সাহিত্যে এক আশ্চর্য প্রতিভা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরাতিপুর গ্রামে নিজ মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ সালে। তার পৈতৃক নিবাস উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁ’র নিকট বারাকপুর গ্রামে। তবে তাদের আদিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত পানিতর গ্রাম৷ তার প্রপিতামহ ছিলেন কবিরাজ এবং তিনি বনগাঁর নিকট বারাকপুর গ্রামে কবিরাজি করতে আসতেন৷ তার পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য এবং কথকতার জন্য তিনি শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মাতা মৃণালিনী দেবী। পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা-সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম, ১৮৫৯ সালের নীল বিদ্রোহের কিছু আগে বিভূতিভূষণের পিতামহ কবিরাজ তারিণীচরণ বসিরহাট সংলগ্ন পানিতর থেকে বনগাঁর বারাকপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পরে কাশী থেকে সংস্কৃত ও হিন্দু পুরাণে শাস্ত্রী উপাধি পেয়েছিলেন। গ্রামে গ্রামে কথকতা করে সংসার নির্বাহ করতেন তিনি। তাঁর প্রথম স্ত্রী হেমাঙ্গিনী নিঃসন্তান ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী মৃণালিনীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিভূতিভূষণ।
বিভূতিভূষণের শিক্ষার শুরু গ্রামের পাঠশালায়। শাগঞ্জ কেওটায় প্রসন্ন মোদকের পাঠশালা, মুরাতিপুরে বিপিন মাস্টারের পাঠশালা, বনগাঁ বারাকপুরে হরি রায়ের পাঠশালা এবং বাগবাজারে আপার প্রাইমারি পাঠশালাতে কিছুদিন করে পড়ার পর, ১৯০৮ সালে তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। স্কুল পাশ করার আগেই অবশ্য (অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়) তাঁর পিতৃ বিয়োগ ঘটে এবং এর ফলে তাঁকে বিশেষ অর্থকষ্টে পড়তে হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এক অবস্থাপন্ন ডাক্তারের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজ করে তাঁকে অতি কষ্টে দিন চালাতে হতো। এই অর্থকষ্ট আরও বেড়ে গেল যখন তিনি কলকাতায় গিয়ে রিপন কলেজে ভর্তি হলেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি ১৯১৬ সালে ওই কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এ এবং ১৯১৮ সালে ডিস্টিংশন সহ বি এ পাশ করেন। বি এ পাশ করার পর তিনি দর্শন নিয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন, আইন পড়তেও শুরু করেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাব এবং অন্যান্য কারণে কোনওটাই সম্পূর্ণ হয়নি।
বিএ ক্লাসের প্রথম বর্ষে পড়ার সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের চোদ্দ বছরের কন্যা গৌরীর সঙ্গে বিভূতিভূষণের বিয়ে হয়। দিনটি ছিল ১৯১৭ সালের ১৫ই অগস্ট। পরের বছর জুলাই মাসে, বি এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর, বিভূতিভূষণ কিশোরী স্ত্রীকে নিয়ে বারাকপুরে তাঁর পিতৃপুরুষের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তাঁর প্রথম দাম্পত্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সেই নভেম্ভর মাসে, অর্থাৎ চার মাস পরে, বাপের বাড়ি পানিতরে বেড়াতে গিয়ে গৌরী নিউমোনিয়ায় (মতান্তরে কলেরায়) মারা যান।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর পড়াশোনা ছেড়ে বিভূতিভূষণ শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন।কিছুদিন ধর্মতলার খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর যোগ দেন বনগাঁর নিকট গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশন স্কুলে। বাকী জীবনটা তিনি এই শিক্ষকতার পেশাতেই নিযুক্ত ছিলেন, যদিও মাঝে মধ্যে তাঁর শিক্ষকতায় কিছু সময়ের জন্য ছেদ পড়েছিল। তাঁর শিক্ষকতা শুরু হয় পঞ্চাশ টাকা মাসিক বেতনে, হুগলির জাঙিপাড়া স্কুলে ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯২০ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই স্কুলে কাজ করার পর তিনি জুন মাসে সোনারপুরের কাছে হরিনাভি হাই ইংলিশ স্কুলে যোগ দেন। ১৯২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বিভূতিভূষণ এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন।
বিভূতিভূষণের মধ্যে একজন উদগ্র ভ্রমণপিপাসু বাস করত। তাঁর এই ভ্রমণপিপাসু সত্তা, যা হয়ত তাঁর বাবা মহানন্দ তাঁর মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে স্কুলের কাজ ছেড়ে ‘গোরক্ষণী সভা’র ভ্রাম্যমান প্রচারকের কাজ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। এই কাজ নিয়ে পূর্ববঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও আরাকান অঞ্চলে ১৯২২ সালের শেষ অব্দি ব্যাপক ভ্রমণ করেন তিনি― কখনও ট্রেনে, কখনও জলপথে, বেশির ভাগটাই পায়ে হেঁটে।
১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় ফিরে এলেন বিভূতিভূষণ। ফিরে এসে তিনি পাথুরিয়া ঘাটার জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজ নিলেন। এর এক বছর পরে খেলাতচন্দ্র উত্তর বিহারের অরণ্য অঞ্চলে তাঁর বিস্তীর্ণ জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য এস্টেট ম্যানেজার করে বিভূতিভূষণকে ভাগলপুরে পাঠান। ভাগলপুর বাস বিভূতিভূষণের জীবনের এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ভাগলপুরে বসেই বিভূতিভূষণ তাঁর প্রথম কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালি’ লিখেছিলেন। এই ভাগলপুরেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বিচিত্রার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মৌচাকের সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের। বস্তুত, ভাগলপুরে থাকার সময় অরণ্য এবং অরণ্যবাসী দরিদ্র মানুষদের সংস্পর্শ তাঁকে এক দশক পরে আর এক মহৎ উপন্যাস ‘আরণ্যক’ লিখতে অনুপ্রাণিত করে।
১৯২১ সালে (১৩২৮ বঙ্গাব্দ) প্রবাসী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় ‘উপেক্ষিতা’ নামক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে।
এর পরের ছ’বছরে তাঁর আরও কয়েকটি গল্প প্রবাসী এবং বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণের প্রথম দিকের দশটি গল্প, যার সাতটি প্রবাসী এবং তিনটি বিচিত্রায় বেরিয়েছিল, একসঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রথম ছোট গল্পের সংকলন ‘মেঘমল্লার’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে, ‘পথের পাঁচালি’ বই হয়ে বেরনোর দু’বছর পরে, যদিও ‘মেঘমল্লার’-এর গল্পগুলো ‘পথের পাঁচালি’র আগে লেখা।
ভাগলপুরে কাজ করার সময় ১৯২৫ সালে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন। এ বই লেখার কাজ শেষ হয় ১৯২৮ সালে। এটি বিভূতিভূষণের প্রথম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী উপন্যাসের কাহিনীকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা করেছিলেন। এ সিনেমাটির নামও ছিল ‘পথের পাঁচালী’। এই চলচ্চিত্রটি দেশী-বিদেশী প্রচুর পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছিল। এরপর “অপরাজিত” নামক উপন্যাস রচনা করেন, যেটি “পথের পাঁচালির”ই পরবর্তী অংশ। সত্যজিৎ এ উপন্যাস নিয়েও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উভয় উপন্যাসেই তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজি ও ফরাসি সহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিভূতিভূষণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্পগ্রন্থ হল – মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল।
তাঁর লেখা ‘চাঁদের পাহাড়’ একটি অনবদ্য অভিযানমূলক কাহিনী, যার পটভূমিকা আফ্রিকা। ২০১৩ সালে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জী “চাঁদের পাহাড়” কে বাংলা চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেন। এ চলচ্চিত্রটিও বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে।
১৯৫১ সালে পান রবীন্দ্র পুরস্কার – (মরণোত্তর), ‘ইছামতী’ উপন্যাসের জন্য।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার (লেখকের জন্মস্থান) পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে রাখা হয়েছে “বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য”।
১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে বিভূতিভূষণ আবার কলকাতায় ফিরে এসে ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটে তাঁর পুরোনো মেসবাড়ি প্যারাডাইস লজে থাকতে শুরু করলেন। এখানে থাকতে এসে সহ-মেসবাসী হিসেবে পেয়ে গেলেন তাঁর সহপাঠী নীরোদচন্দ্র চৌধুরিকে। প্রকাশের অভিপ্রায়ে ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসেই ‘পথের পাঁচালি’র পাণ্ডুলিপি বিচিত্রার দপ্তরে পাঠালেন বিভূতিভূষণ। সে পাণ্ডুলিপি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হল। বিচিত্রার পাতায় ‘পথের পাঁচালি’ জুলাই, ১৯২৮ থেকে সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ অব্দি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘পথের পাঁচালি’কে পাঠকদের একটা বড় অংশ সাদরে গ্রহণ করেছিল, তবু, বিচিত্রায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের পরে কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক বই হিসেবে ‘পথের পাঁচালি’ ছাপতে রাজি হচ্ছিলেন না। হয়ত নতুন লেখকের প্রথম উপন্যাস ছাপার ব্যাপারে তাঁদের জড়তা ছিল। এই সময় নীরোদচন্দ্র সজনীকান্ত দাসের সঙ্গে বিভূতিভূষণের আলাপ করিয়ে দেন। সজনীকান্ত তাঁর নতুন প্রকাশনা রঞ্জন প্রকাশালয় থেকে ১৯২৯ সালের ২রা অক্টোবর ‘পথের পাঁচালি’ প্রকাশ করেন। দিনটি ছিল মহালয়া। সঙ্গত ভাবেই বিভূতিভূষণ পিতৃতর্পণ হিসেবে তাঁর বাবার স্মৃতিতে উৎসর্গ করেন ‘পথের পাঁচালি’। সজনীকান্ত-র স্ত্রী সুধারাণীর একটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, ‘পথের পাঁচালি’র প্রথম সংস্করণের জন্য সজনীকান্ত বিভূতিভূষণকে তিনশ টাকা সম্মান-দক্ষিণা দিয়েছিলেন।
বিভূতিভূষণের দিনলিপি অনুযায়ী, ১৯২৯ সালের ১৪ই নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বসে ‘পথের পাঁচালি’র অনুক্রমিক উপন্যাস ‘অপরাজিত’র মূল কাঠামোটি মনে মনে চূড়ান্ত করেন বিভূতিভূষণ। এর এক মাস পর থেকে, অর্থাৎ ডিসেম্বর, ১৯২৯ থেকে, প্রবাসীতে ধারাবাহিক ভাবে বেরোতে শুরু করে ‘অপরাজিত’। শেষ হয় ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। পুস্তকাকারে ‘অপরাজিত’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয় খণ্ড দু’মাস বাদে, মার্চে। প্রকাশক এবারেও সজনীকান্ত দাস। ‘পথের পাঁচালি’ এবং ‘অপরাজিত’ প্রকাশিত হবার কিছুদিনের মধ্যেই বই দুটি নিয়ে পাঠক মহলের বৃহদাংশে প্রবল উৎসাহ দেখা যায়। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে তাঁর সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশের বরাহনগরের বাড়িতে দেখা করতে বলেন। সেই মাসেই কবির লেখা ‘পথের পাঁচালি’র সমালোচনা প্রকাশিত হয় পরিচয় পত্রিকায়।
উত্তর বিহারে থাকার অভিজ্ঞতা বিভূতিভূষণের মধ্যে বন-জঙ্গলের প্রতি একটা গভীর ভালবাসা তৈরি করে দিয়েছিল। এতটাই যে, জঙ্গলের টানে নিয়মিত তাঁকে বিহারের ঘাটশিলা ও গালুডি অঞ্চলে যেতে হতো। শেষ পর্যন্ত ঘাটশিলায় তিনি একটা বাড়ি কিনে ফেললেন। প্রথম স্ত্রীর স্মৃতিতে তার নাম রাখলেন গৌরীকুঞ্জ। তাঁর জঙ্গল ভ্রমণের ইতিবৃত্তগুলি ‘বনে পাহাড়ে’ (১৯৪৫) এবং ‘হে অরণ্য কথা কও’ (১৯৪৫) এই দুই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।
১৯৪০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বনগাঁয় বসবাসকারী আবগারি বিভাগের অফিসার ষোড়ষীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা রমাকে বিভূতিভূষণ বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে বনগাঁ-বারাকপুরে আবার থাকতে শুরু করেন বিভূতিভূষণ। তবে যখনই সময় পেতেন ঘাটশিলা চলে যেতেন যেখানে তাঁর অনুজ নুটবিহারী ডাক্তারি করতেন এবং স্ত্রী যমুনাকে নিয়ে থাকতেন।
বিয়ের সাত বছর পর, ১৯৪৭ সালে বিভূতিভূষণের একমাত্র সন্তানএকমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু) জন্ম হয়।
তাঁর সাহিত্য রচনার সময় কাল – সময়কাল
১৯২৯ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত।
১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
তাঁর গ্রন্থতালিকা
উপন্যাস
১). পথের পাঁচালি (১৯২৯ সালে)
২). অপরাজিত (১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২ সালে)
৩). দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫ সালে)
৪). আরণ্যক (১৯৩৯ সালে)
৫). আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০ সালে)
৬). বিপিনের সংসার (১৯৪১ সালে)
৭). দুই বাড়ি (১৯৪১ সালে)
৮). অনুবর্তন (১৯৪২ সালে)
৯). দেবযান (১৯৪৪ সালে)
১০). কেদার রাজা (১৯৪৫ সালে)
১১). অথৈজল (১৯৪৭ সালে)
১২). ইছামতি (১৯৫০ সালে)
১৩). অশনি সংকেত (অসমাপ্ত, বঙ্গাব্দ ১৩৬৬)
১৪). দম্পতি (১৯৫২ সালে)
গল্প-সংকলন
১). মেঘমল্লার (১৯৩১ সালে)
২). মৌরীফুল (১৯৩২ সালে)
৩). যাত্রাবাদল (১৯৩৪রসালে)
৪). জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭ সালে)
৫). কিন্নর দল (১৯৩৮ সালে)
৬). বেণীগির ফুলবাড়ি (১৯৪১ সালে)
৭). নবাগত (১৯৪৪ সালে)
৮). তালনবমী (১৯৪৪ সালে)
৯). উপলখন্ড (১৯৪৫নসালে)
১০). বিধুমাস্টার (১৯৪৫ সালে)
১১). ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫নসালে)
১২). অসাধারণ (১৯৪৬নসালে)
১৩). মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭নসালে)
১৪). আচার্য কৃপালিনী কলোনি (১৯৪৮ সালে, ১৯৫৯ সালে ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ নামে প্রকাশিত)
১৫). জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯নসালে)
১৬). কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০নসালে)
১৭). রূপ হলুদ (১৯৫৭নসালে,মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
১৮). অনুসন্ধান (১৯৬০নসালে,বঙ্গাব্দ ১৩৬৬, মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
১৯). ছায়াছবি (১৯৬০নসালে,বঙ্গাব্দ ১৩৬৬, মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
২০). সুলোচনা (১৯৬৩ সালে)
কিশোরপাঠ্য
১). চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮নসালে)
২). আইভ্যানহো (সংক্ষেপানুবাদ, ১৯৩৮ সালে)
৩). মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০ সালে)
৪). মিসমিদের কবচ (১৯৪২ সালে)
৫). হীরা মাণিক জ্বলে (১৯৪৬নসালে)
৬). সুন্দরবনের সাত বৎসর (ভুবনমোহন রায়ের সহযোগিতায়, ১৯৫২ সালে)
ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি
১). অভিযাত্রিক (১৯৪০ সালে)
২). স্মৃতির রেখা (১৯৪১নসালে)
৩). তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩রসালে)
৪). ঊর্মিমুখর (১৯৪৪নসালে)
৫). বনে পাহাড়ে (১৯৪৫ সালে)
৬). উৎকর্ণ (১৯৪৬ সালে)
৭). হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮ সালে)
অন্যান্য
১). বিচিত্র জগত (১৯৩৭ সালে)
২). টমাস বাটার আত্মজীবনী (১৯৪৩ সালে)
৩). আমার লেখা (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সালে)
৪). প্রবন্ধাবলী
৫). পত্রাবলী
৬). দিনের পরে দিন
তাঁর লেখা থেকে সিনেমা হয়েছে –
১). পথের পাঁচালী (১৯৫৫ সালে)
২). অপরাজিত (১৯৫৬ সালে)
৩). আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৫৭ সালে)
৪). অপুর সংসার (১৯৫৯ সালে)
৫). বাক্স বাদল (১৯৭০ সালে)
৬). নিশি পদ্ম (১৯৭০ সালে) ছোট গল্প হিঙ্গের কচুরি অবলম্বনে ।
৭). অমর প্রেম (১৯৭২ সালে) ছোট গল্প হিঙ্গের কচুরি অবলম্বনে ।
৮). নিমন্ত্রণ (১৯৭১ সালে)
৯). অশনি সংকেত (১৯৭৩ সালে)
১০). আলো (২০০৩ সালে)
১১).দ্য ফেস্টিভ্যাল! তালনবমী (চলচ্চিত্র) (২০০৩ সালে)
১২). চাঁদের পাহাড় (২০১৩ সালে)
১৩). সহজ পাঠের গপ্পো (কালার’স অফ ইনোসেন্স) (২০১৭ সালে) তাল নবমী গল্পের উপর ভিত্তি করে।
১৪). অভিযাত্রিক (২০২১ সালে) অপরাজিত উপন্যাসের শেষ অংশের উপর ভিত্তি করে।
১৪). আমাজন অভিজান (২০১৭ সালে) ‘চাঁদের পাহাড় ‘ চলচ্চিত্রের চরিত্রের উপর ভিত্তি করে।
অধুনা ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলাতে, ১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর (১৭ই কার্তিক ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ,বুধবার) বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খন্ড) ঘাটশিলায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। পরদিন দুপুরে সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে ‘পঞ্চপাণ্ডব ঘাট’-এ তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
তিনি তার বাড়িটির নাম স্ত্রীর নামে ‘গৌরীকুঞ্জ’ রেখেছিলেন। সামনের রাস্তাটি ‘অপুর পথ’ হিসেবে পরিচিত।
————————————————-
[ তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া
জীবনের পাঁচালীকার বিভূতিভূষণ, ডঃ তারকনাথ ঘোষ, আনন্দধারা প্রকাশন, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১৫
হরিনাভি ইংরাজী-সংস্কৃত বিদ্যালয় শতবার্ষিকী উৎসব সংকলন (১৯৬৬)
পিনাক বিশ্বাস। “উপেনবাবুর উপন্যাস আবিষ্কার”।
শ্রেষ্ঠ গল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়|ভূমিকা ও সম্পাদনা: হায়াৎ মামুদ|চারুলিপি প্রকাশন|আইএসবিএন ৯৮৪৭০১৮৭০০১৩০
সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ২৫১।