Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সম্পাদক || Ashutosh Mukhopadhyay

সম্পাদক || Ashutosh Mukhopadhyay

কলকাতা থেকে ট্রেনে উনিশ মাইল মাত্র পথ। শহরের এত কাছে এমন অজপাড়াগাঁও আছে জানতাম না। অবশ্য তখনো পর্যন্ত এসে পৌঁছুই নি আমরা। ট্রেনে বসে গাঁয়ের কথা শুনছিলাম। বক্তা শ্রীবিলাসবাবু। ট্রেনের ঝকানিতে ঝিমুনি আসছিল। তাই দেখে আমাদের চলনদার শ্রীবিলাসবাবু পান্‌সিক্ত ঠোঁটে একটু সঙ্কোচের হাসি মিশিয়ে বলল, আপনাদের কষ্ট হবে, এখনো দেড় ঘণ্টার পথ।

আমাদের কষ্ট হবে, এই কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে অনেকবার বলেছে শ্রীবিলাসবাবু। অথচ তারই অনেক দিনের কর-জোড়ের আকুতিতে আমাদের পা বাড়ানো। কিন্তু আরো দেড় ঘণ্টার পথ শুনে অবাক হলাম। আধ ঘণ্টা হল ট্রেন ছেড়েছে, কিছুটা পথ এসেছিও। উনিশ মাইলের বাকিটুকু যেতে আরো দেড় ঘণ্টা লাগবে কেন!

জিজ্ঞাসা করলাম, কেন, দেড় ঘন্টা লাগবে কেন আরো?

জবাবে শ্রীবিলাসবাবু ভয়ে ভয়ে একবার কোণের জানালার দিকে তাকালো। ওই কোণে ঠেস দিয়ে স্থলবপু ভবনাথবাবু বসে। আজকের অনুষ্ঠানের তিনিই সভাপতি। তাকে নিয়ে যাবার জন্যেই শ্রীবিলাসবাবুর এতদিনের এত তোড়জোড়, এত কাকুতিমিনতি।

জানালা-ঘেঁষা কোণটায় পিঠ আর মাথা ঠেকিয়ে ভবনাথবাবু চোখ বুজে বসে আছেন। খুব সম্ভব ঘুমুচ্ছেন।

তবু গলার স্বর আর একটু খাটো করে শ্রীবিলাসবাবু অপরাধীর মতো টোক গিলে বলল, ইয়ে, আপনার গিয়ে তাই তো প্রায় লাগবে, ধামুয়া থেকে দেড় ক্রোশটাক তো আবার গরুর গাড়িতে যেতে হবে-তা আজ্ঞে আমি আপনাদের জন্যে খুব তেজি বলদের গরুর গাড়ি ঠিক করে এয়েছি, কিছু কমও লাগতে পারে।

এইবার আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ওই কোণের দিকে তাকালাম। ভবনাথবাবু ঘুমিয়েই পড়েছেন, আপাতত কিছু কানে যায় নি হয়ত। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে তাঁর মুখের দিকে তাকানো শক্ত হবে। আমারই বিশেষ সুপারিশে তার আসা। একটু দমে গিয়ে। বললাম, গরুর গাড়ির কথা আগে বলেন নি তো?

এই অসুবিধের কথাটাও বলে ফেলার পর শ্রীবিলাসবাবুর সঙ্কোচ গেছে। এই রকমই রীতি তার। একবার ব্যক্ত করে ফেলার পর, ওটুকু অসুবিধে কিছুই না, বলে নিজেই আবার উড়িয়ে দেয়। বলল–তা আজ্ঞে ও তো প্রায় সবাই জানে–কিন্তু আপনাদের একটুও খারাপ লাগবে না, শহুরে মানুষ গরুর গাড়িটাড়িতে তো চড়েন না–ভালোই লাগবে।

অতএব সেই ভালো লাগার জন্যও মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করলাম।

গাঁয়ের প্রসঙ্গ ছেড়ে শ্রীবিলাসবাবু হঠাৎ একসময় সবিনয়ে নিবেদন করল, এবারে আপনারা সেই মহিলাটিকে একটু দেখবেন কিন্তু, আপনারা বিদ্বান পণ্ডিত লোক কি ব্যাপার ভালো বুঝবেন–

আমি অবাক–কোন মহিলা?

এ-রকম বিস্মৃতি শ্রীবিলাসবাবুর ভালো লাগল না বোধ হয়, ঈষৎ আহত বিস্ময়ে সে-ও ফিরে তাকালো আমার দিকে। তারপর স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করল–সেই যে কনকদেবীর কথা বলেছিলাম আপনাদের, কবিতা বলেন—

মনে পড়ল। সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে এক গ্রাম্য মহিলার প্রসঙ্গ শ্রীবিলাসবাবু দুই-একবার উত্থাপন করেছিল বটে। কিন্তু তার বলার আগ্রহের সঙ্গে আমাদের শোনার আগ্রহের। তেমন যোগ ঘটে নি বলে সবিস্তারে কিছু জানা হয় নি। শুধু এইটুকু মনে আছে, মহিলা লিখতে পড়তে জানেন না; অক্ষরপরিচয়ও নেই, অথচ তার মুখে অনর্গল কাব্য-ঝরে। শোনার মতোই কাব্য, গঁয়ের লোকেরা শুনে অবাক হয়।

বললাম–তা তাকে কি দেখব?

শ্রীবিলাসবাবু জবাব দিল–আমাদের শুনতে ভালো লাগে, এই পর্যন্ত আমরা কতটুকু আর বুঝি বলুন। আপনারা হলেন গিয়ে জহুরী, একনজর দেখলে বা দুলাইন শুনলেই কোন দরের জিনিস, ঠিক বুঝে নেবেন।

অক্ষরজ্ঞানবর্জিত মহিলার কবিতার পাল্লায়ও পড়তে হবে জেনে বিরক্তির বদলে অসহায় বোধ করতে লাগলাম। ট্রেনে যখন উঠে বসেছি, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছুবার আগে নামার প্রশ্ন নেই। কিন্তু ফেরার সময়, আর ফেরার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত আমার ওপর দিয়ে দস্তুরমত একটা ধকল যাবে। অদূরের জানালায় তন্দ্রামগ্ন ভদ্রলোককে যেমন নিরীহ দেখাচ্ছে, আদৌ তেমনটি নন তিনি। তার রসনার পাল্লায় পড়লে অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিও চুপসে যান। একটু আগে ভাবছিলাম, পরের দুর্ভোগ যা হয় হোক, আজকের সভাস্থলে মান বাঁচলে বাঁচোয়া। কিন্তু নিরক্ষরা রমণীর কাব্যাঘাতের সম্ভাবনায় সেই আশাও দূরে সরতে লাগল। মুখের ওপর সেখানে কি যে বলে বসবেন। ভবনাথবাবু, ঠিক নেই। যাদের এ অভিজ্ঞতা আছে, ভাবতে গেলে তাদের অন্তত গায়ে জ্বর আসার কথা।

শ্রীবিলাসবাবুকে সময়ে সতর্ক করে রাখা উচিত। কিন্তু সে অবকাশ মেলা ভার। সাগ্রহে কর্কদেবী প্রসঙ্গ বিস্তারে মন দিয়েছেন তিনি। যা বলে গেলেন তার সার কথা, গাঁয়ের এক মানী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের কন্যা কনকদেবী। পণ্ডিতের কথকতায় নাম ছিল খুব, শোনার জন্য পাঁচ গাঁয়ের লোক ভিড় করে আসত। ঘটা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিন বছরের মধ্যে একটি মাত্র সন্তান কোলে সেই মেয়ে বিধবা হতে পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি কিছুটা ম্লান হয়েছিল। বিধবা হওয়ার পর থেকে ছেলে নিয়ে কন্যাটি বাপের কাছেই থাকতেন। বাপের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছলই ছিল, জমি-জমাও মন্দ রেখে যান নি। বাপ চোখ বুজতে পুঁজি ভাঙ্গিয়ে, আর কিছু কিছু জমি বিক্রি করে ছেলেকে মানুষ করে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন কনকদেবী।বড় আশা ছিল ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু তা হল না। ছেলে উল্টে বিপথে পা বাড়ালো। তার মতি ফেরানোর জন্য মায়ের সেই বুক চাপড়ে কান্না, গোঁ ধরে একটানা দু-তিনদিন নিরস্তু উপোস করা–এ-সব শ্রীবিলাসবাবুরাই স্বচক্ষে দেখেছে, শুনেছে। ছেলে এখন উড়িষ্যায় কোন কারখানায় চাকরি করে। বিয়ে-থা করেছে, ছেলে পুলে হয়েছে–কিন্তু ভুলেও একবার মায়ের খোঁজ নেয় না, মাকে দেখতে আসে না। ছেলের ব্যবহার মায়ের বুকে শেলের মতো বিধত, পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেন দিনরাত। কনকদেবী শ্রীবিলাসবাবুর থেকে বয়সে খুব বেশি বড় হবেন না, তবু শ্রীবিলাসবাবু তাকে মাসী বলে ডাকে। তার ছেলে সত্যবিলাস দিদিমা ডাকে। ছেলেটা খুব ছেলেবেলা থেকেই এই দিদিমার, নেওটা। তাকে ভোলাবার জন্য আর খুব সম্ভব নিজের শোক ভোলবার জন্যেই কনকদেবী অনেক সময় মুখে মুখে ছড়া পাঁচালি বলে যেতেন। ছেলে যত হাঁ করে শুনত, তার মুখে মুখে কাব্য-কাহিনী বানানোর ঝোঁকও তত বাড়ত। ছেলে বড় হতে তার বন্ধুবান্ধবেরাও কাব্যের শ্রোতা হয়ে পড়ল। এইভাবেই ব্যাপারটা রটে গেল। মুখে মুখে অজস্র কাব্যকাহিনী রচনা করেন তিনি, ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়ীরা দল বেঁধে এসে শুনতে বসে। শোনে আর অবাক হয়। শ্রীবিলাসবাবুর ছেলে এখন ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। সে দিদিমার একটা কাব্যের খাতা করেছে। দিদিমা কাব্য বলে, আর সে লেখে। কনকদেবী অক্ষর চেনেন না, কিন্তু কোন পাতায় কোন কবিতা লেখা আছে, একবার চোখ বুলিয়েই তা বলে দিতে পারেন। ওই খাতাখানাই এখন প্রাণ তাঁর। সত্যবিলাস বা লিখতে জানে এমন কেউ তাঁর ঘরে এলেই আদর যত্ন করে জলটল খাইয়ে মহিলা খানিকটা কবিতা লিখিয়ে নেন।

এখন যে সামান্য একটু জমি আছে, শ্রীবিলাসবাবুদের চেষ্টায় তারই চাষের সামান্য আয়ে কায়ক্লেশে কোনোরকমে দিন চলে কনকদেবীর। কিন্তু এই কষ্টের জন্য এতটুকু তাপ-উত্তাপ বা খেদ নেই তার। দিনান্তে কাউকে ধরে দু-চার লাইন কবিতা লেখাতে পারলেই খুশী তিনি, আর কিছু চান না।

–আপনারা, বিশেষ করে ভবনাথবাবুর মতো এমন একজন নামজাদা ব্যক্তি গাঁয়ে আসছেন শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে খুব একটা উত্তেজনা চলছে ভদ্রমহিলার।

উত্তেজনার কারণ সভয়ে অনুমান করতে পারছি। তবু জিজ্ঞাসা করলাম–কেন?

-আপনারা আসছেন শুনেই উনি খাতাটা আপনাদের একবার দেখাবার জন্যে ধরেছেন যে।–শ্রীবিলাসবাবু মাথা চুলকে বলল–আমি কথা দিয়েছি চেষ্টা করব। সেই থেকেই তাঁর কখনো আনন্দ, কখনো ভয়। যখন ভাবেন আপনারা ভালো বলবেন, তখন খুশীতে ভরপুর, আবার যখন মনে হয় আপনাদের ভালো নাও লাগতে পারে, তখন ভয়ানক মুষড়ে পড়েন। শ্রীবিলাসবাবু নিজের মন্তব্য যোগ করল, আমরা অবশ্য তেমন বুঝি নে, তবু মনে হয় আপনাদের ভালোই লাগবে, আর সত্যি ভালো লাগলে কিছু সুবিধেও হতে পারে।

ভদ্রমহিলা অর্থাৎ কনকদেবীর প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও মনে মনে। শ্রীবিলাসবাবুর মুণ্ডপাত করলাম। তার দিকে তাকিয়েই বোঝা গেছে, আমাদের যে ভালো লাগবেই এ-আশ্বাস সে মহিলাটিকে দিয়েছে, আর ভালো লাগলে যে দু-একটা কবিতা ছাপার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে সে কথাও নিঃসন্দেহে বলেছে।

নির্লিপ্ত গম্ভীর মুখে প্রস্তাবটা গোড়াতেই হেঁটে দিতে চেষ্টা করলাম।

-একদিনে এ-সব হবে-টবে না, অন্য একদিন দেখা যাবে, আজই এ-সব নিয়ে ওঁকে বলতে গেলে উনি অসন্তুষ্ট হবেন।

উনি অর্থাৎ ভবনাথবাবু। শ্রীবিলাসবাবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল একবার। জানালার কোণে ঠেস দিয়ে তেমনি তন্দ্রামগ্ন। আবার আমার দিকে ফিরে মুখখানা করুণ করে ফেলল শ্রীবিলাসবাবু, যেন তারই কবি-মূল্য যাচাইয়ের প্রস্তাবটা নাকচ করা হল। সানুনয়ে বলল, ভদ্রমহিলা বড় আশা নিয়ে বসে আছেন স্যর, আপনারা এটুকু অনুগ্রহ না করলে ভারি হতাশ হবেন।

বিরক্তি গোপন করার জন্যেই বাইরের দিকে চোখ ফেরালাম। আমার বিরক্তি এবং অস্বস্তির কারণ শ্রীবিলাসবাবুর সঠিক বোঝার কথা নয়। এক নামী সাপ্তাহিক পত্রের ডাকসাইটে সম্পাদক ভবনাথবাবু। নিক্তির ওজনে লেখা বিচার করেন। লেখা ছাপার জন্যে কেউ সুপারিশ করতে এলে সেই লেখা না পড়েই বাতিল করেন। একান্ত পরিচিতজনেরাও এই রসকষশূন্য প্রায়বৃদ্ধ সম্পাদকটিকে রীতিমত সমীহ করে চলে। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে যত না নাম তাঁর, তার থেকেও বেশি সুনাম অথবা দুর্নাম, কঠিন সমালোচক হিসেবে। অনেক নামী সাহিত্যিকের লেখা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেখেছি। আমরা লেখা না দিলে ঠাস ঠাস কথা শোনান, আবার দিলেও কপালে কি আছে ভেবে শঙ্কায় ভিতরটা ভরে ওঠে।

আমাদের ধারণা এ-দেশের মেয়েদের লেখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের এক ধরনের অ্যালার্জি আছে। মনে হয়, মেয়েরা লিখবে সাহিত্য করবে, এটা বোধ হয় তার পছন্দ নয়। শুধু সংসার আর ঘর-করনা নিয়ে থাকুক তারা, মনে মনে এই চান হয়ত। তার নির্মম বিচারের ফলে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে মেয়েদের লেখাই বেশি জমে। লেখা কেন ছাপা হল না জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, লেখা হলে ছাপা হত।

ভদ্রলোক সবথেকে বেশি রেগে যান কোনো মহিলা লেখা নিয়ে নিজে তার দপ্তরে হাজির হলে। স্বল্প দুই-এক কথায় তাকে জানিয়ে দেন, ট্রাম-বাসের পয়সা খরচা করে না এসে, ডাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হত।

একবার একজন আমতা আমতা করে বলেছিলেন–ডাকে পাঠালে লেখা অনেক সময় ঠিক জায়গামত পৌঁছয় না।

ভবনাথবাবু জবাব দিয়েছিলেন–নিজে নিয়ে এলেও জায়গামত পৌঁছয় না।

তিন-চারদিন আগেও এমনি একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। উত্তর-তিরিশ এক সুশ্রী মহিলা লেখা নিয়ে এসেছিলেন। তার ইচ্ছে, লেখাটা তখনই পড়ে দেখা হোক। লেখাটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন, পরে খবর পাবেন।

মহিলা চলে যেতে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে লেখাটা পড়েই ফেললাম। সত্যি ভালো লেখা। আমার বিচারে অন্তত ভালো। দিন তিনেক পরে দেখলাম, ভবনাথবাবু সেই লেখাটা পড়ছেন। সব লেখা যেমন খুঁটিয়ে পড়েন এটাও তেমনি পড়লেন, তারপর পাশের আর কতকগুলো লেখার সঙ্গে সেটা রেখে দিলেন।

কিন্তু আরো তিন-চারদিন না যেতেই ভদ্রমহিলা আবার এসে হাজির। প্রত্যাশাভরা হাসি হাসি মুখ, সযত্ন বেশবাস, সুচারু প্রসাধন। ভবনাথবাবুর সামনে বসে ঈষৎ আব্দারের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার লেখাটা পড়লেন?

জবাবে ভবনাথবাবু মুখ তুলে দুই-এক মুহূর্ত দেখলেন, তারপর পাশের রচনাগুলোর মধ্যে থেকে তাঁর লেখাটা বার করে দিয়ে বললেন, নিয়ে যান।

মহিলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।মনোনীত হল না বুঝি?

অন্য লেখা পড়তে পড়তে ভবনাথবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ, হল না।

শুকনো মুখে মহিলা আবেদন জানালেন-ত্রুটিগুলো যদি একটু বলে দিতেন

ভবনাথবাবু আবার মুখ তুললেন। খানিক নিরীক্ষণ করে জবাব দিলেন–সেটা বলা একটু শক্ত।

যে-রকম নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে বললেন কথা কটা, মহিলা হকচকিয়ে গিয়ে লেখাটি তুলে নিয়ে নীরবে প্রস্থান করে বাঁচলেন।

আমার বিশ্বাস লেখাটা ছাপা হবে বলেই ওখানে ছিল। মহিলা আবার তদবির করতে না এলে ওটা ছাপা হত।

এমন কি, অতটা সচেতন বেশবাস, সুচারু প্রসাধন না করে এলে, বা ও-রকম হাসিমুখে তার আবির্ভাব না ঘটলেও হয়ত ছাপা হত।

সভাপতিত্ব করতে ডেকে এনে এ-হেন লোককে অক্ষরজ্ঞানবর্জিত রমণীর কবিতা শোনানো বা কবিতা ছাপার সুপারিশের নামে গায়ে জ্বর আসবে না তো কি?

গাঁয়ে নতুন পাঠাগার উদ্বোধন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ভবনাথবাবুর আগমন। কোথাও আসেন না বড়। শ্রীবিলাসবাবুর ধড়-পাকড়ে পড়ে আমি বিশেষভাবে আবেদন। জানাতে তবে রাজী হয়েছেন। পাঁচখানা গ্রামের উদ্যোক্তারা অনেক জল্পনা-পরিকল্পনার। পরে এই সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করতে চলেছে। সমস্ত এলাকায় আর দ্বিতীয় লাইব্রেরি নেই। এর জন্যে ঘরে ঘরে চাদা তোলা হয়েছে, একজন জমি দিয়েছেন, আর পাঁচজন অবস্থাপন্ন ভদ্রলোক মিলে ঘর তুলে দিয়েছেন। বেশ কিছু টাকার বইও কেনা হয়েছে। এতবড় ব্যাপারটা অনুষ্ঠানশূন্যভাবে শুরু করতে কারো মন ওঠে না। গ্রামবাসীদের এত উৎসাহের কথা শুনেই ভবনাথবাবু শেষপর্যন্ত আসতে আপত্তি করেন নি।

শ্রীবিলাসবাবু গায়ের ওই উদ্যোক্তাদের একজন। অনেক মাথা ঘামিয়ে আমার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার যোগ আবিষ্কার করেছে সে। অবশ্য তার সঙ্গে জানাশুনা অনেক দিনের। কিন্তু সম্প্রতি তার আত্মীয়তা বজায় রাখার নিষ্ঠা দেখলে সম্পর্কটা দূরের কেউ বলবে না। গায়ে লাইব্রেরি করার উৎসাহ এবং উদ্দীপনার পিছনে তার ছোটখাটো রকমের একটু স্বার্থও আছে। ওই গায়ে তার বইয়ের দোকান। এতদিন শুধু ইস্কুল-বই বিক্রির ওপর নির্ভর করতে হত্ন। লাইব্রেরি হলে গল্প-উপন্যাস মাসিকপত্র। সাপ্তাহিকপত্রও তার মারফতই কেনা হবে জানা কথাই।

এখন প্রস্তাব শুনে আমার চক্ষুস্থির।

যথাসময়ে ট্রেন ধামুয়া স্টেশনে পৌঁছুলো। আরো জনাকতক লোক আমাদের নিতে এসেছে। সকলেরই ব্যস্তসমস্ত ভাব, সশ্রদ্ধ চাউনি। এদের সামনে শ্রীবিলাসবাবুকে দেখে মনে হল, সে যেন দিগ্বিজয় করে ফিরেছে।

প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরুবার সময় ভবনাথবাবুর উদ্দেশে মুখ কাচুমাচু করে বললাম –এখন আবার গরুর গাড়িতে উঠতে হবে শুনছি!

হৃষ্ট মুখে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন, এখানে তুমি ট্রাম-বাস পাবে ভেবে এসেছিলে নাকি! এককালে কত গরুর গাড়িতে চড়েছি।

কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ছেলেরা আর শ্রীবিলাসবাবু টেনে-টুনে ভবনাথবাবুকে গাড়িতে তুলল। মোটা শরীর ভরনাথবাবুর, এটুকু ধকলেই অল্প অল্প হাঁপ ধরেছে। –কিন্তু তাঁকে এত খুশী আর বোধহয় দেখি নি। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি চলেছে, দুদিকে ধানী-জমি, মাঠ, গাছ-গাছড়া, ঝোঁপঝাড়। ভবনাথবাবু আমাকে গাছপালা চেনাচ্ছেন, আর শহুরে মানুষ বলে টিকা-টিপ্পনী কাটছেন।

–ওগুলো কিসের ঝোঁপ বলো তো? বনতুলসী–নাম শুনেছ, না তাও শোন নি? আর ওগুলো? শহুরে সাহিত্যিক জানবে কি করে–ওগুলো আটিশ্বরী।–শেষে আকন্দের জঙ্গল চিনতে পারলুম না দেখে প্রায় রেগেই গেলেন তিনি, বললেন তোমাদের শহুরে সাহিত্যিকদের ধরে ধরে কিছুকালের জন্য বনবাসের মতো গ্রামবাসে পাঠানো উচিত।

মোটকথা আমাকে জব্দ করতে করতে বেশ আনন্দের মধ্যেই তিনি গন্তব্যস্থানে এসে পৌঁছলেন। আমিও হাসছিলাম বটে কিন্তু বিকেলের কথা ভেবে শঙ্কার ছায়াটাকে মন থেকে সরানো যাচ্ছিল না।

গ্রামবাসীদের সরল অনাড়ম্বর প্রীতি-অভ্যর্থনা মনে লেগে থাকার মতো। দুপুরে খানিক বিশ্রামের পর সভার কাজ শুরু হল। শীতকাল, অসুবিধে কিছু নেই। ভবনাথবাবু বক্তৃতা করলেন। তার সাদা-মাটা আন্তরিক বক্তৃতা শুনে এই সাধারণ লোকেরা ভারি খুশী।

অনুষ্ঠান শেষ হল।

আমাদের ফেরার গাড়ি সেই রাত আটটায়। তার ওপর শোনা গেল, তিন চার ক্রোশ দূরের কোনো এক ভদ্রলোকের দুটো সাইকেল-রিকশ সংগ্রহ করা গেছে-তাই ফেরার সময় গরুর গাড়ির মতো অত সময়ও লাগবে না। এখান থেকে সাতটায়– বেরুলেও আমরা হেসে-খেলে পৌঁছুবো।

অতএব আপাতত ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের অখণ্ড অবকাশ।

কিন্তু এ অবকাশ আমি চাই নি। ভবনাথবাবুর বক্তৃতার ফাঁকেও আমার দুচোখ নিজের অজ্ঞাতে অক্ষরজ্ঞান-শূন্য সেই কবি-মহিলাকে খুঁজেছে৷ কিন্তু ভবনাথবাবুর পাশে মঞ্চে বসে ঠিক ঠাওর করতে পারি নি।

সভা শেষে লাইব্রেরি-ঘরে এসে আবার বসলাম আমরা। শীতের বিকেল শেষ হতে না হতে সন্ধ্যে। শুধু শ্রীবিলাসবাবু নয়, অন্যান্য মাতব্বররাও সাগ্রহে কনকদেবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। মহিলার মুখে মুখে কবিতা বানানো তাদের কাছে মস্ত বিস্ময়! প্রশংসার ছলে সেই বিস্ময় জ্ঞাপন করল তারা, কবিতাগুলো একবার দেখার জন্য। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালো।

ভবনাথবাবু বললেন–বেশ তো নিয়ে আসুন না, মহিলাটিকেও আসতে বলুন, দুই-একটা কবিতা শোনা যাবে।

তক্ষুনি লোক ছুটল।

আমার অস্বস্তি বাড়ছে। কবিতা প্রসঙ্গে অত স্তুতির বদলে এরা যদি মহিলাটির বেদনাকরুণ জীবনের আখ্যানটুকু শোনাতো, তাতে বরং কাজ হত। স্বভাবকঠোর সম্পাদকের মনটা হয়ত বা নরম থাকত। কিন্তু এরা জনে জনে শুধু মহিলার আশ্চর্য ক্ষমতার কথাই পঞ্চমুখে বলে গেল।

দশ মিনিটের মধ্যেই কনকদেবী এলেন। না, এঁকে সভায় দেখি নি বটে। সাধারণ আটপৌরে বিধবার বেশবাস। তামাটে গায়ের রঙ, এককালে বেশ ফরসা ছিলেন মনে হয়। বয়স পঞ্চাশের ওধারে, চাপা উদ্দীপনায় মুখখানি ঈষৎ আরক্ত। হাতে একখানি কালো মোটা বাঁধানো খাতা।

ভবনাথবাবুর পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। তারপর খাতাখানা তার পায়ের কাছেই রাখলেন।

আমার মনে হল, আত্মজ সন্তানকে পরম নির্ভয়ে গুরুপায়ে সমর্পণ করে দিলেন।

-বসুন মা, বসুন। ভবনাথবাবু গম্ভীর। সভয়ে তার মুখে সম্পাদকের সেই চিরাচরিত গাম্ভীর্য দেখছি আমি।

তিনি খাতাটা তুলে নিলেন। একটি একটি করে পাতা উল্টে দেখে যেতে লাগলেন। সকলে উন্মুখ। তার একটি কথা, একটি মন্তব্যের ওপর যেন অনেক কিছু নির্ভর করছে।

অনেকক্ষণ ধরে দেখে তিনি একটিও কথা না বলে খাতাটা শুধু আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

সেটা নেবার ফাঁকে মহিলার দিকে চোখ পড়ল। মনে হল, দুই চোখে এমন অধীর প্রতীক্ষা, এমন নীরব প্রত্যাশা, আমি আর দেখি নি।

পাতাগুলো শুধু উল্টেই গেলাম, পড়া হল না। আঁকা-বাঁকা কঁচা ছাঁদের লেখা, খাতা বোঝাই কবিতা। কংসের অত্যাচার, দেবকীর মনোবেদনা, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, বেহুলার শোক, গান্ধারীর বিলাপ, সাবিত্রীর সঙ্কল্প, লব-কুশের বীরত্ব–এমনি অজস্র প্রসঙ্গে এক পাতা দু পাতা করে এক-একটা কবিতা।

মুখ তুলতেই ভবনাথবাবু আবার হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিয়ে নিলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন–আশ্চর্য!তারপর একটা পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি অক্ষর চেনেন না, অথচ কোন পাতায় কোন কবিতা আছে দেখলে বলে যেতে পারেন?

কনকদেবী যেন জীবনের সব থেকে বড় সংশয়টা উত্তীর্ণ হয়েছেন। অদ্ভুত কমনীয় দেখাচ্ছে মুখখানা। প্রত্যয়ভরা দুচোখ মেলে তাকালেন তাঁর দিকে, তারপর মাথা নাড়লেন।…পারেন।

–আচ্ছা, এই কবিতাটা বলুন তো শুনি।

ঈষৎ ঝুঁকে পাতাটা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলেন কনক দেবী। ভবনাথবাবু খাতাটা এগিয়ে দিলেন।

কিন্তু তার আগেই কবিতাটা হয়ত চেনা হয়ে গেছে। আবার যথাপূর্ব স্থির হয়ে মহিলা মাথা নুইয়ে বসে রইলেন একটু। সংকোচ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও হতে পারে। ঘরসুদ্ধ সকলে উৎকর্ণ। আমিও।

টানা সুরের আবৃত্তি কানে এল। মৃদু কণ্ঠ ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল:

প্রহ্লাদ কহে, আমার অন্তর্যামী যিনি
সর্বত্র বিরাজেন তিনি।
শূন্যে জলে স্থলে সমুদ্রে পর্বতে।
তিনি বিনা কিছু নাই নিখিলে ভবেতে।
তারে যদি চাহ পিতা অশ্রুজলে ভাসি
তোমারে দিবেন দেখা মৃদু মৃদু হাসি।
দর্পভরে চাহ যদি দেখিবারে তারে।
দর্পহারী রূপে তিনি আসিবেন দ্বারে।
ভক্তসখা রূপে যদি নাও তারে বরি
দেখিবে সম্মুখে তোমার দাঁড়ায়ে শ্রীহরি।

ভাষা ভাব ছন্দ মিলের কথা কিছু মনে হল না, অনুচ্চ রমণীকণ্ঠের একটুখানি মূর্ত আবেগ যেন কানে লেগে থাকল। ঘরের জোড়া জোড়া মুগ্ধ চোখ এবারে ভবনাথবাবুর মুখখানাকে হেঁকে ধরল। তাদের উক্তি যে একবর্ণও মিথ্যে নয়, তাই যেন প্রমাণ হয়ে গেল।

ভবনাথবাবুও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠলেন বোধহয়। কবিকে দেখলেন একটু। কনকদেবী অধোবদন।

ভবনাথবাবু বললেন–এই খাতায় নেই এ-রকম একটা কবিতা বলুন শুনি

অর্থাৎ, এইখানে বসে মুখে মুখে কবিতা বানানোর আশ্চর্য ক্ষমতাটুকুও যাচাই না করে নড়বেন না তিনি। কনকদেবী আবার মুখ তুললেন। আশায় আশ্বাসে তামাটে মুখখানা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। প্রথমবারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তার আস্থা বেড়েছে, আর এবারেও যে উত্তীর্ণ হবেন, তাতেও কোনো সংশয় নেই।

চোখ বুজে ভাবলেন খানিক। নিশ্চল মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ঘরের মধ্যে আবারও একটা স্তব্ধতা ভরাট হয়ে উঠেছে। যারা চেয়ে আছে কবির দিকে, দেখলে মনে হবে পরীক্ষা তাদেরই। বেশ একটু সময় নিয়ে কনকদেবী চোখ মেলে তাকালেন। তিনি প্রস্তুত।

আগের বারের মতোই একটা আবেগ ঘরের মধ্যে পুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। এবারের এই আবেগ জ্বালাভরা, বেদনাভরা, দরদভরা। একটা তীব্র অনুভূতি যেন কবির মুখে শিখা হয়ে জ্বলছে। তাই

..করজোড়ে নতশিরে অভিবারে সাজা।
মুনির সমুখে আসি দাঁড়াইল রাজা।
পুত্রশোকে মুনি কান্দে, কান্দে মুনিজায়া
কেমনে বাঁচিবে তারা–প্রাণ বিনা কায়া।
সহসা শোকানলে জ্বলি মুনি কহেন রাজারে
শব্দভেদী বান হানি শুধু হিংসা করিবারে
পানরত গজভ্রমে বধিলে সিন্ধুরে
রাঙাইলে সরযূর নীরে।
হারায়ে প্রাণের ধন।
এই প্রাণ মোর দিব বিসর্জন।
তোমা পরে রাজা এই অভিশাপ
তুমিও ত্যাজিবে দেহ লভি পুত্রশোক-তাপ।
অবাক বিষণ্ণ রাজা কাপে থর-থর।
নিঃসন্তানেরে একি অভিশাপ দিলা মুনিবর!
মুনি বরে অভিশাপ সত্য যদি হয়
সন্তান গেহে তবে আসিবে নিশ্চয়।

অনেকক্ষণ বাদে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন ভবনাথবাবু। সমাধি-ভঙ্গ হল যেন। কবিতা প্রসঙ্গে কোনোরকম আলোচনা করলেন না, ভালো-মন্দ একটি কথাও বললেন না। কিন্তু যে কথা বললেন, শুনে শুধু আমারই বিস্ময়ের শেষ নেই।

বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ভবনাথবাবু, তারপর বললেন–আপনার এই খাতাটা আমাকে দেবেন? আপনার তো এটা কোনো কাজে লাগবে না, আমি দেখি যদি কিছু করতে পারি।

এক ঝুড়ি প্রশংসার থেকেও এই কটা কথার মূল্য বেশি। ঘরের সবকটি লোকের মনে যেন এক নীরব খুশীর তরঙ্গ বয়ে গেল। তৃপ্তিতে কৃতজ্ঞতায় কনকদেবী একটি কথাও বলতে পারলেন না। ভবনাথবাবুর পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করে আস্তে আস্তে উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। কবিতার খাতা ভবনাথবাবুর হাতে।

.

যথাসময়ে আমরা আবার স্টেশনে পৌঁছলাম। শ্রীবিলাসবাব এবং আর একজন আমাদের। ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল। শ্রীবিলাসবাবু আনন্দে ডগমগ, ট্রেন ছাড়ার আগে আমার কানে কানে আর একবার বলল, খাতাটার কথা ওঁকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেবেন কিন্তু, আমি পরে খবর নেব।

গাড়ি ছাড়তে ভবনাথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন–শ্রীবিলাস কি বলে গেল?

–ওই খাতাটার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে বলল।

ইতিমধ্যে কবি বা কবিতা প্রসঙ্গে আর একটি কথাও হয় নি। এখনো কিছু না বলে ভবনাথবাবু বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারলুম না, ভেতরটা থেকে থেকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে।

সাদাসিধে ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম–খাতাটা চেয়ে নিয়ে এলেন কেন, সত্যিই কবিতা ছাপবেন নাকি?

ঈষৎ বিস্ময় মেশানো গাম্ভীর্যে আমার দিকে ফিরলেন তিনি।–এ কবিতা ছাপব কি করে?

-তাহলে নিয়ে এলেন কেন? ভদ্রমহিলা আশা করে থাকবেন, শ্রীবিলাসবাবুও তাগিদ দিতে ছাড়বে না।

নির্লিপ্ত মুখে ভবনাথবাবু জবাব দিলেন–কিছুদিন বাদে খাতাটা হারিয়ে যেতে দোষ কি?

আমি হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত।

এতকাল ভদ্রলোকের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। কিন্তু সামান্য চক্ষুলজ্জা বাঁচানোর জন্য তিনি এই কাণ্ড করে এলেন মনে হতে সব যেন এক মুহূর্তে যেতে বসল। নিজের অগোচরে প্রায় রূঢ়কণ্ঠেই বলে উঠলাম, ভদ্রমহিলার সব কথা জানলে এভাবে তাঁকে আপনি

থেমে গেলাম। কেন, বা কি দেখে থামলাম জানি না।

ভবনাথবাবু বললেন, আসার সময় শ্রীবিলাস তোমাকে বলছিল, শুনছিলাম

আবারও বিস্ময়। অর্থাৎ, আসার সময় ট্রেনে তিনি আদৌ ঘুমোন নি। কনকদেবীর বৃত্তান্ত সব শুনেছেন।

আমি বিমূঢ় মুখে অপেক্ষা করছি। ভবনাথবাবু বাইরের অন্ধকার দেখছেন। শেষে আমার নীরব প্রতীক্ষা অনুভব করেই যেন মুখ ফেরালেন। বললেন–শুনেছি বলেই খাতাটা নিলাম। না নিলে আজ হোক, কাল হোক, মেয়েটির এই কবিতার আশ্রয়টুকও যেত। আমার হাত দিয়ে খাতাটা খোয়া গেছে শুনলে ভয়ানক দুঃখ পাবে, পাঁচজনের কাছে দুঃখের কথা বলবে, মনে মনে হয়ত আমাকে ঠিক বিশ্বাসও করবে না। …তবু তাতে সান্ত্বনা থাকবে, নিজের কাছে তার কবিতার দাম কমবে না। বরং বাড়বে। আবার নতুন খাতা হবে। আশ্ৰয়টা হয়ত আরো পাকাঁপোক্ত হবে।

ট্রেন ছুটছে।

দূরে দূরে এক-একটা ল্যাম্পপোস্টের আর কুঁড়েঘরের আলো চোখে পড়ছে। অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে ওগুলোও যেন এক অজ্ঞাত অখ্যাত কবি-রমণীর মুখের মতো। আঁধারে মেশে না।

ভবনাথবাবু জানলায় ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন। সৌম্য, গম্ভীর। থেকে থেকে আমি তাকেও দেখছি। মনে হচ্ছে, এত কাছ থেকে আর বুঝি তাকে কোনোদিন দেখি নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress