Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শান্তিজল || Samaresh Majumdar

শান্তিজল || Samaresh Majumdar

তার সুটকেসটা নেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে অনুপ বলল, দে।

না-না ঠিক আছে। কুড়ি বছরের ছোটভাই দাদার সুটকেস বইতে চাইবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু পিতৃবিয়োগের বিজ্ঞাপন শরীরে ধারণ করে থাকলে তাকে কাজটা করতে দেওয়া যায় না।

মা কেমন আছে? অমিতাভ জিজ্ঞাসা করল।

এই সময় যেরকম থাকা উচিত। অনুপ নিচুগলায় বলল।

রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সময় অমিতাভ লক্ষ করল সবাই অনুপের দিকে তাকাচ্ছে। একজন কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কেন?

অনুপ চলতে-চলতে জবাব দিল, বাবা।

যেহেতু অমিতাভর পরনে শার্ট-প্যান্ট, পায়ে জুতো তাই তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। শোকগ্রস্ত মানুষকে সহানুভূতি দেখানোর জন্যে যতটা নয়, তার চেয়ে কৌতূহলের কারণেই সবাই অনুপকে দেখছে বলে মনে হল অমিতাভর। সে এই শহর ছেড়েছে বহু বছর। বছরে এক-আধবার আসে। বাবা-মায়ের কাছে। বন্ধুবান্ধবরা এখন আর এখানে নেই। তাই যে কদিন থাকে বাড়িতেই থাকে। নতুন মানুষের পক্ষে তাকে চেনার কথা নয়। কিন্তু এখন মনে হল যিনি মারা গিয়েছেন তিনি কেবলই অনুপের বাবা ছিলেন।

রিকশায় বসল ওরা। অনেক বছর পরে, শেষ কবে মনে নেই, এইভাবে পাশাপাশি রিকশায় বসা। রিকশা চলতে শুরু করলে অমিতাভ চারপাশে তাকাল। অনেক নতুন বাড়ি উঠছে, দু-পাশে আধুনিক দোকান হয়েছে।

অনুপ বলল, আমরা রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম।

হুঁ। কিন্তু খবর যখন পেয়েছিলাম তখন কোনও ফ্লাইট নেই। সন্ধের ট্রেন ধরলেও পরের দিন এই সময় পৌঁছতাম। অমিতাভ বলল।

সেটা ভেবেই বডি রাখা হল না। অনুপ বলল।

বডি? অবাক হল অমিতাভ।

বাবার শরীর। শেষ সময়ে তোর খোঁজ করেছিল খুব।

অমিতাভ মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাবার মৃত্যুসংবাদ টেলিফোনে পেয়ে কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে বসেছিল। আজ বিকেল তিনটে। ছশো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মৃত বাবার কাছে পৌঁছতে গেলে বারো ঘণ্টা সময় লাগবে। এই মফসসল শহরে ততটা সময় মৃতশরীর ঠিকঠাক রাখা সম্ভব নয়। তাই দিন-চারেক পর সে এল। দাহের পরের দিন এলে যা হত আজ আসায় তা থেকে অনেক ভালো হয়েছে। কাজকর্ম গুছিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বাবার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে তার একটুও কান্না। পায়নি। একফোঁটা জল চোখ থেকে বেরিয়ে আসেনি। শুধু চারপাশ ফাঁকা লাগছিল, খুব ফাঁকা। অথচ এই মানুষটার সঙ্গে তার অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। উনি তাকে যতটা অপছন্দ করতেন ঠিক। ততটাই পছন্দ করতেন। নিজের বন্ধুদের কাছে ছেলের প্রশংসা করতেন আবার সামনাসামনি হলে ওঁর গাম্ভীর্য ছিল দেখার মতো। ইংরেজি অনার্স ছেড়ে আর্ট কলেজে ভরতি হওয়ার খবর। পেয়ে এমন খেপে গিয়েছিলেন যে একমাস টাকা পাঠাননি। শেষে মায়ের চেষ্টায় একটু নরম হন। সেসময় ছুটিতে বাড়ি এলে কথা বলতেন না। তারপর যখন নামী কাগজে চাকরি পেল সে, শেষপর্যন্ত আর্ট ডিরেক্টর হয়ে গেল, তখন টেলিফোনে বলেছিলেন, জীবন নিয়ে যারা জুয়া খেলে তাদের অধিকাংশই ফতুর হয়ে যায়। তুমি জিতেছ যখন জয়টাকে ধরে রেখো। এই বাবা মারা যাওয়ার আগে তার খোঁজ করছিলেন কেন? কিছু কি বলার ছিল তাঁর? ভদ্রলোক সারাজীবন তার সঙ্গে এত দূরত্ব রেখে গেলেন কেন? আগেকার বাবারা কেন এমন হতেন?

গেটের সামনে রিকশা থামতেই বারান্দায় অতনুকে দেখতে পেল অমিতাভ। টুকুনের স্বামী। তাকে দেখে ঘোষণা করল, দাদা এসে গিয়েছে।

ভাড়া মিটিয়ে সুটকেস নিয়ে বাগানে পা রাখল অমিতাভ। অনুপ গেট বন্ধ করছে। এই সময় টুকুন ছুটে এল। পরনে সাদা শাড়ি। তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা, চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। সুটকেস বারান্দায় রেখে বোনের কাঁধে হাত রাখতেই টুকুন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। খুব ছেলেবেলায় সে যখন কলেজের ছুটিতে বাড়ি আসত তখন তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরত টুকুন। সে কত বছর আগে। শোক মানুষদের আচমকা কাছে এনে দেয়।

অমিতাভ বলল, কাঁদিস না।

আমি বাবার শেষ সময়ে থাকতে পারিনি। টুকুন কান্নাজড়ানো গলায় বলল, খবর পেয়ে এসে দেখলাম বাবা ঘুমিয়ে আছে।

অতনু বলল, সকালেও ফোনে কথা হয়েছিল। তখন বুঝতে পারিনি। আপনি বসুন, অতদূর থেকে এসেছেন।

মা কোথায়?

ততক্ষণে কান্না সামলে নিয়েছে টুকুন। বলল, ঠাকুরঘরে।

এক মুহূর্ত ভাবল অমিতাভ। এ বাড়িতে কেউ বাইরের পোশাক পরে ঠাকুরঘরে ঢোকে না। শৈশব থেকে এই ব্যবস্থায় সে অভ্যস্ত। তার ওপরে সে সারারাত এই পোশাকে ট্রেনে চেপে এসেছে।

এই বাড়িতে এলে বরাবরই একটি বিশেষ ঘরে অমিতাভ থাকে। ঘরটাকে এখন দাদার ঘর বলে সবাই। সেখানেই গেল সে। শার্ট-প্যান্ট খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরল। তারপর ঠাকুরঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজা ভেজানো। সেটা খুলতেই মাকে দেখতে পেল সে। ঘরের মাঝখানে ঠাকুরের আসনের দিকে মাথা করে কম্বলের ওপর শুয়ে আছে মা। চোখ বন্ধ।

শোওয়ার ভঙ্গিতে এমন একটা অসহায়তা ফুটে উঠেছিল যা দেখে অমিতাভ কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। মাকে সে কখনই এইরকম ভঙ্গিতে পড়ে থাকতে দ্যাখেনি। সে মায়ের পাশে এসে বসল। গায়ে হাত রাখল। মায়ের চোখ বন্ধ। সেই অবস্থায় ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এলি?

হুঁ শব্দ করা ছাড়া কোনও জবাব খুঁজে পেল না অমিতাভ।

মা নিশ্চয়ই টুকুনের গলা শুনতে পেয়েছেন। অথবা টুকুনের স্বামীর চিৎকার ওঁর কানে গিয়েছে। তাই জেনেছেন যে সে বাড়িতে এসেছে। এতদিন পরে শুধু স্পর্শে মানুষ চেনা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়।

হঠাৎ মায়ের শরীর কাঁপতে লাগল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা থরথরানি। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন যাতে শব্দ না বের হয়। অমিতাভ বৃদ্ধার শরীর দু-হাতে জড়িয়ে ধরল। এবং তখনই মনে পড়ল, মা তার থেকে ষোলো বছরের বড়। মায়ের বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে, এক বছর পরে প্রথম ছেলের মা হয়েছিলেন। কিন্তু প্রসবের পরে এমন অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তিনমাস সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেননি।

ধীরে-ধীরে কাঁপুনি কমল। শান্ত হতে আরও কয়েক মিনিট। এতটা সময় ধরে মাকে জড়িয়ে সে কি কোনওদিন বসেছিল? অমিতাভর মনে পড়ে না।

মা উঠে বসলেন। আঁচলে চোখ মুছলেন। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাতমুখ ধো, চা খা।

এই সময় মেজভাই অনলের গলা পাওয়া গেল, দাদা কোথায়?

অতনুর গলা শোনা গেল, মায়ের ঘরে।

মা বললেন, অনল ঠাকুরমশাইয়ের কাছে গিয়েছিল।

তখনই অনলকে দরজায় দেখা গেল, যাক, তুই এসে গিয়েছিস।

অমিতাভ দেখল অনলও অনুপের মতো কাছা ধারণ করেছে। মায়ের শরীর থেকে হাত সরাল অমিতাভ।

অনল বলল, তুই পাঞ্জাবি ছেড়ে ফেল। আমি এইসব তোর ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কেন? অমিতাভ জিজ্ঞাসা করল।

কেন মানে? বাবা মারা গিয়েছেন, এখন অশৌচ, এসব পরতে হয়। তুই জেনেশুনে প্রশ্ন করছিস? অনল বিস্মিত।

ওগুলো না পরলে কি শোক দেখানো যাবে না?

লোকে কি শোক দেখানোর জন্যে পরে?

কেন পরে আমি জানি না। তবে তোর বা অনুপের চেয়ে আমার মনে বাবার মৃত্যু কম কষ্ট এনে দেয়নি। অমিতাভ বলল।

মা হাত তুললেন, থাক। ও তো মুখাগ্নির সময় এখানে ছিল না। ওর যদি ওসব পরতে ইচ্ছে না করে পরার দরকার নেই।

অনল কাঁধ নাচাল। এই শহরের বিখ্যাত উকিল সে। মায়ের কথার ওপর আর কথা বাড়াতে চাইল না। বলল, ঠাকুরমশাই লিস্ট দিয়ে দিয়েছেন। শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপা হয়ে গিয়েছে। তুমি একটু সময় দিলে ভালো হয় মা।

মা মাথা নাড়তেই অনল চলে গেল।

অমিতাভ বলল, ও আমাকে ভুল বুঝল মা। শুধু পরতে হয় বলে ওসব পরব কেন? আগে তো এক মাসের পর শ্রাদ্ধ হত, এখন হয়? বিয়ের দিন বর-কনেকে নির্জলা উপোস করতে হত, এখন কেউ করে?

মা চুপ করে থাকলেন।

অমিতাভ বলল, আমি মেনে নিতে পারি না। তবে তুমি যদি বলো তাহলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি মেনে নেব। তোমার জন্যে মানতে হবে।

মা মাথা নাড়লেন। ছেলের হাতে হাত রেখে বললেন, তোর যেটা ভালো লাগে তাই তুই কর। যা, হাত-পা ধুয়ে নে।

দুই ভাই হবিষ্যি করেছে। গোত্ৰান্তরিত হওয়ার সুবাদে টুকুন তিনদিনে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিয়েছে। একই বাবা-মায়ের পুরুষ-সন্তান আর নারী-সন্তানের মধ্যে শোকের বা শ্রদ্ধার এই। হেরফের হবে কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত। তুলে লাভ হবে না বলে মুখ খুলল না অমিতাভ। অমিতাভ সাদামাটা নিরামিষ খেল অতনুর সঙ্গে।

দুপুরে মায়ের ঘরে বসে অনল লিস্ট তৈরি করেছিল। শ্রাদ্ধের কার্ড যাদের পাঠাতে হবে তাদের নামের লিস্ট। মায়ের জানা নাম লিখে নিয়ে সে অমিতাভর দিকে তাকাল, দাদা, তুই কাকে কাকে বলবি, বল।

আমার কাউকে বলার নেই। অমিতাভ বলল।

তো, শ্বশুরবাড়িতে তো পাঠাতে হবে।

ওঁরা জানেন। পাঠাবার দরকার নেই।

বন্ধুবান্ধব?

আশ্চর্য। বন্ধুরা কলকাতায় থাকে, খামোকা পাঠাতে যাব কেন?

অনল বলল, আসলে এটা একটা নোটিফিকেশন। সবাই জানতে পারবে বাবা আর ইহজগতে নেই। সেই জন্যেই–।

এটা আমাদের শাস্ত্রে লেখা আছে নাকি?

না। তবে এটা একটা রীতি, প্রথা।

আমার দরকার নেই। বিয়ের আগে নেমতন্ন করার সময় বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কটা কার্ড আমার দরকার। একই ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না? হাসল অমিতাভ।

এই সময় টুকুন দৌড়ে এল বারান্দা থেকে, কমলকাকু আসছে।

অনল বলল, সর্বনাশ।

সর্বনাশ কেন? অমিতাভ জিজ্ঞাসা করল।

ছিদ্রসন্ধানী মানুষ। তোকে এই অবস্থায় দেখলে শহরময় কেচ্ছা করে বেড়াবে। দাদা, প্লিজ, তুই ঘরে চলে যা।অনল বলল।

অনুপ এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। বলল, দাদা মিছিমিছি সমস্যা তৈরি করে কী লাভ? আমরা মেনে নিয়েছি বলে তো বাইরের লোক মানবে না।

অতনু বলল, কথাটা ঠিক।

বাইরে থেকে ভদ্রলোকের গলা ভেসে এল, কই হে তোমরা? অনল!

অমিতাভ মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের মুখে অস্বস্তি। তর্ক করা যেত। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারত কিন্তু তা না করে অমিতাভ উঠল। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।

ভেজানো দরজা সত্বেও কমলকাকুর গলা শোনা যাচ্ছিল, ও, তোমরা সব এক জায়গায়? কার্ড লেখা হচ্ছে বুঝি। ভালো। আমি কয়েকটা নাম দিয়ে দেব। কিন্তু বউদি, বড়ছেলে কোথায়? বাবা মারা গেল আর সে এখনও কলকাতায় বসে আছে? এ তো ভালো কথা নয়।

কলকাতায় থাকবে কেন? ও এসেছে। মায়ের গলা।

এসেছে। বাঃ। কোথায় সে? একবার ডাক।

অনল বলল, দাদা বেরিয়েছে।

অ। হ্যাঁ, নামগুলো লেখ। এদের দাদা খুব পছন্দ করতেন। আর হ্যাঁ, শ্মশানযাত্রীদের তো বলবেই, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকেও নেমন্তন্ন করে এসো। লেখো–।

অমিতাভ খাটে শুয়ে পড়ল। কলকাতায় তার পরিচিত মানুষগুলো যারা মুসলমান বা খ্রিস্টান নয়, তাদের কাউকেই রোজ পুজো করতে অথবা ধর্মাচরণ করতে দেখা যায় না। তাদের অনেকেই। দুর্গাপুজোর সময় বাইরে বেড়াতে যায়। কলকাতায় থাকলে মণ্ডপে না গিয়ে বাড়িতে ফুর্তি করে। ধর্মের সঙ্গে তাদের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে ঠাকুরদেবতার ছবি নেই। অথচ বাবা-মা মারা গেলেই গালে দাড়ি রেখে পায়ে হাওয়াই পরে কাছা নেয়। শ্রাদ্ধ চুকতে -চুকতে ভাইভাই-এর বিরুদ্ধে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে মামলা ঠুকতে উকিলের কাছে দৌড়য়। অথচ এরা হিন্দু। বারোশো বছর আগে যখন বাঙালি বলে কোনও জাত ছিল না তখন আমাদের পূর্বপুরুষের কি ধর্ম ছিল? আর্যরা তো বঙ্গভূমিতে আসেনি। অদ্ভুত ব্যাপার!

বাড়িতে এখন উৎসবের আবহাওয়া। আত্মীয়স্বজনরা এসে গেছে। এসে প্রথম কয়েক মিনিট শোক-শোক মুখ করে থেকেছে। তারপর এ-ওর খবর নেওয়া, মাকে জ্ঞান দেওয়া–মাসিমা,। আপনি কিন্তু মাছ-মাংস ছাড়বেন না। ওসব ছাড়ার কথা কোনও শাস্ত্রে লেখা নেই। মাসিমা,। মেলোমশাই কী-কী খেতে ভালোবাসতেন বলুন, শ্রাদ্ধের মেনুতে রাখতে হবে। ও টুকুন, তুই কী সুন্দর হয়েছিস রে। বাচ্চা না হওয়ায় ফিগার রাখতে পারছিস। আমি তো–।

ছোটপিসি এসে বললেন, একি তুই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছিস? বাপের শ্রাদ্ধ করবি না।

অমিতাভ বলল, শ্রদ্ধা করব।

ইয়ার্কি নাকি। ও বউদি তোমার বড়ছেলের হাতের জল না পেলে দাদা শান্তি পাবে? ও কি সিনেমাস্টার, যে ম্লেচ্ছ হয়ে আছে?

মা বললেন, বোধহয় ওর শরীর খারাপ। প্রেশার তো আছেই।

ঘর থেকে বের হতে না চাইলেও সবাই তার ঘরে আসতে লাগল। ছোটমামা এসে বলল, আরে ছাড়, আজকাল পুরুতকে মূল্য ধরে দিলে সবকিছু করা যায়। তবে দাড়িটা কাটিস না। ও হ্যাঁ, আমার বড় শালার ছেলে জার্নালিজম পড়ছে। তোদের কাগজে একটু দেখিস।

বাড়িটা ক্রমশ উৎসবের বাড়ি হয়ে গেল। সবসময় হইহই। এক রাত্রে মাকে একটু একা পেয়ে। গেল অমিতাভ। বাবার ছবি বড় করে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছে অনুপ। অল্প বয়সের ছবি। মা একা দেখছিল। অমিতাভ সেদিকে তাকিয়ে বলল, বাবা কেন যে আমার সঙ্গে দূরত্ব রাখত।

মা বললেন, শুধু তোর সঙ্গে কেন, আমার সঙ্গেও।

তাই?

কখনও মনের কথা খুলে বলত না।

তুমি বলতে?

প্রথম-প্রথম বলতাম। তারপর চুপ করে থাকতাম।

কিন্তু তুমি তো বাবাকে ভালোবাসতে।

মাকে এই প্রথম হাসতে দেখল অমিতাভ, দূর! ভালোবাসা কী তা বোঝার আগেই তুই এসে গিয়েছিলি। তারপর সংসারের ঘানি টেনে চলেছি।

বাবা?

মা এবার গম্ভীর হলেন, কী জানি! এসব কথা থাক। দেখ, সবাই যা বলছে তাই দু-কান দিয়ে শুনে চলেছি। শ্রাদ্ধ যে কত রকমের হয় আগে জানতাম না। কিন্তু এত চেঁচামেচি, হুল্লোড় আমার ভালো লাগছে না। টুকুনটাকে দেখ, সারাদুপুর ওদের সঙ্গে ক্যারাম খেলে কাটাল। হয়তো এটাই ঠিক, আমি ভুল বুঝছি। জানিস খোকা, সারাজীবন আমি বোধহয় কোনও কিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না।

ঠাকুরমশাই এসে গিয়েছেন। অনলের গাড়ি গেটের বাইরে। অনল এবং অনুপকে নিয়ে ঠাকুরমশাই যাবেন শহরের পশ্চিমপ্রান্তে যেখানে বিশাল জলাশয় রয়েছে। আজ ওদের মাথার চুল বিসর্জন দিতে হবে। বারান্দায় সবাই ভিড় জমিয়েছে। বাগানেও কিছু লোক। ছোটমামা পুরো ব্যাপার পরিচালনা করছেন। ওদের গাড়িতে তুলে হাঁক দিলেন তিনি, বড়খোকা কোথায়? অমিতাভ। ডাক ওকে।

ভিড় সরিয়ে অমিতাভ সিঁড়িতে পা রাখল, কি ব্যাপার?

আগে ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞাসা কর, তোর চুল না কাটলে কত মূল্য দিতে হবে? ও ঠাকুরমশাই, বড়খোকা ন্যাড়া না হলে কত নেবেন? নিজেই প্রশ্নটা করলেন ছোটমামা।

প্রৌঢ় ঠাকুরমশাই বললেন, এসব তো এখন চালু হয়েছে শুনতে পাই। তা আমি কী বলব, যা মনে ধরে তাই দেবেন।

ঠিক তখনই কান্নাকাটি সোচ্চার হল। বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে মা মুখে হাত চেপে কান্না সামলাচ্ছেন। অমিতাভ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলেরা ন্যাড়া হতে যাচ্ছে বলেই বোধহয় মায়ের শোক ফিরে এল। সে চাপা গলায় বলল, কেঁদো না মা।

খোকা! মা জলভরা চোখে তাকাল।

হ্যাঁ, বলো। দু-হাতে মাকে জড়িয়ে ছিল অমিতাভ।

তোর কি খুব অসুবিধে হবে? ওদের সঙ্গে তুই যেতে পারবি না?

চমকে গেল অমিতাভ। এই কদিন যে ভদ্রমহিলা তার ইচ্ছেগুলোকে আগলে রেখেছেন, কারও সমালোচনায় কান দেননি, তিনি এ কী প্রস্তাব করছেন? কিন্তু সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছিল অমিতাভ। তারপর বলল, বেশ। যাচ্ছি। শুধু তোমার জন্যে যাচ্ছি।

গাড়ির দিকে এগোতে-এগোতে অমিতাভ দেখল ছোটমামা হাততালি দিচ্ছে। দর্শকদের উল্লাস চাপা নেই।

অনলের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অনুপ তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

ছেলেরা ফিরে আসতেই আবার মায়ের কান্না। কিন্তু এবার একটি কথাও না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল অমিতাভ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রায়-অচেনা একটা মানুষকে দেখতে পেল। সামান্য চুল এবং দাড়ি বিসর্জন দিতেই মানুষের এত পরিবর্তন হয়?

এই সময় টুকুন চা নিয়ে এল, জানিস দাদা, তোদের তিনজনকে এখন একরকম দেখাচ্ছে।

একরকম?

হ্যাঁ রে। সবাই বলছে। টুকুন চায়ের কাপ রেখে চলে গেল।

আজ শ্রাদ্ধ। ভোর থেকেই ঠাকুরমশাই তাঁর মণ্ডপ সাজিয়ে বসেছেন। যারা বাড়িতে ছিল তারা তো বটেই, বাইরের অতিথিরা জমতে শুরু করেছেন। অ্যাই, ওকে চা দে। না, না, একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। আরে একা কেন, গিন্নিকে নিয়ে এলেন না কেন? ও অতুলদা আপনার বড় মেয়ে?বাঃকী সুন্দর দেখতে হয়েছে?কী পড়ো গো তুমি? এইরকম সংলাপ এ বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাবার ছবি ঘিরে ফুলের মালা। সামনে ফুলের স্থূপ। বাবা সব দেখছেন।

মা বসে আছেন খানিকটা তফাতে। মোড়ায়। ঠাকুরমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, গোত্রটা কী যেন?

কাশ্যপ? তাই তো?

মা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। মায়ের পরনে শুধু সাদা আর সাদা।

অমিতাভও আসনে বসে হেসে ফেলল।

ঠাকুরমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, হাসি কেন?

মায়ের গোত্র বিয়ের পর বদলে গেল।

স্বামীর গোত্রই তো স্ত্রী-র গোত্র হবে।

আজকাল তো অনেক মেয়েই দু-তিনবার বিয়ে করে। তাহলে তাকে বারংবার গোত্র বদলাতে হবে। তাই তো?

ঠাকুরমশাই চুপ করে গেলেন। মা চোখের ইশারায় জানালেন থামতে। প্রথমে যে মুখাগ্নি করেছিল সে বসবে। অতএব অমিতাভর পালা পরে। সে একটু দূরে চলে আসতে চাইলে কমলকাকা পাশে এসে দাঁড়ালেন, বড় ভালো মানুষ ছিলেন।

কে? মুখ ফেরাল অমিতাভ।

তোমার বাবার কথা বলছি। তাস খেলতে বসে সবাই একটু-আধটু চুরি করে কিন্তু দাদা কখনই করেনি।

আপনারা কী তাস খেলতেন?

বেশিরভাগ সময় রামি। রামির নেশা ছিল ওঁর।

বাবা যে রামি খেলতেন এবং চুরি করতেন না জেনে তার কোনও লাভ নেই। তবে এখন মনে হচ্ছে বাড়ির বাইরের মানুষটা বেশ স্বাভাবিক ছিলেন।

কোনও উইল করে গিয়েছেন? কীসের উইল?

এই বাড়ি, সম্পত্তির?

আমি জানি না।

খোঁজ নাও। এই নিয়েই তো ভাই-এ ভাই-এ বিরোধ হয়।

এ ব্যাপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আপনিই বা কেন এত মাথা ঘামাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ইচ্ছে করে বের করতেই কমলকাকা দ্রুত সরে গেলেন।

ঠাকুরমশাই মন্ত্র পড়ছেন। সুরে এবং দ্রুত উচ্চারণ করা শব্দাবলি কেউ বুঝতে পারছে বলে মনে হল না। আসনে বসে ঠাকুরমশাই যা-যা করতে বলছেন তাই সে করে যাচ্ছিল। অমিতাভর মনে হচ্ছিল, এই অর্থহীন ব্যাপারগুলো শেষ হলে সে বেঁচে যাবে। হঠাৎ কানে এল ঠাকুরমশাই একটা কলাপাতায় চাল, কলা ইত্যাদি মেখে বলছেন, এই পিণ্ড ওই ফাঁকা জায়গায় রেখে এসো।

কেন?

একটা কাক এসে খাবে। একটা খেলেই হল।

আদেশ পালন করল অমিতাভ। ঠাকুরমশাই বললেন, এবার বলো।

সংস্কৃত শব্দগুলো বুঝতে দু-বার বলাল সে। তারপর মাথা নেড়ে বলল, সরি। আমার পক্ষে এই কথাগুলো বলা সম্ভব নয়।

কেন? ঠাকুরমশাই অবাক, সংস্কৃতে কী বলেছি বুঝেছ?

হ্যাঁ। আমি উঠলাম। অমিতাভ উঠে দাঁড়াল।

মা হতভম্ব।

ছোটমামা ছুটে এল, কী হয়েছে? উঠছিস কেন?কমপ্লিট হয়নি এখনও।

উনি আমাকে বলতে বলছেন, আমার বাবা এখানে প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর আত্মার শান্তির জন্যে আমি ওই পিণ্ড দান করেছি। তিনি যেন কাক হয়ে এসে তা খেয়ে নেন। আমার বাবাকে আমি প্রেত বলে ভাবতেই পারি না। ওই পিণ্ড না খেলে যদি তাঁর মুক্তি না হয় তাহলে তিনি এই বাড়িতে থেকে কারও অমঙ্গল করবেন। প্রেত তোতা অমঙ্গল করে। সরি।

সে আসন ছেড়ে ভেতরে পা বাড়াতে অনল এগিয়ে গেল, ঠিক আছে। বলুন কী করতে হবে। আমি বসছি।

শ্রাদ্ধবাড়িতে হইচই পড়ে গেল। পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহরা এতদিন যা করে এসেছেন, তাকে ভুল বলার জন্যে একদল সমালোচনা শুরু করে দিল। আর একদল, যাদের সংখ্যা কম, তারা বলল, ওই প্রেত-ফ্রেত বলতে গেলেন কেন ঠাকুরমশাই। না বললেই তো হত।

এখন ভরদুপুর। অমিতাভ চুপচাপ শুয়েছিল নিজের ঘরে, দরজা ভেজিয়ে। নিজেকে দলছুট বলে মনে হচ্ছিল অমিতাভর। শ্রাদ্ধ চুকে যাওয়ার পর ওদিকে খাওয়া-দাওয়ার উৎসব চলছে। ওই সময় মা এলেন ঘরে। এসে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। উঠে বসল অমিতাভ।

মায়ের মুখ শক্ত। ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে।

অমিতাভ উঠে দাঁড়াল, হাত বাড়াল, মা।

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলেন মা।

তুমি আমাকে ভুল বুঝো না মা। আজ তুই প্রতিবাদ করলি? এতদিন যখন করিসনি তখন আজ কেন করলি? আজ তোর ওকে প্রেত বলে স্বীকার করতে বাধল? হু-হুঁ করে কেঁদে ফেললেন মা।

মা!

মানুষ কি শুধু মরে যাওয়ার পরে প্রেত হয়? বেঁচে থাকতে হয় না, আমার মতো অনেক মেয়েই তো সারাজীবন প্রেতযন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকে। তখন অন্ধ হয়ে থাকিস।

পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল অমিতাভ।

ধীরে-ধীরে নিজেকে সামলালেন মা, আমি মরে গেলে এসব তুই করবি না।

মা!

আমি মরে গিয়ে তোর চারপাশে প্রেত হয়ে ঘুরতে পারব না রে। দু-হাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরলেন মা।

আর এই প্রথম সমস্ত শরীর নিংড়ে কান্না বেরিয়ে এল, প্রচণ্ড জোরে কেঁদে উঠল অমিতাভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress