সমকামি – একুশতম পর্ব
অন্যন্যা চুপ করে আছে ও কি বলবে কিছু বুঝতে পারছিল না। বার বার কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। বৃষ্টির তেজ হঠাৎ যেনো আবার একটু বেড়ে গেলো চিন্তিত ভাবে অন্যন্যা আবার তাঁকালো কৃষ্ণেন্দুর দিকে। অন্যন্যার মনের ভাব বুঝতে পেরে কৃষ্ণেন্দু এবার বললো: চিন্তা বা ভয়ের কোনো কারণ নেই আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না আমি তোমায় পৌঁছে দেবো নিরাপদে বাড়িতে। অন্যন্যা কিছু বলতে যাবে এমন সময় কৃষ্ণেন্দু ওকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললো: থাক্, আমি জানি বুঝি আমার সম্পর্কে কি ভাবো তুমি? ইনফ্যাক্ট তোমরা। কিন্তু কি জানো সব সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পিছনে যে একজন পুরুষকেই সবসময় দোষী হতে হবে তার কোনো মানে নেই। সেটা জরুরি নয় যে একজন পুরুষই সবসময় খারাপ হবে। আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বা তোমার কোনো ক্ষতি করবো ভেবে তোমার সাথে কথা বলতে বা মিশতে চাইনি। আমার একাকীত্বের জীবনে তোমাকে বন্ধু একজন ভালো বন্ধু বলে মনে হয়েছিল যার সাথে সহজ ভাবে মেশা যায় কথা বলা যায়। মনে হয়েছিল তুমি হয়তো আর সবার মতো করে আমাকে ভাবো না। ভাবলে হয়তো নিজের সব কথা এতো সহজে আমার কাছে বলতে পারতে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। যাই হোক আমি এতে কিছু মনে করিনি। তবে বেরোনোর সময় একবার বলবে এটা এক্সপেক্ট করেছিলাম। জানি না এই দুর্যোগ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি মনে হয়েছিল তোমার আমার সাহায্যের দরকার এখন তাই কিছু না ভেবে ছুটে এসেছিলাম। আমি জানি আমি না এলেও তুমি পারতে তবু পারলাম না, না এসে।
অন্যন্যা মাথা নীচু করে বসে থাকে ওর দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। এরমধ্যে ওর ফোনটা আবার বেজে ওঠে ওর বাড়ি থেকে ফোন আসছে। কৃষ্ণেন্দু ওর ফোনটা রিসিভ করে। ওপার থেকে অন্যন্যার বাবা চিন্তিত গলায় বলে: অন্যন্যা মা তুই কোথায় কত দূর আছিস? বাড়িতে কেউ শান্তিতে বসতে পারছিনা। কৃষ্ণেন্দু আসতে করে বলে: মেসোমশাই আমি কৃষ্ণেন্দু। আমিই অন্যন্যাকে বললাম ফোনটা আমাকে দিতে আপনারা চিন্তা করবেন না অন্যন্যা ঠিক আছে যত রাত হোক আমি ওকে সেফলি বাড়িতে পৌঁছে দেবো। নিন ওর সাথে কথা বলুন। ফোনটা বাড়িয়ে দেয় অন্যন্যার দিকে। তারপর হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে: কথা বলো চিন্তা করছে বাড়িতে সবাই। অন্যন্যা ফোন ধরে বলে: আমি আসছি বাবা তোমরা চিন্তা করো না উনি না থাকলে হয়তো অনেক সমস্যায় পড়ে যেতাম কিন্তু এখন কোনো সমস্যা নেই। তারপর ফোনটা কেটে দেয় অন্যন্যা।
ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে কৃষ্ণেন্দু বললো: প্লিজ কেঁদো না। মেয়েদের কান্না আমার কোনোদিন ও ভালো লাগে না। আর আমি তোমায় বললাম তো আমি কিছু মনে করিনি। এগুলো আমার সাথে আগে ও হয়েছে এটা নতুন কিছু নয়। অন্যন্যা মাথা নীচু করে বললো: আই এম রিএলি ভেরি সরি। আমি জানি আমি ভুল করেছি। কৃষ্ণেন্দু ওর দিকে তাঁকিয়ে বলে কতবার চোখের জল মুছিয়ে দেবো হুমম, কেঁদো না আর । আমাকে নিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে সরাসরি জানতে চেয়ো আমি কিছু মনে করবো না কিন্তু কিছু না জেনে ভুল বুঝো না প্লিজ। অন্যন্যা চুপ করে থাকে। অন্যন্যার ফোনটা হঠাৎ ভাইব্রেট করে তৃণা টেক্সট করেছে:” অনু আমি খুব মানুষ চিনি একথা বলছি না। কিন্তু আমি তোকে তাও বলছি মানুষটাকে ফিরিয়ে দিস না। ও সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ। আর তোকে সত্যি খুব ভালোবাসে তা না হলে এই ঝড় জলে শুধু তোর কথা ভেবে এইরকম উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসতো না”। অন্যন্যা লেখাটা পড়ে কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে তাঁকায়। কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞাসা করে: কি হলো কে টেক্সট করেছে? অন্যন্যা অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দু আবার জিজ্ঞাসা করে কি হলো, এরকম অবাক হয়ে কি দেখছো? কার টেক্সট? অন্যন্যার যেনো এবার ঘোর ভাঙ্গে হুমম, না তৃণা। তৃণা টেক্সট করেছে। কৃষ্ণেন্দু বলে: বাব্বা আমি ভাবলাম আবার কি দোষ করলাম? ওরকম ভাবে তাঁকিয়ে আছো। কোনো উত্তর দেয় না অন্যন্যা।
গাড়ি এসে থামে একদম অন্যন্যার বাড়ির সামনে। গাড়ির শব্দ পেয়ে ঘরের ভীতর থেকে সবাই ছুটে আসে। ততক্ষনে বৃষ্টি ও থেমে গেছে। অন্যন্যার সাথে সাথে কৃষ্ণেন্দু ও নেমে আসে গাড়ি থেকে। তারপর অন্যন্যার মা, বাবার সামনে হাত জোড় করে বলে: অনেক দুঃখিত চেষ্টা করেছিলাম তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেবার কিন্তু রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা আর অনেক রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে তাই পারলাম না অনেক চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম আপনাদের। অন্যন্যার বাবা অনুনয়ের সাথে বললো: এ বাবা একদম এভাবে বলবেন না আপনি না থাকলে আজকে কতো বড়ো অসুবিধা বিপদ হতে পারতো তৃণা আমাদের সব বলেছে। আপনাকে আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আজকালের দিনে এই ভাবে কে দাঁড়ায় বিপদের সময়। আপনি আসুন কিছু খাওয়া দাওয়া করে তারপর না হয় যাবেন। কৃষ্ণেন্দু হেঁসে বলে: হুমম খেয়ে নিলে হতো কিন্তু যদি আমার কাজের দিদি আসতে পারে তাহলে আমার ঘরের খাবার গুলো নষ্ট হবে। আর যদি এই দুর্যোগে না এসে থাকে তাহলে আপনাদের না করে খুব ভুল করছি। তবে আজ আসি রাত ও অনেকটাই হয়েছে পরে কখনো আসবো। বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অন্যন্যা পিছন পিছন যায় কৃষ্ণেন্দুর। কৃষ্ণেন্দু পিছন ঘুরে জিজ্ঞাসা করে: কি হলো অন্যন্যা? কিছু বলবে? অন্যন্যা বলে: খেয়ে তো যেতে পারতে। যদি কাজে না আসে কি খাবে তাহলে? কোনো উত্তর দেয় না কৃষ্ণেন্দু। শুধু আসি বলে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যায়।
ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয় অন্যন্যা। তারপর সবাই খেতে বসে একসাথে এতক্ষন চিন্তায় কেউ খায়নি সবাই অপেক্ষা করছিল অন্যন্যার জন্য। খেতে বসে অন্যন্যা কিছু খাচ্ছে না দেখে রিনা দেবী বললো: কিরে কি হলো তোর? খাচ্ছিস না কেনো? অন্যন্যা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে: মা তোমরা খাও আমি এখুনি আসছি। বলে নিজের ঘরের দিকে যায়। তারপর ফোন করে কৃষ্ণেন্দুকে। কিন্তু ফোনটা বেজে যায় কেউ ধরে না। হতাশ হয়ে আবার খাবার টেবিলে গিয়ে বসে অন্যন্যা। রিনা দেবী জিজ্ঞাসা করে: কিরে খাবার ছেড়ে ঘরে গেলি কেনো? অন্যন্যা মার দিকে তাঁকিয়ে বলে: কৃষ্ণেন্দু পৌঁছাল কিনা তাই একবার ফোন করা উচিত মনে হলো। মাথা নীচু করে রিনা দেবী বলে: হুমম, আজকে না থাকলে সত্যি খুব খারাপ হতো। তবে অন্যন্যা অফিসের বসকে অফিস পর্যন্তই রাখা ভালো। অন্তত আমার তাই মনে হয়। অন্যন্যা কিছু বলার আগেই রিনা দেবী হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো: আমার বয়স আর অভিজ্ঞতা দুটোই তোমার থেকে বেশী আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই কথাটা বললাম। যাও অনেক ধকল গেছে হাত মুখ ধুয়ে গিয়ে শুয়ে পড়। অন্যন্যা নিজের রুমে যেতেই ফোনটা ও বেজে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে ফোনটা ধরে অন্যন্যা। ওপার থেকে কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞাসা করে: ফোন করেছিলে? অন্যন্যা বলে: হুমম, করেতো ছিলাম ফোনটা ধরলে না কেনো? তোমার কাজের দিদি এসেছিলো? কি খাবে রাত্রে? ওসব ছাইপাশ গুলো নিয়ে আবার বসো না রাত্রে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো অন্যন্যা। কৃষ্ণেন্দু এবার গম্ভীর হয়ে বলে: কোনটার উত্তর আগে দিলে ভালো হয়? নাকি পর পর দেবো? ফ্রেশ হতে গেছিলাম তাই ধরতে পারিনি। কাজের দিদি আসেনি। ছাইপাশ খেতে খেতে সেদ্ধ ভাত বসিয়ে নেবো ক্ষিদে পেয়ে গেছে আমার তো আর মা নেই যে খাবার থালা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। অন্যন্যা চুপ করে থাকে। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কৃষ্ণেন্দু বলে: কি হলো আছো? থাকলে চুপ করে কেনো আছো? অন্যন্যা এবার বললো তোমাকে বাবা বললো খেয়ে যেতে খেলে না কেনো? কৃষ্ণেন্দু এবার হেঁসে উত্তর দেয় আমি খেতে রাজি হলে তোমার মার খুব একটা ভালো লাগতো না সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম আর তার মেয়ের মনে ও তো আমাকে নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাই না? অন্যন্যা বলে: কৃষ্ণেন্দু। আমি জানি অনু আমি বুঝি তোমার জায়গাটা তাই কোনো রাগ নেই তোমার উপরে। একটু অভিমান হয়েছিল। আমি এখন রাখি তোমার অনেক ধকল গেছে তুমি রেস্ট নাও তোমার রেস্ট দরকার। বলে ফোন কেটে দেয় কৃষ্ণেন্দু।
অন্যন্যা ফোন রেখে টেক্সট করে: আমি অপেক্ষা করবো কাল একসাথে যাবো অফিসে। কিছুক্ষন বাদে রিপ্লাই আসে করো কথায় না অন্যন্যা আগে নিজে ঠিক করো তুমি আমার সম্পর্কে কি ভাবো? তারপর। তুমি চলে যেও অফিসে নিজের মতো করে। গুড নাইট।
অন্যন্যা খুব রাগ হয় আর অপমানিত ও হয় ও। আবার মনে মনে চিন্তা করতে থাকে আজকে ও যা করেছে তাতে হয়তো যে কোনো মানুষ এটাই করতো কাল অফিসে গিয়ে এর বোঝাপড়া হবে। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে অন্যন্যা। কৃষ্ণেন্দুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারে না।