পনের বছর পরের কথা
আসিফ তার স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে টেনে করে ময়মনসিংহে আসছেন। মেয়েটির বয়স চৌদ্দ। তার নাম চন্দ্রশীলা। অসম্ভব চঞ্চল মেয়ে। এক দণ্ডও সুস্থির হয়ে বসতে পারে না। ট্রেনে সারাক্ষণ বকবক করেছে। তার মাথায় একটা রঙিন স্কাযর্ক বাধা ছিল, জানালা দিয়ে অনেকখানি মাথা বের করায় হাওয়ায় সেই স্কাফ উড়ে চলে গেছে। লীনা খুব রাগ করেছেন। সেই রাগ অবশ্যি চন্দ্রশীলাকে মোটেই স্পর্শ করেনি। সে বাবার গায়ে হেলান দিয়ে কি একটা বই পড়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। লীনা বললেন, এসব কি হচ্ছে? চুপ করে ভদ্রভাবে বস না।
চন্দ্রশীলা বলল, তুমি নিজে চুপ করে ভদ্রভাবে বসে থাক তো মা, আমাকে বকবে না। এমনিতেই স্কার্ফ হারিয়ে আমার মনটা খারাপ।
লীনা কঠিন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই সব কঠিন কথা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। মেয়েটা অবিকল ত্রপার মত হয়েছে। কঠিন কিছু বললেই নিচের ঠোঁট উল্টে ফেলে।
আসিফ সাহেব বললেন, বই-টই সব ব্যাগে গুছিয়ে ফেল মা, এসে পড়েছি।
চন্দ্রশীলা বলল, এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম কেন বাবা? আমার নামতে ইচ্ছা করছে না।
কী করতে ইচ্ছা হচ্ছে?
ট্ৰেনেই থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা বাবা, সারাজীবন যদি আমরা ট্রেনে ট্রেনে থাকতাম, তাহলে ভাল হত না?
হ্যাঁ, ভালই হত।
স্টেশনে অসম্ভব ভিড়। আসিফ সাহেব অনেক কষ্টে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে নামলেন। ভিড় ঠেলে এগুতে পারছেন না, এমন অবস্থা লীনা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার বল তো?
আসিফ বললেন, মনে হচ্ছে বিখ্যাত কেউ ট্রেন থেকে নেমেছেন। লোকজনদের হাতে প্রচুর মালা-টালা দেখা যাচ্ছে।
চন্দ্রশীলা বাবার হাত ধরে সাবধানে ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে। সে আড়ে আড়ে ভীত চোখে মার দিকে তাকাচ্ছে, কারণ ভিড়ের চাপে তার বা পায়ের স্যান্ডেলটি সে হারিয়ে ফেলেছে। মা জানতে পারলে আবার খোঁজাখুজি শুরু করবেন। চন্দ্রশীলার ইচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়া। একটা স্যান্ডেল গিয়েছে তো কী হয়েছে? আরেক জোড়া কিনলেই হবে। এই জোড়াটা এমনিতেও তার পছন্দ না। ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙ। সে এবার মেরুন রঙের স্যান্ডেল কিনবে।
চন্দ্রশীলা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। হতভম্ব হয়ে যাওয়া গলায় বলল, বাবা দেখ, ট্রেন থেকে কে নামছেন দেখ। পুষ্প, পুষ্প। বাবা, উনি পুষ্প না? কি আশ্চর্য, আমরা এক ট্রেনে এসেছি!
আসিফের কাছে ভিড়ের রহস্য স্পষ্ট হল। আজকের পত্রিকায় অবশ্যি ছিল। পুষ্প ময়মনসিংহ টাউন ক্লাবে যাবে। সেখানে কি একটা অনুষ্ঠান করার কথা।
বাবা, উনি কি পুষ্প?
হ্যাঁ।
বাবা, উনি কি আমাকে একটা অটোগ্রাফ দেবেন?
এই ভিড় ঠেলে তার কাছে যাবার কোনো উপায় নেই মা।
পুষ্প বিরাট একটা কালো চশমায় চোখ ঢেকে রেখেছে। তাকে ঘিরে আছে বলিষ্ঠ কিছু ছেলেমেয়ে, যেন কেউ কাছে যেতে না পারে। তবু লোকজন। এগুতে চেষ্টা করছে।
বাবা একটু দেখ না, ওনার একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যায় কি না। আমার খুব সখা। উনি দেখতেও তো সুন্দর, তাই না বাবা?
আসিফ মেয়েকে নিয়ে ভিড় ঠেলে কাছে যেতে চেষ্টা করছেন। লীনা একা একা দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছেন। তার চোখ জ্বালা করছে। জল আসবার আগে আগে চোখ এমন জ্বালা করে।
আসিফ মেয়েকে নিয়ে পুষ্পের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। চন্দ্রশীলা ছোট নোটবুক উঁচু করে ধরে আছে।
পুষ্প তার হাত থেকে নোটবুক নিয়ে দ্রুত কী সব লিখে নোটবুক ফেরত দিল। চোখের কালো চশমা খুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল আসিফের দিকে, তারপর সবাইকে হতভম্ব করে নিচু হয়ে তঁর পা স্পর্শ করল। পরমুহূর্তেই এগিয়ে গেল সামনে। মানুষের ভিড় বড়ই বাড়ছে। স্টেশন থেকে বের হয়ে যেতে হবে। তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই।
চন্দ্রশীলা কান্না কান্না গলায় বলল, বাবা, উনি তোমাকে চেনেন? তুমি তো কোনোদিন বলনি। তুমি এরকম কেন বাবা?
অভিমানে তার নিচের ঠোট বেঁকে গেছে। চোখে জল টলমল করছে। হয়ত সে কেঁদে ফেলবে। এই বয়সী মেয়েরা অল্পতেই কেঁদে ফেলে।