Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা || Sankar Brahma

সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা || Sankar Brahma

পর্ব – এক ).

সাম্প্রতিক পাঁচজন আমেরিকান কবির কবিতা

[ ভূমিকা ও অনুবাদ: রাজিয়া সুলতানা ]

চার্লস সিমিককে বর্তমান সময়ের এক অনন্যসাধারণ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর জন্ম সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেদে ১৯৩৮ সালে। ১৯৫৪ সালে বাবার সাথে যোগ দিতে তিনি মা এবং ভাইয়ের সাথে আমেরিকায় চলে আসেন। পরে সেখানেই নাগরিকত্ব নেন। একুশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘হোয়াট দ্য গ্রাস সেইজ’। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন একাডেমিক ফেলোশিপ এবং পুলিৎজারসহ বহু পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলগ্রেদে নিজের শৈশব এবং কৈশোরে যুদ্ধের যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয় তাঁর, পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতাই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে আধুনিক জীবনের আত্মিক শূন্যতার কথা।

আংশিক ব্যাখ্যা
চার্লস সিমিক

মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হলো
ওয়েটার আমার খাবারের অর্ডার নিয়েছে।
দুপুরের খাবারের এই রেস্তোরাঁটা খুব ছোট আর নোংরা
বাইরে বরফ পড়ছে।
মনে হচ্ছে আরো বেশি অন্ধকার হয়ে এসেছে
আমার পেছনে যখন শেষবার রান্নাঘরের দরোজার শব্দ পাই
তখন লক্ষ করি রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে।
বরফ দেওয়া একগ্লাস পানি
আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে
এই টেবিলে প্রথমে ঢুকেই জায়গাটা আমি বেছে নিয়েছি।
এরপর তৃষ্ণা জেগেছে এক
অসম্ভব এক বাসনায়
রাঁধুনেদের কথোপকথন
শোনার জন্য আড়ি পেতেছি।

মেরি কর্নিশের জন্ম ১৯৪৮ সালে। প্রধানত লেখক এবং শিশুদের বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। তিনি তাঁর শেষজীবনে কবিতার দিকে ঝুঁকেছিলেন যখন তিনি সারাহ লরেন্স কলেজে ক্রিয়েটিভ ননফিকশনের ওপর কোর্স করতে যান। কবিতায় গৃহস্থালী জীবনের ওপর চিন্তাশীল তদন্তকার্য চালানোর জন্য তিনি সুপরিচিত। কবিতায় শিল্প, দক্ষতা এবং অতীতের মাঝে সম্পর্ক অন্বেষণে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর কবিতাসংকলনের নাম ‘রেড স্টুডিও’ (ওবার্লিন কলেজ প্রেস থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়)। তিনি ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।

সংখ্যারা
মেরি কর্নিশ

সংখ্যাদের উদারতা আমার পছন্দ
যেভাবে ওরা কোনোকিছু বা কাউকে গণনা করে
দুটো আচার, ঘরে যেতে একটা দোর
রাজহাঁসের পোশাকে নর্তকী আটজন।

যোগ অংকের গৃহস্থালী আমার পছন্দ—
দুইপেয়ালা দুধ যোগ করো আর নাড়ো
প্রাচুর্য্যের বোধটাই ধরো মাটিতে ছয়’টা বরই
গাছ থেকে পড়ছে তিনটে আরও ।
আর গুণনের বিদ্যায়
মাছ দিয়ে যদি মাছ গুণ করো,
নৌকোর ছায়ার নীচে রুপোলি শরীরে তাদের জন্ম।
এমনকি বিয়োগেও নেই ক্ষতি কোনও
অন্য কোথাও তো হচ্ছে যোগ-বাড়ন্ত
ধরো পাঁচটা চড়ুই, তার থেকে নিলে দুটো
অন্য কারো বাগানে এখন ওদের দিব্যি পাচ্ছো।
ভাগ অংকেও রয়েছে বিস্তার,
‘টেক আউট’ চাইনিজ খাবারের বাক্স যদি খোলো
ভাঁজ করা প্রত্যেক কুকির ভেতর
খুলে যাবে নতুন এক ভাগ্য।
বিস্মিত হই না কখনও
উপহারে যখন বেজোড় অবশিষ্ট,
এবং অবশেষে মুক্ত
সাতচল্লিশকে এগারো দিয়ে ভাগ করো
পাবে চার ভাগ,শেষে রবে তিনও।
তিনটে বালককে মা ফোন করে পাচ্ছে না
দু’জন ইতালীয় সমুদ্রের দিকে গেছে
একটা মোজা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না

ক্যারল স্নো কবি ও লেখক।
তাঁর ছয়টি কবিতাগ্রন্থের মধ্যে ‘প্লেসড কেউরসেন্সুই’ [২০০৮ সালে প্রকাশিত] উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতাকে বর্ণনা করা হয় ‘পোস্ট-ট্রমাটিক’ হিসেবে—যেটি অর্ধেক দেখা, অর্ধেক স্মরণের মাঝে ঘুরপাক খায়। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন পুশকার্ট পুরস্কার।

ভ্রমণ
ক্যারল স্নো

জাপানে এক মন্দিরের কাছে সে পথে ঝাড়ু দিত
তারপর ক্যামেলিয়া ফুল বিছিয়ে রাখত সেখানে

অথবা—জানার কোনো উপায়ই নেই—
সে সেই পথে ঝরে পড়া ক্যামেলিয়াগুলোর মাঝখানে ঝাড়ু দিত কিনা

ট্রেসি কে. স্মিথ ম্যাসাচুসেটসে ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে উঠেছেন নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ায়। এ যাবত তাঁর চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘বডি’স কোয়েশ্চেন’ [২০০৩ সালে প্রকাশিত] বইটির জন্য কেইভ কানেম পুরস্কার পান। যেটি আফ্রো-আমেরিকান লেখক হিসেবে তাঁর সেরা প্রথম বইয়ের জন্য দেওয়া হয় তাকে। ‘লাইফ অন মার্স’ [২০১১ সালে প্রকাশিত] বইটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন ২০১২ সালে। তিনি আমেরিকান পোয়েট লরিয়েট হিসেবে ছিলেন ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত। তাঁর কবিতায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জীবনের গভীর সত্য বিশেষ করে তাদের সমাজ-সংস্কৃতি এবং টিকে থাকার যুদ্ধ বিশাল জায়গা অধিকার করে আছে। তবে নারীসত্তার গহন-মগ্ন উদ্ভাস পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়, যা তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ান।

উত্তম জীবন
ট্রেসি কে. স্মিথ

যখন কেউ টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলে
এবং এমনভাবে বলে যেন এগুলো কোনো রহস্যময় প্রেমিক অথবা প্রেমিকা
যারা দুধ ক্রয় করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি,
ভাবতে ভাবতে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি
কতগুলো বছর যে আমি শুধু কফি আর রুটির ওপর বেঁচে ছিলাম,
পেটে খিদে থাকত সারাক্ষণ, বেতন পাবার দিন সেই স্ত্রীলোকটির মতো পায়ে হেঁটে কাজে যেতাম
গ্রামে কুয়ো না থাকায় পানি সংগ্রহের জন্য যে অন্যগ্রামে যেত
তারপর এক কি দুই রাত অন্য সবার মতন
চিকেন-রোস্ট আর রেড ওয়াইন খেয়ে বেঁচে ছিলাম।

স্টিভ কোইট নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন (১৯৩৮-২০১৫)। তিনি একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, শিক্ষক ও ওয়ার্কশপের কাজে সহযোগী। তরুণ বয়সে কফিশপে নিয়মিত কবিতা পড়েছেন। ঘোর যুদ্ধবিরোধী, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি, বরং সেই যুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আমেরিকা কতৃক ভিয়েতনামী মানুষদের পশুর মতো বধ করার আয়োজন’ বলে। পুশকার্ট পুরস্কারসহ পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। কবিতার পাশাপাশি তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্ম পাবলো নেরুদার, ইনসাইটমেন্ট টু নিক্সনিসাইড এন্ড প্রেইজ ফর দ্য চিলিয়ান রেভ্যুলেশন-এর ইংরেজি অনুবাদ। তাঁর তেরটি কবিতাগ্রন্থের মধ্যে ‘চেরিশ নিউ এন্ড সিলেক্টেড পোয়েমস’ (২০১৫) অন্যতম।

কিছু মেঘ
স্টিভ কোইট

এখন যখন ফোন খুলে রেখে দিয়েছি,
কেউ আর আমাকে পাবে না
অন্তত এই বিকেলে তো নয়
এখন আমার পরামর্শ আর মতামত ছাড়াই তাদের চলতে হবে।
এখন কেউ আর আমাকে কল করবে না
দ্বিধান্বিত কণ্ঠে শুধাবে না
একদা যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসতাম
তার মৃত্যুর খবর আমি শুনেছি কি না—
শহরের ওপর যে ছাইগুলো উড়ছিল যেখানে সেখানে
সেগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হয়েছে।
হ্যাঁ, ধন্যবাদ, আমি শুনেছি।
আজ সকালটা এত সুন্দর ছিল যে
তারই আমাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল।
সূর্যটা ছোট কমলালেবুগুলোকে মাতাল করে তুলেছে
আর জ্বলজ্বলে লাল আর হলুদ ফুলগুলো যেন অযুত মোমবাতি।
আজকের এই বিকেলে আমাকে তাদের ছাড় দিতে হবে
অনেক আগের ঘটনাগুলো আবার ঘটছে সেগুলো দেখতে আমি ব্যস্ত
জোসেফিনের বাগানে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দেখছি অসম্ভব নীল আকাশ,
ভেঙে গেছে—বলা যায়—
সাদা সাদা অসম্ভব কমনীয় উত্তাল কিছু মেঘের তরঙ্গ
এক শূন্যগর্ভ থেকে আরেক অনস্তিত্বে ধাবিত হচ্ছে।

পর্ব – দুই ).

উত্তর আমেরিকার পাঁচটি সাম্প্রতিক কবিতা

অনুবাদে কবিতা মোশতাক আহমদ
[ মোশতাক আহমদ
জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৬৮; টাঙ্গাইল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একটি উন্নয়ন সংস্থায়। ]

[ যুক্তরাষ্ট্রের ২০০১- ২০০৩ সালের পোয়েট লরিয়েট বিলি কলিন্স সম্পাদিত ‘পোয়েট্রি ১৮০’ ( র‍্যানডম হাউস ট্রেড পেপারব্যাকস নিউ ইয়র্ক, ২০০৩) এবং কারমিন স্টারনিনো ও মলি পিকক সম্পাদিত ‘দা বেস্ট ক্যানাডিয়ান পোয়েট্রি ২০১২’ (টাইট্রোপ বুকস, ২০১২)—এই দুটি সাম্প্রতিক কবিতার সংকলন থেকে কবিতাগুলো নেওয়া হয়েছে। চ্যাঙমিঙ ইউয়ান কানাডার কবি, বাকি সবাই যুক্তরাষ্ট্রের। ]

এডওয়ার্ড নোবলস : কবিতার বইয়ের নাম থ্রু ওয়ান টিয়ার ( ১৯৯৭), দা ব্লু স্টোন ওয়াক ( ২০০০)। বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের পেনবস্কট নদীর ধারের বেনগর শহরে।

রবার্ট ফিলিপস : সাতটি কবিতার বই (স্পিনাচ ডেজ, সিলেক্টেড পোয়েমস ইত্যাদি) ও তিনটি গল্পগ্রন্থের জনক; সম্পাদক ও সমালোচক। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস এন্ড লেটারস থেকে পুরস্কার পেয়েছেন।

চ্যাঙমিঙ ইউয়ান : চীনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। কানাডায় অভিবাসনের আগেই লেখালেখি শুরু করেন। ইংরেজিতে ডক্টরেট এই কবি ভ্যানকুভারে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ছেলে ‘এলেন কুইং ইউয়ান’ও একজন কবি। দেশবিদেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ও সংকলনে চ্যাঙমিঙ ইউয়ানের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনিই ম্যান্ডারিনভাষী কিন্তু ইংরেজিতে লিখেন এমন কবিদের মধ্যে বিরল একজন।

রিচার্ড জোনস : কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের জনক; উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে ‘দা ব্লেসিংস : নিউ এন্ড সিলেকটেড পোয়েমস’। বেশ কিছু কাব্য সংকলনে তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছে।

জো ওয়েন্ডেরথ : শৈশব কেটেছে বাল্টিমোরে। কবিতার বই ডিজফরচুন ( ১৯৯৫), ইট ইজ ইফ আই স্পিক (২০০০)। উপন্যাসও লিখেছেন। মিনেসোটার মার্শালে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক।

নীল পরিবার ॥ এডওয়ার্ড নোবলস
Nuclear Winter by Edward Nobles
.
যেদিন নীল আসমানটা নেমে এসেছিল
আকাশের নিচে চাপা পড়ে পৃথিবীটা নীল হলো,
ঘরবাড়ি গাড়িঘোড়া ঝোপঝাড়
আকাশের রঙ মেখে নীলাভ সাজলো;
শিশুরা সহসা অন্ধ দৌড়বাজ ।
আমার গিন্নি নীল ফ্যাশনেবল পোশাক পরে
হাতে রাখল হাত, নীল চোখে বিষাদ;
আমি হাঁটা দিলাম বাড়ির পেছনে অরণ্যের দিকে
নীল গাছের ভেতর নীল তুষারে ঢেকে গেলাম।
গাছের ফোঁকর থেকে বেরিয়ে এল একটা নীল কাক
পথের ওপর শুয়ে পড়ে বেদনায় নীলবর্ণ শৃগাল।
সে বছরটা খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল পৃথিবীতে।
আমাদের দুই ছেলেমেয়ে অবশেষে
আমাদের দেহের উপর হাঁটু গেঁড়ে বসল
নীল গ্র্যানাইট পাথর সেজে।
ঈশ্বরের ভালোবাসা চেয়ে চেয়ে কেউ কাঁদছে—
একটি নীলরঞ্জিত পরিবার
নীল তুষারের ভেতর হারিয়ে গেল।

সন্ত্রস্ত পাখি ॥ রবার্ট ফিলিপস
A Panic Bird by Robert Phillips

এই মাত্র উড়ে এল বুকের ভেতর
কিছুকাল আলো দেবে মগজে আবার
ভুল করে ঢুকে যাচ্ছে হাড়ের রাজত্বে
ভাঙনের শব্দ পাই বুকের খাঁচায়

দেখতে পেলে নির্ঘাত বাধা দিতাম শত
শক্ত ঢিল ছুড়ে কিংবা লাঠি দেখিয়ে
অথবা চকিতে ধরেই ফেলতাম ঘাড়

চালাক পাখিটা আসে পেছন দরজায়
নাগালের বাইরে ওড়াউড়ি তার
দেহের দালানে ঢুকে শতেক জ্বালাতন

শকুন আটকে যেনবা ইলেকট্রিকের তারে
বিকট চিৎকার ডানা ঝাপটানোর ফাঁকে
আমার যকৃতে ধারাচ্ছে তার ঠোঁট
নাড়িভুঁড়ি ফুসফুস ছিন্নভিন্ন তাতে
হাড় কালা আর রক্ত কালা হায়
নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে প্রায়
এমন সময় সরু ডানা ঝাপটে বেরোয়
উড়ছে উড়ছে ওই যে যাচ্ছে চলে
রেখে গেল দুর্গন্ধ আর ঝরা পালকের রাত
জীবন তো বয়ে চলে
নতুন শিকার হতে

অপেক্ষমাণ ॥ চ্যাঙমিঙ ইউয়ান
Waiting by Changming Yuan

ঘুরপথে আসা লেট করা বাসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা থাকে যাত্রীদের
শীতের ঘাসের জন্যে যেমন অপেক্ষা
জেব্রাশাবক শিকারের আগে সিংহেরও অপেক্ষা থাকে
গ্রীষ্মকালের সূর্য অপেক্ষমান কুয়াশাময় দুঃস্বপ্নের

জানালার পাশে অপেক্ষমান সবুজ অর্কিড
অজানা খনির গহবরে হিরার দ্যুতিময় অপেক্ষা
প্রাত্যহিক গাছগাছালি দেখতেও খামোখা দাঁড়িয়ে যাওয়া
অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা
যে অন্ধকার শব্দে অনূদিত হবে শাদা কাগজে

আলোকবর্ষ জুড়ে শীতার্ত তারাদের অপেক্ষা
লেখা শেষ করে দীর্ঘতর অপেক্ষা

ঘণ্টা ॥ রিচার্ড জোনস
The Bells by Richard Jones
.
নির্জন টাওয়ারের ঘণ্টা
কবির মতোই ভাবছে বসে একলা ঘরে

এক-মানুষের শক্তি লাগে
লোহায় গড়া সেই ঘণ্টা নাড়াতে ।

হঠাৎ নিচের দড়িতে কার স্পর্শ পেল টের
বাজার সময় হলো এইবেলা
বুঝতে পেরে মাথা নাড়ে ।

দূরের এক ঘরে
কবি শুনল রাত একটা বাজার নির্ঘোষ,
ঘণ্টা বাজছে—
উৎকর্ণ তাই।

আমার জীবন ॥ জো ওয়েন্ডেরথ
My Life by Joe Wenderoth

অবশেষে নিজের ঘরে ঢুকে দেখি
ফাঁদে পড়ে আছে এক ভয়ার্ত জানোয়ার,
দানাপানি দিয়ে বাঁচাই,
কৃতজ্ঞতায় ঘুর ঘুর করে আমার দু’পায়ে:

পোষা প্রাণীটার নাম রাখলাম ‘বাবা-জীবন’।
রোজ দানাপানি দিতে হয় নিজ হাতে
আমার বিছানায় ঘুমায়, স্বপ্নের ভেতর শ্বাস নেয়,
ভালবাসায় বেড়ে ওঠে, শক্তপোক্ত হয়
বেঁচে থাকবার খুচরো চালাকিগুলো শেখে।

সেদিন ওর গলায় চেন বেঁধে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে মনে হলো
সহজেই আমাকে খুন করে ফেলতে পারে সে
যখন তখন
হয়তো সে মতলবেই রয়ে গেছে এ বাড়িতে,
আমিও পালছি সরল বিশ্বাসে।
জানি না কী করা!

দানাপানি বন্ধ করে দিলাম,
হেলদোল নাই, আরো ডাগর হচ্ছে,
নিজেই নিজের খেয়াল রাখছে ইদানীং।
ওকে আর ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি শোনাই না,
তবুও নিরাপদ তন্দ্রা।
জানি না কী উপায়!

বাবা-জীবনকে আর কোনও খুচরা চালাকি শেখাই না
নিঃসঙ্গতার খাঁচায় রেখে আসি বারান্দার কোনে;
দেখি, সে-ই আমাকে আরেকটা নিঃসঙ্গতার খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কিছু বলার কি করার নেই।
বাবা-জীবন আর আমার মাঝে
এক অপ্রবেশ্য নীরবতার
ঘুর্ণি
ধেয়ে আসছে।

পর্ব – তিন ).

সাবওয়ের সাতটি সাম্প্রতিক কবিতা
অনুবাদ: সজল আশফাক

কবিতার চর্চা আমাদের দেশের তুলনায় আমেরিকায় কম কি বেশি হয় সেটা বিতর্কের বিষয় হতেই পারে। সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে নিউইয়র্কে গণ-পরিবহনে লোকজন যে’ভাবে চলতে চলতে বই পড়ে, তা দেখে, তার থেকে এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, এখানে পাঠক আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশী।সেখানে কবিতার বই লাখে লাখে বিক্রি হয়,আমাদের দেশে যেটা কল্পনা করা যায় না( এলেন গীন্সবার্গের প্রথম কবিতার বই ‘হাউল(HOWL) লক্ষাধিক কপির বেশী বিক্রি হয়েছে, তাঁর জীবদ্দশায় ।
সেই সঙ্গে অনেকেই মোবাইল ফোন কিংবা আইপ্যাডে পড়ছেন আমাজনের কিন্ডল অ্যাপ থেকে বই।
পঁচিশ বছর আগে থেকে আমেরিকার খ্যাতিমান কবিদের কবিতা ‘সাবওয়ে’ মানে নিউইয়র্কের পাতাল রেলের দেয়ালে সেঁটে দেওয়ার কার্যক্রম চালু হয়। সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম। সেখান থেকে নেওয়া আমেরিকার বিখ্যাত সাত কবির সাতটি কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।

১).
লেডি লিবার্টি
নাথালি হ্যা

সব তারকা ধাবিত নগরীর দিকে।
সে এক স্বর্গদূত, উন্মুক্ত করছে মধ্যরাতের মোড়ক।
অদৃশ্য ভেঁপুতে মুখরিত এক নদী
চাঁদের দু পাশের হেঁটে চলা পথ।
আলোয় বুঁদ হওয়া
সে এক দুঃখী
পাল তোলা নৌকার বুকে
ভালোবাসা নিয়ে ঘোরা যাত্রী,
খুঁজে পায় নিখুঁত এক দ্বীপ

২).
হাস্যকর
কেভিন ইয়াং

গরমাগরম খাবারের মতো
আমি তোকে ভালোবাসি।
অনুরূপ ভালোবাসি উষ্ণ রুটি,
শীতল মাংসের গোলাকার ফালি,
মাখন শোভিত স্যামেচের আহ্বান
অথবা ‘থ্যাংকস গিভিং’ এর শেষে
কয়েক দিন পর, যখন আমি চাই
যা কিছু উচ্ছিষ্ট।

৩).
প্যাঁচা
আর্থার সি

ধূসরিত নবজাত সন্ধ্যার তালুতে ময়ূরী রঙের পথ।
দেখলাম প্যাঁচা এক অলস বসে আছে গাছের শাখায়। তার পাখা ঝাপটানোর কম্পনে ভূপাতিত ধূলিকণার হাহাকার ।
আমি তখনো নিশ্চুপ। নীরবতা ভেঙে
প্যাঁচার কণ্ঠে এবার বেজে ওঠে প্রভাতি সংকেত।
তারপর ভোর আসে, সবুজাভ পথ জেগে ওঠে
সম্ভাব্য আলোয়।

৪).
ভালোবাসার ধ্বংসাবশেষ
জিম মোরে

আমি দূরে একপ্রান্তে দাঁড়ানো আমার মাকে স্মরণ করছি।
খুব সন্তর্পণে নৈশভোজ শেষে ভাঁজ করছিলেন টেবিল ক্লথ,
যেন ওটা কোনো দেশের পতাকা
যে দেশের অস্তিত্ব এখন পৃথিবীর মানচিত্রে নেই।
কিন্তু একসময় সেই দেশটাই শাসন করত গোটা বিশ্ব।

৫).
একটি মুহূর্ত
মারি হাআও

আহ, ‘কোথাও নেই’ এমন একটি মুহূর্ত থেকে
কিছুই ঘটে না।
‘প্রতিদিনের করণীয় কাজ’ এই তালিকায় কিছু নেই,
এমন একটি মুহূর্ত আমার নেই।
হয়তো আধেক মুহূর্ত পরেই থেমে যায়
ট্রাফিকের হুড়োহুড়ি।
আমার কী হওয়া উচিত, আমার কী হওয়া উচিত,
আমার কী হওয়া উচিত—নিরন্তর উচ্চারিত এই শব্দকে
তাড়া করতে করতে নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে যায় যাপিত জীবন।
সাদা কাপড়ের পর্দাটির চিরন্তন আহ্বান সামনে ঝুলতে থাকে।

৬).
ভালো জীবন
ট্রেসি কে স্মিথ

কিছু মানুষ যখন অর্থ-কড়ি নিয়ে কথা বলে
মনে হয় এটি রহস্যময় কোনো প্রেমিক অথবা প্রেমিকা,
দুধ কিনতে যাওয়ার কথা বলে
যে আর ফিরে আসেনি।
এবং এটি আমাকে স্মৃতিকাতর করে যখন আমি
বছরের পর বছর কফি এবং
রুটির ওপর বেঁচে আছি।
সব সময় ক্ষুধার্ত, কাজের জন্য হেঁটে বেরিয়ে পড়া।
পানি সংগ্রহের জন্য যেমন দূর গ্রামের টিউবওয়েলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে কোনো নারী।
তারপর অন্যদের মতো এক-দুই রাত বেঁচে থাকে
চিকেন রোস্ট এবং রেড ওয়াইনের ওপর।
একটি কবিতার কী করা উচিত বলে তোমার মনে হয়?

৭).
এনটোজাকি স্যাংগে
সহজেই

একটি কবিতায়
পুরোপুরিভাবে
কিছু একটা প্রাপ্তিতে নিজেকে
তোমার পরিপূর্ণ মনে করা উচিত।
সিডি তোমাকে মোহিত করবে,
বন্ধ করে দাও সেই পথ।
বদলে ফেল মন
কিংবা তাকে তৈরি করে নাও।
কবিতা তোমার কাছে শীতল জল অথবা
চুম্বন হয়ে ধরা দেওয়া উচিত।

পর্ব – চার ).

আমেরিকার বহু আলোচিত মহিলা কবি –
‘সারা তাসডাল’-এর গুচ্ছ কবিতা
অনুবাদে – আনোয়ার হোসেন বাদল

( অনুবাদকের পরিচিতিঃ

আনোয়ার হোসেন বাদল একজন বহুমাত্রিক লেখক। ১৯৬৫ সালের ০১ মে, বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত পায়রা নদীর তীরবর্তী ‘রাজগঞ্জ’ গ্রামে জন্ম তার। কর্মজীবনে সামরিক-বেসামরিক নানান পেশায় কাজ করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে পথে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষে গিয়েছেন বহুবার। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় রয়েছে স্বভাবসুলভ বিচরণ। এক জীবনের লেখালেখিতে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণ আখ্যান ও বায়োগ্রাফিসহ এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা চৌদ্দ। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে কমপক্ষে ২০টি পাণ্ডুলিপি।)

[ কবি সারা তাসডালের সংক্ষিপ্ত জীবনী ]

           সারা তাসডালে (বা সারা টিসডাল) 

১৮৮৪ সালে আমেরিকার সেন্ট লুই(মিসৌরি)-তে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রায়ই তাঁর অসুখ হতো, ফলে তিনি নয় বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারেননি। এক ধর্মীয়-রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হয় এবং সেখানে বেড়ে ওঠেন তিনি। পড়াশোনা শুরু করেন মেরি ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীকালে ‘তাসডালে হোসমার’ ‘হল কলেজ’ থেকে ১৯০৩ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি আমেরিকার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দ্য পটারস’-এর সদস্য ছিলেন। একদল মহিলা শিল্পীদের নিয়ে তিনি এই সংগঠনে সঙ্গীতের কাজ করেন।
তাসডালের প্রথম কবিতা ১৯০৭ সালে ‘রিডির মিরর’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং একই বছরে তিনি তাঁর প্রথম বই, ‘সনেটস টু ডুস এবং অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশ করেছিলেন। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘হেলেন অফ ট্রয় এবং অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। এই বইটি আমেরিকা এবং ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমালোচকদের দ্বারা কবি স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি ।
তাসডাল ১৯১৪ সালে বিবাহ করেন এবং স্বামীর সাথে মিসৌরি থেকে নিউ ইয়র্কে চলে যান।
তিনি দুটি কল্পকাহিনী, ‘দ্য আনসারিং ভয়েস’ এবং ‘উইমেন ওয়ান হান্ড্রেড লাভ লিরিক্স’ ও শিশুতোষ গ্রন্থ ‘রেইনবো গোল্ড’ সম্পাদনা করেন।
তাঁর বিখ্যাত আরেকটি বই- ‘রিভার্স টু দ্য সি’ ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতাগুলি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে এবং গানের লিরিক্স হয়ে যায় ফলে তিনি তাঁর জীবদ্দশায়ই ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তাসডালে ১৯১৮ সালে কবিতার জন্য প্রথম পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন। তার প্রেমের গানের জন্য ‘কবিতা সোসাইটি অফ আমেরিকা’ পুরষ্কার সহ আরও অনেক পুরুস্কার পান।
দাম্পত্য জীবনে তাসডালে খুবই হতাশ ছিলেন। বিয়ের পরের প্রায় টানা দশ বছর তাঁর স্বামী ব্যবসায়ের জন্য ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করতেন। তাসডালের এই বিচ্ছেদটি খুব পীড়া দিয়েছিলো। ফলে ১৯২৯ সালে তিনি বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। তাসডালে মূলত লক্ষ্যহীন এক মানুষ ছিলেন এবং যখন তিনি এই বিষয়টি উপলব্ধি করেন তখন তিনি খুব অবাক হয়ে যান।
পরের বছরগুলি তাসডালে শারিরীক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। রাতে তার ঘুম হতো না। তার ফলে ১৯৩০ এর গোড়ার দিকে অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খাওয়ার জন্য তিনি হার্ট ফেল করে মার যান। তাঁকে তাঁর জন্মস্থান সেন্ট লুইসের বেলফন্টেইন কবরস্থানে সমাধিত করা হয়।
আজ সারা বিশ্বের কাছে ‘সারা তাসডেলা’ একজন কবি ও গীতিকার হিসাবে বিখ্যাত। সৌন্দর্য, প্রেম এবং মৃত্যু ভাবনার সাথে সম্পর্কিত তাঁর প্রতিটি গান ও কবিতা মানুষ কে মুগ্ধ করে।
তার গদ্য সাহিত্যেও তার ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা এবং বঞ্চিত যৌবনের তিক্ততা ফুটে উঠেছে।]

১. বিনিময়

সমস্ত রাতের ঝর ঝর বৃষ্টির পর
কাকভেজা সুন্দর এই সকাল
নির্মল বায়ু আর জাঁকজমকপূর্ণ জিনিস-পত্র;
এই সবকিছুর বিনিময়ে মানুষ চায় প্রেম
জীবনের মূল্যে চায় সুখ, ভালোবাসা

জলের ছোট্ট এই তরঙ্গগুলি পাহাড়ের পাদদেশে শুভ্র ফেনিল হয়ে মিশে গেছে,
দেহের গভীরে যে আগুন বয়ে যায় এবং বেজে ওঠে সঙ্গীতের মুর্ছনা
এবং বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যে খাবারের পাত্র, মায়ের স্তন
এ সব কিছু বিনিময় হচ্ছে ভালোবাসা।
মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী যে প্রেমের বিনিময়ে জীবন বিক্রি করতে পারে।

নদীর বাঁকের এই সৌন্দর্য
বৃষ্টিস্নাত গাছের ঘ্রাণ,
যে চোখগুলি তাকে ভালবাসে এবং বুকে ধরে রাখে,
তাদের আনন্দের জন্য, সে দিয়ে দিতে পারে সব।

তোমার সমস্ত কিছু ভালবাসার জন্যেই দাও;
কখনও মূল্য গণনা না করেই প্রকৃতির এই রূপ_রস কিনে নাও
প্রেমের একটি মুহুর্তের জন্যে দিয়ে দাও সব
কেননা প্রেম ছাড়া পৃথিবীতে কোন সুখ নেই।

০২. আমি গ্রাহ্য করবো না

এমনই উজ্জলতর কোন এপ্রিলে যখন আমি মরে যাবো
আমার চুলগুলো বসন্ত-বাতাসে উড়তে থাকবে
তুমি হয়তো ভগ্ন হৃদয়ে আমাকে বুকে চেপে ধরবে
আমি তোমাকে গ্রাহ্য করবো না

আমি তখন বৃক্ষ হতে খসে পড়া একটি পাতার মতোই শান্ত
যখন বৃষ্টির ফোটাগুলো ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসবে

আজ তুমি যেমন নীরব হয়ে আছো
তেমনই আমি তোমাকে গ্রাহ্য করবোনা
বরং আরও নিশ্চুপ, আরও নিস্তব্ধ হয়ে যাবো।

০৩. দুই বীরের স্বপ্ন বিভ্রাট


যৌবনের স্নিগ্ধ প্রভাতে দু’জন বীর তাদের প্রত্যাশিত নারীর কথা বলাবলি করছিলেন।

তাদের একজন বলেছিলেন,

“আমি এমন একজনকে চাই যিনি হবেন স্বর্ণকেশী এবং অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ কোন আদর্শ নারী।”
তারপরে অন্য বীর বললেন-
“আমি তার কোন যত্নই নিতে পারবো না
তবে আমাকে তার অবশ্যই ভালবাসতে হবে
এবং তাকে হতে হবে শান্ত, পবিত্র এক পাখির মত।”
একথা বলে বীরেরা চলে গিয়েছিলেন তাদের কর্মক্ষেত্রে
আমিও আমার কাজে মনোনিবেশ করে ভুলে গিয়েছিলাম তাদের কথোপকথন
অতঃপর যৌবন শেষ হবার আগে
তারা দু’জনেই খুঁজে পান তাদের ভালোবাসা

যিনি স্বর্ণকেশী অস্পরীর স্বপ্ন দেখতেন
তিনি নিয়ে এসেছেন এক বাদামী চুলওয়ালীকে
বীরের সস্ত্রীক আগমনে আমি বেশ পুলকিত হলাম
আর তিনি হয়তো ভুলেছিলেন পূর্বের কথা।

অন্যজন যিনি পবিত্রতা খুঁজতেন
তিনি বাড়িতে এনেছেন এক নির্ভেজাল বুনো নারীকে
এবং যখন তারা একে অপরকে দেখলেন
তখন দু’জনেই স্মিত হেসে বললেন ‘এমনটাই হয়।’

০৪. একটি কান্না

হায়, তার চোখে চোখ রাখার মত কেউ হয়তো আছে
এবং এমন হাতও আছে যে হাতের স্পর্শে সে আনন্দিত হবে,
অথচ আমার প্রেমিকের কাছে
আমার মুখের একটি সম্মোধনই যথেষ্ট ছিলো।

কারও বুকে নিশ্চয়ই তার স্থান রয়েছে
কারো ঠোঁট পাতা আছে
যেখানে তার ঠোঁট মেলাতে পারবে
অথচ আমি একাকী একটি পাখির মত
শুধুই হাহাকার করে মরছি।।

০৫.শুধু ঘুমের মধ্যে

শুধু ঘুমের মাঝেই আমি তাদের সাথে মিলিত হই
শৈশবে যাদের খেলার সাথী ছিলাম
ঘুমোঘোরে চলে আসে সে সব শিশুরা
আসে লুই, যার ছিলো ফিতে বাঁধা বাদামী রঙের চুল
আর বুনো রিংলেট সহ আসে অ্যানি।

ঘুমের মধ্যে থমকে যায় সময়
তারাও কী এসব দেখতে পায়?

আহা, বহুবছর আগের কোন এক সন্ধ্যায়!
আমরা অনেক খেলেছি
আমাদের পুতুল দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মোড়ে।

বছরগুলি তরতর করে চলে যায়
যদিও মুখে তার দাগ সামান্যই পড়ে
তাদের চোখে চোখ রেখে সেসব স্মৃতি অল্পই আঁচ করতে পারি
আহা তারাও কি আমার মত স্বপ্ন দেখে?
আমিও কী তাদের কাছে একটি শিশু নই?

০৬. আমি যা গ্রাহ্য করি

তাকে আমি কেন গ্রাহ্য করবো?
আমার অলস বসন্ত দিনের স্বপ্ন
আর গানগুলোর কোন মূল্য যার কাছে নেই?

তার কাছে আছে প্রশ্ন
অথচ আমার ভেতরে চকমকি পাথর,
ঘর্ষণেই দপ করে জ্বলে ওঠে এবং তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়।

তবু ভালোবাসার জন্যে আমি তাকে সহ্য করি,
তার প্রতি বিরূপ হতে চাইনা আর
আমি দৃঢ়তার সাথে বলি-
গানের কথার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলো না।

০৭. প্রেমের পরে (বিচ্ছেদ)

পরিচয়টা পথেই হয়েছিলো,
আর দশজন সাধারণের মতোই অনারম্ভর এবং আরতি-বিহীন
না, এটাতে কোন মিরাকেল বা জাদু ছিলো না
আর আমিও তোমার জন্যে আহা মরি কেউ ছিলাম না।

সমুদ্রের মতোই আমি বুক পেতে দিয়েছিলাম
তুমি মৌসুমী বায়ু হয়ে এলে
সময় আমাদের উচ্ছলতা কেড়ে নিল আজ
আমি মজা এক জলাশয়

আর তুমি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে কিনারে দাঁড়িয়ে
তবুও স্রোতের টানাপোড়েন, সমুদ্রের তিক্ততা
আর ধংসাত্মক ঝড়ো হাওয়া থেকে আজ আমি নিরাপদ
আজ আমি শান্ত,এবং স্থির।

০৮. আলোকিত জানালা

হতাশা, ক্লান্তি আর সমস্যার স্তুপ মাথায় নিয়ে লোকটি হাঁটছিলো
শীতের সান্ধ্য-অন্ধকারে অতিক্রম করছিলো এক পুরনো বিদঘুটে সড়ক।
দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সে খুব ধ্রুত পা ফেলছিলো
সহসা পাশের জানালা গলে এক ঝলক আলো তার চোখে পড়তেই
সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়
এবং দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দোকানটির দিকে

সেখানে বাচ্চাদের জন্যে নানান রঙের খেলনা সাজানো
নানান রঙের মুখোশ
দেয়ালে ঝুলানো করমারি পুতুল,
ভ্যালেন্টাইন কাগজ, লাল-সবুজ ক্যান্ডি
ঘুড়ি, নাটাই আর রঙ-বেরঙের মার্বেল

নিমিষেই লোকটি তার বর্তমান ভুলে যায়
কতগুলো মার্বেল আর মুখোশ
তাকে শিশু সুলভ লোভী করে তোলে

লোকটি পা বাড়িয়ে চলে আসে বাড়ি
এবং শীতের এ সন্ধ্যেবেলা
আলোকিত দোকানটির কথা ভাবতে ভাবতে নিজমনে হাসেন
আহা কী দুরন্ত শৈশব!

০৯. আই এ্যাম নট ইওর

আমি তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ হতে আসিনি
আমি শুধু একটি প্রজ্জলিত মোমবাতির মতো হতে এসেছি
যেমন তুষার মিলিয়ে যায় সমূদ্রজলে

তুমি আমাকে পেতে চাইলে
সেই আলোর মধ্যে মিশে যাও, জ্বলতে থাকো
তবেই আমি তোমাকে খুঁজে নেব
তখন প্রেমের গভীরে ডুবে যাবো আমরা

তোমার অর্থহীন ভালোবাসার ঝড়ে আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার জ্ঞান,
আমি এখন বধির এবং অন্ধ হয়ে গেছি
তোমার ভালবাসার ঝড়ে
নিভে যাচ্ছে প্রজ্জলিত একটি মোমবাতি t

১০. এসো ভুলে যাই

এসো ভুলে যাই পৃথিবীর সব দুঃখ আর বেদনার কথা
ফুলকে যেমন ভুলে যায় বৃক্ষ,
শ্রোতা যেমন ভুলে যায় গানের সন্ধ্যা

সময় এক দয়াশীল বন্ধু
আমাদের মুখের বলিরেখাগুলো জাগিয়ে দেয় অদ্ভুতশৈল্পিকতায়
আর আমরাও বিস্মৃত হই
জীবনের সকল দুঃখ বেদনার কথা

কেউ প্রশ্ন করলে তুমিও ইতিবাচক হয়ে তাকে বলে দাও
আমরা সে সব কথা ভুলে গিয়েছি বহুকাল আগে
দীর্ঘ পথে হাঁটার ক্লান্তি কেউ কি মনে রাখে?
সুতরাং চলো ভুলে যাই বেদনার কথা
তুষার পাতে সৃষ্ট অচল সময়ের কথা যেভাবে ভুলেছি।

১১. একটি মেয়ের জন্যে পরামর্শ

ওহে বালিকা তোমাকেই বলছি
সত্যকে ধারণ করে, তুমি কঠিন হতে পারলে, হবে অমূল্য পাথর
মনে রেখে পৃথিবী এবং তুমি একমাত্র তোমারই
কেউ একজন তোমার মালিক হতে পারে না
সে তোমাকে ক্ষণিকের জন্যে মোহাবিষ্ট করতে পারে।

এইসব কথা শান্তভাবে মুখের উপর স্থির রাখো
মুছে ফেলো চোখের জল
কঠিন বরফের পাথরটির দিকে তাকাও
মনে রেখো তুমি কখনও একা নও
তোমার ভেতরে আছে ঐ পাথরটির মতোই অদ্ভুত শক্তি
আর কেউ একজন তোমাকে সাময়িক মোহাবিষ্ট করলেও
সে তোমার মালিকানা পায় না।

১৩.জোকার

ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছেন একজন কৌতুকাভিনেতা, সবাই বলেন জোকার
তার ভাঙা বাঁশির সুর
বারবার অনুরণিত হয় আমার হৃদয়ে।

আমি চেরি গাছটির নীচে দাঁড়িয়ে থাকি
আমাকে লক্ষ্য করে সে বাজায় সপ্তসুরের জাদুময় অর্কেস্ট্রা
আমি ভুলে যাই সময় এবং সময়ের ক্ষত।

পৃথিবীর পথে পথে জোকারের অভিনয় আর বাউলের সুর
মানুষেরা তাদের অবজ্ঞা করলেও
নিজের আনন্দে বিভোর থাকেন তারা
আর আমি ভালোবাসি তাদের কৌতুক আর সুমধুর সুর।

১৩. জলজ কণ্ঠ

জলজ কন্যার কণ্ঠে মোহনীময় গান
অরণ্য ঘেষা পাথর খণ্ডের উপর আছড়ে পড়েছে তার সুরের ঝর্নাধারা
আহা প্রকৃতির মতোই শান্ত, স্নিগ্ধ এক নারী
পদ্ম ফুল হয়ে ফুটে থাকে সে
তার বাণী পবিত্র স্রোতের সাথে মিশে যায়
মন্দিরের খিলানগুলির নীচে
একাকী বসে সুখ স্বপ্নে বিভোর হয় সে নারী।

তার সুরের মুর্ছনায় সন্ধ্যা নামে,
মিলিয়ে যায় আকাশের রক্তিম আবির
পার্সিয়ান বাগানের কলিগুলো সহাস্যে ফুটে ওঠে
আর তার চুমুতে ফুটন্ত গোলাপেরা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

১৪. মে

বাতাসে ইলিকাস ফুলগুলো উর্ধ্বমুখে দুলছে
বার্তা এসেছে পুরাতন যাবে ঝরে
শীতের শুস্কতায় ঝরে যাবে ডাল পাতা
আমিও বিদায় নিয়ে চলে যাবো।

আপেল ফুলের নীচে এখন আমার আনন্দহীন কাটবে সময়
হে ছন্দময় যৌবন, তোমাকে বিদায়
এপ্রিলে ভেসেছি যে প্রেমের স্রোতে
মে মাসে সব আমার মিথ্যে হয়ে যায়।


  • যাদের থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত,
    তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার –
    ১). রাজিয়া সুলতানা।
    ২). মোশতাক আহমদ।
    ৩). সজল আশফাক।
    ৪). আনোয়ার হোসেন বাদল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress