Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu » Page 14

সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu

—গুড মর্নিং সমুদ্র!— জয়ন্তী। —গুড মর্নিং— আমি।

—হ্যাললো!— অনিন্দ্য।— হ্যালো— আমি।

—মর্নিং —মুকুলিকা। —মর্নিং —আমি।

—কেমন কাটল উইক-এন্ড? —ভাল— আমি।

—সার, এই ফাইলগুলো রাখুন। চিফকে নোট পাঠাতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পরে এলে হবে? —রাঘব কর। ড্রাফট্‌স্‌ম্যান।

—দীপা ম্যাডাম কোথায় সার? সাহেব ডাকছেন।

—জানি না।

দীপা আসেনি, আসে না।

জয়ন্তী মুকুলিকা দু’জনেই বলে— শনিবারের প্রোগ্রামটা ঠিক আছে তো?

—হ্যাঁ। ঠিক।

—দীপার অসুখ-বিসুখ করল কিনা…

—ফোন করো। করে দেখো।

—করেছি, ক্রমাগত এনগেজ্‌ড্‌ টোন আসছে। খারাপ আছে বোধহয়।

দীপার বিয়ে। অথচ দেখা যাচ্ছে এরা কেউই জানে না। অবশ্য দেরি আছে। দেড় মাসের মতো দেরি। আমার চিঠিটাই সবচেয়ে আগে গেছে। আমাকে নিশ্চিন্ত করতে বোধহয়।

তৃতীয় দিন রাতে ফোন আসে।

—প্লিজ সমুদ্র, স্যরি। আ অ্যাম স্যরি। কাল অফিসের পর কোথাও এসো, দরকার আছে।

—কেন?

—দরকার, প্লিজ।

—আমি জানি না কোথায় যেতে হয়।

—শরৎ বোস রোডে লেকের একেবারে উল্টো দিকে একটা রেস্তরাঁ আছে, নামটা বলছি, আসবে তো? আটটা সুবিধে হবে?—নামটা শুনে নিই। ফোন রেখে দিই। হ্যাঁ না কিচ্ছু বলি না।

সারাদিন কাজে যায়। রোদ্দুরে ঘুরি, ডেসকে কাজ করি, রিপোর্ট তৈরি করি। সারাক্ষণ কুয়াশা আমায় ঘিরে থাকে। দীপা আজ অফিসে এসেছে দেখেছি।

—কী হয়েছিল?— অনিন্দ্য।

—মাইগ্রেন!— দীপা।

অস্পষ্ট গুঞ্জন ভেসে আসে। আমার মাথার ভেতর মৌ ঘোরে। ভিন ভিন ভিন ভিন।

—প্লিজ সমুদ্র, আমার অফিসে ঢুকে নিচু গলায় বলে দীপা, আমি মাথা তুলি না। আটটায় কিন্তু, আটটায়, আমি একা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকব। একা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে… রাত আটটা… থাকব দাঁড়িয়ে… দাঁড়িয়ে থাকব কিন্তু… ঠিক….।

পুলকারের সঙ্গীরা বলল কী হল? ওঠো। সমুদ্র!

—আমার আর একটু কাজ বাকি আছে। তোমরা যাও। আমি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব এখন।

ওরা চলে গেলে আমি হাঁটতে হাঁটতে ময়দানে চলে আসি। শীত সন্ধ্যা জেঁকে বসছে। মশা বেশ। ধুলোয় ডিজেলের গন্ধ। চারদিকের ধুলোয় ময়লা গাছগুলো। একটা উঁচু টিলা হচ্ছে আস্তে আস্তে পাতাল রেলের খোঁড়া মাটিতে। ইতিমধ্যেই কিছু ছোট ছোট চারা গজিয়ে উঠেছে, বুনো ফুলও। অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে সব। শুধু গাড়ির আলোর রক্তচোখ, আর আকাশ থেকে ঝুপ ঝুপ করে ঝুলতে থাকা বাদুড় অন্ধকার। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। যাব, না যাব না। ট্যাক্সি নেব, না নেব না। ভাবতে ভাবতে দেখি হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। হাঁটছি। বাস নিই না। শেয়ার ট্যাক্সি না। একলা ট্যাক্সি এখন পাওয়াও খুব মুশকিল। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছি, কী হুড়োহুড়ি বাসের লাইনে। দেখছি একেকটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে যেন ভোজবাজিতে সব ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ উগরোচ্ছে, মানুষ খাচ্ছে। পা চালাই, পেরিয়ে যায় বিড়লা তারামণ্ডল, সেন্ট পলস্‌ ক্যাথিড্রাল, পেরিয়ে যাচ্ছে নেহরু চিলড্রেন্‌স্‌ মিউজিয়াম। এখানে বোধহয় বাচ্চাদের কিছু ক্লাস-ট্‌লাস হয়। বেরিয়ে আসছে অনেক। সঙ্গে তাদের মায়েরা। চলতে চলতে বুঝতে পারছি এই পথ আমি আগেও হেঁটেছি। ঠিক এমনি করে। অফিসের পর। বিধ্বস্ত। পাতাল রেলের মাটির পাহাড়টা তখন একটা উইঢিবি ছিল, তারামণ্ডল ছিল না। কিন্তু ক্যাথিড্রালটা বোধহয় ছিল, কিংবা কী জানি আমার ভুলও হতে পারে। এত উঁচু উঁচু-অট্টালিকা ছিল না তখন, আকাশ দেখা যেত, এত গন্ধ ছিল না ডিজেলের। কী জানি কী ছিল তখন যানবাহন। যা-ই থেকে থাক, আমার এই হেঁটে চলাটা সত্য। একেবারে ডুবে গিয়েছিলুম পড়া বইয়ের হলদে পাতায়। ঝুর ঝুর করে ভেঙে যাচ্ছে সব, অক্ষরগুলো পুরো বুঝতে পারছি না।

আমার ভেতরে কোথাও টং টং করে আটটা বাজল। কেউ গম্ভীর গলায় বলল— সময় হল। ভেসে উঠেছে ল্যান্সডাউন রোডের মোহনা, সাদার্ন অ্যাভিনিউ মিশবে। দীপা।

আমরা দু’জনে চিনে রেস্তরাঁয় ঢুকি। চিনে লণ্ঠনের মৃদু আলোর ঢুলুনিতে ড্রাগন ফুটে ওঠে দরজার মাথায়।

—তুমি কী ভীষণ ঘেমে গেছ সমুদ্র, কীসে এলে? এত ঘাম? মোছো।

এতক্ষণে বুঝতে পারি কম দেখছিলুম কেন। চোখের ওপর অবিরল ঘাম ঝরে পড়েছে। তাই। আমি বুঝতে পারিনি। সাদা রুমাল বার করে মুখ মুছি, ফিনকি আমার রুমালের তদারকি করে। ইস্ কালো হয়ে গেছে একেবারে! এত বালিও ছিল! মেনু-কার্ড নিয়ে এসেছে। হঠাৎ জেগে উঠি। দীপা কী খাবে জিজ্ঞেস করি না। অর্ডার দিয়ে দিই।

—সমুদ্র তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। খুব জরুরি কিছু। কথাগুলো তুমি কীভাবে নেবে জানি না। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে।

আমি ওর দিকে তাকাই।।

—এই বিয়েটা আমার অনেকদিন থেকেই ঠিক ছিল। দাদার বন্ধু। দু’জনেই দু’জনকে মানে অ্যারেঞ্জড নয়… জাস্ট সব মিলে গিয়েছিল। ও এখন ওয়াশিংটনে। জর্জ টাউনে। অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর— মাইক্রোবায়োলজি।

আমি উঠে পড়ি। ওর চোখে ভয়। আমি বলি— মুখ হাত ভাল করে ধুয়ে আসি, চটচটে করছে সব। —টয়লেটে যাই। এতক্ষণের জমা জল নামাই, মুখ হাত দুই-ই তরল সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলি। এখন একটু তাজা লাগছে।

এসে বসি। খাওয়া শুরু করি। ও-ও এক চামচ খায়। আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

—কারও গুণের ফিরিস্তি শোনবার জন্যে আজ আসিনি কিন্তু — বলি।

—না, সত্যিই, ওটা আমার বলার আসল কথা ছিল না।

—যেটা বলার ছিল বলো, অপেক্ষা করছি।

—আমি… আমি তোমাকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ছিলুম সমুদ্র। তুমি জানো না, তোমার একটা সাংঘাতিক ম্যাগনেটিজম আছে, মুখ নিচু করল। তুলে বলল,

—অ্যাপিল যাকে বলে। অ্যাকচুয়ালি বি.ই.-তে আমরা সবাই তোমায়… চাইতুম। দীপার মুখটা ঝলসে উঠল— এখানেও জয়ন্তী, মুকুল সবাই তোমায়…।

—বাজি ধরেছিলে নাকি?

—বিদ্রূপ কোরো না, পতঙ্গ যেমন আগুনের টানে… কিন্তু সমুদ্র তুমি মনে কোরো না যা বলেছিলুম তা উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছিলুম, মনে করো না আমার কোনও অভিসন্ধি ছিল। তুমি যখন এলে আমি জাস্ট— জাস্ট নিজেকে সামলাতে পারিনি। যা দিয়েছি আনন্দে দিয়েছি, আনন্দ পেয়েছি। পেয়েছি মানে কি? ইট ওয়জ অ্যান এক্সপ্লোশন। এক্সপ্লোশন অ্যান্ড এক্সট্যাসি।

—তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান…

—কিন্তু তুমি আমাকে ভালবাসনি, সমুদ্র আমার ব্যঙ্গ অগ্রাহ্য করে বলল ও।

—সেটা কী করে বোঝা যায়?

—কীভাবে বলি.. তুমি… তুমি অদ্ভুত আনরিয়্যাল… আমাদের মতো জীবন্ত নও। অন্যদের মতো রাগ, লোভ, আসক্তি, ইগো কিচ্ছু নেই তোমার মধ্যে।

—মড়া না মহামানব?

—আমি বোঝাতে পারছি না। তুমি কারও সঙ্গে সেভাবে চিরদিন বাঁচতে পারবে কি না… আমার সন্দেহ আছে। অন্তত আমি সে নই। আমি খুব স্ট্রং, তা দেখতেই পাচ্ছ, আমি প্রচণ্ড ভাবে বাঁচতে চাই। সমুদ্র তুমি তখন ঝলসে উঠেছিলে। কিন্তু অন্য সময়ে ঠান্ডা, ভীষণ… মনে আছে…এলিফ্যান্টায় তুমি কতক্ষণ ত্রিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে, মনে আছে?

—অত সুন্দর ভাস্কর্য দেখব না? আমিও তো কিছু গড়ি!

—না। তা নয়। অন্য জায়গায় যেন চলে গেছ, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

—সন্ন্যাসী? গুপ্ত যোগী?

—হতে পারে। সেটা আমার চেয়ে তুমিই ভাল বলতে পারবে। কিন্তু সমুদ্র তোমার জীবন অস্তিত্ব যেন অন্য জায়গায়। শিব ধ্বংসের দেবতা তবু কেন তাঁকে শিব বলে জিজ্ঞেস করেছিলে না? যে শিব ধ্বংসের দেবতা তার দিকেই তোমার নজর পড়ল?

কথা বলি না। চুপচাপ খাই। অসম্ভব খিদে পেয়েছিল। অবশেষে বলি— খটকা। আমার সম্পর্কে তোমার খটকা ছিল, থাকতেই পারে, ঘনিষ্ঠ ভাবে না মিশলে কাকে চেনা যায়? কিন্তু তোমারও তো একটা ফিলিং…।

—সেটাও ভালবাসা নয় সমুদ্র। টু বি অনেস্ট। সুদ্ধু উন্মাদনা। ওইটুকুর বাইরে যে মানুষটা তাকে আমি ভালবাসিনি। আজ যদি আবার সে রকম সুযোগ ঘটে, আবার হয়তো ওইভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ব, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কোনও মনের মিল নেই, হবে না— দীপা আর লজ্জা পাচ্ছে না, সোজা তাকিয়ে আছে।

—আমাকে বলতে পারতে তোমার বিয়ের ঠিক হয়ে আছে পছন্দের মানুষের সঙ্গে!

—তা হলে তো তোমায় পেতাম না! —দীপার মুখ লাল। আমি অবাক।

—যদি তোমার ভাবী বরকে সব জানিয়ে দিই? —শেষে বলি।

—দিয়ো। কিন্তু তারপরেও আমি তোমাকে বিয়ে করব না। তুমি কি সত্যিই মনে করো একদিনের শারীরিক মিলন থেকে সারাজীবনের সম্পর্কের ঝুঁকি নেওয়া যায়? আমি মনে করছি অঞ্জুকে কোথাও ঠকাচ্ছি না। তুমি যদি অন্য ভাবে ভাবতে, আমার কোনও বিবেকদংশন হত না। কিন্তু তুমি সেভাবে ভাবো না, আনফর্চুনেটলি। তাই তোমার জন্যে খুব খারাপ লাগছে।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরি।

মা রান্নাঘরের দরজায়। ওপর থেকে বাবার তর্জন। ফিনকি ছুটে এল।

—কী রে। কোথায় গিয়েছিলি?

—আচমকা কাজ পড়ে গিয়েছিল।

—একটা ফোন তো অন্তত করে দিবি!

—হ্যাঁ… ফোনটা… তোরা খেয়ে নে।

—আমাদের খাওয়া কবেই সারা। মা-ই না খেয়ে বসে আছে।

আমি হঠাৎ রান্নাঘরের কপাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের কাছে চলে যাই, মুখোমুখি দাঁড়াই— মা, এই রিচুয়ালগুলো কেন?

—কী?

—রিচুয়াল। বাড়ির সবাইকে না খাইয়ে তুমি খাবে না এই ধরনের রিচুয়াল। আরও আছে সেগুলো এখন থাক। তুমি নিশ্চয়ই জানো আমরা প্রত্যেকে অ্যাডাল্ট। আমাদের কোনও কাজ পড়ে গেলে আমরা খেয়ে নিতে জানি। পাকস্থলীর পাচক রসগুলো নিয়ম করে বেরিয়ে আসে। খাবার না পেলে নিজেকেই খায়। ফলে আলসার। তোমার না খেয়ে থাকা আমাদের কোনও আনন্দ দিচ্ছে না। তোমার আলসার হলেও সে যন্ত্রণাটা আমরা ভোগ করব না। তোমার মনে হচ্ছে এই স্যাক্রিফাইসটা, আলসারটা… এগুলো তোমার পত্নীত্বের, মাতৃত্বের মহিমা প্রচার করবে। ব্যাপারটা আদৌ তেমন নয়। তোমার যদি এসব কারণে দুরারোগ্য কোনও রোগ হয় আমরা ডাক্তার পথ্য সবই করব। কিন্তু খুব বিরক্তও হব। ভাবব মা শুধু-শুধু একটা ঝামেলা ডেকে আনল।

হতভম্ব মা আর ফিনকিকে রেখে আমি ওপরে উঠি। বাবার দরজা খোলা, ঢুকে যাই। উনি লুঙ্গির কষি খুলে কোমর চুলকোচ্ছিলেন। আমাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। ওঁর প্রাইভেসি নষ্ট করার সাহস এ বাড়িতে কারও নেই।

—তু ত্তুমি!

—হ্যাঁ বকুনিটা খেতে এলুম। গর্জন করছিলে শুনছিলুম।

—ন্‌ না। এত রাত, কোথায় গেলে…।

—তার জন্য দায়ী কে? মা? আমি যদি কোথাও যাই— তেমন খারাপ কোথাও বা একেবারে দাদার মতো অনেক দূরে। কিছু করতে পারবে? চেঁচিয়ে? মাঝ থেকে নিজের রক্তচাপ বাড়বে। বেশি বাড়লে সেরিব্রাল স্ট্রোক। আর সে রকম স্ট্রোক হলে জীবন্মৃত হয়ে থাকবে। হাতি কাদায় পড়া যাকে বলে। তখন ব্যাঙে লাথি মেরে গেলেও কিছু করতে পারবে না। আবার এ-ও হতে পারে তোমার না হয়ে স্ট্রোকটা, সেরিব্রাল বা করোনারি— মায়ের হল, হতেই পারে, বয়স হয়েছে, সর্বক্ষণের টেনশন সহ্য করতে করতে হার্ট বিদ্রোহ করতেই পারে। মা শুয়ে পড়লে বা মারা গেলে তোমাকে দেখবার আর কেউ থাকবে না।

বেরিয়ে আসি। জেঠুর ঘরে ঢুকি। জেঠু বিছানায় বসে। অবাক হয়ে দেখি উনি জপ করছেন। বেরিয়ে আসছি, ডাকলেন— সমু!

—হ্যাঁ, বলুন। ওষুধ খেয়েছেন? শুয়ে পড়ুন এবার জেঠু। ওষুধটা দেব?

—ফিনকি দিয়েছে বাবা। তোমার কী হয়েছে?

আমার হঠাৎ কী রকম অদ্ভুত একটা কথা মনে হল। জেঠুকে, একমাত্র জেঠুকেই বলতে পারি কী হয়েছে, কেন না ওঁর এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। জেঠুর যা হয়েছিল আমারও তা-ই হল। ঠিক যেমন কাকা যা করেছে, দাদাও তাই করল। কিন্তু জেঠুকে বলা যাবে না। তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার সে-সব হয়নি। হবে না। কিন্তু উনি যেহেতু ভুক্তভোগী তাই সহজাত শক্তিতেই বুঝে ফেলছেন আমার কী হয়েছে।

—শুয়ে পড়ুন জেঠু, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?

—পারবে? ক্লান্ত হয়ে ফিরেছ!

—ক্লান্ত কোথায়! খিদে পেতেই খেয়ে নিয়েছি। একটা ফোন করে দেওয়া উচিত ছিল।

জেঠু পাশ ফিরে শোন।

আমি আস্তে আস্তে জেঠুর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলুম। উনি আস্তে আস্তে বললেন— তুমি একটু থাকো সমু, তুমি থাকলে আমার ভাল লাগে।

জেঠু খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন। উনি যথেষ্ট কড়া ওষুধ খান। আমি একটু দাঁড়িয়ে থাকি। নীল রাত ঢুকে পড়েছে ঘরে। নীল রাত মাথায় করে আমি দাঁড়িয়ে থাকি বিষে নীল এক মনুষ্য আত্মার দিকে ফিরে। যদি আত্মা থাকে সে কি বিষে নীল হয় আদৌ? মনটা হয়, চেতনাও মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়, কিন্তু আত্মা? যা না কি আমাদের ভেতরের আসল সারটুকু! মৃত্যুর পরেও থাকে! নৈনং দহতি পাবকঃ। বিশ্বাস করি না, প্রমাণ নেই বলা খুব সহজ। কিন্তু যে চেতনার কথা এতদিন পাত্তা দিতেন না, আজ সেই কনসাশনেস নিয়েই তো এত কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা! তিন। তিন এমন একটা সংখ্যা যা সর্বত্র রহস্য সংখ্যা বলে মনে হচ্ছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। ফাদার, সন, হোলি গোস্ট। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। বুদ্ধ, সংঘ, ধর্ম। এর মানে কী? দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান সবকিছুর মধ্যে একই যোগসূত্র একটা আছে। সেটা আমরা ধরতে পারছি না। একটা মানুষ যদি একই সঙ্গে দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং শিল্পী হয় তবে ধরতে পারবে কী? আইনস্টাইন একই সঙ্গে বিজ্ঞানী ও শিল্পী ছিলেন। বেহালা বাজাতেন অর্থাৎ ভেতরে শিল্প ছিল ধরে নিতে পারি। সত্যেন্দ্রনাথও ভায়োলিন বাজাতেন, এগুলো কি গুরু চিন্তার ভার থেকে মুক্তি? না তার চেয়ে বেশি কিছু? ফেইনম্যান এক সময়ে অনুভব করেছিলেন তিনি ফিজিক্সের তত্ত্বগুলো ছবি দিয়ে প্রকাশ করতে চান। রীতিমতো শেখেন ড্রয়িং— প্যাস্টেল, জল রং, তেল রং। জেরি নামে এক শিল্পীবন্ধুকে ফেইনম্যান বোঝাচ্ছেন কী করে বৈদ্যুতিক চুম্বক কাজ করে। পেঁচিয়ে একটা ছোট্ট বৃত্ত করেছেন, এবারে সুতো দিয়ে একটা পেরেক ঝুলিয়ে দিলেন ওপর থেকে। তারের মধ্যে ভোল্টেজ দেবার সঙ্গে সঙ্গে পেরেকটা তারের ঘূর্ণির মধ্যে সোজা ঢুকে গেল। জেরির মন্তব্য— ওহ্‌, ইটস জাস্ট লাইক ফাকিং।

আশ্চর্য, যাতে একজন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বর প্রয়োগ দেখছেন বিস্ময়ে, আনন্দে, সেখানে আর একজন তার সঙ্গে ‘ফাকিং’-এর বেশি কিছু খুঁজে পেলেন না। একই প্রক্রিয়া, কিন্তু আলাদা-আলাদা মনে হওয়া। কত রকমের মনে হওয়া আছে পৃথিবীতে! ‘ফাকিং’ সম্পর্কে জেরির মনোভাবটাও বোঝা যায়। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্মের আরেকটা, ব্যস। ফান। অনেক মানুষ, আমি নিজেই যেমন দীপার সঙ্গে মিলনে যে অলৌকিক আনন্দ পেয়েছিলুম তার কিছুই ‘ফাকিং দিয়ে বোঝানো যায় না।

হঠাৎ আমার মনে হয় দীপা মেয়েটিকে যেন বুঝতে পারছি। আমি এমনই তুষার-শীতল, ঠিক জিনিসটা ঠিক সময়ে করছি। বলছি, কারেক্ট যাকে বলে। কিন্তু আমার মধ্যে কোনও উত্থান-পতন নেই। আছে শুধু একটা ক্লান্তিকর একমাত্রিকতা। আমি যে ওভাবে জ্বলে উঠতে পারি, সেটা দীপা প্রত্যাশাই করেনি। দেশলাইয়ের কাঠি খড়ের স্তূপে আগুন জ্বালাল। কিন্তু নিজে হয় নিভে গেল, নয় সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল। সেই স্বল্পায়ু দেশলাইয়ের কাঠিকে ভয় পেয়েছে প্রবল ভাবে বাঁচতে চাওয়া দীপা।

যতক্ষণ না ঘুম আসে ভাবনা যায় না। আমি নিজেকে যা বুঝি, অন্যে আমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি বোঝে। কেন? দাদু বলেছিলেন— তোমার যেন বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা আলগা-আলগা। তুমি দায়িত্বশীল, তাই ব্যাপারটা আরও ভাবায়… তোমার বন্ধু নেই? …যার সঙ্গে একটা বন্ড… যাকে তুমি সব কথা বলতে পারো.. সত্যিই… কাকে বলব? কী বলব? কী যেন বলেছিল পুলু? … তুই একটা পাগল… আমি তো পাগল নই পুলু। পাগল আমার জ্যাঠামশাই। এখন আর নেই। যে জ্যাঠামশাই আগে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলতেন, তিনি এখন সাবান ঘষে ঘষে দু’খানা গেঞ্জি কাঁচেন, দু’খানা রুমালও কেঁচে ঝেড়ে শুকুতে দ্যান, টেবিলের ওপর বই-খাতা গুছিয়ে রাখেন, একটা লাল কলম একটা নীল কলম, একটি ছুরি চিরুনি। সেফটিপিন দিয়ে ভেতরের ময়লা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করেন। কলের জলের তোড়ের তলায় রাখেন। রোদ। যে জ্যাঠামশাই আগে নাকি আমার বাবাকে ধরে মারতেন, মাকে অকথ্য গালাগাল করতেন, দাদুকে দেখলেই চোখে লাল রং এসে যেত, সেই জেঠু এখন বাবাকে ভয় পান, মা’র দিকে চোখ তুলে চান না। ফিনকির সঙ্গে হাসিমুখে গল্প করেন আর আমাকে বলেন— কাছে বসো। তুমি থাকলে আমার ভাল লাগে।

কিন্তু দীপার মনে হয়েছে— আমি আনরিয়্যাল। ‘তোমাকে কী রকম আনরিয়্যাল বলে মনে হয় সমুদ্র।’ এবং আমি আনরিয়্যাল কিনা জানি না। কিন্তু আমার চারপাশটা সত্যিই অবাস্তব লাগে বেশির ভাগ সময়ে।

‘…যে কোনও জায়গা থেকে তুমি কর্পূরের মতো উবে যেতে পারো।’

আমার এই তথাকথিত অবাস্তবতাকে ভয় পেয়ে দীপা সরে গেল। মানে, কেটে পড়ল আর কি! সারা রাত বৃষ্টির মতো চিন্তাপাত। আস্তে আস্তে বৃষ্টির ধারা ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের আরাম হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও সকালবেলা যেমন সময়ে রোজ ভাঙে ঠিক সেই সময়েই ঘুম ভেঙে যায়। দেখি খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছি। পা-দুটো দু’দিকে ফাঁক। যথাসম্ভব আলগা, হাত দুটো দু’দিকে প্রায় ঝুলে পড়েছে। যে কোনও যোগাসনের পর শবাসনে যে ভাবে শরীরটা শিথিল করে দিতে বলে— এ যেন ঠিক সেই রকম। প্রত্যেকটা অঙ্গ থেকে সাড়, বোধ চলে গেছে। আমাকে রীতিমতো চেষ্টা করতে হয় হাত নাড়াতে, পা নাড়াতে। আমি তাদের আলাদা আলাদা করে ডাকি। তোমরা কি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ? আমার ডাকের মধ্যে কোনও ভয় নেই, দুশ্চিন্তা নেই। খুব ঠান্ডা মাথায় নিজের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করি।

—কী রে ছোড়দা? ফিনকির মুখটা আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।

—ছোড়দা!

হঠাৎ আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সাড় ঢুকে যায়। বলি— উঠছি।

—এ রকম অদ্ভুত ভাবে…

—স্ট্রেচ্‌ করছিলুম।— আমি পাশ ফিরে যাই, বুঝে নিই কোমরে জোর এসেছে কি না। তারপর উঠে বসি।

—ঠিক আছিস তো?

—একেবারে— আমি হাসি।

—দেখিস বাবা।

ফিনকি যায় না। সকালের ঘরটার পটে ফিনকি খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে বরং। কোনও সন্দেহ নেই ও বাস্তব, পুরো ঘরটাকে ও এমন একটা অর্থ দিচ্ছে, যেন ফাঁকা লাইন ছিল একটা, কিছু ঠিকঠাক চমৎকার শব্দ এসে সেখানে বসে গেল।

আমি মুখ ধুতে যাই, ফিরে এসে দেখি ফিনকি দাঁড়িয়ে রয়েছে, দাড়ি কামাই, জলজ্যান্ত পার্থিব বাস্তব আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

—চা আনব!

—না। একেবারে চান করে নীচে নামব। একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি খুব হেলাফেলার সঙ্গে বলি।

ও একবার আমার দিকে চেয়ে চলে যায়।

নীচে নেমে দেখি— আমার সঙ্গেই খেতে বসেছে।

—তুই? এখন খাচ্ছিস?

—বেরোব সকাল-সকাল।

জুতোর র‍্যাকের কাছে এসে নিচু হয়ে ফিতে বাঁধছি, ফিনকি জুতো পরতে পরতে বলল— তুই আজকে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিস।

—কেন?

—তোকে ভাল লাগছে না দেখতে। আমি ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখব, তোর অফিসে যাব। ধর পাঁচটা নাগাদ। রেডি থাকবি।

—বাজে চিন্তা করছিস। আমি অনেক রাত অবধি জেগে ছিলুম। শেষ রাতটা মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। তাই কী রকম একটা লেথার্জিক লাগছিল।

—তুই শিওর?

—শিওর। তুই এগিয়ে পড়, আমার গাড়ি এক্ষুনি আসবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *