Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মানুষের পরকালের চিন্তার মধ্যে নাকি পরের চিন্তার ঠাঁই নাই, না হইলে আমার খাওয়া-পরার চিন্তা রাজলক্ষ্মী পরিত্যাগ করিতে পারে এত বড় বিস্ময় সংসারে আর কি আছে? এই গঙ্গামাটিতে আমরা কতদিনই বা আসিয়াছি, এই ক’টা দিনের মধ্যেই হঠাৎ সে কতদূরেই না সরিয়া গেল! আমার খাবার কথা জিজ্ঞেসা করিতে আসে এখন বামুনঠাকুর, আমাকে খাওয়াইতে বসে রতন। একপক্ষে বাঁচিয়াছি, সে দুর্লঙ্ঘ্য পীড়াপীড়ি আর নাই। রোগা শরীরে এগারোটার মধ্যে না খাইলে এখন আর অসুখ করে না। এখন যেমন ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা খাই। শুধু রতনের পুনঃপুনঃ উত্তেজনায় ও বামুনঠাকুরের সখেদ আত্মর্ভৎসনায় স্বল্পাহারের বড় সুযোগ পাই না—সে বেচারা ম্লানমুখে কেবলি মনে করিতে থাকে, তাহারই রান্নার দোষে আমার খাওয়া হইল না। কোনমতে ইহাদের সন্তুষ্ট করিয়া বিছানায় গিয়া বসি। সম্মুখের সেই খোলা জানালা, আর সেই ঊষর প্রান্তরের তীব্র তপ্ত হাওয়া। মধ্যাহ্নের দীর্ঘ দিনমান কেবলমাত্র এই ছায়াহীন শুষ্কতার প্রতি চাহিয়া চাহিয়া যখন আর কাটিতে চাহিত না, তখন একটা প্রশ্ন সবচেয়ে আমার বেশি মনে পড়িত—সে আমাদের সম্বন্ধের কথাটা। ভাল আমাকে সে আজও বাসে, ইহলোকে আমিই তার একান্ত আপনার, কিন্তু লোকান্তরে তার কাছে আমি তত বড়ই পর। তাহার ধর্মজীবনের আমি যে সঙ্গী নই, সেখানে আমাকে দাবি করিবার যে তাহার কোন দলিল নাই, হিন্দুঘরের মেয়ে হইয়া একথা সে ভুলে নাই। এই পৃথিবীটাই শুধু নয়, ইহারও অতীত যে স্থানটা আছে, পাথেয় তাহার শুধু আমাকে কেবল ভালবাসিয়াই অর্জন করা যাইবে না, এ-সংশয় বোধ করি খুব বড় করিয়াই তাহার মনে উঠিয়াছে।

সে রহিল এই লইয়া, আর আমার দিনগুলা কাটিতে লাগিল এম্‌নি করিয়া। কর্মহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনের দিবারম্ভ হয় শ্রান্তিতে, অবসান হয় অবসন্ন গ্লানিতে। নিজের আয়ুষ্কালটাকে নিজের হাত দিয়া প্রতিনিয়ত হত্যা করিয়া চলা ব্যতীত সংসারে আর যেন আমার কিছু করিবার নাই। রতন আসিয়া মাঝে মাঝে তামাক দিয়া যায়, সময় হইলে চা আনিয়া দেয়—কিছু বলে না। কিন্তু মুখ দেখিয়া তাহার বোধ হয়, সে পর্যন্ত আমাকে যেন কৃপার চক্ষে দেখিতে শুরু করিয়াছে। কখনো বা হঠাৎ আসিয়া বলে, বাবু, জানালাটা বন্ধ করে দিন, আগুনের ঝলক আসচে। আমি বলি, থাক। মনে হয়, কত লোকের গায়ের স্পর্শ এবং কত না অচেনা লোকের তপ্ত শ্বাসের আমি যেন ভাগ পাই। হয়ত, আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু ইন্দ্রনাথ আজিও বাঁচিয়া আছে, এই উষ্ণ বায়ু হয়ত তাহাকে এইমাত্র ছুঁইয়া আসিল। হয়ত, সে আমারই মত তাহার অনেকদিনের সুখ-দুঃখের শিশু সঙ্গীটিকে স্মরণ করিতেছে। আর আমাদের উভয়ের সেই অন্নদাদিদি! ভাবিতাম, হয়ত এতদিনে তাঁহার সকল দুঃখের সমাপ্তি ঘটিয়াছে। কখনও মনে হয়, এই কোণেই ত বর্মাদেশ, বাতাসের ত বাধা নাই, কে বলিবে সমুদ্র পার করিয়া অভয়ার স্পর্শটুকু সে আমার কাছে বহিয়া আনিতেছে না! অভয়াকে মনে পড়িলে সহজে সে আমার মন ছাড়িয়া যাইতে চাহিত না। রোহিণীদা এখন কাজে গিয়াছেন, আর তাহাদের ছোট্ট বাসাবাড়ির সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া ঘরের মেঝেতে বসিয়া অভয়া তাহার সেলাই লইয়া পড়িয়াছে।

দিনের বেলা আমারি মত সে ঘুমাইতে পারে না, এতদিনে—হয়ত, কোন ছোট্ট শিশুর কাঁথা, কিংবা ছোট বালিশের অড়, কিংবা এম্‌নি কিছু তাহার ক্ষুদ্র গৃহস্থালীর ক্ষুদ্র গৃহিণীপনা!

বুকের মাঝখানে গিয়া যেন তীরের মত বিঁধে। যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত সংস্কার, যুগ-যুগান্তরের ভাল-মন্দ বিচারের অভিমান আমারও ত রক্তের মধ্যে প্রবহমান। কেমন করিয়া অকপটে তাহাকে দীর্ঘায়ু হও বলিয়া আশীর্বাদ করি! কিন্তু মন যে সরমে সঙ্কোচে একেবারে ছোট হইয়া আসিতে চায়।

কর্মনিরতা অভয়ার শান্ত প্রসন্ন মুখচ্ছবি আমি মনশ্চক্ষে দেখিতে পাই। তাহারি পাশে নিষ্কলঙ্ক ঘুমন্ত বালক। যেন সদ্যফোটা পদ্মের মত শোভায় সম্পদে গন্ধে মধুতে টলটল করিতেছে। এতখানি অমৃত বস্তুর জগতে কি সত্যই প্রয়োজন ছিল না? মানবসমাজে মানব-শিশুর মর্যাদা নাই, নিমন্ত্রণ নাই—স্থান নাই বলিয়া ইহাকেই ঘৃণাভরে দূর করিয়া দিতে হইবে? কল্যাণের ধনকেই চির অকল্যাণের মধ্যে নির্বাসিত করিয়া দিবার অপেক্ষা মানব-হৃদয়ের বৃহত্তর ধর্ম আর নাই?

অভয়াকে আমি চিনি। এইটুকুকে পাইতে সে যে তাহার জীবনের কতখানি দিয়াছে, তাহা আর কেহ না জানে আমি ত জানি। হৃদয়হীন-বর্বরতায় কেবলমাত্র অশ্রদ্ধা ও উপহাসের দ্বারাই সংসারে সকল প্রশ্নের জবার হয় না। ভোগ! অত্যন্ত মোটা রকমের লজ্জাকর দেহের ভোগ! তাই বটে! অভয়াকে ধিক্কার দিবার কথাই বটে!

বাহিরের তপ্ত বাতাসে চোখের তপ্ত অশ্রু আমার নিমেষে শুকাইত। বর্মা হইতে চলিয়া আসার কথাটা মনে পড়িত। ঠিক সেই সময়টায় তখন রেঙ্গুনে মরণের ভয়ে ভাই বোনকে, ছেলে বাপ-মাকেও ঠাঁই দিত না। মৃত্যু-উৎসবের উদ্দণ্ড মৃত্যুলীলা শহরময় চলিয়াছে—তেমনি সময়ে যখন আমি মৃত্যুদূতের কাঁধে চড়িয়া তাহার গৃহে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন নূতন-পাতা ঘরকন্নার মোহ ত তাহাকে একটা মুহূর্তও দ্বিধায় ফেলে নাই! সে কথা ত শুধু আমার আখ্যায়িকার এই কয়টা লাইন পড়িয়াই বুঝা যাইবে না, কিন্তু আমি ত জানি সে কি! আরও অনেক বেশি আমি জানি। আমি জানি কিছুই অভয়ার কাছে কঠিন নয়, মৃত্যু—সেও তাহার কাছে ছোটই। দেহের ক্ষুধা, যৌবনের পিপাসা—এই-সব প্রাচীন ও মামুলি বুলি দিয়া সেই অভয়ার জবাব হয় না। পৃথিবীতে কেবলমাত্র বাহিরের ঘটনাই পাশাপাশি লম্বা করিয়া সাজাইয়া সকল হৃদয়ের জল মাপা যায় না।

কাজের জন্য পুরানো মনিবের কাছে দরখাস্ত করিয়াছি, ভরসা আছে আবেদন নামঞ্জুর হইবে না। সুতরাং আবার আমাদের সাক্ষাৎ ঘটিবে। ইতিমধ্যে দুই তরফেই অনেক অঘটন ঘটিয়াছে। তাহার ভারও সামান্য নয়, কিন্তু সে ভার সে জমা করিয়াছে আপনার অসামান্য সরলতায় ও স্বেচ্ছায়, আর আমার জমিয়া উঠিয়াছে তেমনি অসাধারণ বলহীনতায় ও ইচ্ছাশক্তির অভাবে। কি জানি, ইহাদের রঙ ও চেহারা সেদিন মুখোমুখি কেমনতর দেখিতে হইবে।

একাকী সমস্তদিন প্রাণ যখন হাঁপাইয়া উঠিত, তখন বেলা পড়িলে একটুখানি বেড়াইতে বাহির হইতাম। দিন পাঁচ-সাত হইতে ইহা একপ্রকার অভ্যাসে দাঁড়াইয়াছিল। ধূলাময় যে পথটা দিয়া একদিন আমরা গঙ্গামাটিতে আসিয়াছিলাম, সেই পথ ধরিয়া কোন কোন দিন অনেকদূর পর্যন্ত চলিয়া যাইতাম।

অন্যমনে আজও তেম্‌নি চলিয়াছিলাম, সহসা দেখিতে পাইলাম, সম্মুখে ধূলার পাহাড় সৃষ্টি করিয়া কে-একজন ঘোড়া ছুটাইয়া আসিতেছে। সভয়ে রাস্তা ছাড়িয়া নামিয়া দাঁড়াইলাম। ঘোড়সওয়ার কিছুদূর অগ্রসর হইয়া গিয়া ঘোড়া থামাইল, ফিরিয়া আসিয়া আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, আপনার নাম শ্রীকান্তবাবু না? আমাকে চিনতে পারেন?

বলিলাম, নাম আমার তাই বটে, কিন্তু আপনাকে ত চিনতে পারলাম না।

লোকটি ঘোড়া হইতে নামিল। পরনে তাহার ছিন্ন ও মলিন সাহেবী পোশাক, মাথায় জরাজীর্ণ সোলার হ্যাট খুলিয়া হাতে লইয়া কহিল, আমি সতীশ ভরদ্বাজ। থার্ডক্লাস থেকে প্রোমোশন না পেয়ে সার্ভে-স্কুলে পড়তে যাই, মনে পড়ে না?

মনে পড়িল। খুশি হইয়া কহিলাম, তাই বল, তুমি আমাদের ব্যাঙ। এখানে সাহেব সেজে যাচ্ছ কোথায়?

ব্যাঙ হাসিয়া কহিল, সাহেব কি আর সাধে সাজি ভাই, রেলওয়ে কনস্ট্রাক্‌শনে সাব-ওভারসিয়ারী চাকরি করি, কুলি তাড়াতেই জীবন যায়, হ্যাট-কোট না থাকলে কি আর রক্ষা ছিল? এতদিন তারাই আমাকে তাড়াত। সোপলপুরে একটু বরাত সেরে ফিরচি—মাইলটাক দূরে আমার তাঁবু, সাঁইথিয়া থেকে যে নতুন লাইন বসচে তাতেই কাজ। যাবে আমার ওখানে? চা খেয়ে আসবে?

অস্বীকার করিয়া কহিলাম, আজ নয়, কোনদিন সুযোগ হয় আসব।

ব্যাঙ তখন অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল—শরীর কেমন, কোথায় থাকি, এখানে কি সূত্রে আসা, ছেলে-মেয়ে কয়টি, তাহারা কে কেমন আছে, ইত্যাদি।

জবাবে বলিলাম, শরীর ভাল নয়, থাকি গঙ্গামাটিতে, যে সূত্রে এখানে আসা তাহা অত্যন্ত গোলমেলে। ছেলে-মেয়ে নাই, অতএব তাহারা কে কেমন আছে এ প্রশ্ন নিরর্থক।

ব্যাঙ সাদাসিধাগোছের লোক। আমার উত্তরগুলা ঠিক বুঝিতে না পারিলেও অপরের ব্যাপার বুঝিতেই হইবে এরূপ দৃঢ়সঙ্কল্প ব্যক্তি সে নয়। সে নিজের কথাই বলিতে লাগিল। জায়গাটা স্বাস্থ্যকর, তরিতরকারি মেলে, মাছ এবং দুধ চেষ্টা করিলে পাওয়া যায়; তবে লোকজন নাই, সঙ্গীসাথীর অভাব, কিন্তু কষ্ট বিশেষ হয় না, কারণ সন্ধ্যার পরে একটু নেশা-ভাঙ করিলেই বেশ চলিয়া যায়। সাহেবরা হাজার হোক বাঙালীর চেয়ে ঢের ভাল—টেম্পোরারি গোছের তাড়ির শেড একটা খোলা হইয়াছে—যত ইচ্ছা খাও, তার নিজের ত একরকম পয়সা লাগে না বলিলেই হয়—সবই ভাল—কনস্ট্রাক্‌শনে দু’পয়সা আছেও বটে, এবং আমার জন্যে বড়সাহেবকে ধরিয়া চাকরি একটা অনায়াসে করিয়া দিতে পারে—এমনি সব তাহার সৌভাগ্যের ছোট-বড় কাহিনী। ব্যাঙ তাহার বেতো ঘোড়ার মুখ ধরিয়া অনেকদূর পর্যন্ত আমার সঙ্গে সঙ্গে বকিতে বকিতে চলিল; বার বার জিজ্ঞাসা করিল, আমি কি নাগাইদ তাহার ক্যাম্পে পায়ের ধূলা দিতে পারি, এবং ভরসা দিয়া জানাইল যে, পোড়ামাটিতে প্রায়ই তাহার কাজ থাকে, ফিরিবার পথে একদিন আমার গঙ্গামাটিতে সে নিশ্চয় গিয়া উপস্থিত হইবে।

সেদিন বাড়িতে ফিরিতে আমার একটু রাত্রি হইল। পাচক আসিয়া জানাইল আহার প্রস্তুত। হাতমুখ ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া খাইতে বসিয়াছি, এমন সময় রাজলক্ষ্মীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে ঘরে ঢুকিয়া চৌকাঠের কাছে বসিয়া পড়িল, হাসিমুখে কহিল, তুমি কিন্তু কিছুতেই অমত করতে পাবে না বলে রাখচি।

কহিলাম, না, আমার অমত নেই।

কি তা না শুনেই?

কহিলাম, আবশ্যক মনে হয় ব’লো একসময়।

রাজলক্ষ্মীর হাসিমুখ গম্ভীর হইল, কহিল, আচ্ছা—হঠাৎ তাহার দৃষ্টি পড়িল আমার থালার উপরে। কহিল, ভাত খাচ্চ যে বড়? তুমি জান রাত্রে তোমার ভাত সহ্য হয় না—তুমি কি তোমার অসুখটা আমাকে সারাতে দেবে না ঠিক করেচ?

ভাত আমার ভালই সহ্য হইতেছিল, কিন্তু সেকথা বলিয়া লাভ নাই। রাজলক্ষ্মী তীক্ষ্ণকন্ঠে ডাক দিল, মহারাজ! পাচক দ্বারের কাছে আসিতেই তাহাকে থালা দেখাইয়া ততোধিক তীব্রস্বরে কহিল, কি এ? তোমাকে বোধহয় এক হাজার বার বলেচি ভাত বাবুকে কিছুতেই রাত্রে দেবে না—তোমাকে একমাসের মাইনে আমি জরিমানা করলুম। অবশ্য টাকার দিক দিয়া জরিমানার কোন অর্থ নাই, তাহা সকল চাকরেই জানে, কিন্তু তিরস্কারের দিক দিয়া তাহার অর্থ আছে বৈ কি! মহারাজ রাগ করিয়া কহিল, ঘি নেই, আমি কি করব?

নেই কেন তাই শুনি?

সে জবাব দিল, দু-তিনদিন জানিয়েচি আপনাকে ঘি ফুরিয়েচে, লোক পাঠান। আপনি না পাঠালে আমার দোষ কি?

সংসার খরচের সাধারণ ঘি এইখানেই পাওয়া যাইত, কিন্তু আমার জন্য আসিত সাঁইথিয়ার নিকটবর্তী কি একটা গ্রাম হইতে। তাহা লোক পাঠাইয়া আনাইয়া লইতে হইত।

কথাটা রাজলক্ষ্মীর অন্যমনস্ক কর্ণরন্ধ্রে হয় প্রবেশ করে নাই, না হয় ত সে ভুলিয়াছে।জিজ্ঞাসা করিল, কবে থেকে নেই মহারাজ?

তা হবে পাঁচ-সাতদিন।

এই পাঁচ-সাতদিন তাঁকে ভাত খাওয়াচ্চ? রতনকে ডাকিয়া কহিল, আমিই যেন ভুলেছিলাম, কিন্তু তুই কি আনিয়ে দিতে পারতিস নে বাবা! এম্‌নি করেই কি সবাই মিলে আমাকে জব্দ করতে হয়!

রতন মনে মনে তাহার ঠাকুরানীর উপর খুশি ছিল না। দিবারাত্রি বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র থাকায় এবং বিশেষ করিয়া আমার প্রতি ঔদাসীন্যে তাহার বিরক্তির একশেষ হইয়া ছিল, কর্ত্রীর অনুযোগের উত্তরে ভালমানুষের মত মুখ করিয়া কহিল, কি জানি মা, তুমি গেরাহ্যি করলে না দেখে ভাবলুম ভাল দামী ঘি বোধ হয় আর চাইনে। নইলে পাঁচ-ছদিন ধরে রোগামানুষকে আমি ভাত খেতে দিই!

রাজলক্ষ্মীর বলিবার কিছুই ছিল না, তাই ভৃত্যের কাছে এতবড় খোঁচা খাইয়াও সে কিছুক্ষণ নিরুত্তরে বসিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত ছটফট করিয়া বোধ করি সেইমাত্র তন্দ্রা আসিয়াছিল, রাজলক্ষ্মী দ্বার ঠেলিয়া ঘরে ঢুকিল এবং আমার পায়ের কাছে আসিয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া ডাকিল, তুমি কি ঘুমোলে?

বলিলাম, না,

রাজলক্ষ্মী কহিল, তোমাকে পাবার জন্যে আমি যা করেচি, তার অর্ধেক করলেও বোধ হয় ভগবানকে এতদিনে পেতুম। কিন্তু তোমাকে পেলুম না।

বলিলাম, হতে পারে মানুষকে পাওয়া আরও শক্ত।

মানুষকে পাওয়া? রাজলক্ষ্মী একমুহুর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, যাই হোক, ভালবাসাটাও ত একরকমের বাঁধন, বোধ হয় এও তোমার সয় না— গায়ে লাগে।

এ অভিযোগের জবাব নাই, এ অভিযোগ শাশ্বত ও সনাতন। আদিম মানব-মানবী হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এ কলহের মীমাংসক কেহ নাই—এ বিবাদ যেদিন মিটিবে, সংসারের সমস্ত রস, সমস্ত মাধুর্য সেদিন তিক্ত বিষ হইয়া উঠিবে। তাই উত্তর দিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া নীরব হইয়া রহিলাম।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, উত্তরের জন্য রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিল না। জীবনের এতবড় সর্বব্যাপী প্রশ্নটাকেও সে যেন এক নিমিষে আপনা-আপনিই ভুলিয়া গেল। কহিল, ন্যায়রত্ন ঠাকুর বলছিলেন একটা ব্রতের কথা,—কিন্তু একটু বলে সবাই নিতে পারে না, আর এত সুবিধাই বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে?

অসমাপ্ত প্রস্তাবের মাঝখানে মৌন হইয়া রহিলাম; সে বলিতে লাগিল, তিনদিন একরকম উপোস করেই থাকতে হয়, সুনন্দারও ভারি ইচ্ছে,—দু’জনের একসঙ্গেই তা হলে হয়ে যায়, কিন্তু—এই বলিয়া সে নিজেই একটু হাসিয়া বলিল, তোমার মত না হলে ত আর—

জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার মত না হলে কি হবে?

রাজলক্ষ্মী বলিল, তা হলে হবে না।

কহিলাম, তবে এ মতলব ত্যাগ কর, আমার মত নেই।

যাও—তামাশা করতে হবে না।

তামাশা নয়, সত্যি আমার মত নেই—আমি নিষেধ করচি

কথা শুনিয়া রাজলক্ষ্মীর মুখ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিল, কিন্তু আমরা যে সমস্ত স্থির করে ফেলেচি। জিনিসপত্র কিনতে লোক গেছে—কাল হবিষ্যি করে পরশু থেকে যে—বাঃ! এখন বারণ করলে হবে কেন? সুনন্দার কাছে আমি মুখ দেখাব কি করে? ছোটঠাকুর—বাঃ! এ কেবল তোমার চালাকি। আমাকে মিছিমিছি রাগাবার জন্যে—না, সে হবে না, তুমি বল তোমার মত আছে।

বলিলাম, আছে। কিন্তু তুমি কোনদিনই ত আমার মতামতের অপেক্ষা কর না লক্ষ্মী, আজই বা হঠাৎ কেন তামাশা করতে এলে? আমার আদেশ মানতে হবে এ দাবি আমি ত কখনো তোমার কাছে করিনি!

রাজলক্ষ্মী আমার পায়ের উপর হাত রাখিয়া কহিল, আর কখনও হবে না, এইবারটি শুধু প্রসন্ন মনে আমাকে হুকুম দাও।

কহিলাম, আচ্ছা। কিন্তু ভোরেই তোমাকে হয়ত যেতে হবে, আর রাত ক’রো না শুতে যাও।

রাজলক্ষ্মী গেল না, আস্তে আস্তে আমার পায়ের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। যতক্ষণ না ঘুমাইয়া পড়িলাম ঘুরিয়া ঘুরিয়া বার বার কেবলি মনে হইতে লাগিল, সে স্নেহস্পর্শ আর নাই। সেও ত বেশিদিনের কথা নয়, আরা রেলওয়ে স্টেশন হইতে আমাকে যেদিন সে কুড়াইয়া বাড়ি আনিয়াছিল, সেদিন এমনি করিয়াই পায়ে হাত বুলাইয়া আমাকে সে ঘুম পাড়াইতে ভালবাসিত। ঠিক এমনিই নীরবে, কিন্তু মনে হইত তাহার দশ অঙ্গুলি যেন দশ ইন্দ্রিয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা দিয়া নারীহৃদয়ের যাহা-কিছু আছে, সমস্ত নিঃশেষ করিয়া আমার এই পা-দুটার উপরে উজাড় করিয়া দিতেছে। অথচ, এ আমি চাহি নাই, এই লইয়াই যে কেমন করিয়া কি করিব সেও ভাবিয়া পাই নাই। বানের জলের মত—আসার দিনেও আমার মত চাহে নাই, হয়ত যাবার দিনেও তেমনি মুখ চাহিবে না। চোখ দিয়া আমার সহজে জল পড়ে না, ভালবাসার কাঙালবৃত্তি করিতেও আমি পারি না। জগতে কিছুই নাই, কাহারো কাছে কিছু পাই নাই, দাও দাও বলিয়া হাত বাড়াইয়া থাকিতে আমার লজ্জা করে। বইয়ে পড়িয়াছি এই লইয়া কত বিরোধ, কত জ্বালা, মান-অভিমানের কতই না প্রমত্ত আক্ষেপ—স্নেহের সুধা গরল হইয়া উঠার কত না বিক্ষুব্ধ কাহিনী! এ-সকল মিথ্যা নয় জানি, কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে বৈরাগী তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল, হঠাৎ চমক ভাঙ্গিয়া বলিতে লাগিল ছি ছি ছি!

বহুক্ষণ পরে, ঘুমাইয়া পড়িয়াছি মনে করিয়া রাজলক্ষ্মী যখন সাবধানে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল, তখন জানিতেও পারিল না যে, নিদ্রাবিহীন নিমীলিত চোখের কোণ দিয়া আমার অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে। অশ্রু পড়িতেই লাগিল, কিন্তু আজিকার আয়ত্তাতীত ধন একদিন আমারই ছিল বলিয়া ব্যর্থ হাহাকারে অশান্তি সৃষ্টি করিয়া তুলিতে আর প্রবৃত্তি হইল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress