সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 17
শুনলুম বেশ ঘটাপটা করেই বিয়ে হয়ে গেছে শ্ৰীমতী দীপার। তিনি কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। শ্রীমান আঞ্জনেয়র সঙ্গে ওয়াশিংটন উড়ে চলে যাবেন। ভিসা পেতে সামান্য দেরি। আমি যাইনি কেন বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি অফিসের কাজে ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলুম। কাজেই এড়িয়ে যাওয়ার অপবাদটা দিতে পারলেন না। উনি আজ এসেছেন রেজিগনেশন দিতে এবং সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে। সব বন্ধুদের এড়িয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এগুলো ইনি কীভাবে ম্যানেজ করেন জানি না। তেমন কিছু সাজগোজ করেননি। ঠিক আগেকার মতোই আছেন, খুব সরু একটু লাল সিঁথিতে, তাই দিয়ে যায় চেনা।
—হ্যাললো সমুদ্র, মাস দুই তিনের মধ্যে চলে যাচ্ছি। যাবার আগে জেনে যেতে চাই তুমি আমায় মাফ করেছ।
ওর সমস্ত চেহারার ভেতর থেকে কৃত্রিম স্মার্টনেস ঝরে গেছে। অথচ ও এখনও স্মার্ট। এটা যে ওর অভিনয় নয়, আন্তরিক কিছু সেটা আমি বুঝি। আমার মুখ দিয়ে সুভদ্র হাসি বেরিয়ে আসে।
—কী মুশকিল দীপা, মাফ করার কী হল? কিচ্ছু নেই। আমি এখন এক্কেবারে নিশ্চিত যে আমার সঙ্গে কোনও স্থায়ী সম্পর্ক না হওয়ায় তোমার তো ভাল হয়েইছে, আমারও ভাল হয়েছে। আবেগের মাথায় কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।
এত কথা আমি সাধারণত বলি না।
ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো একটু কেঁপে উঠল। খুব আবছা স্বরে বলল— আনন্দের মুহূর্তগুলোর কথাও কি মনে রাখবে না?
—দ্যাখো দীপা, কী মনে রাখব আর কী রাখব না, সেটা তো আমি ঠিক করি না, আমার জীবন, আমার স্বভাব ঠিক করে। আমি ওসব এক্কেবারে ভুলে গেছি। বিশ্বাস করো। প্রথমটা সামাজিক অভ্যাসে একটু রাগ হয়েছিল ঠিকই, খানিকটা অপমানবোধ। কিন্তু তুমি তো জানই আমার ইগো তেমন স্ট্রং নয়। তাই এখন কিছু নেই। সাফ সব। স্মৃতি আসে স্মৃতি যায়, মনটা একটা ফাঁকা স্লেটের মতো, স্মৃতি আঁচড় কাটে, ঘটনাস্রোত মুছে দেয়, আবার আঁচড় … আবার মুছে যাওয়া …
দীপা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। চোখ টলটল করছে। তারপর পেছন ফিরে চলে গেল।
এতগুলো কথা ওকে বললুম, একেবারেই না ভেবে-চিন্তে। কিন্তু সর্বৈব সত্য কথা। অনেক স্মৃতি কাঁটা হয়ে বেঁধে কিন্তু কোনও না কোনওদিন কাঁটা আপনি গলে যায়। এটাই সত্যি। তবে অন্যের ক্ষেত্রে যেভাবে হয়, আমার ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি শুরু ও শেষ হয় এই প্রক্রিয়া। দীপা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ বিরক্তি যেটুকুও বা ছিল, আমার মন সেটাকে শুষে নিল, বেলাভূমির বালি যেমন জল শুষে নিয়ে সূর্যের তলায় বিছিয়ে থাকে, সব আর্দ্রতা শুকিয়ে যাবে বলে।
কিন্তু ও কী চেয়েছিল? আমি ওকে মনে রাখি? মুম্বইয়ের রাত সারাজীবন প্রাণভোমরার মতো হৃৎ-কৌটোয় রেখে দিই? রেগে যাই, বিষণ্ণ হই, বিষাক্ত হই! আমি যেমন প্র্যাকটিক্যাল দীপাও তো তেমনি, কম ক্যালকুলেশন তো করেনি! সোজাসুজিই তো জানিয়ে দিয়েছিল আমি ওকে ভালবাসিনি ও বোঝে, এবং ও আমাকে ভালবাসে না সেটাও বোঝে। তা হলে? এ কী রকম ধর্ষকাম মেয়েটির মধ্যে? ও চায় ও আমেরিকার ভূস্বর্গে আঞ্জনেয়কে নিয়ে জীবন চূড়ান্ত আনন্দে বাঁচবে। আর সেই আনন্দের একটা উপকরণ হবে সমুদ্র নামে যুবকটির ওকে না পাওয়ার দুঃখ, মাঝে মাঝে ও দুঃখবিলাসে হঠাৎ সমুদ্রের জন্য কষ্ট পাবে, ইশ্শ সমুদ্র! আহা সমুদ্র! সমুদ্রকে যা দিয়েছি তা সে কোনওদিন ভুলতে পারবে না, মাঝে মাঝেই ছটফট করবে মনে ও শরীরে। আর সমুদ্র দেবকুমারের মতো পাগল হয়ে গেলে ওর আনন্দটা তুঙ্গে উঠবে। আহা কী আনন্দ আমি একটা যে-সে-নয় এমন যুবককে পাগল করে দিতে পেরেছি। আহা রে, ও এখন গোবরার পাগলা-গারদে থাকে, জানিস মেবল্, জানো কুর্চি, জানো তহমিনা। এসব তো আঞ্জনেয়কে বলবার নয়। তাই তোদের… তোমাদের না বললে মনটা হালকা হচ্ছিল না!
এইভাবে পরিষ্কার আমি পড়তে পারলুম দীপাকে। নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলুম। আমার মনে হল, জেঠুকে যে মেয়েটি ঠকিয়েছিল, সে তো আরও গভীর ভাবে ঠকিয়েছিল! একেবারে প্রেমে পৌঁছে গিয়েছিল। তাকে যদি খুঁজে বার করা যায়! এখন নিশ্চয় বুড়ি। মাথার চুল সব পাকা, যদি কলপ লাগিয়ে না থাকে, মোটা খসখসে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। গিন্নিবান্নি, খেয়ে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। হয়তো বুড়ো বরকে খ্যাঁকখ্যাঁক করে, উল্টে খ্যাঁকখ্যাঁকানি খায়। ছেলে মেয়েগুলো কথা শোনে না। বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে সব। এইভাবে ভেবে ভারী আনন্দ হল।
বাড়ি ফিরে ফিনকিকে সেদিন বললুম— একটা কাজ করতে পারবি?
—কী কাজ?
—জেঠুর সেই প্রেমিকার নাম-ধাম জোগাড় করতে পারবি? দেখিস যেন আবার জেঠুকেই জিজ্ঞেস করতে যাস না।
—পাগল? কিন্তু কেন?
—কর না।
—অদ্ভুত তো তুই! কোন কালের কথা তুই খুঁড়ছিস কেন?
—প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঠিক যে কারণে ঢিপি-ঢাপা খোঁড়ে!
—তারা খোঁড়ে অ্যাকাডেমিক কারণে, ইতিহাস জানবে বলে।
—আমিও তাই।
—তুই কি জেঠুকে নিয়ে রিসার্চ করছিস? গল্প লিখবি? জীবনী?
—হুঁ।
এই ধরনের উদ্যম আমি সত্যিই আগে কখনও অনুভব করিনি নিজের মধ্যে। কী যেন ভেতরে আসছে, ইচ্ছা, উদ্যোগ, সিদ্ধান্ত। এ সবই নতুন, একেবারে নতুন।
জেঠুর কাছে বসি, ঘনিষ্ঠ আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলি। খুব সাবধানে অবশ্য। পরে নিজের ঘরে এসে নোট করি।
দেবকুমার সেন— এখন বয়স সাতান্ন। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ আগে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, একটি সহপাঠিনীর সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল। মেয়েটি অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে যায়। দেবকুমার ফিজিক্স ও অঙ্কে অসাধারণ মেধাবী ছিলেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ পান। বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই তাঁর চাকরি যায়। বছর চারেক বাড়িতেই হোমিওপ্যাথি ও কবিরাজি চিকিৎসা হয়, তারপর তাঁকে দীর্ঘ বিশ বছর অ্যাসাইলামে রেখে চিকিৎসায় তাঁর পিতার খরচ হয় প্রতি মাসে গড় 6000, অর্থাৎ 6000x12x20 = 14,40000, এ বাদেও আরও কিছু অতিরিক্ত ধরলে পনেরো লাখের ওপরে যায়। এই তথ্যগুলো আমি পাই দাদুর হিসেবের খাতা থেকে।
এতদিনে একটা করার মতো কাজ পেয়েছি যেন। এমন একটা গবেষণা যা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কাঠ, লোহা, সিমেন্ট কাঁকরের ড্রাফট নয়। আমার জীবনের প্রত্যেকটা ধাপ আমি সহজে উতরেছি, প্রত্যেকটা কাজ সহজে করেছি, বোধহয় সেই জন্যেই কোনও উত্তেজনা ছিল না সেগুলোতে। সবই যেন আমার ছায়া, একটা ছায়ামানুষ আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সব করে দিচ্ছে। খুব নিশ্চিন্ত, নির্লিপ্ত হয়ে থেকেছি। প্রথম উত্তেজনা, প্রথম ধাক্কা, প্রথম অসাফল্য দীপা। দীপাকে মনে না রাখলেও, দীপার দেওয়া উন্মাদনা জুড়িয়ে জল হয়ে গেলেও ওটা একটা বিসদৃশ ঘটনা, আমার জীবনে।
ফিনকির প্রতিভা কিন্তু অসামান্য। ঠিক বার করে ফেলল। মেয়েটি, উঁহু মহিলার নাম সৃষ্টি। সহপাঠিনী নয়, জেঠুর দু বছরের জুনিয়র ছিলেন। জেঠুর কাছে পড়ে, জেঠুর নোটস্, বই নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। তারপর জেঠুরই সহপাঠী, তেমন ব্রিলিয়ান্ট নয়, কিন্তু ধনীঘরের ছেলেকে বিয়ে করে পগারপার হয়ে যান। একেবারে ইংল্যান্ড।
‘সৃষ্টি’ নামটা খাতায় লিখে আমি বসে থাকি। এরকম ধরনের সৃষ্টিছাড়া নাম সে সময়ে হত? তখন তো নমিতা, সবিতা, মিনতি, বড়জোর শ্রীলা, মধুশ্রী এই সবের কাল। ভদ্রমহিলা ইংল্যান্ডে। তা হলে তাঁকে ধরবই বা কী করে? বাড়িটা হাজরা রোডের এক ঠিকানায়।
—কী করে এসব জোগাড় করলি? ফিনকিকে জিজ্ঞেস করি।
—বলব কেন? তুই বলেছিস নিয়ে কী করবি?
—ধর যদি ওঁর বাড়ি যাই, কৈফিয়ত দাবি করি?
—দুই যুগ পরে কৈফিয়ত? কৈফিয়ত নিতে যাচ্ছিস আবার তুই? জেঠুর ভাইপো? এসব তোর মাথায় এল কী করে?
—জেঠুর জীবনের এতগুলো বছর অকথ্য দুর্গতিতে কেটেছে, আর জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। যে কোনও জীবন নয়, একজন খুব উজ্জ্বল মানুষের, প্রচুর সম্ভাবনা ছিল যাঁর। এবং পনেরো লাখের ওপর টাকা দাদু ও বাবার খরচ হয়ে গেছে তাঁকে সারাতে।
তখন ফিনকি কতকগুলো অদ্ভুত কথা বলল।
—জেঠুর জীবনের সঙ্গে তুলনা করছি না, ছোড়দা, কিন্তু মায়ের সম্ভাবনার যে অপমৃত্যুগুলো হল, গায়িকা হিসেবে, স্কলার হিসেবে তার কৈফিয়ত তুই কার কাছে চাইবি? ধর মা যদি গান গাইত রেডিয়োতে। সিনেমাতে, জলসাতে, মা যদি প্রোফেসর হত, হতে হতে এখন যদি প্রিন্সিপ্যাল-ট্যাল হয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরই হয়ে যেত, তা হলে ইভন ইন টার্মস অব মানি, মা কতটা লুজ করল হিসেব কর। মায়েরও যেটা হয়েছে সেটা দুর্গতিই। তুই একটা সিভিল এঞ্জিনিয়ার, তোকে যদি কোনও বাড়ির চাকরের কাজে রেখে দেওয়া হয়, তোর কী হবে? কেমন দুর্গতি? ভেতরে হেমারেজ হয় ছোড়দা, সমস্ত মনে ছড়িয়ে যায়, তারপর মনটা সাড় হয়ে যায়।
আমি ওর কথার জবাব দিতে পারি না। দুটো দুর্গতি দুদিকে দাঁড়িয়ে তাদের বিকৃত প্রস্তরীভূত মুখ আমাকে দেখায়। দাদামশাই দিদিমা আর বেঁচে নেই, দাদু-ঠাকুমাও আর বেঁচে নেই। বাবা আছেন। ওঁকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলে হাঁ করে থাকবেন। বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারবেন না। তারপরে হবে একটা অপ্রীতিকর প্রতিক্রিয়া, উনি চেঁচাবেন, গর্জন করবেন, তখন মা ওপরে উঠে আসবেন, হাতে ডালের কাঠি, বলবেন—কী হচ্ছে এখানে? সমু, ফিনকি? যাও, তোমরা এখান থেকে যাও। আমরা চলে যাব, বাবা চাপা গর্জন করে চলবেন। মা ডালের কাঠি নিয়ে নীচে নেমে যাবেন। জিজ্ঞেসও করবেন না কী হয়েছে? কেনই বা আমরা বাবার ঘরে। কেনই বা তিনি গর্জন করছেন। কৌতূহলশূন্য পাথর-প্রতিমা নীচে নেমে গিয়ে আবার ডালে কাঠি দেবেন, সাঁতলাবেন। ডালে নুন কম, ভাত শক্ত, ঝোলে নুন বেশি, মাছ বড্ড বেশি ভাজা। উচ্ছে সেদ্ধ হয়নি।
ফিনকি বলল—আর ধর যারা উজ্জ্বল নয়, সাধারণ, চেষ্টা করে যাচ্ছে, চেষ্টা করে যাচ্ছে যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়ে কোথাও পৌঁছতে। তাদের কারও বা অনেকের জীবন যদি অন্য মানুষদের লোভের জন্য হৃদয়হীনতার জন্য সুবিধেবাদের জন্যে বরবাদ হয়ে যায়। তাতে তোর কিছু বলবার নেই? সে কৈফিয়ত তুই কার কাছে চাইবি? মাফিয়ার কাছে না রাজনীতির কাছে না ভণ্ড সমাজসেবকের কাছে, কার কাছে?
আমার ছায়া দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও বক্তব্য নেই তার। এখন ফিনকি আমাকে এমন কয়েকটা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যার উত্তর আমি জানি না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
—ছোড়দা তুই কোন জগতে থাকিস জানি না, কিন্তু জীবন তো এরকমই! কে যে সুযোগ পাবে কে যে পাবে না, তুই জানিস না। সম্ভাবনাময় মানুষ ব্যর্থ হল, যার কোনও গুণ নেই সে দিব্যি হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে গেল এরকমই তো হয়।
এবার আমি স্বর খুঁজে পাই।
—এগুলো সবই ভাববার জিনিস ফিনকি, কিন্তু এটা তো স্বীকার করবি যেটা আমাদের ব্যক্তিগত ভাবে গায়ে লাগে সেটার কথাই আমরা বেশি অনুভব করি, ভাবি, প্রতিকারের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠি।
—তার মানে জেঠু তোর ব্যক্তিগত, জেঠুর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার হয়ে তুই তুলকালাম লাগিয়ে দিচ্ছিস। মানে জেঠুর সঙ্গে তুই আইডেনটিফাই করছিস। কেন রে? তোরও এ রকম কিছু হয়েছে, না? ও, আমাকে তো আবার বলবি না। আমার সঙ্গে আইডেনটিফাই করতে পারিস না। আমি অবশ্য এ-ও বুঝি এর পেছনে কে।
ফিনকি বলে যায় আর আমি হতবাক হয়ে বসে থাকি।
কী করে ও এত বুঝল?
তা হলে দেখা যাচ্ছে আমি এতই আত্মকেন্দ্রিক নিজের স্বার্থে লাগলেই আমি টলে যাই। আমার নির্লিপ্ততা সুতরাং একটা রূপকথা। এবং মোটের ওপর আমি অন্যদের সম্পর্কে অনুভূতিহীন। দ্বিতীয়টা আমি আন্দাজ করেছিলুম, কিন্তু আমার নির্লিপ্ততার গায়ে এমন একটা দুর্বল জায়গা আছে আমি জানতুম না। আমি কি লজ্জা পাব? আমার কি সঙ্কুচিত হওয়া উচিত? মুখ নিচু, যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাচ্ছে কাপুরুষ— এই জাতীয় কিছু?
ফিনকি বলল— যারা নিজেদের খুব বীরপুরুষ ভাবে তারা কোথাও হেরে গেছে স্বীকার করতে চায় না। এটাই তোর ইগো ছোড়দা, আর তোর ইগোয় লেগেছে অর্থাৎ জিনিসটা আছে এটা একটা ভাল লক্ষণ। দীপা, না রে?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ দিই। ফিনকির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
—ঠিক কীভাবে কতটা সিরিয়াসলি ও তোকে ঠকাল, জানতে চাইছি না, তোর বোধহয় অসুবিধে আছে। কিন্তু ছোড়দা আমার ধারণা এটা তোর দরকার ছিল। তুই কি এখনও দীপাকে ভালবাসিস?
—ওকে আমি কখনও ভালবাসিনি। ও-ই…
—ও তোকে বুঝিয়েছে ও তোকে ভালবাসে, তুই বিশ্বাস করেছিস, ও চলে গেছে। এই তো!
—কতকটা!
—তা হলে তোর জ্বালাটা, আবারও বলছি, অপমানের জ্বালা।
এবার আমি মুখ তুলি,—আমার কোনও জ্বালা নেই ফিনকি। বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার। আমি আর নিজের মনস্তত্ত্ব কী করে বুঝব বল। বরং মনে হয়েছে— ভাগ্যিস! খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। কিন্তু জেঠুর ব্যাপারে আমার ধারণা বা দায়িত্বও বলতে পারিস—একটু অন্যরকম। উনি বহু বছর উন্মাদ ছিলেন। এটা আমি ভুলতে পারছি না।
একমুখ হেসে ফিনকি বলল— যা, তা হলে ভদ্রমহিলার ঠিকানাটা জোগাড় কর, বেশ করে গালাগাল দিয়ে একটা চিঠি লিখে দে।
—গালাগাল দিতে তো আমি পারি না জানিস। ওটা আমার সিসটেমে নেই। আমি যাব হাজরার ওই বাড়িতে, আর তোকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।
—যাক বাবা, অ্যাদ্দিনে পাত্তা দিলি। আমি সাবালক এটা তোর কাছে প্রমাণ করার জন্যে লাগাতার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঠিক আছে, গালাগাল যদি না দিস তোর সঙ্গে যেতে রাজি আছি। এখন এই নে তোর নামে দাদার একটা চিঠি এসেছে। পরে বলিস কী লিখেছে…
আমার নামাঙ্কিত একটা খাম ফিনকি আমার হাতে তুলে দেয়। খামটা আমি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে থাকি। ফিনকি চলে যায়।
রাত আটটা মতো হবে। আমাদের রাতের খাওয়ার সময় নটা থেকে সাড়ে নটা। কিছুদিন আগেও বাবার সঙ্গে খেতে পছন্দ করতুম না। এখনও যে খুব করি তা নয়। কিন্তু মায়ের সুবিধে হবে বলে, আর আমি থাকলে বাবা বিশেষ গোলমাল করেন না বলে আমি একসঙ্গেই বসি।
কী লিখেছে দাদা? বিজয়ার সময়ে একটা করে পোস্টকার্ড আসে জানি। কিন্তু তার চেয়ে বেশি সম্পর্ক তো রাখে না দাদা! আমরা মানে আমিও রাখি না, মা-ও রাখবেন না, ধরে নিতে পারি। বাকি রইলেন বাবা আর ফিনকি। এঁদের কথা এঁরা না বললে আমি বলতে পারব না। চিঠিটা অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করি। তারপর সাবধানে কাগজ কাটার ছুরি দিয়ে কাটি এক দিকটা। ভেতর থেকে বেরোয় একটা ব্যাংক ড্রাফট। পঞ্চাশ হাজার টাকার। সঙ্গে চিঠি।
সমু,
এতদিন পরে আমার চিঠি পেয়ে নিশ্চয় ভাববে কোনও স্বার্থে ডাকাডাকি করছি। ভাবতেই পার। কিন্তু তোমায় আমার বড্ড দরকার। তুমি একা-একা পরিবারের সব দায় বইছ ভেবে, বিশ্বাস করো আমার আত্মগ্লানি হয়। কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা। আমার স্ত্রী সমস্ত টাকাপয়সার হিসেব রাখে। এবং যেহেতু শ্বশুরের আন্ডারে কাজ করি, আমার মাইনেপত্র ডি.এ সমস্তই তিনি জানেন। আমার নিজস্ব রোজগারের ওপর কেন যে এঁরা এত গোয়েন্দাগিরি করেন, সেটা দেখে আশ্চর্য লাগে। এঁরা কিন্তু আদারওয়াইজ লোক খারাপ নন। শুধু ওই নিজের বাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তার ও আর্থিক সম্পর্ক রাখি এটা একেবারে চান না। কেন সেটা এখন রহস্য আর নয় আমার কাছে। আসলে সোনুর প্রথম বিয়েটা কেঁচে যাওয়ার মূলে ওর শ্বশুরবাড়ির বেশ হাত ছিল। অন্তত ওঁরা তাই মনে করেন। একমাত্র মেয়ে এবং যথেষ্ট সম্পত্তি থাকায় ওঁরা একটু সন্দেহ বাতিকগ্রস্তও হয়ে পড়েছেন। আমাকে খুব ভাল করে, স্টাডি করে, নিরাপদ মনে করেছেন বলেই এগিয়েছেন। তুমি জেনে শকড হবে আমার কোনও সন্তান হবে না এমন শর্তও ওঁরা করে নিয়েছেন, পাছে ওঁদের নাতির কোনও অযত্ন হয়, বা তার উত্তরাধিকারে কিছু কম পড়ে। তুমি বলতে পার—এভাবে দাসখত আমি লিখে দিলুম কেন। তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি সমু, আমি চিরকাল ভীষণ ইনসিকিওর ফিল করেছি। বাবা-মা, এঁরা যেন আমার কেউ না, আমি একটা সমুদ্রে ভাসা কাঠের টুকরোর মতো ওই সংসারে পড়ে রয়েছি। তুমি ছাড়া কারও সঙ্গে আমার কোনও বন্ড ছিল না। এখানে আমি সেই আত্মীয়তা, যত্ন, এরা বলে ‘আপনাপন’ পেয়েছিলুম। তার ভেতরে ওঁদের কিছু স্বার্থের অঙ্ক অবশ্যই ছিল। কিন্তু খুব একটা ফাঁকি ছিল না। এখন মুশকিল হচ্ছে সোনুর ছেলে বলবীর এই ক’বছরে বেড়ে চোদ্দো বছরের হয়েছে। ছেলেটি আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয় না। পুত্রস্নেহ ও নাতিস্নেহে অন্ধ এঁরা সেটা দেখেও দেখেন না। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, ইউ.এস.এ-র কয়েকটা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে চিঠিপত্র চলছিল। হয় বার্কলি, নয় কেম্ব্রিজে পাচ্ছি। আরও একটু বেশি ডলারের জন্য বারগেন করছি। যারা রাজি হবে, তাদের ওখানেই যাব। এখানে কেউ সেটা জানে না। আমি ন্যাচার্যালি এক্সপেক্ট করব আমার স্ত্রীও আমার সঙ্গে যাবে। বলবীর যেহেতু তার দাদু-দিদিমার খুব প্রিয় এবং দিল্লি পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করছে ও অনায়াসেই এখানে থেকে যেতে পারে। আমি বলব ওঁর পড়াশোনাটা ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া, ওর ডিফেন্সে যাবারও খুব ইচ্ছে। সেক্ষেত্রে ওর ইউ.এস.এ আসবার দরকারই হচ্ছে না। এইভাবে আমি ও দেশে আমার একটা আলাদা জীবন গড়ে তুলতে পারব। আমার নিজের সন্তান হবে, সোনুকেও কিছুটা বোঝাতে পারব। ইতিমধ্যে এই ড্রাফটা রাখো, কীভাবে কার থিসিস লিখে দিয়ে এটা রোজগার করেছি, সে এক গল্প। ফিনকিকে বলো আমি ওকে ভুলিনি, ওর প্রত্যেকটা চিঠি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মা বাবা এবং আর সবাইকে প্রণাম দিচ্ছি। তুমি আমাকে মর্যাল কারেজ দাও সমু, আমার কোনও বন্ধু নেই যার কাছে পরামর্শ নিতে পারি। তোমাকে আমি ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টাল ফোন নম্বরটা দিচ্ছি। মঙ্গলবার বাদ দিয়ে যে কোনও দিন ফোন করো। প্লিজ।
—সাগর
‘দাদা’ লেখেনি। ‘সাগর’, শুধু ‘সাগর’। দাদার সঙ্গে আমার যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল, বাইরে থেকে বোঝা যেত না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছিল সেটা আমি জানতুম। কিন্তু দাদা বিয়ে করে দিল্লি প্রবাসী হবার পর তাতে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে গিয়েছিল বলেই জানতুম। বিশেষ করে দাদুর শ্রাদ্ধের সময়ে এসে দাদা যে ব্যবহার করেছিল, সমস্তটাই দাদাকে আমার জীবন থেকে বার করে দিয়েছিল। আমার কোনও অভাববোধ ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যেত, কে যেন বলে উঠত— আমার ভীষণ ভয় করছে। সমু! সমু! কার পায়ের শব্দ দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে টের পেতুম। কোনও কষ্টবোধ নেই, খালি শুনতে পাওয়া। দাদা খুব ভিতু লোক ছিল। ভিতুরাই বোধহয় স্বার্থপর হয়। তবে একটা কথা মনে হওয়ায় আমার খুব হাসি পেল। সব প্রডিগ্যালরাই গিয়ে আমেরিকায় জড়ো হচ্ছে। এক নম্বর নবকুমার, দু’নম্বর দীপা, তিন নম্বর দাদা— সাগর। আত্মগোপন করার ভারী চমৎকার জায়গা মহাদেশটি। পলাতকদের মহাদেশ। পলাতকদের শেষ আশ্রয়।
তুই নিয়মিত লিখিস দাদাকে? ফিনকিকে চিঠিটা দিয়ে জিজ্ঞেস করি। কাঁচুমাচু মুখে মেয়েটা বলে—নিয়মিত মানে কিছু ঘটলে, ধর ছোড়দিদা মারা গেলেন, ধর আমি এইচ.এস, বি.এ, এম.এ পাশ করলুম। রিসার্চে ঢুকলুম। এই রকম। জেঠু এলেন…এখন কোচিং করছেন, খুব চমৎকার মানুষ—এটাও লিখেছি।
—দাদা উত্তর দিত?
—সবগুলো না হোক, কতকগুলো দিত। বেশি নয়, দু-চার লাইন। কিন্তু… আমার দাদার জন্যে বড় মন কেমন করে রে! রাগ করিস না!
—রাগ করব কেন? আশ্চর্য তো!
—না। মা-বাবা কেউ তো নাম করে না দাদার। তুইও তো করিস না…
—নাম না করা মানেই তাকে মনে না করা তো নয়!
—তুই মনে করিস?
—স্বজ্ঞানে না করলেও স্বপ্নে যখন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে তখন বোধহয় করি।
—লক্ষণ ভাল।
এই ধরনের কথা ফিনকি আমাকে প্রায়ই বলছে আজকাল। লক্ষণ ভাল, দিস ইজ গুড। আবার… তোর ঘরের ছিটকিনি তুই সব সময়ে লাগিয়ে রাখিস… মনের কথা কাউকে বলিস না… তুই বড্ড একা— এত একা হওয়া ভাল না।
আমি যেন একটা রহস্য গল্প। ফিনকি আমাকে আস্তে আস্তে পড়ছে। যেমন যেমন বুঝছে সাজিয়ে যাচ্ছে তথ্যগুলো। কম্পিউটারে ভরে দিচ্ছে যাতে ওর চেয়েও উন্নত নির্ভুল মস্তিষ্ক আমাকে আপাদমস্তক পড়ে ফেলতে পারে। আমি অপেক্ষা করে আছি কবে সেই নির্ভুল পাঠ ডাউনলোড করবে ফিনকি। আমিও নড়বার সুযোগ পাবো।
দাদাকে ফোনে কিন্তু আমি দু’তিন দিনের চেষ্টাতেও পেলুম না। দুটো তিনটে অর্থাৎ সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে ছাড়া করার উপায় নেই। পাই-ই না। খালি বলে—‘দিস লাইন ইজ বিজি, প্লিজ ট্রাই আফটার সাম-টাইম।’ ট্রাই করতে করতে আমার ধৈর্য চলে যায়, তারপর কাজকর্মের ফেরে ভুলেই যাই। তেমন কিছু দরকার যদি থাকে তা হলে দাদা নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। আবার ভুল না বোঝে, তাই ফিনকিকে বলে দিই। দাদাকে দু লাইন লিখে দিতে।
আসলে এখন আমার নিশ্বাস ফেলবার ফুরসত নেই। আমাদের অফিস কমপিউটারাইজড হচ্ছে। সেই নিয়ে প্রচুর কর্মী-আন্দোলন, কোর্ট কেস, কলিগদের মধ্যেও বাগ্-বিতণ্ডা হয়েই চলল। ইতিমধ্যে অফিস আমাকে ব্যাঙ্গালোর পাঠিয়ে দিল। কমপিউটারের সমস্ত খুঁটিনাটি শিখে নিতে। এটা একটা নতুন যান্ত্রিকতা। প্রথমটা বেশ আগ্রহ হয়। ফিরে এসে আমার কাজ হল অফিসের কর্মীদের কমপিউটার শেখানো। ক্রমে বেশি দায়িত্ব পাচ্ছি। জয়ন্তী একদিন এসে অভিনন্দন জানাল। কী ব্যাপার? না আমার এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার পদে প্রোমোশন হচ্ছে।
পুরুষ কলিগরা দেখা হলে শুধু করমর্দন করে সংক্ষিপ্ত কংগ্র্যাটস বলে চলে গেল। কিন্তু জয়ন্তী মুখে বলে গেল ঘরে এসে, আর মুকুলিকা এমন উজ্জ্বল হেসে আমার দিকে তাকাল যে অভিনন্দনটা আর মুখ ফুটে জানাবার দরকার হল না। সন্দেহ নেই, মেয়ে দুটি আমাকে প্রতিযোগী ভাবে না।
—লগনচাঁদা ছেলে সমুদ্র তুমি—কে যেন বলল একদিন। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছ। নো ফ্রিকশন।
জয়ন্তী অমনি তড়বড় করে বলল—বাঃ ওর বুঝি কোনও ক্রেডিট নেই? সবই চাঁদের কৃপায় হয়ে গেল?
বিজিত চোখ নাচিয়ে বলল—দেখো, নিজেরাই দেখো কেমন চাঁদ কপালে!
জয়ন্তী বিরক্ত হয়ে বলল— পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেল একসঙ্গে কাজ করছি। এখনও ভুলতে পারলে না আমরা মেয়ে, না? আশ্চর্য!
অনিন্দ্য চেঁচিয়ে বলল— ভুললে খুশি হবে? অন গড বলো দেখি।
জয়ন্তী পেছন ফিরে বলল—ডিসগাস্টিং।
কাজে ডুবে থাকি। মাঝে মাঝেই টুর, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর। কোনও কোনও সময়ে ওদের কেউ সুমিত টুমিত সঙ্গী হয়। জয়ন্তী বা মুকুলিকা থাকলে আমি এমন ভাবে আমার অক্ষমতা জানাই… বসের সাধ্য নেই বোঝে আমার আপত্তির আসল কারণ। অনর্থক জটিলতার মধ্যে যেতে চাই না। এভাবেই আমি ভাল থাকি। আমার ঘরের মধ্যে আরেকটা ঘর। সেটা প্রতিধ্বনিতে ভরা, কত মানুষ বেঁচে গেছে এই জমিটুকুতে। হয়তো কোন যুগে এখানে রাজপ্রাসাদ ছিল। এখানেই ঘটেছে কত গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র। হয়তো ছিল বৈরাগীর কুঁড়ে, ভজনগানে ভরে থাকত বাতাস। দুর্ধর্ষ খুনি ডাকাতদের আস্তানা থেকে থাকাও অসম্ভব নয়। যেখানে আমার খাট সেখানে ছিল ডাকাতে কালীর ভয়াল মূর্তি হয়তো। এত চরমেই বা যাব কেন? কত নাম-না-জানা সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ। রেখে গেছে তাদের জীবধারণের শব্দ-গন্ধ এইখানে। যা এখন আমার ঘর। এই অর্থহীন পরিণামহীন চলমানতাকে মেনে নিতে হয়। মেনে নিই।
একেক সময় রাস্তার পাশে কোনও আধখোলা ঝুপড়িতে দেখি দুটো ইটের মাঝখানে কাঠিকুটো জ্বেলে, কুচকুচে কালো হাঁড়িতে কেউ রান্না বসিয়েছে, কোলে ছেলে নিয়ে বা না নিয়ে এসে দাঁড়ায় ভিখারি মেয়ে। মুখে দুঃস্থতা, খিদে কী অদ্ভুত একটা ব্যাকুলতা দিয়েছে মুখকে। কিংবা বিশাল গাড়ি করে এসে থামলেন এম.জি ইনি খুব ভালবাসেন সাহেব সেজে থাকতে। চোস্ত স্যুট, টাই। মসমস করে চলে গেলেন নিজের কামরার দিকে। যেন বেশ বড় কিছু একটা অধিকার করে রেখেছেন। পুরো জীবনটাই বোধহয়। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে জনতা যেই একটা বাস এসে থামল। যেতে হবে, কোথাও পৌঁছতে হবে। পৌঁছে কী হবে? একটু রাত হয়ে গেলেই বা কী ক্ষতি? কয়েকটি মেয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে কী একটা কথায় হাসতে হাসতে, হাসি চাপতে চাপতে চলে যাচ্ছে, মুখে হাত চাপা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে একজন, একজন হাসতে হাসতে পেছনের দিকে হেলে গেছে। আর দুজন দুজনকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে হাসছে। একেবারে নিমগ্ন কোনও তুচ্ছতায়। হাসির কারণটা জানলে হয়তো আর কারও হাসি পাবে না।
দেখতে দেখতে মনে হয় যদি খেতে না পেতুম, কিংবা যদি প্রচুর টাকা আরও টাকা, আরও বিলাস আরও বিলাসের অভ্যেস হয়ে যেত, যদি এমন দৌড়ে, ঝুলে ঝুলে বাস ট্রাম ট্রেনে যেতে হত, যদি এমন অকারণে আধাকারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসতে পারতুম, তা হলেই বোধহয় স্বাভাবিক হতুম। কেউ বলত না তুমি কেমন আনরিয়্যাল … তুমি বড় একা… তুমি কেমন আলগা-আলগা। তার বদলে আমি নিরবধি কালের পুনরাবৃত্তির চলচ্চিত্র চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে দেখতে পাই। এ সব নয় অন্য কিছু অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুর সন্ধানেও আমি তেমন উৎসুক নই। কারণ সন্ধানে সব ধরা দেয় না। এ সত্য আমি বুঝে গেছি।