Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শুকনাঝাড়ে অর্জুন (২০১৪) || Samaresh Majumdar » Page 3

শুকনাঝাড়ে অর্জুন (২০১৪) || Samaresh Majumdar

বাড়ি ফিরে মঙ্গলময়বাবুকে দেখতে এল ওরা। ভদ্রলোক নিজের ঘরে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মুখ চোখ লাল। অর্জুন চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, ওষুধ খেয়েছেন?

এই দুর্যোগে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে যা ছিল তা খেয়েছি। মিনমিন করে বললেন ভদ্রলোক।

আপনি তো আবার হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্য ওষুধ খাবেন না।

অনেকদিনের অভ্যেস তো–!

বাধালেন কী করে?

মাথা নাড়লেন মঙ্গলময়বাবু। কারণ জানেন না। তারপর বললেন, আপনাকে ডেকে এনে কী বিপদে ফেললাম!

বিপদ আমাদের নয়, আপনার, সেটা তো এখনও কাটেনি।

হুঁ।

আপনি কি গতকাল বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন? সরাসরি প্রশ্ন করল অর্জুন।

একটু চমকে উঠলেন মঙ্গলময়বাবু। তারপর নিচু গলায় বললেন, হ্যাঁ।

ছাতি নিয়ে যাননি?

না। আমি বর্ষাতি ব্যবহার করি।

তা হলে ভিজলেন কী করে?

ভিজে গেলাম।

কিছু যদি মনে করেন, খুব প্রয়োজনে ওই বৃষ্টিতে বেরিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। খবর পেয়েছিলাম পোড়ো মন্দিরে একজন সন্ন্যাসী এসে দু’দিন ধরে আছেন। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

সেখানে আমাদের দেখেছেন?

হ্যাঁ। চোখ বন্ধ করলেন মঙ্গলময়বাবু।

ওই সন্ন্যাসীকে চিনতে পারলেন?

না। মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

অর্জুন হাত বাড়িয়ে ওঁর কপাল স্পর্শ করল। জ্বর একশো দুয়ের নীচে নয়। সে উঠে দাঁড়াল। আমার মনে হয় এখনই ক্রোসিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া দরকার। এখানে ওষুধের দোকান নেই?

আছে।

তা হলে বিনা ওষুধে থাকবেন না।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ভৃগু! সে এগিয়ে এল, বাবুর জ্বর বেড়েছে, ওদিকে স্বর্ণলতাদির খুব শরীর খারাপ হয়েছে।

সে কী! উত্তেজিত হলেও মঙ্গলময়বাবুর গলা থেকে সুস্থ স্বর বের হল । তার কী হল?

বাহ্যি হচ্ছে। কয়েকবার গিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠে ঠিক ছিল। জলখাবার খাওয়ার পর থেকেই বিছানা আর বাথরুম করছেন। ভৃগু বলল।

ওষুধ খেয়েছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

বড়বাবু তো ট্যাবলেট খাওয়া অপছন্দ করেন। মুখ নিচু করল ভৃগু।

দোলগোবিন্দবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, আমি তো ব্যাচেলার মানুষ। ছোটখাটো অসুখে পড়লে নিজের চিকিৎসা নিজেই করি। তাই যখনই বাইরে যাই ঝুলিতে কয়েকটা ওষুধ রাখি। জ্বর এবং পেট খারাপের ওষুধ আমার সঙ্গেই রয়েছে। যদি কাজে লাগে তা হলে নিতে পারেন।

অর্জুন মঙ্গলময়বাবুর দিকে তাকাল। অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভদ্রলোক বললেন, আমি ঠিক হয়ে যাব। স্বর্ণলতাকে দিন। ও অসুস্থ হয়ে থাকলে আমার স্ত্রী খুব বিপদে পড়বে।

বিপদ তো শুরু হয়ে গিয়েছে বড়বাবু। স্বর্ণলতাদি ওঁকে জলখাবার খাইয়েছিলেন। তারপর আর ওই ঘরে যেতে পারেননি। উনি কাপড়চোপড় আর শরীরে রাখেননি। হোমিওপ্যাথি ওষুধ যা রোজ খান, তাও খাওয়ানো হয়নি।

মাথা চাপড়াতে লাগলেন মঙ্গলময়বাবু। তারপর উঠে বসতে চাইলেন, কী হবে?

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে ওঁর সেবার জন্য কোনও মহিলা পাওয়া যাবে না?

এমনিতে পাওয়া যায় না। দেখি, খোঁজ করে দেখি। ভৃগু বলল।

.

দুপুরের খাবার দেওয়ার সময় ভৃগু এক গাল হাসল, পাওয়া গিয়েছে।

বাঃ। খুব ভাল। গ্রামের কেউ? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

না। স্বামী-স্ত্রী। বলছে নদীর ধারে যে সন্ন্যাসী এসেছেন, তাঁকে দেখতে এসে জলের জন্যে আটকে গিয়েছে। কী বলব বাবু, স্বামীটা যত বেঁটে, বউটা তত লম্বা। বড়বাবুকে বলে বউটাকে দু-তিনদিনের জন্য রাখা হয়েছে। স্বর্ণলতাদি যতদিন অসুস্থ থাকবেন ততদিন ওঁর কাছ থেকে জেনে কাজ চালিয়ে নেবে। দিনপিছু দুশো টাকা নেবে। তা বড়বাবু তাতে রাজি হয়েছেন। ভৃগু বলল।

স্বর্ণলতা ওষুধ খেয়েছেন? দোলগোবিন্দবাবু প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ। খুব দুর্বল।

তোমার বড়বাবু নিশ্চয়ই ওষুধ খাননি?

না।

কী জেদি লোক! দোলগোবিন্দবাবু বললেন। তা বেঁটে স্বামীটা কোথায়?

নদীর ধারে চলে গেছে।

দুপুরের খাওয়ার পর দোলগোবিন্দবাবু যখন গড়িয়ে নিচ্ছিলেন, তখন অর্জুন বের হল। একটু ঘুরপথে জঙ্গলের আড়াল সরিয়ে সে পৌঁছে গেল ভোরবেলায় দেখা ত্রিপলের ছাউনির কাছে। পাখির ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই। বুনো ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে অর্জুন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। সেই লাল বস্ত্র পরা বৃদ্ধের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন একটা নুড়ি তুলে ছাউনির ভিতর ছুঁড়ে দিল। কিন্তু তার কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। হয় বৃদ্ধ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নয় এখানে নেই। ঠিক তখনই একটা ছোট শেয়ালকে দেখতে পেল সে। জঙ্গলের আড়াল থেকে বেরিয়ে ত্রিপলের ছাউনির ভিতরটা লক্ষ করছে। তারপর চট করে ঢুকে যেতেই অর্জুন নিঃসন্দেহ হয়ে এগিয়ে গেল। তার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এল শিয়াল, দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল জঙ্গলের ভিতরে।

বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ছাউনির ভিতরটা বেশ গোছানো। বিছানা আছে, রান্নার ব্যবস্থার সঙ্গে মদের বোতলও পড়ে আছে। একটা মাঝারি সাইজের মড়ার খুলি, মানুষের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত হাড়, দুটো লাল জামা, লুঙ্গি, দুটো বড় ব্যাগ পড়ে আছে একপাশে। মাথার উপর যেমন ত্রিপলের ছাউনি, মাটির উপরেও ত্রিপল বিছানো। এই ভয়ংকর বৃষ্টিতেও ভেতরটা তেমন ভেজেনি।

ব্যাগ দুটো খুলে দেখার কথা ভাবল অর্জুন। একটি ব্যাগের চেহারা বেশ আধুনিক। সেটা তুলতেই বোঝা গেল ভিতরে ভারী জিনিস রয়েছে। তখনই নজরে পড়ল ব্যাগের হাতল থেকে লাগেজ ট্যাগটা খোলা হয়নি। সাধারণত প্লেনে ওঠার আগে এই ধরনের ট্যাগ হ্যান্ড লাগেজের হাতলে আটকে দেওয়া হয়। ট্যাগটা এয়ার ইন্ডিয়ার। ফ্লাইট নাম্বার লেখা আছে। কিন্তু সেই ফ্লাইট কোথা থেকে কোথায় এসেছে তা অর্জুনের বোধগম্য হল না। ব্যাগটার চেনের শেষে ছোট্ট তালা ঝুলছে। ভিতরে কী আছে দেখতে চাইলে তালা ভাঙতে হবে। দ্বিতীয় ব্যাগটা সাধারণ চটের। তালা নেই। মুখ খুলতেই শাড়ি, জার্মা ইত্যাদি দেখতে পেল সে। তারপর একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের গোল বাক্স হাতে উঠে এল। বাক্সের মধ্যে খানিকটা সিঁদুর ছাড়া কিছু নেই। বাক্সটা পকেটে ভরে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ধপ করে একটা নারকোল প্রায় পায়ের কাছে এসে পড়ল। অর্জুন চোখ তুলতেই স্যাঁৎ করে অন্যগাছে সরে গেল হনুমানটা। ওটা যে এক হনুমান তাতে কোনও সন্দেহ নেই যদিও স্পষ্ট দেখা যায়নি। কিন্তু তাকে লক্ষ্য করে নারকোল ছুড়ল কেন ওই প্রাণীটা? এটা কি ওর স্বভাব? মঙ্গলময়বাবুকে লক্ষ্য করে যে নারকোল দুটো নেমে এসেছিল গাছ থেকে সেটাও কি এরই কীর্তি?

অর্জুন ঘাসের রাস্তায় চলে এল। পশু-পাখিদের ট্রেনিং দিয়ে অপরাধ করার এমন ঘটনার কথা সে বইয়ে পড়েছে। কিন্তু ওই হনুমানটাকে ট্রেনিং দেওয়ার সময় পেল কী করে? ত্রিপলের ছাউনির নীচে যারা আস্তানা গেড়েছে তারা তো বাইরে থেকে এসেছে। ট্রেনিং দেওয়ার সময় পেল কী করে!

ক্রমশ বাগান ছাড়িয়ে এলে দূরে নদী দেখতে পেল অর্জুন। তখনই তার মনে পড়ল লাল পোশাক পরা বৃদ্ধ লোকটি বামনকে জিজ্ঞাসা করেছিল নৌকো এনেছে কি না! তা হলে কি বৃদ্ধ সেই নৌকোয় চেপে কোথাও গিয়েছে? দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে নদীর জল তীব্র বেগে বয়ে যাচ্ছে। এপাশের মাঠের অনেকটাই এখন নদীর কবলে। এরকম নদীতে সচরাচর কেউ নৌকো চালায় না। তা ছাড়া বামনের ডিঙিকে তো নৌকো বলা যায় না।

হঠাৎ ডানদিকের পাড় ধরে ডিঙিটাকে আসতে দেখল অর্জুন। দুটো লোক বসে আছে। একজনের হাতে বইঠা। বাগানের যেদিকটা নদীর কাছাকাছি সেই দিকে এসে ডিঙি থামল। দু’জনেই ডিঙি থেকে নামল। তারপর একটা গাছের গায়ে ডিঙিটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধল। তারপর বামন একটা বোঝা মাথার উপর তুলে সামনে হাঁটতে শুরু করল। পিছনে লাল পোশাক পরা বৃদ্ধ ডানহাতে ব্যাগ বাঁ হাতে লম্বা চিমটি জাতীয় কিছু নিয়ে ধীরে ধীরে বাগানের দিকে এগিয়ে আসছিল। অর্জুন দ্রুত যতটা সম্ভব আড়ালে চলে গেল। সে মাথার উপর তাকিয়ে দেখল এদিকে কোনও নারকোল গাছ নেই।

মাত্র দশ হাত দূর দিয়ে ওরা বাগানে ঢুকল। ঢুকেই বৃদ্ধ সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাল। বামন আচমকা হাঁক দিল। ব্যোম কালী। বৃদ্ধ ধমকাল, অ্যাই, চোপ।

নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করল অজুর্ন। ত্রিপলের ছাউনির কাছে এসে বৃদ্ধ বলল, যা। গিয়ে খোঁজ নিয়ে আয়, সব ঠিক আছে কি না। পই পই করে সব শিখিয়ে দিয়েছি। তবু মেয়েমানুষ বলে কথা। যা।

কিছু খেয়ে নিলে হত না? বামন উবু হয়ে বসল।

যজ্ঞ শেষ হওয়ার আগে খাওয়ার কথা ভুলে যাও।

যজ্ঞ তো আপনি করবেন। আমি সারাদিন ধরে এই জল ভেঙে সবকিছু জোগাড় করে দিয়েছি কিন্তু আমি তো যজ্ঞ করব না, খুব খিদে পেয়েছে। মাইরি।

আঃ ওইসব শব্দ ব্যবহার করতে কতবার নিষেধ করেছি তোমাকে? আমার অবাধ্য হলে ওই হনুমানটাকে গাছ থেকে নামিয়ে তোমাকে গাছে পাঠিয়ে দেব। বেশ রেগে কথাগুলো বলল বৃদ্ধ। বামন ঘনঘন হাত জোড় করে মাথা নোয়াতে লাগল। তাই দেখে বৃদ্ধ একটু নরম হল। হতভাগা, বললাম খবর নিয়ে আয়। ওই বাড়িতে গেলে কি কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দেবে?

সকাল থেকে কিছু খাইনি। করুণ গলায় বলল বামন।

ওরে পাগল! সকাল আর বিকেলের মধ্যে যে অনেক তফাত। যা।

বামনকে চলে যেতে দেখল অর্জুন। বৃদ্ধ আকাশের দিকে তাকাল। সামান্য মেঘ থাকলেও এখনই বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। বৃদ্ধ ত্রিপলের ছাউনির নীচে ঢুকে গেল। তারপরই চাপা গলায় তাকে বলতে শুনল, কে ঢুকেছিল এখানে? কে সে? মনে হচ্ছে শিবার গন্ধ পাচ্ছি। হুম। তার একটু পরে সংস্কৃত মন্ত্র অদ্ভুত স্বরে উচ্চারণ করতে লাগল বৃদ্ধ। বিকৃত সুরের মতো যার একটি শব্দও বুঝতে পারছিল না অর্জুন। সে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঘাসের রাস্তায়।

দূর থেকে দেখা গেল বামন ভৃগুর সঙ্গে কথা বলছে। ভৃগু মাথা নাড়ছে। অর্জুন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, মঙ্গলময়বাবু কেমন আছেন?

আগের থেকে জ্বর একটু কমেছে। এখন ঘুমোচ্ছেন। ভৃগু বলল।

আর স্বর্ণলতা দেবী?

তিনি তো বিছানা থেকে উঠতেই পারছেন না। তবে পেটের ব্যথা বোধহয় আগের মতো নেই।

ইনি কে?

আজ্ঞে, আপনার সঙ্গে নদীর পাড়ে দেখা হয়েছিল, আমি ষষ্ঠী। বামন হাতজোড় করে নমস্কার জানাল।

ভৃগু বলল, এর বউ স্বর্ণলতাদিদির জায়গায় কাজে লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে বামন বেশ কড়া গলায় বলে উঠল, এ কীরকম কাজ ভাই? আমাকে আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছ না?

কী করে দেব? আপনি বলুন বাবু। বউ এখন কাজে ব্যস্ত। এখন ওকে কি নীচে ডেকে আনা যায়? ভৃগু মাথা নাড়ল।

কতক্ষণ পরে উনি দেখা করতে পারবেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

পনেরো মিনিট কি আধা ঘণ্টা। ভৃগু জবাব দিল।

বাঃ। তা হলে তো হয়েই গেল। অর্জুন ষষ্ঠীর দিকে তাকাল, আপনার তো খুব খিদে পেয়েছে। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। ভৃগুভাই, আমাদের তো চা দেবে, তার সঙ্গে ওর জন্যে কিছু খাবার এনে দাও। ততক্ষণে ষষ্ঠীবাবু আমাদের ঘরে অপেক্ষা করবেন।

অর্জুনের কথায় ঘাড় নেড়ে ষষ্ঠী জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী করে বুঝলেন আমার খিদে পেয়েছে।

আপনাকে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে। আসুন।

অর্জুন দেখল বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে ষষ্ঠী। শেষপর্যন্ত সসংকোচে ঢুকল সে। দোলগোবিন্দবাবু বাথরুমে ছিলেন, সেইসময় বেরিয়ে এলেন।

অর্জুন বলল, ষষ্ঠীবাবু, বসুন। ইনি দোলগোবিন্দবাবু।

হাতজোড় করল ষষ্ঠী। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, চেনা চেনা লাগছে। তাঁ, সেই নৌকার মাঝি। তাই তো? তা বাবা আমরা কি ভূত, দেখামাত্র পালিয়ে গেলে?

আজ্ঞে ভূত হবেন কেন? ভূতেরা তো বাবা বাছা বলে কথা কয় না। আসলে ওই নৌকায় তিনজন উঠলেই ডুবে যেত। তাই। জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসল ষষ্ঠী।

তাই? তা এখানে কী মনে করে? দোলগোবিন্দবাবু বিছানায় বসলেন।

আমি ডেকে এনেছি। ওঁর খুব খিদে পেয়েছে তো, ভৃগু খাবার আনতে গিয়েছে। অর্জুন উলটোদিকের চেয়ারে বসল, থাকা হয় কোথায়?

এই এদিক ওদিক। বাপের ভিটা আছে নিউ বনগাইগাঁওতে।

বউকে নিয়ে এদিক ওদিক থাকেন, তিনি কিছু বলেন না?

বলে না আবার! এই শুকনাঝাড় স্টেশনের ওপারে যে গ্রামটা আছে। সেখানে আছি মাস তিনেক। ফাইফরমাশ খাঁটি। কোনওমতে চলে যাচ্ছিল। এই দিন পনেরো হল আশার আলো দেখছি। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে বাকি জীবনটা নিউ বনগাইগাঁওতে ফিরে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দেব। হাসল ষষ্ঠী, বেশ আস্থার সঙ্গে।

ওই ডিঙি অথবা পানসি, ওটা কোথায় পেলে?

একজনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছি। খালের জলের যা অবস্থা, ওটা না থাকলে ওপারে যাওয়া যেত না।

ভাড়া নিতে তো টাকা দিতে হয়।

রহস্য হাসি হাসল ষষ্ঠী। চিন্তামণি আছেন, তিনি জোগাচ্ছেন।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, বাব্বা! এ তো আধ্যাত্মিক কথা বলছে।

মাথা নাড়ল অর্জুন, একদম নয়। চিন্তামণি মানে শুধু ঈশ্বর হবেন কেন? এমন মানুষও তো থাকতে পারে যিনি চিন্তা দূর করতে পারেন। কী, ঠিক কি না?

ষষ্ঠী মাথা দোলাল, ঠিক, ঠিক। কিন্তু খাবার নিয়ে আসছে না কেন?

এই এল বলে। আমরাও তো চা খাইনি। তা ষষ্ঠীবাবু, আপনি তো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান। মানুষ দেখেছেন যেমন, ভূতও তো দেখেছেন–!

কপালে হাত ঠেকাল ষষ্ঠী, এই ভরসন্ধ্যায় আর ওসব কথা বলবেন না বাবু। দিনভর ঘুমিয়ে এবার তাদের জাগরণের সময় হয়েছে যে।

ঠিক তখনই বড় ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল ভৃগু। তিন কাপ চা, প্লেটে বিস্কুট ছাড়া একটা বড় বাটিতে তেলমাখা মুড়ি আর লঙ্কা রয়েছে ট্রের উপর। মুড়ির বাটি ষষ্ঠীকে দিয়ে ভৃগু বলল, একটু পরে আসছে। বেশিক্ষণ আটকে রেখো না। দুটো কথা বলেই ছেড়ে দেবে। এমন ভাব করছ যেন নতুন বউকে এখানে রেখেছ। ভৃগু চলে গেল।

গোগ্রাসে মুড়ি খেতে লাগল ষষ্ঠী, ভাঙা লঙ্কা জিভে ঠেকিয়ে।

দোলগোবিন্দবাবু সেটা দেখে বললেন, মন্বন্তরের মানুষ নাকি!

অর্জুন বলল, তা নয়, সারাদিন কতবার নৌকো ঠেলতে হয়েছে এই তো, খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে আনতে হয়েছে জিনিসপত্র, তার ধকল নেই? খিদে তো পাবেই। কী, বলুন ষষ্ঠীবাবু!

বটেই তো। এটা পাওয়া যায় তো ওটা পাওয়া যায় না। ওপারের ভাতের হোটেলগুলো জলের জন্যে আজও বন্ধ। নইলে লালবাবা ঠিক খাওয়াতেন। ষষ্ঠী মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলল।

একেবারেই ঠিক কথা। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন কি, আপনার খিদে পায় কিন্তু লালবাবার খিদে পায় না। অর্জুন বলল।

দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন, কী যে বলো! মানুষের খিদে পায় না?

মাথা নাড়ল ষষ্ঠী। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় উনি সাধারণ মানুষ নন। খুব বড় তান্ত্রিক। ভূত প্রেত পাখি এমনকী হনুমানও ওঁর আদেশ অমান্য করতে পারে না। বলেই জিভ কাটল সে। ছি ছি, এসব কথা বলা তো নিষেধ। কথায় কথায় বলে ফেললাম। তা বাবুরা আপনারা এখানে কি কোনও কাজে এসেছেন?

আর বলবেন না ষষ্ঠীবাবু, এখানে এসে জলে ফেঁসে গেছি। খবর পেয়েছিলাম, এই বাড়ির বাগানটা মঙ্গলময়বাবু বিক্রি করতে চাইছেন। দেখেশুনে কিনব কি না ঠিক করতে এখানে এসেছিলাম। ওঁর সঙ্গে কথাও হয়েছিল কিন্তু ভদ্রলোক এমন জ্বরে পড়ে গেলেন যে ওঁর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অর্জুন খুব গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলল।

সর্বনাশ! চোখ বড় হয়ে গিয়েছিল ষষ্ঠীর। বলল, খবরদার এই ভুল করবেন না। এই যে গাছপালার জঙ্গল, যাকে আপনি বাগান বলছেন, এখানে অনেক অভিশপ্ত আত্মা বাস করেন। কিনলে ওঁরা আপনাকে ভোগ করতে দেবেন না।

দোলগোবিন্দবাবু এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। এবার মুখ খুললেন, সব গাছ কেটে সাফ করে দেব। মোটা টাকা পাওয়া যাবে। তারপর ট্রাক্টর এনে ন্যাড়া জমি চাষ করব। থাকার জায়গা না পেলে তারা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চলে যাবেন। সব প্ল্যান করা আছে।

অর্জুন দোলগোবিন্দবাবুর দিকে তাকাল। বেশ বললেন ভদ্রলোক।

যেতে পারবেন না ওঁরা। সবাই বন্দি হয়ে আছেন। আপনারা চাষ করলে ওই চাষের জমিতেই পড়ে থাকবেন যতক্ষণ না মুক্তি পাবেন।

একটু রেগে গেলেন দোলগোবিন্দবাবু। তুমি এত কথা জানলে কী করে হে?

ইস। এসব কথা বলা নিষেধ। চোখের সামনে তিনরাত দেখলাম তো, তাই পেটে রাখতে পারলাম না। কপালে দু’বার চড় মারল ষষ্ঠী।

অর্জুন দেখল বড়বাড়ি থেকে একটি স্ত্রীলোক বেরিয়ে এসে এদিকে ওদিক তাকাচ্ছে। তখনও মুড়ি শেয় হয়নি তাই ষষ্ঠী চেঁচিয়ে বলল, আমি এখানে।

আপনার পরিবার? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

আজ্ঞে। খুব ভাল মেয়ে। দ্রুত মুড়ি শেষ করতে লাগল ষষ্ঠী।

স্ত্রীলোকটি বারান্দায় উঠে এসে বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আবার কী হল? কেন এসেছ?

সব ঠিক আছে কি না জানতে এসেছি। বাটি নামিয়ে উঠে দাঁড়াল ষষ্ঠী।

আজ অবধি কোন কাজটা ঠিক করিনি? অ্যাঁ?

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

না ঠিক নেই।

এই বললে, ঠিক আছে।

আমাকে যা যা করতে বলা হয়েছে তা করেছি। কিন্তু খুব শক্ত ঠাই। আর হ্যাঁ, আমি কাল সকালে এখান থেকে চলে যেতে চাই। কথাগুলো বলে হনহনিয়ে চলে গেল স্ত্রীলোকটি।

যাচ্চলে! শব্দটা ছিটকে বের হল ষষ্ঠীর মুখ থেকে।

উনি না থাকলে তো আপনার লস। পেমেন্ট তো পার ডে হিসাবে। অর্জুন ষষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়াল।

কী বলব বলুন। এই তো বুদ্ধি! খাচ্ছে দাচ্ছে, দিনে দুশো টাকা পাবে তবু–! আচ্ছা বাবুরা, আপনারা আমার নমস্কার নেবেন! হাতজোড় করল ষষ্ঠী। তারপর বারান্দায় পা রাখল।

দোলগোবিন্দবাবু পিছন থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ও ভাই, ট্রেনের খবর পেলে?

শুনলাম কাল সকাল থেকে চালু হতে পারে।

দুর্গা। দুর্গা। তা তোমার বউ তো বলল কাল এখান থেকে চলে যাবে। সে গেলে তোমাকেও যেতে হবে। দু’জনে দিব্যি ওই পানসিতে চেপে খাল পার হতে পারবে। আমার হয়েছে মুশকিল! দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

বাবু, যাওয়া আসা কি মানুষের নিজের হাতে থাকে? এই যে বলে গেল চলে যেতে চাই। চাইলেই যদি যাওয়া যেত তা হলে তো কত কী হয়ে যেত। আপনারা পড়ালিখা মানুষ। আমার চেয়ে আপনারা অনেক বেশি বুঝবেন। চলি।

অর্জুন লোকটার পাশে হেঁটে বাগানের রাস্তায় এল, কোনদিকে যাবেন?

আজ্ঞে, রাত নামছে। নদীর পাড়ে গিয়ে আরাম করি।

লালবাবা কোথায়?

তিনি আসনে বসেছেন।

আচ্ছা, নদীর গায়ে যে পোড়ো মন্দির রয়েছে, সেখানে একজন সন্ন্যাসীকে দেখলাম। তিনিই কি লালবাবা? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

না না। তিনি তো তান্ত্রিক নন। মন্দিরঘোরা সন্ন্যাসী। বলে দ্রুত হেঁটে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল ষষ্ঠী।

অর্জুন হাসল। লোকটা মোটেই নদীর ধারে বিশ্রাম করতে যাচ্ছে না। চোখের আড়ালে গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে বাগানের পিছনে ঢুকবে। ত্রিপলের ছাউনির নীচে গিয়ে কথাগুলো উগরে না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, ষষ্ঠী এবং তার বউ যদি নিউ বনগাইগাঁও-এর বাসিন্দা হয় তা হলে ওই লালবাবার সঙ্গে যোগাযোগ হল কী করে? লালবাবার ব্যাগে প্লেনের লাগেজ ট্যাগ এখনও আটকানো আছে। এর সরল অর্থ হল, তিনি বাইরে থেকে এখানে এসেছেন। প্রশ্নটা ষষ্ঠীকে করলে ওর মনে সন্দেহ ঢুকত। কিন্তু উত্তরটা জানা দরকার। অর্জুন ফিরে এল গেস্ট হাউসে।

দোলগোবিন্দবাবু চুপচাপ বসে ছিলেন। ইতিমধ্যে ভৃগু এসে আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, সত্যি বা মিথ্যে জানি না। তবে

লোকটা যখন বলে গেল তখন ভোরের আগে ঘরের বাইরে যেয়ো না।

ভূতের ভয় পাচ্ছেন? অর্জুন হাসল।

দোলগোবিন্দবাবু জবাব দিলেন না। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, যাবেন নাকি?

দোলগোবিন্দবাবু তাকালেন। অর্জুন বলল, মঙ্গলময়বাবু এখন কেমন আছেন তা খোঁজ করে আসি। ওঁর গেস্টহাউসে আছি, ওঁরই পাঠানো খাবার খাচ্ছি, খোঁজ না নেওয়াটা অভদ্রতা হবে।

তাই বলো। বেশ চলো।

.

মঙ্গলময়বাবু চিনচিনে গলায় বললেন, আবার কষ্ট করে এলেন কেন?

অর্জুন বলল, কোনও কষ্ট হয়নি আমাদের। কেমন আছেন?

আপনাদের ওষুধে কাজ হয়েছে। জ্বর নেই বললেই চলে। তবে গায়ে হাতে পায়ে ভয়ংকর ব্যথা। উঠে বসতেই পারছি না।

ওটা দিনদুয়েক থাকবে। এখন খেতে ইচ্ছে না করলেও জোর করে খাবেন। অর্জুন কথাগুলো বলতেই চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন মঙ্গলময়বাবু। অর্জুন ওঁর মাথার কাছে মুখ নিয়ে গেলে তিনি ফিসফিস করে বললেন, আজ ঘোর অমাবস্যা। আমার খুব ভয় হচ্ছে।

কেন?

বাঁ হাত নাচছে, সেই সঙ্গে বাঁ চোখ। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ রেখেছি, তবু–। আমি বলি কী, আজকের রাতটা আপনারা এ বাড়ির দোতলার ঘরেই থেকে যান। গেস্টহাউসে থাকার দরকার নেই। খুব নিচু গলায় বললেন ভদ্রলোক।

বেশ, আপনি যা চাইছেন তাই হবে। অর্জুন বলল।

থ্যাঙ্ক ইউ।

স্বর্ণলতা দেবী কেমন আছেন?

দুপুরে বেশ ভাল ছিল বলে শুনলাম। আবার তার পেটব্যথা শুরু হয়েছে। কী যে সব হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।

আপনার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে তাঁকে একবার দেখতে পারি?

মঙ্গলময়বাবু দূরে দাঁড়ানো ভৃগুকে ডাকলেন, কালোর মাকে বললো এঁদের নিয়ে স্বর্ণলতার ঘরে যেতে।

ভৃগু এই বাড়ির একটি বৃদ্ধা দাসীকে ডেকে আনল। তার পিছন পিছন ওরা যে ঘরে ঢুকল সেখানে বড় সাইজের হারিকেন জ্বলছে। বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে স্বর্ণলতা।

দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, শুনলাম ওষুধ খেয়ে ভাল ছিলে, আবার পেটের ব্যথা শুরু হল কেন মা?

জানি না। প্রায় সাদা মুখ স্বর্ণলতার।

কী খেয়েছিলে দুপুরে? জিজ্ঞাসা করলেন দোলগোবিন্দবাবু।

নুনচিনির জল। গলা থেকে স্বর কোনওরকমে বের হল।

টেবিলে একটা গ্লাসে শরবত জাতীয় তরল পদার্থ পোস্টকার্ড চাপা হয়ে আছে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ওটা খেয়ে তো পেটে ব্যথা হওয়া উচিত নয়।

অর্জুন গ্লাস তুলে চোখের সামনে আনল। জল পরিষ্কার। নুন এবং চিনি জলে যদি গুলে যায় তা হলেও নীচে কিছুটা পড়ে থাকে। সেটা ভাল করে দেখতে গিয়ে কালচে গুঁড়ো চোখে পড়ল। এই ঘরে কোনও বেসিন নেই। অর্জুন জানলার পাশে গিয়ে সন্তর্পণে জল বাইরে ফেলতে লাগল। একেবারে তলানিতে এসে সে বাঁ হাতে জলটুকু ঢেলে ভাল করে দেখে বুঝল ওটা ওষুধের অবশিষ্ট নয়, অন্য কিছু জলে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দোলগোবিন্দবাবু ততক্ষণে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে?

মাথা নাড়ল স্বর্ণলতা, জানি না।

অর্জুন বিছানার পাশে চলে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই নুনচিনির জল কে দিয়েছিল?

একটু দূরে দাঁড়ানো দাসী বলল, আমি।

তুমি নিজে নুনচিনি মিশিয়েছিলে?

না। নতুন দিদি তৈরি করে দিয়েছিল। দাসী জবাব দিল।

অর্জুন দোলগোবিন্দের দিকে তাকাল, আপনার কাছে অ্যান্টাসিড আছে?

হ্যাঁ। দিশি জিনিস। জোয়ানের ফুল।

সেটা কী?

দারুণ পাওয়ারফুল। অল্প একটু জলে গুলে খেলে পেটের সমস্যা উধাও হয়ে যায়। সমস্যা মানে অ্যাসিডিটির ব্যাপারগুলো–।

আপনি যদি কষ্ট করে নিয়ে এসে ওঁকে খাইয়ে দেন তা হলে কষ্টটা অনেক কমে যাবে। অর্জুন দাসীর দিকে তাকাল, এই গ্লাস ভাল করে ধুয়ে আধাআধি জল নিয়ে এসো।

দোলগোবিন্দবাবু এবং দাসী একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে অর্জুন বলল, চিন্তা করবেন না। কালকেই আপনি ভাল হয়ে যাবেন।

ভাল হওয়ামাত্রই আমি এখান থেকে চলে যাব।

কেন? এই বাড়িতে তো আপনি অনেকদিন আছেন। ভাল না লাগলে নিশ্চয়ই থাকতেন না। অর্জুন হাসল।

স্বর্ণলতা কোনও কথা না বলে চোখ বন্ধ করল।

আপনি তো চব্বিশঘণ্টা মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন, ওঁর মুখে দুটো কথা বের হতে না হতেই উনি খেই হারিয়ে ফেলেন। বাকিটা আপনি বুঝতে পারেন?

চেষ্টা করি।

আচ্ছা, উনি আপনাকে কখনও একজন সন্ন্যাসীর কথা বলেছেন?

হ্যাঁ।

কী বলেছেন?

দুটো কথা। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক। ব্যস ওইটুকু।

স্বর্ণলতার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। অর্জুন আর কথা বাড়াল না। কিন্তু ষষ্ঠীর বউ এই কাজটা কেন করল? আজ সকালে এই বাড়িতে ঢুকেই স্বর্ণলতাকে আরও অসুস্থ করার দায়িত্ব তাকে কে দিল? স্বর্ণলতা অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকলে ষষ্ঠীর বউয়ের কী লাভ হবে? বোঝাই যাচ্ছে সে অন্যের নির্দেশে কাজটা করেছে। আর সেই অন্য লোকটি যে লালবাবা তাতে এখন কোনও সন্দেহ নেই। ষষ্ঠীকে লালবাবা খবর নেওয়ার জন্যে জোর করেছিল কারণ তার স্বার্থ ছিল। কী সেই স্বার্থ?

জল নিয়ে এল দাসী। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তুমি নিজে জল ভরেছ?

হ্যাঁ বাবু।

দোলগোবিন্দবাবু একটা ছোট্ট কৌটো নিয়ে এলেন। অর্জুন আলতো করে এক ঢোক জল খেয়ে গ্লাস এগিয়ে দিল নিন।

কৌটোর ভিতর থেকে মিছরির মতো দেখতে দুই-তিনটি পদার্থ জলে ফেলে দিলেন দোলগোবিন্দবাবু। এই হল জোয়ানের ফুল। পুরীতে পাওয়া যায়। এক গ্লাস জলে মিশিয়ে দিলেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। খেয়ে নাও মা।

স্বর্ণলতার ঘর থেকে বের হতেই ভৃগুকে দেখতে পেল ওরা। অর্জুন বলল, ভৃগু, মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ভৃগু ইতস্তত করল। তারপর বলল, একটু দাঁড়ান।

সে চোখের আড়ালে চলে যেতেই দোলগোবিন্দবাবু বললেন, মনিব ছাড়া কারও কথা ও শুনবে না। খুব ভাল।

ফিরে এসে ভৃগু বলল, আসুন।

দরজা বন্ধ ছিল। একবার টোকা দিয়ে সেটা খুলল ভৃগু।

কে? ষষ্ঠীর বউ এগিয়ে এল। ওদের দেখে একটু থতমত হয়ে বলল, ও। কোনও দরকার আছে?

ভৃগু বলল, বাবুরা একটু দেখা করবেন।

ষষ্ঠীর বউ বলল, উনি তো এখন কথা বলতে পারছেন না।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, জানি। একটা-দুটোর বেশি উনি বলতে পারেন না।

এখন দেখছি সেটাও বলতে পারছেন না। চুপচাপ শুয়ে আছেন কিন্তু ঘুমাচ্ছেন না। আমি অনেকবার ডেকেছি, সাড়াই দিচ্ছেন না। ষষ্ঠীর বউ বলল।

অর্জুন স্ত্রীলোকটিকে ভাল করে দেখল। যখন নীচে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তার চেয়ে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে। চুল পরিপাটি করে বাঁধা, চোখে কাজল, ঠোঁটে রং। বয়স যেন অনেক কমে গিয়েছে।

হঠাৎ ভৃগু জিজ্ঞাসা করল, এটা কি তোমার শাড়ি?

পরনের শাড়ির আঁচল ধরে হাসল ষষ্ঠীর বউ। দেখলাম আলমারিতে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে তাই একটু পরে নিলাম। ব্যাটাছেলেরা যে শাড়ি চেনে তা জানতাম না।

অর্জুন এগিয়ে গেল খাটের দিকে। ভদ্রমহিলা পাশ ফিরে শুয়ে আছেন, চোখ ভোলা। সে জিজ্ঞাসা করল, শরীর খারাপ লাগছে?

মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

হাত বাড়িয়ে ওঁর কবজি তুলে পাল্স পরীক্ষা করতে গিয়ে অর্জুন বুঝল গতি খুব দ্রুত। শরীরও বেশ গরম। সে ঘুরে দাঁড়াল। আপনি নিশ্চয়ই খালি হাতে এখানে আসেননি। ব্যাগ সঙ্গে ছিল তো?

কেন? কী দরকার? ষষ্ঠীর বউয়ের চোখ ছোট হল।

ভৃগু ঘরের কোণের টেবিলের দিকে আঙুল তুলল, ওটা ওর ব্যাগ।

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে টেবিলের সামনে পৌঁছে ব্যাগটাকে আড়াল করে দাঁড়াল। কে আপনারা? মেয়েছেলের ব্যাগে হাত দিতে নেই তা জানেন না?

কী আছে ওই ব্যাগে যে দেখাতে ভয় পাচ্ছেন? অর্জুন বলল।

ভয় পাব কেন? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি যে ভয় পাব।

তা হলে ব্যাগের সব জিনিস টেবিলের উপর রাখুন।

এবার ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরল ষষ্ঠীর বউ। না, রাখব না।

অর্জুন এগিয়ে গেল ওর সামনে। শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, এই কাজটা করার জন্যে লালবাবা আপনাকে কত টাকা দেবে বলেছে?

কেউ আমাকে কিছু দিতে চায়নি।

তা হলে স্বর্ণলতার নুন চিনির জলে যেটা মিশিয়েছিলেন, সেটা কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন?

আমি কিছু মেশাইনি।

এই ভদ্রমহিলাকে কী খাইয়েছেন?

আমাকে এসব কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

কারণ কাজটা আপনি করেছেন। আপনি এই বাড়িতে ঢোকার আগে স্বর্ণলতার পেট খারাপ হয়েছিল। সেটা কীভাবে করা হয়েছিল তা এখনও বুঝতে পারছি না। কিন্তু আপনি তো ধরা পড়ে গেছেন। অর্জুন বলল।

হঠাৎ ষষ্ঠীর বউ মেঝের উপর বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢাকল।

অর্জুন তার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ওই তান্ত্রিক লালবাবাকে কতদিন ধরে চেনেন? নিশ্চয়ই আগে পরিচয় ছিল? তাই না?

হ্যাঁ। আমার মা ওকে চিনত। আমি তখন ছোট ছিলাম। মা ওকে খুব ভয় পেত। বলত, তান্ত্রিকরা সবকিছু করতে পারে। ষষ্ঠীর বউয়ের গলায় কান্না।

আপনার মা কী করে ওকে চিনতেন? অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

কী করে চিনত জানি না। তবে ওই লোককে আমাদের বাড়িতে কয়েকবার আসতে দেখেছি। আমার বাবা-মা ওকে খুব খাতির করত।

তারপর?

তিন মাস আগে উনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। আমাদের অবস্থা দেখে ওঁর কষ্ট হয়। কথা দেন আমাদের অবস্থা ফিরিয়ে দেবেন। তার কিছুদিন পরে আমার স্বামীকে শুকনাঝাড়ে এসে থাকতে বলেন। আমার স্বামীরে কিছু টাকাও দেন তিনি। সে ওঁর খুব ভক্ত হয়ে যায় মাথা নাড়ল ষষ্ঠীর বউ, আমি এই কাজটা করতে চাইনি। উনি ভয় দেখালেন যদি না করি তা হলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, আর করলে সারা জীবন আরাম করে থাকতে পারব। আমার স্বামী জোর করল খুউব। আবার কাঁদতে লাগল ষষ্ঠীর বউ। আমি চলে যেতে চাই, আর থাকব না।

এই ভদ্রমহিলাকে আপনি কী খাইয়ে দিয়েছিলেন?

লালবাবা বলেছেন, উনি যেহেতু কথা বলতে পারেন না, তাই মাঝে মাঝে সিঁদুর মাখা ওষুধ খাইয়ে দিলে উনি আবার কথা বলতে পারবেন।

সবটাই খাইয়ে দিয়েছেন না কিছু থেকে গিয়েছে?

কিছু নেই।

আপনি সত্যি কথা বলুন।

বড় চোখে তাকাল ষষ্ঠীর বউ, কিছু বলল না।

আপনার লালবাবা আর কী করতে বলেছেন?

আমি বলতে পারব না, পারব না। দু’দিকে মাথা দোলাতে লাগল ষষ্ঠীর বউ। সেই সঙ্গে তার ফোঁপানি চলছিল সমানে।

অর্জুন চলে এল দোলগোন্দিবাবুর কাছে। তারপর নিচু গলায় বলল, আজ রাতে আমাকে এখানে থাকতে হবে।

এখানে মহিলারা থাকেন। তুমি কী করে থাকবে?

এখন আর মেয়ে-পুরুষের ভাগাভাগি করে লাভ নেই। আমার সন্দেহ হচ্ছে আজ রাতে এ ঘরে কিছু ঘটবে। সেই কারণেই থাকা উচিত। আপনি গেস্টহাউসের ঘরের দরজা জানালা ভাল করে বন্ধ রেখে শোবেন। অর্জুন বলল।

আমি একা থাকব?

সেটাই জরুরি। চলুন।

.

ভৃগু রাতের খাওয়া দিয়ে গেল। অর্জুন বলল, একটু দেরি হবে খেতে, তুমি খানিক পরে এসে থালা-বাসন নিয়ে যেয়ো।

একটু ইতস্তত করে ঘাড় নেড়ে ভৃগু চলে গেল।

জানলাগুলো বন্ধ করতে করতে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আবার বৃষ্টি শুরু হল। বাইরের অন্ধকারটা যেন আজ আরও কালো লাগছে।

অমাবস্যার রাত বলে কথা। অর্জুন অন্যমনস্ক গলায় বলল।

কিন্তু ভাই, আমাকে একা এ ঘরে রেখে যাচ্ছ কেন?

আপনি একা থাকলে কী অসুবিধে হতে পারে?

অসুবিধের আবার কী! ওই। একা থাকব ভাবলেই যাক গে ঘরে আলো জ্বেলে রাখব। ভূত প্রেত নিয়ে চিন্তা করছি না। দোলগোবিন্দবাবু কথাগুলো বলামাত্রই একটা নারকোল বারান্দা থেকে ছিটকে ঘরের দরজায় এসে থামল। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে তুলে নিয়ে বলল, আপনার জন্যে এসে গেল।

আমার জন্যে মানে? কোত্থেকে এল?

যাদের নিয়ে চিন্তা করছেন না তারাই চিন্তা করার জন্যে পাঠাল হয়তো। সদ্য ছেঁড়া হয়েছে। নিন। নারকোল বাড়িয়ে ধরল অর্জুন।

না ভাই, দরকার নেই। ওটা বাইরে ফেলে দাও। হাত নাড়লেন দোলগোবিন্দবাবু। তারপর একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, আমি সঙ্গে থাকলে তোমার কি খুব অসুবিধে হত? এখন অবধি হয়েছে বলে মনে হয় না।

সুবিধে হয়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক সুবিধে হবে আপনি যদি এই ঘরে আরাম করে ঘুমোন। আমি চাইছি সবাই জানুক আমরা রাতে ঘরে আছি। আপনি ঘুমোলে তা বাইরে থেকে জানা যাবে। অর্জুন হাসল।

খোঁচাটা হজম করলেন দোলগোবিন্দবাবু। বললেন, বেশ, সবাই জানবে আমরা ঘরে আছি, ঘুমোচ্ছি। তাতে লাভ কী হবে?

পরে বলব। আসুন, খাওয়া যাক। অর্জুন হাত বাড়াল।

খুব দ্রুত খাবার শেষ করে বাথরুমে গেল অর্জুন। তারপর বেরিয়ে এসে বলল, ভৃগু না জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলবেন না। আর যদি জিজ্ঞাসা করে তা হলে বলবেন টয়লেটে আছি। ওকে তাড়াতাড়ি কাটিয়ে দেবেন। চলি।

দোলগোবিন্দবাবুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল অর্জুন। দ্রুত অন্ধকারে একটা আড়াল আন্দাজ করে দাঁড়িয়ে গেল। এখান থেকে বড় বাড়ির ঢোকার দরজাটা একদম কাছাকাছি। মিনিট চারেক পরে বড় বাড়ির দরজা খুলে গেল। বোঝা গেল ভৃগু বেরিয়ে গেস্টহাউসের দিকে যাচ্ছে। দ্রুত বড় বাড়িতে ঢুকে গেল অর্জুন। তারপর সোজা দোতলায় উঠে পা টিপে টিপে মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর ঘরের দরজায় চলে এল। ভিতরে আলো জ্বলছে। সে উঁকি মারল। ষষ্ঠীর বউ মাটিতে বাবু হয়ে বসে আছে দরজার দিকে পিছন ফিরে। বোঝা গেল, সে ভাত খাচ্ছে। কান্নাকাটি করলে অনেকের খিদে বেড়ে যায়। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল অর্জুন। তারপর বিরাট আলমারি দুটোর পিছনে চলে গেল। একটা মানুষ কোনওমতে দাঁড়াতে পারে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ওখানে স্কুল এবং মাকড়শার জাল ছড়িয়ে থাকায় স্বস্তি পাচ্ছিল না অর্জুন।

ষষ্ঠীর বউয়ের খাওয়া শেষ হলে সে থালা গ্লাস নিয়ে বাইরে চলে গেল। আড়াল থেকে অর্জুন দেখল মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রী সেই একই ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। তার কিছুই করার ছিল না। মঙ্গলময়বাবুকে বললেও তিনি ডাক্তার জোগাড় করতে পারতেন না। ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হত না।

ষষ্ঠীর বউ ফিরে এসে দরজা বন্ধ করল। তারপর মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর পাশে গিয়ে দু’বার ডাকল, এই যে, শুনছেন? তারপর নাকের নীচে আঙুল নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে হাসল। যার অর্থ, মানুষটা বেঁচে আছে।

হারিকেনের আলো অনেকটা কমিয়ে ষষ্ঠীর বউ মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর পায়ের দিকে গিয়ে বসল। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধে হচ্ছিল অর্জুনের। তার উপর একটা নেংটি ইঁদুর জ্বালাতন শুরু করেছে। জুতোর তলায় সেটাকে চেপে মারার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। খুব চটপটে নেংটিটা। এই বাড়ির কোথাও ঘড়িতে আওয়াজ হল। মোবাইলে টাওয়ার। নেই। কিন্তু সেটা বের করে সময় দেখল অর্জুন। রাত সাড়ে এগারোটা। বাড়ির ভিতরে কোনও শব্দ নেই। শব্দ হচ্ছে বাইরের বাগানে গাছে। বৃষ্টির শব্দ, সেই সঙ্গে হাওয়ার দাপটে গাছের ডালের ঘষটানির আওয়াজ। একটা বাজ পড়ল। কাছাকাছি।

হঠাৎ মনে হল কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। ছোট ছোট দুটো শব্দের পর একটা বড় শব্দ। তিরিশ সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার। অর্জুন দেখল ষষ্ঠীর বউ তড়াক করে উঠে ডানদিকে চলে গেল। সেখানে একটা বড় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতল। তৃতীয়বার টোকা পড়তেই সে দরজাটা বেশ কষ্ট করে খুলল। বোঝা যাচ্ছিল ইদানীং দরজাটা ব্যবহার করা হয় না। ভিতরে ঢুকে গেল ষষ্ঠীর বউ, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ষষ্ঠীর বউয়ের পিছন পিছন যে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে একটুও অবাক হল না অর্জুন। সন্ধের সময় এই বাড়িতে এসে স্বর্ণলতা এবং মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর অবস্থা দেখে আর ষষ্ঠীর বউয়ের কথা শোনার পর তার স্থির ধারণা হয়েছিল, লালবাবা আজ রাতে দেখা দেবেনই। কিন্তু তিনি কোন পথে আসবেন সে ব্যাপারে ধন্দ ছিল। বাড়িতে ঢোকার সদর দরজা অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার তার মনে হল যে দরজা দিয়ে ওরা ঢুকল সেখানে নিশ্চয়ই পরিত্যক্ত টয়লেট রয়েছে। সেই টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য যাতে জমাদার আসতে পারে তাই ওপাশে সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখা আছে। আগেকার দিনে ঘরের ভিতর দিয়ে জমাদারের যাতায়াত পছন্দ ছিল না অনেকের।

লালবাবা বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও তার হাতে ধরা ব্যাগটিতে বোধহয় জল ঢোকেনি। চারপাশ তাকিয়ে নিয়ে লালবাবা জিজ্ঞাসা করল, সব ঠিক আছে?

মিনমিন গলায় ষষ্ঠীর বউ জবাব দিল। হ্যাঁ।

লালবাবা আবার যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সেই দরজা দিয়ে আড়ালে চলে গেল। মিনিট পনেরোর মধ্যে শুকনো লাল ধুতি আর ফতুয়া পরে ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরে এসে মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে খানিকক্ষণ কিছু লক্ষ করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কতটা খাইয়েছিলে?

যতটা বলেছেন। ষষ্ঠীর বউ জবাব দিল।

হুম। তারপর আর কথা বলছে না, তাই তো?

হ্যাঁ?

কথা বলছে না বলে কেউ সন্দেহ করেনি?

ঢোক গিলল ষষ্ঠীর বউ। তারপর বলল, না।

গুড। খুশি হয়ে ব্যাগ থেকে নানা ধরনের জিনিস বের করে ঘরের মেঝেতে রাখল লালবাবা। তারপর একটা আসন পেতে বসে পড়ল। ব্যাগের জিনিসপত্র সামনে সাজাতে লাগল যত্ন করে। অর্জুন দেখল একটা মড়ার খুলি, একটা সাঁড়াশি, কতগুলো শেকড়, কতগুলো কাঠের টুকরো। সেগুলো প্লাস্টিকের ব্যাগে আনা বালির উপর চিতার মতো সাজাল। সবশেষে সেই। সিঁদুরের কৌটোটাকে দেখতে পেল অর্জুন। গোছানো হয়ে গেলে লালবাবা বলল, মাথার ওপাশের জানলা খুলে দাও।

জল আসবে। ষষ্ঠীর বউ আপত্তি জানাল।

যা বলছি তাই করো। ওই খোলা জানলা দিয়ে সে আসবে।

জানলা খুলেই সরে এল ষষ্ঠীর বউ। বৃষ্টির ছাঁট আসছে।

এবার তুমি এখান থেকে যাও। লালবাবা হুকুম করল।

কোথায় যাব?

অ। ঠিক আছে। আমি যে ঘর দিয়ে ঢুকলাম সেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার এখানে থাকার কোনও দরকার নেই।

ষষ্ঠীর বউ ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে গেলে লালবাবা পদ্মাসনে বসল। ধূপ জ্বেলে মড়ার খুলির গায়ে জবাফুল রাখল। তারপর টুকরো কাঠের উপরে তরল পদার্থ ঢেলে দেশলাই কাঠি জ্বেলে আগুন ছোঁয়াল। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে আগুনের শিখা উপরে উঠল। লালবাবা সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। অর্জুন দেখল যখনই লালবাবা। মন্ত্র বলছে, তখনই আগুনের শিখা ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে, আবার উচ্চারণ থামালেই শিখা নেমে আসছে। এবার মড়ার খুলির গায়ে অনেকটা সিঁদুর বুলিয়ে দিল লালবাবা। তারপর সাঁড়াশির মুখে শেকড় নিয়ে আগুনের উপর রেখে মন্ত্র পড়তে লাগল। শেকড় পুড়ে কালো হয়ে গেলে সেটা মড়ার খুলির উপর রেখে আগুনের উপর ধরে খানিকটা মন্ত্র পড়ে উঠে দাঁড়াল লালবাবা। মন্ত্র পড়তে পড়তে মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর মুখের কাছে খুলিটা নিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড খুলি ধরে রেখে চাপা গলায় হুংকার ছাড়ল লালবাবা, খুলে যা, খুলে যা, খুলে যা। বলা শেষ হতেই খুলি ঘষতে লাগল ভদ্রমহিলার গলায়, মুখে। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেল।

বেশ কয়েকবার একই পদ্ধতি চালাবার পর মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীর গলা থেকে শব্দ বের হল, আঃ। তারপর ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ছটফট করে শেষ পর্যন্ত স্থির হলেন। লালবাবা জিজ্ঞাসা করল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?

হ্যাঁ। খুব দুর্বল কণ্ঠস্বর ভদ্রমহিলার।

উঠে বস।

ভদ্রমহিলা চেষ্টা করলেন কিন্তু উঠে বসতে পারলেন না।

চেষ্টা কর। তোর মনের দরজার তালা খুলে দিয়েছি। মহাশক্তি তোর মনে যে তথ্য বন্দি করে রেখেছিলেন আজ তার মুক্তির সময় হয়েছে। মুখ খোল, বড় হা কর। হ্যাঁ, এবার জোরে জোরে বল, জয় মা মহাশক্তি।

মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রী বললেন, জয় মা মহাশক্তি।

বলমাত্র মড়ার খুলি নিয়ে লালবাবা ছুটে গেল খোলা জানলার পাশে, খুলিটাকে জানলার বাইরে নিয়ে গিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড় জোরালো হল। বৃষ্টির শব্দ বেড়ে গেল।

লালবাবা বাগানের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে উল্লসিত গলায় বারংবার বলতে লাগল, যাঃ। আজ থেকে তোরাও মুক্ত হয়ে গেলি। আর এই বাগানে তোদের থাকার দরকার নেই।

লালবাবা ফিরে এল খাটের কাছে। তারপর বেশ আবদারের গলায় জিজ্ঞাসা করল, বল কী কথা শুনেছিলি মহাশক্তির কাছে?

আমার কিছুই মনে পড়ছে না। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসলেন ভদ্রমহিলা।

অবশ্যই মনে পড়বে। কোথায় রয়েছে কোটি টাকার ধনরত্ন, বাগানের কোন গাছের নীচে পোঁতা আছে, মনে করে বল।

বিশ্বাস করুন, কিছুই মনে পড়ছে না।

আঃ। হয় তুই মিথ্যে বলছিস, নয় মনে করার চেষ্টা করছিস না। ঠিক আছে, মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমি তখন বন্ধ ঘরে বসে হোমের আগুন জ্বেলেছিলাম। তুই আমার সামনে এসে বসলি। মনে পড়ছে?

মাথায় ঘোমটা টানলেন মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রী, মাথা নাড়লেন।

যখন হোমের আগুন অনেক উঁচুতে উঠেছিল তখন মহাশক্তি আমার জিভে ভর করে যা উচ্চারণ করেছিলেন তা তোমার মনে বন্দি হয়ে ছিল এতদিন। আমার জিভ উচ্চারণ করেছিল বটে কিন্তু আমি শুনতে পাইনি। কী ছিল সেই কথাগুলো? উত্তর দাও নইলে তোমার সবর্নাশ হয়ে যাবে।

আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না! কেঁদে ফেললেন মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রী।

অর্জুন আর অপেক্ষা করল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল আলমারির পিছন থেকে। তারপর সাঁড়াশিটা তুলে আঘাত করল লালবাবার ঘাড়ে। অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেল লালবাবা। সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠলেন ভদ্রমহিলা। লালবাবা উঠে বসার চেষ্টা করলে অর্জুন এবার হাত দিয়ে তাকে আঘাত করল। জ্ঞান হারাল লালবাবা।

ততক্ষণে বাইরের দরজায় শব্দ হল। ভৃগুর গলা শোনা যাচ্ছে। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল ভৃগুর পিছনে মঙ্গলময়বাবু এবং কাজের লোকেরা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

অর্জুন বলল, আসুন মঙ্গলময়বাবু। আপনি এখন বিপদমুক্ত!

আপনি এখানে? আমার স্ত্রী–?

উনি ভাল আছেন। কথা বলতে পারছেন। এসে দেখুন।

মঙ্গলময়বাবু তার দুর্বল শরীর নিয়ে কোনওমতে ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী? এ কে?

অর্জুন লালবাবাকে চিত করে দিতেই মঙ্গলমবাবু বললেন, একী! সন্ন্যাসীকাকা!

অর্জুন বলল, আপনি ওকে একেবারেই চিনতে পারলেন! তা হলে ওর চেহারার পরিবর্তন হয়নি?

তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু উনি এখানে এলেন কী করে? মেঝেতেই বা পড়ে আছেন কেন? মঙ্গলময়বাবু কোনওরকমে স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন কথাগুলো বলতে বলতে।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে টয়লেটের দরজা খুলে বলল, আর ওখানে থাকতে হবে না। ঘরে এসো।

ষষ্ঠীর বউকে ঘরে ঢুকতে দেখে ভৃগু বলল, একী! ও এখানে কেন?

অর্জুন বলল, মঙ্গলময়বাবু, আমি যেটুকু শুনেছি তাতে মনে হয় আপনি এখন বিপদমুক্ত আর আপনার স্ত্রীও কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছেন। ম্যাডাম, আমি অর্জুন, আপনার স্বামীর অতিথি। এখন কেমন বোধ করছেন?

একটু ভাল। খুব আস্তে কথা বললেন ভদ্রমহিলা।

তুমি কথা বলতে পারছ? চিৎকার করলেন মঙ্গলময়বাবু।

হ্যাঁ।

মঙ্গলময়বাবু আবেগে স্ত্রীর হাত আঁকড়ে ধরলেন।

অর্জুন বলল, এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আপনারা সবাই বিশ্রাম করুন। কাল সকালে কথা বলা যাবে। আর হ্যাঁ, আপনার কাকাকে নিয়ে কী করবেন?

আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! মঙ্গলময়বাবু বললেন।

আপনার প্রাণনাশের যে আশঙ্কা করেছিলেন তার পিছনে ছিলেন এই তান্ত্রিক। জানি না কোন তন্ত্রমন্ত্রে উনি আপনার স্ত্রীর বা রোধ করেছিলেন। আজ এখানে এসে তন্ত্রসাধনা করে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়েছিলেন।

কেন?

ওঁর ধারণা, এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার আগে উনি যে তন্ত্রসাধনা করেছিলেন তার ফল হিসাবে মহাশক্তি আপনার স্ত্রীর মনে একটা তথ্য দিয়েছেন। সেই তথ্য হল, এই বাড়ির কোনও গাছের নীচে বহুমূল্য ধনরত্ন লুকিয়ে রাখা আছে দীর্ঘকাল ধরে। তখনই হয়তো অনুসন্ধান করা সম্ভব ছিল না বলে আপনার কাকা ওই তথ্য ওঁর মনে বন্দি করে রেখেছিলেন যার ফলে উনি একটি দুটির পরে আর কথা বলতে পারতেন না। ওঁর মস্তিষ্কও অচল হয়ে যেত। সেই তথ্য উদ্ধার করার জন্যে আজ তান্ত্রিক এসেছিলেন। টাকার লোভ দেখিয়ে ষষ্টী এবং তার বউকে সঙ্গী করেছিলেন। স্বামীর চাপে রাজি হলেও ষষ্ঠীর বউ এসব মেনে নিতে পারছিল না। আপনার কাকার উদ্দেশ্য ছিল তথ্য জেনে নিয়ে আজ রাতেই ধনরত্ন উদ্ধার করে এখান থেকে ষষ্ঠীর নৌকোয় হাওয়া হয়ে যাবেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অর্জুন কথা শেষ করে লালবাবাকে টেনে বসিয়ে দিল।

ভয়ংকর ব্যাপার। ওঁকে পুলিশে দেব। ভৃগু, ওঁকে একটা ঘরে আটকে রেখে দাও। ভৃগুর দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলেন মঙ্গলময়বাবু।

পুলিশে দিতে পারেন কিন্তু উনি বেল পেয়ে যাবেন। অর্জুন বলল।

সে কী! কী করে? মঙ্গলময়বাবু অবাক হলেন।

উনি এমন অপরাধ করেছেন যার কোনও প্রমাণ নেই। ওঁর এইসব তান্ত্রিক কার্যকলাপ আদালত বিশ্বাস করবে না। তবে হ্যাঁ, ষষ্ঠী এবং তার বউ যদি ওঁর পরিকল্পনার কাহিনি ফাঁস করে দেয় তা হলে কয়েক মাস জেলে কাটাতে হতে পারে। অর্জুন ষষ্ঠীর বউয়ের দিকে তাকাল। কী? তুমি পুলিশকে সব কথা খুলে বলবে?।

মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ষষ্ঠীর বউ বলল, আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।

তোমার ইচ্ছে হলেই চলে যাবে তা আর হয় না। তুমি স্বর্ণলতার গ্লাসে পেটের যন্ত্রণা যাতে হয় তার ওষুধ মিশিয়েছ, মঙ্গলময়বাবুর স্ত্রীকে লালবাবার নির্দেশ মেনে অসুস্থ করেছ, এটুকু প্রমাণ করা যাবে। হত্যার চেষ্টা করার অপরাধে বেশ কয়েকবছর জেলে থাকতে হতে পারে। অর্জুন হাসল।

আঁচল মুখে চেপে কেঁদে উঠল ষষ্ঠীর বউ, বিশ্বাস করুন, আমি এসব করতে চাইনি। লোভ দেখিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে বলে করতে বাধ্য হয়েছি। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি এখনই এখান থেকে চলে যাব।

কী করে যাবে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

ওর সঙ্গে নৌকোয় চলে যাব।

ওকে কোথায় পাবে?

বাগানে।

ষষ্ঠীর বউ কথাটা বলতেই মঙ্গলময়বাবু বললেন, বাগানে? বাগানে থাকছে কী করে?

ত্রিপলের ছাউনিতে আপনার কাকা ডেরা বেঁধেছেন। এখন বলুন, ষষ্ঠীর বউকে নিয়ে কী করতে চান?

কী করব বুঝতে পারছি না।

আমি বলি কী, ষষ্ঠীর বউকে ছেড়ে দিন। ও না থাকলে আমার পক্ষে আপনার এই কাকাকে ধরা সম্ভব হত না। আর আপনার স্ত্রীও কথা ফিরে পেতেন না। যেখানে যেতে চাইছে চলে যাক ও। অর্জুন বলল।

ঠিক আছে। দূর হও সামনে থেকে।

ষষ্ঠীর বউ নীচে নেমে গেল বৃষ্টির মধ্যেই। ভৃগু অন্য কাজের লোকদের সাহায্য নিয়ে লালবাবাকে পাশের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। অর্জুন সেই দরজায় তালা দিতে বললে ভৃগু ইতস্তত করে তালা ঝোলাল।

অর্জুন বলল, এবার আপনারা বিশ্রাম নিন। বৃষ্টি পড়ছে, নিশ্চয়ই আরামে ঘুম হবে।

.

ঘুম ভাঙতেই অর্জুন দেখল দোলগোবিন্দবাবু জানলাগুলো খুলছেন। বাইরে ঝকঝকে রোদ। বাথরুম থেকে ফিরে আসার পর ভৃগু চা নিয়ে এল। এবং তার পিছনে এলেন মঙ্গলময়বাবু। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, বাঃ, আপনি তো দেখছি সুস্থ হয়ে গেছেন?

মঙ্গলময়বাবু হালসেন, অর্জুনবাবুর সৌজন্যে।

আচ্ছা! দোলগোবিন্দবাবু বললেন, কী হয়েছিল? আমি কিছুই জানি না।

মঙ্গলময়বাবুর মুখে সব শুনে চোখ বড় হয়ে গেল দোলগোবিন্দবাবুর।

বললেন, এ কী কাণ্ড! আপনার কাকা এত বড় অন্যায় করলেন। তিনি তো এখনও ঘরে আটকে আছেন। একবার দেখতে পারি?

সরি। আজ ভোরে আমার লোকেরা ওকে ট্রেনে তুলে দিয়েছে।

অ্যাঁ। ট্রেন! ট্রেন চালু হয়েছে? দোলগোবিন্দবাবু উৎফুল্ল।

হ্যাঁ। খালের জলও অনেক কমে গেছে।

বাঁচালেন মশাই। কিন্তু কাকা যদি আবার ফিরে আসেন?

আসবেন না। মুক্তির বিনিময়ে ওঁকে অন্যায় স্বীকার করতে হয়েছে যা আমি রেকর্ড করে রেখেছি।

চা খাওয়া শেষ হলে অর্জুন বলল, তা হলে এবার আমরা যেতে পারি।

আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। কিন্তু জিনিসপত্র মানে তো একটা থলি।

তা থেকে তো অনেক কিছু বের হল। দু’জন লোককে সঙ্গে দিলেন মঙ্গলময়বাবু। বললেন, এদিকে এলে অবশ্যই আসবেন এখানে। আর এটা রাখুন।

অর্জুন খামটা নিল। নিয়ে বলল, একটা ধন্দ এখনও আছে আমার, ভৃগু, এদিকে এসো।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃগু কাছে এলে সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, স্বর্ণলতা কী খেয়েছিল যে হঠাৎ ওর পেট খারাপ হয়েছিল তাই ষষ্ঠীর বউকে এই বাড়িতে আনতে হল?

হকচকিয়ে গেল ভৃগু। বলল, আমি জানি না।

জানো, কিন্তু স্বীকার করবে না। অর্জুন হাসল।

তার মানে? অবাক হয়ে অর্জুনের দিকে তাকালেন মঙ্গলময়বাবু।

অর্জুন বলল, প্রমাণ নেই। তাই ভৃগু বেনিফিট অফ ডাউট পেয়ে গেল। কিন্তু আপনি সতর্ক থাকবেন। আচ্ছা নমস্কার।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, নমস্কার।

উত্তর দেওয়ার কথা ভুলে মঙ্গলময়বাবু ক্রুদ্ধ চোখে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃগুর দিকে তাকালেন।

.ট্রেন এল দেরিতে। প্রায় খালি কামরা। গাড়ি চললে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, বেশ কাটল।

কাল রাতে ভূত দেখেছিলেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

কী করে দেখব। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে!

কিন্তু দোলগোবিন্দবাবু।

হাত তুলে অর্জুনকে থামালেন ভদ্রলোক, ভাই অর্জুন, আমার নাম দোলগোবিন্দবাবু নয়।

অর্জুন হাসল, না হোক, আমার কাছে আপনি দোলগোবিন্দবাবু। ব্যস।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress