Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay » Page 8

সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay

এদিকে সন্তু জলে লাফিয়ে পড়ার পরই ভাবল, তাকে কুমিরে ধরবে। সে ভাল সাঁতার জানে। কিন্তু সাঁতার কাটতে হল না। সমুদ্রের একটা বড় ঢেউ তাকে পাড়ে এনে পৌঁছে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠেই চলে এল একটা গাছের আড়ালে।

আর-একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন কাকাবাবু। তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর চাপা গলায় বললেন, তুমি বোকার মতন জলে লাফিয়ে পড়লে কেন? তোমাকে পোর্ট ব্লেয়ারে চলে যেতে বললুম না?

সন্তু বলল, তুমি কেন এলে?

আমি এসেছি, বেশ করেছি। আমি বুড়ো মানুষ, কোনও একটা বড় কাজের জন্য যদি আমি মরেও যাই, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু তুমি ছেলেমানুষ, তোমার মাকে আমি বলে এসেছি তোমার কোনও বিপদ হবে না!

মা আমাকে বলে দিয়েছিলেন, সব সময় তোমার কাছাকাছি থাকতে!

আঃ! তুমি এমন গণ্ডগোল বাধালে! যাক গে, তুমি আমার পেছনে এসে দাঁড়াও! একটুও নড়বে না। কোনও শব্দ করবে না?

দুজনে খানিকক্ষণ কান খাড়া করে রইল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। বোধহয় জারোয়ারা এখনও তাদের আসার ব্যাপারটা টের পায়নি। সামনে থেকেই শুরু হয়ে গেছে ঘন জঙ্গল। ফাঁক নেই একটুও। এত ঘন জঙ্গলের মধ্যে গায়ে তীর লাগবার খুব ভয় নেই। একটু দূর থেকে তীর ছুঁড়লে কোনও না কোনও গাছে আটকে যাবে।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা বুঝতে পারল কাছাকাছি কোনও জারোয়া নেই। তখন পা টিপো-টিপে ওরা জঙ্গলের মধ্যে এগোতে লাগল। পায়ের তলার মাটি ভিজে স্যাঁতসেঁতে। গাছ থেকে খসে পড়া অসংখ্য পাতা পচে নরম হয়ে আছে। এখানে যখন-তখন বৃষ্টি হয়।

কাকাবাবু ভাবছেন, সমুদ্রের ধার থেকে যত দূরে সরে যাওয়া যায়, ততই ভাল। এতবড় জঙ্গলের মধ্যে জারোয়ারা তাঁদের চট্ট করে খুঁজে পাবে না। জঙ্গলের মধ্যে দিনের বেলাতেও অন্ধকার।

কাকাবাবুর ক্রাচটা হঠাৎ এক জায়গায় নরম মাটিতে গেঁথে গেল। তিনি সেটা টেনে তুলতে গিয়ে তাল সামলাতে পারলেন না, পড়ে গেলেন হুমড়ি খেয়ে। সন্তু তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরল। তারপর সে নিজেই ক্রাচটা উপড়ে তুলল কাদা থেকে।

সন্তু ভাবল, কাকাবাবু খোঁড়া পা নিয়ে সব জায়গায় চলাফেরা করতে পারেন। না। এই রকম জঙ্গলের মধ্যে তো আরও অসুবিধে। তবু তিনি সন্তুর ওপর রাগারগি করেছিলেন। ভাগ্যিস সন্তু জোর করে চলে এসেছে!

কাকাবাবু একটা গাছে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সন্তু একটুখানি এগিয়ে দেখতে গেল। সব সময় গা-টা শিরশির করছে। দাশগুপ্ত বলেছিল, এখানকার জঙ্গল এত গভীর হলেও বাঘ-সিংহের কোনও ভয় নেই। সবচেয়ে বেশি ভয় মানুষের! সন্তুর খালি মনে হচ্ছে, কাছেই কারা যেন লুকিয়ে থেকে তাকে দেখছে। যে-কোনও মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সন্তু ওপরের দিকে মুখ তুলে দেখতে লাগল, কোনও গাছের ওপর কেউ বসে আছে কি না। অবশ্য এখানকার গাছে ওঠা সহজ নয়। প্ৰায় সব কটা গাছই বিরাট-বিরাট লম্বা। প্ৰথম দিকে অনেকখানি উঠে গেছে সোজা হয়ে, কোনও ডালপালা নেই, মাথার কাছটা প্ৰকাণ্ড ছাতার মতন। এক-একটা গাছের বয়েস বোধহয় দুশো তিনশো বছর। গায়ে শ্যাওলা ধরে গেছে।

হঠাৎ দূরে একটা ছত্রছর শব্দ হল। ভয়ে কেঁপে উঠল সন্তু। কারা যেন ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে আসছে। এইবার তাহলে আসছে জারোয়ারা। আর উপায় নেই। সন্তুও ছুটে গিয়ে দাঁড়াল কাকাবাবুর পাশে। কাকাবাবুও আওয়াজটা শুনেছেন। তিনি সন্তুকে ধরে এনে দাঁড়ালেন দুটো বড় গাছের ফাঁকে। হাতে রিভলভার।

একটু বাদেই ওদের খানিকটা দূর দিয়ে ছুটে গেল দুটো হরিণ। তারপর আরও তিনটে। শেষ হরিণটি ওদের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে আরও জোরে দৌড়ল।

কাকাবাবু বললেন, সাবধান, একটুও নড়বি না। হরিণগুলোকে তাড়া করে পেছনে মানুষ আসতে পারে।

কিন্তু কোনও মানুষ এল না। হরিণগুলো এমনিই দৌড়চ্ছে। সন্তু বোধহয় ইচ্ছে করলে একটাকে ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন সে সময় নয়।

কাকাবাবু বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আমাদের চেষ্টা করতে হবে জারোয়াদের চোখ এড়িয়ে যাতে সারা দ্বীপটা একবার ঘুরে দেখে আসা যায়। তারপর কাল সকালেই দাশগুপ্ত পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবে, তখন আমরা চলে যাব। চলো এগেই

চারদিক দেখতে দেখতে খুব সাবধানে ওরা এগোতে লাগল। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। খানিকটা দুরে একটা খুব আস্তে শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হয় জলের শব্দ। নিশ্চয়ই ওখানে কোনও ঝানা আছে। সন্তুর মনে পড়ে গেল তার খুব তেষ্টা পেয়েছে। তার গায়ের সমস্ত জামা-প্যান্ট ভিজে। জুতোটাও ভিজে থপথপ করছে। কিন্তু তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ।

কাকাবাবু সেই জলের শব্দটা লক্ষ করেই এগুতে লাগলেন। হঠাৎ সন্তু কিসে একটা হোঁচটি খেল।

নিচু হয়ে দেখল, একটা মানুষ। প্ৰকাণ্ড লম্বা একটা লোক, গায়ে কোনও জামা-কাপড় নেই। লোকটা মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো খোলা।

সন্তু ভয়ে আঁ করে শব্দ করতে গিয়ে নিজেই মুখে হাত চাপা দিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

সন্তু কোনও উত্তর দিল না। ভয়ে তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কাকাবাবুও এবার লোকটাকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রিভলভারটা উঁচিয়ে ধরলেন সেদিকে।

লোকটি কিন্তু একটুও নড়ল-চড়ল না, কোনও কথাও বলল না। শুধু খোলা দু, চোখে যেন কটমট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

কাকাবাবু বুকে লোকটির গায়ে হাত দিয়েই বললেন, এ তো মরে গেছে দেখছি।

কাকাবাবু এবার লোকটির পাশে বসে পড়লেন। লোকটির গায়ে কোনও দাগ নেই, কোনও ক্ষত নেই, তাহলে মরুল কী করে? লোকটার মাথার চুল নিগ্রোদের মতন, কুচকুচে কালো রঙ, হাত দুটো বেশ লম্বা, আর বুকখানা যেন মনে হয়। পাথরের। এমন একটা জোয়ান লোক এমনি-এমনি মরে গেল?

কাকাবাবু লোকটাকে উল্টে দিলেন। তখন দেখা গেল, তার ঘাড়ের কাছে অনেকখানি রক্ত জমে আছে। সেখানে একটা গর্তের মতন।

কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, গুলি! এর ঘাড়ের মধ্যে গুলি ঢুকে গেছে। সর্বনাশ।

সন্তু এত কাছ থেকে কোনওদিন কোনও মরা মানুষ দেখেনি। সে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একটাও কথা বলতে পারছে না।

কাকাবাবু বললেন, একে গুলি করে মেরেছে। তার মানে সেই সাহেবগুলোও এই দ্বীপে নেমেছে। আমি বলেছিলাম না? ওরা আমাদের আগে এসে পৌঁছে গেছে। সন্তু, আমাকে টেনে তোলা!

কাকাবাবুর একটা পা কাটা বলে উনি একবার বসে পড়লে চট্ট করে নিজে থেকে উঠতে পারেন না। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, সন্তু সেই হাত ধরে টেনে তুলল তাঁকে।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের আবার চট করে লুকিয়ে পড়তে হবে। এখন আমাদের দু দিক থেকে বিপদ। জারোয়ারা দেখলে মারবে, আর সাহেবগুলো দেখলেও আমাদের ছেড়ে দেবে না।

দুজনেই একটা ঝোপের আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোথাও কোনও শব্দ নেই, শুধু দুরের একটা ঝর্নার জলের শব্দ ছাড়া। তবু মনে হচ্ছে যেন খুব কাছাকাছি কেউ দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করছে। সব দিকে এমন ঘুটফুটে অন্ধকার যে, কিছুই দেখা যায় না। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না।

সন্তুর গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে। জলতেষ্টায় মনে হচ্ছে যেন বুকটা ফেটে যাবে। ঘাড়ের কাছে অনবরত কটা মশা কামড়াচ্ছে। একবার সে চটাস করে মশা মারল।

কাকাবাবু বললেন, উঁহু! শব্দ করো না।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি জল খাব।

কাকাবাবু বললেন, আমারও জলতেষ্টা পেয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও তো কিছু লাভ নেই। চলো, আমরা আস্তে আস্তে ঝর্নাটার দিকে এগোই।

অন্ধকারে কোথায় পা পড়ছে, তা বোঝবার উপায় নেই। সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখে নিতে হচ্ছে সামনে কোনও বড় গাছ আছে কি না। তাও গাছে মাথা ঠুকে গেল। কয়েকবার। কাকাবাবুর ক্রাচটা প্রায়ই জড়িয়ে যাচ্ছে বুনো লতায়, সেগুলো টেনে-টেনে ছিড়তে হচ্ছে।

বেশ খানিকটা যাবার পর ঝর্নাটা চোখে পড়ল। এখানে গাছপালা কিছু কম বলে চাঁদের আলো এসে জলে পড়েছে, তাই অন্ধকার এখানে পাতলা। বনটি বেশ চওড়া, জলে স্রোত আছে।

এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে বিচ্ছিরি লাগছিল, তাই সন্তু দৌড়ে চলে গেল ঝর্নাটার কাছে। ঝর্নার ধারে বালি ছড়ানো, বেশ ঝকঝকে, পরিষ্কার। সন্তু জলের মধ্যে এক পা দিয়েই আবার উঠে এল তাড়াতাড়ি। এত জোর স্রোত যে, তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। সে উবু হয়ে মাথাটা কুঁকিয়ে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল খানিকটা। জলটা ঠাণ্ডা নয়, একটু-একটু গরম, আর স্বাদটাও কষা-কষা। তবু পেট ভরে জল খেয়ে নিল সন্তু। সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। এতক্ষণ খিদের কথা মনেই পড়েনি।

কাকাবাবু ঝর্নার ধারে বসতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। জলের মধ্যে গিয়ে পড়ার আগেই সন্তু তাঁর পিঠের জামা টেনে ধরল। তাতে কাকাবাবু নিজেকে সামলে নিতে পারলেন বটে, কিন্তু একটা সাঙ্ঘাতিক বিপদ ঘটে গেল। হুমড়ি খাবার সময় কাকাবাবুর ডান হাতের ক্রাচটা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল জলে, আর অমনি স্রোতে সেটা ভেসে গেল। সন্তু বনের ধার দিয়ে খানিকটা দৌড়ে গেল তবু সেটাকে ধরতে পারল না, একটু পরেই একটা দপ্ত বড় পাথর, সেটা ডিঙানো যায় না। ডান পাশ দিয়ে ঘুরে যখন আবার ঝর্নাটার কাছে এল, তখন ক্রাচটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সন্তু ফিরে আসতেই কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, পেলি না?

না।

কাকাবাবু হতাশভাবে বললেন, যাঃ, কী হবে এখন? ক্রাচ ছাড়া কাকাবাবু এক পাও চলতে পারেন না। বাঁ হাতেরটা রয়েছে বটে, কিন্তু একটা নিয়ে হাঁটতে গেলে একটু বাদেই বগলে দারুণ ব্যথা হয়ে যায়। এমনিতেই বিপদে পড়লে কাকাবাবু দৌড়তে পারেন না, এরপর যদি হাঁটতেও না পারেন, তাহলে কী হবে?

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর আজিলা ভরে খানিকটা জল নিয়ে এলেন মুখের কাছে। প্রথমে একটু জিভ ঠেকিয়ে স্বাদ নিলেন, তারপর বললেন, এটা একটা হট ওয়াটার স্ক্রিপ্রং। কাছাকাছি কোনও জায়গায় পাহাড় ফুড়ে বেরিয়েছে। জলে অনেকটা গন্ধক আর লোহা মেশানো আছে। তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি হবে না, এ-জল খাওয়া যায়।

সন্তুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন কাকাবাবু। তারপর সন্তুর কাঁধে ভর দিয়েই এগোতে লাগলেন ঝর্নার ধার দিয়ে। একটু পরে বললেন, কোনও গাছের ডাল ভেঙে একটা লাঠি বানিয়ে নিতে হবে অন্তত।

সন্তু বলল, আমি এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি।

কাছেই একটা গাছের ডাল ধরে সে টান মারল। সেটা কিন্তু ভাঙল না। দারুণ শক্ত। সন্তু ডালটা ধরে ঝুলে পড়ল। সেটা নুয়ে পড়ছে, কিন্তু ভাঙছে না কিছুতেই।

কাকাবাবু বললেন, ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। এখানকার বেশির ভাগ গাছই প্যাডোক কিংবা সিলভার উড, খুব ভাল কাঠ হয়।

সন্তুর পকেটে একটা ছোট্ট ছুরি আছে। তাতে বেশি মোটা ডাল কাটা যাবে না। তবু সে চেষ্টা করতে গেল, সেই সময় শুনতে পেল একটা অদ্ভুত শব্দ। কেউ যেন খুব জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। অনেকখানি রাস্তা দৌড়ে এলে যে-রকম নিশ্বাস পড়ে।

দুজনেই কান খাড়া করে শুনল আওয়াজটা। এক-একবার থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে। খুব কাছেই। শব্দটা লক্ষ করে এগিয়ে যেতেই দেখল একটা লোক শুয়ে আছে মাটিতে। তার দেহটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে, আর মুখটা বেরিয়ে আছে বাইরে। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঝর্নাটার দিকে আর ঐ রকম নিশ্বাস ফেলছে।

এর চেহারাও আগের লোকটার মতন, কিন্তু জ্যোৎস্নার আলোয় বোঝা যায়, এর সারা গায়ে রক্ত মাখা।

কাকাবাবু বললেন, এর গায়েও গুলি লেগেছে। কিন্তু লোকটা এখনও বেঁচে আছে।

ওরা গিয়ে লোকটার কাছে দাঁড়াল। লোকটা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ওদের দিকে, সেই দৃষ্টিতে দারুণ ঘৃণা।

কাকাবাবু বললেন, আহা রে, লোকটা গড়িয়ে গড়িয়ে এতটা এসেছে। জল খাবার জন্য। আর এগোতে পারেনি। সন্তু, ওকে একটু জল এনে দাও তো!

সন্তু আজিলা করে খানিকটা জল নিয়ে এসে লোকটার মুখের ওপর ঢেলে দিল। লোকটা হাঁ করে আছে। যেটুকু জল মুখের বাইরে পড়েছে, তা জিভ দিয়ে চোটে নিচ্ছে। সন্তু তিন-চারবার ওকে জল এনে এনে দিল। কাকাবাবু ততক্ষণে লোকটার পাশে বসে পড়েছেন।

লোকটার পেটে আর কাঁধে আর পায়ে তিনটে গুলি লেগেছে। এর মধ্যে পেটের জখমটাই সাঙ্ঘাতিক।

কাকাবাবু বললেন, এখনও চেষ্টা করলে লোকটাকে বাঁচানো যায়।

তিনি পকেট থেকে রুমাল বার করে তুলোর মতন পেটের ক্ষতটাতে গুঁজে দিলেন। তারপর দু পায়ের মোজা খুলে ফেলে সেগুলো ছিঁড়ে গিঁট বেঁধে

সন্তু পাশে বসে আছে। হঠাৎ লোকটা একটা হাত তুলে সন্তুর গলা টিপে ধরল। সন্তু কিছু বোঝবার আগেই আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতন বসে গেল তার গলায়। লোকটার শরীর থেকে কতখানি রক্ত বেরিয়ে গেছে, তবু তার গায়ে অসম্ভব জোর। সন্তু দু হাত দিয়ে টেনেও লোকটার হাত ছাড়াতে পারছে না। তার দম আটকে আসছে, সে এবার মরে যাবে! সে কোনও শব্দ করতে পারছে। না। কাকাবাবু অন্যদিকে ফিরে এক মনে মোজা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে ব্যাণ্ডেজ বানাচ্ছেন, তিনি কিছু টেরও পেলেন না।

প্ৰাণপণ চেষ্টায় সন্তু একবার শব্দ করে উঠল, আঁ আঁ–

কাকাবাবু পেছন ফিরে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রিভলভারের বাঁট দিয়ে খুব জোরে মারলেন লোকটার হাতে। লোকটা হাত ছেড়ে দিল, সন্তু ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।

লোকটা তখন মুখখানা উঁচু করে কাকাবাবুর একটা হাত কামড়ে ধরল। কাকাবাবু সব কিছু ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন উঃ করে। তারপর অন্য হাত দিয়ে রিভলভারের বাঁটটা ঠিকে দিলেন লোকটার মাথায়। লোকটার কামড় আলগা হয়ে গেল, ঘাড় কাত করে চোখ বুজল।

কাকাবাবু হামাগুড়ি দিয়ে ঝর্না থেকে জল এনে এনে ঝাপটা দিতে লাগলেন সন্তুর চোখ-মুখে। আর ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু!

একটু বাদে সন্তু চোখ মেলল। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে যেতেই কাকাবাবু বললেন, থাক থাক উঠতে হবে না। একটু শুয়ে থোক। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কাকাবাবু আবার হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে জল এনে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন সেই লোকটির মুখে। সে কিন্তু আর চোখ খুলল না।

কাকাবাবু বললেন, লোকটা মরেই গেল নাকি? আমি ওকে মেরে ফেললাম?

তিনি লোকটার নাকের কাছে হাত নিয়ে বললেন, না, এখনও নিশ্বাস পড়ছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। থাক।

এবার তিনি লোকটার ক্ষত জায়গাগুলো মুছে দিলেন। কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে রস লাগিয়ে দিলেন সেখানে। তাঁর মোজার ব্যাণ্ডেজটা বেঁধে দিলেন পেটে। তারপর বললেন, পেট থেকে যদি রক্ত পড়া বন্ধ হয়, তাহলে বেঁচেও যেতে পারে।

সন্তু ততক্ষণে উঠে বসেছে। এখনও তার মাথা বিম-ঝিম করছে। সে ভেবেছিল সে মরেই যাবে। গলাটা ফুলে গেছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন লাগছে? কষ্ট হচ্ছে?

সন্তু বলল, না।

বাবাঃ, কী সাঙ্ঘাতিক?

সন্তু খানিকটা অভিমানের সঙ্গে বলল, আমি ওকে জল খাওয়ালাম, তবুও আমাকে মারতে চাইল কেন? আমরা তো ওকে বাঁচাবারই চেষ্টা করছিলাম।

কাকাবাবু বললেন, ওরা আমাদের বিশ্বাস করে না। বাইরের যে-কোনও লোকই ওদের কাছে শক্ৰ।

আমার আর এখানে একটুও থাকতে ভাল লাগছে না।

কাল সকালেই আমরা চলে যাব। পুলিশের বোট আসবে।

যদি না আসে?

আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে। ওরা কি আমাদের ভুলে যেতে পারে? আমরা রাত্তিরটাতে সারা দ্বীপটা একবার ঘুরে দেখে আসব। রাত্তিরেই সুবিধে। তারপর ভোরবেলা আমরা সমুদ্রের ধারে লুকিয়ে বসে থাকব। লঞ্চ এলেই উঠে পড়ব চট্‌ করে

এত রকম বিপদের পরও কাকাবাবু দ্বীপটা ঘুরে দেখতে চান। ওঁর উৎসাহ কিছুতেই কমে না। ভয়ডর একটুও নেই। একটা ক্রাচ নেই, নিজে হাঁটতে পারছেন না, তবু এখনও হেঁটে বেড়াবেন।

সন্তু বলল, আমরা এখনি সমুদ্রের ধারে চলে যাই না কেন?

কাকাবাবু বললেন, বাঃ গোটা দ্বীপটা না-দেখেই চলে যাব? তাহলে এলাম কেন? সবটা না-দেখে ফিরব না।

আবার তিনি সন্তুর কাঁধ ধরে হাঁটতে লাগলেন। ঝর্নার পাশ দিয়ে-দিয়েই। কারণ বালির ওপরটা বেশ পরিষ্কার। পায়ে লতাপাতা আটকে যায় না। জ্যোৎস্নায় সামনেটাও দেখা যায়।

তবু বেশি দূর আর এগোনো হল না। খানিকটা বাদে হঠাৎ দেখা গেল, বনের মধ্যে এক জায়গায় জ্বলে উঠল একটা টর্চের আলো।

কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুকে এক ধাক্কা দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লে মাটিতে। গড়াতে-গড়াতে ঝর্নার ধার থেকে সরে গিয়ে ঢুকে পড়লেন একটা ঝোপের মধ্যে। সন্তুও চলে এল কাকাবাবুর পাশে-পাশে।

অমনি গুড়ুম-গুড়ুম করে দুটো গুলির শব্দ হল।

সেই গুলির শব্দ যেন প্রতিধ্বনি তুলল। জঙ্গলের মধ্যে। যেন দূরে কোনও পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে শব্দগুলো ফিরে আসছে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই। সন্তু প্ৰায় নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে থাকে, কিন্তু তাব বুকের মধ্যে টিপটপ শব্দ হচ্ছে, যেন সেটাই বাইরের লোক শুনে ফেলবে।

একটু বাদে শোনা গেল পায়ের শব্দ। একসঙ্গে অনেক লোকের। ভাল করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, যারা হাঁটছে, তাদের খালি পা নয়, তারা জুতো পরে আছে। লোকগুলো আসছে। এদিকেই। মাঝে-মাঝে টর্চের আলো জ্বলেই নিভে যাচ্ছে। তারপর প্রায় সাত-আটজন লোক এসে দাঁড়াল কানটির ধারে। এরা সবাই সাহেব। না, সবাই নয়, একজনকে মনে হয় পাঞ্জাবী শিখ। তারা টর্চ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগল।

একজন ইংরিজিতে বলল, নিশ্চয়ই এখানে একটু আগে কেউ ছিল। আমি গলার আওয়াজ শুনেছি।

আর-একজন বলল, এই দ্যাখো, বালিতে পায়ের ছাপ।

আবার তারা টর্চের আলো ফেলল ঝর্নার দু দিকে।

কাকাবাবু আর সন্তু যদিও একটা বেশ ঘন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে আছে, কিন্তু সেটা ঝনা থেকে খুব দূরে নয়। ঐ সাহেবরা একটু ভাল করে খুঁজলেই সন্তয়া ধরা পড়ে যাবে। কাকাবাবু একহাতে রিভলভারটা তাক করে ধরে, অন্য হাতটা তার ওপর চাপা দিয়ে রেখেছেন।

সাহেবদের মধ্যে দুজনের হাতে রাইফেল, বাকিদের হাতে রিভলভার। আর পাঞ্জাবীর মতন চেহারার লোকটির হাতে টর্চ।

সন্তু টের পেল তার পায়ের কাছে কী যেন একটা নড়ছে। একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা জিনিস তার গায় লাগছে। সাপ নাকি? কাকাবাবু যদিও বলেছিলেন যে, এখানকার সাপের বিষ নেই, কিন্তু সে-কথা সন্তুর তখন মনে পড়ল না। সে তাড়াতাড়ি পা-টা সরিয়ে নিল। এবার পা-টা পড়ল বেশ বড় একটা ঠাণ্ডা জ্যাত জিনিসের ওপর। দারুণ ভয় পেয়েও সন্তু মুখ দিয়ে কোনও শব্দ করল না বটে, কিন্তু পা-টা আবার সরিয়ে নিতেই শুকনো পাতায় খচমচ শব্দ হল।

সঙ্গে-সঙ্গে টর্চের আলোটা ঘুরে গেল এদিকে।

কিন্তু সন্তুরা ধরা পড়ার আগেই একটা সাহেব ওয়া বলে চেঁচিয়ে উঠল। আর একজন উত্তেজিতভাবে বলল, ওরা আবার তীর ছুঁড়ছে। টাৰ্চটা শিগগির নেভাও, বোকা!

তারপরই একসঙ্গে ছটা বন্দুক পিস্তল গর্জে উঠল। সন্তুরা বুঝতে পারল, ওদের পিছন দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে। কয়েকটা তীর গাছের ডালে লেগে আটকে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। জারোয়াদের সঙ্গে সাহেবদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সন্তুরা পড়ে গেছে মাঝখানে। যে-কোনও দিক থেকে গুলি কিংবা তীর এসে লাগতে পারে ওদের গায়ে। কিন্তু এখন কিছুই করার উপায় নেই।

সাহেবরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, তারা এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে আর গুলি চালাচ্ছে। জারোয়ারা যাতে তাদের ওপর টিপ না করতে পারে। এর মধ্যে এও গোলাগুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে কোথা থেকে বেরিয়ে পড়ল এক পাল গো শুয়োর। তারা জীবনে কখনও এরকম শব্দ শোনেনি-একসঙ্গে হুড়মুড় করে ছুঁটে গেল ঝর্নার ধার দিয়ে। প্ৰায় পঞ্চাশ-ষাটটা।

যুদ্ধ থেমে গেল মিনিট দিশেকের মধ্যেই। জারোয়ারা তীর ছোঁড়া বন্ধ করে পিছিয়ে যাচ্ছে।

একজন সাহেব বলল, লেটুস মুভ!

আর একজন সাহেব বলল, আমার গায়ে তীর লেগেছে। শিগগির তুলে দাও। ইঞ্জেকশন, ইঞ্জেকশন কার কাছে?

তারপর কিছুক্ষণ ফিসফাস। একটা কাচ ভাঙার শব্দ হল। একটু পরে বোঝা গেল, ওরা চলে যাচ্ছে।

আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর কাকাবাবু উঠে বসলেন। সন্তু উঠে প্ৰথমেই দেখল, তার পায়ের কাছের জিনিসটা কী। না, সাপ নয়, একটা মস্ত বড় ব্যাঙ, প্রায় আধ কিলো ওজন হবে। সন্তু জুতোর ঠোকর দিয়ে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিল।

কাকাবাবু কোট থেকে মাটি আর শুকনো ডালপাতা ঝেড়ে ফেললেন। তারপর বললেন, আমরা দুজন সাহেবকে পালাতে দেখেছিলাম, কিন্তু এখানে এরা ছজন। তার মানে আগে থেকে কয়েকজন এসে অন্য দ্বীপে লুকিয়ে ছিল। আশ্চর্য জাত!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আস্তে কথা বলো, জারোয়ারা যদি কাছেই থাকে?

কাকাবাবু বললেন, না, সে সম্ভাবনা নেই। জারোয়ারা পালিয়েছে। তারা ভয় পেয়েছে। এরকম জিনিস কখনও তারা দেখেনি।

কী? বন্দুক? আগে বন্দুক দেখেনি?

না, বন্দুক নয়। আমি যতদূর শুনেছি, জারোয়ারা গুলি বন্দুককে ভয় পায় না। তারা মরতেও ভয় পায় না। কিন্তু এরকম ব্যাপার ওরা কখনও দেখেনি আগে।

কোন ব্যাপার? তুইও বুঝতে পারলি না। একজন সাহেব যে ইঞ্জেকশন ইঞ্জেকশন বলে চ্যাঁচাল, সেটা শুনিসনি?

হ্যাঁ, শুনেছি।

এবার সাহেবরা আটঘটি বেঁধে এসেছে। সাহেবের জাত তো, কোনও ত্রুটি রাখে না। সবাই জারোয়াদের বিষাক্ত তীরকে ভয় পায়। ঐ তীর গায়ে বিধালে মানুষ মরে যায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, বিষেরও ওষুধ আছে। এমন কী, সাপের বিষও সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ দিয়ে নষ্ট করা যায়। ঐ সাহেবরা সেই ওষুধ নিয়ে এসেছে। কারুর গায়ে তীর লাগলেই ওষুধের ইঞ্জেকশন নিয়ে নিচ্ছে একটা করে। তীর খেয়েও কোনও সাহেব মরছে না, এই দেখে ভয় পেয়ে গেছে জারোয়ারা। এবার ওরা হরবেই।

কাকাবাবু হামাগুড়ি দিয়ে ঝর্নার কাছে এগিয়ে গেলেন। এদিক-ওদিক হাতড়িয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলেন একটা তীর। খুব সাবধানে তীরটার পেছনটা ধরে সেটাকে খুব সাবধানে ধুয়ে নিলেন জলে। তারপর সেটা তুলে বললেন, এই দ্যাখ। এমনিতে এটা এমন কিছু সাঙ্ঘাতিক অস্ত্র নয়।

সন্তু দেখল, তীরটা সত্যিই অন্যরকম। অনেকটা খেলবার তীরের মতন। তীরের ডগায় যে লোহার ফলক থাকবার কথা, এতে তা নেই। তীরটা বাঁশের, মুখটা খুব ভূঁচালো। তীরের পেছন দিকটায় পালকও লাগানো নেই।

কাকাবাবু বললেন, যদি বিষ না থাকে, তাহলে এরকম তীর আট-দশটাও যদি কারুর গায়ে বেঁধে, তাহলেও এমন-কিছু লাগবে না। বিষের জন্য সাহেবরা ইঞ্জেকশন নিয়ে নিচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে কী আর এমন বিষ পাওয়া যাবে? খুব সম্ভব জারোয়ারা ক্টিকনিন ধরনের বিষ ব্যবহার করে। সঙ্গে-সঙ্গে অ্যান্টিডোট নিলে সে-বিষ কোনও ক্ষতিই করতে পারে না। সাহেবরা বুদ্ধি করে সেই ওষুধ সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আমাদেরও আনা উচিত ছিল।

কাকাবাবু সেই তীরটা নিজের ব্যাগের মধ্যে ভরে নিলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঐ ছ-সাতটি সাহেব মিলে পাঁচ-ছাঁশো জারোয়াকে মেরে ফেলতে পারে। আমাদের উচিত এক্ষুনি পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে গিয়ে পুলিশকে এই খবর জানানো?

কিন্তু পোর্ট ব্লেয়ারে ফেরা হবে কী করে? সন্তু সেই কথাই ভাবল। এই অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে সমুদ্রের দিকের রাস্তা খুঁজে পাওয়াই প্রায় অসম্ভব। সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছলেই বা কী লাভ? লঞ্চ কিংবা মোটরবোট কোথায় পাওয়া যাবে? দাশগুপ্তরা তো ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। কাল যদি দাশগুপ্ত পুলিশ সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে–

কাকাবাবু অনেকটা আপন মনেই বললেন, সাহেবরা এত আটঘটি বেঁধে এখানে এসেছে কেন? নিশ্চয়ই এখানে সাঙ্ঘাতিক কোনও দামি জিনিস ওআছে। এর আগে-আগে এসেছে বৈজ্ঞানিকরা। কিন্তু এদের বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয় না, কোনও বৈজ্ঞানিক গুলি করে মানুষ মারে না। এরা নিশ্চয়ই ডাকাত-টাকাত হবে।

তারপর তিনি সন্তুর দিকে ফিরে উত্তেজিতভাবে বললেন, সন্তু, তোকে একটা কাজ করতে হবে। এর জন্য খুব সাহসের দরকার। ভয় পেলে একদম চলবে না। তুই সমুদ্রের ধারে চলে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাক। এখন জারোয়ারা সমুদ্রের ধারে পাহারা দেবার সময় পাবে না। তবু তুই খুব সাবধানে থাকবি। দাশগুপ্ত কাল কোনও সময় মোটরবোট নিয়ে আসবেই। তাকে সব বুঝিয়ে বলবি। দরকার হলে পঞ্চাশ-যাটজন পুলিশ নিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে যেন। ঐ সাহেবগুলোকে আটকাতেই হবে। যে-কোনও উপায়ে হোক। যা, তুই এগিয়ে পড়।

সন্তু অবাক হয়ে বলল, আমি এক যাব?

হ্যাঁ।

আমি এক কেন যাব? না, তা হয় না।

বেশি কথা বলিস না। তোকে একাই যেতে হবে।

তুমি এখানে থাকবে? তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে।

সহজে পারবে না। আমি লুকিয়ে থাকব।

কাকাবাবু, আমি তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না। মা বলে দিয়েছেন, সব সময় তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে।

সন্তু, অবুঝ হয়ো না। এখানে এখন দুজনের থাকার কোনও মনে হয় না। তাহলে দুজনেই মরব। আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, আমি মরে গেলেও কী এমন ক্ষতি আছে! মানুষ তো এক সময় না এক সময় মরেই! তবু মরার আগে এই রহস্যটা জেনে যাওয়ার চেষ্টা করব। তোমাকে বাঁচতেই হবে। তাছাড়া, তুমি গিয়ে দাশগুপ্তকে খবর দিলে তারা হয়তো আমাকে বাঁচাবার চেষ্টাও করতে পারে।

কিন্তু তুমি তো একটা ক্ৰাচ নিয়ে বেশিক্ষণ হাঁটতেই পারবে না।

আমি রাত্তিরটা এখানেই ঝোপের মধ্যে শুয়ে থাকব। সকালবেলা একটা গাছের ডাল জোগাড় করে নেব ঠিকই। আমার অসুবিধে হবে না। সমুদ্রের ধারটাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ।

কিন্তু আমি অন্ধকারের মধ্যে সমুদ্রের ধারে যাব। কী করে? রাস্তা হারিয়ে ফেলব।

সমুদ্রের কাছে যাওয়া তো খুব সোজা। এই ঝর্নাটা যখন পাওয়া গেছে। এটার ধার দিয়ে ধার দিয়ে গেলেই হবে। এই ঝর্নাটা নিশ্চয়ই সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। খুব সাবধানে যাবে কিন্তু।

সন্তুর বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। সে কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, কাকাবাবু, আমি যাব না। আমি তোমাকে একা ফেলে কিছুতেই যাব না।

কাকাবাবু সন্তুর মাথায় হাত রেখে ভারী গলায় বললেন, সন্তু, এবার তোমাকে এখানে আনাই ভুল হয়েছে। এতটা বিপদের কথা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখানে আমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকা খুবই বিপজ্জনক। পুলিশকে একটা খবর দেওয়া খুবই দরকার।

তুমিও চলে আমার সঙ্গে।

আমি গেলে চলবে না। আমি ঐ সাহেবগুলোর ওপর নজর রাখতে চাই।

তুমি এক ওদের সঙ্গে কী করবে? যদি ওরা আবার এদিকে এসে পড়ে?

আমি লুকিয়ে থাকব, ওরা আমাকে দেখতে পাবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি এখানেই থাকব, অন্য কোথাও যাব না।

তাহলে শুধু শুধু কেন একলা বসে থাকবে। না কাকাবাবু, তুমি চলো আমার সঙ্গে। আমি এক কিছুতেই যাব না।

কাকাবাবু এবার গভীর কড়া গলায় বললেন, সন্তু, তোমাকে যেতে বলছি, যাও! তুমি জানো না, আমার কথার নড়াচড় হয় না? আমি অনেক ভেবেচিন্তেই তোমাকে যেতে বলেছি। আমি এখানেই থাকব। যাও, এক্ষুনি রওনা হও!

সন্তু আর কথা বলার সাহস পেল না। এক পা এক পা করে চলতে শুরু করল। কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল, কিন্তু একটু বাদেই আর কাকাবাবুকে দেখতে পেল না। কাকাবাবুঝোপের অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। সন্তুও বড় পাথরটার ওপাশে চলে গেল।

ঝর্নার পাশে বালির ওপর হালকা চাঁদের আলো, তাতে সন্তুর ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াটাই তার সঙ্গী। বন এত নিস্তব্ধ যে, এমনিতেই গা ছমছম করে। কোথায় আড়ালে গাছের ওপর জারোয়ারা লুকিয়ে আছে কে জানে। যে-কোনও সময় একটা তীর এসে গায়ে লাগতে পারে।

সন্তু তাড়াতাড়ি ঝর্নার পাড় থেকে সরে জঙ্গলে চলে গেল। ঝর্নার পাশে থাকলে দূর থেকেও তাকে দেখা যাবে। কিন্তু বনের মধ্যে আসার পর ছায়াটাও আর তার সঙ্গী রইল না।

মনের মধ্যে ভীষণ খারাপ লাগছে। কাকাবাবুকে এরকমভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া কি ঠিক হল? একলা এই ভয়ংকর জঙ্গলের মধ্যে উনি কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবেন? নিজে ভাল করে হাঁটতেও পারেন না। অথচ কাকাবাবু যে কিছুতেই শুনবেন না। অন্য কারুর কথা।

ঝর্নাটা ক্রমশই চওড়া হচ্ছে। এখানে হাঁটাও খুব শক্ত। মাঝে-মাঝেই কাঁটাঝোপ। একটা বড় গাছের গায়ে একবার সন্তু হাত দিতেই তার হাত ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। গাছের গায়েও কাঁটা। খালি তার ভয় হচ্ছে। হোঁচটি খেয়ে পড়ে না যায়। তাকে সমুদ্রের ধারে পৌঁছতেই হবে।

হঠাৎ একটা আওয়াজে সে দারুণ চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। শব্দটা এমনই বিকট যে, শরীরের রক্ত প্ৰায় জল হয়ে যায়। প্ৰথমে মনে হল, যেন একসঙ্গে দু-তিনটে পাখি ডেকে উঠল। কিন্তু কোনও পাখি এরকম বিশ্ৰী সূরে ডাকে? আর এত জোরে? শব্দটা এই রকম : কিলা কিলা কিলা কিলা কিলা কিলা!

সন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু বাদেই সেই রকম আবার কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দ উঠল। ডান দিক থেকে। আগের শব্দটা এসেছিল বাঁ দিক থেকে। এবার মনে হল, যেন কয়েকজন লোক উলু দিচ্ছে। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গা শিউরে ওঠে।

তারপর চারদিক থেকে কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দ উঠল। যেন শত শত লোক একসঙ্গে চিৎকার করছে। বনের সব দিক থেকে ঐ শব্দ করতে করতে কারা ছুটে আসছে। এর মধ্যেই দুমদুম করে গুলির শব্দ শুরু হয়ে গেল। তবু ঐ কিলা কিলা থামল না। সন্তু একটা পাথরের আড়ালে গুটিসুট মেরে বসে রইল। তার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে। তার মনে হচ্ছে যেন নরকের সব প্রাণীরা জেগে উঠে বন ঘিরে ধরছে।

বন্দুকের গুলির শব্দ কিন্তু একটু বাদেই থেমে গেল, কিন্তু কিলা কিলা শব্দ থোমল না। এবার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঐ রকম শব্দ করে এক জায়গায় লাফাচ্ছে। তারপর শব্দটা একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল।

ব্যাপারটা কী হল, তা বোঝার চেষ্টা করল। সন্তু। তার শরীর একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দু-হাত দিয়ে মুখটা ঘষতে লাগল জোরে জোরে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গুড়ি মেরে ঝিনার পাশে এসে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল অনেকটা। তারপর তার পেট ব্যথা করতে লাগল।

সারাদিন কিছুই খায়নি, পেট খালি। শুধু ঝর্নার জল খাচ্ছে। জলেও কষা-কষা স্বাদ। জলের জন্যই পেট ব্যথা করছে কি না কে জানে।

কিলা কিলা আওয়াজটা এখনও শোনা যাচ্ছে, কিন্তু অনেকটা দূরে চলে গেছে। এবার। সন্তুর মনে হল যে, নিশ্চয়ই একসঙ্গে একশো-দুশো জারোয়া এসে সাহেবদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সাহেবরা গুলি করেও আটকাতে পারেনি। এবার ওরা সাহেবগুলোকে ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তাহলে কাকাবাবুর কী হল? ওরা যদি কাকাবাবুকেও ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে? কিংবা যদি কাকাবাবুকে মেরে ফেলে?

সন্তুর ভীষণ ইচ্ছে হল, কাকাবাবুকে আর-একবার দেখে আসে। যদিও কাকাবাবু তাকে হুকুম দিয়েছেন সমুদ্রের কাছে যেতে, কিন্তু সন্তু তক্ষুনি যেতে পারবে না কিছুতেই। সে আবার উল্টে দিকে ফিরল।

এখন আর সন্তু গ্ৰাহ্যই করছে না কেউ তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে কি না। সে বালির ওপর দিয়ে তীরের মতন ছুটতে লাগল। পেটের ব্যথাটা ক্রমেই বাড়ছে, সে দু-হাতে চেপে ধরে রাখল পেট।

সেই ঝোপটার কাছাকাছি এসেই সে ডাকল, কাকাবাবু কাকাবাবু!

কোনও উত্তর পেল না।

সন্তু হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। ঝোপের মধ্যে। কাকাবাবু সেখানে নেই। এর মধ্যে তিনি কোথায় গেলেন? কাকাবাবু যে বলেছিলেন, এ-জায়গাটা ছেড়ে যাবেন না? সন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে কাকাবাবুর নাম ধরে ডাকতে লাগল। কাকাবাবুর কোনও চিহ্নই নেই। সন্তু চলে এল ঝর্নার পাশে। দূরে কিলা কিলা শব্দ শোনা যাচ্ছে, এখন শব্দটা এক জায়গায় গিয়ে থেমেছে মনে হচ্ছে।

সন্তুর দৃঢ় বিশ্বাস হল জারোয়ারা কাকাবাবুকেও ধরে নিয়ে গেছে। সে আর কোনও কিছুই চিন্তা করল না, সেই শব্দটা লক্ষ্য করে ছুটল।

অন্ধকারের মধ্যে সন্তু ছুটছে তো ছুটছেই। নদীর ধারে বালির ওপরে মাঝে মাঝে বড়-বড় পাথর আর কাঁটাগাছের ঝোপ, কিন্তু সন্তু কোনও বাধাই মানছে। না। কাকাবাবুকে ফেলে রেখে সে যাবে না কিছুতেই। যদি কোনওক্রমে সে এখান থেকে প্ৰাণে বেঁচে ফিরতেও পারে, তাহলে বাড়িতে মা, বাবা, আর সবাই বলবেন, তুই কাকাবাবুকে দ্বীপে রেখে নিজে চলে এলি? তুই এত কাপুরুষ? না, যদি মরতে হয় তো কাকাবাবুর সঙ্গে সন্তু নিজেও মরবো।

কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দটা এখনও দূরে শোনা যাচ্ছে। ঐ শব্দটা শুনলেই ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যায়। মানুষের গলার আওয়াজ যে এরকম হতে পারে, নিজের কানে না শুনলে সন্তু বিশ্বাস করত না কিছুতেই। যেন মুখের মধ্যে একটা লোহার জিভা নিয়ে কেউ চ্যাঁচাচ্ছে!

সাহেবরা এতগুলি বন্দুক নিয়ে এসেও হেরে গেল জারোয়াদের কাছে। ওরা একসঙ্গে দু-তিনশো জন এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাহেবদের ওপর। এখন বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। কাকাবাবু কী করে পড়ে গেলেন ওদের মধ্যে? কাকাবাবুর একটা পা নেই, একটা ক্রাচও নদীর জলে ভেসে গেছে, তিনি হাঁটতে পারবেন। না। ওরা কি কাকাবাবুকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছে? ইস, কত কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কাকাবাবু যদি এর মধ্যে মরে গিয়ে থাকেন?

সন্তু আরও জোরে দীেড়তে গেল। তার পেটের মধ্যে দারুণ ব্যথা করছে, দম ফুরিয়ে আসছে, তবু সে কিছুতেই থামবে না। কিন্তু একটু পরেই সন্তু একটা বড় পাথরে দারুণ জোরে হোঁচটি খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল। আর একটা পাথরে তার মাথাটা এমন জোরে ঠুকে গেল যে, সে সঙ্গে-সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে cकाढळे।

অজ্ঞান অবস্থায় সন্তু উপুড় হয়ে পড়ে রইল ঝর্নাটার ধারে। সেই অবস্থাতেই তার বমি হতে লাগল। মুখ দিয়ে গল গল করে বমি বেরিয়ে আসছে তো আসছেই। সন্তুর জামাটামা সব বমিতে মাখামাখি হয়ে গেল। অজ্ঞান অবস্থায় আর মানুষের কোনও ভয় থাকে না। এখন আর সাহেবদের ভয় নেই, জারোয়াদের ভয় নেই। খুব শান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়ার মতন সন্তুর চোখ দুটো বোজা।

খানিকটা বাদে একপাল হরিণ। এল সেই ঝর্নার জল খেতে। এখানকার জঙ্গলে বাঘ সিংহের মতন কোনও হিংস্ৰ প্ৰাণী নেই বলে হরিণের সংখ্যা খুব বেশি। হরিণগুলো সন্তুকে দেখেও কোনও ভয় পেল না। কয়েকটা হরিণ সন্তুর কাছে এসে তার গায়ের গন্ধ ওঁকল! আবার তারা ফিরে গেল বনের মধ্যে।

তারপর বিরঝির করে বৃষ্টি নামল। সন্তু ভিজতে লাগল সেই বৃষ্টিতে। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে, তার মধ্যে সেই কিলা কিলা শব্দটা আর শোনা যায় না।

এখানকার বৃষ্টি হঠাৎ আসে, হঠাৎ থেমে যায়। এই বৃষ্টিও থেমে গেল একটু বাদে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার জন্য সন্তুর জ্ঞান ফিরে এল। সে উঠে বসল। ধড়মড়িয়ে। সে কোথায় আছে, কেন শুয়ে আছে-প্ৰথমে এসব কিছুই তার মনে এল না। একটুক্ষণ বসে রইল বিম দিয়ে, তারপর সব মনে পড়ল। সে শিউরে উঠল একেবারে। সে এরকম ফাঁকা জায়গায় শুয়ে ছিল? যে-কোনও জারোয়ার চোখে পড়লে একেবারে শেষ হয়ে যেত। সে তাড়াতাড়ি চারদিকে তাকিয়ে দেখল। না, কোথাও কেউ নেই। সেই কিলা কিলা শব্দটা এখন একেবারে থেমে গেছে।

বমি হয়ে যাওয়ার জন্য সন্তুর পেটের ব্যথাটা একদম সেরে গেছে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। শুধু মাথার এক জায়গায় ব্যথা। সেখানে হাত দিয়ে দেখল, চুলের মধ্যে এক জায়গায় চট্টচট করছে। রক্ত বেরিয়ে চুলের মধ্যে জমে আছে। সন্তুর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। বাড়ি থেকে কত দূরে এই বিদঘুটে জঙ্গলের মধ্যে সে একা পড়ে আছে। কী করে বাঁচবে জানে না। কাকাবাবু কোথায় তার ঠিক নেই। কাকাবাবুকেন এইসব জায়গায় আসেন?

আবার সন্তু লজ্জা পেয়ে গেল। কাকাবাবু তো তাকে জোর করে আনেননি। সে-ই তো ইচ্ছে করে এসেছে অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। এখন বিপদে পড়ে সে কাঁদছে। কেন? কেঁদে কোনও লাভ নেই, তাকে বাঁচার চেষ্টা করতেই হবে।

চোখের জল মুছে ফেলে সন্তু গেল ঝর্নার ধারে। ভাল করে বমিটমি ধুয়ে ফেলল। এখানকার জলটা বেশ গরম। যাকে উষ্ণ প্রস্রবণ বলে, এই ঝর্নাটা বোধহয় তাই। এর জল খেয়েই সন্তুর পেট ব্যথা করছিল। কিন্তু উপায় তো নেই। আবার আজিলা করে খানিকটা জল তুলে সন্তুকে খেতে হল। তার খুব তেষ্টা পেয়েছিল।

আবার সে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। কিলা কিলা শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলেও যে-দিক থেকে শব্দটা আসছিল, সন্তু যেতে লাগল সেই দিকে। এখন আর দীেড়তে পারছে না। হাঁটছে আস্তে আস্তে।

খানিকটা যাবার পর সে জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো দেখতে পেল। সেই আলোটা দেখেও ভয় পাবার কথা। এই জঙ্গলের মধ্যে এরকম আলো আসবে কোথা থেকে? একদম নীল রঙের আলো। গাছপালা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে সেই আলোর ছটা। কালীপুজোর সময় ম্যাগনেসিয়ামের তার পোড়ালে এরকম নীল আলো হয়। সন্তু যত এগোতে লাগল ততই আলোটা উজ্জ্বল হতে লাগল। যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সন্তু কাকাবাবুর কাছে শুনেছিল যে, জারোয়ারা আগুনই জ্বালাতে জানে না। তা এরকম আলো এখানে কে জ্বেলেছে?

আলোটা দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে। তাই সন্তু নদীর ধার ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে সেই দিকে এগোল। আরও খানিকটা যাবার পর সে থমকে দাঁড়াল। যা দেখল, তাতে তার প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। বুকের মধ্যে এত জোর দুম দুম শব্দ হচ্ছে যেন বাইরে থেকেও শোনা যাবে।

জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। তার পাশে একটা গোল জিনিস দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই গোল জিনিসটা একটা একতলা বাড়ির সমান। সবচেয়ে আশ্চর্য তাঁর আগুনটা। এরকম অদ্ভুত আগুনের কথা সন্তু কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। আগুনটা নানা রঙের। বেশির ভাগই একদম নীল, তাই দূর থেকে নীল রঙের আলো দেখা যায়। কিন্তু ঐ নীল আগুনের মধ্যে আবার লক লক করছে। কয়েকটা লাল, সবুজ আর গোলাপী রঙের শিখা। গ্যাসের আগুন নিয়ে কালাইন্টালাইয়ের কাজ হয় যে-সব দোকানে, সেখানে সন্তু অনেকটা এরকম নীল রঙের আগুন দেখেছে, কিন্তু সবুজ কিংবা আলতার মতন টকটকে লাল রঙের আগুনের কথা কে কবে শুনেছে? ঐ গোল জিনিসটা কী? ওটার মধ্যে যেন অনেকগুলো জিনিস আছে, সেগুলো থেকে আলাদা-আলাদা আগুন বেরুচ্ছে। যেন একটা আগুনের ফুলের তোড়া। ওটার দিক থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না।

তবু কোনওরকমে চোখ ফিরিয়ে সন্তু দেখল, সেই গোল আগুনটা থেকে অনেক দূরে ঘোড়ার ক্ষুরের আকৃতিতে সার বেঁধে বসে আছে কয়েক শো জারোয়া। ওরা বসেছে মাটিতে হাঁটু গোড়ে, সকলের শরীর সোজা। আর ওদের সামনে পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাহেবগুলো। নীল আলোয় জায়গাটা দিনের বেলার মতন পরিষ্কার। সব স্পষ্ট দেখা যায়।

সন্তু গুড়ি মেরে আরও একটু সামনে এগিয়ে গেল। এখন সে আর নিজের প্ৰাণের কথা চিন্তাই করছে না। সে দেখতে চায় ওখানে কাকাবাবুও আছেন কি না। খুব শক্ত কোনও জংলী লতা দিয়ে সাহেবগুলোর হাত-পা একসঙ্গে এমনভাবে বাঁধা যে, তারা নড়তে-চড়তে পারছে না। কিন্তু কাকাবাবুতো ওদের মধ্যে নেই। তাহলে কি কাকাবাবুকে আগেই মেরে ফেলেছে?

ফাঁকা জায়গাটার এক পাশে। কতগুলো ঘর রয়েছে। ঘরগুলো গাছের ডাল আর লতা দিয়ে তৈরি করা। সেই সব ঘর থেকে কিছু কিছু জারোয়া মেয়ে আর বাচ্চা বেরিয়ে আসছে, কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে সাহেবদের। তারপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করছে। একটা জারোয়া মেয়ে একটা লম্বা শুকনো গাছের ডাল নিয়ে এগিয়ে গেল সেই আগুনটার কাছে। দূর থেকে সে ডালটা ঢুকিয়ে দিল আগুনের মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে সেটা দপ করে জ্বলে উঠল। মেয়েটি সেই জ্বলন্ত ডালটা নিয়ে ফিরে এল আবার। এই ডালের আগুনটা কিন্তু সাধারণ আগুনের মতনই, নীল নয়। মেয়েটি সেই আগুন নিয়ে ঢুকে গেল একটা ঘরের মধ্যে।

সন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে, বুঝতে পারছে না। কাকাবাবুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কাকাবাবুকে এরা মেরে বনের মধ্যে কোথাও ফেলে রেখে এসেছে? কিন্তু সাহেবগুলোকে যখন নিয়ে এসেছে, তখন কাকাবাবুকেই বা আনবে না কেন? তাহলে কি কাকাবাবু ধরা পড়েননি, তাহলে কাকাবাবু গেলেন কোথায়? কাকাবাবু যেখানটায় লুকিয়ে ছিলেন, সন্তু সে-জায়গাটা খুঁজে দেখেছে। কাকাবাবু একটা ক্রাচ নিয়ে বেশিদূর যেতেও পারবেন না। তাহলে ব্যাপারটা কী হল?

সাহেবগুলোকে ওরকমভাবে হাত-পা বেঁধে রাখা হলেও ওদের মুখে কোনও ভয়ের চিহ্ন নেই। কেউ কান্নাকাটিও করছে না। জারোয়ারা সবাই একদম চুপ করে বসে আছে। সাহেবরা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। সন্তু ইংরিজি ভালই জানে, কিন্তু সাহেবদের মুখের উচ্চারণ অনেক সময় বুঝতে পারে না। তবু একটা মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করল। সে টুকরো টুকরো কয়েকটা কথা শুনতে পেল-দিজ বেগারস উইল সার্টেনলি কিল আস…দ্যাট মেরিওরাইট…ইনভেলুয়েবল…সো নীয়ার…

একজন সাহেব পাশ ফিরে শুতেই একজন জারোয়া উঠে গিয়ে তাকে আবার চিৎ করে দিল। কচ্ছপকে যেমন চিৎ করে রাখা হয়, এদেরও তেমনি চিৎ হয়েই থাকতে হবে।

জারোয়াদের দেখলেই মনে হয় তারা যেন কিসের জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা যদি সাহেবগুলোকে মারতে চায়, তাহলে তো মেরে ফেললেই পারে। দেরি করছে কেন?

সন্তু নিশ্বাস ফেলছে খুব আস্তে-আস্তে। একটুও নড়াচড়া করতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু এখানেই বা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? কাকাবাবু এখানে নেই, তা বোঝাই যাচ্ছে। মনে হয় ভোর হতেও আর দেরি নেই। বারবার সে সেই গোল আগুনটার দিকে তাকাচ্ছে। ওই দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে—যদিও চোখটা একটু জ্বালা-জ্বালা করে। তবু যেন মনে হয়; ওটার মধ্যে চুম্বক আছে। আগুন যে এত সুন্দর হয়, সন্তু তা জানত না। সবুজ আগুন? এক-একবার মনে হয় যেন রঙিন কাগজ। কিন্তু কাগজ নয়, সত্যিকারের আগুন। একটু আগেই তো একজন মেয়ে ঐ আগুন থেকে একটা গাছের ডাল জ্বলিয়ে নিল।

আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। কাকাবাবুকে খুঁজে বার করতেই হবে। কিন্তু এত বড় জঙ্গলের মধ্যে কোথায় সে কাকাবাবুকে খুঁজে পাবে। তবু শেষ পর্যন্ত চেষ্টা না করে সন্তু ছাড়বে না।

হঠাৎ সন্তুর একটা কথা খেয়াল হল। একটা দারুণ সুযোগ। এখন যদি কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে তারা খুব সহজেই পালিয়ে বেঁচে যেতে পারে। জারোয়ারা সব এখানে, তারা জঙ্গলের মধ্যে খুঁজবে না। ঐ সাহেবগুলোর একটা মোটরবোট নিশ্চয়ই সমুদ্রের ধারে কোথাও আছে। সেই বেটটায় চেপেই তো তারা পালাতে পারে। এখান থেকে। সাহেবগুলোকে ফেলে তাদের মোটরবোট নিয়েই যেতে হবে।কিন্তু তাতে কোনও দোষ নেই, সাহেবরা তো তাদের শত্ৰু!

সন্তু পা টিপে-টিপে আস্তে আস্তে পিছিয়ে যেতে লাগল। আরও খানিকটা দূরে গিয়েই সে দৌড় মারবে। কিন্তু তার যাওয়া হল না। হঠাৎ জারোয়াগুলো শব্দ করে উঠে দাঁড়াল। আবার তারা বিকটভাবে সেই কিলা কিলা কিলা কিলা শব্দ করে উঠল। সন্তু কেঁপে উঠল একেবারে। জারোয়ারা কি তার কথা টের পেয়ে গেছে? সন্তু দৌড়ে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু জারোয়ারা তেড়ে এল না। তার দিকে। সেখানেই দাঁড়িয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। ব্যাপারটা কী ঘটছে তা দেখবার জন্য সন্তু আর কৌতূহল দমন করতে পারল না। আস্তে আস্তে আবার মাথা উঁচু করল।

এবারে সেখানে রয়েছে আর-একজন নতুন লোক। পাতার ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে সেই লোকটি ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। তাকে দেখেই জারোয়ারা ওরকম চিৎকার করছে ঠিক যেন জয়ধ্বনি দেবার মতন। লোকটি একটি হাত উঁচু করে আছে ওদের দিকে।

লোকটি অসম্ভব বুড়ো। মনে হয় নব্বই কিংবা একশো বছর বয়েস। ছোটখাট্রো চেহারা, পিঠটা একটু বেঁকে গেছে। মাথার চুল ধপধাপে সাদা, মুখেও সাদা দাড়ি। লোকটির ভুরু দুটিও পাকা। লোকটি একটি লাল রঙের ধুতি মালকোঁচা দিয়ে পরে আছে গায়ে একটা লাল রঙের চাদর। অন্য কোনও জারোয়া জামা কাপড় কিছুই পরে না। এই বুড়ো লোকটিকে জারোয়া বলে মনেও হয় না, গায়ের রঙ বেশ ফিসা, মাথার চুলও কোঁকড়ানো নয়। এ লোকটা কে? এ কি জারোয়াদের রাজা?

লোকটি আস্তে আস্তে হেঁটে এসে সাহেবগুলোর কাছে দাঁড়াল। খুব ভাল করে দেখতে লাগল তাদের মুখগুলো। আর মাঝে-মাঝে মাটিতে চিক চিক করে থুতু ফেলতে লাগল। তারপর মুখ তুলে কী যেন জিজ্ঞেস করল জারোয়াদের। চার-পাঁচজন জারোয়া একসঙ্গে উত্তর দিল।

একজন সাহেবের পাশে তার বন্দুকটা পড়ে ছিল। বুড়ো লোকটি নিজের হাতে তুলে নিল বন্দুকটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর টুক টুক করে হেঁটে চলে গেল সেই গোল আগুনটার কাছে। বন্দুকটা ছুঁড়ে দিল আগুনের মধ্যে। আবার জারোয়াদের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে অদ্ভুত ভাষায় কী যেন বলল।

অমনি চার-পাঁচজন জারোয়া এগিয়ে এসে একজন সাহেবকে মাটি থেকে উঁচু করে তুলল। তারপর চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে নিয়ে চলল বুড়োটির দিকে। সাহেবটা এবার চ্যাঁচাতে লাগল, হেই হোয়াট আর য়ু ড়ুইং–লীভ মি অ্যালেন। হেই!

জারোয়ারা সাহেবটিকে বুড়ো লোকটির কাছে নিয়ে এল। বুড়ো লোকটি হাত তুলে দেখাল আগুনের দিকে। তারপর সন্তু কিছু বোঝবার আগেই জারোয়ারা সাহেবটিকে ছুঁড়ে দিল আগুনের মধ্যে। ঠিক যেমনভাবে লোকে জলের মধ্যে পাথর ছেড়ে। শেষ মুহুর্তে সাহেবটি প্রচণ্ডভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল। অ আ করে। আগুনের মধ্যে পড়েই সব থেমে গেল। তার আর কোনও চিহ্ন রইল না। একটু ধোঁয়া পর্যন্ত বেরুল না।

সন্তু দু হাতে চোখ ঢেকে ফেলল। চোখের সামনে এরকমভাবে কোনও মানুষকে মরতে কে কবে দেখেছে? সন্তুর মনে হল, সে বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু অজ্ঞান হলে চলবে না। তাকে পালাতে হবে।

বুড়ো লোকটি আবার কিছু একটা হুকুম দিতেই জারোয়ারা আর-একজন সাহেবকে চ্যাংদোলা করে তুলল। এবার সব কটা সাহেব একসঙ্গে চিৎকার শুরু করে দিল। সেটা চিৎকার না। কান্না ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু জারোয়ারা কিছুই গ্রাহ্য করল না। তারা তাকে নিয়ে গেল আগুনের কাছে।

সাহেবটি সেই বুড়ো লোকটিকে কেঁদে কেঁদে বলল, ইউ, ইউ আর নট আ রায়া-ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ? প্লিজ ফরগিভ মী, স্পেয়ার মাই লাইফ, প্লীজ…

বুড়ো লোকটি কিছুই বলল না। চিক করে মাটিতে থুতু ফেলল, তারপর আগুনের দিকে আঙুল দেখিয়ে জারোয়াদের দিকে তাকাল।

জারোয়ারা দ্বিতীয় সাহেবটিকেও আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেবার জন্য যেই উঁচু করে তুলেছে, অমনি দাঁড়াম করে একটা গুলির শব্দ হল। জঙ্গলের মধ্য থেকে একটা গুলি ছুটে এসে লাগল একজন জারোয়ার হাতে। সবাই সেদিকে ফিরে তাকাল।

দূর থেকে স্তম্ভিত হয়ে সন্তু দেখল রিভলভার হাতে নিয়ে জঙ্গলের মধ্য থেকে কাকাবাবু সেই ফাঁকা জায়গাটায় চলে এলেন। এক হাতে ক্ৰাচ নিয়ে তিনি লাফিয়ে-লাফিয়ে হাঁটছেন। তাঁর রিভলভারটা সোজা সেই বুড়ো লোকটির বুকের দিকে তাক করা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress