আবার একদিন প্রান্তিক এল
আবার একদিন প্রান্তিক এল। বলল, প্রদোষ একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দপ করে জ্বলে ওঠে নন্দিতা, দেখা! আমার সঙ্গে! মানে?
মানে হচ্ছে—বলছিল টুবলুকে কোনো বোর্ডিংয়ে ভর্তি করে দেওয়া দরকার কি না সেই পরামর্শ করতে।
পরামর্শ? আমার সঙ্গে? নন্দিতা ধারালো গলায় বলে, ন্যাকামিরও একটা সীমা থাকে, প্রান্তিক! কিন্তু দেখছি তোমার এই নির্লজ্জ বন্ধুটির কোথাও কোনোখানে সীমা নেই।
প্রান্তিক মিটমাটের সুরে বলে, বন্ধুর হয়ে আমি কিছু বলতে আসিনি নন্দিতা, আর তোমরা দুজনেই আমার বন্ধু। আজ থেকে নয়। কিন্তু সে কথা যাক, ও বলছিল, চিরদিনই তো ছেলেটাকে তার মায়ের বিজনেস বলে ভেবে এসেছি, তাই ওর সম্পর্কে কি করা সঙ্গত বুঝতে পারছি না।
নন্দিতা এ কথায় গলে না। নন্দিতা তীব্রস্বরে এইটুকুই জানিয়ে দেয়—প্রদোষ ভৌমিক খোকা নয়, আর তার ছেলেও খোকা নেই। নন্দিতার কোনো বিজনেস নেই। নন্দিতা ধরে নিয়েছে ত্রিভুবনে তার কেউ নেই, সে কারও নয়।
প্রান্তিক বিষণ্ণ হয়ে বসে রইল একটু। প্রান্তিকের মনে ক্ষীণ একটু আশা জাগছিল, ছেলের প্রশ্ন নিয়ে হয়তো একবার ওরা মুখোমুখি হবে। আর সেই মুখোমুখির ঘটনাতেই হয়তো সমস্ত পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যাবে। জগতে এমন ঘটনা ঘটে বৈকি। দুরন্ত রাগ, দুর্জয় অভিমান, হঠাৎ হয়তো একবার কাছাকাছি আসার সূত্রে ভেঙে যায়, গলে যায়। একটু নির্জনতায়, একবার চাহনিতে যে কী হয়, কী না হয়!
কিন্তু প্রান্তিকের আশা রইল না। নন্দিতা যেখানে দেখা করতে চাইল, সেখানে হৃদয়-সমস্যার সমাধান হয় না। তবু নন্দিতা সেই স্থানটাই নির্বাচন করল। বলল, বোলো দেখা করব। কোর্টে। তার আগে নয়।
.
প্রদোষ হেসে বলল, কী হে ভগ্নদূত, দেখলে তো? বলিনি? চিনি তো মহিলাকে!
প্রান্তিক রুক্ষ গলায় বলে, এমন ছিল না ও প্রদোষ, তুমিই করে তুলেছ।
অস্বীকার করছি না। যাক, আমি আর টুবলুর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাব না। ইচ্ছে হয় স্কুলে যাবে, না হয় স্কুলে যাবে না। রাস্তার রকবাজ ছেলে হয়ে ঘুরে বেড়ানোই যদি ওর, তোমরা গিয়ে কি বলে, নিয়তি হয়, তাই হবে।
তাই হবে? প্রান্তিক রুক্ষগলায় বলে, আর তুমি সে দৃশ্যের দর্শক হয়ে দার্শনিক-সুখ অনুভব করবে?
উপায় কি? প্রদোষ অবহেলাভরে ধোঁয়ার রিং সৃষ্টি করতে করতে বলে, সুদপদেশ দিতে গেলে নেবেন বাবু? জানো, ও আমার সঙ্গে কথাই বলে না। কোনো একটা প্রশ্ন করলে দশবারে উত্তর দেয়। আর যখন দেয় বা যেটা দেয়, মনে হয় তার থেকে একটা চড় বসিয়ে দিলেও অনেক কম অপমানিত হতাম। রাতদিন খোকামি করে বেড়াত, চকলেটের জন্যে বায়না করত, জামা-জুতোর ঠিক রাখতে পারত না। অথচ এখন দেখছি একটি বিষধর সপশিশু!
প্রান্তিক ওর ক্ষুব্ধ মুখের দিকে তাকায়। প্রান্তিকের সহানুভূতি আসে না। প্রান্তিক রুক্ষ গলাতেই বলে, স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক? হুঁ, সবাইয়ের সব কিছুই স্বাভাবিক, শুধু একটা মানুষ যদি কোনোখানে একটু জীবনের রস অন্বেষণ করতে চায়, সেটাই বিশ্বছাড়া অস্বাভাবিক। কি বল? প্রদোষ বাঁকা গলায় বলে, কি হল? ভালো বাংলা বললাম না?
প্রান্তিক রুদ্ধগলায় বলে, উচ্ছন্নে যাও তুমি।
আহা, সে আর নতুন করে কী যাব? গিয়েই তো বসে আছি। শুধু ভাবছিলাম তুমি যদি শ্ৰীমতী নন্দিতার এই দুঃসময়ে তাকে একটু হৃদয়রসস্পর্শ জোগাতে পারতে, বিবেকের দংশনটা একটু কম অনুভব করতাম।
প্রান্তিক তীব্রস্বরে বলে, আর কোর্টে গিয়ে বলবার মতো দুটো কথাও পেতে।
প্রদোষ হেসে ওঠে। হা হা করে অস্বাভাবিক হাসি।
তারপর বলে, তোমাদের সাহিত্যিকদের এই এক দোষ, বড়ো তাড়াতাড়ি ভিতরের কথা বুঝে ফেল।
হঠাৎ ধমাস করে একটা শব্দ হয়।
এরা দুজনেই চমকে ওঠে।
তারপর লক্ষ করে বসবার ঘর আর টুবলুর পড়বার ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা রয়েছে, টুবলু সেটা যতটা সম্ভব জোরে বন্ধ করে দিয়েছে। এটা তারই শব্দ।
প্রদোষ তিক্ত হাসি হেসে বলে, দেখলে তো? এই ছেলেকে আমি আহা মাতৃহীন বলে পিঠে হাত বোলাতে যাব?
.
না, টুবলুর পিঠে হাত বোলাতে যাবার সাহস শুধু তার অপরাধী বাপেরই নেই তা নয়, কারোরই নেয়। মাসি একদিন ডেকে পাঠিয়েছিল, হয়তো ওই পিঠে হাত বোলাবে বলেই, টুবলু যায়নি। অতঃপর মাসিই একদিন এল। পিঠ পর্যন্ত নিয়ে গেল হাত, বলল, চ না তোতে আমাতে তোর হাড়মুখ মা-টার কাছে যাই। দেখি তোকে দেখে কেমন মুখমি বজায় রাখতে পারে!
কিন্তু টুলু সে হাতকে আর অগ্রসর হতে দিল না। টুবলু ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর মাসিকে একটা কথাও না-বলে গট গট করে বেরিয়ে গেল।
এরপর আর কার কাছে বসে থাকবে মাসি? কত আর অপমান সইবে? গজগজ করতে করতে চলে গেল, শনি, শনি ঢুকেছে বাড়িতে! সব কটার বুদ্ধিবৃত্তি ভব্যতা-সভ্যতা হরে নিয়েছে। নইলে—এই বাড়িই এই সেদিন পর্যন্তও ইন্দ্রভবন লেগেছে। আর এই সেদিনও ওই ছেলে মাসি একটা গল্প বল না বলে কাছ ঘেঁষে বসেছে।
তবে? তবে আর কি, শনিই। শনি ভিন্ন আর কোনো পাপগ্রহ এমন করে সব ধ্বংস করে দিতে পারে?
শিখাও সেই কথা বলে।
নন্দিতা যখন রুক্ষচুল শুষ্কমূর্তি নিয়ে এসে বাসায় ফেরে, শিখা বলে, শনি, শনিই ধরেছে। তোকে। নইলে এমন বিটকেল মূর্তি হয়? এসে দাঁড়ালি যেন রাক্ষুসী! তোর বরের বাড়ির মতো বড় আর্শি আমার না থাক, তবু ওই ছোটো আর্শিতেই নিজেকে দেখেছিস কোনোদিন?
নন্দিতা মৃদু হাসে, হঠাৎ আর্শিতে মুখ দেখে কী হবে?
কী হবে জানিস? পাঁচজনে তোর কী মুখোনি দেখছে সে বিষয়ে অবহিত হবি। লোকে বোধহয় নন্দিতা ভৌমিকের প্রেতাত্মা বলে মনে করছে তোকে।
তা তাই-ই।
আর্শিতে না-দেখেও নিজেকে নন্দিতা ভৌমিকের প্রেতাত্মাই ভাবছে নন্দিতা। যে প্রেতাত্মাটা অহরহ শুধু ভাবছে, কবে প্রদোষ ভৌমিকের নামটা কাগজে কাগজে ছড়াবে। কবে প্রদোষ ভৌমিক সেই ছড়ানো নামের লজ্জায় গুটিয়ে যাবে মাথা হেঁট করে। এই শুধু এই নন্দিতার ধ্যান-জ্ঞান।
.
অতএব চালিয়ে যাও কুশ্রীতার যুদ্ধ। দেখা যাক যুদ্ধফল। যুদ্ধে নামলে তো দুপক্ষই সমান নির্লজ্জ হয়ে উঠবে, সমান নোংরা, সমান ইতর। যুদ্ধের নিয়মই তো তাই। যুদ্ধক্ষেত্রের মানুষকে তো মানুষ বলে চেনা যায় না। কাজে কাজেই বলা যাচ্ছে না কে জয়ী হবে। তবু জয়ের মালা বুঝি প্রদোষ ভৌমিকের দিকেই হেলছে।
কারণ চারুভোষ পালিত নিজে এসে সাক্ষী দিয়ে গেছে—সমস্ত ব্যাপারটাই অমূলক। ভৌমিক, পালিত এবং মিসেস পালিতের মধ্যে যে একটি নির্মল বন্ধুত্ব আছে, সেই বন্ধুত্বের জন্য গর্ববোধ করে থাকে সে।
মিসেস ভৌমিক যে সেই নির্মল এবং পবিত্র বস্তুটিকে কালি-মাখা করে উপস্থাপিত করেছেন, সেটা কেবলমাত্র মেয়েলি ঈর্ষা-সঞ্জাত।
এরপর নন্দিতার পক্ষে শক্ত ভূমিতে দাঁড়ানো শক্ত হবে।
অতএব আবার উকিলের উপর চাই বড়ো উকিলের পরামর্শ। সেই ধান্ধায় ঘুরছে নন্দিতা—দিন নেই রাত নেই।
শিখা বলছে, তোকে ঠিক একটা বাঘিনীর মতো দেখতে লাগছে।
লাগুক-বাঘিনীই তো হয়ে উঠেছে নন্দিতা!
কিন্তু খবরের কাগজগুলোকে বোবায় পেয়েছে নাকি? আইন আদালতের পাতাগুলো যেন তার সমস্ত তীক্ষ্মতা আর সরসতা হারিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আছে।
কই, প্রদোষ ভৌমিক আর বিপাশা পালিতের নাম জড়ানো রসালো খবরগুলো কোথায়? যাতে দেশসুদ্ধ লোক টের পেয়ে যাবে প্রদোষ ভৌমিক নামের লোকটা কী চরিত্রের!
এ প্রশ্নে মুহুরি জীবনকৃষ্ণ হেসে ওঠে, বলে, এসব সংবাদ আর আজকাল কাগজে ওঠে না।
ওঠে না?
নাঃ। এ কেস তো আজকাল আকছার হচ্ছে। হাজারটা ডিভোর্স কেস ঝুলছে, কোন্টা রেখে কোন্টা দেবে। কাগজে অত জায়গা নেই।
কাগজে অত জায়গা নেই?
নন্দিতা হঠাৎ যেন ঝুলে পড়ে। নন্দিতার সব উত্তেজনা শিথিল হয়ে যায়। এ কেস আজকাল আকছার হচ্ছে? তবে নন্দিতা কী জন্যে এই ভয়ঙ্কর স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছিল? হাজারটার উপর আরও একটা হবার জন্যে? শুধু এই? আর কিছু না?
নন্দিতার জীবনের এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা, আকছার-ঘটে-চলা একটা বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন ঘটনা-প্রবাহের বুদবুদ মাত্র? তবে আর ও যুদ্ধে ফল কি? শুধু শেষ ফল ঘোষণাটুকুর আশায়? সেও তো বোঝা যাচ্ছে ক্রমশ। সেই শেষ ফলও হবে এমনি বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন বোদা বিস্বাদ। কেউ বাহাদুরি দিয়ে বলবে না-ওঃ, লড়ল বটে নন্দিতা! কেউ ধিক্কার দিয়ে বলবে না—ওঃ, শয়তান বটে ওই প্রদোষ নামের লোকটা!
নন্দিতা তবে এখন আবার বড়ো উকিলের বাড়ি ছুটবে কেন? নন্দিতা বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়বে না কেন? এ সময় শিখা বাড়ি থাকে না, চাকরটা কোথায় কোথায় বেড়াতে যায়, অতএব অবস্থাটা ঘুমের পক্ষে ভারী অনুকূল।
নন্দিতা তাই ডুপ্লিকেট চাবিতে দরজাটা খুলে নিয়ে শিখার সরু খাটটার উপর শুয়ে পড়ল ঝুপ করে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমিয়ে পড়ে কত সব যেন স্বপ্ন দেখতে লাগল নন্দিতা। কত কথা, কত লোক, নন্দিতা একটা বড়ো গাড়ি চড়ে কোথায় যাচ্ছে, হঠাৎ নন্দিতা সামনে আর রাস্তা দেখতে পাচ্ছে না, দেখছে শুধু অথই জল!
স্বপ্নের মধ্যেও ভাবছে নন্দিতা, কলকাতার রাস্তার মাঝখানে এতবড়ো নদী এল কোথা থেকে? নন্দিতার আর ওই যুদ্ধের কথা মনে পড়ছিল না। আর নন্দিতা এও টের পাচ্ছে না, তার ঘুমের অবসরে যুদ্ধফল ঘোষণা হয়ে গেল। কিন্তু সে কি লোকলোচনের অন্তরালে? সে কি বর্ণহীন? বৈচিত্র্যহীন? না, এতে একটা রং আছে বৈকি। চড়া রং, তাতে ও তো হাজারটার একটা বলে উদাসীন দর্শক চোখ ফিরিয়ে চলে যাবে না। আর খবরের কাগজের খবর সংগ্রহকারীরা কাগজে অত জায়গা নেই-বলে অবজ্ঞা করে ঠেলে রাখবে না। শহরের নিত্যঘটনার একটা হলেও, যে শুনবে বলবে, ই। বলবে, তা হবেই তো এই সব।
.
কিন্তু খবরটা প্রথমে নন্দিতার কাছে আসেনি। নন্দিতা তো তখন ঘুমোচ্ছিল।
খবর এল প্রদোষ ভৌমিকের কাছে। প্রদোষ ভৌমিক তখন তার বান্ধবীর সঙ্গে বাহুলগ্ন হয়ে সেই মাত্র একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোচ্ছে। সামনেই প্রান্তিক সোম। প্রদোষ হই চই করে উঠল, কী ব্যাপার? তুমি? তুমিও এসেছিলে বুঝি? বাস্তবিক ছবিটা দেখবার মতো, কি বলো?
প্রগল্ভ লোকটা লজ্জা ঢাকতে আরও একটু প্রগলভ হচ্ছে। কিন্তু তার বন্ধু তাকে অন্যদিনের মতো ধমক দিল না। বলল না, বাজে কথা রাখো। শুধু কালো শুকনো মুখে বলল, গাড়িতে উঠে এসো।
গাড়িতে? তোমার গাড়িতে? কেন?
কথা বলার সময় নেই, এসো।
বিপাশা পালিত ওর ওই গাম্ভীর্য দেখে একবার হেসে ওঠার চেষ্টা করল, হল না। প্রান্তিক সোমের মুখ দেখে থতমত খেলো। প্রদোষও বোধহয় তাই নিঃশব্দে উঠে এল প্রান্তিকের গাড়িতে।
হাত নেড়ে বলল বিপাশাকে, তুমি যাও। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে প্রদোষ ভৌমিক।
প্রান্তিকের ওই নিঃশব্দ শাসন আর অনুরক্ত ঘৃণা-আঁকা চোখের তারায় কী ছিল কে জানে! তাই প্রদোষ কথা বলতে পারে না।
কিন্তু প্রান্তিকই বা বলেছে কৈ, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে প্রদোষকে? কী করবে সেখানে গিয়ে প্রদোষ? কী দেখবে? নন্দিতা ভৌমিক বনাম প্রদোষ ভৌমিকের লড়াইয়ের রেজাল্ট?—থই থই জল থেকে টেনে তুলে অজস্র কৌতূহলী দৃষ্টির নীচে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে যাকে?
প্রদোষ ভৌমিক আসতেই ভিড় সরে গেল, আর সবগুলো দৃষ্টি এবার তার উপরেই পড়ল। অনেকগুলো চোখ, অনেক অর্থবহ। বিস্ময় ধিক্কার ঘৃণা সমবেদনা—কতরকম যেন। প্রদোষ কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। কারণ প্রদোষ এই প্রখর সূর্যালোকের মধ্যে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলল।
প্রদোষ তাই খানায় পড়ে-যাওয়া অন্ধের মতো চিৎকার করে উঠল, সোম—নন্দিতা?
প্রান্তিক সোম শান্ত গলায় বলল, তাকে আনতে লোক গেছে। এতক্ষণ তোমাকে খুঁজে পেতেই—অফিসে নই, বাড়িতে নেই, শেষকালে পালিতের বাড়ির একটা চাকরের কাছ থেকে–
প্রান্তিক সোম না প্রদোষ ভৌমিকের চিরদিনের বন্ধু ছিল?
তবে অমন করে প্রদোষ ভৌমিকের ভিতরকার সবচেয়ে নরম জায়গাটায় অমন করে করাত চালাচ্ছে কেন? ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নুন লাগাচ্ছ কেন? হ্যাঁ, তাই তো লাগাচ্ছ।
নইলে বলছে কেন, তোমার বাড়ির চাকরের মুখে জানতে পারলাম, কাল রাত থেকে খায়নি। আজ বেলা দশটার সময় বেরিয়ে গেছে, না স্নান, না আহার। আশ্চর্য, একটা লাইন লিখে পর্যন্ত রেখে যায়নি।…
করাত চালাচ্ছে।
অথচ অদ্ভুত শান্ত আর মোলায়েম মুখে। ও কি ভাবছে তাতেই করাতের দাঁতটা গম্ভীর হয়ে বসবে? উত্তেজিত হলে জোরটা কমে যাবে, হাত থেকে খসে পড়বে করাতটা?
তা, শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে নাম বেরোল প্রদোষ ভৌমিকের।
বড়ো বড়ো অক্ষরে অবশ্য নয়, ছোটো ছোটো অক্ষরে।
ঘটনা ও দুর্ঘটনার কলমে ছাপা হল নামটা।
কল্য বেলা তিনটা নাগাত সময়ে আজাদ হিন্দ বাগে একটি কিশোর বালকের (১৪) মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতের নাম কৌশিক ভৌমিক। বালকের পিতা শ্রীপ্রদোষকুমার ভৌমিক একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত, অসাবধানতা বলিয়াই মনে হয়। বালকটি সেন্ট জোনস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের দিন সে স্কুলে না গিয়া শহরের দক্ষিণ প্রান্ত হইতে উত্তর প্রান্তে আসিয়াছিল কেন, এ রহস্য এখনও অজ্ঞাত। তবে স্কুল-কর্তৃপক্ষের সাক্ষ্যে জানা যায় কিছুকাল হইতেই বালকটি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকিতেছিল।
খবরটা কেউ পড়ল, কেউ পড়ল না, কারণ শহরের এই নিত্য খবরগুলোর দিকে সবাই আর নজর দেয় না।…যারা নজর দেয়, তাদের কেউ বলল, পরীক্ষায় ফেল বোধহয়। তা ছাড়া আর কি হবে? বয়েস তো চোদ্দ। কেউ কেউ বলল, আজকালকার ছেলেদের বিশ্বাস নেই, চৌদ্দতেও পাকা-পান্ন হয়। হয়তো হতাশ প্রেম হবে।
একটা ছোটো ছেলে লাইনের নীচে আঙুল দিয়ে পড়ে হেসে উঠে বলল, কৌশিক ভৌমিক। দুটো ঔকার। হি হি!
হ্যাঁ, কৌশিক।
সকলের মুখে মুখে ওই নামটাই ফিরছে। টুবলু নামের যে উজ্জ্বল ছেলেটা শহরের দক্ষিণ প্রান্তের কোনো একটা বড়োসড়ো বাড়িতে যথেচ্ছ খেলে বেড়াত, দুমদাম করত, রেডিও খুলত, রেকর্ড বাজাত, আর স্কুল থেকে ফিরে যেখানে সেখানে জুতো-জামা ছড়িয়ে বলে উঠত, মা, শীগগির—ভীষণ খিদে–সে ছেলেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। টুবলু বলে কেউ নেই। কেউ ছিল না।
কোনো একটা অতলস্পর্শ অন্ধকারের তল হতে যদি সেই অর্থহীন নামটা আর্তনাদ হয়ে আছড়ে আছড়ে এসে পড়তে চায়, কেউ তো শুনতে পাবে না সেই আর্তনাদ, শুধু যুদ্ধোন্মাদ দুটো পক্ষ তাদের জয় আর পরাজয়ের সমস্ত উত্তেজনা হারিয়ে একটা অর্থহীন শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে যাবে।