Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শেষ-বিকেলের প্যাসেঞ্জার || Buddhadeb Guha

শেষ-বিকেলের প্যাসেঞ্জার || Buddhadeb Guha

চৌপান প্যাসেঞ্জারের গতি কমে এল।

জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম দূরে ছবির মতো একটা স্টেশন দেখা যাচ্ছে।

এইখানেই তাহলে থাক তুমি, এইখানেই এই জঙ্গল-পাহাড়-ঘেরা অখ্যাত জায়গায় তুমি নিজেকে নির্বাসিত করেছঞ্জ, হারিয়ে গেছ ইচ্ছা করে।

একটু আগেই কী একটা স্টেশন পেরিয়ে এলাম, (এই স্টেশনের উল্লেখ ছিল তোমার চিঠিতে) মনে পড়ল। আসলে কাল রাত থেকে আমার কিছুই মনে থাকছে না। ট্রেনটি যেই তোমার দিকে মুখ করে চলতে শুরু করেছে তোমার মুখ ছাড়া তোমার মুখের শান্তশ্রী ছাড়া কিছুই মনে থাকছে না।

কাউকে যে জিজ্ঞেস করব, তোমার ঠিকানায় পৌঁছোলাম কিনা, এমন দ্বিতীয় প্রাণী নেই এই কম্পার্টমেন্টে।

ট্রেনটা আর একটু এগোতেই নামটা পড়া গেল স্টেশনের।

এখানেই আমার সেই তুমি থাক। যাকে একবছর আমি দেখিনি। আজ তোমাকে চারঘন্টা চোখের দেখা দেখবার জন্যে তেরো ঘন্টা ট্রেন জার্নি করে আমি এসেছিঞ্জ, আবার তেরো ঘন্টা ট্রেন জার্নি করে আজই ফিরে যাব।

আজই ফিরে যাব শুনে তুমি বলবে, এলে কেন? কী লাভ এমন করে এসে?

উত্তরে কী বলব তা আমিও ভেবে রেখেছি, ভেবেছি বলবঞ্জ, এর চেয়ে বেশিই-বা থাকব কেন? থেকে লাভ কী? তোমাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করেছিল তাই দেখতে এলাম শুধু চোখের দেখা দেখার পক্ষে কি যথেষ্ট নয়? চারঘন্টা সময়?

আমি জানি, আমার কথার খোঁচাটা তুমি বুঝতে পারবে, তারপর মুখ নীচু করে বলবে যা ভালো মনে করো তাই-ই করবে। তোমার উপর আমার তো কোনো জোর নেই।

ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। সেটা বাঁধানো নয়। লাল কাঁকরের জমি। দু-পাশে শালের জঙ্গল ঘন হয়ে আছে। কাছেই বোধহয় কোনো হাট ছিল। আজ দেহাতি ওঁরাও-গঞ্জুরা নানারকম সামান নিয়ে হাট থেকে উঠছে নামছে। প্ল্যাটফর্মের এক কোণে একটি চায়ের দোকান। চা ও গরম সিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে।

ট্রেনটা থামার আগেই স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা চোখ বুলিয়ে নিলাম। কোথাওই

তোমাকে দেখা গেল না। স্টেশনমাস্টার, চেকারবাবুরা, কালোকালো সরলমুখ দেহাতি লোকজনের মুখগুলো আমার চোখের মণির লেন্সে ধরা পড়েই ফেড-আউট করে গেল। কারো ছবিই চোখে লেগে থাকল না।

ফিসফিস করে বৃষ্টি কথা বলছে।

ঝোলাটা কাঁধে ফেলে নেমে পড়লাম।

নেমে পড়তেই দেখলাম, সেই চায়ের দোকানের ভিতরের কাঠের বেঞ্চ থেকে উঠে, ছাতা খুলে তুমি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলে।

একটা খয়েরি রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছিলে তুমি, ফিকে খয়েরি-রঙা ব্লাউজ। এলো-খোঁপা করেছিলে, টিপ পরেছিলে বড়ো করে। তোমার মনে ছিল, বড়ো করে টিপ পরলে তোমাকে আমি বেশি সুন্দর দেখি।

তুমি ভিড় ঠেলে হাসি মুখে এগিয়ে আসছিলে আমার দিকে। সেই মুহূর্তে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে আমার বুকের মধ্যে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু উপায় নেই। লোকজন, আদিগন্ত বে-আব্রু আকাশ, সমাজ, সংসার, এত কিছুর ব্যুহ ভেদ করে যা সমস্ত জীবন এমন তীব্রভাবে চাইলাম, তা করতে পারলাম কোথায়?

তুমি কাছে এলে, এসে আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলে, বললে, খুব কষ্ট হয়েছে তোমার, না? এই পাণ্ডব-বর্জিত জায়গায় ভদ্রলোক আসে! তারপরই বললে, চলো চা খেয়ে নেবে গরম গরম, ভালো লাগবে। কেমন ঠান্ডা দেখছ তো? এখানে এই শীতে আমরা কী করে থাকি বুঝতেই পার।

আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কি শরীর খারাপ? জ্বরটর হয়নি তো?

তুমি হাসলে, বললে, নাঃ। কিছু না।

আজ স্কুলে যাওনি?

আজ ছুটি নিয়েছি।

কেন?

তুমি আমার চোখে তাকালে। উত্তর দিলে না কোনো। তোমাকে হঠাৎ দেখে মনে হল, তুমি ভীষণ লাজুক হয়ে গেছ। আমার সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় যেমন ছিলে।

চা খাওয়ার পর স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমরা।

বাইরেটা ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে। কোনো ট্যাক্সি বা সাইকেল রিক্সা কিছুই নেই।

আমি বললাম, তোমার কোয়ার্টার কি কাছেই?

তুমি বললে, তা প্রায় মাইল দেড়েক হবে। চলোশর্টকার্ট দিয়ে যাই। পথটা তোমার ভালো লাগবে। তারপর বললে, জান কোনোরকম কনভেয়ান্স নেই। পা ছাড়া। নিজেদের পা ছাড়া যাদের দাঁড়াবার আর কোনো উপায় নেই, শুধু তাদের জন্যই এই জায়গা।

ছোটো পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে মাঠ পেরিয়ে বড়ো বটগাছের তলা দিয়ে কতগুলি ছোটো ছোটো দোকান পেরিয়ে আমরা একেবারে নির্জনতার মধ্যে এসে পড়লাম। জায়গাটা

একটা মালভূমির মতো। চতুর্দিকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পুরোনো মহুয়া গাছ এখানে-ওখানে, ছাড়াছাড়া শাল সেগুন, কাছে-দূরে, সবুজের আড়ালে আবডালে, লাল টালির ছাদওয়ালা বড়ো ছোটো বাংলো। দেখতে দেখতে পথটা ঢালু হয়ে একটা পাহাড়ি ঝর্নার দিকে গড়িয়ে গেছে।

শুধোলাম, ঝর্নাটা পেরুতে হবে বুঝি? জল নেই?

তুমি বললে, জল আছেঞ্জ, হাঁটু জল, স্রোতও আছে।

ঝর্নার কাছে এসে তুমি বললে, তুমি আগে যাও, তোমার পিছনে আমি যাচ্ছি আমি এগিয়ে গেলাম। তুমি প্রায় আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগলে।

ঝর্নাটার মাঝবরাবর এসেছি, হঠাৎ তুমি উঃবলে আমার পাঞ্জাবির কোণাটা চেপে ধরলে। এতক্ষণ নিশ্চয়ই তোমার শাড়ি হাঁটুর উপরে তুলে নদী পেরুচ্ছিলে, আমাকে জড়িয়ে ধরতেই শাড়ি জলে ভিজে গেল। তুমি আমার বাহুতে ভর দিয়ে, দাঁড়িয়ে রইলে। তোমার গা-লাগতেই মনে হল গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কপালে হাত দিয়ে দেখি, প্রচণ্ড জ্বর।

কী করব ভেবে পেলাম না, কি বলব, তাও নয়।

বললাম, তোমাকে কোলে করে পার করে দিই।

অত জ্বরের মধ্যেও তুমি তেমনি হাসলে, দুষ্টু দুষ্টু হাসি, যেমন চিরদিন হাস। বললে, মোটেই না। অত দরদে কাজ নেই।

তাহলে আমার হাত ধরো।

না। হাত ধরব না। ধরবই যদি তো এমনিই ধরব, পাড়ে উঠে ধরব–। আমি বললাম, কেন? তুমি বললে, তোমার হাত ধরে যখন কোনো নদী পার হইনি, আজ আর তার দরকার নেই। আমি নিজেই পার হতে পারব। মাথাটা ঘুরে গেছিল, তাই।

আমি তোমাকে জানি। তাই কথা না বলে আবার এগিয়ে গিয়ে পাড়ের পাথরে বসলাম।

তুমি এসে আমার পাশের পাথরে বসলে।

আমি রাগের গলায় বললাম, এত জ্বর নিয়ে কেউ এই বৃষ্টিতে এতখানি পথ হেঁটে আসে? তুমি কীরকম লোক বলত? লোক তো আমি ভালো নয়, তা তো তুমি জানই। কিন্তু আমি না এলে কে তোমাকে চিনত? আমি ছাড়া তোমাকে কেউ কি চেনে, না চিনেছে কখনো?

চমকে ওঠে, তোমার মুখের দিকে চাইলাম।

তুমি থুতনির উপর মুখ রেখে, দুই হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলে। তোমার হাঁটুর উপর হাত রাখলাম আমি।

তুমি কথা বললে না, চুপ করে নদীর দিকে চেয়ে রইলে। একটু পরে বললাম, উঠবে না? তাড়াতাড়ি চলো, তোমার এক্ষুণি শুয়ে পড়া দরকার। ডাক্তার দেখিয়েছ?

এখানে ডাক্তার নেই, এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে রুবীয়া, সেখানে আছে। অ্যানাসিন খেয়েছি। বাড়ি গিয়ে আবার খাব। ঠিক হয়ে যাবে।

আমি অধৈর্য গলায় বললাম, কম করে তিন-চার জ্বর, গা পুড়ে যাচ্ছে, আর কী ছেলেমানুষি করছ তুমি? বাড়ি চলো, আমি এক্ষুনি ডাক্তার আনছি।

ও হাসল, বলল সত্যিই নেই, কী করে আনবে? আজ থেকে, কাল ভোরের বাসে গেলে, সেখান থেকে ট্যাক্সি করে আনতে পারবে। সে অনেক সময় ও খরচের ব্যাপার। আমার অত সামর্থ্য নেই। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এখানে তুমি আমারই মতো অসহায়। গাড়ি টেলিফোন, দাসদাসি, ড্রাইভার এখানে তোমার কিছুই নেই। তোমার পার্সের নোটগুলোর এখানে কোনোই মূল্য নেই। মূল্য নেই তোমার যশের, তোমার প্রতিপত্তির। এখানে তুমি আর আমি সমান। একদিক দিয়ে ভালোই, আমার জন্যে কিছু করে পৃথিবীর কাছে তোমার লজ্জা পাবার ভয় নেই, আমি এখানে সকলের সব নিন্দা, কুৎসা ও ঈর্ষার বাইরে দিব্যি আরামে আছি? বল? অনেক ভেবেচিন্তেই তো এই চাকরি নিয়েছিলাম।

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে তুমি হাঁফিয়ে পড়লে, চোখ বুজে ফেললে। তোমার সেই চোখ বোজা মুখের দিকে চেয়ে আমার মনে হল ওই পাহাড়ি ঝর্নাটা তার লালমাটি নুড়ি, খড়কুটো, তার ঘূর্ণি সব কিছু নিয়ে আমার বুকের মধ্যে উঠে এল। বুকের মধ্যে যে কী এক যন্ত্রণা হতে লাগল, তা বলার নয়। আমি তো কোন ছার, কোনো কবির পক্ষেও সে যন্ত্রণা ভাষায় ব্যক্ত করা বুঝি সম্ভব। ছিল না।

তুমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালে, বললে, চলো, তোমার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে।

আমি ওকে ধরে দাঁড় করালাম, তারপর ওর হাত ধরলাম, বললাম, আস্তে আস্তে চলো, আমার কাঁধে মাথা রেখে চল।

এবারে তুমি আর আপত্তি করলে না, আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললে।

কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ারা-গাছে ঘেরা একটি ছোটো লাল টালির ছাদওয়ালা বাংলো দেখা গেল।

পিটিস, ঝাঁটি ও মহুয়ার মধ্যে মধ্যে পুঁড়ি পথ বেয়ে নেমে পেছনের গেট দিয়ে আমরা ঢুকলাম। ঘরে এসেই তুমি বিছানায় শুয়ে পড়লে।

একটি দেহাতি মেয়ে কাজকর্ম করছিল। তুমি তাকে ডেকে খাবার দিতে বললে আমায়। আমি মুখ হাত-পা ধুয়ে এলাম।

২.

বাইরে দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটু পরে বিকেল ঘনাবে। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোমার জন্যে আমার সত্যিই কিছু করার নেই। তোমাকে এমন জ্বরের মধ্যে, ঘোরের মধ্যে একা একা। ফেলে রেখে আমাকে আবার আমার কাজে আমার সংসারের একঘেয়ে আনন্দহীন আবর্তে ফিরে যেতে হবে–ফিরে যেতে হবে টাকা রোজগার করতে, সকলের সবরকম চাহিদা মেটাতে।

পৃথিবীতে আমার একমাত্র একজনই লোক ছিল এবং সে তুমি! যার কাছে এলে আমার মন কানায় কানায় ভরে ওঠে। অথচ তোমার জন্যে করার মতো কিছুই আমি করতে পারিনি। বলতে গেলে, আমিই এই নির্বাসনে পাঠিয়েছি তোমাকে। আমার জন্যেই, আমার সম্মানের দাম দিতেই তুমিই এত দূরে চলে এসেছ যা কিছু তোমার ছিল সব ফেলে রেখে, বিনা

অনুযোগেঞ্জ, বিনা প্রতিবাদে। অথচ, বুকের মধ্যের যন্ত্রণায় ককিয়ে মরা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই তোমার জন্যে।

ঘরটা বেশ বড়ো। টালির ছাদ, দু-জায়গা দিয়ে জল পড়ছে। নেয়ারের খাটে সস্তা সুজনি পাতা–ঘরের কোণায় আলনা। তাতে তোমার জামাকাপড় ঝুলছে। চার-পাঁচখানা শাড়ি, বাড়িতে কেচে, পাট করে রাখা। দুটো শাড়ির পাড় খুলে গেছে। আলনার নীচে একজোড়া চটি। সোল ক্ষয়ে গিয়ে কাঁটা বেরিয়ে রয়েছে। চারিদিকে দৈন্য ও দারিদ্র্যের ছাপ, অথচ তোমার মুখে রানির উজ্জ্বলতা। অত জ্বরের মধ্যেও তোমার মুখে হাসি লেগেই আছে।

তুমি দুটো বালিশ মাথার নীচে দিয়ে আমার দিকে অপলকে চেয়ে রইলে। …টিয়া ঝাঁপাঝাঁপি করছে। ফলসা গাছে বুলবুলি গান গাইছে। ঘরের বাইরের সমস্ত আলো আনন্দ প্রায়ান্ধকার ঘরের ভিতরে তোমার রোগগ্রস্ত মুখে লেগে রয়েছে।

অনেকক্ষণ পর তুমি বললে, বাড়িতে সবাই ভালো আছে? তোমার স্ত্রী তোমার ছেলেরা? তোমার ছোটো ছেলে কার মতো দেখতে হয়েছে?

আমি চুপ করে রইলাম। বড়ো লজ্জা করতে লাগল আমার।

মুখ নিচু করে বললাম, ভালো আছে, সবাই ভালো আছে।

এমন সময় কাজের মেয়েটি মেঝে পরিষ্কার করে একটা কাঁথা পেতে খাওয়ার জায়গা করে দিল।

তুমি হঠাৎ বললে, দাড়ি কামালে না কেন? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। এরকম করে দেখতে ভালো লাগে না।

আমি হাসলাম, তোমার কোলের উপর রাখা হাতটা আমার হাতে নিলাম।

তুমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, দেখলাম, তোমার চোখে জল টলটল করছে।

তোমার কী করে মনে থাকে জানি না, আমি যা-যা খেতে ভালোবাসি সবই রান্না করেছিলে। তুমি শুয়ে শুয়ে বলতে লাগলে, এটা আর একটু খাও, ওটা আর একটুনাও, বললে. ভালো করে খাও লক্ষ্মীটি, তোমার জন্যে জ্বর গায়ে রান্না করেছি। আমার অনেক কষ্টের দাম দিও।

খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে বললাম, তোমার কোনো কষ্টের দামই-বা দিতে পারলাম বল? এ জীবনে শুধু তো নিলামই তোমার কাছ থেকে। বদলে কিছুই তো দিলাম না।

তুমি বললে, ওসব কথা থাক। ভালো করে খাও। কী ভালো যে লাগছে আমার। তুমি আমার পর্ণকুটিরে এসেছ, আমার চোখের সামনে বসে খাচ্ছঞ্জ, বিশ্বাস করো, ভালো লাগায় আমি মরে যাচ্ছি।

খাওয়া শেষ করে উঠে তোমার বিছানায়, তোমার পাশে বসলাম। লছমি তোমাকে লেবু মিশিয়ে বার্লি এনে দিল।

তুমি বার্লিটা শেষ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ বললে, এই! আমার কাছে এসো, ওরকম মুখ করে বসে আছা কেন? এসো, আমার কাছে এসো।

তুমি দু-হাতে আমার চুল এলোমেলো করে দিলে, দু-হাতে আমার মুখ ধরলে, আমার চোখের মধ্যে কী যেন খুঁজতে লাগলে। তারপর ঘরের কোণায় তোমার পড়াশোনার টেবলের

দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ওই ড্রয়ারে একটা জিনিস আছে, একটু নিয়ে আসবে?

ড্রয়ারটা খুলে দেখলাম, আমার একটা পুরোনো দিনের ছবি।

তুমি বললে, এখানে আনন।

ছবিটা তোমার হাতে দিলাম, তুমি ছবিটা হাতে নিয়ে বললে, তুমি শুধু আমার ছেঁড়া শাড়ি আর আমার অভাবটাই দেখলে, তুমি কোনোদিনও আমার সুখটা দেখলে না।

তারপর একটু থেমে বললে, মনে পড়ে, একদিন তুমি বলেছিলে, আমি তোমার রানি, আমি উত্তরে বলেছিলাম, ছাই! তোমার পেত্নী। কিন্তু আজ আমার সমস্ত দুঃখের মধ্যে আমার মতো করে কেউ জানে না যে, সত্যিই আমি রানি। আমার রাজাকে আমি রোজ দেখতে পাই না, কাছে পাই না এইটুকুই যা দুঃখ। তা বলে আমার এ পাওয়া তো মিথ্যা নয়। আমার এ সাম্রাজ্য তো হেলাফেলার নয়। এ পাওয়াকে মিথ্যা করে দেয় এমন কোনো শক্তি নেই পৃথিবীতে।

৩.

দেখতে দেখতে যাবার সময় হল।

আমি উঠলাম।

তুমি বাইরের দরজা অবধি এলে। এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম আমি মুখ নীচু করে।

তুমি পেছন থেকে ডাকলে, বললে, শোনো, আমার দিকে তাকাও, হাসো একটু। বললে, যাবার সময়ে অমন করে যেতে হয় না।

আমি একটু দাঁড়ালাম, কলের পুতুলের মতো হাসলাম, তারপর সেই পিটিস ও ঝাঁটিজঙ্গল পেরিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে লাগলাম।

তখন সন্ধ্যে হবো-হবো। শেষ বিকেলের হলুদ আলো প্রদোষের মাঠ-প্রান্তরকে কী এক ব্যথাতুর রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। চারিদিক থেকে তিতিরের কান্না আমার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

ট্রেন এসে গেছিল। ঝোলা কাঁধে উঠে পড়লাম।

ঘন্টা বাজল গাড়ির। ঘন্টা বাজল আমার মাথার মধ্যে। আমার বুকের মধ্যের শেষ-বিকেলের। প্যাসেঞ্জার। দিনের শেষ আলোয় যতি ও গতির মধ্যবর্তী স্বপ্নলোকে ঘন্টার শব্দের অনুরণনের মধ্যে এক নিরুদ্দেশ গন্তব্যর উদ্দেশ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেই সুন্দর সন্ধ্যার সমস্ত আলো, শব্দ, গন্ধ বেরিয়ে এসে আমার মন যেন এক দুর্গের সানন্ধকার ঘরে, একজন রোগিণীর আশ্চর্য চোখে চেয়ে রইল অনিমিখে। ট্রেনটা ছেড়ে দিল। তারপর গতি বাড়ালো ধীরে ধীরে। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে একা বসে আমি ভাবছিলাম, আমার সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যেও আমি কী কত অসহায়। পেছন ফিরে যাওয়ার জোরটুকু পর্যন্ত আমার নেই। শেষ-বিকেলের প্যাসেঞ্জার দুলতে দুলতে চলতে লাগল ঝিকিমিক করে আর একটা অদৃশ্য ধিকিধিকি আগুন ক্রমশই গনগনে হয়ে উঠতে লাগল আমার বুকের মধ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress