Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 28

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যের বয়স ছিয়াত্তর সাতাত্তর। বেশ শক্ত আছেন। খালি চোখে ছানি পড়েছে। এখনও পাকেনি বলে কাটানো হচ্ছে না। দাঁত প্রায় সবই অক্ষত। মাথার চুলগুলি সব সাদা। গোঁফ দাড়ি পরিষ্কার কামানো। তাঁর দাদা চোমরানো গোঁফ রাখতেন। বিশ্বনাথ যেন দাদার থেকে নিজেকে আলাদা বলে চেনাবার জন্যেই গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন। রাম লক্ষ্মণ বা গৌর নিতাইয়ের সঙ্গে দু-ভাইয়ের তুলনায় কোথায় যেন তিনি গভীরভাবে ক্লান্ত। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন হাফ পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, পায়ে শুঁড়তোলা চটি। বেশ খটখট করে উঠে এলেন, প্রায় নিঃশব্দে। বন্দনা বাইরের পোশাক পরে বেরোচ্ছিল, কাঁধে ব্যাগ, মুখ নিচু। একেবারে অন্যমনস্ক। সিঁড়ির মোড়ে দু-জনে প্রায় ঠোকাঠুকি। বন্দনা অবাক হয়ে বলল—‘কাকাবাবু!’ বিশ্বনাথ ঘেমে গেছেন, বন্দনা বলল—‘আসুন, পাখার তলায় বসুন।’ অনেক দিন বাদে সে মাথায় কাপড় টেনে দিয়েছে। বিশ্বনাথবাবু বসতে, প্রণাম করেছে অনেকখানি মাথা নিচু করে। একটা অভ্যাসও ভোলেনি। বিশ্বনাথবাবু সেই যুগের মানুষ যাঁরা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম নেন। দু হাত মাথায় রেখে আশীর্বাদ করেন।

—‘সুখী হও মা,’ বলতে বলতে বিশ্বনাথবাবুর গলা ভারি হয়ে এল, —‘জীবনের কতগুলো বছর তো কেটেই গেল। বৃদ্ধের এ আশীর্বাদ যেন বাকি জীবনটাতে তোমার কাজে লাগে মা।’

বন্দনা ব্যস্ত হয়ে বলল—‘আপনি বসুন কাকাবাবু, আমি একটু শরবত করে আনি।’ তার মনে আছে বিশ্বনাথবাবু দু’বেলা দু কাপের বেশি চা খেতেন না। গরমকালে শরবত তাঁর খুব প্রিয়। বেশি উপকরণ লাগে না, পাতিলেবু নুন, চিনি দিয়ে ঠাণ্ডা জল। এই-ই তিনি খেতে ভালোবাসতেন, দোকানের বোতলের জিনিস নয়।

‘শোনো মা বসতে আসিনি, তোমার কাছে আর্জি নিয়ে এসেছি। যদি সাহস দাও তো পেশ করি, শরবতের কথা তার পরে ভাবা যাবে।’

বন্দনা বলল—‘কি আশ্চর্য! আর্জি? আমার কাছে আপনার?’

—‘হ্যাঁ মা, তোমার কাছে আমার। একদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে দুধের ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছিলে। কোনও সাধ্য ছিল না, তাই রুখতে পারিনি। কৃতী দাদা। সংসার তাঁরই। আমি চিরকাল এটা সেটা বাজে কাজে পৈতৃক টাকা, দাদার টাকা নষ্ট করেছি শুধু। মাথা তোলবার মুখ ছিল না। যা করেছেন চিরকাল মেনে নিয়েছি। আজ তাঁর অবর্তমানে যত অভাজনই হই, আমিই তো ও বাড়ির কর্তা! তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি বউমা।’

বন্দনা মুশকিলে পড়া গলায় বলল—‘আমি তো বেশ আছি কাকাবাবু। জীবনকাল এখানে কেটে গেল। এখন আর যেতে চাইলেই কি পারব?’

—‘দেখ মা, দাদা বউদিদি চলে গেছেন, তাঁদের ওপর আর অভিমান রাখতে নেই।’ বিশ্বনাথবাবু বললেন।

—‘আমার মনে আর কোনও রাগ-অভিমান নেই, কাকাবাবু।’

—‘সে আমি জানি না মা। বাড়ি সেই থেকে খাঁ খাঁ করে। দাদার বড় ছেলে চলে গেল অকালে, সেজ তো বাড়ি ছাড়া সেই কবে থেকে। শুনেছি তারা অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেট্‌ল করেছে। মেজবাবু থাকে বম্বেতে। সেখানে শহরতলিতে শ্বশুরের বিরাট সম্পত্তি পেয়েছে। তার ছেলেমেয়েরা এখানে আসতেও চায় না। এক রইল ছোটবাবু। তার কোনও ইস্যু নেই। স্বামী-স্ত্রীতে উদয়াস্ত চাকরি করে। অত পরিশ্রম যে ওদের কার জন্য, কিসের জন্য বুঝি না মা। তুমি শুনলুম খোকামণির বিয়ে দিচ্ছ, অত বড় বাড়ি আমাদের। আমার অনুরোধ ওখান থেকেই দাও। ওখানেই ছেলে-বউ নিয়ে থাক। বাড়ি তো তোমার ছেলেরও।’

বন্দনা কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। এই সময়ে কলি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নিচ থেকে উঠে এল। বোধহয় গাড়িতে বসে ছিল। বন্দনার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসল। ভাবটা-কেমন জব্দ করেছি।

—‘কথা হল তোমাদের? কাকু!’

—‘আমি আমার আর্জি পেশ করেছি মা।’

—কলি বলল—‘আর্জি পেশ আবার কি? নিজেদের বাড়ির বউ নিজেরা নিয়ে যাবে। শোনো বউমণি, অত ভেবো না। আগে একবার শ্যামবাজার ঘুরে আসবে চলো তো! আজই চলো!’

—‘সেই ভালো,’ বিশ্বনাথবাবু বললেন—খোকা কোথায়?

—‘খোকা তো অফিস গেছে।’

—‘তুমি!’

—‘আমার শনিবারে ছুটি থাকে। আমি একটু কেনাকাটা করব বলে বেরোচ্ছিলুম।’

—‘মার্কেটিং আজ থাক না বউমণি। আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি কি কেনাকাটা করবে শুনি!’ কলি ঝাঁঝিয়ে উঠল। গলা নামিয়ে বলল—‘চলো! কাকু বাড়ি বয়ে এসেছেন!’

বন্দনার দ্বিধা একটা কারণে নয়। শ্বশুর-শাশুড়ি এক এক করে মারা গেছেন। সে যায়নি। শ্বশুরমশাই যেদিন মারা গেলেন সে আর রূপ সুদীপ্ত সরকারের সঙ্গে ফুলেশ্বরে বেড়াতে গিয়েছিল। দিন তিনেকের ব্যাপার। কিন্তু অত পরে যেতে তার কিন্তু-কিন্তু লেগেছিল। শাশুড়ির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবার সাহসই তার হয়নি। আর শাশুড়ি যখন গেছেন তখন সে খুব অসুস্থ, নার্সিং হোমে। কলি তাকে খবরটা জানায়নি। দিনের পর দিন তার সঙ্গে কাটিয়েছে, সেবা করেছে, একবার মুখ ফসকেও বলেনি। অনেকদিন পর জেনেছে, তখন আর যাবার বেলা নেই। সেই সব অপরাধবোধ তার মনের মধ্যে ভারের মতো চেপে রয়েছে। মেজ দেওর, ছোট দেওরের বিয়ের সময়ে, মিলির বিয়ের সময়ে ওঁরা কার্ড পাঠিয়েছিলেন, সে যায়নি। উপহারস্বরূপ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল শুধু।

বিশ্বনাথবাবু বললেন—‘চলো মা, তালাচাবি যা দিতে হবে, দিয়ে নাও। আমরা আস্তে আস্তে নিচে নামি। তোমার কাকিমা কী খুশি যে হবেন!’

পঁয়তাল্লিশ নং শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে কবে শেষ রঙ পড়েছিল বন্দনা জানে না। সে বাড়ি ছাড়ার পর তিন তিনটে বিয়ে হয়েছে, কোনও একটাতে পড়ে থাকা সম্ভব। লাল ইঁটের বাড়ি। সকাল বেলার রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। সিংদরজা দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই খুড়শাশুড়ি বেরিয়ে এলেন। ছলছলে চোখ। বড্ড যেন বুড়ো হয়ে গেছেন। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গেছেন, এই সব শিরদাঁড়ার রোগ আগেকার দিনে একশ জনের মধ্যে পঞ্চাশ জনেরই হত। এখন কিন্তু আর হয় না ঠিকঠাক চিকিৎসা করালে। বন্দনা প্রণাম করতে আদরে জড়িয়ে ধরলেন।

কাকাবাবু বললেন—‘দাদার সেরেস্তাঘর, এই দামী লাইব্রেরি এসবের কোনও উত্তরাধিকারী নেই। আমি ঝেড়েঝুড়ে এখনও টিঁকিয়ে রেখেছি, তোমরা যা বুঝবে করো।’

সেই কালো পাথরের ঠাণ্ডা সিঁড়ি। দোতলায় ঘরের পর ঘর তালা ঝুলছে। কাকিমা বললেন—‘তুমি চলে যাবার পর থেকে তোমার ঘর তোমার কাকাবাবু তালা দিয়ে রাখেন সমানে। মেজর বিয়ে হল, ছোটর বিয়ে হল কাউকে খুলে দিলেন না। বটঠাকুরও কিছু বললেন না। যতই যাই বলুন, তাঁদের আদরের ছেলের আদরের বউই তো তুমি মা?’ দরজা খুলে দিয়ে বললেন—‘নাও, তোমার নিজের জিনিস বুঝে নাও।’

ডবল-বেড খাটে বন্দনার বিয়েতে বাবার দেওয়া জাজিম পাতা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাচ অস্বচ্ছ। পড়ার টেবিল, চেয়ার, শূন্য আলনা। কালো সাদা মার্বেলের মেঝে এইমাত্র বুঝি কেউ ধুয়ে মুছে গেছে। দেয়ালে তার স্বামীর ছবি। বহু পুরনো একটি টুরিজমের জমকালো ক্যালেন্ডার, যা বন্দনা অপূর্ব ছবিগুলোর জন্যে ফেলতে পারেনি। বন্দনার মনে হল তাকে কেউ পূর্বজন্মে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আবছা আবছা মনে পড়ছে সব। বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে কাকিমা বললেন—‘তুমি কাকাবাবুর কাছে বসো মা, আমি একটু কাজ সারি।’ কলি গাড়ি নিয়ে কোথায় গেছে। একটু পরে এসে বন্দনাকে তুলে নিয়ে যাবে। বৈঠকখানা ঘরে বসে কাকাবাবু খাটো গলায় বললেন—‘সাত কাঠার ওপরে ভদ্রাসন মা। আরও কাঠা তিনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। আমার অর্ধেক প্রাপ্য হয়। সে অর্ধেক আমি তোমাকে লিখে দেব। বাকিটুকুরও তিনভাগের এক ভাগ তোমার ছেলের। মানে দুয়ের তিন অংশই তোমার । তার ওপরে মেজ আর এখানে আসতে চায় না। তার শ্বশুরের অগাধ বিষয় সেখানে। এদিকে ছোট নিঃসন্তান। এত বড় বাড়ি পড়ে থাকবে মা, এই বেলা ছেলেকে নিয়ে এসে বসো।’

বন্দনা আস্তে আস্তে বলল—‘কাকাবাবু, আমি অত হিসেব বুঝি না। আমার একটা বাস করবার নিজস্ব জায়গা আছে। আমি তো গৃহহীন নই! এখানে এতকাল পরে এভাবে এলে মেজদা কি ছোড়দা যদি ভালো মনে নিতে না পারেন, সে অশান্তি আমি সইতে পারব না।’

বিশ্বনাথবাবু বললেন—‘না মা। তুমি ভুল বুঝছ। ছোট আর বউমা একটা শিশুর মুখের জন্যে হা পিত্যেশ করে থাকে। তোমরা এলে, তোমার বউমা এলে, নাতি নাতনি হলে এ ঘর দুয়োর ভরে যাবে, তাতে তাদের আনন্দের সীমা থাকবে না। আমি জানি।’

বন্দনা মনে মনে হাসল। কাকাবাবু অনেক দূর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছেন। বলল—‘আমি রূপুকে বলি। সে যদি রাজি হয় তো ভেবে দেখব।’

রূপের সঙ্গে অঞ্জুও এল সন্ধেবেলায়। স্কুটারের পেছনে চেপে। রাত ন’টায় একসঙ্গে খেয়ে বাড়ি ফিরবে। বন্দনা বাধ্য হয়ে তার সামনেই কাকাবাবুর প্রস্তাবটা পেশ করল। রূপ বলল—‘দূর, শ্যামবাজারের সেই আদ্যিকালের বাড়িতে কে ফিরে যাবে?’

অঞ্জু বলল—‘বাঃ, বাড়িটা তো তোমাদেরই। না গেলে তো বেহাত হয়ে যাবে! গাড়ল আর কাকে বলে!’

বন্দনা সামনে থেকে সরে গেল। অঞ্জুর কথাবার্তার ধরন শুনলে তার বিশ্রী মন খারাপ হয়ে যায়।

বন্দনা সরে যেতে অঞ্জু বলল—‘কোথায় তোমাদের শ্যামবাজারের দরদালান, আর কোথায় এই একরত্তি বাড়ি। ওখান থেকেই বিয়েটা হোক। বাড়িতে সম্পত্তিতে তোমার ভাগ রয়েছে, দখল নেবে না? কোথাকার বুদ্ধু রে!’

অনেক তর্কাতর্কির পর স্থির হল শ্যামবাজারের বাড়িতেই বিয়ে হবে। কিন্তু থাকা হবে আপাতত এখানেই। বন্দনার অফিস ডালহৌসী পাড়া ছেড়ে উঠে এসেছে লোয়ার সার্কুলার রোড। রূপ যায় হ্যারিংটন স্ট্রিট। শ্যামবাজার থেকে যাতায়াতের অসুবিধে।

রূপ বলল—‘তাছাড়া ওরকম যৌথ পরিবারে তুমি থাকতে পারবে?’

—অঞ্জু বলল—‘যৌথ পরিবারেই তো থাকছি।’

—‘কোথায়?’

—‘তোমার মা তো থাকছেন, যৌথ পরিবার ছাড়া কি?’

—‘ওখানে আমার দাদু-দিদা বুড়ো-বুড়ি রয়েছে। কাকা-কাকিমা রয়েছে, তাদের আমিই ভালো করে চিনি না।’

—‘তারা থাকবে তাদের মতো! আমি থাকব আমার মতো!’ রূপ কাঁধ নাচিয়ে বলল—‘কি জানি বাবা, তোমাদের মেয়েদের মতিগতি বোঝা ভার।’

হেসে উঠল অঞ্জু—‘বুঝতে চেষ্টা করো না। একেন্নম্বরের ভূত একটা।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress