সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 13
আজকাল সংসারের অবস্থা বেশ স্থিতিশীল হয়েছে। ফিনকি খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। পাশ করা মাত্র ইউ. জি. সি স্কলারশিপ পেয়ে গেল। মেজদিদা সামান্য পেটের অসুখে মারা গেলেন। জেঠু ক্রমশ নিজের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে রোজ বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। সবচেয়ে কাছে চিলড্রেন্স পার্ক, আর একটু দূরে গঙ্গার ধার। এখনকার কেউ জানে না, জেঠু একদিন মনোরোগী ছিলেন। একদিন আমাকে ডাকলেন— সমু!
এখনও খানিকটা সংকুচিত। কিন্তু তার মধ্যে আগের মতো অস্বাভাবিকতা নেই।
—বলুন।
—আমি কিছু কাজ করতে পারি না?
—কী কাজ? আপনিই বলুন।
—আমার খুব লজ্জা করে। কিছু করি না।
—লজ্জা করার কিছু নেই জেঠু।
—না না লজ্জা, ভীষণ লজ্জা। ওইটুকু মেয়ে ফিনকি পর্যন্ত কত কাজ করে। তোমার মা, তোমার বাবা। তোমার তো কথাই নেই। এতটুকু ছেলে তুমি!
—এতটুকু ছেলে? আমি? লোকে শুনলে হাসবে জেঠু।
—না না, আমি ঠিক বলছি। আমি একটু পড়াশোনা শুরু করেছি, যদি একটু ছাত্র পড়াই?
আমি একটু ঘাবড়ে যাই। ছাত্র পড়ানোর পরিশ্রম কি ওঁর সইবে? মাথার ওপরই তো প্রেশারটা বেশি পড়বে।
—আমি একটু ভেবে দেখি জেঠু।
বাবাকে বলতে তো বাবা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের বেশি মগজ খাটাতে খাটাতে এই রকম হয়। বাবার আরও কেস জানা আছে। মা বললেন— যা করবে ভেবেচিন্তে করো সমু। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।
শেষ পর্যন্ত জেঠুর ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করি।
উনি একবার দেখতে চাইলেন জেঠুকে। অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন, বেশ সময় নিয়ে কথাবার্তা বললেন। আমাকে ডাকলেন— উনি ঠিক আছেন। ইচ্ছে হয়েছে যখন করুন। তবে বেশি চাপ যেন না নেন। আর দুষ্টু বা বিরক্ত করে কি খুব বোকা এ রকম ছাত্র ওঁকে যেন পড়াতে না হয়। আর… একটা কথা… কোনও মেয়েও নয়, বাচ্চা হলে ঠিক আছে। কিন্তু তরুণী-যুবতী মেয়ে কদাপি নয়।
আসল সময়ে কিন্তু দেখলুম উনি হাইস্কুলের ছেলেদের খুব অনায়াসে বিজ্ঞান ও অঙ্ক পড়িয়ে দিচ্ছেন। বেশি কথা বলেন না। খুব ধৈর্য ধরে আস্তে আস্তে নিচু গলায় বোঝান। খাতায় কষে দ্যান অঙ্ক। ক্রমে কলেজের ছাত্ররাও আসতে লাগল। উনি আমার কাছ থেকে সিলেবাসের বই চান, খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন। চট করে পাতা উল্টে দ্যান। কোনও কোনও জায়গায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন। স্মৃতির একটু অসুবিধে আছে বুঝি। উনিও বোঝেন, কাগজে বড় বড় করে ফর্মুলা লিখে রাখেন, কোনও কিছু সংজ্ঞা, নিয়ম, ঠিকঠাক ভাষায় লিখে রেখে দ্যান চোখের সামনে। কিন্তু ওঁর যুক্তি বুঝতে বা বোঝাতে কোনও অসুবিধে নেই।
আমি মাঝে মাঝেই বসি। ইচ্ছে করে। নজর রাখা দরকার। উনি প্রথম প্রথম একটু লজ্জা পেতেন। তারপর অভ্যেস হয়ে গেল।
জেঠু একদিন তাঁর উপার্জনের হাজার ছয়েক টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন— বউমাকে দিতে লজ্জা করল, সমু, তুমি ওঁকে দিয়ো। চোখমুখে খুশির ছাপ এতই স্পষ্ট, যে আমার না বলতে মন সরল না।
অতএব আমি দীপাকে বলি— দীপা আমাদের বাড়ি চলো। জাস্ট হঠাৎ একদিন। আমি শুধু শিওর হয়ে নেব ফিনকি থাকছে কি না।
—কিন্তু তুমি যে বলেছিলে আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে নিয়ে যাবে?
ভেবে-চিন্তে দেখি। ঠিকই। বলেছিলুম বটে। যদি জয়ন্তী মুকুলিকা জানতে পারে আমি একা দীপাকে নিয়ে গেছি, ওদের খারাপ লাগবে। শুধু শুধু কাউকে আঘাত দেওয়া তো আমার উদ্দেশ্য নয়। তা ছাড়া সত্যপালন। সত্যপালনের দায় আছে। অথচ সময় পার হয়ে যাচ্ছে। পার হয়ে যাচ্ছে। এত কাজ, দীপার সঙ্গে কথা হচ্ছে না।
—সে ক্ষেত্রে দীপা বাড়িতে একটু নোটিস দিয়ে অর্থাৎ জানিয়েই নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির সবাই একটু হতবুদ্ধি হয়ে যেতে পারেন।
—কেন? খুব প্রাচীনপন্থী না কি!
—এটা আমি বলতে পারব না। আমি আমার বাড়ির লোকেদের খুব একটা বুঝি না।
দীপা অদ্ভুত ভাবে হাসল।
আমি বললুম আমার দাদা দিল্লিতে পঞ্জাবি মেয়ে বিয়ে করেছে। কোনও সমস্যা হয়নি।
একটু চুপ করে থেকে দীপা বলল— উনি কি কারও মতামতের ধার ধেরেছিলেন?
খুবই সংসারাভিজ্ঞ ও স্পষ্টবাদী মেয়েটি।
আমি হেসে বলি— ধরেছ ঠিকই। কিন্তু তার তো পরও আছে। দাদা এসেছে, সবাই তাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছেন তো!
—তুমি বলছ তোমার দাদা-বউদি এখন তোমাদের বাড়িতেই থাকেন!
—তা কী করে থাকবে? দুজনেরই কর্মস্থল দিল্লি।
—তাই। এসে থাকলে কী হত তুমি জানো না, তাই না?
—এসব ছাড়ো। দীপা, আমাদের বাড়ি অতিথি-অভ্যাগতের আসা-যাওয়া একটু কম, ছোট থেকেই দেখছি। তাই-ই বলছি। তোমরা তিনজনে হঠাৎ গিয়ে পড়লে ওঁদের ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। ঘাবড়ে যাবেন আর কি!
—না-মঞ্জুর।
—সে কী?
—ওই আগে যা ব্যবস্থা ছিল, ফিনকি থাকছে কি না শিওর হয়ে বা ওকে আলাদা করে বলে উইদাউট নোটিস নিয়ে যেতে হবে।
—মামার বাড়ির আবদার?
—তাই বলো তো— তাই।
—ঠিক আছে, যা থাকে কপালে।
আমি আসলে আমার বাড়িকে প্রস্তুত করে নিতে চাইছিলুম। চাইছিলুম দীপা একাই যাক। সেই যাওয়াটাই হবে উপক্রমণিকা। তারপর পাঁচজনের মতামত। বিশেষ করে ফিনকির। ফিনকির কাছ থেকে মা-বাবা এঁদের মতামত জানতে পারব। জানা দরকার। যদিও তার জন্য কিছু আটকাবে না। তবু জানা দরকার। তিনজনকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব আমিই দিয়েছিলুম। তার কারণ ছিল অন্য, জয়ন্তীকে আমি আলাদা করে দেখিনি, অথচ ও গেলে সেটাই এক রকম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। কিন্তু দীপা কেন তিনজনে যেতে চাইছে তাও আবার উইদাউট নোটিস— আমি বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে যা বলছে তাই-ই করি অতএব। ফিনকিকে বলব ঠিক করি।
ফিনকি এত ভাল পাশ করে গবেষণা করছে, হেঁজিপেঁজি বিষয় নয়, মুদ্রা নিয়ে কাজ। কিন্তু প্রায় এক রকমই আছে। দেখায় সেই ছটফটে অষ্টাদশীটি। জেঠুর সঙ্গে কত গল্প করে, বড় দিদার পান ছেঁচবার সময়ে ছ্যাঁচা পান টুক করে তুলে নিয়ে রাগায়, মাকে সাহায্য করে, বাবার মেজাজ সামলায়। আমার সময় হলে আমার সঙ্গেও বসে গল্প করে।
—কী রে ছোড়দা—কী করছিস?—একেবারে ডাকাতের মতো এসে পড়ল। ওর ছোটবেলাকার ডলি-ডলি শিশুমুখ খুব একটা ছাঁদ পাল্টায়নি। বড় বড় চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত, কোঁকড়া ছোট চুল, কাটেনি, কিন্তু বাড়ে না বিশেষ। ফর্সা নয় একেবারেই কিন্তু খুব উজ্জ্বল, কোনওদিন ব্রণ হতে দেখিনি। আমাদের বিশেষত দাদার তো ব্রণ হয়ে হয়ে গালে দাগই হয়ে গেল। দাদু বলতেন ‘বয়ঃব্রণ, ঘাবড়িও না, হরমোন্যাল চেঞ্জের সময়ে ছেলে-মেয়ে সবারই হয়।’ কিন্তু ফিনকির মুখে কোনওদিন কোনও ব্রণ দেখিনি। মুখে দাগ না থাকলে মুখটা খুব নিষ্পাপ নির্মল দেখায়। প্রচুর বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ফিনকিকে তেমনই নির্মল দেখায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির শাণিত ভাবটা ওর মুখে একেবারেই নেই।
একদিন শীতের রোববার। কুয়াশা ভাল কাটেনি। কুয়াশা ভেদ করা স্যাঁতা রোদ ঘরে, ঠিক যেন একটা উজ্জ্বল বাঘ নিস্তেজ হয়ে ঘুমোচ্ছে। জানি ঘুম ভাঙবে, লাফিয়ে উঠবে তখন, আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘের গায়ের রং মেখে শীত-সকালের গায়ে-হলুদ হয়ে যাবে। একটু দেরি করে উঠেছি। মনে হচ্ছে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। প্রত্যেক ঘর-সংসারের বিভিন্ন সময়ে কিছু বিশেষ শব্দ-গন্ধ থাকে। তাতে সকালে-বিকেলে তফাত হয়ে যায়। ঠিক যে কী, বলতে পারব না। মাংসের গন্ধ কি হাওয়ায়? হ্যাঁ, খুবই সুবাস।
ফটাস ফটাস করে বাবা নেমে গেলেন। প্রত্যেকটা ফটাসে যেন এক একটা করে পটকা ফাটছে। বাবাও রোববার দেরি করে ওঠেন। জেঠুর একটু কুণ্ঠিত কাশির শব্দ, কেউ চান করে গেছে, বাথরুমের দরজা বোধহয় খোলা, হুড়হুড় করে একটা ভাল কোনও সাবানের গন্ধ আসছে। ফিনকির উপস্থিতিতেই সেই গন্ধ। ও-ই তবে চান করে এল এইমাত্র।
আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে ছ্যাঁক করে দুটো চিঠি রাখল আমার সামনে। একটা দেখি এরোগ্রাম, আর একটা লম্বা অফিশিয়্যাল চিঠি।
—কী ব্যাপার? এগুলো কোথা থেকে? বিদেশে চাকরি পাচ্ছিস? কোথায়?
—পেলে যেতে দিবি তো?
আমি ওর দিকে একটু তাকিয়ে থাকি।— কী যে বলিস ফিনকি? তুই চাকরি চেয়েছিস। পাচ্ছিস। নিবি তোর নিজের সিদ্ধান্তে, আমি কেন বাধা দেব?
—তোর কথা বলছি না ছোড়দা, ধর মা, বাবা, জেঠু, দিদা।
—বাবা একটু চেঁচামেচি করতে পারেন। আর কেউ কিচ্ছু বলবেন না।
—বলবেন না হয়তো। কিন্তু মা মনের কষ্টে গুমরে শেষ হয়ে যাবে। জেঠু খুব অসহায় বোধ করবেন, দিদুও তাই।
আমি চুপ করে থাকি।
—ছোড়দা তোরা কারও মনের খবর রাখিস না, না?
ভেবে দেখলুম সত্যিই রাখি না। যাকে যেমন দেখছি তেমনই মেনে নিয়েছি। না। এমনকী দাদুরও না। মন? মন কোথায় থাকে? পৃথিবীর কোন দুর্গম গুহায়? কত অধ্যবসায় স্বীকার করে তবে সেখানে যাওয়া যায়? খুব তাগিদ না থাকলে সে অধ্যবসায়ও আসে না, গুহায় পৌঁছনোও হয় না। নিজের মনকেও কি খুব ভাল করে জানি আমি? যা কিছু চারপাশে ঘটছে, বাইরে ও ভেতরে সবই যেন এক অন্তহীন জলছবি। টলটল করছে জলে, ঠিকমতো উঠছে না খাতায়, বা কিছু উঠছে কিছু উঠছে না। ডগডগে রং ফিকে হয়ে গেছে অপ্রত্যাশিত ভাবে।
—রাগ করলি?
—না। ভাবছি। তুই যেটা বললি… সত্যিই… আমি কি কোনও কর্তব্যে অবহেলা করেছি! সেটাই…
ফিনকি এবার ভারী রেগে উঠল— কর্তব্যের কথা কে তোকে বলেছে? আমি কি সে সবে কোনও গাফিলতির কথা বলেছি? কর্তব্য ছাড়া আর কিছুর কথা ভাবতে পারিস না, না?
—আমি জানি না রে ফিনকি। সত্যিই তুই, তুই-ই কিন্তু সবাইকার একমাত্র আশা।
যে কথাটা দাদু মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, সেটাই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
—গ্যাস দিচ্ছিস? শোন্, আমি দুটো দু-রকমের চাকরি পাচ্ছি। একটা এশিয়াটিক সোসাইটিতে ওদের ইনসক্রিপশন সেকশনে, সংরক্ষণ, ক্যাটালগিং রিসার্চ… সবই। আর দ্বিতীয়টা কানাডায় কাকার কাছে। কী ধরনের চাকরি তা জানি না, যিনি স্ত্রী মারা যেতে দুধের শিশুকে ফেলে চলে যেতে পারেন, বছর না ঘুরতেই বিয়ে করে পগার পার, কোনওদিনও সে মেয়ের খোঁজ নেন না, তিনি হঠাৎ এ রকম দরাজ হয়ে উঠলেন কেন? কী চাকরি… সেটা? তোরা ওঁকে জানাসনি আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছি, আমার আর গার্জেনের দরকার নেই?
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
ও একটু রাগী হাসি হাসে।— কাকা আমাকে আগেও একটা চিঠি দিয়েছিলেন তাতেই নিজের গুণপনা ব্যক্ত করে ফেলেছেন। এখন লিখছেন আমাকে উচ্চশিক্ষা দেবেন। আমার ভাই বড় হয়ে যাচ্ছে, কাকিমা ওঁকে ছেড়ে গেছেন তো! আবার বিয়ে করেছেন।
—সে কী? আমরা তো জানি মোটর দুর্ঘটনায় উনি আর ওঁর বড় ছেলে মারা গেছে।
—আমিও তো তেমনই কানাঘুষো শুনেছিলুম। তা উনি যদি নিজে লেখেন কাকিমা ডিভোর্স করে অন্য এক ধনকুবেরকে বিয়ে করেছেন। এক ছেলে তিনি নিয়েছেন, আর এক ছেলে এঁর। তা হলে তো ওঁর এই কথাটাই সত্যি বলে মেনে নিতে হয়।
আমি বিমূঢ়।
—কী বল?
—কী বলব ফিনকি? স-বই তোর। এ বাড়ি ও বাড়ি। তুই যেখানে যেতে চাস…
এবারে ফুঁসে উঠল ফিনকি— এত নিষ্ঠুর তুই? একবার মুখ ফুটে বলতে পারছিস না— ফিনকি তুই আমাদের, যাস না, কোথাও যেতে দেব না! ভারী বিবেচক ভদ্রলোক হয়েছিস, না?
ওর চোখ জলে ভরে উঠছে।
–শোন শোন। আমি আমরা তোকে যেতে দিতে চাই না, ভুল বুঝিস না। কিন্তু তোর বাবার কাছে যদি তুই যেতে চাস?
—কে আমার বাবা? রাজকুমার না নবকুমার? কে আমার ভাই, তুই না সেই এঁচড়ে-পক্বটা?
—শুধু-শুধু কেন গালাগাল দিচ্ছিস, কেন? বেচারা ছেলেটাকে?
—না রে গোল্লায় গেছে, কাকার চিঠি পড়ে আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি।
—সে দোষটা পুরোপুরি ওর কি? ব্রোক্ন ফ্যামিলি…
—দরদ উথলোচ্ছে যে রে। এবার বলবি না তো আহা তুই দিদি হলি। মা-হারা ছেলেটার জন্যেও যা! বল্। কর্তব্য। কর্তব্যটা তো খুব বুঝিস!
—ঠিক আছে তাই বললে তুই কী বলবি?
—বলব পৃথিবীতে কত শত ব্রোক্ন ফ্যামিলি আছে, ছেলেমেয়ে অসহায়, বখে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে—অত দায় নেবার সাধ্য কী আমার! …ওহ্, আর একটা চিঠিও আছে। তোর। কার যেন বিয়ের কার্ড।
স্বস্তিকা আঁকা হ্যান্ড-মেড পেপারের একটা শুভবিবাহের কার্ড আমার হাতে দিল ফিনকি।
সবিনয় নিবেদন,
আগামী… অমুক তারিখে অমুক লগ্নে আমাদের জ্যেষ্ঠা কন্যা কল্যাণীয়া দীপার সহিত শ্রীযুক্ত অমলেন্দু ও উষা চক্রবর্তীর একমাত্র পুত্র কল্যাণীয় আঞ্জনেয়র শুভবিবাহ অনুষ্ঠিত হইবে। অনুগ্রহ করিয়া…
কে রে মেয়েটি?
—ওই যে আসছে শনিবার যে তিনজন আমাদের বাড়ি আসবে বলেছে, তাদেরই একজন।
—তোর তো ছেলে-কলিগও আছে। তাদের ডাকলি না তো?
—আমি এদেরও ডাকিনি ফিনকি, ওরা নিজেরাই… অন্যরা ওদের বড্ড হেক্ল করত, আমি করতুম না। এই থেকে…
—যাক তিন থেকে এক কমে গেলে দুই।
ও কী বলতে চায় আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপাতত আমার মাথায় কিছু মৌমাছি। তাদের তাড়াতে পারছি না। ফিনকির কথার জবাবে কিছুই আমার মুখ দিয়ে বেরোয় না।
ও বোধহয় ঘাবড়ে যায়। এত ফাজলামি ছোড়দা পছন্দ করছে না,— বলে— কী খাওয়াব ছোড়দা?
—তুই যা ভাল বুঝিস!
—বাঃ! আসছে তোর অ্যাডমায়ারার, আর বুঝব আমি?
—আমি কী-ই বা বুঝি?
—তার মানে আমার অ্যাডমায়ারার এলেও মেনুটা আমাকেই বানাতে হবে? কী রে?
ইয়ার্কির উত্তরে পাল্টা ইয়ার্কি করতে পারি না। বলি— তখন দেখা যাবে। এখন যা তো! আমার কয়েকটা ড্রয়িং দেখবার আছে।
—তুই যেন কেমন! —ফিনকি হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
কুয়াশাটা বোধহয় কেটে গেছে। জানলা দিয়ে ঘর-ভাসানি রোদ। কিন্তু কুয়াশাটাকে তো কোথাও যেতে হবে! তাই আমার কাছে এসেছে। আমাকে সাত পাকে জড়িয়ে। ঘরটা যেন টং ঘর। কত উঁচুতে? সাত ফুট? আট ফুট? না তার চেয়েও বেশি? মাটির সঙ্গে সম্পর্ক তার কতকগুলো লম্বা লম্বা খুঁটির। কুয়াশা, ভোঁতা শীত, আমি। আমি, ভোঁতা শীত, কুয়াশা। কাজকর্ম? চলছে, যেমন চলে। আমি বুঝেও বুঝতে পারছি না। আমি উঠে দাঁড়াই, আমার কোল থেকে কুয়াশা গড়িয়ে যায়, উঠে দাঁড়ায়, আস্তে আস্তে হেঁটে বইয়ের দিকে যাই। চোখ বুলিয়ে যাই পরপর। –‘ডাব্ল হেলিক্স’ ‘শিওরলি য়ু আর জোকিং মিঃ ফেইনম্যান’ ‘সামার লাইটনিং’, রিলকে। ‘সঞ্চয়িতা’, ‘ছাড়পত্র’, ‘টাইম-মেশিন’, ‘আরণ্যক’, আমার বিষয়ের কিছু বই। সব উল্টেপাল্টে দেখি কোথাও যদি কিছু পাই, যার এই মুহূর্তে আমার কাছে বিশেষ মানে আছে।
‘আই লাভ দা ডার্কার আওয়ার্স অব মাই এগজিসটেন্স
হোয়্যার ইন, অ্যাজ ইন ওল্ড লেটার্স, আই ডিসকভার
মাই ডেইলি লাইফ অলরেডি লিভ্ড্ অ্যান্ড ওভার
অ্যান্ড লাইক সাম লেজেন্ড লস্ট ইন ফার্দেস্ট ডিসট্যান্স…’
রিলকেরও তা হলে এমন মনে হয়েছিল? বারবার হচ্ছে। যে ভাবে বাঁচছি সব বারবার ফিরে আসছে। খুব পুরনো, ‘মাই ডেইলি লাইফ অলরেডি লিভ্ড্ অ্যান্ড ওভার’। সব অভিজ্ঞতাই সুদূর অতীতের ছেঁড়া পাতা হঠাৎ উড়ে আসছে। উড়ে আসছে যেন নতুন পাতা, নতুন চিঠি। কুড়িয়ে দেখি, ওহ্ হো! এ তো সেই পুরনো গল্প লোককথায় কথায় যা পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর পাতায় আমি একটা পুনরাবৃত্তি। অথচ এই অন্ধকারতম অস্তিত্ব কেমন দপ্দপ্ করছে। পুনরাবৃত্তি বলে চিনলে কেন এই অন্ধকার? কেন এই দপদপানি?
তবে? তবে কি আমি দীপাকে এতই ভালবাসি? আর কেউ যে দুঃখবোধ আমাকে দিতে পারেনি, সে পেরেছে! কিন্তু দীপার প্রতি বম্বের সেই রাতের আগে আমি তো সত্যিই কোনও ভালবাসা বোধ করিনি? এখনও, এখনও দীপার অদর্শনে আমার কোনও কষ্ট তো হয় না, দেখা করার জন্য কোনও উদগ্র বাসনা নেই, অন্য সবাইকে জীবনে যেভাবে নিয়েছি, এই বন্ধুটিকেও তাই। কাকে তা হলে ভালবাসা বলে? কেনই বা এই তিমিরবোধ? অপমান? প্রতারণা? আমাকে একজন ঠকিয়েছে সেই লজ্জা, সেই নৈরাশ্য? ব্যস?
আমি চুপ করে বসে থাকি আর জাগ্রতেই এই বাড়ি ছাপিয়ে আমার চোখে ভেসে ওঠে অন্য এক বাড়ি। বিরাট। ভাঙা ভাঙা গাবদা থাম। আগাছা গজিয়েছে, আস্তর খসে পড়ছে। দূরে সাপের মুখে ব্যাঙের অদ্ভুত চিৎকার। ঢুকতে চাইছি ঢুকতে পারছি না। যে দিকেই যেতে চাই হঠাৎ যেন পা আটকে যায়। শুধু প্রশস্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি ঘরের পর ঘর, ঘরের পর ঘর, সব কার ঢোকবার অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষার রুদ্ধ নিশ্বাস টের পাচ্ছি।