Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya » Page 4

সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya

০৪. পুরুষোত্তম সিংহর বাড়ি

পুরুষোত্তম সিংহর বাড়ি খুঁজতে একটুও কষ্ট করতে হল না। তাঁকে চেনে না এমন মানুষ বোধহয় জামদায় একজনও নেই। জামদার সবচেয়ে বড় বাড়িটাই সিংহসদন।

জয় হনুমান গ্যারাজ থেকে সিংহসদন খুব একটা দূরেও নয়। হাঁটাপথে মিনিট সাতেক। বাজারের পরেই মোরাম বিছানো রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণে, রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে সিংহমশাইয়ের ডেরা। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি, চারদিকে প্রচুর গাছপালা। শাল, সেগুন, শিমুল, মহুয়া, ইউক্যালিপ্টাসের বাহিনী পাঁচিলের ওপারে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে। জাল জাল গেটের পাশে শ্বেতপাথরের ফলকে হিন্দি ইংরেজি বাংলা তিনটে ভাষায় জ্বলজ্বল করছে পুরুষোত্তমের নাম।

গেট বন্ধ। টুপুররা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। কীভাবে ডাকবে, কাকে ডাকবে ভেবে পাচ্ছে না।

পার্থই গলা ওঠাল, কোই হ্যায়?

তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হয়েছে এক আদিবাসী যুবক। পরনে খাকি প্যান্ট, সাদা শার্ট, হাতে লাঠি। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, কিসকো চাহিয়ে?

পার্থ হিন্দিতেই বলল, মুকুল সিংহর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

দারোয়ান যেন একটু অবাক। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল সবাইকে। জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে। পার্থর গলায় ভারিক্কি ভাব, আমরা মুকুলবাবুর বন্ধু।

উনি তো নেই। সকালবেলা বেরিয়ে গেছেন। সন্ধের আগে ফিরবেন না।

শুনেই অবনী মহাখুশি। কোনও এক অর্ধপরিচিতের বাড়িতে এরকম উৎপটাং চলে আসায় তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। হোটেলে খেতে-খেতেও তিনি সারাক্ষণ গাঁইগুঁই করছিলেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, বাঁচা গেল।… চলো, এবার গ্যারাজে ফিরি।

অবনী প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছেন, মিতিন খপ করে চেপে ধরল তাঁর হাত, একবার পুরুষোত্তমবাবুর দর্শন নেবেন না, অবনীদা?

আমার দরকার নেই। তোমরাই টিকটিকিগিরি করো গিয়ে।

আহা, মানুষকে দেখা মানেই কি টিকটিকিগিরি করা?

অবনী উত্তরে কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অন্দর থেকে বাজখাঁই কণ্ঠস্বর, কৌন হ্যায় রে অভিরাম?

কোই বাবুলোগ বড়াভাইসে মিলনে আয়া।

খোল দো।

গেট খুলে গেল। এক দীর্ঘদেহী পুরুষ লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে এলেন গেটে। পরনে ধুতি আর ফতুয়া।

মিতিন হাতজোড় করে নমস্কার করল, আমি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। আপনি নিশ্চয়ই পুরুষোত্তমবাবু?

টকটকে গৌরবর্ণ পুরুষোত্তম ঘাড় নাড়লেন। ঈষৎ বিস্মিত স্বরে বললেন, আপনারা মুকুলের কাছে…?

আমরা সারান্ডায় যাচ্ছি। পরশু ট্রেনে মুকুলবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আজ জামদায় হঠাৎ গাড়ি খারাপ হয়ে গেল তাই ভাবলাম…। মিতিন মিষ্টি করে হাসল, আমরা আপনার সঙ্গেও দেখা করতে এসেছি। মুকুলবাবু আপনার কথা খুব বলছিলেন।

তাই বুঝি? পুরুষোত্তমবাবুর মুখে চিলতে হাসি ফুটল, আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন।

বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কম্পাউন্ডের ভেতরটা আরও সুসজ্জিত। যত্ন করে বানানো বাগানে ফুটে আছে রং-বেরং-এর গোলাপ। মূল বাড়ির সামনে গোল বাঁধানো চাতাল, সেখানে ডানা মেলে আছে শ্বেতপাথরের পরি। সবুজ লনে রঙিন ছাতার নীচে বেতের চেয়ার টেবিল। লনের ঘাস নিখুঁত মাপে ছাঁটা। দেখে বোঝা যায় শুধু টাকা নয়, গৃহস্বামীর রুচিও আছে।

গাড়িবারান্দা থেকে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে গোল গোল থামলা দালানে। উঁচু সিলিং-এ ঝুলছে ঝাড়বাতি। মৃদু বাতাসের দোলায় ঝাড়লন্ঠনে টুং টুং শব্দ।

দালান পেরিয়ে বৈঠকখানা-ঘরে এনে সকলকে বসালেন পুরুষোত্তম। পাখা চালিয়ে দিয়ে বললেন, বসুন, আরাম করে বসুন।

পুরনো আমলের ভারী ভারী সোফা, কিন্তু এখনও কী নরম। টুপুর যেন ড়ুবে যাচ্ছিল। আড়ষ্ট চোখে দেখছিল ঘরখানাকে। এ ঘরেও একখানা ঝাড়লণ্ঠন আর দেওয়ালে বেশ কয়েকখানা বাঁধানো ছবি। সবকটা ফোটোতেই পুরুষোত্তম উপস্থিত। কোনওটায় তিনি কোনও সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করছেন, কোনওটায় দাঁড়িয়ে আছেন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে। ছবিতে বয়স কম হলেও মানুষটাকে চিনতে অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে পুরু গোঁফখানা দেখে।

পুরুষোত্তমের সেই পুরু গোঁফ এখন পুরোপুরি সাদা। মাথার চুলও। তা সত্ত্বেও মানুষটাকে তত বুড়ো বলে মনে হচ্ছিল না। টুপুরের। কিছু না হোক সত্তর-পঁচাত্তর তো বয়স হবেই, অথচ এখনও চেহারাটা কী সুন্দর রেখেছেন ভদ্রলোক। টানটান চামড়া, কপালে বলিরেখা নেই, শরীরও ঝোঁকেনি এতটুকু। নিৰ্ঘাত ব্যায়াম করেন নিয়মিত।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সকলের সঙ্গে পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হল। অবনী কলেজে পড়ান শুনে পুরুষোত্তম রীতিমত শ্ৰদ্ধান্বিত। পার্থও প্রেসের ব্যবসা করে শুনে তারিফ করলেন খুব। বুমবুমকে হাত নেড়ে ডাকলেন কাছে, তবে বুমবুম এগোল না, বসে আছে মায়ের কোল ঘেঁষে।

মিতিনের পেশার খবর জেনে পুরুষোত্তম যেন খানিকটা থতমত। ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনি ডিটেকটিভ?

মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, হ্যাঁ, দুষ্টু লোকদের পেছনে ছুটে বেড়াই আর কী।

বাহ্, বাহ, মেয়েরা দেখছি আজকাল অনেক এগিয়ে গেছে। তা আপনি পুলিশের চাকরিতে ঢোকেননি কেন?

পুলিশের কাজ তো অনেকটাই রুটিন জব, ভাল লাগে না। তুলনায় আমার কাজে স্বাধীনতা অনেক বেশি। নিজের পছন্দমতো কেস নিতে পারি। অবশ্য পুলিশের সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতেই হয়। তাদের সাহায্য ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এগনো মুশকিল।

হুম। তা আর্মস হ্যান্ডেল করার অভ্যেস আছে?

রিভলভারটা পারি মোটামুটি। লাইসেন্সও আছে।

রাইফেল?

আজ্ঞে না। কখনও চেষ্টা করার সুযোগ হয়নি।

রিভলভার তো খেলনা। আসল অস্ত্র হল রাইফেল। বলতে বলতে কী যেন খেয়াল হল পুরুষোত্তমের, লজ্জিত স্বরে বললেন, ছি ছি, তখন থেকে শুধু কথাই বলে যাচ্ছি… আপনাদের নিশ্চয়ই এখনও খাওয়াদাওয়া হয়নি?

অবনী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমরা লাঞ্চ সেরেই এসেছি।

তবু একটু শরবত-টরবত তো চলতে পারে?

পার্থ বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, গরমের দিন…

কী নেবেন? লস্যি? আমপোড়ার শরবত?

লস্যিই ভাল। পার্থ বিন্দুমাত্র সঙ্কুচিত নয়, আমপোড়াও মন্দ কী!

পুরুষোত্তম দ্রুত পায়ে অন্দরে চলে গেলেন। খানিক পরে ফিরে এসে থিতু হয়ে বসলেন সোফায়। বললেন, আজ আমার আপ্যায়নের আসল লোক নেই। বউমা নাতিকে নিয়ে টাটানগর গেছে। বাপের বাড়ি।

সহেলি প্রশ্ন করলেন, উমা মানে আপনার ছোট ছেলের বউ?

বড়টির আর বিয়ে দিতে পারলাম কোথায়! সে তো ভ্যাগাবণ্ডই রয়ে গেল।

উনি তো আপনার ব্যবসাতেও নেই?

যার মতিস্থির নেই তাকে দিয়ে কি ব্যবসা হয়? তা ছাড়া ও একটু আয়েসী ধরনের, ব্যবসার খাটাখাটনি ওর পোষাবে না। অগত্যা আমার ছোট ছেলেই ভরসা।

তিনি বুঝি খুব পরিশ্রমী?

হ্যাঁ। খানিকটা আমার ধাতের। ছোটাছুটি করতে পারে খুব। এই তো কালই গেল সারান্ডায়। ডিভিশান অফিসে। আজ ফেরার কথা। ফিরেই কাল আবার মনোহরপুর ছুটবে। আমি এখানকার অফিসটা সামলাই, সকাল-বিকেল বসি। দৌড়োদৌড়িটা এখন ওর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি। বয়স হচ্ছে তো।

সহেলি বললেন, আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না বয়স হয়েছে।

পুরুষোত্তম গর্বিত মুখে বললেন, তার কারণ আছে। এখনও নিয়মিত কাজকর্ম করি। রোজ অন্তত পাঁচ কিলোমিটার হাঁটি। দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই। খাওয়াদাওয়াও করি মেপেজুপে। স্ত্রী বিয়োগের পর গত দশ বছর ধরে মাছ মাংস ছেড়ে নিরামিষ খাচ্ছি।

টুপুর ফিক করে হেসে ফেলল। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের নাকি মাছ মাংস খেতে নেই! যথেষ্ট খারাপ নিয়ম, তবু এখনও নাকি অনেকে মানেন। স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্বামীও যে আমিষ খাওয়া ছেড়ে দেন, জীবনে এই প্রথম শুনল টুপুর।

পুরুষোত্তম টুপুরের হাসিটুকু লক্ষ করেননি। বললেন, এককালে শরীরের ওপর প্রচুর অত্যাচার করেছি তো, তাই এখন বেশি করে নিয়ম মানি।

মিতিন হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ, শুনেছি আপনি এককালে খুব ডাকাবুকো ছিলেন।

কে বলল? আমার বড় পুত্তুর?

শুধু মুকুলবাবু কেন, আরও অনেকের মুখে শুনলাম। আপনি তো এ অঞ্চলের স্বনামধন্য মানুষ।

পুরুষোত্তম হা হা হেসে উঠলেন, আরে ছাড়ুন। আমার সম্পর্কে কেউ ভাল কথা বলতেই পারে না। তাতে অবশ্য আমার কাঁচকলা। আমি চিরকাল আমার মতো থেকেছি। কোনও সুনাম বদনামের পরোয়া করিনি।

মিতিন তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, আপনার মেন বিজনেস তো ছিল জঙ্গলের ঠিকাদারি, তাই না?

ছিল কেন, এখনও আছে। সেই ফরটিনাইন থেকে করছি। তখন আমার বয়স মাত্র তেইশ।

তার মানে আপনি খুব অল্প বয়সে কলকাতা ছেড়েছেন?

কলকাতা নয়, আমার নিবাস ছিল হাওড়ায়। সাঁতরাগাছি। বাবা-মা সাতদিনের তফাতে কলেরায় মারা গেলেন, কাকার সংসারে মন টিকছিল না, পড়াশুনোও ভাল লাগত না, তাই বেরিয়ে পড়লাম ভাগ্যান্বেষণে। ইন দা ইয়ার নাইন্টিন ফরটিফাইভ। বেরিয়েছিলাম বম্বে যাব বলে। ট্রেনে যেতে যেতে মনোহরপুর নামটা পছন্দ হয়ে গেল। ব্যস, নেমে পড়লাম।

বাহ, এ তো বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!

বলতে পারেন। পুরুষোত্তম মাথা নাড়লেন, মনোহরপুরের কাছেই তখন ইসকোর দুদুটো আয়রন মাইন ছিল। চিড়িয়া আর দুইয়া। ফরটিফোরে দুটো মাইনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন সবে চিড়িয়া মাইনটা খুলেছে। সেখানে কাজ জুটিয়ে ফেললাম একটা। ঠিকাদারের আন্ডারে। নিজের হাতে গাঁইতি মেরে মেরে পাহাড় কাটতাম। তখনই তো স্বাস্থ্যটা পোক্ত হল। এক-দু বছর পরেই আবার বন্ধ হয়ে গেল মাইন। আর ওই সময়েই এক সাহেব, মিস্টার উইলিয়ামস, তিনি ছিলেন ইস্কোর ডি-জিএম… কী জানি কেন, সাহেব আমায় খুব নেকনজরে দেখতেন… তিনিই তদ্বির তদারক। করে আমায় ওই ঠিকাদারির লাইনে ঢুকিয়ে দেন।

অবনী বললেন, তার মানে তখন থেকেই জঙ্গলের গাছ কাটছেন?

না প্রোফেসরসাহেব। আমার তখন কাজটা ছিল অন্যরকম। গাছের লাইনেই যাইনি। সারান্ডার জঙ্গলে একধরনের ঘাস হয়। সাবুই ঘাস। কাগজ তৈরিতে ওই ঘাসের খুব চাহিদা ছিল। জঙ্গলের ইজারা নিয়ে ওই সাবুই ঘাস আর বাঁশ কেটে কেটে চালান দিতাম রানিগঞ্জের পেপার মিলে। সেই সময়েই মনোহরপুর ছেড়ে চলে যাই গুয়ায়। সেখানে একখানা বাড়িও বানিয়েছিলাম ছোটখাটো।

গুয়াতেও তখন স্যার বীরেনের আয়রন মাইন ছিল, তাই না?

হুম। গুয়ার লোহাখনির তখন গোল্ডেন পিরিয়ড। এখন অবশ্য সেই খনিও আর নেই। তবে গুয়া জায়গাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। জানেন তো, ওখানে একসময়ে সোনার খনিও ছিল। খঞ্জর-দিরি-বুরুতে।

তাই নাকি? অবনী নড়ে বসলেন, এটা তো একটা নতুন ইনফরমেশান!

আরে প্রোফেসরসাহেব, এই ঝাড়খণ্ডে কী না ছিল! সোনা, রুপো, লোহা, মাইকা, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়াম, এমনকী কয়লা খনিতে হিরে পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আমাদের সারান্ডার সম্পদই কী কম! এখানে তো সব পাহাড়ই লোহাপাহাড়। মেঘাতুবুরু কিরিবুরুর কাজ শেষ হলেই ফের একটা বুরু কাটা শুরু হয়ে যাবে।

প্রশ্নটা কদিন ধরেই টুপুরের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করে ফেলল, আচ্ছা, এখানে সব নামের পেছনেই একটা করে বুরু লাগানো কেন?

অবনী শিক্ষকের সুরে বললেন, এটা তোমার জানা উচিত ছিল টুপুর। বুরু মানে পাহাড়।

আর বুরু জুড়ে জুড়ে এরা পাহাড়ের নাম দেয়। পুরুষোত্তম বললেন, যেমন কিরি মানে পোকা, কিরিবুরু মানে পোকার পাহাড়। মেঘাতুবুরুর অর্থ মেঘ ছোঁয়া পাহাড়। গুয়া মাইন্সের ওখানে ছিল বনম-উলি-বুরু, ছাতমবুরু, ঝিলিবুরু, ঝাণ্ডিবুরু. প্রতিটি পাহাড়ই এক-একটি মাইন। বনম্ মানে এখানকার হো ভাষায় উইঢিবি আর উলি মানে আম। যে পাহাড়ে উইঢিবি আর আমগাছ আছে তার নাম বনমউলিবুরু। ছাতার মতো দেখতে যে পাহাড়, সেটা ছাতমবুরু। কিংবা পতাকার মতো চেহারা বলে ঝাণ্ডিবুরু।

বড় পাথরের রেকাবিতে ছ গ্লাস লস্যি এসে গেছে। সঙ্গে আর-একটা মিনে করা রেকাবিতে রসগোল্লা আর ল্যাংচা।

এক চুমুকে পার্থর লস্যি শেষ। গোঁফ মুছে মিষ্টির প্লেটের দিকে হাত বাড়াল। অন্যরা গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে ধীরেসুস্থে। লস্যি মিষ্টি কোনওটাতেই বুমবুমের আগ্রহ নেই, সে হাই তুলছে ঘন ঘন।

পুরুষোত্তম বুমবুমকে দেখে বললেন, আহা, আমার নাতিটা থাকলে ওর ভাল লাগত। বেচারা বড্ড বোর হচ্ছে।

বুমবুম গম্ভীর মুখে বলল, আমি ঠিক আছি।

যাও না, বাইরে ঘুরে এসো। পেছনের বাগানে দোলনা আছে।

আমি দোলনায় চড়ি না। আমার মাথা ঘোরে।

তা হলে লখিয়াকে বলি, তোমায় একটা বল এনে দিক?

আমি এখন খেলব না। আমি তোমাদের কথা শুনব।

পুরুষোত্তম হা হা হেসে উঠলেন, বেশ। তাই শোনো তবে।

মিতিন গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রাখল। ফিরেছে পুরনো প্রসঙ্গে, তা আপনি এই জামদায় এলেন কবে?

উনিশশো ছাপ্পান্নয়।

গুয়ার বাড়ি বেচে দিলেন?

কী আর করব, আমার স্ত্রীর আর জঙ্গল ভাল লাগছিল না যে। জামদায় তখন নতুন বসতি গড়ে উঠছে, বাঙালিও ছিল অনেক… তা ছাড়া এখান থেকে টাটা চাইবাসা সর্বত্রই যোগাযোগের সুবিধে বেশি। এখানে এসে ব্যবসাও বাড়ালাম, একখানা শ মিল খুললাম, ট্রাক কিনলাম, গভর্নমেন্ট মাইনগুলোতে এখন অর্ডার সাপ্লাই-এর কাজও ধরেছি…

জঙ্গলে আপনার বিশাল দাপট ছিল, তাই না?

লোকে আমায় মানত খুব। বিশেষ করে আদিবাসীরা। আমি তাদের ওপর কখনও জোরজুলুম করিনি। আবার অন্য কেউ ওদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করলে বরদাস্তও করিনি।

যদি কিছু না মনে করেন, একটা প্রশ্ন করব?

ডিটেকটিভের প্রশ্ন?

না। একজন সফল ব্যবসায়ীকে জানার কৌতূহল। মিতিন গলা নামাল, এই যে আপনি এত ধনসম্পদ করেছেন, এতে আপনার শত্ৰু বাড়েনি?

পুরুষোত্তম মুচকি হাসলেন, দেখুন, আমি নিজেকে সাধুপুরুষ বলে দাবি করি না। বিজনেস করতে গেলে শত্রু হয়ই। তাদের ছলে বলে কৌশলে হটিয়েও দিতে হয়। আমি শত্ৰু কোনওদিন বাড়তেই দিইনি। আমি যেভাবে বাঁচতে চাই, সেভাবেই থেকেছি।

বাইরে একটা গাড়ির হর্ন। টুপুর দৌড়ে বারান্দায় গেল। নজরুলসাহেব কি জিপ নিয়ে এসে গেলেন?

অভিরাম গেট খুলেছে। উহুঁ, এ তো টুপুরদের জিপ নয়। একজন ভদ্রলোক নামলেন জিপ থেকে। পার্থরই সমবয়সি, লম্বা ঝকঝকে চেহারা, পরনে জি, টি-শার্ট। মুখখানা যেন পুরুষোত্তম বসানো।

পুরুষোত্তমও বেরিয়ে এসেছিলেন বারান্দায়। জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তোর কাজ মিটল?

উত্তর না দিয়ে বিকাশ ঝলক দেখল টুপুরকে। চোখে প্রশ্ন।

পুরুষোত্তম বললেন, এরা কজন সারান্ডা যাওয়ার পথে আমাদের বাড়ি এসেছে। তোর দাদার সঙ্গে ট্রেনে বন্ধুত্ব হয়েছিল।

বিকাশের ভুরুর ভাঁজ বাড়ল, তবে মন্তব্য করল না কিছু। ঘরে ঢুকে আলাপ-পরিচয় করল সবার সঙ্গে। অবনীকেই দলের পাণ্ডা ঠাউরে প্রশ্ন করল, এখানে হঠাৎ হল্ট করলেন যে? জঙ্গলে পৌঁছতে তো রাত হয়ে যাবে।

অবনী বললেন, আমাদের থলকোবাদে কাল থেকে বুকিং। আজ মেঘাতুবুরু যাচ্ছি। রাস্তায় জিপটা খারাপ হলে বলে…

অর্থাৎ জিপ সারানোর ফাঁকে আলাপ ঝালাতে এলেন?

হ্যাঁ মানে…

দাদার সঙ্গে কি ট্রেনেই আলাপ? না আগে থেকে পরিচয় ছিল?

বিকাশের স্বরে কেমন যেন জেরা করার সুর। টুপুর মিতিনের দিকে তাকাল।

বিকাশের জেরা মিতিনেরও ভাল লাগেনি। গলা একটু ভারী করেই উত্তর দিল, কেন, শুধুমাত্র ট্রেনের পরিচয়ে বুঝি বাড়িতে আসা যায় না?

বিকাশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

পুরুষোত্তম বলে উঠলেন, কোত্থেকে হবে? তোর দাদা তো সেই সকালবেলা বেরিয়ে গেছে।

কোথায় গেল?

কী জানি! বললাম অ্যাম্বাসাডারটা নিয়ে যা, ড্রাইভারও আছে… কিছু না বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। কোনও বন্ধুটন্ধুর বাড়ি গেছে বোধহয়।

বিকাশ আবার কাঁধ ঝাঁকাল। চলেই যাচ্ছিল ভেতরে, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, বেড়াতে যাচ্ছেন যান, তবে রেস্টহাউস ছেড়ে জঙ্গলে বেশি ঘোরাঘুরি করবেন না।

কেন?

সিমলিপাল থেকে একটা হাতির পাল এসে ঢুকেছে সারান্ডায়। প্রত্যেক বছরই এ সময়ে হাতিরা আসে, সেটা বড় কথা নয়। ভয়ের কারণ হল, ওই দলের মধ্যে থেকে একটি হাতিকে রোগ ডিক্লেয়ার করা হয়েছে।

রোগ মানে পাগলা হাতি?

ইয়েস। হাতির পাল সারান্ডায় ঢোকার পর কেউ বোধহয় ওই হাতিটাকে গুলি করেছিল। মরেনি হাতিটা, কিন্তু খেপে গিয়ে দলছাড়া হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

পুরুষোত্তম উত্তেজিত স্বরে বললেন, আমাদের জঙ্গলে হাতিকে গুলি করল? কার এত সাহস?

বিকাশ নিরুত্তাপ গলায় বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন জঙ্গলে হাতিকে শুট করার ঘটনা পৃথিবীতে এই প্রথম ঘটল?

যেখানে যা খুশি হোক, সারান্ডায় কেন হবে?

দ্যাখো বাবা, পুরুষ হাতি বুড়ো হলে অনেক সময়েই তাকে দল থেকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। সে তখন রোগ বনে যায়। এই বুড়ো হাতিটা আগেই দলছুট হয়ে পাগলা বনে যাওয়ার পর গুলি খেয়েছে, না কি গুলি খাওয়ার পর পাগল হয়েছে, এটা সঠিকভাবে বলা কঠিন। রেঞ্জারসাহেবও ঠিক ঠিক বলতে পারলেন না। যদি আগেই পাগলা বনে গিয়ে থাকে, তো সেই হাতিকে নিকেশ করে দেওয়াই তো ভাল। না হলে তো গ্রাম-কে-গ্রাম ছারখার করে দেবে।

কিন্তু গুলিটা করল কে? কোনও চোরাশিকারির দল ঢোকেনি তো জঙ্গলে? হাতির দাঁতের লোভে?

হতেও পারে। নাও হতে পারে। চোরাগোপ্তা শৌখিন শিকারিও তো থাকে। এখন শিকার নিষিদ্ধ বটে, তা বলে দু-চারটে মানুষের কি আর বাঘ হাতি সিংহ হরিণ মারতে সাধ যায় না? তুমিই তো গল্প করেছ একসময় কত সাহেবসুবো জঙ্গলে জন্তু মারতে আসত। তোমার নিজেরও তো এককালে শিকারের নেশা ছিল।

পুরুষোত্তম গর্জে উঠলেন, আমার সঙ্গে তুমি অন্যদের তুলনা করবে না। আমি কখনও বিনা কারণে কোনও পশুকে হত্যা করিনি। আমি শুধু বাঘ মেরেছি। তাও সেই বাঘ কোনও মানুষকে মারার পর।

কে জানে কেন বিকাশ আর তর্কে গেল না। পরদা সরিয়ে চলে গেছে অন্দরে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই চুপ। একটু আগের গল্প আড্ডার পরিবেশ যেন ছানা কেটে গেছে। অবনী বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পার্থও।

খানিক পরে নজরুলের জিপ এসে যেতে বিদায় নিল সকলে।

মোরামের রাস্তা ছাড়িয়ে গাড়ি মেন রোডে পড়তেই সহেলি বলে উঠলেন, শোনো বাপু, সাফ কথা বলি। সারান্ডা মারান্ডায় আর গিয়ে কাজ নেই। মুকুলবাবুর পরামর্শটাই ভাল। মেঘাতুবুরুতে এক-দুদিন কাটাব, ওখান থেকেই একটু জঙ্গল দেখে আসব, তারপর সোজা চলে যাব গালুডি।

পাৰ্থ হেসে বলল, কিন্তু বড়দি, আমার যে পাগলা হাতি দেখার ভীষণ শখ।

বুমবুম হাততালি দিয়ে উঠল, আমিও পাগলা হাতি দেখব।

তোমরা দ্যাখোগে যাও। আমায় একটা বাসে তুলে দিয়ে, আমি চাইবাসা ফিরে যাব।

টুপুর টিপ্পনি জুড়ল, ভয় পাচ্ছ কেন মা? তুমি নয় সারান্ডা গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থেকো।

অবনী অনেকক্ষণ পর কথা বললেন, আমি কিন্তু তাই থাকব।

বাইরে মায়াবী বিকেল। কাঁচা সোনারঙের রোদ্দুর। পাহাড় জঙ্গল কাছে এসে গেছে, দুধারে এখন শালগাছের মিছিল।

একটা তেমাথার মোড়ে এসে থামল জিপ। সামনে বাঁশ নামিয়ে রাস্তা আটকে রেখেছে বনবিভাগ। গাড়ির নম্বর নেবে। আইন। পাশেই বনবিভাগের ছোট্ট অফিস, গুমটির মতো। এখান থেকেই দুটো পথ চলে গেছে দুদিকে। একদিকে মনোহরপুর, অন্যদিকে মেঘাতুবুরু।

রাস্তার মাথায় সবুজ তোরণ। সেখানে বড় বড় করে লেখা, ওয়েলকাম টু সারান্ডা।

লেখাটার দিকে তাকিয়ে মিতিন হঠাৎ বলে উঠল, মনে হচ্ছে সারান্ডা টুরটা এবার একেবারে নিরামিষ হবে না। বুঝলি টুপুর!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *