প্লেনটা ঘুরে ঘুরে নামতে লাগল
কিন্তু প্লেনটা যখন ঘুরে ঘুরে নামতে লাগল, তখন জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে সন্তু একেবারে অবাক হয়ে গেল। ছবির বই ছাড়া এমন সুন্দর দৃশ্য সন্তু আগে কখনও দেখেনি। পুরী কিংবা দীঘার সমুদ্রে সে দেখেছে ঘোলাটে ধরনের জল। এখানে সমুদ্রের জল একেবারে গাঢ় নীল রঙের। এত গাঢ় যে, মনে হয়। কলম ড়ুবিয়ে অনায়াসে লেখা যাবে। তার মাঝখানে ছোট-ছেট দ্বীপ। আন্দামান তো একটা দ্বীপ নয়-সন্তুই গুনে ফেলল। এগারোটা। পরে শুনেছিল, ওখানে দুশোর বেশি দ্বীপ আছে।
প্ৰত্যেকটা দ্বীপেই ছোট-ছোট পাহাড় আছে, আর সেই পাহাড়ে গিসগিস করছে গাছপালা। এত গভীর বন যে পৃথিবীতে এখনও আছে, ভাবাই যায় না। মনে হয় যেন ওর মধ্য দিয়ে হাঁটাই যাবে না। বিরাট বিরাট গাছ। সেই নীল রঙের সমুদ্রের মধ্যে সবুজ সবুজ দ্বীপ, দ্বীপগুলোর ধারে ধারে ঢেউ এসে ভেঙে পড়ে ধপধাপে সাদা ফেনা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বেশির ভাগ দ্বীপেই একটাও বাড়িঘর নেই। তারপর একটা বড় দ্বীপে কিছু কিছু বাড়ি চোখে পড়ল। প্লেনটা সেখানেই নামছে। এই জায়গাটার নামই পোর্ট ব্লেয়ার। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনটা মাটি ছুতেই সন্তু তার কাকাবাবুর দেখাদেখি কোমর থেকে সীটবেল্ট খুলে ফেলল। কান দুটো কী রকম যেন ভৌভোঁ করছে। মাঝে মাঝেই পুচুপুচু করে একটু হাওয়া বেরিয়ে আসছে। কানের ভেতর থেকে। বাইরের শব্দ কিংবা ভেতরের অন্যদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে খুব আস্তে। বেশ মজাই লাগছে সন্তুর।
অন্যরা নামতে শুরু করতেই সন্তু তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। কাকাবাবু নামলেন সবার শেষে। কাকাবাবুকে ক্ৰাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয় খুব সাবধানে। সন্তু একটু লজ্জা পেল। আগে আগে না এসে তার উচিত ছিল কাকাবাবুকে একটু সাহায্য করা। কিন্তু সে আবার সিঁড়ির কাছে যাবার আগেই কাকাবাবু নেমে পড়েছেন।
একজন গোলগাল বেঁটেমতন লোক এগিয়ে এসে কাকাবাবুর হাত ছুয়ে বলল, আপনি নিশ্চয় মিস্টার রায়চৌধুরী? আমি দাশগুপ্ত। আপনার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছি।
কাকাবাবু সন্তুকে দেখিয়ে বললেন, এটি আমার ভাইপো। এর নাম সুনন্দ রায়চৌধুরী, ডাকনাম সন্তু।
দাশগুপ্ত নামের লোকটি সন্তুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, বেড়াতে এসেছ তো? ভাল লাগবে, দেখো খুব ভাল লাগবে
কাকাবাবু দাশগুপ্তকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ঐ যে দুজন বিদেশি সাহেব, ওদের দিকে একটু নজর রাখতে হবে। ওরা কোথায় যায়, কোথায় ওঠে-
দাশগুপ্ত একটু অবাক হয়ে বলল, এই প্লেনে তো বিদেশি কেউ আসছে। না! আমরা আগে থেকেই খবর পাই।
কাকাবাবুজিজ্ঞেস করলেন, তাহলে ঐ দুজন? ওরা নিশ্চয়ই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। এখানে একটা দেশলাইয়ের কারখানা আছে। সেখানে কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কাজ করে। মাঝে-মাঝে ওদের যাতায়াত করতে হয়। কলকাতায়-
তবু ওরা কোথায় থাকবে, সেটা আমি জেনে রাখতে চাই।
দাশগুপ্ত এবার হেসে বলল, সে ঠিক জানা যাবে। এটা খুব ছোট জায়গা, এখানে সকলের সঙ্গেই সকলের দেখা হয়ে যায়। ওরা নিশ্চয়ই দেশলাই কারখানার কোয়াটারেই থাকবে।
কাকাবাবু আড়চোখে সাহেব দুটির দিকে লক্ষ করতে লাগলেন। লোক দুটি এমনভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, যেন কারুকে খুঁজছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য কোনও লোক আসেনি। একটু বাদে ওরা নিজেরাই গট গট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল।
মালপত্তর নিয়ে ওরা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে একটা জিপ গাড়িতে চড়ল। কাকাবাবুজিজ্ঞেস করলেন, আমাদের থাকার জায়গা ঠিক আছে তো?
দাশগুপ্ত বলল, হ্যাঁ, টুরিস্ট হোমে আপনাদের ঘর বুক করা আছে। সেটাই এখানকার সবচেয়ে ভাল জায়গা! খাওয়া-দাওয়ারও কিছু অসুবিধে হবে না। বেশ কিছুদিন থাকবেন তো?
কাকাবাবু বললেন, দেখি!
প্লেন থেকে বোঝাই যায়নি যে দ্বীপের মধ্যে এ-রকম একটা শহর আছে। বেশ চমৎকার পীচ বাঁধানো রাস্তা, দুপাশে নতুন-নতুন বাড়ি ও দোকানপাট। তবে রাস্তাটা পাহাড়ি শহরের মতন উঁচু-নীচু, আর মাঝে-মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ দূরে সমুদ্র দেখা যায়।
টুরিস্ট হোমটা একটা ছোট টিলার ওপর। আসবার পথে খনিকটা জঙ্গল পার হতে হয়। বাড়িটার সামনে অনেকখানি ফুলের বাগান। আর পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালেই সমুদ্র। খুব কাছে। এখানে অনেকগুলো ছোট ছোট জাহাজ আর স্টিমার রয়েছে। চমৎকার জায়গা। যে-কোনও দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
একটা ডবল-বেড ঘর ঠিক করা ছিল সন্তুদের জন্য। একজন বেয়ারা ওদের মালপত্র পৌঁছে দিল ঘরে। কাকাবাবু তাকে এক টাকা বখশিস দিতে যেতেই সে লজ্জায় জিভা কেটে বলল, নেহি! নেহি।
কাকাবাবু আবার বললেন, আরে নাও নাও, তোমার চা খাবার জন্য!
লোকটি আরও লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলে বলল, নেহি! নেহি! আপ ब्रांर्थ निधि श।
এ আবার কী রকম-হোটেলের বেয়ারা যে বখশিস নিতে চায় না? কাকাবাবু দাশগুপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন, এক টাকা বখশিস দিলে কম হয় নাকি? আরও বেশি চাইছে?
দাশগুপ্ত বলল, না, না, এরা বখশিস নিতে চায় না। দেখবেন, এখানকার লোক খুব ভাল-পয়সা-কড়ির দিকে কারুর লোভ নেই।
লোকটির কালো কুচকুচে গায়ের রঙ। চেহারা দেখলেই মনে হয় দক্ষিণ ভারতীয়। অথচ হিন্দীতে কথা বলছে।
কাকাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? তুমি বাংলা বোঝে?
লোকটি বলল, হাঁ সাব, বাংলা বুঝি। আমার নাম কড়াকড়ি?
সন্তু আমনি ফিক করে হেসে ফেলল। কড়াকড়ি আবার লোকের নাম হয় নাকি?
দাশগুপ্ত বলল, সত্যিই ওর নাম কড়াকড়ি। এই যে, শোনো কড়াকড়ি, সাহেবদের যত্ন-টত্ব করবে কিন্তু! ভাল খাবার-দাবার দেবে। আজি কী কী খাবার আছে?
কাকাবাবু বললেন, মাছের ঝোল ভাত পাওয়া যাবে?
দাশগুপ্ত বলল, মাছ যত ইচ্ছে চাইবেন। এটা তো মাছেরই দেশ। এখানকার রাধুনী, বেয়ারা সবাই কেরালার লোক, ওরা আমাদেরই মতন মাছের ঝোল খায়। চিংড়ি মাছ পাবেন খুব ভাল। তাছাড়া মুগী বা হরিণের মাংসযেদিন যেটা ইচ্ছা হয় অর্ডার করবেন?
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তাহলে তো চমৎকার ব্যবস্থা!
দাশগুপ্ত তখনকার মতন বিদায় নিল। আবার সন্ধের সময় আসবে। সন্তু সুটকেসগুলো খুলে জামা-টামা সব বার করে গুছিয়ে রাখল। দুটো পাশাপাশি বিছানা, বেশ চওড়া খাট।
কাকাবাবু একটা খাটের ওপর বসে একটা ম্যাপ বিছিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। সন্তু পেছনের দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনেও খানিকটা বাগান, তারপর পাহাড়টা খাড়া হয়ে নেমে গেছে, তার ঠিক নীচেই সমুদ্র। একটু দূরেই, বা পাশে আর-একটা স্বীপ। সেটা একেবারে জঙ্গলে ভরা। ঐ দ্বীপটিায় একবার যেতেই হবে।
সন্তু দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ শুনতে পেল হাতির ডাক। পরপর দুবার। সে একেবারে শিউরে উঠল। এত কাছের ঐ দ্বীপটায় বুনো হাতি আছে? বাঘ-সিংহও আছে নিশ্চয়ই। এরকম একটা ভয়ংকর জঙ্গল এত কাছে? একটা দূরবীন থাকলে সে নিশ্চয়ই হাতিগুলোকে দেখতে পেত।
কিন্তু সন্তুর আর সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো হল না। কথা নেই বাতা নেই, অমনি বৃষ্টি এসে গেল! প্ৰথমে মিহি বরফের গুঁড়োর মতন, তারপরই ঝমোঝম। সন্তু দৌড়ে ফিরে এল নিজেদের ঘরে।
কাকাবাবু তখনও ম্যাপটা দেখছেন। সন্তু উত্তেজিতভাবে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, সামনের দ্বীপটায় না, হাতি আছে।
কাকাবাবু মুখ না তুলেই বললেন, তা তো থাকতেই পারে!
আমি হাতির ডাক শুনলাম। নিজের কানে, এক্ষুনি!
হুঁ।
ওখানে বাঘ বা সিংহ আছে? কাকাবাবু এবার মুখ তুলে বললেন, না! আন্দামানে কোনও হিংস্ৰ জন্তু নেই। ঐ হাতিগুলোও পোষা হাতি। বড়বড় গাছ কাটা হয় তো, সেগুলো বয়ে নিয়ে যাবার জন্য হাতি লাগে। আমার চেনা এক ভদ্রলোক একবার কলকাতা থেকে পঞ্চাশটা হাতি নিয়ে এসেছিলেন এখানে।
পোষা হাতির কথা শুনে সন্তু একটু দমে গেল। পোষা হাতি আর বুনো হাতি দেখা তো আর এক নয়! যাই হোক, রিনিকে যখন সে চিঠি লিখবে, তখন লিখবে যে, সে বুনো হাতিরই ডাক শুনেছে। এত গভীর জঙ্গলের মধ্যে পোষা হাতিই বা দেখেছে কজন?
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ঐ লোকটিকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বলো তো আমাকে। ভাত খাবার তো খানিকটা দেরি আছে?
এইরে, লোকটার নাম কী যেন? একটু আগেই তো বলল, একদম মনে পড়ছে না! গড়াগড়ি? খড়খড়ি? সুড়সুড়ি? কাতুকুতু? না তো! ধরাধরি? মারামারি?
বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এসে সন্তু চেঁচিয়ে বলল, এই যে, ইয়ে! একটু শুনে যাও তো!
ভাগ্যিস তাতেই সাড়া দিল লোকটা। ডাইনিং রুমের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কী বলছেন, সাব?
সন্তু তাকে চায়ের কথাটা জানিয়ে নিশ্চিন্ত হল। ওর নামটা কিন্তু এখনও মনে পড়ছে না!
আশ্চৰ্য, এর মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেছে। এ কী রকম ভালুকের জ্বরের মতন বৃষ্টি! আকাশে আর একটুকরোও মেঘ নেই।
ভোরবেলা সন্তু ছিল কলকাতায় তার নিজের বাড়িতে। আর এখন এই দুপুরের মধ্যেই সে কোথা চলে এসেছে! হঠাৎ যেন বিশ্বাসই করা যায় না। সত্যি কি সে আন্দামানের টুরিস্ট হোমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে? নাকি এটা স্বপ্ন? সন্তু নিজের হাতে একটু চিমটি কেটে দেখল, না, এটা স্বপ্ন নয়।
কাকাবাবুর আগে সন্তু স্নান করে নেবার জন্য বাথরুমে ঢুকল। সেখানে আবার এক অবাক কাণ্ড! শাওয়ার খুলে সে সবেমাত্র ওপর দিকে তাকিয়েছে, পাশের দেয়ালে দেখল একটা সবুজ রঙের টিকটিকি! প্ৰথমে সে ভেবেছিল সাপ বা অন্য কিছু। কিন্তু তা নয়। এমনিই একটি সাধারণ টিকটিকি। কিন্তু রঙটা একদম সবুজ। টিকটিকিটা তাড়া করে আসছেও না, কিছুই না। শুধু তার দিকে চেয়ে আছে। সবুজ রঙের টিকটিকির কথা সে কারুর কাছে কোনওদিন শোনেনি। সে এতই অবাক হয়ে গেল যে, আর চেপে রাখতে পারল না। ভিজে গায়ে তোয়ালে পরেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, একটা অদ্ভুত জিনিস!
সে এতই উত্তেজিত হয়ে বলল যে কাকাবাবু উপেক্ষা করতে পারলেন না। তাড়াতাড়ি উঠে এলেন। টিকটিকিটা দেখে বললেন, আিৰ্হ, অদ্ভুতই বটে। এখানে এরকম আরও কিছু কিছু আছে, শুনেছি। এখানে সাদা রঙের কুমির দেখতে পাওয়া যায়।
সন্তু ভাবল, রিনিকে চিঠি লিখে চমকে দেবার আর একটা জিনিস পাওয়া গেল। গোয়াতে বেড়াতে গিয়ে ও কি এত সব নতুন জিনিস দেখতে পাবে!
সেদিন দুপুরে আর কোথাও বেরুনো হল না। খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম। এখানে সন্ধে হয় বেশ তাড়াতাড়ি। বিকেল হতে না হতেই সন্ধে।
সন্ধের সময় দাশগুপ্ত এল, তার সঙ্গে যাওয়া হল বাজারের দিকে। পোর্ট ব্লেয়ার বেশ আধুনিক শহর। এখানে টেলিফোন করে ডাকলেই ট্যাক্সি এসে যায়। বাজারে সবরকম জিনিসই। কিনতে পাওয়া যায়। অবশ্য সে-সব জিনিস কলকাতা কিংবা মাদ্রাজ থেকে আনা।
শহরে নানারকম লোক। বাঙালি, মাদ্ৰাজী, কেরালার লোক, পাঞ্জাবী, বিহারী, বমী। তবে বাঙালিই যেন বেশি মনে হয়। কিছু লোক আছে, যারা আগেকার কয়েদীদের বংশধর। তবে, দাশগুপ্ত বলল, এখানে এখন চুরি ডাকাতি একদম হয় না।
রাস্তার পাশে-পাশে বড়-বড় ব্যারাক বাড়িতে দেখা যায় কিছু চীনে মেয়ে-পুরুষ। তাদের নোংরা নোংরা জামা, কী রকম রাগ-রাগ চোখে তারা তাকায়।
কাকাবাবুজিজ্ঞেস করলেন, দাশগুপ্ত, এরাই বুঝি সেই তাইওয়ানিজ?
দাশগুপ্ত বলল, হ্যাঁ সার!
সন্তু ঠিক বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তাইওয়ানিজ মানে কী?
কাকাবাবুর বদলে দাশগুপ্তই বলল, তাইওয়ান বলে চীনেদের একটা ছোট্ট দেশ আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ক নেই। সেই দেশ থেকে মাঝে মাঝে সাত-আটজন লোকসুন্ধু এক-একটা মাছ ধরা নৌকো এখানে ভেসে চলে আসে। তাই তাদের ধরে আটকে রাখতে হয়?
কেন, তারা মাছ ধরতে আসে বলে তাদের ধরে রাখতে হয় কেন?
এক দেশের নৌকো তো আর-এক দেশে বিনা অনুমতিতে যাবার নিয়ম নেই। তাছাড়া ওরা শুধু মাছ ধরতে আসে, না গুপ্তচরের কাজ করতে আসে, সেটাও জানা দরকার।
কিন্তু ওদের বাড়ির দরজা-টিরজা তো সব খোলা। ওরা পালিয়ে যেতে পারে না আবার?
কী করে যাবে? ওদের নৌকো যে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সমুদ্র দিয়ে আর তো পালাবার কোনও উপায় নেই! ওদের মধ্যে যারা একটু বদমেজাজী, তাদের আটকে রাখা হয় জেলে।
দাশগুপ্ত এবার কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, স্যার, আপনি এখানকার জেল দেখতে যাবেন না? এখানকার বিখ্যাত জেল সবাই আগে দেখে। কবে যাবেন? কাল?
কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, না। কাল সকালে আমার প্রথম কাজ হবে এখানকার দেশলাইয়ের কারখানাটা দেখতে যাওয়া। সেখানকার কারুর সঙ্গে আপনার চেনা আছে?
দাশগুপ্ত বলল, হ্যাঁ। অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার মিঃ। ভার্গবকে আমি ভালই চিনি।
কাল সকালেই সেখানে যাব।
পরদিন খুব সকালে উঠেই সন্তু তৈরি হয়ে নিল। তারপর কাকাবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল হেঁটেই। সকালবেলা একটু হাঁটলে ভালই লাগে। কাকাবাবু খোঁড়া পা নিয়েও হাঁটতে ভালবাসেন। কিন্তু সুস্থির হয়ে হটবার কি উপায় আছে? মাঝে-মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি। তখন কোনও গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। অবশ্য দু-এক মিনিটের বেশি বৃষ্টি থাকে না।
দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বড় রাস্তায়। সে তাড়াতাড়ি হেঁটে আসছিল। লোকটি বেশ বেঁটে ও মোটা, এত জোরে হটবার জন্য হাঁপাচ্ছিল। সে বলল, দেশলাইয়ের কারখানা অনেকটা দূর, সেখানে তো হেঁটে যাওয়া যাবে না। দাঁড়ান, এই রাস্তা দিয়ে বাস আসবে।
মিনিট পনেরো পরেই বাস এল। একদম ভিড় নেই। বাসের মাথায় লেখা আছে চ্যাথাম আয়ল্যাণ্ড। তার মনে বাসটা অন্য কোনও দ্বীপে যাবে! কী করে সমুদ্রের ওপর দিয়ে বাস যায়?
দেশলাইয়ের কারখানাটা পোর্ট ব্লেয়ার শহরের একেবারে এক প্রান্তে, বন্দরের কাছে। সেখানেই বাস থেকে নেমে পড়া হল, সামনেই কারখানার বড় গেট, আর ডান পাশে সমুদ্র।
কারখানার গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কাকাবাবু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর আপনমনে বললেন, সন্তুকে এখানে নিয়ে আসা ভুল হয়েছে। ওকে বাংলোতে রেখে এলেই হত
সন্তু একটু দুঃখ পেয়েও চুপ করে রইল।
দাশগুপ্ত বলল, কেন, চলুক না!
না, আমরা কারখানায় গিয়ে ম্যানেজার ট্যানেজারের সঙ্গে কথা বলব, সেখানে ও কী করবে? ছেলেমানুষ, ওর সেখানে থাকা উচিত নয়।
তা অবশ্য।
সন্তু, তুই আবার এখান থেকে বাস ধরে বাংলোয় ফিরে যেতে পারবি না? দাশগুপ্ত বাধা দিয়ে বলল, না, তার দরকার নেই। ও এখানেই একটু ঘুরে বেড়াক না। আন্দামানে ভয় তো কিছু নেই।
ভয়ের কথা বলছি না।
দাশগুপ্ত সন্তুকে বলল, তুমি সামনের দিকে একটু এগোলেই একটা ব্রীজ দেখতে পাবে, তার ওপারে চ্যাথাম আয়ল্যান্ড। সেখানটা ঘুরে এসো না।
কাকাবাবু, বললেন, সেই ভাল, সন্তু, তুই একটু বেড়িয়ে আয় এদিকটা, আবার ঠিক এখানে ফিরে আসবি।
ওরা কারখানার ভেতরে ঢুকে যাবার পর সন্তু সামনের দিকে এগুলো। একটুখানি যেতেই দেখল বাঁ দিকে সমুদ্রের ওপর একটা কাঠের ব্রীজ। তার ওপারে একটা পুঁচকি দ্বীপ। বড় জোর একটা ফুটবল মাঠের সমান।
ব্রীজটার ওপর পা দিয়ে সন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। সমুদ্রের ওপর সেতু! রামায়ণে সেই রাম তাঁর বানর-সৈন্যদের নিয়ে সমুদ্রের ওপর সেতুবন্ধন করেছিলেন। সেই কথা মনে পড়ে যায়। হোক না এটা ছোট সেতু, তবু দুটো দ্বীপের মাঝখানে তো, এবং তলায় আসল সমুদ্র।
জলের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। এখানে জলের রঙ আর ঘন নীল নয়, কাচের বোতলের মতন হালকা সবুজ। তার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মাছ, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ। অনেক মাছই রঙিন, লাল, সবুজ, হলুদ, ময়ুরুকণ্ঠী—মনে হয় গোটা সমুদ্রটাই যেন একটা অ্যাকোয়ারিয়াম! স্ত্রীজের কাঠের খুঁটির গায়ে-গায়ে লেগে আছে কাঁকড়া-সেগুলোর একটাও সাধারণ কাঁকড়ার মতন খয়েরি নয়, মাছগুলোর মতনই নানা রঙে রঙিন।
সন্তু কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে মাছেদের খেলা দেখছিল, আবার বৃষ্টি এসে গেল। সে দৌড়ে চলে গেল শ্ৰীজের ওপারে। চ্যাথাম দ্বীপটিতে বড়-বড় গুদাম ভর্তি কাঠ, এক জায়গায় কাঠ চেরাই হচ্ছে। দ্বীপটার অন্যদিকে রয়েছে। কয়েকটা বড়-বড় জাহাজ। কোনওটার নাম এস এস হরিয়ানা, কোনওটার নাম চলুঙ্গা, কোনওটার নাম গঙ্গা। সেখানে কোনও লোকজন নেই। একটু দূরে দেখা যায় সমুদ্রের ওপর কয়েকটা মাছ ধরা নৌকো।
সন্তু সবচেয়ে বড় জাহাজটার খুব কাছে গিয়ে সেটার গায়ে হাত বুলোতে লাগল। সে কোনওদিন জাহাজে চাপেনি। ফেরার সময় নিশ্চয়ই জাহাজে করে ফেরা হবে! কিন্তু কবে ফেরা হবে?
হঠাৎ সন্তুর মনে হল, সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। কাকাবাবুদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন। সে তাড়াতাড়ি ব্রীজ পেরিয়ে আবার ফিরে এল ওপরে।
কাকাবাবু আর দাশগুপ্ত ঠিক তখুনি বেরিয়ে এলেন কারখানার গেট দিয়ে। কাকাবাবুর মুখ গম্ভীর। থমথমে। ক্রাচের খটখট শব্দ তুলে তিনি এগিয়ে গেলেন সমুদ্রের দিকে। একদম কিনারার কাছে থেমে দূরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা হাত বোলাতে লাগলেন গোঁফের ওপরে।
সন্তু ফিসফিস করে দাশগুপ্তকে জিজ্ঞেস করল, সেই সাহেব দুজনকে পাওয়া গেছে?
দাশগুপ্ত মাথা নাড়িয়ে জানোল, না।
তারা এখানে আসেনি তাহলে?
উঁহু! গত দু মাসের মধ্যে এখানকার কেউ বাইরে যায়নি। নতুন কেউ আসেওনি। এখানে মাত্র তিনজন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কাজ করে। তাদের দেখলাম, তারা অন্য লোক!
তবে সেই সাহেব দুজন নিশ্চয়ই অন্য কোনও হোটেলে আছে।
এখানে সাহেবদের থাকার মতন কোনও হোটেল নেই। ওরা যদি বিদেশি হয়, তাহলে তো আরও মুশকিল! কোনও বিদেশিই আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে এখানে আসতে পারে না!
দাশগুপ্ত কাকাবাবুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না, ওদের ঠিক খুঁজে বার করা যাবে। এইটুকু ছোট জায়গা, এখানে ওরা পালাবে কোথায়?
কাকাবাবু মুখটা ফিরিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, এখানে অনেক দ্বীপ আছে, তার যে-কোনও একটাতে গিয়ে লুকিয়ে থাকা তো খুব সোজা?
কিন্তু এখানে এসে তাদের লুকিয়ে থেকে কী লাভ? কী আর এমন আছে এখানে?
কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর অনেকটা আপনমনেই বললেন, আছে। কারণ আছে। সেইজন্যই তো আমিও এসেছি এখানে।
এই সময় চ্যাথাম দ্বীপের পেছন দিক থেকে ভট্টভট্ট শব্দে একটা মোটরবোট বেরিয়ে এল। মোটরবোটটা ছোট, ঠিক একটা হাঙরের মতন দেখতে। সেটা সমুদ্রের জল কেটে খুব জোরে ছুটে যেতে লাগল দূরের দিকে। এতদূর থেকেও সন্তুরা স্পষ্ট দেখতে পেল, সেই বোটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দুজন সাহেব। কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, দাশগুপ্ত, দাশগুপ্ত, একটা মোটরবোট জোগাড় করতে পারো? এক্ষুনি?
দাশগুপ্ত অবাক হয়ে বলল, মোটরবোট? কেন, আপনি কি ওদের তাড়া করবেন নাকি?
কাকাবাবু অধৈৰ্য হয়ে প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, আঃ, জোগাড় করতে পারবে কিনা বলো না! ওরা একবার লুকিয়ে পড়লে আর ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না! এই তো ব্রিজের পাশে একটা খালি মোটরবোট রয়েছে, এটা ব্যবহার করা যায় না?
দাশগুপ্ত বলল, না, স্যার। এখানে পুলিশের অনুমতি ছাড়া কেউ বোট চালাতে পারে না। আমি পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে আপনার জন্য একটা ব্যবস্থা করতে পারি-
সে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
কাকাবাবু হতাশভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাহেবদের মোটরবোট ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। তারপর একটা দ্বীপের আড়ালে বাঁক নিতেই সেটাকে আর দেখা গেল না।
কাকাবাবু নিজের বাঁ হাতের ওপর ডান হাত দিয়ে একটা ঘুষি মারলেন। তারপর বললেন, এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে, ওরা ঠিক লুকোবার চেষ্টা করবে। এখানে লুকিয়ে থাকা খুব সহজ! ওরা যে বোটটা নিয়ে গেল, সেটা কার বোট, কোনও অনুমতি নিয়েছে কিনা–এ খবর জোগাড় করতে পারবে?
দাশগুপ্ত বলল, তা পারব। হারবার মাস্টারের কাছেই খোঁজ পাওয়া যাবে।
তবে এক্ষুনি সেই খবর নিয়ে এসো।
দাশগুপ্ত একটুক্ষণ তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু চিন্তা করার সময় লোকটির একটা চোখ ট্যারা হয়ে যায়। ট্যারা চোখে জলের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, এক কাজ করুন, স্যার। আপনি টুরিস্ট হোমে ফিরে যান। ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নিন। ততক্ষণে আমি সমস্ত খবর নিয়ে আপনার কাছে আবার যাচ্ছি। দিল্লি থেকে আমার কাছে অর্ডার এসেছে আপনাকে সব রকমে সাহায্য করার জন্য। তবে আপনি কোন রহস্যের খোঁজে এসেছেন, তা কিন্তু আমি এখনও জানি না।
কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, একটু বাদে তুমি যখন টুরিস্ট হোমে আসবে, তখন তোমাকে সব বলব। চলো, সন্তু!