শেষ সম্বল
অনিতার সঙ্গে আজ রাস্তায় দেখা হওয়ার পর এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছিলো দুজনেই যে কুশল বিনিময় করে কথা বললেও ফোন নাম্বারটা আর নেওয়া হলো না। ভাবলো দীপঙ্কর অন্ততঃ পক্ষে ফোনেও তো যোগাযোগটা থাকতো! তার বুকের ভেতরে অস্বস্তিকর একটা ছটফটানি স্থির থাকতে দিচ্ছে না কিছুতেই। এবয়সে এই অস্থিরতা ভালো লক্ষণ নয় মোটেও।
কোনোরকম ভাতদুটো খেয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। ফেলে আসা দিনগুলি যেন ছবির মতো একে একে উঠে আসছে । মনে পড়ছে চলার পথের বাঁকে বাঁকে কত সম্পর্কের আঁচল বিছানো ছিল তার জন্য!
সেই সব সম্পর্কের কোনো আঁচলেই বাঁধা পড়েনি শেষ পর্যন্ত । বৌদির বোন ঝুমুরের সঙ্গেই সম্পর্কটা রয়ে গেছিল,তবে সে সম্পর্ক রয়ে গেছিল পরকীয়ার আবেশ মাখা অনুভব নিয়ে। সে সম্পর্কের ঘনত্ব এতটাই ছিল যে দুজনের ভরাভর্তি সংসার সত্ত্বেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপনে মিলিত হতো দুজনে।
বিয়ের বহু বছর পরেও অব্যাহত ছিল তাদের প্রেম। ভালবাসার রসায়নে কামনার পারদ চড়েই ছিল। ঝুমুরের প্রতি দীপঙ্করের আগ্রহ ছিল মাত্রাছাড়া। দীপঙ্করের দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। তখনো সম্পর্কের উত্তাপ বাড়লো বৈ কমলো না এতটুকুও । ঝুমুর যেমন তাকে সর্বস্ব অর্পণ করেছিল,তেমনি ঝুমুরের ইচ্ছে পূরণের জন্য দীপঙ্করও তার জন্য কীনা করেছে! স্বাবলম্বী হতেও সাহায্য করেছিল সেদিন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিউটি পার্লার বানিয়ে ঝুমুরকে স্বাবলম্বী করে দিয়েছিল। এই পার্লারটাই ছিল তাদের অবাধ মিলনের চারণভূমি । দীপঙ্কর ভেবেছিল এই সম্পর্কটা হয়তো রয়েই যাবে সারাজীবনের মতো। এই ধারণা দৃঢ় হবার পেছনেও কারণ ছিল বৈকি! বিয়ের কিছুদিন পরও যখন ঝুমুরের বরের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। ওর বর ছিল ঝুমুরের তুলনায় যথেষ্ট বয়ষ্ক । সে সময় ঝুমুর তার দিদির কাছে মানে দীপঙ্করদের বাড়িতেই ছিল বেশ কিছুদিন। এই সময়টাই তাদের কামনার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। বিয়ে না হলেও তাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে কমতো ছিলই না বরং অনেক বেশীই ছিল বলা যেতে পারে । দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর প্রেমে উচ্ছ্বাস তো থাকবেই। বিশেষতঃ সেই নারী যদি স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। আর সুযোগ ! সে তো তৈরী করেই দিয়েছিল ঝুমুরের বাড়ীর লোকেরাই।
আরো কয়েক বছর ধরে সম্পর্কের ঘনত্ব বেড়েছিল বৈ কমে নি তবুও সব কিছুরই বোধহয় শেষ আছে, নাহলে এতদিনের এত ঘনিষ্ঠতার কথা ভুলে শেষ পর্যন্ত একদিন চলে গেছিল ঝুমুর। দীপঙ্করের কথা ভাবতে চায় নি আর। আর আত্মীয়দের মধ্যেও এ নিয়ে কানাঘুষোও ছিল বিস্তর। সেটা আর কানাকানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। তাছাড়া ইতিমধ্যে ঝুমুর মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাতায়াতের পথে একজন অবাঙালী আর স্বাস্থ্যবান যুবকের প্রেমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে , ঘটনাচক্রে দীপঙ্করের কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। এতকিছুর বিনিময়ে এই কৃতঘ্নতা তাকে নিঃস্ব রিক্ত করে তুললো। কাউকে বুঝতে না দিলেও মনের দিক থেকে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল সে সময়টা।
অনিতার কথা বড়ো বেশী করে মনে পড়ছে আজ, অথচ সেই সময় তার জন্য মনে কোন ভাবনাই ছিল না । থাকার কথাও নয়। আসলে সেই সময়টা দীপঙ্কর ঝুমুরের প্রেমে এতটাই মগ্ন ছিল যে চোখের সামনে আলো আঁধারির লুকোচুরি খেলাটুকু ধরতে পর্যন্ত পারেনি। যেদিন বুঝলো সেদিন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছিলো।
অরুণাক্ষ কাকু, দীপঙ্করের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ছেলে বিপুল পড়তো দীপঙ্করের সঙ্গে। বিপুলের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওরা থাকতো কিষণগঞ্জে। দূরত্ব থাকলেও সে দূরত্ব দুই পরিবারের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি কখনোই। পড়াশোনার পাট মিটে গেলেও অবাধ যাতায়াতের পথ প্রশস্ত ছিল। বিপুলের বোন অনিতার পরীক্ষার সীট পড়েছিল দীপঙ্কর দের শহরে। পরীক্ষা দিতে এসে অনিতা তখন বেশ কয়েকদিন রয়ে গেছিল দীপঙ্করের বাড়িতে। পরীক্ষার পর যে কদিন ছিল ঘরের কাজে হাত লাগাতো। দীপঙ্করের ফিরতে দেরী হলে রাত জেগে বসে থাকতো খাবার নিয়ে।
দীপঙ্করের দিক থেকে আগ্রহ ছিল না বলেই হয়তো অভিমান করে মুখ বুজে সরে গেছিলো।
হঠাৎ করেই একদিন বলেছিল ‘দেখবো তোমার বৌ কত সুন্দরী হয়! ‘
সেদিন অনিতাদের বাড়ীতেই ছিলো দীপঙ্কর ।যেমন যায় আরকি, অনিতার কথা শুনে তো থ একেবারে। সারারাত ঘুমাতে পারেনি সেদিন। অনিতার ছোট ছোট আচরণ গুলোর অর্থ খুঁজে পেয়েছিল সেদিন।মনে পড়ছিলো দীপঙ্করের উপস্থিতির খবর পেয়ে অনিতার বন্ধুরা সব এসে জুটতো, নানারকম রঙ্গ রসিকতা করতো। কখনো বা সিনেমা দেখতে যাবার কথা বলতো।
তারপর অনিতার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল যখন,দীপঙ্কর কে বলেছিলো ‘ জানো তো, আমার বর খুব সুন্দর আর খুব ভালো চাকরী করে।’
সত্যিই বড়ো অভিমানী মেয়ে ছিল অনিতা!
বছর তিনেক পর একবার দীপঙ্কর ওদের ওখানে ফুটবল খেলতে গেছিল ,খবর পেয়েই বরকে পাঠিয়েছিল খাবার জন্য নেমতন্ন করতে।
গেছিল দীপঙ্কর! আর হতবাক হয়ে গেছিল। বুঝতে পেরেছিল,অনিতার বিয়েটা সুখের হয়নি। বড়ো দুঃখ পেয়েছিল সেদিন।
অনিতার কথা ভুলতে পারে নি আজও।ভুলতে পারে নি ওর দীর্ঘশ্বাসের কথাও! আজো কখনো কখনো সত্যিই ওর কথা মনে হলে বড়ো দুঃখ হয় দীপঙ্করের।
ঝুমুরের চলে যাওয়ার ঘটনা দীপঙ্করের মন কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। যখন বুঝলো মন তখন হতাশায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ঝুমুর যে ছেড়ে যেতে পারে কোনদিন একথা তার মনে হওয়া দূরে থাক, কল্পনাতেও আসেনি। ঝুমুর যে অন্যের স্ত্রী সে কথা মাথাতেই ছিল না। থাকবে কী করে! অন্যের স্ত্রী হলেও দীপঙ্করের সঙ্গে তো তার সম্পর্কের বুনোটে টান পড়ে নি কোনদিনই কোথাও কোনোখানেই।
ঝুমুর চলে যাবার পরের দিনগুলোয় বড়ো বেশী একা হয়ে গেল দীপঙ্কর। এতদিনের অবাধ ঘনিষ্ঠতার শেষ হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। সেই মনকেমনের দিনগুলোতে একবুক হাহাকার নিয়ে যাপনের সময় গুলো ছিল বড়োই বেদনার!
সময় কাটানোর জন্য মোবাইলের ফেসবুক আইডি থেকে নূতন নূতন বন্ধুর খোঁজ খবর, পুরানোদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করতে করতে দিনগুলো মন্দ কাটছিল না। তবুও হতাশা আর অবসাদ কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না তার।
একবুক হতাশায় কোন একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো দীপঙ্কর! মনের অবস্থাটা যখন এরকম সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পরিচয় হলো রমার সঙ্গে। পরিচয়টা প্রেমে গড়াতেও দেরী হলো না। একেবারেই সাদামাটা চেহারা রমার, তবুও দীপঙ্করের সঙ্গে রমার প্রেমের কারণ ছিল এক দীপঙ্করের একাকীত্ব, দুই হলো রমার অনুভূতি প্রবণ মন। দীপঙ্করের লেখার হাত ছিল ভালো, এতদিন নানা ব্যস্ততার কারনে লেখার জগতে সেভাবে সাড়া জাগাতে পারে নি। রমার প্রেমহীন জগতে দীপঙ্কর আলোর মতো,পতঙ্গ যেমন মৃত্যুর টানে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় ঝাঁপ দেয় ঠিক তমনই একবুক আলোর তৃষ্ণা নিয়ে দীপঙ্করের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলো রমা। অনুভূতিময়ী রমার প্রেমের জোয়ারে অবগাহন করে শুরু হলো দীপঙ্করের নতুন জীবন , রমার প্রেরণায় দীপঙ্করের লেখা শুরু হলো, খণ্ডিত চিত্রগুলি, মুহূর্ত গুলি মূর্ত রূপ পেলো তার কবিতায়। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বের করে আনতে লাগলো যাপিত সুখের মুহূর্ত । স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ায় দীপঙ্করের সাথে প্রেম কোনো বাঁধ মানলো না। মনে মনে রোমাঞ্চিত রমা এখন প্রাণ-স্পন্দনে ভরপুর। তার জীবন ছিল বর্ণহীন। দীপঙ্করের বর্ণময় জীবনে সে খুঁজে পেল আলোর ঠিকানা। দিনগুলো কাটছিল ভালোই তবুও ইদানীং একটা খটকা লাগে। একটা বিষয় শুধুই যে তার মানসিক দ্বন্দ্বের কারণ হলো তা নয় রীতিমত অশান্তির সৃষ্টি হলো। রমার মনের সমস্ত অলিন্দ জুড়ে যখন দীপঙ্করের প্রেমে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ,তখনই দীপঙ্করের লেখার মধ্যে তার বর্ণময় অতীতের ছায়া গুলি উঠে এসে মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ করে দিত রমার বর্তমান প্রেমময় দিনগুলি। মনের মধ্যে জেগে উঠতো একের পর এক প্রশ্ন ,”আমার ভূমিকা তাহলে ঠিক কী? অতীতের ছায়া এতই স্পষ্ট যে বর্তমানকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে? আমি কী শুধুই প্রয়োজন মাত্র? ” মানসিক টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্ব প্রতি মুহূর্তে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলতে লাগলো। মনকে প্রবোধ দিয়ে বারবার ভালোবাসার প্রাসাদ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে আর তখনই মুহূর্তে র আঘাতে সে প্রাসাদ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে তার মানসিক চেতনা। অবচেতন মনে ভালোবাসার ছায়া নিয়ে বেঁচে থাকতে লাগলো।
বাস্তবের পথ সকলেরই চেনা থাকেনা,চেনা পথে চলতে চলতে একদিন কোন একজনকে দেখে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না মানুষের মুগ্ধ হৃদয়! ভালোমন্দের দ্বন্দ্ব দ্বিধা কাটিয়ে ভালো লাগার কল্পনায় মগ্ন হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই। তারপর কল্পনার জগতে ভাসতে ভাসতে কেটে যায় দিন।হঠাৎ করেই কোন ঘটনার নিরিখে এক মুহুর্তেই টের পায় বিশ্ব ভুবন জুড়ে পেতে রাখা প্রেমের ফাঁদে আটকে,কলে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ।
রমার কথা ভাববার মতো সময় কোথায় দীপঙ্করের ! লেখালেখির জীবনেও দীপঙ্করের সাফল্য এলো সময়ের হাত ধরে। আজ সমকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ কবির শিরোপায় ভূষিত সে। তার অটোগ্রাফ নেবার জন্য অপেক্ষা করে কত শত অনুগামী ভক্তের দল। চারিদিকে ঘিরে থাকা স্তাবকদের মাঝেও অসীম শূন্যতার অনুভবটুকু ব্যক্ত করে রাখতেই মরিয়া দীপঙ্কর, এটুকুই যে তার শেষ সম্বল!