চিঠিতে তোমাকে সম্বোধন করতাম, ওগো মরীচিকা, তাই না?
তখন বয়েস ছিল তেইশ, মরুভূমিটি দিগন্ত ছড়ানো, আর
সব সময় তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ
তুমি কখনো কখনো দাঁড়াতে এসে ঝুল বারান্দায়
সমুজ্জ্বল দন্তরুচির হাসিতে, এক পাশে মুখ ফিরিয়ে
ছড়িয়ে দিতে ছাতিম ফুলের মতন কিছু পরাগরেণু
তারপরেই আমার জ্বর হত
দেখা, চেনা হাসি, কিন্তু কাছে ডাকতে না
জ্বর হলেই আমার চিঠি লেখার ইচ্ছে হত খুব
রক্ত মাখা পরাবাস্তব চিঠি শুধু এক শো চার ডিগ্রি জ্বরেই লেখা যায়
আমার সারা শরীরে মরুভূমির বাতাস, অন্তঃস্থল পর্যন্ত
দগ্ধ করে দিচ্ছে
চিঠির অক্ষরে পিণ্ডি চটকাতাম বাংলা ভাষার
কখনো কখনো তোমাকে মনে মনে রাক্ষসীও বলতাম
তোমার ঠোঁটে রক্ত, টপটপ করে ঝরে পড়ছে, আমারই রক্ত
সে রকমই দেখতাম, কেমন স্বাদ বলো তো, জিজ্ঞেস করিনি।
যেবার তুমি হঠাৎ সিঙ্গাপুর চলে গেলে কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে
সেবারে না-লেখা চিঠিতে তিনবার বলেছিলাম, হারামজাদি!
এতদিন পর সত্যি কথা বলছি, এখন আর লজ্জা কী, বলো
ছাদে উঠে নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম
এর নাম কি প্রেম, না নারী-মাংস চেটেপুটে খাবার তীব্র বাসনা?
কিন্তু তুমি তো নারী নও
তুমি নারী ছিলে না, নারীর আদল, কুয়াশা ভেদ করা
এক বিমূর্ত অভিমান
না হলে সুহৃদয়ের বোন মণিদীপা কী দোষ করল
তার স্তন দুটি ও ঊরুর ডৌল তো তোমার চেয়ে মন্দ বলা যায় না
আমি বেকার জেনেও মণিদীপা আমার দিকে তরল করেছিল চোখ
একদিন সারা দুপুর কেউ নেই, মণিদীপার নাকের পাটা ফুলে গেছে
আর একটু হলেই…তুমি এসে কল্পনায় দারুণ উৎপাত শুরু করলে
তোমার কাছে আমি দাসখৎ লিখে দিইনি, যদি একটা দুপুর
মণিদীপার সঙ্গে…তারপর সব মুছে ফেলা যেত
তবু পারিনি, সেদিন তোমায় বলেছিলাম, হিংসুটে আহ্লাদী পেল্লাদি!
তুমিও আমাকে দু-তিনটে চিঠি লিখেছিলে
না, মোট পাঁচটা, ঠিক মনে আছে
কী সম্বোধন করেছ, শুধু নাম, তাই না?
তোমাদের বাড়ির কাজের লোক আর আমার নাম একই
তবু তুমি অন্য নাম দাওনি
সে সব চিঠি রেখে দিইনি অবশ্য, বিয়ের আগে নষ্ট করে ফেলতে হয়েছে
আমি জানি, আমার ছিন্নপত্রগুলিও হাওয়ায় উড়তে উড়তে
কোনো মরুভূমিতে কিংবা লবণ সমুদ্রে ছড়িয়ে গেছে
একেই বলে, সাধনোচিত ধামে প্রস্থান!
সরকারি কাজে বাইরে যাচ্ছি, এয়ারপোর্টে হঠাৎ দেখা
অনেক বছর বাদে, একটুক্ষণের জন্যে, মনে আছে?
কী সব এলেবেলে কথা হল, ইংরিজিতে যাকে বলে স্মল টক
ওদিকে তোমার স্বামী বেচারি অতিরিক্ত লাগেজ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত
তোমরা যাবে মুম্বাই, আমি দিল্লি, আমাদের সময় আলাদা
সময় আলাদা, সময়ের মাঝখানে বিরাট ফাটল, আমরা কেউ কারুর নয়
তোমার একটা ছেলে, বোধহয় তিন চার বছর বয়েস হবে
তোমার ঊরুর শাড়িতে মুখ ঢেকে মিটি মিটি চোখে দেখছে আমাকে
সরল শৈশব অতি সাংঘাতিক, বয়স্করা দুর্বল হয়ে পড়ে
এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, এ আমার সন্তান
হলেও তো হতে পারত
যদি আমি পেরিয়ে আসতে পারতাম একটা মরুভূমি
আমিও অবশ্য অন্য দুটি সন্তানের পিতা, তারা আমার খুবই প্রিয়
তবু ঐ বাচ্চাটা জুল জুল করে তাকাচ্ছে, কী যে মায়া হল
ওর মাথার চুলে আদর করতে গিয়েও সরিয়ে নিলাম হাত
সিকিউরিটিতে ঢোকার আগে আমি মনে মনে কী বললাম জানো?
এই নারীকে আমি মরীচিকা বলতাম এক সময়, তাই না?
ও আসলে আমার মরূদ্যান
কোনো দিন পৌঁছোতে পারিনি, কিংবা চাইনি, কিন্তু ওর অঞ্জলি থেকেই
তো জল পান করে গেছি সেই যৌবনে
শুধু ঐ টুকুই, মনে রেখো, তুমি আমার বুক মুচড়ে দিতে পারোনি
তোমার মূর্তি গড়িয়ে ভালোবাসার নামে ঘোরাফেরা করেছি
শিল্পের আশে পাশে
সব চিঠি, সব সম্বোধন, তোমাকে নয়, সেই মূর্তিকে
ঝুল বারান্দা থেকে আমিই তোমাকে নেমে আসতে দিইনি
ধুলো মাটির রাস্তায়!