Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাঁঝ বেলার উত্তম মাস্টার || Shipra Mukherjee

সাঁঝ বেলার উত্তম মাস্টার || Shipra Mukherjee

দক্ষিণের মেঘ উড়ে চলেছে পশ্চিম দিকে । মন আঁধার করা রং আকাশের । বইয়ের পাঁজা বুকে করে ছুটতে শুরু করলো উত্তম। সবাই ডাকে উতমা। স্কুলে গেলেই নাম বদলে যায় । গরবে বুক টান করে হাঁটে উত্তম। এ যেন অন্য জগৎ। গাঁয়ের অকাট মখখু লোকও উত্তম কে আজকাল মান্যি করে । আর করবে না ই বা কেন? সাত ক্লাসে উঠেছে প্রথম হয়ে । বাপ মায়ের পাঁচটা ছেলে মেয়ে মরে বেঁচে বর্তে আছে শেষের ছেলে উতমা। আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছে । স্কুল ছুটি হবার সময় ও আকাশ ঝলমল করছিল । তীরের ফলার মতো শরীরে বিধছে বৃষ্টির ফোঁটা । ছুটতে শুরু করলো উতমা। ধারে কাছে কোন ছাউনি নেই । একটু এগোলে তবে বারোয়ারি তলা । ওখানে ই দুদণ্ড জিরিয়ে নেবে। শাল মহুয়ার মেঠো পথে ছুটছে । বইগুলো ভিজে না যায় । ওর শরীরের থেকে ও বেশি দামী ওর বইগুলো । পেটের ভেতরের বই বাঁচাতে কচ্ছপের পিঠের মতো পিঠ বাঁকিয়ে ছুটতে লাগল । ছুটতে ছুটতে বারোয়ারি তলায় এসে পৌঁছলো । মানুষ বলতে উতমা একা । আর ঠাঁই নিয়েছে গরু, ছাগল, কুকুর । এরা সবাই উতমা র স্কুলে যাওয়ার পথের সাথী । ওরা কথা না বললেও উতমা ওদের কথা বোঝে । তাই মনের যতো কথা ওদের ই বলে । আজ ও শুরু করলো ।

——-আজ বড়ো জল হচ্ছে তাই না রে? গাই গরু কে মাথা দোলাতে দেখেই আবার বলে ।
—–বইগুলো ভিজে গেলে কি হবে বল তো?দামী জিনিস । বুঝলি কিছু? ওর কথা শুনে ছাগল গুলো ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।
———তোরা এসব বুঝবি না। যতো কান্ড করে সব সূর্যিমামা । এই যে বৃষ্টি দেখছিস, এও সেই করে । এতো তাপ দেবার কি দরকার বলতো? গরুটা গাঁ গাঁ করে ডাকতে লাগল ।
—–রাগ করছিস কেন? ঠিক আছে বাবা,সূর্যিমামা আমাদের ভালোই করছে । রোদ দিচ্ছে । তার থেকে বাষ্প জমছে আকাশে । আবার সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে । তাতে ফসল ভালো ফলছে । বৃষ্টি র জল নদীতে পড়ছে ,আবার নদীর জল সুর্যির তাপে বাষ্প হয়ে আকাশে জমছে । ছাগল গুলো ম্যাঁ ম্যাঁ করে ছুটতে শুরু করলো । উতমা গরুটা র দিকে চেয়ে বললো ।
——-ছাগল গুলা ভালো কথা শুনতে চায় না। জানিস তো আন্টার্টিকার আকাশে আশ্চর্য রকম মেঘ দেখে বৈজ্ঞানিকেরা চিন্তায় পড়ে গেছে । দেখতে ও অসাধারণ । স্ফটিকের মতো রং,তার মধ্যে রামধনুর ছটা। বৈজ্ঞানিকদের ধারণা এতে আবহাওয়ার ও পরিবর্তন হতে পারে । বদলে যেতে পারে ঝড়,বৃষ্টি, রোদ সবই ।

গরু টা লেজ নাড়তে নাড়তে মাথা দোলাতে লাগল । মুগ্ধ হয়ে গরুর সজল চোখের দিকে চেয়ে রইল উতমা ।শাস্ত্রে নাকি গরু কে গোমাতা বলেছে । ঠিক ই বলেছে । এমন স্নেহ ভরা চোখ তো কেবল উতমার মা রাধার ই আছে । মায়ের কথা মনে হতে ই ঘরের দিকে ছুটলো সে। খিদে তে পেটে টান ধরেছে। বৃষ্টি নেই । এঁটেল মাটির পথ। পা টেনে ধরছে। ঐ মাটিতে বড়ো হয়েছে। তাই কেমন করে এঁটেল মাটিতে ছুটতে হয় তা জানে উতমা । কোন সকালেে পান্তা খেয়ে বেড়িয়েছে। খিদে তো পাবেই । রোজের মতো ভোরবেলায় উঠেই বালতি নিয়ে ছুটেছে মাঠে। গরুর নাদি কুড়োতেই মাঠে যায় । মা সারাদিন খাটে। মায়ের এই কাজটা করতে ভালোই লাগে । গরুর পেছনে দৌড়োয় উত্তম । গরুর নাদিটা পড়ার আগেই বালতিটাকে গরুর পেছনে ধরে ফেলে। স্বাস্থ্যবতী গরুর নাদিই উত্তমের পছন্দ । মাঠ থেকে ফিরেই পড়তে বসা । তারপর স্নান করে পান্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়া । স্কুল থেকে ফেরার পথে বাউরি পাড়ায় ঢুকতে দেখলো ওর বয়সী ছেলেরা বুড়ি ছোঁওয়া ছুঁয়ি খেলছে । মাঠে বৃষ্টির থৈ থৈ জল। ছেলেরা কাদার মধ্যে হুটোপুটি করছে । উত্তম কে বললো–এই উতমা খেলবি?

উত্তম বলল -নারে।সনঝা বেলায় পড়তে হবেক।তোদের তো লিখাপড়া নাই দিনভর খেলা ।
——হঁ হঁ,লেখা পড়া করগা যা। দুইটা ঠ্যাং গজাবেক। আমরা গিয়ে মুখ্যু থাকবো। আগে আগে ছুটি হলে উত্তম ওদের সাথে খেলে । ফিরতে দেরি হলে সোজা ঘর মুখো হয়। এই ঝেপে বৃষ্টি হলো । সূর্যিমামা এখন হাসছে । লাল গোল থালার মতো সূর্য এখন কবিরাজ বাড়ির নারকেল পাতায় নকশা কেটেছে । ঝুপ করে নেমে পড়বে কবিরাজ বাড়ির পুকুরে ।

রাধাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো উত্তম —–
এই মা খেতে দে ।

রাধা ঘুঁটে দিতে দিতে বললো——হাঁড়িতে ভাত আছে খা গা।
——-শুধু ভাত,আর কিছু নাই?
——-হঁহঁ,একটু গুগলি রান্না করা আছে ।খা গা।

গুগলি উত্তমের মা যত্ন করেই রাঁধে । এর থেকে বেশি আশা করেনা উত্তম। পয়সা নেই । গুগলি কিনতে হয় না । সকাল বেলা সাড়ে সাড়ে গুগলি বসে থাকে কুঁয়োর তলায় । সেগুলোর খোসা ছাড়িয়ে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে যত্ন করে রাঁধে রাধা।

ভাতের হাঁড়িতে ঢাকা নেই দেখে উত্তমের ডাক—– এই মা,ভাতের হাঁড়িতে ঢাকা দিস নাই ক্যানে? মাছি বসলে কি হবেক তা জানিস?কলেরা হবেক রে আমার ।রাধা বলে———বাপ আর ভুল হবেক লাই। তুই দেখে লিস।

উত্তম ভালো করে দেখে নেয় ভাতটা। না মাছি নেই ভাতে। না আজ ভালো করে মাকে বোঝাতেই হবে । খাবার পর মায়ের পাশে বসে । তারপর বলে ।
——-এই মা কথাটা শুনিস লাই কেনে?
—–কি কথা রে বাপ?
——-এই যে মাছি সেইটা আমাদের মিত্র লয়। শত্রু । ওটা যিখানে বসবেক সিখানেই মল ত্যাগ করবেক ।
——-হ,তা করুক গা।
——তোর ছিলার ভাতে মলত্যাগ করবেক। আর সেই ভাত খেয়ে তোর ছিলাটার কলেরা হবেক। সিটা ভাল?
——–হাই বাপ,কি বুলছিস রে?
——–হঁহঁ, ইটা বাঝা কথা লয়। হক কথা ।
———তুই দেখে লিবি বাপ আর কুনোদিন ভুল হবেক লাই।

দুদিন পর পঞ্চায়েত এর সভা বসবে । কদিন ধরে বাঁকুড়া সদর থেকে গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির দরজায় । বাউড়ি পাড়ার ছেলে বৌরা জটলা করছে । রাধার সে সব শোনার সময় নেই । এখন ও মহিম বাবুর বাড়ি কাজ বাকি। উতমার চাকরি করে দেবে বলেছে ।ছেলের চাকরি হবে । তাই মাস কাবারে মাইনে না পেয়ে ও কাজ ছাড়ে না সে বাড়ির। মহিমবাবু ও টাকার কথা তোলে না। ছেলে যখন স্কুলে যাচ্ছে তখন থেকে কাজ করছে রাধা । অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে । রাতে ই উতমার বাপের কাছে হিসাব টা জানতে হবেক । হকের ধন ছাড়বে কেন? ইসকুলে আজ রব উঠেছে, বড়োদের পাঠশালা হবে এ গাঁয়ে। কে পড়াবে। মাস্টার বাবুরা উত্তম কে ডেকে বললেন।
—-এই উতমা বড়োদের পড়াতে হবেক। পারবি তো?

উত্তম ভয়ে ভয়ে বলে—বড়দের!আমি লারব মাস্টার বাবু । মাস্টার মশাই বলেন—মারব এক ঘা। তুকে পড়াতে হবেক । কোন উপায় নেই। পড়াতেই হবে বয়স্কদের। বড়োদের মাস্টারমশাই হবে উত্তম । ভাবতে ভাবতেই ঘরের দিকে ছোটে উত্তম । ঘোষেদের পুকুর পাড়ে হাঁসগুলান চড়ছে। হাঁসেদের পিছনে ছোটে উত্তম । হাঁসেদের বলে——এই উত্তম মাস্টারকে ভয় পাচ্ছিস?ক্যানে? ভয় পাস না। আমি তোদের মারতে লারবো । হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে জলে নেমে গেল । উত্তম ঘরের দিকে ছুটলো ।

উত্তমের বাপ রতন বাউরি । বিড়ি ফুঁকছে ফুকফুক করে । উত্তম দাওয়ায় গিয়ে বসল বাপের পাশে । বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে রতন ভাবছিল উত্তমের কথা । ‘ছিলাটা লিখাপড়ায় ভালো । বড়ো অফিসে চাকরি করবে । কোন দুঃখ থাকবেনা ওদের । উত্তম বাপের পিঠে হাত দিয়ে বলে—–এই বাপ,বিড়ি ফুঁকাটা ভালো লয়। সবাই বলে বিড়ি ফুঁকলে ক্যান্সার হয় গ । রতন ছেলের দিকে চেয়ে বলে——হঁ হঁ । তুর খালি বড় বড় কথা ।
———বড় কথা লয় গ বাপ। হক্ কথা । ক্যান্সার
ধরলে মানুষকে যমে লিয়ে লিবে।

থম মেরে যায় রতন । চোখে ভেসে ওঠে রাধা আর উতমার দুর্দশার ছবিখানা। একটানে মুখ থেকে বিড়িটা ফেলে দিলো রতন ।- ——এই দ্যাক ।ফেলে দিলম বিড়িটা। উত্তম বাপকে জড়িয়ে ধরল। রাধা ঘরে ঢুকে বাপ ছেলের জড়াজড়ি দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলো । উত্তম মাকে টেনে নিয়ে বসালো । তারপর মাকে বলল-।
—–এই মা,একবারটি শোন,বাপ আজ থেকে বিড়ি ফুঁকবে না রে।

রাধা বলল—-হঁ,সিটা হলেই ভালো ।

শহর থেকে বড়ো গাড়ি করে বাবুরা,দিদিমনিরা এসেছেন । পঞ্চায়েত প্রধান এর বাড়ির সামনের দরজায় লোক জনের ভীর । উত্তমেরও ডাক পড়েছে সেখানে । ভয়ে ভয়ে হারান জ্যাঠার বাড়িতে হাজির হলো উত্তম । হারান জ্যাঠা বললেন—-কি রে উতমা পড়াতে পারবি তো? —–হঁ,একটু শিখিয়ে দিলেই পারবে ।—-আমিনুল চাচা বললেন ।—–কিরে পারবি না?

উত্তম বললো—-হ্যাঁ চাচা। তারপর শহরের দিদিমনির দিকে চেয়ে বলে— চেষ্টা করবো দিদিমনিরা ।

তিন চার দিনের ক্যাম্প করলো শহরের দিদিমনিরা আর বাবুরা। খুব ভালো লাগছে উত্তমের । পড়ানো শেখার সাথে সাথে শহরের বাবু আর দিদিমণিদের সাথে চার দিন থাকা। একেবারে ভদ্রলোকের মতো । ভারী মজা করে সবার সাথে পাত পেতে ডাল,ভাত, তরকারি,মাছ খাওয়া । একেবারে পেট পুরে গরম গরম ভাত খাওয়া। এমন পেট পুরে ভাত উত্তম কখনো খায়নি । গরম ভাতের এতো সুঘ্রাণ। ক্যাম্প এ ছড়িয়ে পড়েছে ভাতের গন্ধ । খেতে বসে উত্তমের বাপ মায়ের তরে মন টেনেছে।

উত্তম কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি এলে রাধা ছেলের কপালের ঘাম মুছে দিয়েছে। ছেলের মুখের হাসি দেখে রাধা বুঝেছে,ছেলে পেট ভরে খাচ্ছে । বাউড়ি পাড়ায় সভা বসেছে । হৈ হৈ রৈরৈ রব। বাউড়ি পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে সেই সভায় । মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দিদিমনি বললেন—“আপনারা পড়তে শিখুন,লিখতে শিখুন । গুনতে শিখুন । তাহলে আপনারা ঠকবেন না । হকের জন্য লড়াই করতে পারবেন । কেউ সাহস পাবে না,আপনাকে ঠকাতে ।শিক্ষা আপনাদের জন্মগত অধিকার ।” দিদিমনির কথায় হাততালি পড়তে লাগল ।

ঘরে ফিরে এসে রাধা আর রতন দুজনেই বলে—- আমাদের উতমা মাস্টার বাবু হবেক। সেদিন রতনের পড়ার ইচ্ছা চলে গেছে । বাপ হয়ে ছেলের কাছে পড়বে! বেশ কদিন ধরে উত্তম সাঁঝ বেলায় পাড়ার বড়ো দের ইসকুলে পড়াচ্ছে । উত্তম ইস্কুল থেকে ফিরতে রতন বলল—-এই উতমা,ইদিক আয় একবারটি । উঠোনে বসে আছে রতন। উত্তম তার পাশে বসল । রতন বললো—-এই একবারটি আমার নাম টি লিখ ইখানে । উত্তম বললো—–মাটিতে? —-হঁ রে বাপ । আংগুলের ডগায় উত্তম লিখে দিল ,”রতন বাউরি “। রতন জ্বল জ্বল চোখে চেয়ে রইলো সেই আঁচর কাটা মাটিতে । বাপের জন্য কষ্ট হলো উত্তমের । রাধা আর রতন বাদে বাউড়ি পাড়ার সবাই সাঁঝ বেলার ইস্কুলে যাচ্ছে। তাই উত্তম বললো—-এই বাপ,সাঁঝ বেলার ইসকুলে যা না ক্যানে? —–যাব। কিন্তক রাধা যাবেক লাই। বাপ ছেলের কথা কানে গেছে রাধার তাই বলে—— কি বুলছে গ। ছিলার কাছে বাপ পড়বেক?

সাঁঝ বেলার পাঠশালায় উত্তম কে ঢুকতে দেখে একজন বললো,”——দ্যাখ গ কে আইচেন । আমাদের মাস্টার বাবু গ।” সবাই সে কথায় হেসে উঠলো । উত্তমের তেল চুকচুকে মাথা থেকে তেল গড়িয়ে নেমেছে । মুখ খানা মিষ্টি ।এতো লোকের হাসিতে ভয় পাবার কথা । কিন্তু পাড়ার হারান জ্যাঠার কথায় ভয় কেটে গেল । তিনি বলেন—–এখানে আমরা সবাই বিদ্যা দেবীর আরাধনা করতে এসেছি । উত্তম আমাদের জ্ঞান দান করে উপকার করছে ।

সাহস পেয়ে উত্তম বললো——-জ্যাঠা,জেঠি,খুড়া, খুড়ী তোমাদের পেন্নাম । আমি মাস্টার বাবু লই গ। আমি যা জানি তা তুমাদের শিখা করাব। কথা বলতে বলতে নজরে পড়ে রতন পিছনের সারিতে একা বসে আছে । উত্তম বলল——এই বাপ সামনে আয় না ক্যানে। মহিম বাবুর বাড়ি থেকে রাধা বাড়ি ফিরেছে। মাথায় ঘুরছে তার হক্ এর টাকা গুলার কথা । সে রাতে ই রতনকে বলল——মহিম বাবুর থেকে কত টাকা পাব তার হিসাবটা কর না ক্যানে । রতন রাগ করে বলে—-আমি কি লেখা পড়া জানি? উতমার কাছে জান না ক্যানে ।

উত্তম বলল—-এই মা সাঁঝ বেলার পাঠশালায় যা না ক্যানে । তাহলে হিসাব করতে শিখ্যে যাবি। রাধা বলে—-না না। আমি ইসকুলে যাব লাই। রাগ করে উত্তম বললো—–তাহলে মুখ্যু হয়ে থাক গা যা । তুর পাশের সবাই লিখতে,পড়তে জানবে আর তুই হাঁ করে থাকবি। তুকে বাবুরা ঠকাবেক । মহিম বাবুর বাড়ি কতো পাবি তা হিসাব করতে লারবি।

স্কুল ছুটির ঘন্টা পড়লো । উত্তম ঘরের দিকে ছুটলো । ।মাস্টার মশায় বলেন,”সময় চলিয়া যায়,নদীর স্রোতের প্রায়/বেগে ধায় নাহি রহে স্থির “।তাই উত্তম সময় নষ্ট করে না । ঘরে আজ আঁধার । হবেই তো। মায়ের মুখে হাসি নেই বাপ নিশ্চয়ই মাকে মেরেছে । ভয় পায় উত্তম । অন্য দিনের মতো মায়ের কাছে যায় । কিন্তু খাবার কথা বলে না। কি করে বলবে?মায়ের চোখে জল দেখে উত্তমের খিদে চলে গেছে । বাপ তখন দাওয়ায় বসে ঝিমোচ্ছে । উত্তম ছুটলো রূকমিনী মায়ের থানে। বাপের ডাক কানে এলো ।—-এই উতমা কোথায় যাস? বাপের ডাক কানে এলো । তবু ও ফিরে তাকালো না। এক ছুটে পৌঁছলো রূক্মিনী মায়ের থানে । মাটি দিয়ে নিকানো মায়ের থান । গাছের তলে সারি সারি মাটির ঘোড়া । এঁকে ই সবাই পুজো করে । হাত জোড় করে চোখ বুজে উত্তম বলল—-হে মা, তুমি আমার মায়ের সব কষ্ট দূর করে দাও । চন্ডাল বাপ টার রাগ কমিয়ে দাও। মা রূক্মিনী কে ডাকতে ডাকতে বুকের মাঝে গুরগুর করে । চোখে জল এসে যায় । মন শান্ত হলো মায়ের থানে এসে । এবার ছুটতে লাগল ঘরের দিকে । ঘরের কাছে এসে ভয় হলো । বাপ যদি ওকে মারে? তবু ও দাওয়ায় উঠলো পা টিপে টিপে । দাওয়া থেকে চেয়ে দেখলো মায়ের অন্য রূপ । পাটভাঙা হলুদ রং এর শাড়ি পড়েছে মা। মাথায় মান্দারফুলের মালা ।চোখে কাজল । মায়ের মুখোমুখি বসে আছে বাপ। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে । উত্তম ভাবে তবে কি মা রূক্মিনীর দয়াতেই হয়েছে? নইলে বাপের মুখে এমন হাসি কেন? ঘুমে কাদা বারো বছরের উত্তম । এখন উত্তম কে দেখে কে বলবে–উত্তম মাস্টার । বাপ মায়ের মাঝে শুয়ে আছে । তার এক পা মায়ের পেটের ওপর। অন্য পা বাপের পেটের ওপরে। গভীর ঘুমে কাতর উত্তম ।উত্তম সকালে ঘুম থেকে উঠেছে । তখন সূর্যিমামা উপেন জ্যাঠার দু’তলার ছাদে উঠে গেছে । গোবরের বালতি নিয়ে ছুটলো উত্তম । আজকাল ছেলে গোবর কুড়োতে গেলে রাধার খারাপ লাগে।

রাধা তাই বললো—–
বাপ,তুই যাস না । আমি লিয়ে আসব ।
উত্তম বলে—-ক্যানে ?

উত্তম জানে কারণটা । এখন উত্তম মাস্টার বাবু হয়েছে। আরে,সে কি সত্যি সত্যি মাস্টার হয়েছে? যেদিন সত্যি সত্যি মাস্টার বাবু হবেক সেদিন মাকে কোন ও কাজ করতে দেবে না উত্তম । সূর্যের দিকে তাকানো যায় না এসময় । সূর্যদেব কে না দেখলে ভালো লাগে না উত্তমের। ভোরের লাল থালার মতো সূর্য কে দেখে দিন শুরু করতে ভালো লাগে। আর স্কুল থেকে ফেরার সময় সেই সূর্যের অন্য রং। যাবার আগে আকাশটাকে লাল করে দিয়ে যায় । উত্তম ভাবে মা যেদিন সাঁঝের ইসকুলে যাবে সেদিন গাঁয়ের সবাই অক্ষর চিনে যাবে । কেউ ঠকাতে পারবে না গরিবদের । ঠিকই বলেছেন শহরের দিদিমনি।আজই মাকে বোঝাবে উত্তম । সাঁঝ বেলার ইস্কুলে যাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে রাধা ছেলেকে বললো—–কিরে উতমা,ইসকুলে যাবি লাই?
——-না।তুই সাঁঝের ইসকুলে না গেলে আমি ইসকুলে যেতে লারবো ।
——-হঁ রে বাপ , আমি যাব।

মায়ের মুখে সাঁঝ বেলার ইস্কুলে যাবেশুনে ও বিশ্বাস করেনি উত্তম । কিন্তু সাঁঝ বেলার ইস্কুলে ঢুকে দেখলো রতন আর রাধা একেবারে সামনের সারিতে বসে আছে । উত্তম বোর্ডে লিখলো—–সবাই নিজের নাম লিখ। একটু পরে মায়ের কাছে এগিয়ে গেল । মাকে লেখা শিখিয়ে দেবে বলে । মায়ের হাত থেকে শ্লেট খানা নিয়ে থমকে গেল উত্তম । শ্লেট এ গোট গোট করে লেখা——-“রাধা রানী বাউড়ি । স্বামী রতন বাউরি । ছেলে উত্তম বাউড়ি।”
উত্তম মায়ের দিকে চেয়ে বলে—–কে লিখেছে? রাধা কে হাসতে দেখে রতন ছেলেকে বললো —— তুর মা লিখেছে রে বাপ । আমার থেকে দেখে দেখে সারাদিন অভ্যাস করে লিখেছে। উত্তম মাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর হারান জ্যাঠাকে বললো——-জ্যাঠা গ তোমার গাঁয়ের সবাই অক্ষর চিনেছে।সবাই শিক্ষিত ।কেউ আর নিরক্ষর লাই গ। সে রাতে উত্তম মায়ের আর বাপের পেটের ওপরে পা রেখে ঘুমে কাদা ।

শহরের সূর্য টা এবার ওদের গাঁয়ে ঢুকে পড়েছে। আলোয় ভরে গেছে বাউড়ি পাড়া।রাতে পথ দেখতে কষ্ট নেই ।সেই আলোতে ক্ষেত খামারে কাজ হচ্ছে । ধান ভাঙ্গতে যাচ্ছে ।আর ঘরে ঘরে ভাতের গন্ধ ।সেই ভাত খেয়ে ছেলে বুড়োর মুখে হাসি ।চোখে চকচকে খুশির হাসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress