Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 3

ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ || Shirshendu Mukhopadhyay

কয়েক পা এগোতেই

কয়েক পা এগোতেই একজন বেশ আহ্লাদি চেহারায় লোকের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গোলগাল চেহারা আর হাসি হাসি মুখের লোকটা তাদের দেখেই বলে উঠল, “এই যে, তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”

ফটিক বলল, “আজ্ঞে, অনেক দূর থেকে।”

“বাঃ বাঃ বেশ। তা নটবর রায়ের বাড়ি যাবে নাকি?”

ফটিক অবাক হয়ে বলল, “কী করে বুঝলেন?”

“সে আর শক্ত কী? তা তোমাদের মধ্যে কোনজন ফটিক ঘোষ বলো তো? না কি দু’জনেই ফটিক ঘোয?”

ফটিক হাঁ। এ যে তার নামও জানে।

নিতাই তাড়াতাড়ি বলল, “এই হল ফটিক ঘোষ। আর আমি নিতাই।”

লোকটা আত্মদি গলায় বলল, “পায়রাডাঙার হরিহর ঘোষের ছেলে তো তুমি, তাই না?”

ফটিকের প্রথমটায় বাক্য সরল না, এত অবাক হয়েছে সে। তারপর বলল, “কী করে জানলেন?”

“আমি অন্তর্যামী যে। তা নটবর রায়ের বাড়ির পথ খুব সোজা। এই রাস্তা ধরে নাক বরাবর চলে যাও। চৌপথির পরেই দেখবে ডানধারে মস্ত দেউড়ি, বিরাট বাগান, আর খুব বড় দালানকোঠাওলা বাড়ি। ফটকে ভোজপুরি দরোয়ান আছে। ও বাড়ি ভুল হওয়ার জো নেই।”

লোকটা হাসি-হাসি মুখ করে ডানধারের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়ার পর ফটিক নিতাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝতে পারলি নিতাই?”

“কী বুঝব?”

লোকটা আমাকে চিনল কী করে? আমার বাবার নাম, গাঁয়ের নাম অবধি জেনে বসে আছে!”

নিতাই বলল, “তুই যে আসবি সেটা বোধ হয় নটবর রায় সবাইকে বলে রেখেছে। তবে লোকটার একটা কথা একটু গণ্ডগোলের।”

“কোন কথাটা বল তো।”

“ওই যে বলল না, তোমাদের মধ্যে কোনজন ফটিক ঘোষ বলল তো! না কি দু’জনেই ফটিক ঘোষ। কথাটা হল, দু’জন ফটিক ঘোষ হয় কী করে?”

“হ্যাঁ, সেটাও ভাববার কথা।”

“অত ভেবে লাভ নেই, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। আগে তোর পিসির কাছে চল তো!”

পাঁচ ছয় মিনিট পর চৌপথি পেরিয়ে যে বাড়িটার দেউড়ির সামনে তারা দাঁড়াল তাকে বাড়ি না বলে প্রাসাদও বলা যায়। বিশাল দেউড়ি, ভেতরে মস্ত বাগান, বাগান পেরিয়ে বিরাট বড় দোতলা বাড়ি। বাড়ি দেখে দু’জনেই হাঁ।

নিতাই বলল, “তোর পিসেমশাই যে এত বড়লোক তা আগে বলবি তো!”

ফটিক বলল, “দুর! পিসে বা পিসির কোনও খবরই তো আমরা জানতাম না। যোগাযোগই ছিল না। শুধু জানতাম আমার এক পিসি আছে, অনেক দূরে থাকে।”

দু’জনে একটু ভয়ে ভয়ে ফটকের দিকে এগিয়ে যেতেই বিশাল

চেহারার ভোজপুরি দরোয়ানটাকে দেখতে পেল। মিলিটারির মতো পোশাক, বিশাল পাকানো গোঁফ, বড় জুলপি, মাথায় আবার পাগড়িও আছে।

তাদের দেখেই দরোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “রাম রাম বাবুজি। ফটিক ঘোষ আছেন নাকি আপনারা?”

ফটিক বলল, “আমি ফটিক ঘোষ, আর এ হল আমার বন্ধু নিতাই।”

“পায়রাডাঙার হরিহর ঘোষের ছেলিয়া তো!”

“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?”

“জান পহচান তো কুছু নাই। লেকিন আপনাকে দেখে মনে হল কি আপ ফটিক ঘোষ ভি হোতে পারেন। তো সিধা চলিয়ে যান, এই বড়া কাছারি ঘরে বড়বাবু ফটিক ঘঘাষের জন্য বসিয়ে আছেন।”

ফটিক আর নিতাই পরস্পরের দিকে তাকাতাকি করে নিল। তারপর একটু ভ্যাবাচাকা মুখে গুটিগুটি ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। অনেকটা হেঁটে গিয়ে তবে কাছারিঘর।

অনেক সিঁড়ি ভেঙে মস্ত মস্ত থামওলা বারান্দা পেরিয়ে তবে কাছারিঘর। তা ঘরখানাও হলঘরের মতো। ঝাড়লণ্ঠন আর দেওয়ালগিরির আলোয় ঝলমল করছে। নিচু মস্ত এক তক্তপোশে সাদা ধপধপে বিছানায় যিনি বসে আছেন তাঁর চেহারাটা দেখবার মতো। যেমন লম্বাচওড়া তেমনই টকটকে ফরসা রং, গায়ে ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি আর তেমনই ফিনফিনে শৌখিন ধুতি। চেহারাটা এত শক্তপোক্ত যে, বয়স বোঝা যায় না। আর চোখ দুটো এত তীক্ষ্ণ যে, তাকালে ভয়-ভয় করে। মুখোনা খুবই গম্ভীর। ফটিক আর নিতাই পটাপট প্রণাম সেরে নিল।

তিনি তাদের দিকে গম্ভীর মুখে চেয়ে বললেন, “কে তোমরা?” ফটিক আমতা আমতা করে বলল, “আপনিই কি নটবর রায়– মানে পিসেমশাই?”

“আমিই নটবর রায়, তবে পিসেমশাই কিনা তা জানি না। তোমরা কোথা থেকে আসছ?”

ফটিক জড়োসড়ো হয়ে বলল, “পায়রাডাঙা থেকে। আমি হরিহর ঘোষের ছেলে ফটিক।”

একথায় নটবর রায় বিশেষ খুশি হলেন বলে মনে হল না। জ্ব কুঁচকে বললেন, “সবাই তাই বলছে বটে। দেখি, চিঠিখানা দেখি।”

ফটিক তাড়াতাড়ি তার টিনের বাক্সটা খুলে একখানা চিঠি বের করে নটবর রায়ের হাতে দিয়ে বলল, “এই যে চিঠি, আমার বাবা পিসিকে দিয়েছেন।”

নটবর রায় চিঠিখানা সরিয়ে রেখে বললেন, “এ-চিঠির কথা বলিনি। তোমার বাবার হাতের লেখা আমরা চিনি না, কারণ তাঁর সঙ্গে আমাদের দীর্ঘকাল যোগাযোগ নেই। কাজেই এই চিঠি থেকে প্রমাণ হয় না যে তিনিই আসল হরিহর ঘোষ বা তুমিই তাঁর ছেলে ফটিক।”

“তা হলে কোন চিঠি?”

“তোমার পিসি তোমার বাবাকে যে পোস্টকার্ডখানা পাঠিয়েছিল সেখানা কোথায়? সেই চিঠির নীচে পুনশ্চ দিয়ে লেখা ছিল, ফটিক যেন চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে আসে।”

ফটিক খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটা সঙ্গে করেই আনছিলাম, তবে পথে খোয়া গেছে। একজন লোক চিঠিটা যাচাই করতে নিয়ে গেছে, আর ফেরত দেয়নি।”

নটবর রায় গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে বললেন, “বাঃ, বেশ বেশ। চমৎকার। তা শোনো হে ছোঁকরা, গত চারদিনে তোমাকে নিয়ে অন্তত ষোলোজন ফটিক ঘোষ এসে হাজির হয়েছে। তারা সবাই বলেছে প্রত্যেকেই নাকি পায়রাডাঙার হরিহর ঘোষের ছেলে ফটিক ঘোষ। কেউই অবশ্য পোস্টকার্ডখানা দেখাতে পারেনি। আমার যতদূর জানা আছে, আমার সম্বন্ধি হরিহর ঘোষের একটাই ছেলে, তার নাম ফটিক। কিন্তু যদি হরিহর ঘোষের ষোলোটা ছেলেও হয়ে থাকে তা হলে সকলেরই নাম ফটিক হয় কী করে বলতে পারো?”

বিস্ময়ে ফটিকের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। সে বিড়বিড় করে শুধু বলল, “ষোলোজন ফটিক ঘোষ?”

নটবর রায় বললেন, “হ্যাঁ পাক্কা ষোলোজন। কে আসল কে নকল তার বিচার করার মতো সময় আমার নেই। যদি পোস্টকার্ড দেখাতে পারো তবেই বুঝব আসল লোকটা কে। তা হলে এবার তোমরা এসে গিয়ে। আমার জরুরি কাজ আছে।”

নিতাই এবার একটু সাহস করে বলল, “আচ্ছা, সবাই ফটিক ঘোষ হতে চাইছে কেন জানেন?”

নটবর রায় মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, আমি জানি না।” ফটিক করুণ মুখ করে বলল, “পিসির সঙ্গে একটু দেখা–”

“না হে বাপু, দেখা হওয়া সম্ভব নয়। কে কার পিসি তারই ঠিক নেই। তোমরা এবার এসো।”

দু’জনে গুটি গুটি বেরিয়ে এল। দুদিন ধরে খানিক ট্রেন, খানিক বাস, তারপর মাইলের পর মাইল হেঁটে লবেজান হয়ে এত দূর আসার যে কোনও মানেই হল না, সেটা বুঝতে পেরে ফটিকের পা চলছিল না। সে অসহায় গলায় বলল, “নিতাই, কিছু বুঝতে পারলি?”

“না। তবে একটা ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে।”

“কীসের ষড়যন্ত্র?”

“সেটাই ভাবছি। ষড়যন্ত্র না থাকলে মহাদেব দাস তোর কাছ থেকে চিঠিটা চালাকি করে হাতিয়ে নিত না।”

“সেটা আমারও মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। পিসির বাড়িতে ভাইপো আসবে, তার মধ্যে এত ভেজাল কীসের রে বাবা! আগে জানলে কখনও এত কষ্ট করে আসতাম না।”

ফটকের কাছে ভোজপুরি দরোয়ানটার সঙ্গে দেখা। খুব আহ্লাদের গলায় বলল, “কী খোকাবাবু, জান পহচান হোলো?”

ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না দরোয়ানজি, উনি আমাদের পাত্তা দিলেন না। কী ব্যাপার বলতে পারেন?”

“সো হামি কুছু জানি না। লেকিন রোজ দু-চারটো করে ফটিক ঘোষ আসছে বাবুজি। ইতনা ফটিক ঘোষ কভি নেহি দেখা। নাটা ফটিক ঘোষ, লম্বা ফটিক ঘোষ, মোটা ফটিক ঘোষ, রোগা ফটিক ঘোষ, কালা ফটিক ঘোষ, ফর্সা ফটিক ঘোষ। রোজ আসছে। উসি লিয়ে বড়াবাবু কুছ পারসান মালুম হোতা।”

ফটক পেরিয়ে দু’জন ফের রাস্তায় পড়ল।

ফটিক বলল, “এখন কী করা যায় বল তো! সন্ধে হয়ে গেছে, এখন তো আর ফিরে যাওয়া যায় না। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে যে।”

নিতাই বলল, “ভাবিস না। একটা রাত ঠিক কাটিয়ে দেওয়া যাবে। এখন চল, জায়গাটা একটু ঘুরেফিরে দেখি।”

ফটিক দাঁত কড়মড় করে বলল, “মহাদেব দাসকে এখন পেলে তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেলতাম। ওই লোকটার জন্যই তো এত হেনস্থা হতে হল।”

নিতাই বলল, “মাথা গরম করে লাভ আছে কিছু? দোষ তো তোরই। তুই চিঠিটা ফস করে দিয়ে ফেললি।”

“তখন কি জানি চিঠি না নিয়ে এলে পিসির বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তা ছাড়া আমরা তো ফিরেই যাচ্ছিলাম।”

“যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন চোখকান খোলা রেখে চল তো, আমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।”

ক্লান্ত শরীরে তারা বেশি ঘুরতে পারল না। তবে দোগেছে যে বেশ ভাল জায়গা, সেটা বোঝা গেল।

নিতাই বলল,”গনা ডাইনির ফলার হজম হয়ে আমার এখন বেশ খিদে পাচ্ছে।”

ফটিক বলল, “আমারও। চল, ওখানে একটা বেশ ঝকঝকে মিষ্টির দোকান দেখা যাচ্ছে।”

মিষ্টির দোকানটায় বেশ ভিড়। সামনে পাতা বেঞ্চে কয়েকজন লোক বসে গল্পটল্প করছে। তারা দু’জন দোকানের কাছাকাছি এগোতেই দোকানের এক ছোঁকরা কর্মচারী বলে উঠল, “ওই যে, ফটিকবাবু এসে গেছেন।”

নিতাই ফটিককে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “তুই এখন বিখ্যাত লোক।”

ফটিক গম্ভীর হয়ে বলল, “তাই দেখছি।”

কর্মচারীটা হাসিমুখে বলে উঠল, “ফটিকবাবু তো? পায়রাডাঙার হরিহর ঘোষের ছেলে ফটিক ঘোষ?”

যারা বেঞ্চে বসে ছিল তারা তাদের দিকে খুব তাকাতে লাগল। একজন বলে উঠল, “ওঃ, এই কয়েকদিনে যা ফটিক ঘোষ দেখলুম এমনটা আর জন্মেও দেখব না। দেশে কত ফটিক ঘোষ আছে রে বাবা!”

একজন বুড়োমানুষ বলল, “কেন হে, এই আমাদের দোগেছেতেই তো চারজন সুধীর রায় আছে। তারপর ধরে বৈরাগী মণ্ডল আছে তিনজন, পাশের গাঁ নয়নপুরে নরহরি দাস আছে পাঁচজন।”

একজন বলল, “আহা, তা বলে তো পনেরো-বিশজন করে নয়। আর সবারই বাপের নামও এক নয়।”

উত্তেজিত আলোচনা ক্রমে তর্কে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ আর তাদের খেয়াল করল না। দু’জনে ভরপেট মিষ্টি খেয়ে নিল। নিতাই কর্মচারীটাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, এখানে কোথাও রাতে থাকার একটু জায়গা হবে?”

কর্মচারীটা বলল, “এখানে তো হোটেল টোটেল নেই। তবে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরলে চণ্ডীমণ্ডপ দেখতে পাবে, সেখানে থাকা যাবে।” দু’জনে উঠে পড়ল। চণ্ডীমণ্ডপটা খুঁজে পেতেও বেশি ঘোরাঘুরি করতে হল না। বেশ বড় আটচালা, চারদিক খোলা, তবে মেঝেটা বাঁধানো, সারাদিনের ক্লান্তির পর দু’জনে দু’খানা চাঁদর পেতে শুয়ে পড়ল। এত ক্লান্ত যে, কথাবার্তাও আসছিল না তাদের। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress