Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্রুতিধরা? || Arindam Deb

শ্রুতিধরা? || Arindam Deb

নাম পারুল খাতুন!

শান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয়! ছটফটে – কথায় বোঝা যায় শিক্ষার ও ভালো বংশের এক অদৃশ্য ছাপ, যা হয়তো অনুভব করা যায় – স্থূল চক্ষে, বাহ্যিক দিকে বোঝা অসম্ভব!

আমি ও মালবিকা, চুঁচুঁড়ার উদ্দেশ্যে দমদম স্টেশন হতে নৈহাটি লোকাল ধরবো,ট্রেন আসার মুহুর্তে জামার হাতায় টান – ” কাকু, একটু সাহায্য করবেন?”
আমি “হ্যাঁ নিশ্চয়ই! “, বলতেই মালবিকার কাছ ঘেঁষে মেয়েটি দাঁড়ালো!
” একটু ট্রেনে উঠতে সাহায্য করবেন? “
চোখের দিকে তাকিয়ে, মনটা হুহু করে উঠলো, হাতে একটি ফোল্ডিং স্টিক – আর…
চোখের মনি দুটো ঘোলাটে…

” আসলে এই প্রথম তো একা এতোটা চলেছি – বাবা যে অসুস্থ, জানাইনি যাচ্ছি! “

” কিন্তু… “

আমার প্রশ্ন বুঝতে পেরে সেই জবাব দিলো –
” কাকু আমি নৈহাটি থেকে লালগোলা ধরবো, নৈহাটিতে আমার বান্ধবীর মা আসবেন আমার সাথে যাবেন তাই..!”

আমি তার ডানহাত ধরলাম, মালবিকা বাঁ হাত। তাকে আশ্বস্ত করলাম, চিন্তা করতে বারণ করে আমাদের সাথেই পথ পরিক্রমা করতে অনুরোধ করলাম।

সেও যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো।
” আসলে পৃথিবী তো বড্ড জটিল – তাই.. তবু – মিলিয়ে দেন ঈশ্বর আপনাদের মতন দুচারজন ভালো লোককে, পথের সাথীরূপে, যা পাথেয় হয়ে থাকে আমার! “

চোখে জল এলো।আমরা নিঃসন্তান, আজ এই প্রৌঢ়ত্বে এসে মনে হলো সত্যিই এই হচ্ছে কন্যা! তার পরিবারের মা লক্ষ্মী সে!
” কি হয়েছে বাবার? “
জিজ্ঞেস করাতে বললো –
” এই অল্প জ্বর, আর ব্লাড সুগার আছে তো!”( সুগারের নির্ভুল সাহেবী উচ্চারণ)
” না জানিয়ে যাচ্ছি যে – জানলে বাবা রাগ করবেন, আসার দরকার কী, বলে বকাবকি করবেন! আচ্ছা বলুন তো কাকু, মা ওষুধপত্র ভালো বোঝেনা, আমি না গেলে চলে? “

আমি আর কৌতূহল নিবারণ না করতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম –
” তুমি কী পড়ো মা? “
” জ্বী, বাংলাতে এম. এ, ফার্স্ট ইয়ার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে! “

” তাহলে, তুমি লেখো.. “
বুদ্ধিমতী এই মেয়েটি আমার প্রশ্নটি বুঝতে পেরে বললো,
” রাইটার দিয়ে লিখি! আমার চেয়ে বয়সে ছোট, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে যার পড়াশোনা তাকে দিয়ে লেখাই কাকু!স্কুল -কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সর্বত্রই এই নিয়ম! “

তাকে ও তার এই দৃঢ়তাকে, তার পিতা মাতা পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধকে মনে মনে স্যালুট না করে পারলামনা!

তাও জিজ্ঞেস করলাম –
” আচ্ছা, ভালোকরে পড়াশোনা করো! তোমাদের এম.এ ক্লাসে, এখন কী উপন্যাস পড়ানো হয়, রবীন্দ্রভারতীতে?”

” এ মুহূর্তে ঠিক বলতে পারবোনা কাকু, কেউ তো বলে দেয়নি, তবে এখন ক্লাসে চর্যাপদ নিয়ে আলোচনা চলছে, সেখান থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিয়ে পাঠক্রম চলবে “!

বললাম – ” মনে হয় তোমার বৈষ্ণবপদাবলীর অবতারণা করছে এভাবে! “

এরপরে তার সাথে আমার বিদ্যাপতি – চণ্ডীদাস নিয়ে এক মনোরম আলোচনা চলতে লাগলো, আর বিদ্যুৎ গতিতে যেন একের পর এক স্টেশনগুলো পার হতে হতে প্রায় গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম!

আলোচনা চললো
“বিদ্যাপতির দাম্ভিক রাধা ও চণ্ডীদাসের দীনহীন রাধার ” পার্থক্য, এসব নিয়ে!

তার গভীরতায় আমি আপ্লুত হলাম, জিজ্ঞেস করলাম,
” কলেজে অধ্যাপনা করা তো মুশকিল, তা তুমি বি.এ অনার্সের ক্লাসে কত পেয়েছিলে?”

” কাকু – সেদিক দিয়ে অসুবিধা নেই, আমি তো ৫৫%র অনেক ওপরেই নম্বর পেয়েছি! “

বড্ড ভালো লাগলো।
এ মেয়েটি জীবন সংগ্রামে জয়লাভ করবে না তো কে করবে?

নৈহাটিতে নেমে, তার অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে, আমাদের বিদায় দিলো বটে, কিন্তু মনটা পূর্ণ জয় করে নিলো!

” আজ আপনাদের সাথে দেখা হবার ছিলো বলেই হয়তো আগের নৈহাটি লোকালে যাওয়া হয়নি! “

ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও যে ধান ভানে! আর স্বভাব যায়না ম’লে!

তাকে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী পেয়ে সদর্পে আমার কিছু বাংলা কবিতা শুনিয়ে ছাড়লাম!

ট্রেনের ছুটে যাওয়ার আওয়াজকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে, মেয়েটির পাশে বসে, তারস্বরে তাকে আমার ” অপাঠ্য ” কিছু কবিতা শোনানোর সুযোগ কি আর ছাড়তে পারি?

মালবিকা, অসহায় হয়ে
” আবার এখন কবিতা শোনাতে বসলে?” এ অাস্ফালনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আমার তিনটি কবিতা সাড়ম্বরে শুনিয়েই ছাড়লাম, আর তার অ্যাপ্রিশিয়েসন আর প্রীত হাসি ও মন্তব্যের পরে, মালবিকার দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললাম –
” আসলে স্বামী বিবেকানন্দ বলে গিয়েছিলেন না, – যা কিছু অত্যধিক হয়ে যায়, তাহাই বিষ – সেরকমই, তোমার কাকিমা আমার কাছে এতোরকম কবিতা, এতোবার শোনে, যে তার কাছে আমার কবিতা আজ প্রায় কবিতাফোবিয়ার রূপ নিয়েছে!
” কাকিমাও কি লেখেন? কবিতা? “
সরাসরি প্রশ্ন!
” তা লেখেন বইকি! সেও তো বর্দ্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় এম.এ আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথসঙ্গীত বিভাগের এম. মিউজ!
তোমার কাকি আমার থেকে অনেক ভালো লেখে কিন্তু বিয়ের পর থেকে কলমকে প্রায় অবসরই দিয়েছে, সংসার কারাবরণ করার জন্য! “
এই বলে আমি আমার অতি প্রিয় এক রচনা, মালবিকার বহু বছর আগের লেখা, পড়ে শোনালাম!
মালবিকা ও আমি দুজনেই শুনলাম যখন যে সে দমদমের ঘোষপাড়ায় হস্টেলে থাকে, আমরা বললাম সহযোগীতার হাত রইলো, আমাদের থেকে সে সবরকম সাহায্য পাবে, আর মালবিকার নিজেরই তো বাংলা সাবজেক্ট!

“আপনার নম্বরটা বলবেন কাকু! “
” আমি বললে কিভাবে মনে রাখবে?”
” না, আমি একবার শুনে নিই, লালগোলা পৌঁছে ওই দুপুর আড়াইটে নাগাদ গিয়ে, ডায়েরিতে লিখে রাখবো! “

আবার আমার হতবাক হবার পালা! এতক্ষণ মনে থাকবে কি করে তার?

বুঝে নিয়ে, এই প্রখর বুদ্ধিমতী বললো –
” কাকু, রাইটার দিয়ে লেখাতে হয়, মাস্টারমশাই ও দিদিমনিদের ক্লাসে শুনে শুনেই তো শিখতে হয়? এছাড়া উপায় কি বলুন?
অনেক কিছু তো জানতেই পারিনা – কেউ না পড়ে দিলে বা নিজে না শুনলে! “

সাবাশ! একেই কি শ্রুতিধরা বলে?জানিনা! হয়তো তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকতার জন্যই ঈশ্বর তার শ্রবণেন্দ্রিয় প্রখর করেছেন, কিন্তু তাই বলে এরকম স্মরণশক্তি?

জানিনা সে মেয়েটির আমাদের দ্বারা কোনো উপকার হবে কি না, কিন্তু আমি ঋদ্ধ হলাম, শুদ্ধ হলাম তার অগ্নিসম সম্ভাবনায় ও দৃপ্তচেতনায়!

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম, তার মতন কন্যা কোনো প্রতিবন্ধকতাহীন হয়ে যেন ঘরে ঘরে জন্মলাভ করে!

সে যদি আমার কন্যা হতো?

যেন বুঝতে পেরে, আমার হাত চেপে ধরে বললো
কাকু, যোগাযোগ রাখবো আমি, আমি তো তোদেরই মেয়ে তাই না? “
আমার কান্না সে বুঝে নিলে কি করে?

জানিনা! চোখের জল চাপতে না পেরে আশীর্বাদ জানিয়ে তাড়াতাড়ি যেন পালিয়ে এলাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *