Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya » Page 10

সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya

১০. কাকভোরে রেঞ্জ অফিসে

কাকভোরে রেঞ্জ অফিসে চলে গেছে সারগিয়া। মিতিনের চিঠি নিয়ে। একটু পরে মিতিনও রওনা হল মেঘাতুবুরু। একাই। টুপুরের খুব ইচ্ছে ছিল যাওয়ার, কিন্তু তাকে নিল না মিতিন। পার্থকেও না। জঙ্গলের রাস্তা বিপদসঙ্কুল বটে, তবে নজরুলের ওপর মিতিনের যথেষ্ট ভরসা আছে। বাকিরা বরং সকালে একটু এদিক-ওদিক ঘুরুক। সকালটা বেজায় ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছিল টুপুরের। মিতিনমাসির ওপর অভিমান হচ্ছে মনে মনে। রাতেও তো মিতিনমাসির কথা শুনে মনে হয়েছিল টুপুরকে সে সঙ্গে নেবে। শেষ পর্যন্ত কেন যে টুপুরকে কাটিয়ে দিল? এখনও কি টুপুরের ওপর আস্থা জন্মায়নি মিতিনমাসির?

সারগিয়ার বদলে সুমায়া আজ রান্নাঘরে। উনুন জ্বালিয়ে ময়দাটয়দা মেখে দিল সুমায়া, ঝটপট লুচি ভেজে ফেললেন সহেলি। দুপুরের রান্নার ভারও আজ সহেলির ওপর। রেঞ্জ অফিস মাইলদশেক দূর পোরঙ্গায়। সাইকেলে গেছে সারগিয়া, এই পাহাড় জঙ্গলের রাস্তা ঠেঙিয়ে কখন ফেরে তার ঠিক কী!

সহেলি কুটনো কুটছেন। সুমায়া সামনের কাঁঠালগাছ থেকে একটা কচি এঁচোড় পেড়েছিল সকালে, সহেলি আজ বড় করে এঁচোড়ের ডালনা রাঁধবেন। সরষে দিয়ে ডিম। সুমায়া হাতে হাতে সাহায্য করছে তাঁকে। এমনিতেই অবশ্য সুমায়ার আজ অনেক কাজ। ঘরদোর পরিষ্কার করবে, জলটল তুলবে, কাচাকুচিও আছে কিছু। হ্যারিকেনের চিমনিগুলোতে কালি পড়েছে, সেগুলোও ভাল করে মোছার জন্য নির্দেশ জারি করেছেন সহেলি।

পার্থ টুপুরকে বলল, চল, আমরা একটু থলকোবাদটা সার্ভে করে আসি।

অবনী বারান্দার বেতের চেয়ারে। বই পড়ছেন। আমাজনের পোকামাকড় খতম, এখন তিনি ড়ুবেছেন মহাসমুদ্রের গভীরে। ওশনোগ্রাফির একখানা বই এখন তাঁর সঙ্গী।

বইতে চোখ রেখেই অবনীর মন্তব্য, কী দেখার আছে আর থলকোবাদে?

পার্থ বলল, গ্রামটা দেখব।

সে তো কাল কালিঝরনা যাওয়ার পথেই দেখে নিয়েছ। খানচল্লিশেক কুঁড়েঘর, গোটাপাঁচেক দোকান, একটা টেলারিং শপ, একখানা স্কুল, আর কিছু মুরগি, ভেড়া, ছাগল। পাঁচটা দোকানের তিনটে মুদিখানা, দুটো টি-স্টল। সবথেকে বড় মুদিখানার মালিকটি মোটেই আদিবাসী নয়, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।

আইব্বাস! যাতায়াতের দুই দুই চার মিনিটে আপনি এত কিছু নোট করে নিয়েছেন?

ডিটেকটিভগিরি করি না ভাই। করলে অনেকের অন্ন মারা যেত।

কথাটায় যেন সামান্য ঠেস আছে। মিতিনের উদ্দেশে। বোধহয় মনে মনে মেঘতুবুরু যাওয়ার সাধ ছিল অবনীর, মিতিন তাঁকে একবারও ডাকেনি বলে তিনি ঈষৎ ক্ষুব্ধ। তার ওপর উৎসাহ নিয়ে কাল রাতের কাহিনী যখন সবে শোনাতে শুরু করেছিল টুপুর, মিতিন তাকে নিষেধ করল, এটাও বোধহয় ক্ষোভের আর একটা কারণ।

পার্থ বলল, বুঝেছি। এবার গাত্ৰোত্থান করুন।

অবনী বললেন, আমি বেরোব না। তোমরা যাও। ঘুরে এসে বোলো আমার ইনফরমেশানে কোনও গলতি আছে কি না।

অগত্যা বেরিয়ে পড়ল টুপুররা। আগে আগে লাফাতে লাফাতে বুমবুম। বিট অফিসারের কোয়ার্টার পেরিয়ে ডানদিকে মেঠো পথ। রাস্তার দুধারে থলকোবাদ গ্রাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যেও থলকোবাদ মোটেই পাণ্ডববর্জিত এলাকা নয়, গ্রামে লোকবসতি আছে ভালই। ছোট্ট একটা বাজার মতোও আছে। সাইকেল চড়ে আদিবাসীরা এসেছে বাজারে, শাকসবজি কেনাকাটা করছে। একটা দোকান উগ্ৰ গন্ধে ম ম। বাইরে বেঞ্চিতে বসে আদিবাসীরা শালপাতার দোনায় পান করছে কী যেন। পার্থই বলে দিল পানীয়টা মহুয়া। অবনীর কথামতো দরজির দোকানও দেখা গেল একটা। বড়। মুদিখানাও। মুদিখানার মালিক সত্যিই এক গৌরবর্ণ মধ্যবয়সি পুরুষ। এবং তিনি যে আদিবাসী নন, এক ঝলকেই চেনা যায়।

স্কুলটাও রাস্তার ধারে। কাল টুপুর নজর করেনি। বেশ বড়ই বলা যায় স্কুলটাকে। একতলা পাকাবাড়ি, ভেতরে কম করেও খানদশেক ঘর। সামনে বিশাল মাঠ। ফুটবল পেটাচ্ছে কয়েকটি আদিবাসী কিশোর। এই সকালবেলাতেই। কখন এদের স্কুল বসে? না কি থলকোবাদে এখন বসন্তের ছুটি?

স্কুলটাকে দেখতে দেখতে টুপুর বলল, সুমায়াকে কেন জামদায় পড়তে পাঠিয়েছিল সারগিয়াদাদা? এই স্কুলটাই তো ভাল ছিল।

পার্থ বলল, বোধহয় আরও ভাল স্কুলে পড়ানোর শখ হয়েছিল।

তো? এখনও তো সুমায়া এখানে ভর্তি হতে পারে!

ও একবার না পড়ার স্বাদ পেয়ে গেছে। আর কি ওকে স্কুলে ঢোকানো যাবে?

পার্থ হাসতে হাসতে বলল, তা ছাড়া ওর ন্যাক জাঙ্গল-লাইফে, ও নিজের মতোই বড় হোক।

সুমায়ার কিন্তু কাল থেকে খুব মনখারাপ।

হবেই তো। জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারকে ও ভীষণ ভালবাসে।

স্কুল পেরিয়ে ছোট ছোট খেত। কচি সবুজ ধানগাছে নরম। গালিচার মতো হয়ে আছে খেতগুলো। এ জায়গাটা মোটামুটি সমতল। কোনও পাহাড়ি ঝোরা থেকে নালা কেটে এনে সেচের। বন্দোবস্ত করা হয়েছে খেতে। নালার জল অতি স্বচ্ছ। কাকচক্ষুর মতো। বুমবুম দৌড়ে গিয়ে জলটা ছুঁয়ে এল। আবার যাচ্ছে ছুঁতে। খেলা।

গ্রামের শেষে ফের জঙ্গল। প্রথমে হাল্কা, ক্রমশ ঘন। কচি শালপাতায় সবুজ হয়ে আছে গাছগাছালি। পাখি ডাকছে পিক পিক। গ্রামে চড়া রোদ ছিল, এখানে সূর্য অনেক নরম।

জঙ্গলের মধ্যিখানে এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল পার্থ। বলল, চোখ বোজ।

কেন?

বোজ না। বুমবুম, তুইও চোখ বন্ধ কর।

চোখের পাতা একটুখানি বন্ধ রাখতেই এক অপার্থিব অনুভূতি। প্রায় নিস্তব্ধ জঙ্গলে টুপ টুপ টুপ টুপ শব্দ হচ্ছে একটানা। যেন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।

পার্থ বলল, শব্দটা কীসের বল তো?

কীসের?

ফুল ঝরছে অবিরাম। পাতা খসছে।

শব্দটা দারুণ ভাল লেগে গেল টুপুরের। একটু হাঁটছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শুনছে। সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে বনতল। বুমবুম আর টুপুর কুড়োচ্ছে ফুল। শুঁকছে ফুলগুলোকে।

টুপুর বলল, একটা স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার লক্ষ করেছ মেসো? শাল সেগুন গাছের নীচে কত ফুল পড়ে থাকে, কিন্তু মহুয়াগাছের নীচটা একেবারে ফাঁকা। মহুয়াগাছের ফুল কি ঝরে না?

পার্থ মুচকি হাসল, ঝরে, কিন্তু থাকে না। সাফ হয়ে যায়।

বুঝেছি। টুপুরও মুখ টিপে হাসছে, আদিবাসীরা ওই ফুল দিয়ে নেশা করার মহুয়া বানায়।

শুধু নেশার কাজে নয়, মহুয়ার ফুল ফল আরও অনেক কাজে লাগে রে! ওই ফুল কিংবা ফল সেদ্ধ করে খাদ্যবস্তু হিসেবে খায় আদিবাসীরা। পেট ভরানোর জন্যে। মহুয়া ফলের বীজ থেকে তেল বার করে ওরা রান্নাবান্না করে। মহুয়ার খোল ব্যবহার হয় সার হিসেবে। গোরু ছাগলেও খায়। ওই খোলের ধোঁয়ায় মশা পালায়।

পার্থর বক্তৃতার মাঝেই বুমবুম চেঁচিয়ে উঠল, টুপুরদিদি, টুপুরদিদি, ওই দ্যাখো খরগোশ!

বুমবুমের গলার আওয়াজে খরগোশগুলো থমকে গেছে। পিছন ঘুরে সাঁ দৌড় লাগাল জঙ্গলে।

পার্থ বুমবুমকে বলল, যাক, তোর তবে আর একটা অ্যানিম্যাল দেখা হয়ে গেল।

টুপুর বলল, খরগোশগুলো কী লাভলি! ইস, মিতিনমাসি মিস করল!

কিছু মিস করেনি। তোর মাসি এখন আসল ওয়াইল্ড অ্যানিম্যালের পেছনে ছুটছে।

টুপুর ভুরু কুঁচকে বলল, মেঘাতুবুরুতে মিতিনমাসি কী করতে গেল বলো তো?

মনে হল কাউকে ফোনটোন করবে। টেলিফোনের ছোট নোটবইটা তো নিয়ে গেল।

শুধু ফোন?

আরও কিছু প্ল্যান আছে হয়তো। আমাদের এখনই জানাতে চায় না।

সাড়ে দশটা বাজে। জঙ্গলে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না টুপুররা। ফিরছে।

রেস্টহাউসের কাছাকাছি এসে টুপুর দেখল কম্পাউণ্ডে একখানা জিপ দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছলাৎ করে উঠেছে। মিতিনমাসি ফিরে এল নাকি?

আরও কাছে এসে ভুল ভাঙল। অন্য জিপ। জে এইচ কে সাতশো উনত্রিশ। ছোকরা সারথি ড্রাইভিং সিটে বসে কানে পালক ঘোরাচ্ছে।

চাতালে উঠে টুপুর ভীষণ অবাক! বারান্দায় অবনীর পাশে মুকুল সিংহ! দুজনের হাতেই চায়ের কাপ।

পার্থ বিস্মিত স্বরে বলল, আপনি কোত্থেকে?

মুকুল গাল ছড়িয়ে হাসলেন, এসেছি কুমডিতে। আমাদের আই-আই-টির এক প্রোফেসর ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন সারান্ডায়। জোর করে আমায় জামদা থেকে তুলে নিয়ে এলেন। জঙ্গলে ওঁর খুব ভয়, আমাকে না নিয়ে তিনি জঙ্গলে ঢুকবেনই না। আমার মতো প্যাংলা লোক নাকি ওঁদের বাঘ সিংহের হাত থেকে বাঁচাবেন! হা। হা।

তা ওঁরা কোথায়?

বললাম যে, কুমডিতে। রেস্টহাউসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সেই খড়্গপুর থেকে টানা এসেছেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাহিল। মুকুল চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখলেন, এই সুযোগে আমিও ভাবলাম আপনাদের সঙ্গে একটু মোলাকাত করে আসি। আমার বাড়িতে এসেছিলেন, সেদিন দেখা হল না..

ভালই করেছেন। পার্থ ঘর থেকে চেয়ার টেনে এনে বসল, ফেরার পথে আর দেখা হত কি হত না…

মুকুল বললেন, আপনাদের সারান্ডা ভ্ৰমণ তো শুনলাম খুব জমে উঠেছে? ম্যাডামও দিব্যি একটা কেস পেয়ে গেছেন?

আপনি লিগিরদা এপিসোডটা শুনলেন?

অবনীবাবু বলছিলেন। কী ডেঞ্জারাস কাণ্ড বলুন তো? জঙ্গলে জঙ্গি হানা!

অবনী বললেন, কাল রাতেও তো কীসব কাণ্ড হয়েছিল। মাঝরাত্তিরে কারা নাকি জিপ নিয়ে ইনস্পেকশন বাংলোয় এসেছিল।

তাই নাকি! কারা?

টুপুর বলতে পারবে। এই টুপুর, বল না কী হয়েছিল!

টুপুর ঢোক গিলল। কাল রাতের ঘটনাটার প্রচার চায় না মিতিনমাসি, মুকুলবাবুকে বলাটা কি উচিত হবে? বিশেষ করে মুকুলবাবুর বাবা আর ভাই যখন মিতিনসির সন্দেহের তালিকায় আছে? তা ছাড়া এই মুকুলবাবুও তো একজন সিংহ, একথা তো ভুললে চলবে না।

টুপুর সপ্রতিভ স্বরেই বলল, দেখলাম তো রেস্টহাউস থেকে। হুশ করে একটা জিপ ঢুকল, জেনারেটার চলল, আলো জ্বলল… তারপর কিছুক্ষণ থেকে জিপটা চলে গেল, আলোও নিভে গেল।

কারা ছিল জিপে?

দেখতে পাইনি। জিপটা তো এদিকে আর আসেইনি। বোধহয় বাংলোর ভেতর দিয়ে জঙ্গলে নেমে গেছিল।

অবনী বললেন, তাই? লিগিরদা গেল নাকি?

মুকুল বললেন, ওই গেট দিয়ে তো হাজারো দিকে যাওয়া যায়… আপনাদের চৌকিদার কী বলছে? কজন ছিল?

টুপুর একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, তিনজন।

ও চেনে?

বলল তো, না।

তার মানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কেউ নয়। মুকুল মাথা নাড়লেন, অনেক সময়ে রাত্তিরে উলটোপালটা পাবলিকও চলে আসে। অনেকেরই তো রাতে জঙ্গল দেখার নেশা। তারা পারমিট টারমিটের পরোয়া করে না, চৌকিদারকে পয়সা খাইয়ে হুটহাট বাংলোয় ঢুকে যায়। অথচ আপনারা, আই মিন জেনুইন টুরিস্টরা, গভর্নমেন্টকে পয়সা দিলেও ওই বাড়ি ভাড়া পাবেন না।

পার্থ তির্যক স্বরে বলল, জঙ্গলের কানুন বোধহয় এরকমই হয়।

জঙ্গলের কানুন! ভাল বলেছেন তো! হা হা হা। মুকুল হাসতে হাসতেই বললেন, তবে লোকগুলো যদি কালপ্রিটও হয়, তা হলে তাদের কাল রাতের এক্সপিডিশান মাটি হয়েছে। আপনার মিসেসের নুন ফেলে দেওয়ার আইডিয়াটা ব্রিলিয়ান্ট।

পার্থ বলল, হ্যাঁ, মিতিনের মাথায় চটপট বুদ্ধি এসে যায়।

মুকুল বললেন, দেরি না করে আজই রেঞ্জ অফিসে খবর পাঠিয়ে দেওয়াটাও ভাল কাজ হয়েছে। যদিও, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, এখানকার রেঞ্জ অফিসগুলোর ওপর আমার খুব ভরসা নেই।

কেন?

ওরা তো সব ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। গোটা সারান্ডায় আপনি সাকুল্যে কুড়িখানা রাইফেল পাবেন কিনা সন্দেহ।

আমার স্ত্রী বোধহয় চাইবাসাতেও ফোন করবে।

গুড। ভেরি গুড। যদি কিছু করতে পারে, তো ডিস্ট্রিক্ট অফিসই পারবে। মনে হয় ম্যাডামের দৌলতে হাতিটা বোধহয় এযাত্ৰা রেহাই পেয়ে গেল। ডি-এফ-ও সাহেব হুকুম ছাড়লেই জঙ্গলের সমস্ত গেট সিল হয়ে যাবে। ব্যস, তখন কালপ্রিটদেরও পালানোর রাস্তা বন্ধ।

অবনী বললেন, ব্যাটাদের ধরে আচ্ছাসে জেলের চাকি পেষানো দরকার। হাতির মতো একটা প্রাণীকে অ্যাটাক করবে…ছি ছি ছি।

শুরু হয়ে গেল হস্তী প্রসঙ্গ। সারান্ডার জঙ্গলেরই অজস্ৰ হাতির কাহিনী উপকাহিনী শোনাতে লাগলেন মুকুল। কোথায় দুই হাতিতে নাকি টানা ছাব্বিশ দিন লড়াই চলেছিল, কীভাবে একটা বাচ্চা হাতিকে উদ্ধার করেছিল অন্য হাতিরা, পাগল হাতিকে কেন বাকিরা দলে রাখে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

গল্পের মাঝেই রান্নাঘর থেকে সহেলির আবির্ভাব। সহেলি মুকুলকে বললেন, এবেলা আর ফিরবেন কেন? ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের এখানেই চাট্টি খেয়ে নিন। তারপর চলুন করমপদা। মধুবাবার দর্শন করে আসি।

অবনী বললেন, উত্তম প্রস্তাব। ফেরার পথে আমরাই নয় আপনাকে কুমডিতে ছেড়ে দিয়ে আসব। জানেন তো, আমার শ্যালিকার আজ সকালে কুমডি যাওয়ারই প্ল্যান ছিল।

ওরেব্বাস, অসম্ভব।

কেন?

প্রথমত, আমার সঙ্গীরা তিনটের মধ্যে জঙ্গল ছাড়বে, আমাকে ওদের সঙ্গে থাকতেই হবে। দ্বিতীয়ত, আমার ওই মধুবাবাতে কোনও আকর্ষণ নেই। কারণ আমি কোনও বুজরুক সাধুতে বিশ্বাস করি না।

মধুবাবা বুজরুক? সহেলি হাঁ হাঁ করে উঠলেন।

ভেলকি দেখানো সাধুমাত্রই বুজরুক। এই নিয়ে বাড়িতে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কত তর্ক হয়ে গেল। বিকাশের আবার এসবে খুব বিশ্বাস। ওই মধুবাবার কাছে তো বারতিনেক ঘুরে গেছে। একবার বউমাকে নিয়ে এসেছিল। মুকুল ঘড়ি দেখলেন, বারোটা বাজল, এবার আমি চলি। ম্যাডামের সঙ্গে আজ আর দেখা হল না। বাই দা বাই, আপনারা যেন ফিরছেন কবে?

শনিবার। রাত্তিরটা চাইবাসায় থেকে রবিবার চক্ৰধরপুর থেকে ট্রেন ধরার ইচ্ছে আছে।

আমার রিটার্ন নেক্সট রবিবার। মুকুল উঠে গাড়ির দিকে গেলেন, পারলে শনিবার চলে আসুন জামদায়। আমি হোল-ডে বাড়িতেই আছি।

মুকুল চলে যাওয়ার অনেক পরে মিতিন ফিরল। প্ৰায় দুটোয়। থমথমে মুখে।

মিতিন ফেরার খানিক আগে সারগিয়া ফিরেছে। সারগিয়া চিঠি পৌঁছে দিয়েছে বটে, তবে রেঞ্জার সাহেব অফিসে ছিলেন না, তিনি নাকি গেছেন সেরাইকেলা।

খেতে খেতে সারগিয়ার মুখে রেঞ্জ অফিসের বৃত্তান্ত শুনল মিতিন। টুপুর পার্থ শোনাল মুকুল সিংহর কথা।

মিতিন কথা বলছে অস্বাভাবিক কম। আহারের পর চাতালে হাঁটছে একা একা।

সহেলি তাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, করমপদায় যাবি তো? না কি আজ ক্যানসেল করে দেব? কাল না হয়…।

মিতিন মাথা নেড়ে বলল, না। আজই চলো।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *