভিজিয়ে দিচ্ছে। এখন কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার।

কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে হানিফ ফের ডাকে, আব্বাজান—

চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন নওয়াজ খান। বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি এখনো যাও নি?

না।

কেন?

আম্মা আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছেন।

তুমি বহুত বেতর্বিয়ত হয়েছ। নাও, চল। একটু থেমে নওয়াজ খান করুণ গলায় বললেন, এ জিন্দগিতে আর শান্তি মিলবে না। সবই খুদার মর্জি।

হানিফের পেছন পেছন বান্দা নওয়াজ খান চলতে লাগলেন।

যে সড়কটা অ্যাটলান্টা পয়েন্টে বাঁক নিয়ে উপসাগরের পার দিয়ে সিধা ফিনিক্স বের দিকে চলে গিয়েছে, সেখানে এসে পড়লেন দুজনে। বাঁ পাশে উঁচু টিলার মাথায় সেলুলার জেল। টিলার গায়ে নারকেল বন আর হাওয়াই বুটির জঙ্গল। সমুদ্র ফুড়ে ঝড়ো বাতাস উঠে আসে, নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে সনসনিয়ে ছোটে। ডান পাশে পাথরের দেওয়াল সড়কের সঙ্গে সঙ্গে এঁকেবেঁকে ফিনিক্স বের দিকে চলে গিয়েছে।

উপসাগর মেতে উঠেছে। অনেক দূর থেকে মাথা উঁচু করে দুর্জয় তরঙ্গমালা ছুটে আসে, পারের পাথুরে দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লবণ জল ফেনিয়ে ওঠে।

অ্যাটলান্টা পয়েন্টের এই পথটা নির্জন। উপসাগরের ঢেউ এবং বাতাসের গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

নওয়াজ খানের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন সুন্দর খান ম্যাককয় জাহাজে আন্দামান এসেছিল। বিশ বছর আগের সেই দিন।

নতুন কয়েদি এসেছে। তাই এবারডিন জেটিতে সেদিনও বিরাট জটলা।

সিসোস্ট্রেস বেতে জাহাজ ঢুকবার কিছুক্ষণ পরই নতুন কয়েদিদের নামানো হয়েছিল। সব পরিষ্কার মনে আছে নওয়াজ খানের।

বেড়ি বাজাতে বাজাতে নতুন কয়েদিরা সেলুলার জেলের দিকে চলেছে। অনেক দিনের অভ্যাস। নওয়াজ খান কয়েদিদের নাম-ধাম, দেশগাঁও, মুল্লুক, সাজার মেয়াদ, কে কোন ধারার আসামী–সব খবর নিচ্ছিলেন।

মিছিলের মতো সারি দিয়ে কয়েদিরা চলেছে।

সকলের পেছনে সেই কয়েদিটি এসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নওয়াজ খান। দৃষ্টি ফেরাতে পারেননি।

টকটকে রং, টান টান চেহারা, থরে থরে পেশিগুলো সুন্দর ভাবে সাজানো। মজবুত গর্দান, শক্ত কবজি, একজোড়া দীর্ঘ চোখ, ধারাল নাক, চওড়া কপাল। খাড়া চোয়ালে দৃঢ়তা, থুতনিতে একটি মনোরম খাঁজ। এই হল সুন্দর খান। যে-চেহারা চোখকে সুখ দেয়, এ সেই চেহারা। কালাপানি পাড়ি দিয়ে যে-সব দুর্ধর্ষ হত্যাকারী আন্দামানে দ্বীপান্তরের মেয়াদ খাটতে আসে, তাদের সঙ্গে এ চেহারা আদৌ মেলে না।

মুখময় দাড়িগোঁফ, রুক্ষ অবিন্যস্ত চুল। তবু দেখেই মালুম হল, খানদানি ঘরের ছেলে।

নওয়াজ খান জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার নাম কী?

সুন্দর খান।

ক’সালের মেয়াদে এসেছ?

তামাম জিন্দেগির।

কোন ধারার আসামী?

তিন শ’ দো ধারার।

একটু দম নিয়ে নওয়াজ খান বলেছিলেন, কোতল করে এসেছ?

না। কোতল আর করতে পারলাম কই? সুন্দর খানের চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠেছিল।

বিশ বছর পরও অ্যাটলান্টা পয়েন্টের এই পাথুরে পথ ধরে চলতে চলতে অবিকল মনে করতে পারছিলেন নওয়াজ খান। স্মৃতিটা এতটুকু ফিকে হয়ে যায়নি।

হঠাৎ পেছন থেকে হানিফ ডাকল, আব্বাজান—

নওয়াজ খান চমকে উঠলেন।

ভীরু গলায় হানিফ আবার বলল, ফজিরে রোশন বহিন কাঁদছিল।

নওয়াজ খান একবার হানিফের দিকে তাকালেন। তারপরেই মাথা নিচু করে এগোতে লাগলেন। ভগ্ন, জড়িত স্বরে কী বললেন, বোঝা গেল না।

হানিফ ফের বলল, লুকিয়ে লুকিয়ে রোশন বহিন রোজ কাঁদে।

নওয়াজ খান সব জানেন। তার দিল মুচড়ে মুচড়ে অনেক দীর্ঘশ্বাস এইদ্বীপের বাতাসে মিশেছে। রোশনের চোখ থেকে অনেক আঁশু এই দ্বীপের মাটিতে ঝরেছে। তবুও সুন্দর খান ফেরেনি।

নওয়াজ খান জানেন, একদিন তার বুক মুচড়ে আর দীর্ঘশ্বাস বেরুবে না, রোশনের আঁখ থেকে আঁশু ঝরবে না। সব দীর্ঘশ্বাস, সব আঁশু ফুরিয়ে যাবে। একদিন তারা এই দ্বীপের মাটিতে মিশে যাবেন। সেদিনও সুন্দর খান ফিরবে না।

পাঁচ বছর আগে এই দ্বীপ ছেড়ে মেইন ল্যান্ডে চলে গিয়েছিল সুন্দর খান। তারপর কতবার জাহাজ এল, কতবার গেল, তবু সে ফিরল না। এই পাঁচ বছরে কোনো খোঁজখবর মেলেনি সুন্দর খানের, আর মুহূর্তের জন্য রোশনের আঁখও শুকনো থাকেনি।

সুন্দর জরুর ফিরবে–নওয়াজ খান অনেক আশ্বাস দিয়েছেন রোশনকে, অনেক ভরসা দিয়েছেন। এই পাঁচ বছরে সিসোস্ট্রেস উপসাগরে যতবার জাহাজ এসে নোঙর ফেলেছে, ততবার অনেক আশা নিয়ে এবারডিন জেটিতে ছুটে গিয়েছে। প্রতি মাসে কত নতুন কয়েদি এসেছে, নতুন মানুষে এই দ্বীপ ভরে গিয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ সুন্দর খানের খবর দিতে পারেনি।

সব কয়েদি যখন কয়েদখানায় চলে গিয়েছে, যখন এবারডিন জেটিতে একটি মানুষও আর নেই, দুর্বল পায়ে টলতে টলতে নিঃশব্দে কুঠিতে ফিরেছেন নওয়াজ খান। কারো সঙ্গে একটি কথা বলেননি। কপাট বন্ধ করে ছটফট করে কাটিয়েছেন। আর দিল নেই, দরদ নেই, ইমান নেই যে হৃদয়হীন জানোয়ারটার, তার কথা ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় যন্ত্রণায় ঘরময় ছুটোছুটি করেছেন। অথচ বিশ বছর আগে এই সুন্দর খানকে কি ভালই না লেগেছিল তার!

সেদিন নওয়াজ খান জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোতল করতে গিয়েছিলে কেন?

যাব না? পেশল গর্দান ঘুরিয়ে গর্জে উঠেছিল সুন্দর খান, আমার আব্বাজান ছিল রিসালদার সিপাহি। সিপাহিদের সঙ্গে ইংরাজদের লড়াই হয়েছিল, ইয়াদ আছে আপনার?

আছে।

নওয়াজ খানের মেরুদণ্ড বেয়ে বিজলি খেলে গিয়েছিল। চমকে তিনি সুন্দরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন।

সুন্দর খান বলেছিল, সিপাহি লড়াইয়ের পর ইংরাজরা আবৃাজানের গর্দানে রশি বেঁধে গাছের ডালে লটকে গুলি করে মেরেছিল। সাহেব কোতল করে তার শোধ নিতে গিয়েছিলাম। খুদার ইচ্ছা ছিল না। ইংরাজ মারতে পারলাম না। মগর তামাম জিন্দগির জন্য দ্বীপান্তর হয়েছে আমার। সে জন্যে আপশোশ নেই।

একসময় বেড়ি বাজাতে বাজাতে টাপু আর বিজনগুলোর পাশ দিয়ে সেলুলার জেলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সুন্দর খান। আর অ্যাটলান্টা পয়েন্টের টিলায় দাঁড়িয়ে কয়েদখানার বিরাট ফটকটা দেখতে দেখতে নওয়াজ খান ভাবছিলেন, এইদ্বীপে মাসে মাসে কত কয়েদিই তো আসে, কিন্তু কেউ তার কথা বোঝে না, বুঝবার চেষ্টা করে না। সেদিন নওয়াজ খানের মনে হয়েছিল, ম্যাককয় জাহাজে আজ এমন এক কয়েদি এসেছে, যে তাঁর। দিলের জ্বালা বুঝবে। মনে হয়েছিল, যে-বেদনা মেদ-মজ্জা-খুন আর বুকের মধ্যে পুরে এতগুলো বছর তিনি এই দ্বীপে কাটালেন, তার এক দরদি শরিক এসেছে।

অ্যাটলান্টা পয়েন্টের টিলায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন নওয়াজ খান। কয়েক মুহূর্তের পরিচয়ে সুন্দর খান তাঁর হৃদয় ওলটপালট করে দিয়েছে যেন।

পাশ থেকে হানিফ ডাকল, আব্বাজান–

বিশ বছর আগের অতীত থেকে অ্যাটলান্টা পয়েন্টের পাথুরে সড়কে ফিরে এলেন নওয়াজ খান। মৃদু গলায় বললেন, কী বলছ?

মেইন ল্যান্ডে গিয়ে একবার সুন্দর সাহেবকে খোঁজ করলে হয় না?

না। খুব আস্তে, অথচ কঠিন স্বরে নওয়াজ খান বলতে লাগলেন, যার ইমান নেই, দিল নেই, তাকে খুঁজে কী হবে? কোনো লাভ নেই।

বলতে বলতে প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।

এবারডিন বাজারের মধ্য দিয়ে সরাসরি পথ রয়েছে। তবু কেন যে উপসাগরের পার দিয়ে ফিনিক্স বে ঘুরে ডিলানিপুরের কুঠিতে ফিরলেন নওয়াজ খান, তিনিই জানেন।

জানালার পাশে একটি করুণ, বিষণ্ণ নারীমুখ চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন নওয়াজ খান। তারপরেই চোখ নামালেন। সে-মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। সে-মুখের বিষণ্ণতায় কোথায় যেন একটা কঠোর, ক্ষমাহীন অভিযোগ রয়েছে।

কিছুই বলে না রোশন। ধিক্কার দেয় না, অভিযোগ করে না। কিন্তু তার কঠিন নীরবতা যেন সব সময় চিৎকার করে বলে, সমস্ত অপরাধ, তার সরল নিষ্পাপ জীবনটাকে বরবাদ করে দেওয়ার সমস্ত কারসাজিই নওয়াজ খানের।

সুন্দর খান নামে যে যন্ত্রণাকে তিনি আর সকলের সামনে গোপন করে রাখেন, রোশনের দিকে তাকালে দিল ফালা ফালা করে তা বেরিয়ে আসে। এইদ্বীপের সবাই জানে, নওয়াজ খান দৃঢ়, অবিচল পুরুষ। কোনো আঘাতেই তাকে টলানো যায় না। কিন্তু তার বিরাট, কঠিন বুকের মধ্যে এই পাঁচ বছরে বিন্দু বিন্দু কত খুন যে ঝরেছে, সে খোঁজ কে রাখে, সে খবর কে জানে? চামড়া ছিঁড়ে যে খুন ঝরে তা তো সবাই দেখে। দিল টুটে যে খুন ঝরে, তা দেখার চোখ কজনের?

অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন নওয়াজ খান। তারপর কপাটটা ঠেলে ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। রোশনকে বুকের মধ্যে টেনে মাথায় হাত রাখলেন। হাতটা থরথর কাঁপতে লাগল।

ভাঙা ভাঙা, অস্থির, অদ্ভুত স্বরে নওয়াজ খান বলতে লাগলেন, সব কসুর, সব দোষ আমার। তোর জিন্দেগি আমিই নষ্ট করে দিলাম রোশন।

নওয়াজ খান এ-বেলা আসেননি। এবারডিন জেটিতে জনকতক কয়েদি ইতস্তত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর আছে টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, ফ্রি ওয়ার্ডার পুলিশ এবং হাবিলদার।

অশান্ত উপসাগর বিপুল গর্জনে পাথুরে দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

এখন বিকেল। সিসোস্ট্রেস বের নীল জল ঝকমক করে। উড়ুক্কু মাছগুলি ঢেউ কেটে কেটে তীরবেগে ছুটে যায়। যে হিংস্র হাঙরের দল শিকারের খোঁজে পারের দিকে আসছিল, ক্ষয়িত পাথরের তটে বাড়ি খেয়ে দূরে পালিয়ে যায়। উপসাগরের ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সিন্ধুশকুন চলেছে এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে।

রস আর বেলী–মোটর বোট দুটো বোঝাই করে এলফিনস্টোন জাহাজ থেকে কয়েদিদের পারে নিয়ে আসা হচ্ছে। একেবারে শেষ খেপে এল মঙ চো, ভিখন, তোরাব আলি আর লখাই।

সবাই এবারডিন জেটিতে নামল। একটু পর জেটির পাথুরে চত্বর থেকে চলে এল দ্বীপের মাটিতে।

মেইনল্যান্ডের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। দুস্তর কালাপানির ওপারে কোথায় পড়ে রইল দেশ-গাঁও-মুল্লুক! কোথায় রয়ে গেল জান-পয়চান দুনিয়া, কতকালের পরিচিত সেই পৃথিবী!

শীতের বিকেল এখন নিভুনিভু। রোদের তেজ মরে আসতে শুরু করেছে। রস দ্বীপটাকে আবছা দেখায়।

উপসাগরের গর্জন বেড়েই চলে। দুর্বোধ্য ভাষায় দরিয়া অবিরাম শাসাতেই থাকে।

এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে তাকিয়ে ছিল লখাই। নিরুপায় আক্রোশে চোখজোড়া জ্বলছিল। এই কদিন কিনারা নেই, এমন দরিয়ায় ভেসেছে। কালাপানি উন্মাদ হয়ে উঠেছে, পাহাড়প্রমাণ তুফান জাহাজের তলা ফঁসাবার কারসাজিতে মেতেছে, জাহাজটাকে ডুবিয়ে দেওয়ার কসরত করেছে সমানে। দরিয়ার চেহারা-নমুনা দেখে সারেঙ-সুখানি-খালাসি, সবার বুকের লৌ পানি হয়ে গিয়েছে। লোয়ার ডেকে পিঁজরাবদ্ধ হয়ে আড়াই শ’ কয়েদি সমস্বরে পাঁচ পীর আর বদরের নাম জপেছে। খুদাতাল্লার দোয়া মেঙেছে, ভগবান আর ফায়ার নাম নিয়েছে, আর ভয়ার্ত গলায় কেঁদেছে।

লখাইর রক্তে ডর নেই। কোনো কিছুতেই সে ভয় পায় না। উন্মাদ তুফানে জাহাজ যখন ডুবে যাবে মনে হয়েছে, বিচিত্র উল্লাসে সে তখন ডেকের ওপর বুকে হেঁটেছে। দরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে যুঝেছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে নেমে মেইনল্যান্ডের সঙ্গে সব যোগাযোগ ঘুচিয়ে লখাইর মনে হয়, ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে। মনে হয়, একটা অদম্য চিৎকার গলার নলিটাকে চিরে ফেঁড়ে বেরিয়ে পড়বে। ঢোক গিলেও সেটাকে রোখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ সমস্ত দুনিয়ার ওপর অদ্ভুত আক্রোশে মনটা ভরে গেল লখাইর।

একটা পুরনো কয়েদি জান-পয়চান করতে এসেছিল। আলাপ জমাতে চেয়েছিল। নাম কি তোর?

লখাই জবাব দিল না।

কয়েদিটা আবার বলল, ইন্ডিয়ার কোন গাঁও থেকে এসেছিস?

বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল লখাই। আচমকা ভীষণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হঠ শালে, কুত্তীকা বাচ্চা–

কয়েদিটাও খিস্তি দিল। কিছু অশ্লীল বুলি আদানপ্রদানের পর কয়েদিটা ভিখন আহিরের কাছে গেল।

লখাই ভাবছিল, সেই বিবিবাজার, মতি, তিয়াসী নদী, শরিয়তুল্লা মৃধা–এমনি নানা কথা। পারকূলহীন দরিয়া পাড়ি দিয়ে আন্দামানের মাটিতে নামার পরও তাদের কথা মনে পড়ে কেন? ভেবে ভেবে লখাই দিশা পায় না।

হঠাৎ পাঠান টিণ্ডাল দেহের সমস্ত গদ গলায় ঢেলে চিল্লায়, নয়া কয়েদিলোগ, আ যা–

লখাই চমকে উঠল।

একটু পর কয়েদিরা কম্বল কাপড়-বোঁচকা মাথায় চাপিয়ে পাহারাদারদের পিছু পিছু চলল। আড়াই শ’ কয়েদির পায়ের বেড়ি ঝনঝন করে সমতালে বাজতে লাগল।

পাথুরে সড়কটা অ্যাটলান্টা পয়েন্টের টিলাটাকে পেঁচিয়ে পুরো একটা পাক খেয়ে ওপরে উঠেছে। টিলাটা নারকেল গাছে ছয়লাপ। ঝড় মুখে নিয়ে সমুদ্র ছুঁড়ে বাতাস উঠে আসে, নারকেল গাছের মাথাগুলি এলোপাতাড়ি আঁকায়। নারকেলের পাতায় পাতায় সে সোঁ শব্দ তুলে দরিয়ার বাতাস কি শোহরত যে করে, কে জানে!

তুফান মুখে নিয়ে যে সমুদ্র পাথুরে দেওয়ালে অবিরাম আছাড় খায়, তাকে এখন আর স্পষ্ট দেখা যায় না। এখান থেকে উপসাগরটাকে মাঝে মাঝে একটা চকিত ঝিলিকের মতো মনে হয়।

তোরাব পেছন পেছন হাঁটছিল। হঠাৎ সে ডাকল, লখাই ভাই—

চলতে চলতেই ঘাড়টা একবার ঘোরায় লখাই, কী কইছিস রে তোরাব?

তোরাব বলল, বড় ডর লাগে রে লখাই ভাই। তার গলায় কাঁপুনি ধরেছে।

লখাই খেঁকিয়ে উঠল না, দাঁত মুখ খিচাল না। মৃদু, নরম গলায় বলল, হুঁ–

ভরসা পেয়ে তোরাব বলতে লাগল, দ্বীপান্তরে নেমেই জান লবেজান হয়ে গেল রে লখাই ভাই। দো-চার রোজেই ফৌত হয়ে যাব। বিশ পঁচিশ সাল আর ঘানি ঘোরাতে হবে না।

লখাই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

কাঁপা কাঁপা, বিষণ্ণ গলায় তোরাব বলেই চলে, বড় আপশোশ রয়ে গেল লখাই ভাই, বিবির পেটের ছানাটা কুননা কালে তার বাপজানের মুখ দেখবে না।

গলাটা ধরে এল তোরাবের। লখাই দেখল, হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে তোরাব।

দু’পাশে কয়েদিদের লম্বা লম্বা ব্যারাক। এগুলির নাম বিজন। বিজন থেকে পুরনো কয়েদিরা নতুন কয়েদিদের দেখছে।

একসময় রাস্তা ফুরিয়ে গেল। আড়াই শ’ আনকোরা কয়েদি কয়েদখানার সামনে এসে পড়ল।

পাঠান টিণ্ডাল হুঙ্কার ছাড়ল, কয়েদিলোগ, ঠার যা–

আড়াই শ’ কয়েদি থমকে দাঁড়াল। পাঁচ শ’ চোখের নজর সামনের দিকে স্থির হয়ে গেল। চোখের পাতা পড়ছে না তাদের।

হাত বিশেক দূরে সেলুলার জেল, আন্দামানের কয়েদখানা। ফটকের সামনের দুদল পাহারাদার কাঁধে বন্দুক চাপিয়ে টহল দিচ্ছে। ফটকের এ-মাথায় এসে জোড়া পায়ে শব্দ তুলে একবার তারা দাঁড়ায়। তারপরেই ঘুরে ফটকের ও-মাথায় যায়। আবার ফেরে। নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে তাদের কঠিন নিয়মে ঘোরাফেরা। পাকা সড়কে ভারী বুটের বিচিত্র, গম্ভীর আওয়াজ ওঠে সমতালে। খট খট, খটা খট।

পাহারাদারদের বন্দুকগুলোর মাথায় সঙিন ঝকমক করছে। লখাই একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

সূর্যটাকে এখন আর দেখা যায় না। পশ্চিম আকাশে যে-সব খাড়া-খাড়া পাহাড়ের মাথা উঠেছে, সেগুলোর আড়ালে সূর্যটা ঢলে পড়েছে। পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে নিভুনিভু রক্তাভ আলো আকাশের খানিকটা অংশ দখল করে রেখেছে।

খণ্ড খণ্ড ঘন কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। সামুদ্রিক বাতাসের ঘা খেয়ে কঁক বেঁধে তারা উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছে।

পেছন থেকে তোরাব ডাকল, লখাই ভাই—

উঁ—

চাপা, ভীরু গলায় তোরাব বলল, এই বুঝি দ্বীপান্তরের কয়েদখানা!

হুঁ–

এবার বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য গলায় কী যে বলতে লাগল তোরাব, কিছুই বোঝা গেল। না।

লখাই ভাবছিল। তার মনটা সোজা সহজ খাতে বয় না। নিজের মনোভাবই বুঝতে পারে না সে। কতকগুলো ছন্নছাড়া আবোল-তাবোল চিন্তা এই মুহূর্তে মনটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাবু করে ফেলতে চায়।

আউটরাম ঘাট থেকে যখন জাহাজে উঠেছিল লখাই, মনের কোথাও ভাবনার চিহ্নমাত্র ছিল না। মনটা ছিল শূন্য হালকা, সব কিছু থেকে মুক্ত। সব ভাবনা মেইনল্যান্ডের মাটিতে রেখে কালাপানির জাহাজে উঠেছিল সে।

লখাই হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ, মন যাকে বিকল করতে পারে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দ্বীপান্তরের কয়েদখানার সামনে পশ্চিম আকাশ থেকে যখন শীতের বেলাশেষ নিষ্প্রভ আলো দিচ্ছে, মনের ওপর পরতের পর পরত ভাবনার চাপ পড়ল। বিবিবাজারের মোতি, দরিয়ার জাহাজ, কালাপানির ঝড়, শরিয়তুল্লা, ভিখন আহির–সব একসঙ্গে তুমুল ধুন্ধুমার। বাধিয়ে দিল।

আচমকা বিরাট শরীর আর শরীরের মধ্যে অদৃশ্য মনটার ভেতর চমক খেলে গেল লখাইর। সব ছাপিয়ে সোনিয়ার মুখ দেখা দিল। ঝড়ের দরিয়ায় উথালপাতাল জাহাজের সঙ্গিনী মুহূর্তে সমস্ত মন জুড়ে বসল।

সামনে পেছনে, সব দিক থেকে ফাঁচ্ ফেঁচ শব্দ উঠছে। চমকে চারপাশে তাকাল লখাই। বিশাল চেহারার জনকতক খুনি মরদ কাঁদছে।

মরদের কান্না কোনোকালে সইতে পারে না লখাই। কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎই তার মনে হল, আন্দামানের কয়েদখানার সামনে মরদের কান্না অস্বাভাবিক নয়, অসহ্যও নয়।

একটু পরেই লোহার কবজায় বিকট ধাতব শব্দ তুলে কয়েদখানার ফটকটা খুলে গেল।

পাঠান টিণ্ডাল খেঁকিয়ে উঠল, কয়েদিলোগ অন্দর যা–

একে একে কয়েদিরা কয়েদখানার ভেতরে ঢুকতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফটকটা আড়াই শ’ নয়া কয়েদিকে গ্রাস করে ফেলল।

পশ্চিম আকাশের স্তিমিত আলো এখন এক ফুকারে নিভে গিয়েছে। ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।

একটু পর ফটকের মুখ বন্ধ হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress