Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা || Tarapada Roy

সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা || Tarapada Roy

সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা

সর্বাঙ্গসুন্দর চৌধুরীর নাম কেউ শোনেনি। সর্বাঙ্গসুন্দরের কোনও কবিতাও পড়েনি। তার একটা কারণ অবশ্য এই যে সর্বাঙ্গসুন্দরের কোনও কবিতাই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যদিও তার কবিতার সংখ্যা অজস্র, কবিতার খাতাই হবে গোটা দশেক, আর সে খাতাগুলোও বেশ মোটা মোটা।

সর্বাঙ্গসুন্দর নামটা নিয়ে কারও কারও মনে খটকা লাগতে পারে। এ আবার কী নাম রে বাবা! তাই ব্যাপারটা প্রথমেই খোলসা করে নেওয়া ভাল।

সর্বাঙ্গসুন্দরদের পরিবারের গৃহদেবতা হলেন গৌরাঙ্গ। বীরভূম জেলায় রামপুরহাট মহকুমা শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে বটতলা গ্রামে সর্বাঙ্গসুন্দরের বাড়ি। সে বাড়িতে সোনার গৌরাঙ্গের মন্দির আছে। আশেপাশের লোকেরা বলে, চৌধুরীদের সোনার গৌরাঙ্গ, যদিও সোনার গৌরাঙ্গ এখন আর নেই। এই সোনার গৌরাঙ্গের নামেই সর্বাঙ্গসুন্দরের দাদার নাম রাখা হয়েছিল গৌরাঙ্গসুন্দর। গৌরাঙ্গসুন্দরের জন্মের বছর কয়েক পরে আমাদের সর্বাঙ্গসুন্দর যখন জন্মাল তখন স্বাভাবিকভাবেই তার পিতামহ এই দ্বিতীয় পৌত্রের নামকরণ করলেন সর্বাঙ্গসুন্দর। গৌরাঙ্গের সঙ্গে মিল দিয়ে অন্য নাম পাওয়া গেল না।

সর্বাঙ্গসুন্দরের পিতামহ অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই। সর্বাঙ্গসুন্দরেরাও আর বটতলা গ্রামে থাকে না। তাদের সেই পারিবারিক বিগ্রহ সোনার গৌরাঙ্গ, সেও কয়েক বছর আগে দেশের বাড়ি থেকে চুরি গেছে।

কিন্তু জমজমাট সর্বাঙ্গসুন্দর নামটা রয়ে গেছে। তবে এত বড় নামটা সব সময়ে সবাই ব্যবহার করে না, তাকে ছোট করে সুন্দর বলে ডাকে। সর্বাঙ্গসুন্দরের দাদা গৌরাঙ্গসুন্দরকে অবশ্য সবাই ডাকে গোরা বলে।

সুন্দরের বাবা রেলে কাজ করেন। এখন থাকেন হাওড়ায় সাঁতরাগাছি অঞ্চলে রেলওয়ে কোয়ার্টারে। কাছেই একটা পুরনো আর ভাল হাইস্কুল আছে। সেই স্কুলে গোরা আর সুন্দর দুজনেই পড়ে, গোরা পড়ে ক্লাস টেনে। এ বছরই তার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। সুন্দর অবশ্য দু ক্লাশ নীচে পড়ে।

গোরা খুব ভাল ছাত্র। স্কুলের মাস্টারমশায়রা জানেন গোরা স্টার পাবেই, হয়তো স্ট্যান্ড করতেও পারে। কিন্তু সুন্দর মোটেই ভাল নয় লেখাপড়ায়, কোনও রকমে টায়েটুয়ে পরীক্ষায় পাশ করে। অবশ্য দেখলে দেখা যাবে গোরা খেলাধূলা, হইচই করে বেশি সময় কাটায়। আর সুন্দর সর্বদাই। খাতা-কলম নিয়ে বসে আছে।

এসব কথার ফাঁকে বলি, আসল গোলমালটা অন্য জায়গায়।

রামপুরহাটের বটতলা গ্রামের চৌধুরীরা খুবই জ্যোতিষ-ট্যোতিষ মানেন। মহাধাম কাশীতে তাদের কুলগুরুরা পুরুষানুক্রমে বাস করেন। চৌধুরীবাড়িতে কোনও জন্মমৃত্যুর ঘটনা ঘটলে দিনক্ষণ-ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড, সমস্ত বিশদ করে কাশীতে গুরুগৃহে জানানো হয়।

বর্তমান গুরু হলেন জ্যোতিষ বারিধি, ত্রিকালদর্শী পণ্ডুলাল দেবশর্মা। সর্বাঙ্গসুন্দরের জন্মক্ষণ ইত্যাদি তার কাছে পৌঁছানোর পর পঙুলাল ঠাকুর বহু যত্নে সর্বাঙ্গসুন্দরের ঠিকুজি তৈরি করে পাঠিয়েছিলেন। এর বাবদ চৌধুরী পরিবার পাঁচশো এক টাকা পঁচিশ পয়সা প্রণামী দিয়েছিলেন গুরুদেবকে।

এই মূল্যবান ঠিকুজিতে লেখা আছে যে, শ্রীমান সর্বাঙ্গসুন্দর চৌধুরীর জন্মক্ষণে রাশি-নক্ষত্র, গ্রহাদির যেরকম অবস্থান ছিল তাহা এক কথায় বলা চলে অভূতপূর্ব। তাঁহার জন্মকুণ্ডলীতে মহাকবির সমস্ত লক্ষণ পাওয়া গিয়াছে। এই শিশু একদিন কালিদাস-ভবভূতি কিংবা রবীন্দ্রনাথের মতো বড় কবি হইবেই হইবে। অত্যন্ত সতর্কতা এবং যত্নের সহিত ইহাকে লালন-পালন করিতে হইবে। ইহার কবিত্ব বিকশিত হওয়ার জন্য যাহা কিছু করা প্রয়োজন তাহার যেন অন্যথা না হয়।

ঠিকুজির সঙ্গে এই ভবিষ্যৎবাণী, তার সঙ্গে গুরুদেবের স্বহস্ত লিখিত প্রেসক্রিপশন এবং ওষুধ ছিল। একটি ছোট তামার মাদুলি, পদ্যবিকশিনী তাবিজ সেটা, আকারে ছোট হলে কী হবে দারুণ শক্তিশালী, ভগবতী ভারতীর আশীর্বাদধন্য অথচ দাম মাত্র এগারোশো টাকা।

সুন্দরের বাবা নিমাই চৌধুরী রেলে কাজ করেন, চোখা বুদ্ধির লোক। তিনি এ টাকা কখনওই গুরুদেবকে দিতেন না। মাদুলি ফেরত দেওয়ার উপক্রম করেছিলেন তিনি, কিন্তু সুন্দরের ঠাকুরদা তখনও বেঁচে, তিনি আধ বিঘে ধানজমি বেচে গুরুর পাওনা মেটালেন। তাঁর বক্তব্য হল যে বাড়িতে এমন একটি ছেলে জন্মেছে যে একদিন কবিতা লিখে বংশের মুখোজ্জ্বল করবে, তার জন্যে এক-আধ বিঘে জমি বেচে দেওয়া যেতেই পারে। লোকেরা তো ছেলেমেয়ের ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে কত খরচ করে। কবি হওয়ার জন্যে তো আর সেরকম খরচ করতে হবে না।

অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। সর্বাঙ্গসুন্দর লেখাপড়া বিশেষ করে না, সদা-সর্বদাই কাব্য রচনা করে চলেছে। কখনও সে কবিতা জলের মতো সোজা:

সোজা চল, বাঁকা চল,
জলে জলে টলমল।
কিবা হবে বাহুবল,
নৌকাই সম্বল।

এ কবিতা অবশ্য অনেকদিন আগে লেখা। সর্বাঙ্গসুন্দর দ্বিতীয় ভাগ শেষ করেই কবিতা লিখতে শুরু করে। এ কবিতা তার বছর দুয়েকের মধ্যেই সে রচনা করে।

তার এখনকার কবিতা কিন্তু আস্তে আস্তে জটিল হচ্ছে। বছর কয়েক আগের জলের কবিতাই ধীরে ধীরে অন্য রকম হয়েছে, তার মধ্যে নানা প্যাঁচ এসে গেছে, সে তেল আর জল মেলাতে গেছে:

তেল আর জল। ধর্মের কল।
দধি অম্বল। অমল কমল।
গদি টলমল। চোখ ছলছল।
নদী ছলছল। অদল বদল।
দিবসে নিশাতে। লেপ কম্বল।
তেল আর জল। তরল গরল।
মিশাতে মিশাতে…

ভুক্তভোগীরা জানেন এ ধরনের কবিতা লেখা বেশ কঠিন। যেমন এইখানে সর্বাঙ্গসুন্দরের একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তেল আর জল মেশানোর পরে কী করতে হবে, সেটা ঠিক তার মাথায় খেলছে না।

মাস তিনেক আগে আরেকবার এমন হয়েছিল। সেবার পাড়ায় একটা বড় চুরি হয়েছিল। চুরির তিনদিন পরে একজন বেঁটে দারোগা চুরির তদন্ত করতে এসেছিলেন। সেই দারোগাসাহেব শুধু বেঁটেই নন, রোগাও খুব। পরনের খাকি ইউনিফর্ম ঢলঢল করছে। কিন্তু তাঁর কী প্রতাপ! কথায় কথায় হাতের বেতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকছেন, কাউকে ইডিয়েট, কাউকে স্টুপিড বলছেন।

দারোগা চলে যাওয়ার সময় পাড়ার মুদির দোকান থেকে পাঁচ কেজি সরষের তেলের একটা টিন আর দশ কেজি গোবিন্দভোগ চাল ধারে নিয়ে গেলেন। পরে শোনা গেল, দারোগাবাবু নাকি ভীষণ ঘুষখোর। চোর-টোর কোনওদিন কিছুই ধরেন না, ধরার চেষ্টাও করেন না। শুধু ঘুষ খেতে ওস্তাদ। পান-সিগারেট, এক টাকা দু টাকা থেকে সোনা-দানা মোটা টাকা সব কিছুই ঘুষ খান এই দারোগাবাবু।

চোর বলে দারোগারে
কত ঘুষ খাবি খারে।
তার পরও যদি ধারে
তেল খাস চাল খাস…

সেই সময়ে দারোগাবাবুর ব্যাপার, দেখে রাগে, ঘৃণায় এই কবিতাটি লিখেছিল সুন্দর। কিন্তু কবিতাটি একাধিক কারণে শেষ করা সম্ভব হয়নি।

এক নম্বর কারণ হল, এর পরে আর কী লেখার থাকতে পারে সেটা সুন্দর ভেবে উঠতে পারেনি। ওই তেল খাস, চাল খাস এতেই সব কথা বলা শেষ হয়ে গেছে।

দুই নম্বর কারণটি অবশ্য খুবই সাংঘাতিক।

কবিতাটি আরম্ভ করেই সর্বাঙ্গসুন্দর তার বাবাকে শোনাতে গিয়েছিল। নিমাই চৌধুরী ওই চার লাইন শুনেই ছেলেকে বাধা দিলেন। তিনি বললেন, পুলিশের ঘুষ খাওয়া নিয়ে কবিতা লিখতে যেও না। একদম ফাটকে পুরে দেবে।

এরকম একটা সম্ভাবনার কথা কিশোর সর্বাঙ্গসুন্দর মোটেই ভাবেনি। কিন্তু বুদ্ধিমান পিতার নির্দেশে সে সতর্ক হয়ে গেল।

তারপর অনেকক্ষণ চিন্তা করে বাবাকে প্রশ্ন করল, বাবা, তাহলে রেশনের জিনিসপত্র নিয়ে কোনও কবিতা লেখা চলবে না?

নিমাইবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রেশনের চাল-গম নিয়ে আবার কী কবিতা?

সর্বাঙ্গসুন্দর বলল, পড়ব, শুনবে?

নিমাইবাবু রাজি হতে সর্বাঙ্গসুন্দর পড়তে আরম্ভ করল:

পচা চাল, পচা গম
ওজনেও কম কম…

মাত্র এই দু লাইন শুনেই সর্বাঙ্গসুন্দরের বাবা চমকিয়ে উঠলেন, আরে সর্বনাশ! থাম, থাম৷ এসব কী লিখেছিস? তারপর সর্বাঙ্গসুন্দর থেমে যেতে তিনি বললেন, কবিতার কি আর বিষয় নেই? আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, পাখি, ফুল–সেই সব নিয়ে কবিতা না লিখে রেশনের পচা চাল আর দারোগার ঘুষ খাওয়া নিয়ে কবিতা?

বাবার কথা শুনে সর্বাঙ্গসুন্দর নতুন করে ভাবা শুরু করল।

তাদের বাড়ির কাছে নদী নেই বটে, তবে ফুল আছে, পাখি আছে। তাদের নিজেদেরই কোয়ার্টারের উঠোনে একচিলতে ফুলের বাগান আছে। সে প্রথমেই ফুলের বিষয়ে একটা নীতিমূলক কবিতা লিখল:

জবা ফুল, গাঁদা ও গোলাপ,
গাছ থেকে ফুল তোলা পাপ।
গাছে গাছে ডালিয়া-জিনিয়া,
খেলিতেছে হাসিয়া হাসিয়া।
আরও কত ফুলটুল ফোটে,
সব আমি চিনি নাই মোটে।

এর দু-চার দিন পরেই একটা খুব বড় নদীর কথা কল্পনা করে সে লিখল:

একবার যদি
সাঁতরাই নদী
ওই পারাবার
হয়ে যাই পার।
রাশি রাশি ঢেউ
ভেসে যায় কেউ,
ডুবে যায় কেউ,
কাঁদে ভেউ ভেউ,
ডুবে ডুবে জল খায়।
নদী চলে যায়,
নিজের বাসায়,
থামে না তো কভু হায়!!

এইভাবে ভালই এগোচ্ছিল সুন্দর। তার ইচ্ছে ছিল নদীর পরে পাহাড়ের ওপর কবিতা লিখবে সে। কিন্তু সে কোনওদিন পাহাড় দেখেনি। এ কথা বাবাকে বলতে নিমাইবাবু বললেন, আমাদের। বীরভূম জেলাতেই তো মামা-ভাগ্নে পাহাড় আছে। ছোটবেলায় দেখেছিস, তোর মনে নেই। ঠিক। আছে পুজোর ছুটিতে তোকে মামা-ভাগ্নে পাহাড় দেখিয়ে আনব।

কিন্তু এর মধ্যে একটা ভীষণ গোলমাল হয়ে গেল।

নিমাইবাবুদের রেল কলোনির পাড়ায় নিমাইবাবুদের কোয়ার্টারের পাশেই একটি নতুন পরিবার বদলি হয়ে এল খঙ্গাপুর থেকে। সে বাড়ির বড় ছেলেটি সর্বাঙ্গের দাদা গোরার সমবয়সি, কিন্তু পড়ে সর্বাঙ্গসুন্দরের সঙ্গে এক ক্লাশে। ছেলেটির নামও চমৎকার, মিলটন চক্রবর্তী।

মিলটন চক্রবর্তী তার বয়েসের তুলনায় একটু বেশি পাকা, এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হল, সে একজন ডাকসাইটে কবি, নিজের কবিক্ষমতা সম্পর্কে তার খুব উঁচু ধারণা।

পাশাপাশি বাড়িতে দুজন কবি হলে নানা রকম ঝামেলা দেখা দেয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। তা ছাড়া মিলটন আর সুন্দর শুধু পাড়াতেই প্রতিবেশী নয়, স্কুলেও সহপাঠী। সুন্দর যখন জানতে পারল, মিলটনও কবি, সে কেমন গুটিয়ে গেল। মিলটন নিজে থেকেই একদিন সুন্দরকে নিজের কবিতা শুনিয়ে দিল:

মহা চিন, মহা রাশিয়া
সবাই গিয়াছে ফাঁসিয়া
যদু-মধু, রাম ও রহিম
সবাই শুধায়,
অতঃ কিম, অতঃ কিম্।

এই রকম কয়েকটি গোলমেলে ছন্দভুল কবিতা মিলটন পড়ে শোনায়। বলা বাহুল্য, ঠিক এরকম কবিতা সুন্দর কখনও শোনেনি। মিলটনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পদ্য সম্পর্কে ধারণাই তার পালটে গেল।

সুন্দর মিলটনের কাছে প্রকাশ করল যে, সে নিজেও কবিতা লেখে। মিলটন ব্যাপারটাকে কোনও পাত্তা দিল না।

সুন্দর তখন মিলটনকে প্রায় জোর করে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা সোনার মোহর শোনাল। কিন্তু মিলটন রাত হল ভোর সোনার মোহর আকাশের গায়ে গড়ায়… এইটুকু শুনেই সুন্দরকে থামিয়ে দিল, বলল, ব্রাদার, এসব কবিতা চলবে না। খবরের কাগজের সংবাদ নিয়ে পদ্য লেখো, দুঃখ-বেদনা নিয়ে কবিতা লেখো। তবে তো পাবলিক পড়বে।

মিলটনের অনুপ্রেরণায় সুন্দর তার পদ্যগুলোকে একটু একটু করে বদলাতে লাগল। পাখিদের নিয়ে একটা কবিতা লিখল, রীতিমতো মর্মস্পর্শী:

চড়ুই, কাক, ও টুনটুনি,
সারাদিন তাহাদের ভীষণ খাটুনি।
কারণ শালিক,
সেই কি না তাহাদের মালিক
কথায় কথায়
সারাদিন তাহাদের ভীষণ খাটায়।

সর্বাঙ্গসুন্দরের এই কবিতাও মিলটনকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। মিলটন গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, কিছু মনে কোরো না ভাই, কবিতার লাইনে তোমার সুবিধে হবে না।

একটু দুঃখিত হয়ে সুন্দর পালটা প্রশ্ন করল, কবিতার লাইনে তোমার সুবিধে হবে?

মিলটন বলল, না হয়ে উপায় নেই। কাশীর জ্যোতিষী পঞ্চুলাল দেবশর্মা নিজে আমার ঠিকুজি দেখে বলেছে, আমি মহাকবি হব, আমি নোবেল প্রাইজ পাব।

মিলটনের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেল সুন্দর। সেদিন রাতেই সে তার বাবাকে বলল, পাশের বাড়িতে নতুন যে ছেলেটা এসেছে, সে খুব কবিতা লেখে।

বাবা অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ, আজকাল অনেক লোকে কবিতা লিখছে।

সুন্দর বলল, তা শুধু নয়, কাশীর সেই আমাদের পণ্ডুলাল জ্যোতিষী, তিনি ওঁর ঠিকুজি দেখেও বলেছেন, ও মহাকবি হবে, নোবেল প্রাইজ পাবে।

হো হো করে হেসে উঠলেন সুন্দরের বাবা নিমাইবাবু। তারপর বললেন, এই পঞ্চুলাল তো এক নম্বরের জোচ্চোর। ও জ্যোতিষের কী জানে? গত বছর জুয়াচুরির মামলায় জেলে গেছে। ওর ভবিষ্যৎবাণীর কী দাম? বছরের পর বছর লোকটা বাবাকে নানা কায়দায় ঠকাত।

পঞ্চলের ঠিকুজি মিথ্যে, তার ভবিষ্যৎ গণনা জোচ্চুরি, এ কথা বাবার কাছ থেকে শোনার পর সর্বাঙ্গসুন্দরের মনের ওপর থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল। তার আর কবিতা লেখার দায়িত্ব নেই। সে ঠিক করল, অত কবিতা কবিতা করে আর পাগলামি করবে না।

এর পরে দু-চার দিন মিলটনের সঙ্গে স্কুলে এবং পাড়ার মধ্যে দেখা হলেও সে কবিতা বিষয়ে আগের মতো কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। অবশেষে নাক-উঁচু মিলটনই নিজে থেকে জিজ্ঞাসা করল, কী হে কবিতা-টবিতা কিছু লিখলে?

সুন্দর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি।

আসল কথাটা হল, সুন্দর কিন্তু কবিতা লেখা একেবারে ছেড়ে দেয়নি। এখন কিছুদিন কবিতা লিখবে না। তারপর ধীরে-সুস্থে, ভেবে-চিন্তে একটা একটা করে কবিতা লিখবে সে। পঞ্চুলাল জ্যোতিষীর মনগড়া, জোচ্চুরির ভবিষ্যৎবাণী সর্বাঙ্গসুন্দর নিজের ক্ষেত্রে মেলাবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress