Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শাড়ির ইতিহাস ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবী || Soumen Chakraborty

শাড়ির ইতিহাস ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবী || Soumen Chakraborty

শাড়ির ইতিহাস ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

সত্যি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হরেক পোশাকের মধ্যে শাড়ি অনন্য। শাড়ি পরিহিত কোনো রমণীর সৌন্দর্য সম্পর্কে কবির কথায়-
‘হাতে–পায়ে যতই আলতার দাগ টানো মেয়ে, জামদানিই হোক কিংবা নীলাম্বরী অথবা কেলী-কদম্ব-শাড়ি না হলে তোমার রূপ খোলতাই হবে না, পূর্ণ হবে না অভিসার অথবা প্রতীক্ষা। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে শাড়ির বর্ণনায় জসিমউদ্দিন রোমান্টিক কিন্তু বাস্তব—

‘তবুও আবার রজনী আসিল,
জামদানি শাড়িখানি
পেটেরা খুলিয়া সযতনে দুলী
অঙ্গে লইল টানি।’

শাড়ি বাঙালির পরিচয়ের সাথে মিশে আছে বাংলার অহংকার হয়ে। শুধু বাংলা বললে যদিও ঠিক হবে না। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত প্রায় সবকটি দেশেই শাড়ি পরার প্রচলন রয়েছে। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম পরিধেয় বস্ত্র এই শাড়ি, যার ব্যাবহার এবং জনপ্রিয়তা আজও আকাশ ছোয়া। আজও বিবাহের সময় হবু বধুর শাড়ির দিকে সকল নিমন্ত্রিত অতিথির নজর থাকে।

তবে প্রাচীনকালে বা বলতে গেলে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেও আমরা দেখেছি বাংলা তথা ভারতের রমণীরা শাড়ির সঙ্গে সাজুয্য রেখে অন্যান্য সহায়ক পরিধেয় তেমন ভাবে পরতেন না। পরবর্তীতে সঠিক ভাবে শাড়ি পরার বিষয়টি যিনি সর্বপ্রথম ভারতবাসী তথা বাংলার মহিলাদের সামনে তুলে ধরেন তিনি হলেন জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। ওনার কথায় আসার পূর্বে আসুন শাড়ির ইতিহাস নিয়ে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

কখন কীভাবে শাড়ি উদ্ভূত হয়েছিল সে ইতিহাস খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আবহমান বাংলার ইতিহাসে শাড়ির স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা রমণীর কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্তও শাড়িই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। তবে যুগ পরিবর্তনের ফলে নারীদের চাহিদা বদলেছে। নতুন নতুন পোশাক আবিষ্কার হয়েছে, যা বর্তমান দুরন্ত গতিতে চলতে থাকা সমাজের সঙ্গে চলনসই হয়েছে। তাই শাড়ি এখন কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে। তা সত্ত্বেও নারীদের শাড়ির প্রতি ভালোবাসা বা টানে কিন্তু ঘাটতি পড়েনি।
যুগে যুগে বদলেছে শাড়ির পাড়-আঁচল, পরার ধরন আর বুনন কৌশল। শাড়ি শব্দটির বুৎপত্তিগত উৎস সংস্কৃত “শাটী” শব্দ থেকে। ‘শাটী’ অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। ইতিহাসবিদদের মতে, সংস্কৃত ‘ সত্তিকা’ শব্দ থেকে শাড়ি শব্দটির জন্ম যার অর্থ ‘কাপড়ের টুকরা’ অর্থাৎ শাড়ি। অষ্টম শতাব্দীতেও শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। এই সেলাই রহিত অখন্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে “ধুতি” এবং মেয়েদের বেলায় “শাড়ি” নামে অভিহিত হয়। আসলে তৎকালীন সময়ে যেহেতু সেলাই করার কৌশল তেমন জানা ছিল না তাই সেলাই ছাড়া টুকরা কাপড় পরাই ছিল শাস্ত্রীয় বিধান। এ থেকেই শাড়ির প্রচলন।

সময়ের ধারাবাহিকতাতে ভারত বর্ষে মুসলমানদের আগমন আর মোঘল আমলে শাড়ি আভিজাত্যের ছোঁয়া পায়। শুরু হয় শাড়ি পরার নানান কৌশল। ক্রমে ক্রমে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানের নারীদের মধ্যে শাড়ি পরার প্রচলন দেখা যায়। মূলত শাড়ি পরার আদলে আমূল পরিবর্তন ঘটে সেলাই অর্থাৎ সিয়ান শিল্প আবিষ্কারের পর থেকে। শুধুমাত্র সেলাইবিহীন শাড়ি পরার ক্ষেত্রে নারীদের কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হতো। প্রাচীনকালে নারীর অধোবাসের একটু অংশ (বা বাড়তি অংশ) সামনে অথবা পেছনে ঝুলিয়ে রাখা হতো। যেটি থেকে পরবর্তীতে ব্লাউজ বা ঘোমটার ধারণা আসে। কালক্রমে তা-ই বক্ষাবরণের উপরে স্থাপিত হতে থাকে এবং আরও পরে অবগুণ্ঠনের প্রয়োজনে মাথায় স্থান পায়। সেলাই শিল্প আবিষ্কারের পর ব্যবহৃত হয় ব্লাউজ। কিন্তু তারও আগে ছিল সেমিজ। এতো গেল শাড়ির ইতিহাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এবারে আসবো সেই মহিয়সী রমণীর কথায়, যিনি আদতে বাঙালি নারীদের শাড়ি পরার ভুলগুলি শুধরে দিয়েছিলেন। তিনি জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর।

জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর ( ২৬ জুলাই ১৮৫০ – ১ অক্টোবর ১৯৪১) উনিশ শতকের একজন সমাজ সংস্কারক যিনি বাংলার নারীদের ক্ষমতায়ন ও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব-এর জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ওপার বাংলার যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন জ্ঞানদানন্দিনী । বাবা অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় এবং মা নিস্তারিনী দেবী। কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। খুব ছোট বয়সেই ওনার বিবাহ হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। গোঁড়া ধর্মভীরু অন্ধ সমাজ বিবাহের পর তাঁকে সমাজচ্যুত করেন। কুলীন পরিবারের মেয়ে পিরালী পরিবারের অন্তর্গত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিবাহ করায় তাদের সমাজচ্যুত করা হয়।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আধুনিক ভারতীয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনাকারী রাজা রামমোহন রায় দেখেছিলেন ,সেযুগের হিন্দু নারীরা ছিলেন অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। তাদের না ছিল কোনো সামাজিক অধিকার,না ছিল অর্থনৈতিক অধিকার। তারা সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিতা হতেন। বাড়ির ভিতরে অন্তরালে থেকে সবকিছু সহ্য করা ছিল তাদের ভবিতব্য। বাল্যকালেই তাদের বিবাহ হয়ে যেত, তারপর সারা জীবন পর্দার আড়ালে কাটাতেন । আর ঠিক এই দিকটাই পরবর্তীতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। বাইরের জগতের সঙ্গে তৎকালীন হিন্দু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের কোনো যোগাযোগ থাকতো না। এর বিরুদ্ধেই আজীবন লড়াই করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তার দেখানো পথেই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর পথচলা। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ওদের সমাজে সত্যেন্দ্রনাথ যে নারী স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ব্রিটেনে নারীরা যেমন পুরুষদের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী ,তা তিনি স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর মাধ্যমে এই দেশেও শুরু করার পক্ষপাতী ছিলেন। নিজের সহধর্মিণীর মাধ্যমে তিনি এই সংস্কার শুরুর পাশাপাশি সমস্ত হিন্দু সমাজের নারীদের মধ্যে তা সঞ্চালন করতে চেয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও এব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।


স্বামীর সঙ্গে তৎকালীন বোম্বেতে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী ইউরোপীয়দের সামাজিক বলয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং ইংরেজি আদব-কায়দা রপ্ত করতে লাগলেন। ওনাকে সর্বপ্রথম আধুনিকা বাঙালি নারীদের মধ্যে একজন বললে অত্যুক্তি হয়না। সামাজিক অবস্থানের এই পরিবর্তনের কারণে তার জন্য সঠিক ভাবে শাড়ি পড়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বাঙ্গালি কায়দায় শাড়ি পরার তখনকার প্রচলিত রীতি যা ছিল তা অনেকটাই আড়ম্বরপূর্ণ ছিল। যে পদ্ধতিতে নারীদের বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। স্বামীর সাথে গুজরাটে এক সফরে গিয়ে পারসি নারীরা যে শৌখিন কায়দায় শাড়ি পরেন,সেভাবে নিজের মত করে শাড়ি পরার কায়দা শুরু করলেন। শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। এক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল চালু করলেন। তিনিই প্রথম বাম দিকে আঁচল দিয়ে শাড়ি পড়ার ধরনটি চালু করেন। সেটা ছিল মূলত পারসি স্টাইলের বিপরীত। ডান হাত দিয়ে যেন নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনি শুরু করেন। এতদিন বাঙালি নারীদের শাড়ি পরে কাজ করতে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তার নিরসন হয়। তিনি ‘বামাবোধিনি পত্রিকা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনও করেছেন তার মত করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে। কলকাতায় তার অনুগত প্রথম দিককার ছাত্রীদের মধ্যে একজন আই. সি. এস. বিহারী লাল গুপ্তার স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা। কলকাতার ব্রাহ্ম নারীদের মধ্যে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকলো “ব্রাহ্মিকা শাড়ি” নামে। পরে এটি পরার ধরনে পরিবর্তিত হয়ে “বোম্বাই দস্তুর” এবং শেষে নাম হয় ঠাকুরবাডির শাড়ি। এছাড়াও নারীদের শাড়ির সঙ্গে অন্তর্বাস পরিধানের প্রচলনের পক্ষেও জ্ঞানদানন্দিনী সওয়াল করেন। আজও বাঙালি নারীরা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর দেখানো উপায়েই শাড়ি পরে থাকেন। তিনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে শাড়িকে সুন্দর ভাবে পরে নিজেকে সাবলীল ভঙ্গীমায় উপস্থাপন করা যায়। নিজের সমাজ সংশোধনী কর্মজীবনের পাশাপাশি এই শাড়ি পরার বিশেষ উপায় উদ্ভাবনের জন্য জ্ঞানদানন্দিনী দেবী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অন্যান্য পোশাকের পাশাপাশি শাড়ি পরতে পছন্দ করেনা এমন নারী পাওয়া আজও দুস্কর । আর কোনো অনুষ্ঠান হলে তো মেয়েদের পছন্দের তালিকায় আজও জায়গা করে নেয় নানা নামের নানা রঙের শাড়ি। শাড়ির ইতিহাসবিদ এবং স্বীকৃত বস্ত্রশিল্প পণ্ডিত রতা কাপুর চিশতি তার ‘Saris: Tradition and Beyond’ গ্রন্থে শাড়ি পরিধানের ১০৮টি পদ্ধতি নথিভুক্ত করেছেন। তবে ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক আর শোভনীয় শাড়ি এতেই বাঙালি রমণী বিশ্বজয় করে ফেরে। কাজেই শাড়ি বাঙালি নারীদের অহংকার ছিল, অহংকার আছে আর ভবিষ্যতে থাকবেও।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress