হুমায়ূন আহমেদ
আজ সারাটা দিন আমার মন খারাপ ছিল; এখন মধ্যরাত্রি, ছপছপ শব্দে কাদা-ভরা রাস্তায় হাঁটছি। মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এত দিনেও হাঁটার অভ্যেস হল না। আনিস এবং মজিদ কত নির্বিকার ভঙ্গিতেই না পা ফেলছে। এতটুকু ক্লান্ত না হয়েও তারা দশ মাইল হেটে পার হবে; বিপদ হবে আমাকে নিয়ে। জাফরও হাঁটতে পারে না। তবে আমার মতো এত সহজে ক্লান্তও হয় না। সমস্ত দলটির মধ্যে আমি সবচেয়ে দুর্বল। শরীরের দিক দিয়ে তো বটেই, মনের দিক থেকেও। তবুও আজকের জন্যে আমিই কমাণ্ডার। কমাণ্ডার শব্দটা শুনতে বড়ো গেয়ো। অধিপতি বা দলপতি হলে মানাত। না, আমি তেমন বাংলাগ্রেমিক নই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজি সাইন-বোর্ড ভাঙার ব্যাপার আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। যে-কোনো জিনিসের বাড়াবাড়ি আমাকে পীড়া দেয়। আর সে জন্যেই যুদ্ধে এসেছি।
এক মাইলও হাঁটি নি, এর মধ্যেই পা ভারি হয়ে এসেছে। কী মুশকিল! নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। শার্ট ভিজে গিয়েছে ঘামে।
ঢাকা থেকে ভাই, বোন, বাবা, মা সবাইকে নিয়ে একনাগাড়ে ত্রিশ মাইল হেঁটে পৌঁছেছিলাম মির্জাপুর। কী কষ্ট, কী কষ্ট! নিজের জন্যে কিছু নয়। জরী ও পরীর দিকে তাকান যাচ্ছিল না। পরীর ফর্স মুখ নীল বর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে অনেকেই হাঁটছিলেন। কাফেলার মতো ব্যাপার। এক-এক বার হুস করে সুখী মানুষেরা গাড়ি নিয়ে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। এমন হৃদয়বান কাউকে কি পাওয়া যাবে, যে আমাদের একটুখানি লিফট্ দেবে! দুঃসময়ে সবাই হৃদয়হীন হয়ে পড়ে। আমাদের সঙ্গে এক জন গৰ্ভবতী মহিলা ক্লান্ত পায়ে হাঁটছিলেন। তিনি ক্রমাগতই পিছিয়ে পড়ছিলেন। ভদ্রমহিলাস্ত্র স্বামী তা দেখে রেগে আগুন। রাগী গলায় বললেন, টুকুস টুকুস করে হাঁটছ যে? তোমার জন্যে আমি মরব নাকি? এই দীর্ঘ পথে কত কথাবার্তা হয়েছে কত জনের মধ্যে। কত অশ্রুবর্ষণ, কত তামাশা।–কিছুই আজ আর মনে নেই, কিন্তু ঐ স্বামী বেচারার কথাগুলি এখনো কাঁটার মত বুকে বিধে আছে। গৰ্ভবতী মহিলার শোকাহত চোখ এখনো চোখে ভাসে।
রাস্তাতেই পরীর হুঁ-হু করে জ্বর উঠে গেল। আমি বললাম, কোলে উঠবি পরী? পরীর কী লজ্জা। ক্লাস টেনে পড়ে মেয়ে, দাদার কোলে উঠবে কি? পরী অপ্রকৃতিস্থের মতো পা ফেলে হাঁটতেই থাকল। তার হাত ধরে–ধরে চলছি আমি। ঘামে ভেজা গরম হাত, আর কী তুলতুলে নরম। পরীর হাতটা যে এত নরম, তা আগে কখনো জানি নি। জরীর হাত ভীষণ খসখসে, অনেকটা পুরুষালি। কিন্তু পরীর হাত কী নরম, কী নরম।
মীর্জাপুরের কাছাকাছি এসেই পরী নেতিয়ে পড়ল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। বমি করতে লাগল ঘনঘন। বাবা একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। কোথায় ডাক্তার কোথায় কি? এর মধ্যে গুজব রটে গিয়েছে, ঢাকা থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক দল জোয়ানকে মিলিটারিরা এই দিকেই তাড়া করে আনছে। চারদিকে ছুটোছুটি, চিৎকার, আতঙ্ক। মা এবং জরী ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। বাবা যাকেই পাচ্ছেন তাকেই জিজ্ঞেস করছেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি ডাক্তার?
ডাক্তার পাওয়া যায় নি, কিন্তু এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে তাঁর ট্রাকে আমাদের টাঙ্গাইল পৌঁছে দিলেন। টাঙ্গাইল পৌঁছালাম শুক্রবার সন্ধ্যায়। পরী মারা গেল রোববার রাতে। সন্ধ্যাবেলাতে কথা বলল ভালো মানুষের মতো। বারবার বলল, কোনো মতে দাদার বাড়ি পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। তাই না বাবা?
পরীর মৃত্যু তো কিছুই নয়। কত কুৎসিত মৃত্যু হয়েছে চারপাশে। মৃত্যু এসেছে। সীমাহীন বীভৎসতার মধ্যে। কত অসংখ্য অসহায় মানুষ প্রিয়জনের এক ফোঁটা চোখের জল দেখে মরতে পারে নি। মরবার আগে তাদের কপালে কোনো স্নেহময় কোমল করম্পর্শ পড়ে নি।
অনেক মধ্যরাত্রিতে যখন অতলস্পর্শী ক্লান্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে কেলে তখন মনে হয় আমার হাত ধরে টুকটুক পা ফেলে পরী হাঁটছে।
যে-জান্তব পশুশক্তির ভয়ে পরী ছোট ছোট পা ফেলে ত্ৰিশ মাইল হেঁটে গেছে, আমার সমস্ত ক্ষমতা ও শক্তি তার বিরুদ্ধে। আমি রাজনীতি বুঝি না। স্বাধীনতাটাধীনতা নিয়ে সে-রকম মাথাও ঘামাই না। শুধু বুঝি, ওদের শিক্ষা দিতে হবে। জাফর প্রায়ই বলে, হুমায়ূন ভাই ইচ্ছে করে চোখ বুজে থাকেন। হয়তো থাকি। তাতে ক্ষতি কিছু নেই। আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করি নি, জাফর?
মনে মনে এই কথা বলে আমি একটু হাসলাম। জাফরের সঙ্গে আজ ভোরে আমার খানিকটা মন কষাকষি হয়েছে। সে চাচ্ছিল। আজকের এই এ্যাসাইনমেন্টের নেতৃত্ব যেন আসলাম পায়। জানি না। এর পেছনের সত্যিকার কারণটি কি? দলপতির পুতি আস্থা না থাকা বড়ো বিপজ্জনক। মুশকিল হচ্ছে-আমরা রেগুলার আর্মির লোকজন নই। আনুগত্য হল একটা অভ্যাস, যা দীর্ঘদিনের টেনিং-এর ফলে মজ্জাগত হয়। রেগুলার আর্মির এক জন অফিসারের অনুচিত হুকুমও সেপাইরা বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে। কিন্তু আমার হুকুম নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করবে। পছন্দ না হলে কৈফিয়ত পর্যন্ত তলব করে বসবে। কাজেই আমার প্রথম কাজ ছিল দলের লোকের আস্থা অর্জন করা। বুঝিয়ে দেওয়া যে, আমার উপর নির্ভর করা যেতে পারে। কিন্তু আমি তা পারি নি। কাপুরুষ হিসেবে মার্কা-মারা হয়ে গেছি।
যদিও তারা সব সময়ই হুমায়ূন ভাই, হুমায়ূন ভাই করে এবং সবাই হয়তো একটু শ্রদ্ধাও করে, কিন্তু সে-শ্রদ্ধা এক জন যোদ্ধা হিসেবে নয়।
আমার প্রথম ভুল হল আমি হাজী সাহেবের মৃত্যুতে সায় দিতে পারি নি। লোকটার নৃশংসতা সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। মৃত্যুদণ্ড যে তার প্রাপ্য শাস্তি, এতেও ভুল নেই। তবু আমার মায়া লাগল। ষাটের উপর বয়স হয়েছে। মরবার সময় তো এমনিতেই হল। তবু বাঁচবার কী আগ্রহ! সে আমাদের বিশ হাজার টাকা দিতে চাইল। শুনে আমার ইচ্ছে হল, একটা প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দি। কিন্তু আমি শান্ত গলায় বললাম–জাফর, হাজী সাহেবকে ক্যাম্পে নিয়ে চল। জাফর চোখ লাল করে তাকাল আমার দিকে। থেমে থেমে বলল, একে কুকুরের মতো গুলী করে মারব। হাজী সাহেব চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। এই তিনিই যখন মিলিটারি দিয়ে লোকজন মারিয়েছেন, তখন সেই লোকগুলিও নিশ্চয়ই আল্লাহকে ডেকেছিল। আল্লাহ তাদের যেমন রক্ষা করেন নি-হাজী সাহেবের বেলায়ও তাই হল। হাজী সাহেব অপ্রকৃতিস্থ চোখে তাকিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগলেন। জাফর এক সময় বলল, তওবা-টওবা যা করবার করে নেন। দোওয়াকালাম পড়েন। হাজী সাহেব। আর তখন হাজী সাহেব চিৎকার করে তাঁর মাকে ডাকতে লাগলেন।
ও মাইজি গো, ও মাইজি গো। কতকাল আগে হয়তো এই মহিলা মারা গেছেন। সেই মহিলাটিকে হাজী সাহেব হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ রাইফেলের কালো নলের সামনে দাঁড়িয়ে আবার তাঁর কথা মনে পড়ল। আল্লাহর নাম চাপা পড়ে গেল। এক অখ্যাত গ্রাম্য মহিলা এসে দাঁড়ালেন সেখানে।
আমি পিছিয়ে পড়েছিলাম। আনিস বলল, রাইফেলটা আমার কাছে দিন, হুমায়ূন ভাই। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। জাফর এবং হাসান আলি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু সড়কে উঠে পড়েছে। বেশ কিছু দূর এগিয়ে রয়েছে তারা। দ্রুত পা চালাচ্ছি। উঁচু সড়কে উঠে পড়তে পারলে হাঁটা অনেক সহজ হবে। পরিষ্কার রাস্তা, জল-কাদা নেই। এখান থেকেই আমরা সরাসরি গ্রামের ভেতর দিয়ে চলব। আমি উঠে আসতেই মজিদ বলল, জোঁক ধরেছে নাকি দেখেন ভালো করে। আনিসের পা থেকে তিনটি জোঁক সরান হয়েছে। একটা রক্ত খেয়ে একেবারে কোলবালিশ হয়ে গিয়েছিল।
হাসান আলি টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পায়ে উপর ফেলতে লাগল। না, জোঁকটোক নেই। তবে শামুকে লেগে পা অল্প কেটেছে। জ্বালা করছে। মজিদ বলল, একটু রেস্ট নিই, মালগাড়ির মতো টায়ার্ড হয়ে গেছি। দেখি আনিস, একটা সিগারেট।
আনিস সিগারেটের প্যাকেট খুলল। হাসান আলিও হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। সে আমাদের সামনে খাবে না, তাই একটু সরে গেল। আনিস বলল, আপনিও নিন একটা হুমায়ূন ভাই। সিগারেট টানলে আমার জিভ জ্বালা করে। নিকোটিন জিভের উপর জমা হয় হয়তো। তবুনিলাম একটা। আমাদের এখন সাহস দরকার। আগুনের স্পর্শ সে সাহস দেবে হয়তো। দেয়াশলাই সবে জ্বলিয়েছি, অমনি বাঁশবনের অন্ধকার থেকে কুকুর ডাকতে লাগল। তার পরপরই একটি ভয়ার্ত, চিৎকার শোনা গেল, কোডা, ঐখানে কেডা? কতা কয় না লোকটা! কেডা গো?
হারিকেন হাতে দু-চার জন মানুষও বেরিয়ে এল। ও রমিজের বাপ, ও রমিজের বাপ বলে চিকন কণ্ঠে তুমুল চিৎকার শুরু করল একটি মেয়ে। সবাই বড়ো ভয় পেয়েছে। এর মধ্যে অল্পবয়সী একটি শিশু তারস্বরে কাঁদতে শুরু করল। মজিদের উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল, ভয় নাই, আমরা।
তোমরা কেডা?
আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশে ভিড় জমে উঠল। হারিকেন হাতে ভয়কাতর লোকগুলি ঘিরে দাঁড়াল আমাদেম। অস্পষ্ট আলোয় রাইফেলের কালো নল চিকচিক করছে। আমরা তাদের সামনে অষ্টম আশ্চর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছি।
মিয়া সাবরা এটু পান তামুক খাইবেন?
না। আপনারা এত রাতেও জাগা, কারণ কি?
বড়ো ডাকাইতের উপদ্রব। ঘুমাইতাম পারি না। জাইগা বইয়া থাকি।
এই দিকে মিলিটারি আসছিল?
জ্বি না। তয় রাজাকার আইছিল দুই বার। রমেশ মালাকাররে বাইন্ধা লইয়া গেছে। গয়লা পাড়া পুড়াইয়া দিছে।
রাজাকারদের কেউ খাতির যত্ব করেছিল নাকি?
জ্বি না, জ্বি না।
এই গ্রামের কেউ রাজাকারে নাম লেখাইছে?
লোকগুলি চুপ করে রইল। জাফর ধমকে উঠল, বল ঠিক করে।
এক জন গেছে। কী করব মিয়া সাব, পেটে ভাত নাই। পুলাপানিডি ক্যান্দে।
আমি বললাম, দেরি হয়ে যাচ্ছে, চল হাঁটা দিই।
আনিসের বোধহয় কিছু কথা বলবার ইচ্ছে ছিল। সে অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
আনিসের এই স্বভাব আমি লক্ষ করেছি। মানুষের সপ্রশংস চোখ তার ভারি প্রিয়। যখনি আমাদের ঘিরে কিছু কৌতূহলী মানুষ জড় হয়, তখনি সে খুব ব্যস্ত হয়ে এল এম জি র ব্যারেল নাড়তে থাকে বা খামকাই গুলীর কেন্সটা খুলে ফেলে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে এমন একটা ভঙ্গি করে, যেন ভারি বিরক্ত হয়েছে। বক্তৃতা দিতেও তার খুব উৎসাহ দেশের এই দুদিনে আমাদের কী করা উচিত, এ সম্বন্ধে তার সারগর্ভ ভাষণ তৈরী। টেপ রেকর্ডারের মতো।–চালু করে দিলেই হল। গ্রামে গ্রামে প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করতে হবে। চোর, ডাকাত, দালাল নিমূল করতে হবে। দখলদার বাহিনীকে দাঁত-ভাঙা জবাব দিতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্তৃতা শেষে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিকট সুরে চেঁচিয়ে ওঠে-জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!
আনিস ছেলেটিকে আমি খুব পছন্দ করি। চমৎকার ছেলে, একটু পাগলাটে। অপারেশনের সময় সব বিচারবুদ্ধি খুইয়ে বসে। গুলী ছেড়ে এলোপাথাড়ি। পেছনে সরতে বললে ক্রল করে সামনে এগিয়ে যায়। সামনে এগুতে বললে আচমকা পেছন দিকে দৌড় মেরে বসে।
মেথিকান্দায় প্রথম অপারেশনে গিয়েছি। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, একেবারে ফাঁকা ক্যাম্প। চার জন পশ্চিম পাকিস্তানী রেঞ্জার আর গোটা পনের রাজাকার ছাড়া আর কেউ নেই। রাত দুটোয় অপারেশন শুরু হল। আমি আর সতীশ গর্তের মতো একটা জায়গায় পজিশন নিয়েছি। বেশ বড়ো দল আমাদের। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। দলের নেতা হচ্ছেন আবু ভাই। কথা আছে পশ্চিম দিক থেকে আবু ভাই প্রথম গুলী চালাতে শুরু করবেন, তার পরই মাথা নিচু করে খালের ভেতর দিয়ে চলে আসবেন আমাদের কাছে। আমরা সবাই পূর্ব দিকে বসে আছি। আনিস আর রমজান উত্তরে একটা মাটির টিবির আড়ালে চমৎকার পজিশন নিয়েছে। রমজান খুব ভালো মেশিনগানার। বসে আছি তো আছিই, আবু ভাইয়ের গুলী করার কোনো লক্ষণই দেখি না। সবাই অধৈৰ্য হয়ে উঠেছি। আচমকা আমাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলীবর্ষণ হতে লাগল। আমরা হতবুদ্ধি। অবশ্যি সবারই পজিশন ভালো। গায়ে গুলী লোগবার প্রশ্নই ওঠে না। তবু একদল ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল আর তার পরই মর্টারে গোলাবর্ষণ হতে লাগল। আমাদের দিকে সবাই চুপচাপ। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছি। রমজান মিয়া এই সময় উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কেউ ভয় পাবেন না, কেউ ভয় পাবেন না।
তার পরই রমজান মিয়ার মেশিনগানের ক্যাটিক্যাট শব্দ শোনা যেতে লাগল। সতীশকে বললাম, শুরু করা দেখি, আল্লাহ ভরসা। আর তখনি মর্টারের গোলা এসে পড়ল। বারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ধোঁয়া পরিষ্কার হতেই দেখি আমি আনিসের কাধে শুয়ে। আনিস প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছে। সবাই যখন পালিয়েছে, সে তখন জীবন তুচ্ছ করে খোঁজ নিতে এসেছে আমার। মেথিকান্দার সেই যুদ্ধে আমাদের চার জন ছেলে মারা গেল। রমজান মিয়ার মতো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হারলাম।
গুলী লেগে আবু ভাইয়ের ডান হাতের দুটি আঙুল উড়ে গেল। আবু ভাই তারপর একেবারে ক্ষেপে গেলেন। পাঁচ দিন পরই আবার দল নিয়ে এলেন মেথিকান্দায়। সেবারও দটি ছেলে মারা গেল। তৃতীয় দফায় আবার এলেন। সেবারও তাই হল। মিলিটারিরা তত দিনে মেথিকান্দাকে দুৰ্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করিয়েছে। চারিদিকে বড়ো বড়ো বাঙ্কার, রাত-দিন কড়া পাহারা। গুজব রটে গেল, মেথিকান্দা মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ। সতীশ বলত, যদি বলেন তাহলে গভর্ণর হাউসে বোমা মেরে আসব, কিন্তু মেথিকান্দায় যাব না, ওরে বাপ রে।
কিন্তু আবু ভাইয়ের মুখে অন্য কথা, মেথিকান্দা আমিই কাজ করব। যদি না পারি, তাহলে গু খাই। চতুৰ্থ বারের মতো তিনি বিরাট দল নিয়ে গেলেন সেখানে। সবাই ফিরল, আবু ভাই ফিরলেন না।
পঞ্চম বারের মতো যাচ্ছি। আমরা। আমার কি ভয় লাগছে নাকি? ছিঃ হুমায়ূন ছিঃ একটির পর একটি জায়গা তোমাদের দখলে চলে আসছে, মেথিকান্দায ঘাঁটি করে এক বার যদি সোনারদির রেলওয়ে ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বিরাট একটা অংশ তোমাদের হয়ে যাবে। আর এত ভয় পাওয়ারই—বা কী? মৃত্যুকে এত ভয় পেলে চলে? একটা গল্প আছে না–এক নাবিককে এক জন সংসারী লোক জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা কোথায় মারা গেছিলেন?
তিনি নাবিক ছিলেন। সমুদ্রে জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরেছেন।
আর আপনার দাদা?
তিনিও ছিলেন নাবিক। মরেছেন জাহাজ ড়ুবিতে।
সংসারী লোকটি আত্মকে উঠে বলল, কী সর্বনাশ! আপনিও তো মশাই নাবিক। আপনিও তো জাহাজ ড়ুবি হয়ে মরবেন!
নাবিকটি বলল, তা হয়তো মরব। কিন্তু নাবিক না হয়েও আপনার দাদা বিছানায় শুয়ে মরেছেন, ঠিক নয় কি?
হ্যাঁ।
আপনার বাবাও বিছানাতেই মরেছেন, নয় কি?
হ্যাঁ, হাসপাতালে!
আপনিও সেইভাবেই মরবেন। তাহলে বেশ-কমটা হল কোথায়?
আসল কথা, আমার ভয় লাগছে। সাহস সঞ্চায়ের চেষ্টা করছি। ভয় পাওয়াতে লজ্জার কিছু আছে কি? আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এই মনে করে গুনগুন করে গান গাইতে চেষ্টা করলাম।–সেদিন দুজনে। শিস দিয়ে আমি বেশ ভালো সুর তুলতে পারি। কিন্তু গান গাইতে গেলেই চিত্তির। জরী বলে, তোমার মীড়গুলি খুব ভালো আসে, আর কিছুই হয় না। কি জানি বাবা, মীড় কাকে বলে। আমি এত সব জানি না। আমি তো তোর মতো বিখ্যাত শিল্পী নই, গান নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। বাথরুমে গোসল করতে করতে একটু গুনগুন করতে পারলেই হল।
জাফরটা ভীষণ গান-পাগল। যেই গুনগুন করে একটু সুর ধরেছি, অমনি সে পিছিয়ে পড়েছে। এখন সে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। জাফর যাতে ভালোমতো শুনতে পায়, সেই জন্যে আরেকটু উঁচু গলায় গাইতে শুরু করলাম। আমার গুনগুন শুনেই এই? জরীর গান শুনলে তো আর হুঁশি থাকবে না। জাফরকে এক দিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, গান গায় যে কানিজ আহমেদ, তার নাম শুনেছি? সে চমকে উঠে বলল, নজরুল— গীতি গান যিনি, তাঁর কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
খুব শুনেছি। আপনি চেনেন নাকি?
আমি সে-কথা এড়িয়ে গিয়েছি। যুদ্ধটুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জাফরকে এক দিন বাসায় নিয়ে যাব। জরীকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেব, এর নাম আবু জাফর শামসুদ্দীন। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর জাফরকে হেসে বলব, জাফর, এর নাম হল জরী। আমার ছোট বোন। তুমি চিনলে চিনতেও পার, গানটান গায়, কানিজ আহমেদ। শুনেছি হয়তো।
জাফর নিশ্চয়ই চোখ বড়ো করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। সেই দৃশ্যটি আমার বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে। তা ছাড়া আমার মনে একটি গোপন বাসনা আছে। জরীর সঙ্গে বিয়ে দ্বিয়ে দেব জ্বাফরের। যুদ্ধের মধ্যে যো-পরিচয়, তার চেয়ে খাঁটি পরিচয় আর কী হতে পারে? জাফরকে আমি ভালোভাবেই চিনেছি।
কিন্তু জরীর কি পছন্দ হবে? বড়ো খুঁতখুতে মেয়ে। সমালোচনা করা তার স্বভাব। কেউ হয়তো বাসায় গিয়েছে আমার খোঁজে, জারী আমাকে এসে বলবে, দাদা, তোমার এক জন চ্যাপ্টা মতো বন্ধু এসেছে। অরুণকে সে বলত কাৎলা মাছ। অরুণ রেগে গিয়ে বলেছিল, কাৎলা মাছের কী দেখলে আমার মধ্যে? জরী সহজভাবে বলেছে, তোমার মাথাটা শরীরের তুলনায় বড়ো তো, এই জন্যে। আচ্ছা, রাগ করলে আর বলব না। আদর দিয়ে-দিয়ে মা জরীর মাথাটি খেয়ে বসে আছেন। অল্প বয়সেই অহংকারী আর আহ্লাদী হয়ে উঠেছে।
কে জানে এর মধ্যে বিয়েই হয়ে গেছে হয়তো। অনেক দিন তাদের কোনো খবর পাই না। শুনেছি। বাবা আবার ঢাকা ফিরে এসেছেন। ওকালতি শুরুর চেষ্টা করছেন। দেশে এখন কি আর মামলা–মোকদ্দমা আছে? টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারছেন। কিনা কে জানে।
ঢাকার অবস্থা নাকি সম্পূর্ণ অন্য রকম। কিছু চেনা যায় না। ইউনিভার্সিটি পাড়া খা-খী করে। দুপুরের পর রাস্তাঘাট নিঝরঝুম হয়ে যায়। ঢাকায় বড়ো যেতে ইচ্ছে করে। কত দিন ঢাকায় যাওয়া হয় না। আবার কি কখনো এ-রকম হবে যে নিৰ্ভয়ে ঢাকার রাস্তায় হেটে বেড়াব! সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খেয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরব!
সলিল কিছুদিন আগে গিয়েছিল ঢাকায়। অনেক গল্প শুনলাম তার কাছে। খুব নাকি বিয়ে হচ্ছে সেখানে। বয়স্থা মেয়েদের সবাই ঝটপট বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ঘরে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। হতেও পারে। সলিল অবশ্যি বেশি কথা বলে, তবুও বিয়ে কি আর হচ্ছে না? বিয়ে হচ্ছে। নতুন শিশুরা জন্মাচ্ছে। মানুষজন হাট-বাজার করছে। জীবন হচ্ছে বহতা নদী।
একি! আবু ভাইয়ের মতো ফিলসফি শুরু করলাম দেখি। আবু ভাই কথায় কথায় হাসাতেন, আবার তার ফাঁকে ফাঁকে এত সহজভাবে এমন সব সিরিয়াস কথা বলে যেতেন–আশ্চর্য! আবু ভাই তাঁর অসংখ্য ভক্ত রেখে গেছেন, যারা তাঁকে দীর্ঘ দিন মনে রাখবে। এই–বা কম কী?
এক দিন হস্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন আবু ভাই। দারুণ খুশি-খুশি চেহারা। মাথার লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে বললেন, হুমায়ূন, গুড নিউজ আছে। মিষ্টি খেতে চাও কিনা বল।
চাই চাই।
ভেরি গুড নিউজটা পরশু শোনাব। মিষ্টি যোগাড় করি আগে, তার পর। পরশু। সন্ধ্যায় সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব।
সেই গুড নিউজটি শোনা হয় নি। দারুণ ব্যস্ততা শুরু হল হঠাৎ ছড়িয়েছিটিয়ে পড়লাম সবাই। এবং সবশেষে আবু ভাই গেলেন মেথিকান্দা।
আবু ভাইয়ের লাশ হাসান আলি বয়ে এনেছিল। বিশেষ কোনো কথাবার্তা বলে নি। হাউমাউ করে কাঁদেও নি। অথচ সবাই সেদিন বুঝেছিলাম, হাসান আলির মন ভেঙে গেছে।
মজিদ ডাকল, পা চালিয়ে হুমায়ূন ভাই, আপনি বারবার পিছিয়ে পড়ছেন। হাসান আলি দেখি হন।হন করে এগিয়ে চলছে। এত চুপচাপ থাকে কেন লোকটা?